Pages

Saturday, 20 February 2021

'শিক্ষিত সন্ত্রাসবাদী'র খোঁজে

প্রধানমন্ত্রী উবাচ

নীলকন্ঠ আচার্য

 

'কিছু শিক্ষিত মানুষ সন্ত্রাস ছড়াচ্ছেন'- প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী/ বিশ্বভারতীর সমাবর্তন/ ১৯ ফেব্রু ২০২১

বিশ্বভারতীর সমাবর্তনে দিল্লি থেকে ভার্চুয়াল ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এ কথা হঠাৎ বললেন কেন? এবং এও বললেন, যে যেমন কর্ম করবেন তাঁকে সেভাবে তার ফলও পেতে হবে। বাঃ! বেশ 'সুন্দর' শাসানি তো! কিন্তু প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, সমাবর্তনের মতো এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর এরকম ক্রূর মন্তব্য কি বিশেষ কোনও বার্তা দিতে চাইছে?

উল্লেখ্য যে, এই সমাবর্তন অনুষ্ঠান একদম হঠাৎ করেই মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে তড়িঘড়ি করে আয়োজিত হয়েছে যা বিশ্বভারতীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পরিপন্থী। এ নিয়ে বিশ্বভারতীর শিক্ষক ও ছাত্রসমাজ যারপরনাই ভীষণভাবে অসন্তুষ্ট এবং ক্ষুব্ধ। ফলস্বরূপ, এই সমাবর্তনে ছাত্র বা শিক্ষক সমাজের উপস্থিতি প্রায় ছিলই না। সাধারণত বিশ্বভারতীর সমাবর্তনের জন্য প্রায় ২/৩ মাস আগে থেকেই প্রস্তুতির প্রয়োজন পড়ে। সে ক্ষেত্রে এই নির্বাচনী মুহূর্তে মাত্র ৪৮ ঘন্টার মধ্যে প্রশাসনিক বিজ্ঞপ্তি জারি করে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা এবং নরেন্দ্র মোদীর এই ধরনের ভাষণ দেওয়া নিশ্চয়ই এক অন্যতম তাৎপর্য বহন করে।

প্রশ্ন হল, নরেন্দ্র মোদী তাঁর এই ভাষণে ঠিক কী বলতে চাইলেন? কিছু শিক্ষিত মানুষ বলতে কাদের বোঝাতে চাইছেন?  তাঁদের দ্বারা ছড়ানো কোন সন্ত্রাসের (!) কথা উল্লেখ করলেন? তা কি দিল্লি সীমান্তে চলমান কৃষক আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থনে পাশে দাঁড়ানো দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় ব্যক্তি ও অ্যাক্টিভিস্টদের (যেমন, নির্ভীক সাংবাদিক, ব্লগার, দেশি বিদেশি টুইটার হ্যান্ডলার, আইনজীবী, শিল্পী ইত্যাদি) নিশানা করে? যাদের মধ্যে একাংশ বহুদিন যাবৎ এবং সাম্প্রতিক কারারুদ্ধ হয়েছেন? অথবা, উনি কি তাঁদেরকেও বোঝাতে চাইছেন- সেইসব গণতান্ত্রিক মানবতাবাদী ও  প্রগতিশীল মানুষদের- যাঁরা এই রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে কলকাতা সহ গোটা রাজ্যে সমস্বরে এক ঐকতানে জনসমাজের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টির পথে এগিয়ে চলেছেন?

'আন্দোলনজীবী', 'পরজীবী' বা 'আরবান নকশাল'-  এইসব প্রতীকি শব্দের স্রষ্টার ট্র্যাক রেকর্ড থেকে মনে হয়, উভয় ক্ষেত্রকেই এখানে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ কথা অনস্বীকার্য যে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী এই ফ্যাসিবাদী শক্তিটি চলমান অভূতপূর্ব কৃষক আন্দোলন এবং তার সমর্থনে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের সমবেত হওয়ার সামনে রাজনৈতিক ও সাংগঠনিকভাবে অনেকটাই বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে। গোটা পাঞ্জাব ও হরিয়ানা, পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, দক্ষিণ রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক ও বিহারের বহুলাংশে বিজেপি ও আরএসএস'এর অস্তিত্ব আজ ভীষণভাবে বিপন্ন। সম্প্রতি এই বাংলাতেও এই শক্তিটির নির্বাচনী জনসভায় লোকসমাগম সেভাবে আর হচ্ছে না। তাই এরা আজ ভীত। সন্ত্রস্ত। 

মনে পড়ে যাচ্ছে প্রয়াত গৌরী লঙ্কেশের কথা, ওমর খালিদের কথা, জেএনইউ, জামিয়া, এএমইউ, ডিইউ'এর ছাত্রছাত্রীদের কথা; অরুন্ধতী রায়, হর্ষ মন্দর, প্রশান্ত ভূষণ, চন্দ্রশেখর রাবণ, কানহাইয়া কুমার সহ জুলিয়ান অ্যাসেঞ্জে, এডওয়ার্ড স্নোডেন'এর কথা যাঁরা তাঁদের বাস্তবতায় এ কথা আমাদের বলেছেন যে নিষ্ঠুর শাসকেরা সবচেয়ে ভয় পায় তখনই যখন শাসিতরা তাদের আর ভয় পেতে চায় না। তাই এই চরম আগ্রাসী আরএসএস-বিজেপি'র অন্যতম প্রধান কান্ডারী আজ বিচলিত। শাহিনবাগ খ্যাত কালা নাগরিক আইন বিরোধী শান্তিপুর্ণ আন্দোলনকে চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে ও ঠান্ডা মাথায় দিল্লির বুকে মুসলমান সমাজে গণহত্যা সম্পন্ন করার মাধ্যমে সমসাময়িকভাবে থামিয়ে দিতে পারলেও এই ফ্যাসিবাদী কেন্দ্রীয় সরকার আজকের উত্তাল কৃষক আন্দোলন এবং পশ্চিমবাংলার জনসমাজের মধ্যে ক্রম সৃষ্টিরত প্রতিবাদী আন্দোলনের সামনে রাজনৈতিকভাবে স্পষ্টতই অনেকটা বেসামাল।

তাই কি এখন একমাত্র পন্থা প্রতিবাদীদের ঠান্ডা মাথায় ভয় দেখানো? শাসানো? ক্রুরতার পথে হাঁটা? রাষ্ট্রীয় হিংসার ভয় দেখানো? হতে পারে এগুলো হয়তো শাসকের ভয় দেখানোর 'ক্রোনোলজি'! ভবিষ্যৎ'ই বলবে শেষ কথা। তবে, বিগত শতাব্দীর সাম্প্রতিক ইতিহাস কিন্তু স্পষ্ট একটি বার্তা আমাদের জানিয়ে দিয়েছে: অত্যাচারীর পতন হয় আমজনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে। ভিয়েতনামের জনতার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম থেকে শুরু করে গণরোষের আগুনে পরিসমাপ্তি ঘটে যাওয়া মুসোলিনি ও হিটলারের শাসন এবং সেই সন্ধিক্ষণে এই বিশাল অবিভক্ত ভারতীয় ভূখন্ড থেকে সেই চরম শক্তিধর বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বাধ্যতামূলক ভারত ত্যাগ- এও এক ক্রোনোলজি! তবে ঐতিহাসিক ক্রোনোলজি! কি বলুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী?


No comments:

Post a Comment