Pages

Tuesday, 28 July 2020

একটি বইয়ের কথা

‘অখিল ক্ষুধায় শেষে কি নিজেকে খাবে?’

প্রবুদ্ধ বাগচী


প্রায় বিশ বছর আগে কলকাতার একটি কবিতা-পত্রিকা ঘোষণা করেছিল, বাংলা কবিতায় আধুনিকতার শেষ হয়ে উত্তর-আধুনিকতার সূত্রপাত হয়েছে, তাই তারা তাদের পত্রিকায় কেবল উত্তর-আধুনিক চরিত্রের কবিতাই প্রকাশ করবে। কেমন সে উত্তর-আধুনিক কবিতা? কবিতা-পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী জানালেন, আধুনিকতার ইশারা আছে এমন কবিতা পরিত্যাজ্য। তাদের বিচারে, প্রযুক্তি বিপ্লবের ফলে যে নতুন বিশ্ববীক্ষা তৈরি হয়েছে, যেখানে অনেক সাবেকী ধারণার অবসান সূচিত হয়ে গেছে, পুরনো অর্থনীতি দিয়ে এখনকার অর্থনীতিকে আর ব্যাখ্যা করা যায় না- শ্রেণি পরিচয়ের ক্ষেত্রে, শ্রেণির ভিতরকার নানা আন্তঃসম্পর্কের ক্ষেত্রেও নাকি অনেক ধারণা পাল্টে গেছে বলে তাদের বিশ্বাস। তখন অতটা তাত্ত্বিক বিষয়ে জ্ঞানগম্যি ছিল না ঠিকই কিন্তু দুটো জিনিস নিজের সামান্য চিন্তায় বুঝতে পেরেছিলাম। একটা হল, কোনও বিশেষ কালপর্বে হঠাৎ করে আধুনিক থেকে উত্তর-আধুনিকতায় উল্লম্ফন, এটা বাস্তবে ঘটতে পারে না, সমাজ বিকাশের ধারা রাসায়নিক বিক্রিয়া নয়। অন্যটা হল, এই কথাগুলো বলার পেছনে মার্কসবাদী বিশ্ববীক্ষার ধারাকে কিছুটা নাকচ করে দেবার প্রবণতা রয়েছে। মার্কসবাদকে সর্বশক্তিমান না ভাবি, তার বৃহত্তর ভাবনাকে অত সহজে বোধহয় বাতিল করা যায় না। তাছাড়া, একটা সমাজে নানারকম আর্থিক স্তর থাকে, একটা স্তরের কাছে হয়তো বিদেশি সুরার দাম বাড়াটা মাথা ব্যথার কারণ, অন্য কারওর ক্ষেত্রে মাথায় হাত দিয়ে বসতে হয় বাজারে পেঁয়াজের দাম বাড়লে। এই দুজনের বিশ্ববীক্ষা কি এক হতে পারে ?

পরে, অল্প কিছু পড়াশোনার মাধ্যমে জেনেছি, এই উত্তর-আধুনিকতার ধারণা একেবারেই একটা অ্যাকাডেমিক ইউরোপিয় ভাবনা এবং এই তত্ত্বের প্রবক্তারা মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতা বেশ খানিকটা অস্বীকার করেন। তা করুন, কিন্তু একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের নাগরিক হয়ে চারদিক দেখেশুনে আমার মনে হয়নি শ্রেণিগত বিবেচনার ধারণাকে একেবারে বর্জন করাই উচিত। প্রযুক্তির দৌলতে তৃতীয় শিল্প বিপ্লব হয়ে গেছে বলে অর্থনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার ক্ষেত্রে মার্কসবাদী চিন্তাকে কুলোর বাতাস দিয়ে বিদেয় করতে হবে এবং এইসব আচারপর্ব শেষে কবিতা লিখতে বসতে হবে, তবেই সেই কবিতা উত্তর-আধুনিকতায় স্নাত হবে, এমন বেয়াড়া ব্যাপারে আমার পক্ষে মত দেওয়া সম্ভব হয়নি। আমি আমার প্রশ্নগুলো তাদের বিশদে লিখে জানিয়েছিলাম, তারা সেটা তাদের পত্রিকায় প্রকাশ করলেও সেগুলোর আজ অবধি জবাব দেননি। হয়তো জবাব ছিল না, তাই।

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য'এর ‘আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ পড়তে গিয়ে প্রথমেই আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ওই পুরনো অমীমাংসিত জিজ্ঞাসাগুলোর কথা। কিন্তু গোড়া থেকেই দেখলাম, লেখক তার ভাবনার ধ্রুবপদ একটা জায়গায় ধরে রেখেছেন। তা হল, মার্কসবাদী অর্থনৈতিক বিচার। গত তিরিশ বছর ধরে, বিশেষ করে, সাবেক সোভিয়েতের পতনের পর সব থেকে বেশি আন্তর্জাতিক আক্রমণ এসেছে মার্কসবাদের প্রাসঙ্গিকতার ওপর। ওই বিশেষ মতাদর্শ কতদূর ভ্রান্ত ও ভুয়ো তা নিয়ে চর্চা হয়েছে বিস্তর, কুৎসা হয়েছে নাগাড়ে- আজও দেশে-বিদেশে তার জোয়ারে ভাঁটা এসেছে এমন নয়। পুঁজিবাদ যে থেকে গেল এবং আরও চওড়া করে মেলে দিল তার দুই ডানা, এই নিয়ে কারও কারও মনে পুলকের পর পুলক, চোখে মদির স্বপ্ন, মনে মনে উদ্বাহু নৃত্যের প্রণোদন। লেখক অনিন্দ্য সেই নাচানাচির গোড়া মেরে রেখে প্রথমেই বলে দিয়েছেন, প্রথম শিল্প বিপ্লব থেকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ঘিরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব, যাই হোক না কেন এর মূলে আছে মার্কস'এর মূল্যতত্ত্ব, অর্থাৎ, একজন শ্রমদাতা যখন তার শ্রম নিয়োগ করে কোনও একটি পণ্য ( বস্তু বা পরিষেবা) তৈরি করেন তখন তার শ্রমের মাধ্যমে তিনি উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি করেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায় যাকে বলেছিলেন ‘ভূতের বেগার’। এই উদ্বৃত্ত মূল্যই শ্রমের নিয়োগকারী বা মালিকের কাছে আসল জিনিস। কারণ, এইটাই তার হাতে আসে মুনাফা হিসেবে আর এই মুনাফার হার সব সময় চড়া না রাখতে পারলে পুঁজির বিনিয়োগ ও তার ফেরত লাভ নিয়ে তৈরি হয় ঘোর সংকট। গাণিতিক হিসেবেই এই চড়া মুনাফার হার বজায় রাখতে গেলে নিয়োজিত শ্রমের মজুরিকে ক্রমশ কমিয়ে আনতে হয়, আর, সেই অনন্ত মুনাফা ক্ষুধার জন্যই শ্রমের উপকরণ ক্রমশ পাল্টে যেতে থাকে। স্টিম এঞ্জিনের কালেও তা যা ছিল আজকের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বাজারেও তার মূল সুত্র এক।

কিন্তু যে বিষয়কে কেন্দ্র করে এইসব আলোচনা, অর্থাৎ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা যন্ত্র নির্ভর প্রায়-মনুষ্যশ্রমের একটা প্রতিস্থাপন, তার কিছু কিছু অন্য ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা নিবিড় ভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। প্রযুক্তি বিপ্লবের হাত ধরে ভার্চুয়াল দুনিয়ার যে বিপুল বিস্ফোরণ তার ফলে কয়েকটা ঘটনা ঘটে গেছে যা এর আগে দেখা যায়নি। একটা হল ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের ক্রমিক ক্ষয় ও পরিষেবা শিল্পের বিস্তার; অন্যটা হল ডাটা বা তথ্যের একটা সুবিশাল বাজার যার মালিক হয়ে উঠেছে গুটিকয় বহুজাতিক যারা প্রায় আক্ষরিক অর্থেই দুনিয়াকে তাদের মুঠির মধ্যে নিয়ে আসতে পেরেছেন। আর বর্তমানের যা প্রবণতা তাতে আগামী কয়েক বছরে নিজেদের লাভের কড়িকে এক পর্বতপ্রমাণ জায়গায় নিয়ে যাওয়ার তাড়নায় তাঁরাই বিপুল বিনিয়োগ করছেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-বিষয়ক গবেষণায়। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে শিক্ষা, গবেষণা, অর্থনৈতিক দুনিয়ায় এবং রাজনীতির বাজারেও। দেশে দেশে রাষ্ট্র ব্যবস্থা অনেক আগে থেকেই বণিকের মানদণ্ড দ্বারা পরিচালিত হত এখন তা ছাড়িয়ে রাষ্ট্র ব্যবস্থাটাই প্রায় একরকম এই সব বহুজাতিকের কব্জায়। তারা নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবেন, অর্থনীতির অভিমুখ ঠিক করবেন আর এই সবটাই হবে সেই মুনাফার হারের সুউচ্চ গতির স্বার্থে। স্বাভাবিক, এই বিশ্ব ব্যবস্থায় চাকরির বাজার ক্রমশ সংকুচিত, স্থায়ী চাকরির বদলে গিগ অর্থনীতি থেকে চুইয়ে আসা স্বল্পস্থায়ী চুক্তি-চাকরি, যার কোনও নিরাপত্তা নেই। লেখক তথ্য দিয়েছেন, আগামী কয়েক বছরে সত্তর শতাংশ মানুষের হাতে স্থায়ী কোনও চাকরি থাকবে না। কথাটা দুইদিক দিয়ে বিপজ্জনক।

এত মানুষের হাতে কাজ না থাকলে অর্থনীতির কী দশা হবে? এক শ্রেণির মানুষের হাতে এমনিতেই বিশ্বের সম্পদ কেন্দ্রীভুত হচ্ছে, অসাম্য বাড়ছে- তা কি এসে দাঁড়াবে আরও ভয়াবহ কিনারায়? অন্যদিকে, এত মানুষের কর্মহীনতা, জীবন ঘিরে অনিশ্চয়তা তাদের কি ঠেলে দেবে না নতুন কোনও পুঞ্জীভূত ক্ষোভ বিক্ষোভের দিকে? মনে পড়ে যায়, শঙ্খ ঘোষের ‘রাধাচূড়া’ কবিতার কথা! এর একটা অভিঘাতে লেখকের বক্তব্য, এই বিদ্রোহের সম্ভাবনায় মাটিচাপা দিতে উঠে আসছে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকামের ধারণা- রাষ্ট্র তার নিরাপত্তা রক্ষায় তার নাগরিকদের জন্য বরাদ্দ করবে কিছু মাসিক অর্থ- উপায় নেই, অলস মস্তিষ্ক কী থেকে কী করে ফেলে তার কি হিসেব রাখা সম্ভব? যদিও তথ্যের নজরদারি দিয়ে নিয়ত ম্যাপিং হয়ে চলেছে নাগরিকের- তবু, তবুও। খেয়াল রাখি, আমাদের দেশেও এই ন্যূনতম আয়ের ধারণা নিয়ে কথাবার্তা চালু হয়েছে সম্প্রতি। সবদিক দিয়ে লেখক যে বিপুল পরিশ্রম করে অত্যন্ত সুন্দর ঝরঝরে ভাষায় এইসব কথা আলোচনা করেছেন তা প্রশংসার। অন্তত বাংলা ভাষায় এমন একটি বিষয় নিয়ে যে বই লেখা যায় তা প্রমাণিত এই উদ্যোগে।

