Pages

Tuesday, 27 October 2020

'ঠেঠ বিহারি' কথা

বিহার মে কা বা?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

 

‘অব উঠা হ্যায় লহর’- কিন্তু কীসের লহর? কার লহর? এই প্রশ্নটাই আপাতত ব্যতিব্যস্ত রেখেছে সারা দেশের কৌতূহলী মনকে। যে মন তাকিয়ে আছে ১০ নভেম্বরের দিকে- যেদিন বিহার বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরবে।

বলাই বাহুল্য, এক জলবিভাজিকার মাঝে দাঁড়িয়ে আপামর মানুষ গভীরভাবে বুঝতে চাইছেন কী হতে চলেছে বিহারের ভোটে! এই মাসখানেক আগেও অধিকাংশ জনই ধরে নিয়েছিলেন, ছত্রভঙ্গ বিরোধীকুল যাদের প্রধান নেতা জেলবন্দী, করোনা পরিস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে এক প্রকার জোরজবরদস্তি নির্বাচন করিয়ে আয়েসে ভোটে জিতে আসাটা মোদি-নীতিশ জোটের পক্ষে ‘বাঁয়ে হাতকা খেল’। সেই মতো প্রস্তুতি সেরে ও ঘোষণা দিয়ে যখন মাঠে নামার উপক্রম হল, তখনও এ বিষয়ে কারও মনে এতটুকু সন্দেহ ছিল না যে এই ভোটে এনডিএ জোটের জয় একপ্রকার নিশ্চিত।

কিন্তু সে চেনা ছবিতে কিছুটা যেন চোনা পড়ল দুটি দৃশ্যত মামুলি ঘটনায়: এক, চিরাগ পাসওয়ানের নেতৃত্বাধীন এলজেপি দলের বিহারের এনডিএ ত্যাগ ও নীতিশকুমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও দুই, এনডিএ’র অনেক আগেই মহাগঠবন্ধনের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা। বড় বড় পণ্ডিত ও কর্পোরেট মিডিয়ার ‘দৃষ্টি এড়িয়ে’ গেলেও আসলে এই দুটি ঘটনা ছিল এক আগত ভবিষ্যতের শঙ্খধ্বনির মতো। কারণ, আচম্বিতে ঘটে যাওয়া এই দুটি ঘটনা কোনও কাকতালীয় ব্যাপার ছিল না। বরং, বিহারের বুকে ইতিমধ্যেই যে পরিবর্তনের অন্তঃসলিলা স্রোত বহমান হয়েছে, তারই এক প্রতিফলন ছিল মাত্র। অর্থাৎ, নীতিশকুমার সরকারের বিরুদ্ধে যে জনরোষ নির্মিত হয়ে আছে ও তা বিজেপি’র হিন্দুত্ব এজেন্ডা দিয়ে ঠেকানোর কোনও উপায়ই যে আর নেই- এই দুই বার্তাই যেন উক্ত ঘটনাদ্বয়ের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক ভাবে দেওয়ার ছিল। তারপর গঙ্গা দিয়ে যত জল গড়িয়েছে, বিহারের মানুষ ততই পরিণতমনস্কতা ও রাজনৈতিক সচেতনতার পরিচয় রেখেছেন। সেইগুলিকে বরং একে একে সাজিয়ে ফেলা যাক।

১) এই প্রথম ও অতি দ্রুত আরজেডি ও বামপন্থীদের মধ্যে এমন এক সুষ্ঠু নির্বাচনী সমঝোতা হল যা আগামী দিনে হিন্দি বলয়ে এক নতুন রাজনৈতিক মাত্রার উন্মেষ ঘটাতে চলেছে। আর এই সমঝোতাই বিহারের নির্বাচনের চেহারাটাকেও আমূল বদলে দিয়েছে যেখানে প্রথম চোটেই প্রকারান্তরে মুখ থুবড়ে পড়েছে এনডিএ। কেন বলছি এ কথা? কারণ, এই সমঝোতার ফলে নির্বাচনের প্রধান ইস্যু বা মুদ্দাই আমূল বদলে গেছে। গত পাঁচ-ছ বছরে যে কোনও জায়গায় নির্বাচনে কী ইস্যু হবে তার স্টিয়ারিংটা থাকত আরএসএস-বিজেপি’র থিঙ্ক-ট্যাঙ্কের হাতে; যেখানে ৩৭০, রামমন্দির, দেশদ্রোহিতা, হিন্দু-মুসলমান, পাকিস্তান, হিন্দুত্ব এগুলোই হত চর্চার বিষয় এবং বিজেপি খুব কৌশলে বিরোধী ও সমূহ জনমতকে সেদিক পানেই টেনে আনত। কিন্তু এবারে লক্ষণীয়, অতি তৎপরতার সঙ্গে বিজেপি’র এই কৌশলটিকে মহাগঠবন্ধন প্রথম রাতেই ভোঁতা করে দিয়েছে। মণ্ডল কমিশন ও জাতপাতের রাজনীতির ওপর ভিত্তি করে যে আরজেডি’র উত্থান, জনপ্রিয়তা ও ১৫ বছরের শাসন, তাকে তারা শিকেয় তুলে রেখে বেরোজগারি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সড়ক, বিজলি, পানি’র মতো ইস্যুগুলিকে নিয়ে প্রচারে নামতে পেরেছে। এর প্রথম কারণ হল, বিহারের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বামপন্থীদের, বিশেষত সিপিআই(এম-এল)-লিবারেশন দলের গরিব ও শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ব্যাপক উপস্থিতি ও দীর্ঘ সংগ্রাম এবং আরজেডি দলের এক সময়ে সোশালিস্ট রাজনীতির ঐতিহ্য (জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনোহর লোহিয়া প্রমুখ)- এই দুই মাত্রা একযোগে এসে মিলতে পারার ফলে ঐক্যের এক সবল ভিত্তিকে খুঁজে পেয়েছে। বামপন্থী শক্তি ও আরজেডি’র এই রাজনৈতিক সংযোগে বিলুপ্ত-প্রায় কংগ্রেসের তাল মেলানো ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। কারণ, বিজেপি’র বাড়বাড়ন্ত মানে জাতীয় স্তরে কংগ্রেসের আরও ক্ষয়, তাই যে কোনও প্রকারে বিজেপিকে পর্যুদস্ত করতে পারলে কংগ্রেস নিজেকে খানিক তাজা মনে করতে পারে। দ্বিতীয় কারণ, গত লোকসভা ভোটে বামপন্থী ও আরজেডি’র মধ্যে যে চারটি আসনে সমঝোতা হয়েছিল সেখানে তাদের জোট প্রার্থীরা প্রতি আসনে ৪ লক্ষের ওপর ভোট পেয়েছিল। অর্থাৎ, এই দুই শক্তির মিলিত মূল জনভিত্তি হল গরিব ও শ্রমজীবী জনতা যাদের ভোট আলাদা হয়ে অপর পক্ষকে বরাবর সুবিধা করে দিয়েছে। এই ভোট বিভাজন যেন এবারে না হয় সে চিন্তা দু পক্ষেরই ছিল। আর তাই শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার দাবি-দাওয়াকে আঁকড়ে ধরাটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছিল। তৃতীয় ও সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, বিহারের মেহনতি জনগণের ব্যাপক অংশ লকডাউন, বেরোজগারি, বন্যা ও নানা কারণে এতই দুঃসহ অবস্থা ও বিপন্নতার মধ্যে ছিল যে তাদের অনুভবকে পড়ে ফেলতে এই দুই শক্তি বেশি দেরি করেনি।

২) হতে পারে, আরজেডি তেজস্বীর মতো এক তরুণ নেতৃত্বে নতুন ভাবে সমাজকে দেখতে চাইছে ও আগামী ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করছে। যে কারণে, এবারে তাদের প্রচারের ব্যানারে, হোর্ডিং’এ, পোস্টারে যেমন পুরনো জমানার লালুপ্রসাদের ছবি নেই, তেমনই রাজনৈতিক বার্তাতেও জাতপাত ও পিছড়ে বর্গের উল্লেখ নেই। বরং, বামপন্থী ও সোশ্যালিস্টদের রোটি-কাপড়া অউর মকান’এর দাবিকেই তারা আপাতত সম্যক বলে উপলব্ধি করেছে।

৩) তাই, জীবন-জীবিকার মুদ্দা ও রাজনৈতিক অধিকার নিয়ে এই নির্বাচনে বামপন্থী-আরজেডি’র সজোরে উত্থান ও ব্যাপক প্রচারাভিযানে থতমত খেয়ে যাওয়া এনডিএ, যোগী আদিত্যনাথ ও মোদিকে দিয়ে চেষ্টা করেছিল তাদের চিরাচরিত হিন্দুত্বের এজেন্ডাকে তুলে ধরে প্রচারের বিষয়কে পাল্টাতে। কিন্তু ভবি অত সহজে ভোলেনি। মহাগঠবন্ধনও সে ফাঁদে পা দেয়নি। উপায়ন্তর না পেয়ে ১৯ লক্ষ কাজের প্রতিশ্রুতি, বিনামূল্যে করোনা ভ্যাকসিন ও আইটি-হাব গড়ে ৫ লক্ষ কর্মসংস্থান- এইসব জীবন-জীবিকার প্রচারে তারাও নামতে বাধ্য হল। সুস্পষ্ট দেখা গেল, নির্বাচনী মুদ্দার স্টিয়ারিং’টা বিজেপি’র হাতে আর নেই।

৪) আর এই আবহেই চিরাগের এলজেপি পার্টির আলাদা ভাবে জেডিইউ’র বিরুদ্ধে (কিছু ক্ষেত্রে বিজেপি’র বিরুদ্ধেও) প্রার্থী দেওয়া বহু আসনে এনডিএ’র পক্ষে এক আতান্তরের অবস্থা তৈরি করেছে। এটা পরিষ্কার যে, এলজেপি ভোট কাটাকাটি করে অনেক জায়গায় জেডিইউ’কে হারিয়ে দেবে। কেউ কেউ বলছেন, এটা বিজেপি’রই গেমপ্ল্যান, যেখানে তারা ভেবেছিল এইভাবে জেডিইউ’কে তারা দুর্বল করে নিজেরা প্রধান শক্তি হিসেবে বিহারে আত্মপ্রকাশ করবে! কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে গুড়ে বালি। কারণ, গেমপ্ল্যানটা যখন তারা কষেছিল তখন ধরে নিয়েছিল যে নির্বাচনের হালটা তাদের হাতে ধরা আছে। কিন্তু এখন পরিস্থিতি সম্পূর্ণত বদলে গেছে, যে কারণে, ব্যুমেরাং হওয়াটা আর সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

৫) সরেজমিনে মাটিতে নেমে যখন দেখা গেল মানুষ বেজায় ক্ষিপ্ত, তখন নীতিশকুমারকে শিখণ্ডী খাড়া করা ছাড়া বিজেপি’র আর উপায়ই বা কী! যদিও তাদের নেতৃত্ব বারবার বলে চলেছে, যে কোনও অবস্থাতেই তাদের জোটের মুখ্যমন্ত্রী পদপর্থী নীতিশকুমারই থাকবেন, কিন্তু প্রথম পর্বের ভোটের প্রচারপর্ব শেষ হওয়ার মুখে দেখা গেল বিজেপির তরফে নির্বাচনী ক্ষেত্রগুলিতে শুধুমাত্র মোদির ছবি দিয়ে বিজেপি নতুন করে হোর্ডিং ও ব্যানার টাঙাতে শুরু করেছে। তাহলে কি নিজেদের পরাজয় নিশ্চিত বুঝে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখা, যদি শিখণ্ডী নীতিশকুমারকে প্রচারের আলো থেকে সরিয়ে রেখে মানুষের মনে কিছু বিভ্রান্তি তৈরি করা যায়!

