খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি?
উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
National Institute of Epidemiology-র চেয়ারম্যান ও CMC Vellore-এর প্রাক্তন ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান জয়প্রকাশ মুলিইল বললেন যে R-factor-টা কমছে। এটা ফের বেড়ে যাবার কোনও সম্ভাবনা নেই।
R-factor কী? একটা মানুষ কতজনকে গড়ে সংক্রমণ ছড়াতে পারে। জানা গেল, একজন কোভিড১৯ অ্যাক্টিভ মানুষের গড় সংক্রমণ ক্ষমতা কমছে। বেশ দ্রুত হারে কমছে। তা আর বাড়ার সম্ভাবনা নেই। এই মডেলটা প্রাপ্ত হয়েছে চেন্নাই ম্যাথামেটিক্যাল ইনস্টিটিউট ও শিকাগো ইউনিভার্সিটির একটি যৌথ গবেষণায়।
R-factor তো অঙ্কের ব্যাপার! এর সঙ্গে শরীরের সম্পর্ক কী!যখন র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা কম হত তখন অসুস্থ হলেই রোগী কোভিড অ্যাক্টিভ হয়ে যেত আর মৃত্যুহার বেশি দেখাত। এখন প্রচুর পরিমাণে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষা হওয়ার ফলে মৃত্যুহার স্বাভাবিকভাবেই কম দেখাবে। এর থেকে ভাইরোলজি'র একটা প্রাথমিক স্বতঃসিদ্ধ মিলে গেল: যে ভাইরাসটির সংক্রমণ ক্ষমতা ভীষণ সেই ভাইরাসটির মারণ ক্ষমতা খুবই কম। এইবার, জনসাধারণের একটা বিপুল অংশকে সংক্রমণ করলে স্বাভাবিকভাবেই ভাইরাসের ভেক্টর বায়োলজির চরিত্রে সে অনেকটা তার সংক্রমণ ক্ষমতা খর্ব করে। ফলে, সে আরও কম ক্ষতি করার মিউটেশন ঘটায়। প্রসঙ্গত বলে রাখি, জিনের হঠাৎ পরিবর্তনকে মিউটেশন বলে ধরা হয়। ধরুন, একটা মোটা বইয়ে যা যা লেখা আছে, হুবহু আমাকে সেই বইটা দ্রুত টাইপ করে যেতে হবে। এবার টাইপিং'এ ভুল হবেই। ঠিক তেমনই একটা RNA ভাইরাসের জিনম বা জিন-ম্যাপিং করলে প্রায় পঁচিশ হাজার কো-অর্ডিনেট পয়েন্ট হয়, মানে পঁচিশ হাজার টাইপ করতে হয়। তার মানে, এই টাইপিং'এও ভুল হতেই পারে। জিন ম্যাপের এই পরিবর্তনই একটা মিউটেশন। ফলে, সামান্য হলেও তার চরিত্রগত পরিবর্তন হয়। এখন চারদিকে মানুষের শরীরে যদি আগের সংক্রমণ সেরে ওঠার পরে অ্যান্টিবডি বিকশিত হয়, স্বাভাবিকভাবেই ভাইরাসটি তাকে তার সমগোত্রীয় হোস্ট মনে করে আর আক্রমণ করতে পারবে না, অস্ত্রগুলো অকেজো হয়ে যাবে ও ধীরে ধীরে ভাইরাসটি পোষা বা পানসে অথবা কম ধারালো হয়ে উঠবে।