সব শেষে কয়েকটা প্রসঙ্গ না তুললেই নয়। পুঁজিবাদ যে ক্রমশ তার নিজের চেহারাকে আরও আগ্রাসী করে তুলছে এবং নিজের সম্ভাব্য সংকট থেকে মুক্তির জন্য নিয়ত উদ্ভাবন করে চলেছে ফন্দি-ফিকির, এটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রেও সমান সত্যি। আর পুঁজির (যতদূর জানি, মার্কস নিজে পুঁজিবাদ কথাটি ব্যবহার করেননি) এই আগ্রাসন ও মুনাফাকেন্দ্রিকতা নিয়ে মার্কস তাঁর অর্থনৈতিক লেখাপত্রে স্পষ্ট মত প্রকাশ করেছিলেন- মার্কসবাদ অনড় এক স্থায়ী মতাদর্শ বলে স্বীকার না করলেও তাঁর এই প্রাসঙ্গিকতা এইভাবে প্রতিষ্ঠা পায়। পরের কথাটা হল, আলোচনা যা করা হয়েছে সেখানে পুঁজিবাদী দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ এসেছে বেশি। কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশ যেখানে তথ্য প্রযুক্তির সঙ্গে নাগরিকদের যোগাযোগ তুলনায় অনেক কম সেখানে এই নতুন শিল্প বিপ্লবের ধাক্কা কেমন ভাবে আসবে তার একটা আভাস দেওয়া মনে হয় দরকার ছিল। এই লকডাউনের সময়ে প্রযুক্তি-নির্ভর ভার্চুয়াল জীবনযাপন করতে গিয়ে দেখা গেল বহু মানুষ এর নাগালের বাইরে। প্রতীচী ট্রাস্টের সদ্য প্রকাশিত এক তথ্য হল, এই রাজ্যের মাত্র ৯ শতাংশ পরিবার কম্পিউটার ব্যবহার করেন, সারা দেশে সেই সংখ্যাটা ১৫ শতাংশের আশেপাশে; ইন্টারনেটের ব্যবহারকারীও সারা দেশের জনসংখ্যার তুলনায় বেশ কম। এই বাইরে থাকা মানুষের জন্য বার্তাটা কী? আর, এই নতুন জমানায় ব্যক্তি মানুষের আদল কী বা কেমন হবে সেই বিষয়ে এই বইয়ে লেখক কিছু ভাবনাবহ প্রসঙ্গ তুলেছেন, সময় ঠিক করবে তার যাথার্থ্য। তবে সব মিলিয়ে এই বই আমাদের একটা বড় প্রাপ্তি।


Monday, 27 July 2020

ভূতের মতো এক অবিশ্বাস!

নব স্বাভাবিক যুগে রাষ্ট্রের সমস্যা

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


পাখা মুড়ে যেন বিদায় নিয়েছে দিন, ঘন অনিশ্চিত অন্ধকারে ডুব দিয়েছে রাত্রি। এই অসময়ে জেগে আছে বা কে? কেউ নেই?

আছে, আছে। রাষ্ট্র পরিচালক জেগে আছে। সত্যি! সত্য-মিথ্যা জানি না, তবে জানি রাষ্ট্রপরিচালক নিশ্চয় জেগে আছে। তার তো না জেগে উপায় নেই। সে একদা শাসনযন্ত্র হাতে পেয়েছে মানুষেরই ইচ্ছায়। সে কী জেগে আছে ‘আত্মা’ অথবা বিবেকের মতো? নাকি সে জেগে আছে দখল চিরস্থায়ী করার ইচ্ছে নিয়ে? কে জানে! জেগে আছে রাষ্ট্র ও তার অসহায় জনতাও – শিশু, কিশোর, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। কেউ জেগে আছে অতীত গর্ব নিয়ে, কেউ জেগে আছে ভবিষ্যতের সুখময় দিনের পদধ্বনি শোনার আশায়।

এদের জন্য কী জেগে আছে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র পরিচালক? হায়, সে কাল গত, এখন রাষ্ট্র জাগে কেবল নিজ প্রয়োজনে। আর রাষ্ট্র পরিচালক জাগে ক্ষমতা নিশ্চিত করতে। তার ইচ্ছায় বা অত্যাচারে ক্লান্ত দেশ এক অবিশ্বাস বুকে চেপে ঘুমিয়ে থাকে।

অবিশ্বাস! হ্যাঁ, তাই। এই ঘন অন্ধকারে জেগে আছে ভূতের মতো এক অবিশ্বাস। না রাষ্ট্র, না জনতা কেউই জানে না এই করোনা-পীড়িত বিশ্বে পথ কোথায়? অবিশ্বাস কেবল প্রশ্ন তোলে। প্রশ্ন তোলে দেশের হয়ে, দেশের পরিযায়ী শ্রমিকের হয়ে, অসুস্থ মানুষের হয়ে, মানবিকতার হয়ে। প্রশ্ন তোলে করোনা-সন্ত্রাস শেষে এই পরিচালক কেড়ে নেবে না তো আমার অধিকার? পরিচালকের মনেও প্রশ্ন। সে প্রশ্ন তোলে নিজের আয়নায়– কৌশলে ফাঁক নেই তো, মিলবে তো চিরদিন তখতে থাকার অধিকার?  

এই প্রথম এমন তো নয়– প্রতি একশো বছরের ব্যবধানে সৃষ্টির প্রাসাদ গুঁড়িয়ে দিতে এসেছে ওরা– কখনও করোনা হয়ে, কখনও ফ্লু হয়ে। করোনার আগেই এসেছিল ‘স্প্যানিশ’ ফ্লু (১৯১৮-২০)। তখনও তার মোকাবিলায় রাষ্ট্র নানা জনপদে লকডাউন ঘোষণা করেছিল, আর এখনকার মতোই মুখোশ ইত্যাদির সুপারিশ রেখেছিল। তার কতটা মানুষ মেনেছে তার পূর্ণ ইতিহাস অন্তত আমার জানা নেই। জানা নেই সেই সব ব্যবস্থার কারণে কতটা জব্দ হয়েছে সেই ফ্লু। কারও কী জানা আছে? আমরা কেবল এটুকু জানি, তারপরও মানুষ আছে, সৃষ্টি আছে, মহিমময় সভ্যতার চাকা ঘুরছে, রাষ্ট্র আছে। আহত হয়েও দেশ আছে। তবে কেন আশা করব না যে করোনা-সন্ত্রাস শেষে আমরা সবাই থাকব। আমরা– এই মানবজাতি, সমাজ ও সভ্যতা। দুর্ভাগ্য হলেও সত্য এই যে, তখনও থাকবে রাষ্ট্র, রাষ্ট্র পরিচালক। তারা কী একই চেহারা নিয়ে থাকবে? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হবে? সংশয় যে যায় না।

যাবে বা কেন? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে কেমনে? স্প্যানিশ ফ্লু চোখ রাঙাতে শুরু করার ঠিক আগে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করেছে প্রথম মহাযুদ্ধ। করোনা তো তেমন যুদ্ধ দেখেনি, দেখবে কী? বিশ্বব্যবস্থা এখন আরও চতুর, আরও পরিশীলিত, তাই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বেশি হয়, প্রকৃত মহাযুদ্ধ হয় না। সেই স্প্যানিশ ফ্লু-র অল্প আগেই আমরা দেখা পেয়েছি মহান রুশ বিপ্লবের। পরবর্তী সময়ে বা সমকালে দেখা পেয়েছি মহাত্মা গান্ধীর। করোনার সমকালিক সঙ্গী হয়ে তো দেখা দিল না তেমন কোনও ব্যক্তি বা বিপ্লব? তবে কী এবার দেখা দেবে না মহাত্মা গান্ধী বা লেনিন বা রবি ঠাকুরের মতো কোনও ব্যক্তিত্ব? নাকি আরও কিছুকাল আমাদের অপেক্ষায় রেখে দেখা দেবে কোনও হিটলার? এসে পড়বে কোনও মহা সঙ্কট (Great Recession)। আমরা তো জানি না, তাই সংশয়। সংশয় বাড়াচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র, তার পরিচালক বা নেতা তথা রাষ্ট্রব্যবস্থা। আমরা খুঁজেই চলেছি মিল ও অমিল। এক এক খবরের ঘাতে আমরা কেউ কেউ চমকিত হচ্ছি, কেউ চমৎকৃত। হায়, কেউ বা আহ্লাদিতও।

করোনা ত্রাসের গোড়ার পর্বে এ দেশে এলেন মহামতি ট্রাম্প, দেশের মানুষ তখন এনআরসি আর ক্যা-বিরোধী আন্দোলনে মত্ত। একদিকে ট্রাম্পের সেবায়, অন্যদিকে রাজ্য সরকার (মধ্যপ্রদেশ) দখলে মত্ত পরিচালক। ট্রাম্প চলে যাবার পর রাজ্যে রাজ্যে শোনা গেল সেই ত্রাসের কথা, সেই হাহাকারের কথা। হাহাকার কেন? ভয়! অজানার ভয়। জানে না তো কেউ কী করলে বিদায় নেবে এই শত্রু, কোথায় তার উৎস বা জন্ম, কোথায় বা বিস্তার, কোথায় মৃত্যু। শোনা গেল, এ দেশের মানুষদের- গোমূত্র, গোবর খায় যারা- কিছুতেই কাবু করতে পারবে না এই আটকুঁড়ের বেটা; আর কাঁসর ঘণ্টা ইত্যাদি বাজালে বেচারা করোনা নাকি পালানোর পথ পাবে না। এ তো এপারে এই রাষ্ট্রের কথা, ওপারে মহামতি ট্রাম্প বললেন, ও (করোনা) ভয়ে ভীত নয় বীরের হৃদয়। বীরই বটে, তিনি লকডাউন মানবেন না, মুখোশ বাঁধবেন না। (কিছুদিন পর অবশ্য দেখা যাচ্ছে তিনি তার দেশের মানুষের মতোই সবই মানছেন, মানতে হচ্ছে)। এপারে যেমন দেখা গেল বেচারা করোনা পালাল না, আরও প্রতাপ বাড়িয়ে রাজত্ব বিস্তারে মন দিল, ওপারেও তাই। নেতারা প্রায় কেউই গোমূত্র বা গোবরে ভরসা রাখলেন না। চারিদিকে বাড়ল ভয়। একদিকে বাজার অর্থনীতি তথা বিকাশ ও জিডিপি, অন্যদিকে অপ্রস্তুত পরিযায়ী শ্রমিক। একদিকে যদি পরিবহন বা স্বাস্থ্য কাঠামো তো উল্টোদিকে শিক্ষা কাঠামো চিৎকার জুড়েছে, গেল গেল রব তুলেছে। কোথায় গান্ধী, কোথায় লেনিন? তবে কী আসছেন হিটলার বা স্ট্যালিন বা ফ্রাঙ্কো? ভয় বেড়েই চলে। ভয় কাটাতে চাই নাকি ভ্যাকসিন। N- 95 মুখোশেও মুক্তি বা নিরাপত্তা নিশ্চিত নয়।