৬) করোনার ভয়ে স্টুডিওতে বসে ও শহরের অল্প কিছু লোকের তথ্য নিয়ে বড় বড় টিভিওয়ালারা যখন নির্বাচনী সমীক্ষা করে সাব্যস্ত করছে যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ থাকলেও এনডিএ’র জয় একপ্রকার নিশ্চিত, তখন বিহার নির্বাচনের আসল খবরগুলি পাওয়া যাচ্ছে নব-উত্থিত ‘সিটিজেন্স জার্নালিজম’এর (সচ মিডিয়া, অনলাইন জানকারি, সুধীর গুপ্তা, দ্য লাইভ টিভি ইত্যাদি) হরেক ভিডিও, বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ থেকে। তাদেরই সংগৃহীত ছবি থেকে জানা যাচ্ছে, তেজস্বীর সভায় জনতার ঢল, উচ্ছ্বাস ও উন্মাদনা, যুবদের তীব্র সরকার-বিরোধী বক্তব্য এবং সর্বোপরি, জনতার বিপুল অংশ, বিশেষত শ্রমজীবী মানুষ যে বিকাশ নিয়েই ভাবতে চাইছে ও বেরোজগারি থেকে ছুটকারা চাইছে, তার ইতিবৃত্ত। আর তেমন আশ্চর্যের না হলেও দেখা যাচ্ছে, এইসব ‘সিটিজেন্স জার্নালিজম’এর ভিডিও ও খবরগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর কর্পোরেট বা মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার (বিহারে বলে ‘গদি মিডিয়া’) দ্বারাও প্রচারিত হচ্ছে। ফলে, টিভিওয়ালা ও বড় দৈনিকের বিভ্রান্তি আরও বাড়ছে এবং বিহারের নির্বাচন যে একতরফা হচ্ছে না তা এখন চাপে পড়ে প্রতিদিনই তারাও বলতে শুরু করেছে এবং তাদের নিত্য নতুন নির্বাচনী সমীক্ষায় ক্রমশ এনডিএ’র পাল্লা হাল্কা হয়ে আসছে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, এই আবহে এক সময়ের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার জনপ্রিয় ‘অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা’র কদর একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে।

২০১৪ সালে দিল্লির তখতে মোদি সরকার সওয়ার হওয়ার পরে ভারতীয় রাজনীতির গতিবিধি ও বিষয়বস্তুতে যে পরিবর্তনগুলি এসেছিল তা বিহার নির্বাচনে এসে নতুন মোড় নিয়েছে। দিল্লির বিধানসভা ভোটেও সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নকে উসকে দিয়ে চেষ্টা হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজন করিয়ে ভোটে জেতার। কিন্তু বিহার বিধানসভা ভোটে তেমন কোনও অবকাশই মেলেনি। সাধারণ মানুষ এতটাই প্রস্তুত ছিলেন যে জীবন-জীবিকার মুদ্দা ছাড়া তাঁরা অন্য কোনও বিষয়ে আলোচনা শুনতেই রাজী নন। উপরন্তু, বিহার সরকারের মন্ত্রীরা (মুখ্যমন্ত্রী সহ) প্রচারে গিয়ে ‘মুর্দাবাদ’ ধ্বনি শুনছেন, মানুষের গালাগালি খাচ্ছেন ও তাঁদের সভাতে তেমন ভিড়ও জমছে না। গত কয়েক দশকে এই প্রথম বিহারে নির্বাচন হচ্ছে যেখানে সাম্প্রদায়িকতা ও জাতপাতের মুদ্দা কোনওভাবেই তেমন দাগ কাটতে পারছে না। এ এক অভিনব পরিস্থিতি। এক নতুন দিশার ঝলক।

ভুলে গেলে চলবে না, এ দেশে ফিরে গান্ধীর বাস্তব রাজনৈতিক উন্মেষ হয়েছিল বিহারের চম্পারণ থেকে। ৪২’এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে বিহারের অংশগ্রহণ ছিল ব্যাপক। বহু পরিবর্তন ও নতুন দিশার আবাহনে বিহার সব সময়েই সমুজ্জ্বল। ১৯৭৪ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের ‘নবনির্মাণ আন্দোলন’এ বিহারের ছাত্র-যুবদের অত্যুজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। আজ আবার যুবশক্তি সোচ্চার হয়েছে। দেশের তমসাবৃত রাজনীতির আবহে এ নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। আমরা তাকিয়ে রইলাম ১০ নভেম্বরের দিকে। ‘ঠেঠ বিহারি’দের হাতে প্রজ্জ্বলিত মশালের দিকে।  

              

Sunday, 18 October 2020

নতুন নির্মিতির পথে

 সময় পাল্টাচ্ছে!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

এক অদ্ভুত ও বিভ্রান্তিকর সময়ে এসে আমরা উপনীত হয়েছি। যুক্তি-তক্কের সমস্ত উপচারকে বিদায় দিয়ে এ যেন এক ঘোর আবোলতাবোলের সমাহার। শুধু আবোলতাবোল বললে কম বলা হয়; প্রতিহিংসা, কপটতা, ঘৃণা ও অবিশ্বাসের এক বিষাদ-সিন্ধু। শুধু এ দেশে নয়, প্রায় সারা বিশ্ব জুড়েই। করোনা এসে এই দুঃসহতায় ঘৃতাহুতি দিয়েছে।

আগে কি এমনতর দুর্যোগ আসেনি? সম্ভবত নয়। তা বলা এই কারণে যে, আগের দুঃসহতায় দুর্বল ও নিপীড়িত মানুষের অপারগতা ছিল অনেক বেশি। ফলে, অসহায়তার কারণে ও ক্লিষ্ট জীবনে তারা দগ্ধ হয়েছে, নিষ্পেষিত ও শোষিত হয়ে দিন গুজরান করেছে তদুপরি বেঁচে ওঠার আশায় কখনও কখনও বা লড়াই’ও করেছে, নিজ নিজ পরিসরে খুঁজে ফিরেছে অন্যতর জীবনের সন্ধান। সে সন্ধানে হতাশা ও বিভ্রান্তি ছিল, তদাপি কখনও বা আশা ও সফলতাও ছিল। কিন্তু আজকের পরিস্থিতি সম্পূর্ণত ভিন্ন। এক জটিল-কুটিল মহাসাগরে পড়ে আজ প্রায় সকলেই উদভ্রান্ত; শুধু তা নয়, নিজ নিজ পরিসর-চ্যুত ও নিরালম্ব বায়ুভূতের মতো যাপনরত। না চাইলেও এই জীবনেই বাধ্যত বাস। সোশ্যাল মিডিয়া ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত সমাজ-অর্থনীতি অক্টোপাসের মতো সকলকে জড়িয়ে ফেলেছে। যেখানে তেমন তেমন নড়াচড়ার কোনও উপায়ন্তর নেই। আজ তাই বলা যাবে না, সে মানুষ অপারগ, সে বরং স্বেচ্ছাবন্দী। সে তৃষ্ণার্ত, কিন্তু জীবন-মরুভূমির পথে হাঁটতে হাঁটতে মরীচিকাই তার কাছে বেঁচে ওঠার অভীপ্সা।

আর এই সামগ্রিক পরিপ্রেক্ষিতেই বিশ্ব জুড়ে বহু দেশে গত দশ বছরে এমন এমন শাসকের উদয় হয়েছে যারা বিচারের কঠিন-নিঠুর মানদণ্ড তৈরি করে মরীচিকার বিভ্রান্তিকে আরও বাস্তব ও আপন করে তুলতে পেরেছে। তার কারণও ছিল। এমন এক সন্ধিক্ষণে (২০০৮-০৯ সালে) বিশ্বায়িত ফিনান্স পুঁজির বাজার যখন হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল তখন তথ্য প্রযুক্তির উল্লম্ফন ঘটছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এক অভাবনীয় জগতে। অথচ উদার পুঁজিবাদের আগ্রাসী ধাবমানতায় দুনিয়া জুড়ে আর্থিক বৈষম্য ও জীবন-অনিশ্চয়তার তীব্রতাও ছিল ভয়ঙ্কর। তার বিরুদ্ধে জনমানসে তৈরি হয়েছে প্রবল আশঙ্কা ও বিক্ষোভও। আমাদের দেশেও তখন মনমোহন সিং’এর প্রধানমন্ত্রীত্বের উদার-অর্থনীতির কাল। অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার ৮-১০ শতাংশ ছুঁলেও জল-জঙ্গল-জমিতে কর্পোরেট লুঠতরাজ, শিল্প ঋণের নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের যথেচ্ছ অর্থ পাচার, অবিশ্বাস্য দুর্নীতি ও বড় বড় স্ক্যাম, সর্বোপরি, সাধারণ মানুষের জীবনে সে সব অভিঘাতে নতুন নতুন অর্থনৈতিক দুর্গতি জনসাধারণের মধ্যে এক তীব্র অশান্তি ও অসন্তোষের জন্ম দিয়েছে। সেই অসন্তোষের অগ্নিতেই উদয় উগ্র রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী শক্তির যারা উদার-পুঁজিবাদের চিহ্নগুলিকে শনাক্ত করে তার পাল্টা বয়ান বানিয়ে ধীরে ধীরে মানুষের সমর্থন আদায় করে নিতে পেরেছে। সেই পাল্টা বয়ানগুলি কী?

মূলত:

১) বিশ্বায়নের প্রবাহে দেশের স্বার্থ ‘রক্ষা’ করো। শ্লোগান উঠল: মেক ইন ইন্ডিয়া, আমেরিকা আমেরিকানদের জন্য, আত্মনির্ভর ভারত;

২) অভিবাসীদের প্রতিহত করো: আমেরিকায় বলা হল মেক্সিকানদের আটকাও, এ দেশে বাংলাদেশিদের;

৩) সামাজিক, অর্থনৈতিক দুর্দশার জন্য দায়ী করা হল নির্দিষ্ট কোনও বর্ণ, ধর্ম বা জাতিকে: যেমন, আমেরিকায় কালোরা অপরাধ-প্রবণ, ভারতে মুসলমানরাই সমস্ত সমস্যার মূলে;

৪) প্রতিবেশীদের সম্পর্কে সাবধান হও। সকলেই সন্দেহজনক: আমেরিকার মতে, প্রতিবেশী মেক্সিকো হল ড্রাগ ও সমাজবিরোধীদের দেশ, ভারতে বলা হল, সমস্ত অপকর্মের মূলে পাকিস্তান; 

৫) সরকারি স্তরে অর্থনৈতিক উদ্যোগ সর্বদাই ক্ষতিকর। একচ্ছত্র কর্পোরেট ক্ষমতায়নের পথেই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সম্ভব;

৬) দেশের প্রধান বা সরকারি নীতি অথবা আইনকানুন সম্পর্কে যে কোনও প্রশ্নই দেশ-বিরোধী ও দেশদ্রোহিতার সামিল: আমেরিকায় জো বিডেন তাই চীনের দালাল আর এ দেশে বিরোধীরা কোনও রাজ্যে নির্বাচনে জিতলে তা মিনি-পাকিস্তান হয়ে উঠবে বলে প্রচার।

অতএব, ইত্যাকার নানাবিধ রীতিনীতি ও বয়ানকে সাব্যস্ত করে ফেলা গেল। তৈরি হল মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস ও বিভেদের এক নতুন বাতাবরণ। ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত ভার্চুয়াল অর্থনীতির আধিপত্য ও রমরমায় এমন এক নতুন সামাজিক পরিসর নির্মিত হয়ে গেছে যা কস্মিনকালে ভাবাই যায়নি। ভার্চুয়াল সত্তায় সমস্ত অস্তিত্ব যেন তালগোল পাকিয়ে এক নতুন অবয়ব ও বয়ানে আত্মপ্রকাশ পেল। আপনার দীর্ঘদিনের বন্ধু অথবা নিকট পরিজনকে এবার যেন আপনি আর চিনতে পারছেন না। অথবা, তাঁরাও যেন আপনাকে কেমন বাঁকা দৃষ্টিতে দেখছেনপরিচিতি ও আলাপচারিতার বিভঙ্গটাই হয়ে গেছে ভার্চুয়াল, যেখানে ছবি, শ্রবণ বা লেখার মাধ্যমে যোগাযোগ রাখাটাই দস্তুর, চাক্ষুষ দেখাদেখি কেমন জানি এক অবাস্তব প্রকল্প বিশেষ।    