এখানেই আশার আলো, যে R-factor ৩'এর উপরে ছিল তা সারা ভারতবর্ষ জুড়ে ১'এর অনেক নিচে চলে এসেছে। তবে একটা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই আসে। কথাগুলো ঠিক বলছি কী? গোলাচ্ছি না তো? তাহলে কোনও সুস্থ মানুষের করোনা হলে, যার কোনও কো-মরবিডিটি নেই, তারও মৃত্যু হল- এই উদাহরণও তো আছে! হ্যাঁ আছে। সেই ক্ষেত্রে জেনে রাখুন, মৃত্যুর কারণ রোগটির জন্য ততটা নয়। ব্যবস্থার জন্যই মৃত্যু বেশি। উদাহরণ দিচ্ছি। রোগীর বয়স ৬০। কোলেস্টেরল কমার ওষুধ খান। নন-ডায়াবেটিক বা সুগারের রোগ নেই, লাইফস্টাইল ও বয়সের জন্য সামান্য প্রেশারের ওষুধ খান, হিস্ট্রি বলছে বছরখানেক আগে বুকে একটা ব্যথা হয়েছিল, তাই রক্তটা যাতে পাতলা থাকে ও কোনও করোনারি আর্টারি ব্লক না হয়ে যায় তার জন্য তাকে ইকোস্প্রিন ও ক্লোপিডোগ্রিল খেতে হয়। ইদানীং তার খুব কোমরে ব্যথা, গা গোলানো ও লো-গ্রেডেড জ্বর আসছিল। আসলে প্রস্রাব-দূষণ হচ্ছিল। পরে তলপেটের আলট্রাসোনোগ্রাফিতে ধরা পড়ল প্রস্টেট সামান্য বেড়েছে আর ইউরিনারি ব্লাডারে একটা স্যাক বা থলি হয়েছে এক্সট্রা। এটাকে বলে ইউরেটেরাসিল। জন্মগত হয়। বেশি বয়সে ধরা পড়ে বা পড়ে না। এটার চিকিৎসা সিস্টোস্কোপি করে স্যাকটাকে বের করে দেওয়া। কারণ, ঐ স্যাকের জন্য বারবার পেচ্ছাপে ইনফেকশন হচ্ছে। তাই যাওয়া হল ইউরোসার্জেনের কাছে। উনি বললেন, এটা খুব সাধারণ ব্যাপার- এখন ইউরিন ইনফেকশন তো নেই, রিপোর্ট তাই বলছে। তবু জ্বর আসছে কেন? আর একেবারে খিদে পাচ্ছে না খাচ্ছেও না কেন গত পাঁচ দিন ধরে? আর যাই হোক এটা ইউরোলজিক্যাল কারণে নয়। মেডিসিনের ডাক্তারকে দেখানো হোক। মেডিসিনের ডাক্তারই ওনার কাছে রোগীকে পাঠিয়েছিলেন।
রোগীর RT-PCR বা নাকের পিছন থেকে গলার রস নিয়ে পরীক্ষাতে নেগেটিভ এসেছে, তার মানে করোনা নেই। ডাক্তার তবুও বললেন টেস্ট রিপিট করুন। আর র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষাটাও করতে বললেন। মনে করুন আমি রোগীর বন্ধু, বললাম- র্যাপিড অ্যান্টিজেন পরীক্ষায় তো ৫০ শতাংশ ভুল পজিটিভ আসে। উনি বললেন, ভুল নেগেটিভ কম আসে, তাই। কপাল ভাল, নেগেটিভ এল। কিন্তু মারাত্মক অক্ষুধা পেশেন্টের। কথা বললেই হাঁপ ধরছে। আর খুব লো-গ্রেডেড জ্বর মাঝে মাঝে। ডাক্তার খুবই নামকরা, পিজি হাসপাতালে এক বিভাগীয় প্রধান, আমার বন্ধু মানুষ। তবুও উনি বললেন, 'না, আমি খুশি হতে পারছি না, আরও একবার RT-PCR পরীক্ষা করা হোক। এদিকে করোনার স্ট্যান্ডার্ড প্রটোকল ইতোমধ্যে চলছে- Doxycycline 100 আর Ivermectin 12। বুকের এক্স-রে'তে বাঁদিকের ফুসফুসের নিচের দিকের লোব'এ বলছে যে ফাইব্রোসিস হলেও হতে পারে। সিটি স্ক্যান করলে বোঝা যাবে। তাই আরেকবার RT-PCR পরীক্ষা হল। এবারে করোনা পজিটিভ এল। উনি বললেন, হাসপাতালে ভর্তি করে দিন।