এই স্তরে এসেই জানা গেল বিজ্ঞানীদের কথা শোনা দরকার। এর আগে পর্যন্ত তো কেবল কিছু নকল বিজ্ঞানী আর চিকিৎসক ও ব্যবসাদার তথা বাজারের কথাই শুনেছে রাষ্ট্র। তবে রাষ্ট্রও তো ধমক খায় বাজারের কাছে, ধমক খেয়ে সে ধমক দেয় প্রজাদের। তাই বিজ্ঞানী-গবেষকদেরও দুটো কথা না শোনালে তার চলবে কেন? আমাদের রাষ্ট্র আরও একটু এগিয়ে। সে তার অধীনস্থ গোলাম একটি সংস্থাকে– যেমন তেমন সংস্থা নয়, সে নিজেও এক নিয়ামক সংস্থা (ICMR-এর কথা বলছি, যে নাকি আর এক বিশ্বসংস্থা (WHO)র চর বা অনুচর)– ডেকে নাকি বলল, টিকা লাও, আভি লাও, জলদি লাও। ১৫ অগাস্টের মধ্যে দাও। টিকা আবিষ্কারের পদ্ধতি ও তার ব্যবহারবিধি বাতিল করা যে যায় না, তাতে কী? কর্তারা চেয়েছিল বলেই না তড়িঘড়ি পরমাণু বোমা পেয়েছিল বিশ্ব। কারও হয়তো মনে পড়বে হিটলারের কথাও। আমার মনে পড়ছে সত্যজিৎ রায়ের বানানো ছবি ‘মহাপুরুষ’এর কথা। নেতা বললে উঠতেই হবে সূর্যকে– ওঠ, ওঠ। 

পরিচালকদের দুর্ভাগ্য এই যে, তাদের মাত্র দুটো কান। একটা কান আবার চিরতরে বাজারে বন্ধক দেওয়া। আর একটা কানে শুনতে হচ্ছে হাজারও সমস্যার কথা। সমস্যা তো এক নয়, তার মধ্যে কোথায় ঝড়, কোথায় ঘোড়া কেনা-বেচা, কোথায় বন্যা তাও দেখতে হবে। মানুষ এখন সব জেনে যাচ্ছে, সব শুনতে পাচ্ছে, বুঝতে পারছে। তবে কেন কেবল এটা বুঝতে পারছে না বা বুঝতে চাইছে না যে সব কিছু করে দিতে পারবে না সরকার। ভোট চাইতে এসে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বলে? কেন মানুষ বুঝতে চাইবে না যে পরিচালকেরও ঘর-দোর-সংসার-উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে এবং তা দোষের নয়! কে ওদের, ওই হতভাগাদের বোঝাবে পরিচালকদের দুঃখ বা কষ্টের কথা। তারা যে বুঝবে না বলে গোঁ ধরেছে। একালের নিয়মে যে ‘গজাল মেরে’ বোঝানোর রীতি বাতিল। তবু, সেনা-পুলিস-আদালত আর অন্ধ ক্যাডার লেলিয়ে ভয় দেখানো যায় বৈকি। তার চেষ্টাও চলছে যদিও কাঙ্খিত ফল মিলছে না।

কী করে মিলবে? শিশু আর খোকাদের এই দেশ বড় ঝামেলার দেশ। কত বলা হচ্ছে রামমন্দির হলে সব বিপদ দূর হবে, স্বয়ং রামচন্দ্র তোমাদের দেখবে। লোকে শোনে না। কারা ঈশ্বর নিয়ে পাকা ও বোকা কথা বলে বেড়াচ্ছে, কারা উগান্ডার প্রেসিডেন্টের ভাষণও ছড়াচ্ছে। ওদের এমনও বলা হল– ভাবীজি পাপড় খাও, সুখে নিদ্রা যাও– তাও শোনে না, বড় খোকারা মজা ওড়ায়। অবিশ্বাস আর অবিশ্বাস এবং প্রশ্ন। প্রশ্ন তোলে কেন আমাদের রুটি-কাপড়া-মোকান দেবে না, কেন পাব না চিকিৎসা, কেন তেলের দাম বাড়াবে রোজ? কেন বৃদ্ধ কবিকেও তোমরা জেলে আটকে রাখবে? শিশু আর ছোট খোকারা বলে আমাদের দিকে তাকাও– কী হবে আমাদের শিক্ষা, পুষ্টি, মানসিক বিকাশের?

এসব অবান্তর প্রশ্ন তাই কোনও উত্তর দেব না, তা যে পরিচালক বলতে পারছেন না। এ যে নব স্বাভাবিক (New Normal)'এর যুগ। সে একটা যুগ ছিল বটে যখন বলা যেত, answers must be precise & to the point, কিন্তু সমস্যা তো এখন প্রশ্ন নিয়েই। কেন অনলাইনে পড়াশোনা ভালো নয়, কেন প্রাইভেট স্কুলের এতো রমরমা, কেন স্কুল শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে সরে যাচ্ছে শিশুরা, কেন মিড ডে মিলে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ থাকা সত্ত্বেও রান্না করা খাবার মেলে না? যাদের উত্তর দেবার কথা, তারাই এখন কত প্রশ্ন তোলে। তাও তো বুড়োরা, শিশুরা কেউ বলতে পারে না ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়?’ বলবে কেমনে– প্রাণের মায়া আছে না! বুট-বন্দুক-বুলেটের ভয় আছে না?                             

চেনা দুঃখ চেনা সুখ

সোনামুখ করে খেয়ে নাও বাবা
অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী

'কী রান্না হয়েছে আজকে?'
 সকালবেলা উঠে  ঘুমের ঘোর কাটার পরেই মাকে ঠিক এই প্রশ্নটাই করতাম।

যদি মা বলতেন, আজ নিরামিষ, ভাত ডাল আলু ভাজা, আলু পটলের ডালনা... অমনি মেজাজ বিগড়ে যেত। আমি বলতাম, সে কি? মাছ হয়নি? কিংবা ডিম?

মা তখন অবধারিতভাবে বলতেন, এমন করতে নেই বাবা। এইটুকু কত লোক জোগাড় করতে পারছে না। যা পাচ্ছ সেটাই সোনামুখ করে খেয়ে নিতে হয়।

তাতেও আমার মাথা ঠান্ডা হচ্ছে না দেখে মা বলতেন, তুই তোর বন্ধু বাচ্চুকে দেখে শেখ। ওর মা আমাকে বলেছে, দ্যাখেন দিদি, ভগবানের আশীর্বাদে আমার বাচ্চু কত সমঝদার হয়েছে কী বলব। কলমি শাক ভাত, আলু সেদ্ধ ভাত, যা দেব হাসিমুখে খেয়ে নেয়। নইলে আমাদের সংসার চলে কী করে বলুন?

বলাই বাহুল্য, এসব কথা শুনতে আরও বিরক্ত লাগত। তবে আজ এটুকু বলতে পারি, সেদিন না খেয়ে উঠে যাইনি কোনওদিন। পরে মুসুর ডাল আর আলু ভাজা হলে খুশি মনেই খেয়ে নিতাম। মায়ের শাসনে ধীরে ধীরে এই অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল।

একেবারে অভাবগ্রস্ত পরিবারের সন্তান ছিলাম না। বাবা একটি নামী বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তখনকার বিচারে মধ্যবিত্তই বলতে হবে। কিন্তু খাদ্যের সংকট প্রত্যক্ষ করেছি। না, ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ দেখিনি। দেখার কথাও নয়। বাবার মুখে বর্ণনা শুনেছি, কলকাতার রাস্তায় 'ফ্যান দাও ফ্যান দাও' চিৎকার। রাস্তাঘাটে যত্রতত্র কঙ্কালসার নারী-পুরুষ পড়ে আছে। জেনেছি সুনীল জানার ফটোগ্রাফ, সোমনাথ লাহিড়ীর কলিযুগের গল্প, জয়নুল আবেদিনের আঁকা, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্রের নবজীবনের গান অথবা সত্যজিৎ রায়ের অশনি সংকেত  থেকে। সেদিন অবিভক্ত বঙ্গে কমপক্ষে ৬০ লক্ষ মানুষ মারা গিয়েছিল। আমি বলছি গত শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকের কথা।

আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, সকাল থেকে 'দুটো ভাত দেবে গো' বলে ভিখারী দলের পাড়া পরিক্রমা। অধিকাংশ বাড়িতে তখন রেফ্রিজারেটর ছিল না। সকলের বাড়িতেই কিছু না কিছু খাবার বাঁচত। ভিখারীর দল সেটা নিয়েই চলে যেত, নগদ পয়সা আশা করত না। খোলাবাজারে চাল পাওয়া যেত না। কেনার সামর্থ্য থাকলেও বাবা প্রায়শই চাল জোগাড় করতে পারতেন না। তাই আমাকে রেশনের লাইনে দাঁড়াতে হত। সেই চালে যখন ভাত রান্না হত তার দুর্গন্ধে টেকা যেত না। আমার এক আত্মীয় লুকিয়ে আমাদের জন্য চাল আনতে গিয়ে বিস্তর পুলিশি হয়রানির মুখে পড়েছিলেন। বহুবার দেখেছি মহিলা চাল বিক্রেতাদের চুলের মুঠি ধরে পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে। দেখেছি খোলা লরিতে চালের বস্তা। ধীরগতি লরির পিছন পিছন দৌড়চ্ছে  বস্তির ছেলেগুলো। ছুরি দিয়ে ফুটো করে দিচ্ছে বস্তা। সেই ফুটো বস্তা দিয়ে ঝুরঝুর করে চাল পড়ছে। সেই চাল বাটিতে ধরছে ওই সব ছেলেরা। শৈশবে এ দৃশ্য দেখে বেশ মজাও পেতাম। আবার যখন দেখেছি বিয়ে বাড়ির পিছনে আবর্জনার মধ্যে ফেলে দেওয়া খাবার নেবার জন্য কুকুর আর মানুষের মধ্যে কামড়াকামড়ি, তখন মনের মধ্যে কিছু রেখাপাত করেছে বৈকি।

আমাদের বাড়ির পিছনে চিৎপুর রেলওয়ে ইয়ার্ড। ওয়াগন ব্রেকারদের তখন পোয়াবারো। প্রায়ই ওয়াগন ভেঙে এটা ওটা চোরাই মাল খেলার মাঠের এক কোণে ফেলে জলের দরে বিক্রি করত। কখনও জুতো, কখনও থালা-বাটি, কখনো চাল। একবার খবর এল সস্তায় চাল পাওয়া যাচ্ছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে দৌড়ে বাড়িতে এসে মায়ের কাছ থেকে কিছু টাকা আর থলি নিয়ে গিয়ে কিলো পাঁচেক চাল কিনে আনলাম সেখান থেকে। বাড়িতে সারাক্ষণই শুনতে হত চাল নেই চাল নেই। তাই এ হেন সস্তার চাল আনতে পেরে বেশ একটা গর্ব হচ্ছিল। কিন্তু ব্যাপার হল উল্টো। সেদিন রাত্রে বাবা বাড়িতে ফিরে ঘটনাটা শুনে রেগে আগুন হয়ে গেলেন। মাকে বলতে লাগলেন, আর কি। তোমার ছেলে তালেবর হয়ে গেছে। ওয়াগন ব্রেকারদের খাতায় নাম লিখিয়েছে। আর চিন্তা কী? পড়াশোনার পিছনে খরচা করে কী হবে? শুধু আমার কবে হাতকড়া পড়বে তাই ভাবি। পরদিন সকালে ঘুম ভাঙার আগেই বাবা সেই চাল সরিয়ে দিয়েছিলেন বাড়ি থেকে। কাউকে দিয়ে দিয়েছিলেন সম্ভবত।

যে সহৃদয় পাঠক এতক্ষণ ধরে এই লেখা পড়ছেন, তিনি  হয়তো ভাবছেন, হঠাৎ এ হেন স্মৃতিচারণের হেতু কী? কেনই বা খাদ্য সংকটের প্রসঙ্গ?