এমন এক হযবরল পরিস্থিতিতে, খুব স্বাভাবিক, অবিশ্বাস, মিথ্যাচার, কপটতা, জিঘাংসা ও এমনতর আরও নানাবিধ প্রকোপের মাত্রায় সমাজ একেবারে পর্যুদস্ত হয়ে পড়বে। কারণ, ক্ষমতা লাভের দম্ভে যেমন বহু রাজনৈতিক দল বা নেতা স্বৈরাচারী হয়ে ওঠে, তেমনই আমজনতাও ক্ষমতার পাকদণ্ডীতে ‘দশচক্রে ভগবানের ভূত হয়ে ওঠা’র মতোই দশা প্রাপ্ত হয়। সোশ্যাল মিডিয়া নামক বস্তুটিতে অবাধে কথা বলার প্রায় বিনিপয়সার লাইসেন্স পেয়ে সাধারণ মানুষেরও যে মাথা ঘুরে যাবে, এ আর আশ্চর্য কী! যেমন, পকেটমার, ছিঁচকে চোর বা পাগলকে গণধোলাইয়ে অত্যন্ত নিরীহজনও গিয়ে যে কষে অন্তত খান-দুয়েক লাথি মেরে আসে, তা আকছার দেখতে দেখতেই তো বড় হয়েছি। তাই ব্যক্তি মনের কোটরে বহমান জিঘাংসা ও কপটতা যে সুযোগ ও আবহ পেলে বিধ্বংসী রূপ ধরবে তা তো স্বতঃসিদ্ধই। সেই বিধ্বংসী সময়েই আপাতত আমাদের ঘর। আর এই সময়ের তালে যখন বৃহত্তর ক্ষমতার বিভাজন ও প্রতিহিংসার রাজনীতি ব্যক্তি ক্ষমতার কপটতা ও জিঘাংসার সঙ্গে মিশে যায় তখন আক্ষরিক অর্থেই তা এক মহামারি। ভাইরাস তো শুধু বস্তুগত নয়, মানসিকও। আর এই মানসিক বিকারের উৎসও তখন হয়ে উঠতে পারে সোশ্যাল মিডিয়ার অনর্গল নেত্যকলা। যেমন, সুশান্ত সিং’এর মৃত্যুর মাসখানেক পর হঠাৎ (তখন বিহার নির্বাচন দু-এক মাস পরেই) কারও কারও মাথায় এল যে তাঁকে খুন করা হয়েছে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত মুম্বাই পুলিশ যথাযথ ভাবে তাদের কর্তব্য পালন করছে না, অতএব, বিহার পুলিশ সে দায়িত্ব নিতে পারে। তারপর কেস গেল সিবিআই’এর হাতে। কোনওমতেই খুনের তত্ত্ব খাড়া না করতে পেরে সব থেকে সফট টার্গেট সুশান্ত’র বান্ধবী রিয়া চক্রবর্তীকে অন্তত কিছু গাঁজা কেনাবেচার (তাও সুশান্তের জন্যই) দায়ে তাহলে জেলের ঘানি টানানো যাক। সঙ্গে সঙ্গে রিপাবলিক টিভি’র মর্কটেরা পাগলের কেত্তন শুরু করে দিল। নেমে পড়ল গৈরিক শিবির- আসলে বাঙালি মেয়েরা কতরকমের ‘কালা যাদু’ জানে সেই সব উদ্ভট, বিকৃত, বৈকল্যজনিত আলোচনা ও মন্তব্যে সোশ্যাল মিডিয়াকে সরগরম করে তুলল। অশ্লীল নর্তন-কুর্দনে বহুজনের মন ও চোখের সামনে নির্মিত হল জিঘাংসা ও ঘৃণার এক অভিনব কুনাট্য।

দেখা গেল, আমেরিকার উদ্ভট রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পও কম যান না। তাঁর যে কোভিড হয়েছে তা তিনি বিশ্বাস করতেই নারাজ। তিন কি চারদিন হাসপাতালে থেকে একপ্রকার পালিয়ে চলে এলেন হোয়াইট হাউসে। সাংবাদিকদের সামনে মাস্ক খুলে ফেলে উপস্থিত আর সকলের অবস্থাকে কোভিড-আতঙ্কে সঙ্গীন করে গটগট করে হেঁটে ভেতরে চলে গেলেন। আগে একবার ট্যুইট করে জানিয়েছিলেন, মানব শরীরে সাবান ইনজেক্ট করে দিলেই তো করোনার প্রসঙ্গ শেষ করে দেওয়া যেতে পারে। ঠিক যেমন, প্রধানমন্ত্রী মোদী থালা-বাটি বাজিয়ে ধ্বনিদ্রুম সৃষ্টি করে করোনা নিকেশ করতে দেশবাসীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। ইদানীং তাঁর দলের অনুগামীরা বলছেন, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পুলিশ তাঁদের জমায়েতে জল-কামান থেকে যে বেগুনি রঙের জল ছিটিয়েছিল তাতে নাকি করোনার জীবাণু মেশানো ছিল। শুধু কি তাই! তনিশক’এর একটি বিজ্ঞাপনে কেন এক মুসলমান শাশুড়ি তাঁর হিন্দু বউমাকে সাধ দিচ্ছেন তা নিয়ে সারা দেশ জুড়ে গৈরিক শিবির শুধু হৈ-হট্টগোল করেনি, বহু জায়গায় শোরুমের ওপর হামলা করেছে, জোর করে মুচলেকা লিখিয়েছে ও ভয় দেখিয়ে বিজ্ঞাপনটিকে প্রত্যাহার করিয়েছে। কেন করবে না! মহারাষ্ট্রের রাজ্যপাল যদি সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে ‘আপনি সেক্যুলার হয়ে উঠছেন’ বলে গাল পাড়তে পারেন তাহলে এইসব তাণ্ডব তো খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।

এদিকে বাংলাদেশ, এমনকি নেপাল, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারে ভারতকে আগামী দিনে ছাপিয়ে যেতে চলেছে বলে আইএমএফ থেকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই অধঃপাত তো এই চলতি আবহে খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ঘৃণা ও বিভাজনকে পাথেয় করে কোনও রাজনৈতিক শক্তি যদি পরিকল্পনামাফিক নিরলস অনুশীলন চালিয়ে যায় তাহলে তার সাময়িক ফসল সে নিশ্চয়ই ঘরে তুলতে পারে। সেই কাণ্ডটিই ঘটেছে সোশ্যাল মিডিয়ার নতুন ভুবনে। কারণ, রীতিমতো পেশাদার আইটি সেল তৈরি করে, সেখানে দক্ষ লোক নিয়োগ করে, নানা কিসিমের উত্তেজনাকর ও হিংসাত্মক বয়ান বানিয়ে সুচতুর ভাবে যদি এ প্রান্ত থেকে সে প্রান্ত ছড়িয়ে দেওয়া যায় তবে তার সাময়িক প্রতিদান নিশ্চয়ই মিলতে পারে। অবশ্য তার জন্য দুটি মজবুত ভিত তৈরি থাকতে হবে: এক, নানা বঞ্চনার কারণে মানুষের মধ্যে হতাশা, ক্লেদ ও ক্ষোভ এবং দুই, ফলত, চটজলদি সমাধান ও চোখের সামনে জ্যান্ত শত্রুর উপস্থিতি।

এই দুই ভিতই প্রস্তুত ছিল। ফলে, উগ্র রক্ষণশীলদের পাল্টা বয়ানে বিশ্বাস রেখে মানুষ তথাকথিত উদারবাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে কার্যত এক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইল। আর সম সময়েই নব উত্থিত সোশ্যাল মিডিয়া এই কার্যক্রমে নানা ভাবে সহায়ক শক্তি হয়ে দাঁড়াল। উসকে উঠল ঘৃণা ও বিভাজনের চরম বিস্ফোরণ। রক্ষণশীলদের সুপরিকল্পিত ঘৃণার রাজনীতির সঙ্গে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিবমিষা মিলেমিশে এক অন্ধকার বৃত্তের জন্ম দিল। বহু আশা-আকাঙ্ক্ষার স্মারক বামপন্থা, যা হতে পারত এই দুঃসময়ে এক দুর্ভেদ্য প্রতিষেধক, ভেসে গেল নব-নির্মিত বিভাজনের রাজনীতির তুমুল স্রোতে। কেন, তা অন্য আলোচনার বিষয়।

তবে এও তো দেখা গেছে, বহু মূল্য চুকিয়ে মনুষ্য-সমাজ আবারও চেষ্টা করেছে নতুন আলোকমালাকে ধরতে। তথাকথিত উদারবাদী রাজনীতির যে কপটতা ও দুরাচার, তার প্রতিক্রিয়ায় উগ্র রক্ষণশীল রাজনীতির জিঘাংসা- এই দুইকে ছাপিয়েই এক নতুন সম্ভাবনা তো নির্মিতও হচ্ছে। একদিকে সোশ্যাল মিডিয়া সম্পর্কে বেশি বেশি মানুষ সচেতন ও সতর্ক হচ্ছে, এমনকি বহুল পরিমাণে তাকে পরিত্যাগও করছে, অন্যদিকে, এক নতুন বাস্তব রাজনীতির বীক্ষারও উদয় হচ্ছে যা সাবেকি বামপন্থাকেও নতুন করে ভাবতে সহায়তা করতে পারে।

এই লেখা যখন শেষ করছি, তখন তরুণ নেত্রী জ্যাকিন্ডা আর্ডার্ন’এর নেতৃত্বে লেবর পার্টি নিউজিল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গড়ার পথে। একক গরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তারা গ্রিন পার্টির সঙ্গে জোট সরকার গড়তে আগ্রহী। কারণ, পরিবেশ তাদের কাছে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০৩০ সালের মধ্যে দেশে সৌরশক্তির ব্যবহারকে সর্বজনীন করা, উচ্চ আয়ের ধনীদের ওপর বেশি কর বসানো, শ্রমিকদের জন্য সপ্তাহে অন্তত ১৬০ ডলার ন্যূনতম মজুরি, কর্মনিয়োজনের গুরুত্বকে অগ্রাধিকারে রাখা- এইসবই ছিল তাদের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার। মনে হয়, সারা বিশ্ব জুড়েই, এমনকি আমাদের দেশেও, এক নতুন ও সার্বিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির উত্থান এবং সদর্থক রাজনীতির বাতাবরণ গড়ে ওঠা সময়ের খানিক অপেক্ষা মাত্র।

      

Friday, 16 October 2020

দুঃসহ জীবন

পরিযায়ী শিশু-নারী-পুরুষ

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

পরিযায়ী শিশু-নারী-পুরুষের সমস্যা গভীর ও ব্যাপক। ধর্মীয় কারণে (যথা বার্মা মুলুকের রোহিঙ্গা বা পাকিস্তান থেকে উত্যক্ত অথবা নিপীড়িত হয়ে বিতাড়িত শিখ/হিন্দু শরণার্থীরা) পরিযায়ী, আর ভবঘুরে সম্প্রদায়ভুক্ত (দেশে কত কিসিমের আইন ও তার সংশোধনী আমরা দেখি, কিন্তু ভবঘুরেদের জন্য মান্ধাতার বাবার আমলের বিদেশী কর্তাদের সম্মান রক্ষার্থে সৃষ্ট আইন ছাড়া কার্যত কোনও আইন নেই; পুলিস কাউকে ভবঘুরে বলে ঘোষণা করে দিলেই হল), তাদের এই আলোচনার বাইরে রাখছি। আরও কয়েকটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায় সম্পর্কে পরে উল্লেখ করলেও তাদের আপাতত এই আলোচনার বাইরে রাখছি আলোচনার সুবিধার্থে।

পরিযায়ীদের মূল সমস্যা চিকিৎসা, রুজি-রোজগার ও নিরাপত্তা সম্পর্কিত। চিকিৎসা-বিষয়ক সমস্যা সবারই। বিশেষ সমস্যা পরিযায়ীদের। তাদের কর্মস্থলে পাওয়া বাসস্থানের পরিবেশ অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর। দু-একটি উদাহরণ দেওয়া যাক।

চা-বাগান শ্রমিকদের থাকার জন্য নির্মিত বহু বস্তিরই হাল বেশ খারাপ। তাদের না আছে সুশিক্ষার সুযোগ, না স্বাস্থ্য সচেতনতা। আছে অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার আর কুপ্রথা। তারা অনেকেই জানে না কোথায় ছিল তাদের দেশ, আত্মীয়স্বজন কে, কবে কী করে তারা এখানে এল! কেউ এসেছে জেলা ডিঙ্গিয়ে, কেউ রাজ্যের সীমানা পেরিয়ে। তারা জানেই না স্বাস্থ্যবিধিসম্মত টয়লেট ব্যবস্থার কথা, এখনও ছোটে বাগানে, ঝোপেঝাড়ে। পরিশ্রুত পানীয় জল তারা স্বপ্নেও চায়নি (কে বা পায় পরিশ্রুত পানীয় জল এমন আর্সেনিক-দূষিত এই রাজ্যে?)। জলবাহিত রোগের কথা তারা জানেই না তো পরিশ্রুত পানীয় জল!