পেশেন্ট একটু কিন্তু সুস্থ হচ্ছে। গোটা সময়টায় তার অক্সিজেন স্যাচুরেশন সব সময়ে ভাল, মানে ৯৭ শতাংশ। আমার প্রশ্ন ডাক্তারকে- হাসপাতালে ভর্তি কেন? রোগী তো ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, জ্বর কমেছে, কোমরে ব্যথা নেই, হাঁপ ওঠাটা হঠাৎ বন্ধ হয়েছে, ওষুধে কাজ দিচ্ছে, পেশেন্ট তো নিজে এখন খাবার চাইছে, অক্সিজেন স্যাচুরেশন দারুণ, প্রেশার স্বাভাবিক, সুগার (র্যান্ডম) স্বাভাবিক, লিভার ফাংশন পরীক্ষা দারুণ, ইউরিয়া ক্রিয়েটিনিন দারুণ, আর এইবারে পজিটিভটাকে ভুল পজিটিভ বলছেন না কেন? উনি বললেন, লক্ষণ বলছে করোনা হয়েছে, যদিও নাকে গন্ধ ও স্বাদ কখনও যায়নি, শুধু খিদেটাই চলে গিয়েছিল, তাই একবার পজিটিভ হলে ওটা ধরেই আমাদের এগোতে হবে।
- তো, এখন তো পেশেন্ট ভাল আছে! তাহলে?
- পেশেন্টের কো-মরবিডিটিটা একটু বেশি তো, কখন আবার খারাপ হয়ে যায় তাই হাসপাতালে ভর্তি হওয়া জরুরি।
আমি আর প্রশ্ন বাড়ালাম না। বন্ধুগণ শুনে রাখুন, এটা ভেক্টর বায়োলজির বিষয়। ভাইরাল লোড বলে একটা কথা আছে। সেটা RT-PCR পজিটিভ হলে CT value-টা দেখায়, ওটা দেখে নেবেন। CT value-টা কী? Cyclic Threshold বা সিটি। এটা হল, মেশিনটা যদি কম বার ঘুরিয়েই ভাইরাসটি প্রতীয়মান হয় বা ভাইরাসটির সন্ধান মেলে তখন সহজেই ভাইরাসটিকে খুঁজে পাওয়া যাবে, সে ক্ষেত্রে ভাইরাল লোড বেশি- এই পেশেন্টদের উপসর্গও বেশি হয়, আবার সংক্রমণ ক্ষমতাও বেশি। তাই ২৪ অবধি CT থাকলে নিজে ও অপরের ক্ষতি বেশি। কিন্তু আমাদের আলোচ্য পেশেন্টের RT-PCR পরীক্ষায় CT value দেখাচ্ছে ৩২। তার মানে তার বেশি ক্ষতি হবে না এবং অন্য কাউকে সংক্রমণ করারও সম্ভাবনা খুবই কম। তাহলে ওকে হাসপাতালে কেন! ডাক্তার কহিলেন, CT value-তে তো হিসেবের গোলমালও হতে পারে, আর ওসব হচ্ছে তাত্ত্বিক ব্যাপার। আমি সরাসরি রোগীকে দেখি।
বলে রাখি, এই রোগীকে কোনও সরকারি হাসপাতাল ভর্তি করবে না প্রয়োজন নেই বলে, তারা বাড়িতে থাকারই পরামর্শ দেবে।