দিনগুলোর কথা মনে পড়ল এই সেদিন কলেজ স্ট্রিটের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে। গত সপ্তাহে জরুরি প্রয়োজনে গিয়েছিলাম ওইদিকে। করোনার কবলে থাকা কলেজ স্ট্রিট এবং গোলদিঘিকে চেনা যাচ্ছে না। কে যেন তার সমস্ত রক্ত শুষে নিয়েছে। বইয়ের দোকান খোলা আছে কিন্তু ক্রেতা নেই। স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা নেই। প্যারামাউন্ট শরবতের দোকান বন্ধ। দিলখুসা কেবিনে টেবিলের ওপর চেয়ার উল্টানো। দরজা বন্ধ কফি হাউসের। কলেজ স্কোয়ারে শান বাঁধানো আচ্ছাদনের নিচে উদাস বৃদ্ধ, ভবঘুরে, প্রেমিক-প্রেমিকা এবং পুলিশের ইনফরমারদের কাউকেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। বিদ্যাসাগর মূর্তির সামনে কেউ বিশ্ব বিপ্লবের আহ্বান জানাচ্ছে না। বরং তার জায়গায় এক আশ্চর্য দৃশ্য! ইউনিভার্সিটির মূল প্রবেশপথের সামনে প্রেসিডেন্সি কলেজের কিছু ছাত্রছাত্রী ভাত ডাল সবজি বিতরণ করছে। সারিবদ্ধ ভাবে লাইনে দাঁড়িয়ে গ্রহণ করছেন অসংখ্য পুরুষ এবং মহিলা। লাইন এঁকেবেঁকে কলুটোলার  দিকে চলে গেছে, শেষ দেখতে পেলাম না।

এ দৃশ্য দেখে দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ল আমার। কলেজ স্ট্রিটের এই পিচঢালা রাস্তায় অনেক মিছিলে পথ হেঁটেছি। মানুষের সার্বিক মুক্তির স্বপ্ন নিয়ে। কিন্তু আজ ঘুরেফিরে সেই খাদ্যের সারিতে দীর্ঘ প্রতীক্ষা দেখতে হল? একেবারে দ্বিপ্রহরে, মধ্য কলকাতার রাজপথে?

ইতিমধ্যে অর্ধাহার অনাহারের খবর কানে আসছে। করোনার আতঙ্কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সামনের মাসগুলোতে কোনওমতে খেয়ে পরে কিভাবে বেঁচে থাকব সেই দুর্ভাবনা। কোনও সুরাহার পথ না পেয়ে, সাহায্য তো দূরের কথা, কারওর কাছ থেকে এতটুকুও আশার আলো না পেয়ে অনেকে আত্মহত্যা করছেন। শুনতে ভাল লাগবে না, কিন্তু এই কলকাতা শহরে এমন ঘটনা অনেক ঘটছে। এই 'একক মাত্রা'র ব্লগেই অমৃতা ঘোষাল লিখেছেন এমন মর্মান্তিক পরিণতির কথা।

এ এক সমস্যা। দুনিয়া জোড়া সমস্যা। বিশ্বের রাষ্ট্রনায়করা কী করতে পারেন? দেশের সরকার কী করতে পারে? রাজনৈতিক দলগুলো কী করতে পারে? কী নীতি গ্রহণ করা উচিত? এসব প্রসঙ্গ তো অনেক বড় বড় ব্যাপার! আমি আপনি কি কিছু করতে পারি? আমরা কি খোঁজ নিতে পারি আমাদের  একান্ত চেনা পরিচিত মানুষজনের মধ্যে কেউ কি আছেন যিনি অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন? অথবা ভবিষ্যতের দুর্ভাবনায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন? সে ক্ষেত্রে আমি আপনি কি কোনওভাবে তার পাশে দাঁড়াতে পারি? আর্থিকভাবে হোক, মনে ভরসা যুগিয়ে হোক। কেউ হয়তো বলতে পারেন, অনেকেই তো দুর্গতদের সাহায্যে এগিয়ে আসছেন। অনেকে খাদ্য বিতরণ করছেন। সবজি বিতরণ করছেন। ঠিকই তো। অনেকেই করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হল, আপনি কী করছেন? আমি কী করছি? আমরা কি সংসার খরচ থেকে কিছু বাঁচাতে পারি? সামান্য কিছু বাঁচিয়ে আরেকজনের পাশে একটু হলেও দাড়াতে পারি?

আমরা কি আমাদের সন্তানদের বলতে পারি, সোনামুখ করে খেয়ে নাও বাবা। এটাই কত লোক জোটাতে পারছে না।

Sunday, 26 July 2020

জীবন যখন 'ফুরায়ে' আসে!

পাথরভাঙার গল্প
অমৃতা ঘোষাল

জীবন শুকিয়ে গেলে করুণা মেলে। আর করুণা শুকিয়ে গেলে উপহাস। মানুষ কিন্তু করুণা কিংবা উপহাস কোনওটারই প্রত্যাশা রাখে না। প্রত্যাশার চূড়ান্তবিন্দুতে থাকে একটু অনুভূতির সন্ধান। আর অনুভূতির সমস্ত উৎসগুলো যখন বন্ধ হতে থাকে তখন মানুষ নিজের প্রকৃত সত্তাই খুঁজে পায় না। সত্তা নেই অর্থাৎ অস্তিত্ব নেই। অস্তিত্ব নেই অর্থাৎ রক্তমাংসও অর্থহীন। সুতরাং, এই দপদপিয়ে চলা প্রাণটাকেও থামিয়ে দিতে হবে। হয় নিজেকে চরম কষ্ট দিয়ে, নয়তো তিলে তিলে একটু একটু করে কষ্ট জমিয়ে। একটু সুখীরা আবার খোঁজেন আরামের মৃত্যু। 'Euthanasia' কয় যাহারে! 

কিছু সত্যি ঘটনা তুলে ধরা যাক। আর আসল নামগুলোকে পাল্টে দেওয়া যাক।

কুমু  কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। তার ভাই ছোট, চার বছরের। স্কলারশিপের টাকা থেকে বাবা যে মোবাইলটা কিনে দিয়েছিল ওটা আর অন হচ্ছে না। বাবার কাছে টাকা নেই। পাকা ঘর তুলতে স্কলারশিপের সব টাকা শেষ। বন্ধুরা সবাই রোজ ক্লাস করছে। পাশের বাড়ির রিঙ্কুর মোবাইল থেকে একদিন কলেজের ম্যাডামকে সমস্যাটা জানিয়েছিল। ম্যাডাম 'আমার কিছু করার নেই ' বলে ফোন রেখে দেন। এখন রিঙ্কুর বাড়ি যাওয়া বন্ধ। মাস্ক পরেও যাওয়া যাবে না। একশো দিনের কাজে নাম লেখানো বৌ-পালানো স্বপনের সঙ্গে কুমুর বাবা হঠাৎই তার বিয়ে ঠিক করে ফেলে। কাউকে কোনও কিছুই বোঝানোর চেষ্টা করল না কুমু। শুধু ওড়না আর সিলিং ফ্যানটাকেই সব চেয়ে ভালো বন্ধু ভাবল।

আজ হৃদির পাঁচ বছরের বিবাহবার্ষিকী। সরকারি স্কুল টিচার হৃদির মাইনে এখনও ঠিকঠাক ঢুকছে। বর সুমনের প্রাইভেট চাকরি। তার মাইনে অর্ধেক করে ঢুকছে। আগে নিজের জন্যে দশ হাজার রেখে পুরোটাই সংসারের জন্যে বরকে দিত। এখন দশ হাজারটুকুও সুমন চাইছে। চাওয়া থেকে মারধোর। বাবা-মাকে ফোন করলে বলে, 'তুমি তো নিজে দেখেই বিয়ে করেছ! এখন আমরা কী করব!' ঠিকই তো! তাহলে হয়তো টাকা দিয়েই প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। কিন্তু টাকা বেশি দিলেই সুখ কি ভাগ্যে আছে! বিয়ের আগে প্রায় সাত বছর সুমনের সঙ্গে প্রেমপর্বে এসব তো হৃদি কল্পনা করেনি! হৃদি মুখ খুলতে শেখেনি। গত বছর দু' বছরের ছেলে সবুজ ডেঙ্গুতে চিরকালের মতো চলে যাওয়ার পর হৃদি সংসার ছাড়বে ভেবেছিল। হয়ে ওঠেনি। এই সবটুকুই হৃদি ভাবল পাঁচতলা ফ্ল্যাটবাড়ির ছাদে এসে। একেবারে ছাদের পাঁচিলটাতে দাঁড়িয়ে। বেশিক্ষণ সে আর দাঁড়াবে না, এবার সামনে লাফ দেবে।

ব্যাংকের সুদ সম্ভবত আরও কমবে। এটা ভাবতে ভাবতে মুদিখানার সামনে দাঁড়ালেন ছিয়াত্তর বছরের তপনবাবু। চা নেবেন, বিস্কুট নেবেন, অল্প চাল নেবেন, আর কিছু তার মনেই পড়ছে না। ঘরে ঢুকেই রমাকে বেড প্যান দেওয়া, তারপর কিছু খাইয়ে দেওয়া। গত দু' বছর এরকমই চলছে। কিন্তু সত্যি এবার যদি করোনা হয়, তখন কী করবেন ! চটজলদি সিদ্ধান্ত নিলেন। কাঁপা কাঁপা হাতে রমা আর নিজের ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে নিলেন অনেকগুলো স্লিপিং পিল। দুপুরে ভাত খেয়ে বিছানার সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া একাত্তরের রমার বুকে প্রায় বছর কুড়ি পর মাথা রেখে অসীম শান্তিতে ঘুমোলেন তপনবাবু।