রাজ্যের ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প চত্বরেও অবস্থা অন্যরকম কিছু নয়। গঙ্গাপারের বৃত্তান্ত বা ‘অসমাপ্ত চটাব্দ’এর গল্প আজও এক।

আর ইটভাটায়? আমার দেখা একটি বস্তিরও হাল ভালো না। একটিরও না। বিশ্বাস করাই শক্ত যে সেখানে মানুষ বাস করে এবং সাপ-বিছে, মশা-মাছি সঙ্গে নিয়ে মানুষ বেঁচে আছে! বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প যথা টীকাকরণ ইত্যাদির সুযোগই তারা অনেকে পায় না। জানেই না। অনেক মালিক আবার ঘটা করে বোর্ডে লিখে রাখে সেই মানুষগুলির জন্য সরকার ও তারা কী করেছে, তাদের সহায়ক আইন কী কী আছে ইত্যাদি। বদ-রসিকতা ছাড়া কিছুই বলা যায় না।

ঐসব অস্থায়ী ছাউনি ইত্যাদি স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার জন্য বিপদজনক। সংক্রামক রোগগুলো তো আছেই, তারই মাঝে একদিকে আছে আন্ত্রিক, মহামারী, সাপে-কাটা, রক্তাল্পতা, কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, কবচ-তাবিজ, অন্যদিকে নারী-পুরুষের মিলন, জন্ম-মৃত্যু। মহিলারা, শিশুর হাত ধরে, ঝুঁকি নিয়েই বাড়ি ছাড়ে অভিভাবক স্থানীয় কোনও পুরুষের ভরসায় (সেই পুরুষও কখনও ঠকায়)। যে মানুষটা দাওয়ায় পা ছড়িয়ে বসে বিড়ি বাঁধে কি মুখোশ বানায়, সেও ভাবে বাড়তি দু’ পয়সা পেলে আর একটু সুখে থাকা যায়। আরও একবেলা খাবার জোটে বা চালে আর এক-আঁটি খড় দেওয়া যায়! তাই তাঁরা ঝুঁকি নেয়।

এমন আবাসস্থলে মহিলা পেলে, অনেক সময়েই, মালিক বা তার কোনও দুর্বৃত্ত এজেন্ট টেনে নেবে তাকে যেভাবে নেকড়ে বা শেয়াল টান মেরে কেড়ে নেয় শরীর। তাদের নিয়োগকারীরা বা তাদের এজেন্ট দারিদ্র ও অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে থাকে। ‘ভেট’ দিতে তাদের ব্যবহার করা হয়। ‘নাবাল’এ কাজ করতে যাওয়া মানুষগুলোরও একই হাল। এই তো তাদের জীবন ‘কালিদা’।  

তাদের জন্য নিরবচ্ছিন্ন, চিরস্থায়ী সুব্যবস্থা চাই। চাই তো, পাই কৈ? কেবল বর্তমানের জন্য নয়, কেবল কোভিড পরিস্থিতির জন্য নয়, ওরা চিরদিনই বঞ্চিত- কখনও চা বাগানে, কখনও ইটভাটায়, কখনও হোটেলে, কখনও শিল্পক্ষেত্রে, কখনও কৃষিক্ষেত্রে। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে নিয়োজিত যারা তাদের অতি বড় অংশই তো ঠিকাকর্মী- তারাই বা কী ভালো আছে, প্রাপ্য/যোগ্য সম্মান পায়? এদের সমস্যাও বড় হয়ে দেখা দেবার পথে। ঠিকাকর্মীদের একাংশও পরিযায়ী, তবে তাদের সমস্যাও আলাদা করে আমরা এই আলোচনায় আনছি না।    

অতিমারি কালে কিছু মানুষ পরিযায়ীদের জন্য অনেক কিছু করতে চেয়েছে। করেওছে- খাদ্য, আশ্রয়, লেখাপড়ার সরঞ্জাম, চিকিৎসা দিয়েছে। পরিযায়ীদের তারা নানা কাজের উৎস যেমন '১০০ দিনের কাজ' ইত্যাদিও ধরিয়ে দিয়েছে। সেখানেও দুর্নীতির অন্ত নেই, তবু এ কথাও তো মানতে হয় যে তারা অনেকে কিছু খেতে পায় সেই কাজের সুবাদে। আমরা কেবল দুর্নীতিই দেখি, দেখি না যে প্রশাসকদের অযোগ্যতা বা মোসাহেবিপনার কারণেও বহু অপচয় হয়, অনেকে খেতে পায় না। 

শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের অনেকে চায় সব কিছু হোক আইনমাফিক। সে ব্যবস্থা কেবল রাষ্ট্রব্যবস্থাই করতে পারে, যদি না রাষ্ট্র ভিন্ন কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে নিজের তৈরি ব্যবস্থাগুলি নিজেই ভাঙতে উদ্যোগী হয়। দুঃখের হলেও সত্যি যে, কেবল আপৎকালীন সময়ে নয়– অন্য সময়েও অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্র ইচ্ছে করেই বা উদ্দেশ্য নিয়ে (নিজেদের গড়া) নিয়ম ভাঙ্গে, আর অনেক মালিক তো জেনেবুঝেই, কিছু ক্ষেত্রে রাষ্ট্র বা রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কর্তাদের হিসেব করা উদাসীনতার সুযোগ নিয়ে বিধি-নিয়ম অগ্রাহ্য করে। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও সাধারণ মানুষ বিপদে তাদের পাশে থাকে কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই। এতে সর্বদা লাভ হয় এমন নয়।

একালে যেন কেবল অহিংস সদিচ্ছায় কাজ হয় না। তাতে অনেকে লড়াই করার মানসিক জোরটুকুও হারায়। এর মানে কিন্তু এই নয় যে সহিংস হলেই সমাধান মিলবে।

আমরা পরিযায়ীদের দুটো অংশে ভাগ করি: ১) স্থায়ী ও ২) অস্থায়ী বা সাময়িক। মনে রাখতে হবে, পরিযায়ীরা সর্বদা শ্রমিক নাও হতে পারে। তাঁরা সাধারণত মধ্যবিত্ত ভাবনা ও শ্রেণি বদলের স্বপ্ন নিয়ে বাঁচেন। যথা ছাত্র, দেহোপজীবী ও চাকুরিজীবী সম্প্রদায়। এদের মধ্যে কিছু শিল্পী ও তথ্যপ্রযুক্তির ঠিকাকর্মীও আছেন।

পরিযায়ীদের জন্য যে আইন আছে তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত হলেই তাদের সমস্যা অন্তত কিছুটা মেটে। তা তো হয় না। কেবল শিশু বা নারী নয়, এই সাময়িক পরিযায়ী গোষ্ঠীর সকলেই কোনও না কোনও ভাবে ঘরে-বাইরে বিবিধ সমস্যায় জর্জরিত। তাই সব সাময়িক পরিযায়ীদের নিয়ে সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রয়োজন। নানাবিধ সামাজিক, প্রাকৃতিক, শারীরিক কারণে মহিলা ও শিশুরা পরিস্থিতির শিকার হয় বেশি। তাই, আপাতত আমরা সাধারণভাবে তাদের সকলের সুরক্ষায় যা করা উচিত তা নিয়ে ভাবি। সমস্যার চরিত্র যেহেতু প্রায় অভিন্ন তাই তার সমাধানও নারী-পুরুষ-শিশু নিরপেক্ষ। কিছু পরিযায়ী দেশ বা রাষ্ট্রের সীমানাও পার হয়। তাদের এই আলোচনায় টানা হয়নি।

এখন তাকানো যাক কিছু জরুরি কাজের দিকে:

ক) পঞ্চায়েত ও পৌরসভাগুলো সকলের জন্য সুরক্ষা কার্ড বানাক যাতে থাকবে ১) নাম ২) অভিভাবকের নাম ৩) ঠিকানা ৪) পঞ্চায়েতের ঠিকানা ও ফোন নম্বর। প্রত্যেককে এই কার্ড দেওয়া হোক। কেউ অপহৃত হলে বা হারিয়ে গেলে এই কার্ড দেখে কোনও ব্যক্তি বা সংস্থা তাদের স্বস্থানে ফিরতে সাহায্য করতে পারবে সহজে। 

খ) যাওয়া ও আসার ক্ষেত্রে পরিযায়ী কর্মী ও শিশুদের নাম নথিভুক্ত করা হোক। নথিভুক্তিকরণে কারণ জানার প্রয়োজন নেই।

গ) এই কার্ডে জল ও স্থলপথে পরিবহনে সুবিধা দিতে হবে।

ঘ) শিক্ষা দফতর স্কুলগুলিকে নির্দেশ দিক যাতে পরিযায়ী কর্মী ও শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ সহ (জাতীয় শিক্ষানীতিতেও মাতৃভাষায় শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, যদিও সেখানে পরিযায়ীদের সমস্যার কোনও উল্লেখ নেই) ভর্তি, ট্রান্সফার সার্টিফিকেট পেতে অসুবিধা না হয়। ভ্রাম্যমান বিদ্যালয় তৈরি করা হোক যেখানে মিড ডে মিল-সহ শিশুদের শ্রী ফেরাতে প্রাপ্য সব সুবিধা নিশ্চিত হবে। অনেক জায়গায় দেখেছি, বিশেষত ডুয়ার্স ও জঙ্গলমহলে, বন্য জন্তুর আক্রমণে শিশুদের জন্য স্থিরীকৃত সব আয়োজন নষ্ট হয়ে গেছে। সরকার (বন দফতর পরিচালিত সব স্কুলেরই হাল অবশ্য বেশ খারাপ, তাদের উদ্যোগ নিয়ে কিছু বলার প্রয়োজন নেই) ও বেসরকারি উদ্যোগ পরিচালিত এমন কিছু স্পেশ্যাল স্কুল আছে বটে, সেগুলি নগণ্যপ্রায়। নিয়োগকারীরা অশিক্ষার সুযোগ যাতে না নিতে পারে তার জন্য পরিযায়ীদের সুশিক্ষার আয়োজন নিশ্চিত করা অতি জরুরি।

ঙ) স্বাস্থ্য দফতরকেও ভ্রাম্যমান হাসপাতাল বানাতে হবে পরিযায়ী কর্মী ও শিশুদের জন্য। তাদের অতি দ্রুত (এক সপ্তাহের মধ্যে) বয়স, টীকাকরণ ও প্রতিবন্ধী শংসাপত্র দিতে হবে। জননী সুরক্ষা ইত্যাদি কল্যাণমূলক প্রকল্প তাদের জন্যও বাস্তবে চাই। আইন তো আছে, কিন্তু বহু ব্লকে গাড়ির অভাবে নাকি আইন প্রয়োগে অসুবিধা হচ্ছে! জঙ্গলমহল বা চা-বাগান অঞ্চলে কিছু হাসপাতাল আছে যেখানে তুলো, ব্যান্ডেজ, জ্বর বা পেটের গণ্ডগোলের ওষুধ ছাড়া তেমন কিছু মেলে না।

চ) রাজ্য শ্রম দফতরকে NCLP (National Child Labour Project) স্কুল চালানোর পূর্ণ উদ্যোগ নিতে হবে, কেন্দ্রীয় সাহায্যের ভরসায় না থেকে। কেন্দ্র এই প্রকল্প থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়। তাই বুঝি ২০১৬-র পর NCLP স্কুল বিষয়ক তথ্য অমিল। শিশু সুরক্ষা ও মহিলা কমিশন এই তথ্য সংগ্রহের কাজ হাতে নিক। মানবাধিকার কমিশনকে পাশে নিয়ে শ্রম দফতরকে দেখতে হবে যে পরিবেশের ক্ষতি না করে সব পক্ষ কোম্পানি/ফ্যাক্টরি আইন মানছে কিনা।