এরপরের ঘটনা কী কী ঘটে বা ঘটতে পারে অনুমান করুন। বেসরকারি দামি নার্সিংহোমে রোগী ভর্তি হল। এবারে কিন্তু সংক্রমণকে ব্যবসার ঢাল করা হবে। আপনি জানতে পারবেন না নিজের থেকে কিছু। ওনারা প্রয়োজন মনে করলে জানতে পারবেন। আর কখন টাকাপয়সা কাউন্টারে দিয়ে আসতে হবে সেটা জানতে পারবেন। মেডিকেল জার্নালিজম ও রোগী অধিকার আন্দোলনের কর্মী হিসেবে এ আমার পঁচিশ বছরের অভিজ্ঞতা। প্রোটোকল চলছিল, তাও তিনদিন খাওয়া হয়ে গেছে। ওখানে দিতে শুরু করবে আবারও ডক্সিসাইক্লিন ও আইভারমেক্টিনের ফুল কোর্স। তার ওপর দেবে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন ও আ্যাজিথ্রোমাইসিন। বুঝুন। এটাকে বলে অতি-চিকিৎসা। আপনার শরীরটা খারাপ হবে। আর বিল বাড়াতে গেলে একটা লজিক খাড়া করতে হয়। এটাই লজিক।
এবার একটা কথা বলে লেখাটি শেষ করি।
কতজন রোগীর স্রেফ ডায়রিয়ার কারণে ভারতে এক বছরে মৃত্যু হয় জানেন? ডায়রিয়াও তো সংক্রামিত অসুখ। যক্ষ্মায়? করোনায় এখনও পর্যন্ত যত লোক মারা গেছে বলে বলা হচ্ছে, তার দশ গুণ মানুষ ভারতে প্রতি বছর যক্ষ্মার অসুখে মারা যায়। অতএব, ফোকাস যদি করোনা এবং করোনাই হয় তাহলে আপনার সাধারণ দুবার হ্যঁআচ্চো দিয়ে হাঁচলেই করোনা করোনা মনে হবে। আর এই সব সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ইদানীং আম্বানীও সরকারের সাথ নিয়ে নিজেদের সম্পদ দারুণ বৃদ্ধি করছে। প্রায় রেকর্ড বৃদ্ধি। কেন এমনটা হয়, বলুন !
কতগুলো ভুল ধারণা আছে। ভাইরাসটির নাম SARS Cov2। আর নতুন করোনা ভাইরাস বলে এটাকে বলা হয় নোভেল করোনা ভাইরাস। করোনা ভাইরাস সার্স ছিল ২০০২-০৩ সালে, তখন তাকে বলা হত SARS Cov1 ভাইরাস। SARS মানে Severe Acute Respiratory Distress Syndrome। ২০১২ সালে এল মার্স (MARS)। ওটাও করোনা ভাইরাস: Middle East Respiratory Distress Syndrome। এটা তাই SARS Cov2। আর অসুখ করলে তার নাম COVID 19। দ্বিতীয়ত, RNA ভাইরাস কি বেশি সাংঘাতিক? কে বলেছে? আফ্রিকায় হয়েছিল ইবোলা ভাইরাস, ডিএনএ ভাইরাস। তার মারণ ক্ষমতা ৫০ শতাংশ। করোনার এখন মারণ ক্ষমতা ইনফ্লুয়েঞ্জার থেকেও কম। আর R- factor-ও ১'এর কম দেখাচ্ছে। এটা অবশ্যই আশা। আরেকটা কথা। কো-মরবিডিটি কাকে বলব? ওষুধ খেয়েও অসুখটা কন্ট্রোলে নেই- তাকেই কো-মরবিডিটি বলব। তাই অসুখটা থাকলেই কো-মরবিডিটি হয় না।যাই হোক, আপাতত সরকার বা প্রশাসন করোনার প্রস্থান নিয়ে অত চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না। প্রচারে 'নিউ নর্ম্যাল' নাম দিচ্ছে। এটা থাকুক। ছাঁটাই চলুক। চাকরি যাক। ছেলেমেয়েরা চাকরি না পাক। আন্দোলন, জটলা তো করতে দেব না: সোশ্যাল ডিস্টেনসিং। সত্যিই সোশ্যাল। ফিজিক্যাল নয়।
খুব গোলমেলে । সব জটপেকে যাচ্ছে।এত রকম থিওরি।
ReplyDeleteখুব ভাল লিখেছেন। অনেক কথা জানা গেল।
ReplyDelete