পেটের জ্বালা বড় জ্বালা। কাল সারা রাত কচিটাকে দুধ না খাইয়ে রেখেছে বিন্তি। ওর বুক টনটনিয়ে উঠছে, তবু দেবে না। বৌবাজারের এই গলিতে তাকে এনে তুলেছে বর সাধন। মন্দিরে বিয়ে, তুলতুলে সোহাগ, চুরমুরে দেহ-ব্যবসা। সাধনের অনেক বন্ধু, অনেক মালিক, অনেক প্রতিবেশী। বিন্তি সত্যিই জানে না কচির আসল বাবা কে! সাধন হারামি পালিয়েছে অনেকদিন। তবে খদ্দের আসত ভালোই। নিরোধ নিত। তবু বাচ্চা গজাল। খসাল না। সেদিনও বুক টনটনিয়ে উঠেছিল যে! শালা করোনা আসার আগে ভালোই ইনকাম ছিল। এখন এক কুটোও নেই। বাচ্চাটা আগে না খেয়ে মরুক, তারপর সে বিষ খাবে। তবে বাচ্চাটাকে বিষ দেবে না। কচিটা নিজে থেকেই শুকোবে।

গিটার বাজাতে ভালোবাসে তনুময়। সে যখন স্নানে গিয়েছিল মা গিটারটা ভেঙে ছিঁড়ে রেখে দিয়েছে। সঙ্গত কারণ ছিল। তনুময় সিঙ্গল মাদারের ছেলে। ওর মায়ের কাছে কাল এসেছিল জয়ন্ত আঙ্কল। তনুময়ের জন্যে এনেছিল শার্লক হোমস। মোটা বইটার নিচে ছিল পাতলা চটি বই। ইনসেস্ট চটি। তনুময়ের গা গুলিয়ে উঠেছিল। মায়ের ঘরের বন্ধ দরজা ভেঙে আঙ্কলকে বের করে দিয়েছিল ফ্ল্যাট থেকে। আঙ্কলকে তনুময় বলেছিল, 'ফাকিং বাস্টার্ড, এরপর এলে মাস্ক পরে আসবি।' আজ মা গিটার ভেঙে দিল, তারপর মাস্ক-পরা জয়ন্ত আঙ্কলকে নিয়ে দরজা আটকাল। আর তনুময় বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নতুন ব্লেডটা হাতে তুলে নিল। দৃঢ় প্রত্যয়ে ভরা শ্বাসটা একটু পরেই স্মৃতি হয়ে যাবে।

লকডাউন থাক বা না থাক, করোনা কিন্তু ঘরের অন্ধকার কোণগুলোতে তীব্র আলো ফেলেছে। আমরা বেশিরভাগ মানুষই দেখেছি, আর পিছনোর জায়গা নেই। দেওয়ালে পিঠ একেবারে ঠেকে গ্যাছে। এগোনোও যাচ্ছে না। পা আর মন দুটোই পাথর হয়ে গ্যাছে। এখন প্রশ্ন, পাথর দিয়ে পাথরে আঘাত করলে কি স্থবিরতা ভাঙবে? সত্যি যদি চরিত্রগুলো প্রত্যেকে একে অন্যের মুখোমুখি দাঁড়াত? হৃদি-কুমু-বিন্তি কিংবা তপনবাবু আর তনুময় যদি বন্ধু হত, তবে কি এমনটা হত! তাই বন্ধু হওয়ার সহজাত প্রবৃত্তিটাকে একটু শানিয়ে তুলি। তবেই পাথরের ভেতর থেকে জেগে উঠবে আমি-তুমির মধ্যে লুকিয়ে থাকা জীবনযুদ্ধের এক একজন সংশপ্তক।

Wednesday, 22 July 2020

আপনি ও আমি



দুরাচার, করোনা ও ‘মহান জনগণের’ গল্প

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
 

Whoever fights monsters should see to it that in the process he does not become a monster. And if you gaze long enough into an abyss, the abyss will gaze back into you.

-Friedrich Nietzsche

সেই কবে লিঙ্কন সাহেব বলেছিলেন, ‘অফ দ্য পিপল ফর দ্য পিপল বাই দ্য পিপল’। একটি দেশের শাসনতন্ত্রের এই হওয়াই ছিল বিধি। অর্থাৎ, দেশের লোক ভোট দিয়ে শাসক নির্বাচন করবে যারা সেই জনগণের স্বার্থে দেশ চালাবে। একটি সেরা উদ্ধৃতিযোগ্য বয়ান হিসেবে লিঙ্কনের এই উচ্চারণটুকু তাই ইতিহাসে অমলিন স্থান পেয়েছে। সকলেই কথায় কথায় এ বাচন আওড়ায়, যেন নিজের ও অপরের গণতন্ত্রের পরীক্ষায় সর্বোত্তম প্রশ্নের উত্তর এটিই।

কিন্তু এই ‘পিপল’ বস্তুটি কী, তা নিয়ে বিস্ময়, সংশয় ও আতান্তরেরও শেষ নেই। ফরাসি বিপ্লব কালে কৃষক ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জনজাগরণে উৎখাত হয়েছিল রাজতন্ত্র। যে গিলোটিনে মারা পড়েছিলেন রাজা ষোড়শ লুই ও তাঁর স্ত্রী, সেই গিলোটিনেই শিরোচ্ছেদ হয়েছিল বিপ্লবের নেতা রোবসপিয়রের। ১৭৯৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের অন্তে ‘কমিটি ফর পাবলিক সেফটি’র হাত থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেপোলিয়ন ফ্রান্সের অধিপতি হয়েছিলেন। আর এই সমস্ত ক্রিয়াকলাপের পেছনে আধুনিক সময়ের ‘পিপল’ বা জনগণের সোৎসাহ সমর্থন বা অংশগ্রহণ ছিল সর্বাধিক।

কিন্তু এই জনগণ কি একীভূত, সমচিন্তার কোনও একরূপী পিণ্ড? এখানেই যত গোল! কারণ, সমাজ নানা শ্রেণিতে বিভক্ত- অভিজাত, রাজ কর্মচারী, ছোট ব্যবসায়ী, বড় বণিক, মধ্যবিত্ত, শ্রমজীবী, কৃষক, বেকার, ভবঘুরে ও নানাবিধ। চিরায়ত ক্ষমতার শিখরে অধিষ্ঠিত অভিজাত বা রাজন্যবর্গের লোকেরা তো আর নিজেদের শাসনের অধিকারকে বিপদাপন্ন করতে চাইবেন না, তাই স্বভাবতই ধরে নেওয়া যেতে পারে, ক্ষমতাহীন সংখ্যাগুরু জনতা অর্থাৎ, গরিব, মধ্যবিত্ত, শ্রমজীবী, কৃষক– এনারাই আধুনিক ‘পিপল’ শব্দের ধারক ও বাহক, যারা ধনতন্ত্রের উত্থানে আগুয়ান সমাজে ক্ষমতার ভাগ পেতে প্রত্যাশী ও সম্ভাব্যতার আকর। নইলে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অভিষেক যে বাকী পড়ে থাকে! আর ফরাসি বিপ্লবের ‘সাম্য মৈত্রী স্বাধীনতা’র আহ্বান তো এই উত্থিত জনতার আশা-আকাঙ্ক্ষাকেই প্রতিফলিত করতে চেয়েছে।

রাজতন্ত্রের বিলোপে বা তার প্রতীকী অবনমনে ‘জনগণ’ শীর্ষক এক নতুন ক্ষমতার বর্গ তৈরি হল বটে কিন্তু ইতিহাসের গতিপথে মার্কসবাদীরা এই জনগণের মধ্যেও কার্যকরী বিভাজন দেখালেন। কারখানায় উৎপাদনরত শ্রমিকদের থেকে কৃষকরা ভিন্ন চরিত্রের। শ্রমিকেরা সমাজ পরিবর্তনের বিপ্লবে কাণ্ডারীর ভূমিকা নিতে পারে, কৃষকেরা দ্বিধাগ্রস্ত ও সংশয়াদীর্ণ। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত বা পেটি-বুর্জোয়ারা তো সময় বিশেষে সুবিধাবাদী বলেও প্রতিপন্ন। সে ক্ষেত্রে, ‘অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল’ নিঃসন্দেহে এক অতিকথা মাত্র। আসলে, শাসন বা শাসকেরা হল নানা শ্রেণি স্বার্থের প্রতিভূ। কারণ, শ্রমিকেরা যাদের শাসক বলে ভাবতে চাইবেন, কৃষকেরা তাদের থেকে ভিন্ন মতালম্বী হতেই পারেন। অতএব, সংখ্যাগরিষ্ঠতার একটি নিরিখ নির্মিত হয়ে গেল, যেখানে বেশির ভাগ মানুষের পছন্দই শিরোধার্য। আমরা পেলাম ক্রমবিকাশমান সংসদীয় গণতন্ত্রের এক রকমারি মডেল। থেকে গেল বিরোধের বীজ ও অন্তর্দ্বন্দ্বের চোরাস্রোত।

এই বিরোধ কার সঙ্গে কার? জনতার মধ্যকার বিরোধ। মাওসেতুঙ বলেছিলেন, জনতার মধ্যে বিরোধ আছে, কিন্তু তা অবৈরিমূলক। অর্থাৎ, হিংসা বা সংঘর্ষ নয়, আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্কের মধ্যে দিয়ে তা মিটিয়ে নেওয়া যেতে পারে। একটি আদর্শগত ব্যবস্থা বা নৈতিক আকাঙ্ক্ষা হিসেবে তা অতুলনীয়, কিন্তু বাস্তবে তা কি অত সরল-সোজা বা অকপট? দার্শনিক জিড্ডু কৃষ্ণমূর্তি ও পদার্থবিদ ডেভিড বোহম’এর একটি সুগভীর আলোচনা ‘দ্য এন্ডিং অফ টাইম’ গ্রন্থে সুশায়িত আছে। সেই আলোচনা শুরুই করছেন কৃষ্ণমূর্তি এই প্রশ্নটি তুলে যে, মানবসভ্যতা কি ভুল পথে চলেছে? এই ভুল পথে চলা অর্থে কী বোঝায় অথবা কবে থেকে এই চলা শুরু- সেইসব ভাবনাই ধীরে ধীরে আলোচনায় প্রকট হয়েছে। দুই আলোচক ‘অহং’এর তাৎপর্যকে ধরার চেষ্টা করছেন, সেই সাথে মানুষের অন্তর্যাত্রা ও বহির্যাত্রা- এই দুই অভিমুখকেও বুঝতে চাইছেন। মোদ্দা কথায়, দরিদ্র, অসহায়, নিপীড়িত মানুষের যদি গায়েগতরে বেঁচে থাকাটাই মূল যাপন হয়ে পড়ে তাহলে তার কাছে ততটা অবকাশ নেই যাতে করে সে তার প্রতিবেশী বা সমমানের মানুষের সঙ্গে বিবাদ-সংঘর্ষে লিপ্ত হতে পারে। অবশ্য অর্থের জন্য বা অসহনীয় বিপদে খেই হারিয়ে কিছুজন ভয়ানক হিংস্র কাজে লিপ্ত হয় বটে। কিন্তু তা ব্যতিক্রমী। অথচ সেই মানুষটিরই যদি আপাত এক সুস্থির অবস্থা তৈরি হয় তাহলে তার অহং’এর বাসনায় সে দুঃসাধ্য, দুরূহ শুধুমাত্র নয়, বহু দুষ্কর্মও সাধন করতে পারে।