ছ) ১০০ দিনের কাজে শিশুদের ব্যবহার নিষিদ্ধকরণ নিশ্চিত করতে হবে। তদারকির ভার নিক শিশু সুরক্ষা কমিশন।

জ) রেলওয়ে প্ল্যাটফর্ম নানা দুর্নীতির আখড়া, যৌন নির্যাতন, মাদক ও শিশু পাচার ইত্যাদি প্রতিরোধে রেল দফতরকে সক্রিয় হতেই হবে। আমাদের প্রার্থনা ওরা যেন অন্তত সুপ্রিম কোর্টের আদেশটুকু কার্যকর করে।

ঝ) শিশু শ্রম আইনের সংশোধন প্রয়োজন। সে আইন নানা কারণে বিপদজনক ও শিশু শিক্ষার পরিপন্থী। এই আইনে জাতীয় শিশুনীতি, UNCRC ইত্যাদির বেশ কিছু ধারা লঙ্ঘন করা হয়েছে। NCPCR ও SCPCRগুলিকে এই আইন সংস্কারের কাজে সক্রিয় হতে হবে।

ঞ) যে কোনও সামাজিক সুরক্ষা তথা কল্যাণ প্রকল্পে পরিযায়ী নারী ও শিশুদের অগ্রাধিকার দিতেই হবে। যে কোনও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের অন্তত ২৫ শতাংশ এই শ্রেণির জন্য সংরক্ষণ প্রয়োজন। সেই সুবিধা তদারকির ভার নিক DCPS। এদের প্রত্যেকের PDS ব্যবস্থার অধীনে আসার অধিকার স্বীকার করে নিতে  যোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ট) বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধনে DCPSগুলিকে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে তাদের কিছু প্রশাসনিক ক্ষমতা দিতে হবে এবং উন্নত মানের কাজ পেতে তাদের চাকরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ভাড়াটে সৈন্য দিয়ে যেমন যুদ্ধ জয় করা যায় না তেমন চুক্তিবদ্ধ কর্মচারী দিয়ে কর্ম সম্পাদন হয় না। জেলা আধিকারিকরা যেন DCPS কর্মীদের অন্য কাজে নিয়োগ না করেন।

ঠ) উদ্ধার হওয়া শিশুদের জন্য পৃথক সরকারি হোম গড়া একান্ত জরুরি। এমন হোমে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টির আয়োজন যেন নিশ্চিত হয়। উদ্ধার হওয়া শিশু ও মায়েদের ICDS প্রকল্পের আওতাভুক্ত করতে হবে।

এসবই তো ন্যূনতম কাজের তালিকা। আরও অনেক কাজ করতে হবে শিশু ও মহিলা পরিযায়ীদের মানুষের মতো বাঁচাতে চাইলে। রাজ্য স্তরে বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও NGO-র মধ্যে সমন্বয়ের দায় নিক শিশু সুরক্ষা, মহিলা সহ সব অধিকার রক্ষা কমিশন। কান্নাকাটি বা নিছক সমবেদনায় কিছু হবার নয়, নিশ্চেষ্ট নিরপেক্ষতার দিনও গত। এখন চাই দেশ জুড়ে আন্দোলন। এখনই। আইন তো অনেক, আমরা চাই আইনের নিশ্চিত পক্ষপাতহীন প্রয়োগ মাত্র। কর্তারা বলবেন, এতে খরচ বাড়বে, বলবেন না যে এতে তাদের লাভ কমবে।

তবে সমস্যা সেই একই- 'লাও তো বটে, আনে কে?'


Wednesday, 7 October 2020

লেখালেখির অন্দরমহল

একুশ শতকের বাঙালি লেখকের ভবিতব্য

অর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়


'বাইরে লোক দেখানো অ্যারিস্টোক্রাসি এবং গণতান্ত্রিক আচরণে অন্তরে বর্বরতা– এটাই তো ভবিষ্যৎ আমাদের জন্যে তুলে রেখেছে। আর এই ক্রমে, ভাবুক ও স্বপ্নদর্শী ব্যক্তিদের জীবনের উৎকর্ষতা, সম্ভ্রম ও সারল্য প্রতিপালিত হবে একজন ভুঁইফোঁড়ের প্রতিষ্ঠা, সফলতা ও খ্যাতির নমনীয়তার মানদণ্ডের ভিত্তিতে। তার চেয়েও দুর্ভাগ্যের যেটা, অর্থ ও লৌহদণ্ডের ক্ষমতার সামনে, একজন প্রকৃত আদর্শবাদী ও ভাল মানুষকে চরম একাকীত্ব ও দারিদ্রের মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে। এমনকি দাওয়াতখানার মহাভোজের দরজার বাইরে এরা ধামাধরা লোমওঠা কুত্তার মতো করজোড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হবে, যাতে অন্তত জীবনধারনের জন্য ছুঁড়ে দেওয়া সামান্য হাড়টুকু চাটতে পারে।                                                        -  শার্লস মোররে (বুদ্ধিমত্তার ভবিষ্যৎ, ১৯০৫ সাল)।

নীরদচন্দ্র চৌধুরি তাঁর আত্মজীবনী লেখা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে, তত্ত্বমূলক গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাস অনুসন্ধানে গবেষণার উপায় ও সামর্থ্য না থাকায়, তিনি নিজে যে ইতিহাসের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত করেছেন সেই অভিজ্ঞতাই লিখেছেন। আমরাও এখন এক যুগ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছি, একটা ইতিহাস যাপন করছি, হয় জেনে-বুঝে নয়তো অজ্ঞানতার সঙ্গে। 

উনিশ শতকের নবজাগরণ থেকে আজ অবধি কেটে গেছে দু’শোর বেশি বছর। বিদগ্ধজন থেকে বুদ্ধিজীবীতে উত্তরণ-অবরোহনের নানা রঙের দ্যুতি ইতিহাস যাত্রার বাঁকে বাঁকে বিস্ময় সঞ্চয় করে রেখেছে। আমরা এগিয়ে চলেছি। এই পথের কোনও শেষ নেই। কিন্তু কোনও দিশা আছে কী– সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই হবে। দিশা থাকা কি সব সময়ে জরুরি, তাই নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। অনেকে বলতে পারেন, চিত্তের দুর্দমনীয় গতিতে যা সৃষ্টি হয় সেটাই তো স্বতঃস্ফূর্ত সভ্যতার ইমারত, সুখের পরাগভূমি। মনে রাখা জরুরি, অনাবিলভাবে শুধু আগাছার বনভূমি জন্মায় যেখানে আদিম অভ্যেসে পরাভূত প্রাকৃতিক জীবকুল বসবাস করে, সুসভ্য মানুষের পক্ষে তা অনুকূল নয়। দৃষ্টিনন্দন তো নয়ই। আজকাল যদিও সভ্য মানুষের মধ্যেও আদিম প্রবৃত্তির বিনাশরূপের আনাগোনা প্রায়শই দেখা যাচ্ছে, তা হলে বলতে হয় সেটা দিশাহীনতারই লক্ষণ। অশেষ গন্তব্যে ধাবমান দিশাহীন বাঙালি সমাজে যারা দিশারী, অন্ধকারের মধ্যে আলোকবর্তিকার মানদণ্ড যাদের হাতে শোভিত অর্থাৎ লেখকগোষ্ঠী– আজ তাদের অবস্থা কীরকম? তারা কি গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানোর দল নাকি গ্রিম্পেন মায়ার থেকে নতুন ভবিষ্যতের ভাষ্য উদ্ধারকারী স্বাপ্নিক। নবজাগরণের ধারায় মানবতাবাদের নিরিখে শুধু যে সাহিত্য রচিত হয়েছিল ভুরি-ভুরি তা কিন্তু নয়। পক্ষান্তরে, ধর্ম, বিজ্ঞান, সমাজবোধ ও রাজনীতির দর্শনেও ছিল পালাবদলের অঙ্গীকার। বর্তমানে আরেক নবজাগরণের দোরে আমরা কড়া নাড়ছি। এই নবজাগরণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার। মানবতাবোধ নয়, এখন ট্রান্সহিউম্যানিজমের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাই আজকের বাঙালি সমাজে লেখক বলতে শুধু সাহিত্য শিল্পের দলদাসদের মধ্যে এলাকা ভাগ করলে হবে না, এক্তিয়ারের সীমানা বিজ্ঞান ও দর্শনের উন্মুক্ত উদ্যানেও বিস্তার করতে হবে। সাহিত্য শিল্প সমাজ প্রগতির আবশ্যিক শর্ত হতে পারে, কিন্তু তা কখনওই যথেষ্ট নয়।

একুশ শতকের (পশ্চিমবাংলায় তো দশকের লেখক শতকের কবির বিভক্তিকরণ চলতি ব্যাপার, সুতরাং এখানে কাদের কথা বলা হচ্ছে সেটা সহজবোধ্য) বাঙালি লেখকের মধ্যে মূলত দু’ ধরনের চেতনাস্তর প্রচলিত। একদল বিভ্রান্ত, আরেক দল ফাঁপা। তথাপি একটি ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী আছে, চিন্তা-চেতনায় অগ্রসরমানতার যাবতীয় উপাদান যাদের মধ্যে বর্তমান। এদের আদর্শ মূলত নীরদচন্দ্র চৌধুরি-শিবনারায়ণ রায়-সমর সেন-অশোক সেন-অশোক মিত্র-দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়-ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়-দীপেন্দু চক্রবর্তী-প্রদ্যুম্ন ভট্টাচার্য-সিদ্ধার্থ ঘোষ-দীপেশ চক্রবর্তী-আশীষ লাহিড়ী-রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য-গৌতম ভদ্র-পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের চর্চাবোধ। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের দল ভাগাভাগির প্রাবল্যে আজকাল এরা এতটাই একাকীত্ব ও উদাসীনতায় আচ্ছন্ন যে নিজের চর্যাবৃত্তের বাইরে গিয়ে উপযাচক হয়ে সমাজ-সক্রিয়তায় অংশ নিতে চায় না। বরং, যতদূর সম্ভব ভাবনাপ্রবাহের বয়ান নিভৃতে নিষ্কামভাবে লিখে যাওয়াতেই এদের সুখযাপন। কেননা, সেই লেখা প্রকাশ করার মতো প্রকাশক আজ যেমন আর নেই, তেমনই নিজের উদ্যোগে বই প্রকাশের সুযোগ থাকলেও একদিকে বিক্রির ক্ষুদ্র পরিচিত পরিসরের সমস্যা ও অন্যদিকে পাঠকের ভাঁড়ারে যে 'ভাঁড়ে মা ভবানির দশা' তাও সুবিদিত। সুতরাং, এদের আত্মপ্রকাশের প্রায় কোনও সম্ভাবনাই আজ আর পশ্চিমবঙ্গে নেই, নগণ্য কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া যাকে ধর্তব্যের অন্তর্গত না করাই শ্রেয় 