মূল প্রসঙ্গের অবতারণায় এই কথাগুলো বলে নিতে হল, কারণ, শুধুমাত্র শাসক-শাসিতের দ্বন্দ্বের মধ্যেই আমাদের ভালোমন্দের টানাপোড়েনগুলো অন্তর্হিত আছে- এই ভাবনাটি অতীব সংকীর্ণ ও ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন। তথাকথিত ‘মহান জনগণ’এর যে গল্পগাছা আমরা গত দু-তিন শতক ধরে শুনে আসছি, তার নির্মাণে সুপ্ত হয়ে আছে অর্ধসত্য। আজকের প্রসারিত ভুবনে নানা কারণে যখন সাধারণ ভাবে বিশ্ব জুড়ে দারিদ্র্য কমে আসছে (যদিও অসাম্য বাড়ছে), তখন আরও বেশি করে প্রতীয়মান হচ্ছে এই যে, সাধারণ মানুষের ব্যক্তিযাপন ও টানাপোড়েনে যে সুতোগুলো ঢিল ছাড়ে ও গুটোয়, তার মধ্যে থাকে নানাবিধ প্রশান্তি ও সর্বনাশ। কিন্তু এতদিন তা অত প্রকট ছিল না; অভাব ছিল তেমন কোনও সর্বগ্রাসী মাধ্যমের যার মধ্য দিয়ে সেইসব ইচ্ছা-অনিচ্ছা, বাস্তবে কার্যকরী হোক বা না হোক, অন্তত দেখা বা শোনা যেতে পারে। পুঁজিবাদ, প্রযুক্তি ও গণতন্ত্রের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সেইসব বলা-না বলা উপাদানগুলি দানা বেঁধেছে, সাধারণের প্রত্যাশাসমূহের প্রকাশ নানান অবয়ব পেয়েছে, কমবেশি তা নিয়ে আলোড়ন-আন্দোলন হয়েছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে জনতার মধ্যকার বিরোধও আরও বেড়েছে, শাসকের মদতে বা জনতারই নিজ আয়োজনে। জনতার যে অংশ কার্যত অর্থনৈতিক বা সামাজিক ভাবে সবল হয়েছে, সে অংশের কেউ কেউ জনতার আরেক অংশের সঙ্গে নতুন নতুন বিরোধে জড়িয়েছে। আজ সোশ্যাল মিডিয়ার সর্বব্যাপী প্রসারের ফলে এই বিরোধ ও কর্তন এক নতুন প্রকাশ ও মাত্রা পেয়েছে।

যে শ্রমিকশ্রেণিকে এক সময় নেতৃত্বকারী বিপ্লবী শ্রেণি বলে মনে করা হত, সেই শ্রেণির একাংশের ওপরেই ‘আভিজাত্যের’ বদনাম চেপেছে। ইউরোপ ও আমেরিকায় শ্রমিকশ্রেণির অবস্থা যখন কিঞ্চিৎ ভালো বলে মনে হচ্ছে তখন তারা বিশ্বের বাকী শ্রমিকশ্রেণির থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে ও তাদের নিজ দেশের পুঁজিপতি শ্রেণির বিশ্ব-বাণিজ্য থেকে আহরিত ধনের অংশবিশেষ তাদের ভাগেও পড়েছে বলে অনুযোগ। কথা উঠেছে, মনু’র ‘স্মৃতি’ভ্রংশে পরিত্যক্ত অন্ত্যজ জাতের প্রতিনিধিরা কেউ কেউ ক্ষমতায় গিয়ে নতুন মাফিয়া রাজ নির্মাণ করেছে, উত্তরপ্রদেশে ‘যাদব’দের কুটিল শাসনের স্মৃতি এখনও বহুজনের মনে টাটকা। জনজাতির কোনও কোনও নেতা ক্ষমতায় গিয়ে অপশাসন ও দুর্নীতির জালে জড়িয়েছেন। নারীর অবমাননায় পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে ওঠা আওয়াজ বহু জায়গাতেই নিরীহ পুরুষ দমনের অযাচিত তন্ত্রে রূপ পেয়েছে। নিরন্ন গ্রামবাসী পঞ্চায়েতের ক্ষমতা পেয়ে রাতারাতি অর্থ ও পেশিশক্তির জোরে নিজস্ব আধিপত্য বলয় তৈরি করেছে। এমনকি, এক সাধারণ চোর বা পকেটমার পেলে তাকে যে নৃশংশ গণপ্রহার দেওয়া হয়, সেখানে সব থেকে নিরীহ, গোবেচারা দর্শকটিও তার নিকৃষ্টতম হিংসার অভিব্যক্তির পরিচয় রাখে। তাহলে এসবের অর্থ কি এই যে, শ্রমজীবী, তপশীলী, উপজাতি, নারী এদের ওপর হওয়া অত্যাচার, বঞ্চনার অবসান হয়েছে? সার্বিক ভাবে, মোটেই নয়। কিন্তু আবার এও বাস্তব, এইসব অত্যাচার, অনাচারের প্রতিরোধে যে রূপকল্প ও বাস্তব আধারগুলো তৈরি হয়েছে তা অনেকাংশেই এক অত্যাচারের অবসানে আরেক অত্যাচারের প্রতিমা গড়েছে। অর্থাৎ, বদলটা এসেছে শাসকে, কর্তৃত্বে, শাসনের আঙ্গিক বা উপচারে নয়। এ এক অখণ্ড ‘দুরভিসন্ধিমূলক’ সমস্যা। গান্ধী হয়তো সে কারণেই শাসক বদলের থেকেও ‘স্বরাজ’ অধিষ্ঠানে আরও বেশি আগ্রহী ছিলেন। যে কারণে, ১৯২১’এর অসহযোগ আন্দোলনের সময় চৌরিচৌরার পুলিশ শিবিরে জনতার আক্রমণে সাত পুলিশ কর্মীর হত্যার ঘটনায় তিনি গোটা আন্দোলনটাকেই প্রত্যাহার করে নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেন। কারণ, যে অনাচার ও হিংসার বিরুদ্ধে আন্দোলন ও জাগরণ, তার মধ্যেই লুকিয়ে আছে হিংসার নতুনতর বীজ।

তবে শাসনের মাত্রা ছাড়িয়ে গেলে জনতা বিদ্রোহ করবে, সেও স্বাভাবিক। কিন্তু সে বিদ্রোহের ফলশ্রুতিতে ক্ষমতার বয়ানে কী বদল হবে, তা অনিশ্চিত। আজকের সোশ্যাল মিডিয়ার জমানায় এসে বোঝা যাচ্ছে, এই অনিশ্চিতি কতটা বাস্তব ও অদৃষ্টপূর্ব। এমন খোলা পরিসর এতদিন কোথায় আর ছিল, যেখানে এসে যা খুশি বলে যাওয়া যেতে পারে। যেন খুলে দিয়েছে মানুষের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে থাকা প্রতিহিংসা ও ঘৃণার জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি। প্রায় সকলেরই বক্তা হয়ে ওঠার এমন সুযোগ তাই মানুষের গহন, গভীরে যে বাতায়ন, তার কপাট দিল উন্মুক্ত করে। সত্যি অর্থে, ‘অফ দ্য পিপল বাই দ্য পিপল ফর দ্য পিপল’এর এক ঘোলা জলে আমরা নেমে পড়লাম কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি করতে। আপনার প্রিয় বন্ধু আপনার ফোন ধরেনি, আপনি দু কলম লিখে ফেললেন সকলকে জানান দিয়ে। রেস্তোরাঁয় টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিয়েছে, আপনি সে সবের কুৎসিত ছবি তুলে ফেসবুক বা ইন্সটাগ্রামের পেজে সেঁটে দিচ্ছেন। তাও না হয় বোঝা গেল। কিন্তু প্রকাশ্যে বা গোপনে যখন কাউকে খুন বা ধর্ষণ করার হুমকি দিচ্ছেন, কোনও ব্যক্তিকে স্রেফ তাঁর ধর্ম, জাতি বা গায়ের রঙ’এর জন্য ট্রোল করছেন, গণহত্যা বা দাঙ্গায় প্রচ্ছন্ন বা প্রত্যক্ষ মদত দিচ্ছেন, চুরি, খুন, ধর্ষণেরও মিথ্যা অভিযোগ আনছেন, ঈর্ষাপরায়ণতা বা মতের অমিলের জন্যই কাউকে হিংস্রভাবে অপদস্থ করছেন- সেই আপনিই আবার গণতন্ত্রের জন্য সওয়াল করছেন, আপনার অধিকারের পাইপয়সা আদায় করে নিতে সচেষ্ট হচ্ছেন, নিকটজনের কারও ওপরে কোনও অন্যায় হলে চীৎকার করে উঠছেন। আসলে, এই দ্বন্দ্ববিধুর সংশ্লেষে আপনার সত্তা আপনাকে বাধা দিচ্ছে আগামীর কোনও উত্তরণের দোরগোড়ায় পৌঁছতে। সোশ্যাল মিডিয়া এইভাবেই নির্মাণ করছে ‘জনতা’র এক আজানুলম্ব অবয়ব। পঙ্গপালের মতো আরও আরও মানুষ সোশ্যাল মিডিয়ার এই মায়ামোহ রূপধারিণীর আগুনে ঝাঁপ দিচ্ছে নিজেদের আরও তীব্র ভাবে উলঙ্গ করে। সে আগুনে তার বস্ত্র পুড়ছে। তারপর নিজেও পুড়ছে অনাহূতের মতো, সভয়ে। কারণ, ভয় ছাড়া তার আর কিছুই নেই যে, তাই মেঘের আড়াল থেকেই সে অস্ত্র ছুঁড়তে পটুত্ব অর্জন করেছে।

করোনার এই মাহামারিতেও তাই বেঁচে থাকার সমস্ত অনুষঙ্গগুলিই যেন ক্রমবিষাক্ত হয়ে উঠছে। কথায় বলে, বিপদে পড়লে বাঘে-গরুতেও এক ঘাটে জল খায়। প্রবল বন্যায় একই ভেলায় ভেসে যায় সাপ ও ব্যাঙ। তাই এ অযাচিত নয় যে প্রচণ্ড প্রলয়ে মানুষ সবেগে মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠবে। অথচ, এমনতর মহা বিপর্যয়েও ‘মহান জনগণের’ এই দুরাচার কেন? সুস্থ হয়ে ফেরা মানুষকে ঘরে ঢুকতে দিচ্ছে না, পারলে পিটিয়ে দিচ্ছে; করোনা-যুদ্ধে লড়াই করে ফেরা ডাক্তার-নার্স একঘরে হচ্ছে; সামান্য একজন ধান চুরি করেছে বলে তার গায়ে গরম লোহার শিক দিয়ে প্রহার করছে; শত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও রাস্তায় মাস্কহীন ঘুরে বেড়াচ্ছে শত শত লোক যাদের বারণ করলে পালটা তেড়ে আসছে, এই অবিশ্রান্ত মৃত্যু মিছিলেও যেন নির্লিপ্ত ভাব। সহযোগী মানুষের থেকে দুর্বিনীত, স্বার্থপরের সংখ্যা কি তাহলে অধিক?