সুতরাং মূলস্রোতে ফিরে এলে দেখা যায়, লেখকদের মধ্যে যারা বিভ্রান্ত তারা দুটি উপদলে বিভক্ত। এক দল বৈষয়িকভাবে সফল, অন্য দল ব্যর্থ। বিভ্রান্ত দলটি মূলত একটি দ্বন্দ্বময়তার মধ্যে নর্তনকর্দন করে। একদিকে উনিশ শতকের মহীয়সী ঘনঘটা ও অন্যদিকে বিনয়-ঋত্বিক-শক্তির বোহেমিয়ানিজমের মধ্যেই সুনীল-শীর্ষেন্দু-জয় প্রমুখের সেলিব্রিটিসুলভ বৈভব অর্জন– এই যুগপৎ সাঁড়াশির চাপে এরা পিষ্ট। উনিশ শতকের অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে আজকের অবস্থান একেবারে আলাদা। বাঙালি এই অর্থনৈতিক ভোলবদলের মধ্যে দেখেছে বঙ্কিম যুগ–রবীন্দ্র যুগ–কল্লোল যুগ। এই উন্মেষপর্বের জোয়ার কাটতে না কাটতেই বাঙালি সমাজে আছড়ে পড়েছে বামপন্থী-অতিবামপন্থী ভাবধারার প্রাধান্য। এই ভাবধারার সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার মৌলিক চেষ্টায় একদিকে মানিক-সতীনাথ-কমলকুমার-মহাশ্বেতা-সন্দীপন-নবারুণ প্রমুখের সাহিত্যবীক্ষা, অন্যদিকে শরদিন্দু-সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশ-বুদ্ধদেব-জয়ের সাহিত্যখ্যাতি বাঙালির মননকে তোলপাড় করেছিল। এর মধ্যে থেকে সন্তোষ ঘোষ-শঙ্খ ঘোষ-অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-ভাস্কর চক্রবর্তী-নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-দেবেশ রায়-রামকুমার মুখোপাধ্যায়-মলয় রায়চৌধুরির ঘরানা অন্য ধারার, সে জন্য পূর্বোল্লিখিত ক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বাঙালি পাঠক ও একুশ শতকের কবি-লেখক যশোপ্রার্থীদের মধ্যে এই ব্যাপ্তির কোনওটাকেই প্রত্যাখ্যান বা উপেক্ষা করার মতো স্পর্ধা কারও নেই– এমনই ছিল লেখনির গুণমান এবং সংখ্যার বিশালত্ব। কিন্তু এর মধ্যে একটা সংঘর্ষও ছিল– প্রাতিষ্ঠানিকতা বনাম প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা। ফলে, প্রাতিষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সাহিত্যের বাজার শাসনের বাণিজ্য কৌশল ও প্রচারের মধ্যেই দেখা গিয়েছিল একটি উলটো স্রোত: লিটল ম্যাগাজিন। এই দ্বৈরথ ছিল জমজমাটি। পণ্য সাহিত্য বনাম মৌলিক সাহিত্য কীর্তির দুই যুযুধান পক্ষের মধ্যে থেকে কোনটা বাঙালি সংস্কৃতি ও রুচিবোধকে নিয়ন্ত্রণ করবে সেটাই ছিল দেখার। কেননা দুটোর মধ্যেই কিছু না কিছু মর্মবস্তু ছিল– তা ভোগবাদ সর্বস্ব লঘুকরণের হোক কিংবা গুরুগম্ভীর তেজস্ক্রিয় বিকিরণের। 

কিন্তু, ইত্যবসরে উদার অর্থনীতিবাদ ও প্রযুক্তির আবির্ভাবের মধ্যে দিয়ে যে নয়া-বিনোদনের দুয়ার খুলে গেল তা একুশ শতকের লেখকদের মধ্যে জাগ্রত করল এক বিশাল বিভ্রান্তি। এই নয়া-বিনোদনকল্প পণ্য সাহিত্যের অন্তরেও যে শুদ্ধতা ছিল তাকে তো খোলাবাজারে খোলামকুচি করলই, সঙ্গে সঙ্গে পণ্যায়ন-সংস্কৃতির স্তম্ভ মজবুত করার জন্যে এমন এক প্রশ্ন জনমানসে প্রচার করল যে একুশ শতকের লেখকের মনে একটি সংশয় দেখা দিল। আসলে লেখক ‘যেমন ব্যষ্টির প্রকাশ, তেমনই সমষ্টিরও অন্তর্ভুক্ত’, ফলে সেও ভাবল যে, মহৎ সৃষ্টির মধ্যে দিয়ে নিজের সময়ে যদি পয়সা করা কিংবা পাঠকের কদর পেয়ে বিখ্যাত হওয়াই না যায় তবে তার বিশিষ্টতা প্রমাণ হবে কী করে? এভাবেই সে এক চূড়ান্ত বিভ্রান্তির পথে পা বাড়াল– সে চর্চাহীন বোহেমিয়ানিজমকে গ্রহণ করল একদিকে, অন্যদিকে হাত বাড়াল দিশাহীন বাজার-নিয়ন্ত্রিত সৃষ্টির ভুলভুলইয়াতে। এখন সে আত্মসংযম, ইতিহাস-চেতনা, বিশ্ববীক্ষা ও প্রাজ্ঞতার মুক্তমনা সারস্বতচর্চার পরিশ্রমের চেয়ে ভাবের ঘরে চুরি করে ভিজে বেড়াল সেজে থেকে কার্যসিদ্ধির উপায় সন্ধানে নিবেদিতপ্রাণ হয়েছে। যেন জাতে মাতাল তালে ঠিক। অনেকে এদের প্রফেশনাল রাইটার বলে আখ্যায়িত করেন। আগেও এই প্রফেশনাল রাইটার ছিল। তবে আগের যুগের সঙ্গে এ যুগের পার্থক্য কিছুটা আগের যুগের বাইজি প্রথার সঙ্গে এ যুগের গণিকাবৃত্তির মতো হয়ে গেছে। আর এই প্রফেশনালিজমের ও পিঠে যেহেতু থাকে আত্মার ইচ্ছাকে বিসর্জন দিয়ে বাছবিচারহীন খরিদ্দারের দাবি মেটানোর আর্জি, সেহেতু ঘোমটার আর কোনও বালাই-ই আজ আর নেই। কোনও বিখ্যাত প্রকাশনা থেকে কটা বই আর খবরের কাগজে কিংবা বোকাবাক্সের পর্দায় ক’বার দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেটিয় ধাঁচায় চকচকে সিভি প্রস্তুতির সে হিসেবে এখন লেখকরা বেশ পাকা হয়ে উঠেছেন ও সদর্পে ঘোষণাও করছেন। আফসোসের বিষয় এই যে, লিটল ম্যাগাজিনও এখন আর নিজেকে এই চোরাস্রোত থেকে রক্ষা করতে পারছে না। তারাও এখন হয় উনিশ শতক নয় নকশালবাড়ির মধ্যে প্রগতিশীলতা খুঁজছে ও বিভ্রান্ত হচ্ছে। ‘সাহিত্যের ইয়ারবুক’ খুললেই প্রায় দু’ হাজার পত্রিকার সন্ধান পাওয়া যাবে কিন্তু তার মধ্যে ক'টা পত্রিকা লিটলের ধর্ম-প্রবৃত্তি-চরিত্র অনুযায়ী কাজের কাজ করছে আর ক'টা যে-লেখকের লেখা কোনও পত্রিকাতেই ছাপানোর যোগ্য নয় কিন্তু তার সম্পাদনায় প্রকাশিত হচ্ছে, সে তথ্যতল্লাশ হৃদপীড়া ছাড়া আর কিছুই যে দিচ্ছে না। এরকমভাবেও যে সকলেই সফল হচ্ছে তা নয়। ব্যর্থদের তালিকাতে জমছে শুধুই তিতিবিরক্ত গ্লানিময় ক্ষোভ ও ক্রোধের খিস্তি-খেউড়ে নষ্ট জীবনের আখ্যানএ কথা এরা বুঝতেই পারছে না যে, বিভ্রান্তির স্থবির বৈকল্য আর অতীত ভাঙিয়ে পয়সা করার মনোভাব দিয়ে বৌদ্ধিক মুৎসুদ্দি থেকে মহাজন স্তর অবধি পৌঁছনো যায় কিন্তু পরিতৃপ্তিময় রসেবশে থাকা সৃষ্টিশীলের আনন্দের জীবন পাওয়া যায় না। এই গেল গেল রব কান পাতলেই বুকের ভেতর থেকে শোনা যায়।

অন্যদিকে, ফাঁপা দলটির মধ্যে কেবলমাত্র অসংযত আবেগের ছলাৎ-ছলাৎ আর জীবনে হতাশার দগদগে ঘা। যারা জীবনে কোনওদিন ‘স্বপনকুমারের রহস্যের বই পড়েনি’ তারাও আজ সাহিত্যশিল্পের পথে এসে স্লোগান দিচ্ছে ‘পাশ করিয়ে দেবার’। এটা দেখে বলা যায় যে, যতদিন এ দেশে গণতন্ত্রের একটা ধরতাই খোলস ও অপার্থিব সামাজিক মাধ্যম পরিচালনার জন্য দৈনিক আন্তর্জালিক অধিকোষস্থিতি বিদ্যমান ততদিন এদের প্রাধান্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে। জনজীবনে এমনিতে যে পরিমাণ নিরাপত্তাহীনতা দেখা যাচ্ছে– অর্থাৎ ডিগ্রিধারীর চাকরি নেই, ডাক্তারি পড়ে সম্মান নেই, ওকালতি পড়ে পসার নেই, ছোট ব্যবসার বাজার আর বড় ব্যবসার পুঁজি নেই কিন্তু বিলাসিতার পণ্যসামগ্রীর প্রদর্শনীতে ঘাটতিও নেই– তাতে করে নিজের বাজার দর বা কদর, পারতপক্ষে, নিজের চোখে বজায় রাখার একমাত্র পন্থা হল খোলা সাহিত্যের বাজারে ‘লাইক-কমেন্ট-শেয়ারের’ খ্যাতিলাভ। যাতে বোঝা যায় কিছু না কিছু তো করছে, অর্থাৎ বিপন্নতার খড়কুটোখানি হল এইরকম যে, 'যে লোকটা কোনো কর্মেরই নয় ঠাকুর তাহাকে বসিয়া থাকিতে দেন না, পাছে সে মাটি হইয়া যায়। যতরকমের বাজে কাজ করিবার ভার তাহারই উপরে।' আর এখানে সেই বাজে কাজটা হল Gone with the wind-এর মতো Trend-এ ভেসে যাওয়াআবার এ কথাও ঠিক যে, মূর্খের একপ্রকার সারল্যও থাকে, সাহসও থাকে আর চতুরের একদিকে থাকে মেকি বিনয় আর অন্যদিকে কানিং অ্যান্ড শ্রুডের মনোভাবযাদের মধ্যে সারল্য আছে তাদের ক্ষমা করা যায়, ভালোবাসা যায়। কেননা সাহসের বশে এরা অনেক সময় প্রতিবাদী হয়ে ওঠে এবং সমাজের এমন কিছু বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধে চেঁচামেচি করে যে একটা হুলুস্থুল ব্যাপারের অন্তত উপক্রম হয়। কিন্তু যারা চতুর তাদের বিনয়কে সহ্য করা আর ধূর্ততাকে শ্রদ্ধা করার মতো অন্যায় আর কিছুতে নেই। এরা হচ্ছে সেই কালসর্প যা সমাজের যাবতীয় যা কিছু মঙ্গলময় চেতনা তাকে বেচে দিয়ে আসতে পারে ও নামিয়ে আনতে পারে একটা সর্বনাশ।

এমতাবস্থায়, তাহলে কি আমরা বাংলা সাহিত্যে আরেক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করতে চলেছি? ওয়াকিল আহমদ অন্ধকার যুগ সম্বন্ধে লিখেছিলেন- 'বাংলা সাহিত্যের কথিত ‘অন্ধকার যুগ’ মোটেই সাংস্কৃতিক বন্ধ্যাত্বের যুগ ছিল না। ধর্ম-শিক্ষা শিল্প চর্চার দায়িত্ব যাদের উপর ন্যস্ত ছিল, তারা সীমিত আকারে হলেও শিক্ষা সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। তবে, কি হিন্দু কি মুসলমান কেউ লোকভাষা বাংলাকে গ্রহণ করেননি। বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন না থাকার এটাই মুখ্য কারণ।' আর নয়া-অন্ধকার যুগে কি তবে বণিকি ইংরেজি-হিন্দির প্রভাব এবং বাংলায় একদিকে অতিলিখনের জঞ্জাল ও পক্ষান্তরে মূল্যবান রচনার নির্বাসন-আত্মগোপনে প্রকৃত মননকে মানুষ প্রত্যাখ্যান করবেন? তাহলে কি খড়ের গাদায় সূচ অনুসন্ধানের মতো করে একদিন চিন্তাশীল, মৌলিক সাহিত্য ভবিষ্যতের কোনও গবেষককে এই সময় থেকে খুঁজে নিতে হবে? এই কি তবে বিধিলিপি? এটা শুধু ভাবনার বিষয় নয়, মাঝে মাঝে কান্নারও আক্ষেপ হয়ে দাঁড়ায়।

প্রশ্ন হল, বিভ্রান্ত, ফাঁপা ও নির্বিকার গোষ্ঠীর মধ্যে থেকে সতেজ-টাটকা মনস্বীর দেখা মিলবে কী করে? আশীষ লাহিড়ী তাঁর ‘এই পঙ্ক কালচারের হেজিমনি ভাঙুন’ নিবন্ধে লিখেছেন যে, 'প্রথম কর্তব্য হল অবস্থার ভয়াবহ বহুমাত্রিক জটিলতাটা বোঝা। ... (এবং) মূলস্রোত-বাহিত পাঁকের বিপরীতে যত ছোট আকারেই হোক, আমাদের আসল সংস্কৃতির চর্চা বাড়ানো দরকার। কেরিয়ার করার জন্য নয়, মিডিয়ার শরণ না নিয়ে, নিছক ভালোবেসে। আমি নিশ্চিত যে, যে কোনো শুদ্ধ সংস্কৃতির নিবিষ্ট চর্চাই এই পঙ্ক-কালচারকে ঘা দেবে। যদি প্রতিনিয়ত আমরা প্রমাণ করতে পারি যে নিছক প্রকরণগত দিক থেকেও আমরা এই মুৎসুদ্দি বিকার-সংস্কৃতির চেয়ে বহুগুণে শ্রেষ্ঠ, সুরটা আমরা ঠিকঠাক লাগাতে শিখি, সম্-টা আমরা ঠিকঠাক জায়গাতে ফেলি, শুধু কারাওকে আর সিন্থেসাইজারের ভরসায় গান গাই না – তাহলে সমাজের ওপর তার একটা প্রভাব পড়তে বাধ্য।' নইলে স্বঘোষিত কবি-লেখকের সংখ্যাবৃদ্ধি হবে মাত্র, গুণপনা-প্রতিভা যে তিমিরে সে তিমিরেই রয়ে যাবে। 

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, সমাজে প্রকৃত কবি-লেখকের পরিচয় কী, চরিত্রই বা কেমন? জয়া মিত্র একবার মহাভারত অনুসরণ করে বলেছিলেন যে, আত্মাকে দহন করে যিনি অস্থি প্রজ্বলিত করেন তিনিই কবি। একুশ শতকের বাঙালি লেখকের মধ্যে আজ মূলত কবি, তারপরে গল্পকার-ঔপন্যাসিক এবং সর্বশেষে প্রাবন্ধিকের দেখা মেলে। কিন্তু ক’জন আত্মাকে দহন করে অস্থি প্রজ্জ্বলন করেন সে কথা আমাদের জানা নেই। প্রকৃত লেখকের ধর্ম কী হওয়া উচিত তা নিয়ে বিতর্ক নেই। দুটি চরম বিপরীত চিন্তাধারার মধ্যেও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমী ভাবে মিলমিশ দেখা যায়। এই প্রসঙ্গে একদিকে মার্কস'এর ধারণা ও অন্যদিকে মার্কস-বিরোধীর ধারণা কী ছিল সেটা জেনে নেওয়া যাক। অ্যান্ডি ব্লুডেনের অনুলিখনে জানা যায় যে, 'Artistic creation is one of the ways of reflecting reality and, at the same time, of perceiving and apprehending it; it is also one of the strongest levers of influencing the spiritual development of humanity. The author of genuinely realistic works communicates his ideas to the reader not by didactic philosophising, but by vivid images which affect the reader’s consciousness and feelings by their artistic expressiveness.'অন্যদিকে নীরদচন্দ্র চৌধুরি বলেছেন যে, 'উপনিষদ, গীতা, কালিদাসের কাব্য, হোমার, এস্কিলাস, সোফোক্লেস, ইউরিপিডিস, প্লেটোর রচনা ছাপাখানার অস্তিত্বের অপেক্ষা না রাখিয়াও বাঁচিয়া আছে। সুতরাং, লেখক নশ্বর হইতে পারে, অমরও হইতে পারে। অমর হয় যাহারা পাঠকের চরিত্র ও মনকে গঠিত বা পুনর্গঠিত করিতে পারে; আর নশ্বর হইয়া যায় তাহারাই যাহারা জনসাধারণের আমোদের উপকরণ জোগায়।'

উদার-অর্থনীতি, খোলা বাজার ও প্রযুক্তির যুগে দুনিয়া যেখানে মানুষের পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রকে (যা মস্তিষ্কের মাধ্যমে ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিকে নির্ধারণ করে) বদলে দিয়ে মানবিকতর প্রজন্মের দিকে হাত বাড়িয়ে সাফল্য পেয়ে গেছে এবং এই ট্রান্সহিউম্যানিজমে ন্যানো প্রযুক্তি, জৈব প্রযুক্তি, তথ্য প্রযুক্তি এবং ইন্দ্রিয়তর বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ ঘটিয়ে অন্য দুনিয়ার জবানি রচনা চলছে, সেখানে একুশ শতকের বাঙালি লেখকের মন যদি শুধুমাত্র ঘ্যানঘ্যানে সিরিয়ালের মতো দিশাহীন দৌড় লাগাতে থাকে আর এখান থেকে সেখান থেকে অতীত ঘেঁটে এনে ভাবে চমক লাগিয়ে দিয়েছে, তবে আগামী পৃথিবী আমাদের স্রেফ কনজিউমারিজমের দাসত্বে বন্দি করবে। সিমুলেটেড বাস্তবতা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, অতিমানববুদ্ধি, থ্রি-ডি বায়োপ্রিন্টিং, মাইন্ড আপলোডিং, রাসায়নিক মস্তিষ্ক সংরক্ষণ এবং ক্রোনোনিক্সের মতো অত্যাধুনিক ব্যবস্থাপনার আঙ্গিকে লেখককে ভবিষ্যৎদ্রষ্টার স্বজ্ঞা অর্জন করতে হবে এবং জীবনের উত্থানপতনের নতুন ভাষায় জনমনকে দিতে হবে আবেগমথিত নাড়া। টি-২০ জ্যোতিষ সেজে থাকার দিন চলে গেছে। কেননা মানুষের মনে এখন শুধু অতীত ঐতিহ্যের মূর্তিপুজোটুকু আছে, চৈতন্যের ঘোরখানি আছে কিন্তু যাপনে বাস্তবায়ন নেই। তাই প্রতি মুহূর্তে আরও বেশি করে মুনাফাবাজের রক্ষণশীল সংস্কৃতির সঙ্গে লড়াই করে রক্ষা করতে হবে প্রগতিবাদকে। মনে রাখতে হবে, বাজার সব সময়ে মূর্খ ক্রেতা তৈরির পক্ষে কাজ করে, তা ক্রেতা নিজেকে যতই চালাক ভাবুক, বাজার তাকে বোকা বানাবেই। একইভাবে সে পাঠকমনেও অনুপ্রবেশ করাতে চায় খরিদ্দারের চরিত্র ও সংস্কৃতি। লেখকের কাজই তো পাঠককে এই দানবীয় অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা করা। এটাই চিরকালের দ্বন্দ্ব। শুধু যুগে যুগে নতুন অভিধায় ফিরে আসে। মার্কস বোধহয় এ জন্যই বলেছিলেন, 'Capitalist production is hostile to certain branches of spiritual production, for example, art and poetry.'তাই-ই সন্ধান রাখতে হবে বিশল্যকরণীর। মনে রাখতে হবে যে, শিল্পই হল একটি 'important weapon in the ideological struggle between classes.'। 

সুতরাং, ব্যতিক্রমী শিল্পের দ্বারাই ধ্বংস করতে হবে অবক্ষয়ের অলাতচক্র। খেলোয়াড়-সঙ্গীতশিল্পীর মতো বিখ্যাত হবার বাসনা নিয়ে সেই সাধনার ফললাভ অসম্ভব। হয় ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাও নইলে আগাছার মধ্যে থেকেই বটবৃক্ষ হয়ে ওঠার নিমগ্ন চর্চায় মনোনিবেশ কর। ধৈর্য, স্থৈর্য ও প্রজ্ঞার গভীর সমুদ্রে যাওয়া প্রাকটিস কর, খ্যাপার মতো পরশপাথর খুঁজে ফিরলেই একদিন উদ্ভাসিত হবে অন্য দিগন্ত, বিকল্প ও আনকোরা চিন্তার হীরকখণ্ড। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোটগল্প ‘বোষ্টমী’-তে বলেছেন, 'আমি লিখিয়া থাকি অথচ লোকরঞ্জন আমার কলমের ধর্ম নয়।' স্রোতে ভাসা নয়, স্রোতের বিপ্রতীপে যাত্রাই হোক ভবিতব্য। এটা প্রার্থনা করি কিন্তু জানি যে, 'কামারের এক ঘায়ে অবস্থাটা একেবারে বদলে ফেলতে হলে যে-প্রজ্ঞাশীল রাজনৈতিক আন্দোলন ও সংগঠন চাই, সে জিনিসের সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে (নেই)। আপাতত ‘ওদের’ মুৎসুদ্দি সংস্কৃতির হেজিমনি ভেঙে কিছুটা পরিসর দখল করতে পারলেই মনে করব ‘অনেক দিয়েছ নাথ’।' 

 

গ্রন্থপঞ্জী:

1.    ১) আমার দেবোত্তর সম্পত্তি: নীরদচন্দ্র চৌধুরি

2.    ২) সংস্কৃতির বাংলা বাজার: আশীষ লাহিড়ী

3.    ৩) প্রবন্ধ সংগ্রহ: দীপেন্দু চক্রবর্তী

4.    ৪) নারীর পৃথিবী নারীর সংগ্রাম: সুপর্ণা লাহিড়ী বড়ুয়া

5.    ৫) L'avenir De L'intelligence: Charles Maurras

6.    ৬) গল্পগুচ্ছ: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

7.    ৭) Marx and Engels on Literature and Art – (Transcribed by) Andy Blunden.

তথ্যসূত্র:

1.    https://en.wikipedia.org/wiki/Transhumanism

2.    https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE_%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AF

Monday, 5 October 2020

কৃষ্ণগহ্বরে গণতন্ত্র!

অশ্বমেধের ঘোড়া ছুটছে

সোমনাথ গুহ

কখনও একটা শুভ সংকটের অপচয় হতে দেবে না- কথাটি বলেছিলেন ইংল্যান্ডের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী উইন্সটন চার্চিল। কবে, কখন, কোথায় এবং কী পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কথাটি বলেছিলেন তা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, কিন্তু আমাদের সে নিয়ে মাথা ঘামানোর কোনও প্রয়োজন নেই। কারণ, সেটা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়শুভ সংকট’ কথাটি একটি Oxymoron, বিরোধাভাস। সংকট আবার শুভ হয় কী করে! হয় বৈকিশাসক দলের পক্ষে বেশ হয়। কোভিড১৯'এর সংকট দেশের শাসক দলের পক্ষে যে এক অতীব শুভ পরিস্থিতি তৈরি করে দিয়েছে সেটা নিয়ে কি কোনও সন্দেহ আছে? লকডাউনের পর গত ছয় মাসে কেন্দ্রীয় সরকার কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে, তার একটা খতিয়ান প্রস্তুত করা যেতে পারে। এই পদক্ষেপগুলির গুরুত্ব অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী, যা ভারতীয় রাষ্ট্রের চরিত্রের আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে। এখানে আমরা কৃষি আইন, শ্রম বিধি এবং জাতীয় শিক্ষানীতি নিয়ে কোনও আলোচনায় যাব না, কারণ এগুলি ইতিমধ্যেই বহু চর্চিত। বাকিগুলি মূলত খসড়া, প্রস্তাব, পরিকল্পনার স্তরে আছে, দু-একটি ক্ষেত্রে আইন প্রণয়নও হয়ে গেছে। প্রতিটিতে সংক্ষিপ্ত মতামত দেব, বিস্তারিত আলোচনা স্বাভাবিকভাবেই সম্ভব নয়।