এই ঘোর গোলাকার চক্রব্যূহে আমরা নিশ্চয়ই বারবার শাসকদের ব্যর্থতা নিয়ে প্রশ্ন করব, তাদের দুষ্ট নীতিমালা নিয়ে অবশ্যই জবাব চাইব, কিন্তু নিজেরা ‘মহান জনগণ’ সেজে আপন আপন বলয়ে ক্ষমতা, হিংসা, ঘৃণা ও কপটতা দেখাব আর আশা করব সুদিনের, তা তো হয় না! নীৎজে’কে আবারও স্মরণ করলে বলতে হয়: ‘যদি রসাতলে নজর দাও, তাহলে রসাতল তোমার দিকে নজর দেবে।’

    

Sunday, 12 July 2020

আগামী দিন!

যন্ত্রের দাপটে শ্রমের বৈকুণ্ঠযাত্রা
সোমনাথ গুহ

অনিন্দ্য ভট্টাচার্যর ‘আশায় বাঁচে চাষা: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও একুশ শতকের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ বইটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে বৃহৎ সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় একটি তাৎপর্যমূলক খবর নজরে এল: একশো তিরিশ বছরের প্রাচীন মোহনবাগান ক্লাবের সাথে মাত্র ছয় বছর আগে গজিয়ে ওঠা অ্যাটলেটিকো দ্য কলকাতা'র সংযুক্তিকরণ। বাংলার সুবিশাল এবং আবেগমথিত ফুটবল ঐতিহ্যের কর্পোরেটিকরণের আগাম পূর্বাভাস পাই বইটির 'বিনোদন ও বিজ্ঞাপন' সংক্রান্ত অধ্যায়ে যেখানে লেখক বলছেন, 'আজ আর এমন কোনও  ক্ষেত্র থাকতে পারে না যেখানে পুঁজি অনুপ্রবেশ করবে না… এটাই তার গতিপথ। ...কারণ, নতুন আবহেই তার মুনাফার উর্ধ্বগতি।' এমনটা নয় যে এটিকে-মোহনবাগানের মালিক সঞ্জীব গোয়েঙ্কা শুধুমাত্র ভারতীয় ফুটবলের উন্নতি নিয়ে চিন্তিত, কিন্তু তিনি জানেন  ঐতিহ্যশালী ক্লাবের সাথে সংযুক্তিকরণ এমন এক ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করবে যা তাঁর মুনাফার পথ প্রশস্ত করবে। মুনাফার সন্ধানে পুঁজির এই উদগ্রীব, নাছোড়বান্দা, নিরন্তর যাত্রা যা একটি পণ্যের নির্মাণে শ্রমের অবদান ক্রমশ কমিয়ে আনে, যার ফলে তার প্রায় বৈকুণ্ঠযাত্রা ঘটে এবং যন্ত্রের অবদান ক্রমান্বয়ে দৃষ্টান্তমূলক ভাবে বাড়ে, সেটাই এই বইয়ের মর্মকথা।

শুরুতে ‘লেখকের কথা’তে অনিন্দ্য লিখছেন, তিনি একাডেমিক জগতের লোক নন, সাধারণ মানুষের সঙ্গে থেকে তাঁদের দোরে ঘুরে ঘুরে তাঁর জীবন ও অর্থনীতির পাঠ। অর্থনীতির বই পড়বার প্রয়োজন হলেই বুকটা ধড়াস করে ওঠে। মনে হয় এ তো বড় কঠিন, কাঠকাঠ ব্যাপার, মন বিদ্রোহ করে। জারগনে ভারাক্রান্ত সেই সব বইয়ের দুটি পাতা পড়লেই ক্লান্তি আসে। কিন্তু একজন ব্যক্তির শ্রম থেকে নির্মিত পণ্য, সেটির বিনিময়- বাজার-কড়ি-বাজারের ওপর ক্ষমতার দাপট- মুদ্রা-মূল্য-দাম-উদবৃত্ত মুল্য- এক অংশ মুনাফা-আরেক অংশ আবার পুঁজি হিসাবে বিনিয়োগ- পুঁজির এই চক্র যা অন্তহীন ভাবে উদ্বৃত্ত উদগীরণ করছে, তা তিনি অত্যন্ত সহজ ও সাবলীল ভাবে ছবির মতো চিত্রায়িত করেছেন। বিষয়টি কিন্তু জটিল এবং অনেক লেখক এটা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করেন এবং পাঠককে বিভ্রান্ত করেন। কিন্তু মূল্যতত্ত্ব সম্পর্কে লেখকের স্বচ্ছ এবং সম্যক উপলব্ধির কারণে তিনি অনায়াস দক্ষতায় পাঠকের কাছে একটি জটিল বিষয়কে সহজ করে তুলে ধরেন এতটাই যে একটা অর্থনীতির বই তরতর করে থ্রিলারের মতো পড়ে ফেলা যায়। 

পুঁজির এই আগ্রাসী, নির্মম যাত্রায় লেখক দেখাচ্ছেন, কীভাবে একটি শিল্পের সূর্যাস্ত হয় এবং শ্রমের অবদান কমিয়ে দিয়ে অধিক যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে নতুন ক্ষেত্রের আবির্ভাব ঘটে যা মুনাফার হারে ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি ঘটায়। লেখকের ভাষায়, 'ম্যানুফ্যাকচারিং-এর পুরনো জমানা ছেড়ে পুঁজি এসে ভেড়ে পরিষেবা ক্ষেত্রের তীরে এবং তারপর আরও নতুন নতুন ক্ষেত্রে যেমন আইসিটি এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দুনিয়ায়।' পণ্য উৎপাদনে মনুষ্য শ্রম যন্ত্র দ্বারা প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়ায় ১৯৯৯-২০০০'এ Y2K একটা মাইলফলক হিসাবে গণ্য হতে পারে। Y2K সমস্যা সমাধানের জন্য আইটি শিল্পে বিপুল কর্মীবাহিনী নিয়োজিত হয় এবং ইন্টারনেটের ব্যবহার এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লম্ফন ঘটে। তথ্য এখন হয়ে উঠল অন্যতম পণ্য- ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের যুগে যে পণ্য ছিল বস্তুগত তাই এখন হয়ে উঠল অধরা (Tangible থেকে Intangible)। তথ্যপ্রযুক্তির মহাসড়ক বেয়েই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্ভব।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা! এ এক অনন্য, বিস্ময়কর বিশ্বকর্মা যা অতীতের যাবতীয় উৎপাদন প্রক্রিয়ার শুধু পরিবর্তন নয় এক আমূল রূপান্তর ঘটায়। লেখক এই যুগান্তকারী আগমনের তিনটি উপাদানকে চিহ্নিত করছেন: (১) এক বিশাল ও ক্রমবর্ধমান ডাটাবেস; (২) গণনাশক্তির ক্ষমতার বিস্ফোরণ; (৩) ভেঞ্চার পুঁজির আগমন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চালিত অর্থনীতি পুঁজির বিচরণকে অবাধ, উন্মুক্ত করে দেয়, তাকে আর দেশকালের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা যায় না। হাতে একটা স্মার্টফোন থাকলেই সারা বিশ্বকে করায়ত্ত করা যায়। ফেসবুক, টুইটার, গুগল, ইন্সটাগ্রামের জনপ্রিয়তা দুই দশকের মধ্যে বিস্ময়কর ভাবে বৃদ্ধি পায়। অ্যামাজন, সুইগি, জম্যাটো, উবের, আর্বান ক্ল্যাপের সৌজন্যে যাবতীয় পরিষেবা মানুষের হাতের মুঠোয় এসে পড়ে। বিশ্ব হয়ে পড়ে এক 'ভার্চুয়াল লোকালয় বা বিশ্বায়িত গ্রাম'। তথ্যের এক মহাসমুদ্র তৈরি হয় যেখান থেকে মানুষ বেঁচে থাকার যাবতীয় সামগ্রী আহরণ করতে পারে আবার যা তার যাপনের ওপর বেড়ি পড়ায়, নজরদারিতে বন্দি করে। এই বিশাল ডাটাবেস বা তথ্যভাণ্ডার যে সব কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণ করে তারা ক্ষমতার লড়াইয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দেয়। রাষ্ট্রের সঙ্গে এই কর্পোরেটদের সংঘাত ক্রমবর্ধমান যা অনেক সময় অনিবার্য হয়ে পড়ে। 

প্রযুক্তির এই মহাপ্রলয়ের কারণে শ্রমের বাজার হয়ে পড়ে পরিবর্তনশীল, অস্থির, অনিশ্চিত। অনিন্দ্য লিখছেন, 'দশ কি পাঁচ বছর আগে যিনি এক ধরনের আঙ্গিক ও প্রোগ্রামিং-এ দক্ষ ছিলেন তিনি আজ একেবারে পিছিয়ে পড়তে পারেন আজকের নলেজ-ডোমেইন-এ পারদর্শী কোনও শ্রমবাহকের কাছে। তাই চাকরির বাজার আজ অনিশ্চিত।' কিন্তু তিনি বলছেন এমনটা নয় যে কাজ নেই; কাজ আছে কিন্তু চাকরি নেই। গিগ অর্থনীতির উদ্ভব ঘটছে, যাতে 'শ্রম অনেক বেশি কার্যভিত্তিক, চুক্তিবদ্ধ ও স্বল্পমেয়াদি'। এর উদাহরণ হিসাবে তিনি সার্ভেন্ট ইকোনমি বা ভৃত্য পরিষেবার কথা বলছেন যা আমেরিকায় সম্প্রতি জনপ্রিয় হয়েছে। এছাড়া আছে যন্ত্রযুগের নতুন ধরনের সব কাজ: ম্যানিকিউর, পেডিকিউর, বৃদ্ধদের দেখভাল, শিশুদের যত্ন ইত্যাদি। যন্ত্র দ্বারা শ্রমের প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া এমন পর্যায়ে পৌঁছচ্ছে যে অধিকাংশ লোক কর্মহীন হয়ে পড়ছে। এদের জীবিকা নির্বাহ এবং সমাজে অস্থিরতা ঠেকানোর জন্য রাষ্ট্র এদের ব্যাংকের খাতায় কিছু টাকা জমা করবে যা ইদানীংকালে ‘ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম’ (ইউবিআই) তত্ত্ব নামে চর্চিত হচ্ছে। আমাদের দেশে অনেক রাজ্যে বিভিন্ন খাতে- মিড-ডে-মিল, উজ্জ্বলা যোজনা, কন্যাশ্রী প্রকল্প- এখন যে অনুদান দেওয়া হচ্ছে তা এই ইউবিআই'এর প্রাকপর্ব বলা যেতে পারে।