·         ইআইএ (এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট): বলা হচ্ছে এটি শুধুমাত্র খসড়া। চল্লিশটি শিল্প চিহ্নিত করা হয়েছে যেগুলির পরিবেশ মন্ত্রকের ছাড় প্রয়োজন হবে না। এর মধ্যে আছে বালি খনন ও উত্তোলন, সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র, রাসায়নিক সার, ২৫ মেগাওয়াট অবধি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র, ছোট ও মাঝারি সিমেন্ট কারখানা, রংয়ের কারখানা ইত্যাদি। আগে যে কোনও প্রকল্প রূপায়ণের আগে এলাকার বাসিন্দাদের সাথে আলোচনার জন্য ৩০ দিন সময় দেওয়া হত, সেটা এখন হবে ২০ দিন। এর নোটিশ জারি করা হয় হিন্দিতে যা স্থানীয়দের ক্ষেত্রে জানতে বুঝতে প্রবল সমস্যা সৃষ্টি করে, তাই সময় কমে যাওয়ার অর্থ এলাকার বাসিন্দাদের মতামতের গুরুত্বও কমে যাওয়া। মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোনও কারখানা দূষণ ছড়ালে স্থানীয় মানুষের অভিযোগ গ্রাহ্য হবে না। সেই কারখানা নিজেরা মন্ত্রককে জানালে তাহলেই পদক্ষেপ নেওয়া হবে! মন্ত্রকের ছাড় না নিয়ে যদি কোনও প্রকল্প চালু হয়ে যায় তবে তারা পরে অনুমতির জন্য আবেদন করতে পারবে। প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়া হবে না। আগে ছিল অনুমতি নিয়ে তবেই প্রকল্প শুরু করা যাবে। গত ১১ অগস্ট অবধি ইআইএ-র ওপর মতামত জানানোর সময় নির্ধারিত ছিল এবং জানা যাচ্ছে পরিবেশ মন্ত্রকের কাছে প্রায় ১৭ লক্ষ মতামত এসেছে যার মধ্যে ২ লক্ষ এই খসড়া নিয়ে ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছে। মন্ত্রকের সেক্রেটারি জানিয়েছেন, মতামতগুলি ঘুরেফিরে প্রায় একই এবং নতুন করে আলোচনার কোনও সম্ভাবনা নেই।

·         ৪১টি কয়লা ব্লক নীলামে চড়ানো হল: সরকার বলছে এতে প্রায় আড়াই লক্ষ নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। এই ব্লকগুলি ছত্তিশগড়, ঝাড়খন্ড, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে অবস্থিত। ১৪টি ব্লক নো-গো-জোন অঞ্চলে, অর্থাৎ বিশুদ্ধ এলাকা যেখানে অরণ্য, জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয় এমন কোনও কিছু করা যাবে না। এর আগে কয়েকবার চেষ্টা হয়েছে কিন্তু স্থানীয়দের আপত্তির কারণে বাতিল হয়ে গেছে। দুটি ব্লকে ব্যাঘ্র প্রকল্প ও জাতীয় উদ্যান অবস্থিত। প্রথম তিনটি রাজ্যের প্রত্যেকটিতে ৮০০০-১০০০০ মানুষ উৎখাত হবে। ঝাড়খণ্ডে ৩০-৩২টি গ্রামের মানুষকে অন্যত্র সরে যেতে হবে। শুধু ছত্তিশগড়েই ২৫-৩০ লাখ গাছ ধ্বংস হবে।

·        ন্যাশানাল ডিজিটাল হেলথ মিশন: সবার জন্য স্বাস্থ্য কার্ড যাতে প্রত্যেকের শরীর স্বাস্থ্যের ঠিকুজি কোষ্ঠী লেখা থাকবে। উদ্দেশ্য? যাতে রোগী সহজে সঠিক চিকিৎসক চিহ্নিত করতে পারেন, অ্যাপয়েনমেন্ট ঠিক করতে পারেন, তাঁর পারিশ্রমিক জানতে পারেন, অযথা হাসপাতালে হন্যে হয়ে না ঘুরে বেড়াতে হয়। চিকিৎসকও এক নজরে রোগীর অবস্থা জেনে নিতে পারেন। যেখানে চিকিৎসক, শয্যা, স্বাস্থ্যকর্মী বিপুল ভাবে অপ্রতুল সেখানে কার্ড দিয়ে কী হবে! উদ্দেশ্য হচ্ছে, তথ্যভান্ডার তৈরি করা যাতে মানুষের ওপর নজরদারির পথ আরও সুগম হয়। এটা আরোগ্য সেতু অ্যাপের পরিবর্ধিত রূপ ছাড়া কিছু নয়।

·         এক জাতি এক রেশন কার্ড: গত পয়লা জুলাই থেকে ‘জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইন’এর আওতাভুক্ত উপভোক্তারা দেশের যে কোনও রেশন দোকান থেকে পরিষেবা পাবে। রেশন কার্ড আধারের সাথে সংযুক্ত হতে হবে। পরিযায়ী শ্রমিকরা শুধুমাত্র কেন্দ্রের দেওয়া রেশন পাবে, রাজ্যের নয়। এটা ভালো উদ্যোগ। একটাই খটকা আছে; নতুন কৃষি আইনের ফলে যদি অধিকাংশ শস্য কর্পোরেটের গুদামে চলে যায় তাহলে রেশন ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত খাদ্যশস্যের জোগান থাকবে তো?

·        ভারতীয় রেলের বেসরকারিকরণ: ১০৯টি রুটে ১৫১টি বেসরকারি ট্রেন চালু হবে। এই ট্রেনগুলির সমস্ত দায়ভার বেসরকারি কোম্পানির ওপর বর্তাবে। আপাতত পরীক্ষামূলক ভাবে দিল্লি-লক্ষৌ, মুম্বাই-আমেদাবাদ রুটে আইআরসিটিসি-র তত্ত্বাবধানে এই ধরনের কিছু ট্রেন চালু হয়েছে। দিল্লি থেকে এখনকার ভাড়া এসি চেয়ার কারে ১২৮০ টাকা/ এবং এক্সিকিউটিভ চেয়ার কারে ২৪৫০ টাকা/। আগে ভাড়া ছিল ৬৯৯ টাকা/ এবং ১৫৭২ টাকা। এই পরিসংখ্যানটাই যথেষ্ট। বলা হচ্ছে বিমান ভাড়ার থেকে অনেক কম। ভাবটা এমন যেন দেশের সব মানুষ বিমান চড়েই অভ্যস্ত। রেল যদি বেসরকারি হত তাহলে এই মড়কের সময় এত পরিযায়ী শ্রমিককে কি বাড়ি ফেরত পাঠানো যেত? বিদেশ থেকে ভারতীয়দের ফেরত আনতে তো সেই এয়ার ইন্ডিয়ারই সাহায্য নিতে হয়েছে, যে সংস্থাটিকে বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলির সুবিধা করে দিতে ছক করে লোকসানে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ইন্ডিগো বা স্পাইসজেট কি একজনকেও ফেরত আনতে সাহায্য করেছে? একই ভাবে নানা অছিলায় 4G কানেকশনের অনুমতি না দিয়ে BSNL-কেও পঙ্গু করে রাখা হয়েছে।  

·       বিমানবন্দরের বেসরকারিকরণ: গত বছরের মার্চ মাসে ছয়টি বিমানবন্দর বেসরকারিকরণের মধ্যে দিয়ে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। লকডাউন চলাকালীন আরও ছয়টির নাম ঘোষিত হয়েছে। এর মধ্যে তিরুচিরাপল্লির বিমানবন্দর একটি লাভজনক সংস্থা এবং স্বাভাবিক ভাবেই বিমানবন্দরের কর্মচারীরা এবং কেরালা সরকার এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেছে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের অজুহাত দেখিয়ে একের পর এক বিমানবন্দর আদানিদের হাতে তুলে দেওয়া এই সরকারের কর্পোরেট-চাটুকারিতার এক নির্লজ্জ উদাহরণ।

·         ১০১টি যুদ্ধাস্ত্র এবং নানা যন্ত্রাংশর আমদানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে: এটি ‘আত্মনির্ভর ভারত’ প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। এই সামগ্রীগুলি এখন থেকে দেশের অর্ডিন্যান্স কারখানাগুলি তৈরি করবে। কিন্তু এদের নির্মিত অস্ত্রশস্ত্র নাকি এতই নিম্নমানের যে সেগুলো ব্যবহার করতে গিয়ে অনেক সৈন্যের মৃত্যু হয়েছে। তাই এই ফ্যাক্টরিগুলির কর্পোরেটিকরণ হচ্ছে; এগুলি এখন শেয়ার বাজারে লিস্টেড কোম্পানি হবে। স্বভাবতই বিভিন্ন ইউনিয়ন এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে মুখর।

·        চাকরিতে বাধ্যতামূলক অবসর: এখন থেকে প্রতি তিন মাস সরকারি কর্মীদের কাজের মূল্যায়ন করা হবে। এই লক্ষ্যে যাঁদের তিরিশ বছর চাকরি হয়ে গেছে বা বয়স পঞ্চাশের বেশি, তাঁদের কাজের রেকর্ড খতিয়ে দেখা হচ্ছে। যারা 'অলস', 'নিষ্কর্মা' তাঁদের অবসর নিতে বাধ্য করা হবে।

·         বিদ্যুৎ শিল্পে সংস্কার: সরকার বলছে আমাদের দেশে কলকারখানায় বিদ্যুতের মাশুলের হার বিশ্বে সর্বোত্তম। তাই cross-subsidy বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ, শিল্পের ওপর অধিক মাশুলের বোঝা চাপিয়ে কৃষি ও গৃহস্থের মাশুল কমিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ বন্ধ করতে হবে। রাজ্য বন্টন সংস্থাগুলিকে বেসরকারি করে লাভজনক করে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বাস্তবটা হচ্ছে, কৃষিতে মান্ডি, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সুবিধা কম সংখ্যক কৃষক পায়, যে কারণে আন্দোলন পাঞ্জাব এবং হরিয়ানায় প্রবল আকার ধারণ করেছে, অন্যত্র অতটা নয়যেটা দরকার সেটা হচ্ছে স্থানীয় ফড়ে ও সরকারি আধিকারিদের দাপট কমিয়ে ব্যাপক সংখ্যক কৃষক যাতে এমএসপি পায়, মান্ডির সুবিধা নিতে পারে সেটা নিশ্চিত করা। এই কারণে এই ব্যবস্থার সংস্কার প্রয়োজন। একই ভাবে বন্টন সংস্থা এবং সমবায় ব্যাঙ্কগুলি দুর্নীতির আখড়া, সেখানেও সংস্কারের আশু প্রয়োজন। সেটা করার বদলে সরকারের ঝোঁকটাই হচ্ছে সব কিছু কর্পোরেটদের হাতে তুলে দাও তাহলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বেসরকারিকরণ যেন একটা বিশল্যকরণী।     

এছাড়াও ‘বিদেশি মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ আইন’ আরও কঠোর করা হয়েছে, অ্যামনেস্টি যার প্রথম শিকার। এসবিআই-এ ডিসেম্বর মাস থেকে ভিআরএস আসছে, মেয়েদের বিবাহের বয়স ১৮ থেকে বাড়িয়ে ২১ করার প্রস্তাব এসেছে। এই সবই করা হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন মহামারি আইন বলবৎ আছেশতাব্দী-প্রাচীন এই আইন দানবীয় এবং প্রায় আভ্যন্তরীণ এমার্জেন্সি জারির শামিল। এর সুযোগ নিয়ে দিল্লি দাঙ্গা এবং ভিমা কোরেগাঁও কেসে মিথ্যা অভিযোগে অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছে। বর্ষীয়ান এবং গুরুতর অসুস্থ সমাজকর্মীদের জামিনের আবেদন বারবার নাকচ করা হয়েছে। যে কোনও বিক্ষোভ, প্রতিবাদকে অপরাধমূলক কাজ ও চক্রান্ত হিসাবে গণ্য করা হচ্ছেএত দ্রুত এই সব করা হচ্ছে যে বিরোধী দলগুলি দিশাহারা হয়ে পড়ছে, কোনটা ছেড়ে কোনটার প্রতিবাদ করবে। এর ফলে ভারতীয় গণতন্ত্র নিশ্চিতভাবে একটি কৃষ্ণগহ্বরে প্রবেশ করছে।