গত পঞ্চাশ বছর ধরে যবে থেকে সমাজ-রাজনীতি সম্পর্কে বুঝতে শুরু করেছি সেই সময় থেকেই শুনে আসছি, পুঁজিবাদ মুমূর্ষু, ভেঙে পড়া শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। হায়, সেই পুঁজিবাদ আজও একের পর এক অভাবনীয় উদ্ভাবন করে দুর্নিবার গতিতে এগিয়ে চলেছে। তার ধ্বংসের বীজ তারই মধ্যে নিহিত আছে- এটা খালি আপ্তবাক্য, বাস্তবে প্রমাণ কিছু পাইনি। পুঁজিবাদের এই চিরন্তনতা সম্পর্কে লেখক একটা মোক্ষম কথা বলেছেন: 'পুঁজিবাদ নিরন্তর ও নিয়ত পুনঃউৎপাদিত হয় আমার, আপনার সকলের কার্যকারণ ও অংশগ্রহণে। আমাদের কেনাবেচা, জীবনাচরণ, বেশি বেশি আয়ের আকাঙ্ক্ষা, সুযোগ-সন্ধান এবং আগ্রাসী ক্রেতামুখি বা বিক্রেতামুখি বোধ ও অনুশীলন পুঁজিবাদকে আমাদের সকলের মধ্যে লালনপালন করে। আমরা এই পুঁজিবাদের জাঁতাকলে পিষ্ট অথচ তাকেই স্বেচ্ছায় ধারণ ও বহন করি আমাদের দৈনন্দিন নিত্যক্রিয়ায়। গোড়ার সমস্যাটা এখানেই নিহিত।' এই সূত্রায়ন করতে অনিন্দ্য অ্যাডাম স্মিথ থেকে অরবিন্দ অবধি পরিক্রমা করেছেন, আরবের জ্ঞানতাপস ইবন খালদুনকে শ্রমতত্ত্বের জনক হিসাবে অধিষ্ঠিত করেছেন।

তাহলে কি যন্ত্রের দাপটে মানুষের আত্মসমর্পণ নিশ্চিত? যন্ত্রই কি হয়ে উঠবে বিশ্বের চালিকাশক্তি? যন্ত্র মনুষ্য শ্রমকে প্রায় সর্বত্র প্রতিস্থাপিত করবে, কিন্তু যন্ত্র তো স্থির পুঁজি; পণ্য উৎপাদনে শ্রমের আর যদি কোনও ভূমিকাই না থাকে তাহলে শ্রম ও পুঁজির চিরায়ত দ্বন্দ্ব কী রূপ নেবে? আর কর্মদক্ষতায় যন্ত্র না হয় মানুষের চেয়ে হাজার গুণ শ্রেষ্ঠ, কিন্তু আবেগ, অনুভূতি, প্রেম, ভালোবাসা, যৌনতা? লেখক সবজান্তা হওয়ার চেষ্টা করেননি, তিনি কোনও নিদান দেননি। তিনি গান্ধী, অরবিন্দ, মার্কস'এর পথ অনুসরণ করে ব্যক্তি মানুষের বিকাশের কথা বলেছেন- সত্যের খোঁজে মানুষের এক নিরন্তর অন্বেষণ যা হয়তো বা সৃষ্টি করবে এক নতুন মানব। 

Thursday, 9 July 2020

ব্রহ্মা হইল মোহাম্মদ

মুক্তির স্বাদ
সিদ্ধার্থ  বসু
           
       
আজকের পৃথিবীতে বর্ণ বৈষম্যের লাগাতার প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশেও ঢেউ উঠেছে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের। তাদের বিচার বোধের উপর একটা ধর্মীয় মোড়ক লাগিয়ে এমন প্রচার শুরু হয়েছে যেন এটাই ভারতবর্ষের আদর্শ। সেই আদর্শ ভারতের লক্ষ্যে পৌঁছনোর জন্য লাগাতার প্রচারে ব্যস্ত মিডিয়াওয়ালারা। ফলে, দেশ জুড়ে চলেছে দলিত, নিম্নবর্গ ও  সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উপর নানা ভাবে লাগাতার আক্রমণ। ভারতবর্ষে এই আক্রমণ যে নতুন, তেমনটা কিন্তু  নয়।  আগেও ভারতবর্ষে ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের দাপট ও অত্যাচার দলিত, পিছড়েবর্গ ও সংখ্যালঘু মানুষদের উপর অব্যাহত ছিল। তার প্রমাণ মেলে ইতিহাসের পাতায়, লেখায়।

আজ যেমন দেশ জুড়ে আওয়াজ উঠেছে ‘ব্রাহ্মণ্যবাদ সে আজাদী’, ‘মনুবাদ সে আজাদী’, ঠিক তেমনই ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে নিচুতলার মানুষ সেদিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে প্রতিবাদী হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্যপন্থীরা তাদের প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য জনসাধারণের উপর যে লাগামছাড়া অত্যাচার শুরু করেছিল, তার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে তারা ধর্মঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে যা জানায় তা জানা যায় 'ধর্মপূ বাজারে জাবিধান' গ্রন্থে:
             
  মনেতে পাইয়া মর্ম     সবে বলে রাখ
  তোমা বিনে কে করে পরিত্রাণ। 

   এইরূপ দ্বিজগণ     করে সৃষ্টি সংহরণ 
   এ বড় হইল অবিচার।

এই অত্যাচার ও উৎপীড়নের কথা বৈকুণ্ঠে পৌঁছল তাদের কাতর প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে। জনগণের এই অবস্থার কথা শুনে ধর্মঠাকুর আর নিশ্চিন্তে বসে থাকতে পারলেন না। ব্রাহ্মণদের অত্যাচারের হাত থেকে নিপীড়িত মানুষকে বাঁচানোর জন্য তিনি যবন বা মুসলমানের রূপ ধরে পৃথিবীতে অবতরণ করলেন:
                
  বৈকুণ্ঠে থাকিয়া ধর্ম    মনেতে পাইয়া মর্ম  
  মায়ারূপে হইল খনকার   
  ধর্ম হইলা যবনরূপী     শিরে পরে কাল টুপি  
  হাতে ধরে ত্রিকষ কামান।  
                     
  চাপিয়া উত্তম হয়       দেবগণে লাগে ভয় 
  খোদায় হইল এক নাম। 
  ব্রহ্মা হইল মোহাম্মদ      বিষ্ণু হইল পেগম্বর 
  মহেশ হইল আদম 
  গনেশ হইল গাজী         কার্তিক হইল কাজী 
  ফকির হইল মুনিগণ। 
                
  তেজিয়া আপন ভেক      নারদ হইল শেখ  
  পুরন্দর হইল মৌলানা।  
  চন্দ্র সূর্য আদি যত         পদাতিক হইয়া শত  
  উচ্চস্বরে বাজায় বাজনা।  

পদ্যটির এই অংশ থেকে পরিষ্কার, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের হাতে বৌদ্ধ ও নিম্নবর্ণের মানুষেরা অত্যাচারিত হয়ে তাদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যে নিরুপায় হয়ে দৈবশক্তির স্মরণাপন্ন হয়।

আবার অন্য স্থানে জাতের নামে যে বজ্জাতি, অর্থাৎ জাতপাতের ধুয়ো তুলে মানুষকে নির্মম হত্যার ঘটনা যে ভাবে আজকের সভ্যসমাজের চোখের সামনে ঘটে চলেছে দিনের পর দিন, সেই জাতপাতের বিরুদ্ধে হাকিমের সামনে কৃ্ষ্ণপুরের কৃষ্ণদাসী বৈষ্ণবীর গানে নতুন সুর শোনা যায়:  
               
          এই পাগলের দলে – এই দলে কেউ এস না রে ভাই,
          কেউ এস না, বস’ না, কেউ ঘেষ না গায়।
          এই দলেতে এলে পরে- জাতের বিচার নাই। 

এই ভাববাদী চিন্তায় যে দলগত সম্প্রীতির চিত্র পাই তাই ভারতবর্ষের চিরকালীন ঐতিহ্য। তাকে আজ পদে পদে প্রতি মুহূর্তে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। কীরকম ছবি ছিল আমাদের দেশে তার একটা সুন্দর ছবি পাওয়া যায় এই গানে:
                  
       এই দলেতে এলে পরে জাতের বিচার নাই।
       এক পাগল উড়িষ্যাতে,  চণ্ডালেতে আনে অন্ন ব্রাহ্মণেতে খায়।   
       এক পাগল চিত লাইতে শম্ভুচাঁদ গোঁসাই।
       সে যে হিন্দুর গুরু, ব্রাহ্মণের শিব, মোসলমানের সাঁই।  

আসল কথাটা সম্প্রীতি। সবাইকে নিয়ে বাঁচা, সবাই দেশমাতৃকার সন্তান, কোনও ধর্মীয় ভেদাভেদ নয়। সবার নিজের নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী যে যার ধর্ম পালন করবে, এটাই ভারতের মূল মন্ত্র। আজ সেখানে বিপদের সঙ্কেত। নিজের নিজের ধর্মাচারণ যেন অপরাধ। আবার কেউ যদি এসবের মধ্যে না থাকে তাতেই বা কি? এমন কথাও শোনা যায় সেই সময়:
                
         জো হম নহীঁ গুজরাতে তুক্ষ্ম কৌঁ ক্যা ভাই। 
         সিরি নাহীঁ কুছ বংদগী কহু ক্যঁ ফুর মাঈ।। ( দাদূ / ক্ষিতিমোহন সেন ) 

অর্থাৎ, আমি যদি পূজা বা নেমাজ না করি, তবে হে ভাই, তোমার তাতে কী? / মাথা আপনি প্রণত না হয়, তবে বলো, কেন তোমার কথায় করি প্রণাম? এটা ভারতের আজকের ছবি মনে করিয়ে দেয় নাকি?  
সেই সঙ্গে স্মরণ করিয়ে দেয় আজাদীর, স্বাধীনতার।  মুক্তির আস্বাদ পেতে মানুষ ঘোষণা করেছিল:
                
          অপনে সে তীঁ কাজ হৈ ভাবৈ তি ধরি মৈঁ জাই।
          মেরা থা সো মৈঁ লিয়া লোগৌঁ কা ক্যা জাই।।  ( দাদূ / ক্ষিতিমোহন সেন ) 

যে দিকে আমার খুশি আমি যাইব, আমার সঙ্গেই আমার প্রয়োজন। যা আমার ছিল তা আমি নিলাম, লোকের তাতে কি আসে যায়? এ কথার উৎস যে অত্যাচারের ফল তা বোধহয় বলার অপেক্ষা রাখে না।

আপন আপন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল যেমন হব, তেমনি অন্যের বিশ্বাস ও তার আদর্শ, স্বাধীনতার প্রতিও সমান শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। সেই চিন্তাই আজকের ভারতে সব চেয়ে প্রয়োজন নয় কি?