জেরুজালেম'এর ইতিহাস
সুব্রত হালদার
প্রথম পর্ব:
https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_27.html
তৃতীয় পর্ব:
https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_29.html
দ্বিতীয় পর্ব:
জেরুজালেমকে হিব্রুতে বলা হয় 'ইয়ারশালেইম' বা 'শান্তির নগর'। অথচ, যুগ যুগ ধরে জেরুজালেমকে কেন্দ্র করে অশান্তি নেহাত কম হয়নি এবং কেউ বলতে পারবে না এ অশান্তির আদৌ কোনও শেষ আছে কিনা।
মধ্যপ্রাচ্যের জুদিয়া পাহাড়ি এলাকার মালভূমিতে ভূমধ্যসাগর আর মৃত সাগরের মাঝে এ শহরের অবস্থান। ইজরায়েল ও ফিলিস্তিনি উভয়েরই দাবি, জেরুজালেম তাদের রাজধানী। জেরুজালেম নগরীর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, এ নগরী অন্তত দু'বার ধ্বংস, ২৩ বার অধিকৃত, ৫২ বার আক্রান্ত হয়, আর উদ্ধার করা হয় ৪৪ বার। খ্রিষ্টপূর্ব ১০০০ সন নাগাদ রাজা ডেভিডের সময় জেরুজালেম ইজরায়েলের রাজধানী ছিল। জেরুজালেমের উপর ইহুদিদের দাবির প্রাচীন ইতিহাস দাঁড়িয়ে রয়েছে একটি অতিকথার উপরে, যে অতিকথার উল্লেখ বাইবেলে রয়েছে। সেই অতিকথা অনুযায়ী, বর্তমান জেরুজালেমের একটি পাথরের উপর আব্রাহামের পৌত্র জ্যাকবের সঙ্গে তাদের ঈশ্বরের ফেরেসতার মল্লযুদ্ধ হয়। যুদ্ধ শেষে তিনি জ্যাকবকে আশীর্বাদ দান করে তাঁর নতুন নামকরণ করেন 'ইজরায়েল'। সেখান থেকেই এই নামানুসারে এই ভূখণ্ড ইজরায়েল নামে পরিচিতি পায়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ইহুদিদের ঐতিহ্যগত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি এবং তাদের নিজস্ব ইতিহাসের ইহুদি ধর্মের প্রাচীন বাইবেলের (তোরাহ) বর্ণনার উপর ভিত্তি করে তারা বিশ্বাস করে যে আব্রাহাম তাদের জৈবিক পিতৃপুরুষ। অর্থাৎ, ইহুদিরা আসলে একটি ফ্যামিলি-ট্রি'র জাতিগত অংশ হিসেবে একটি ধর্মীয় বর্গ। এ ক্ষেত্রে পৃথিবীর অন্যান্য ধর্মের মতো ইহুদি ধর্মপ্রচার বা সে ধর্ম গ্রহণ বা বর্জনের আলাদা করে কোনও সুযোগ সম্ভবত নেই। আবার যেহেতু তা জাতিগত ও পরিবারগত অনুভবকে প্রাধান্যে রেখে তারা নিজেদের সত্তাকে বহন করে, সেই হেতু নাস্তিক বা পৌত্তলিক হলেও সে ইহুদি হিসেবেই বিবেচিত হবে। যেমন, জায়োনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের প্রকল্পের বিরোধী অংশও ইহুদি। তারা নন-জায়োনিস্ট হিসেবে বিবেচিত।
জ্যাকব বা ইজরায়েলের সঙ্গে ঈশ্বরের ফেরেসতার লড়াই যেখানে হয়েছিল, সেটিকে বলা হয় টেম্পল মাউন্ট, যার অর্থ 'ঈশ্বরের ঘরের পাহাড়'। এই টেম্পল মাউন্ট ধর্মপ্রাণ ইহুদিদের কাছে সর্বোচ্চ পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়। খ্রিষ্টপূর্ব মোটামুটি ১০০০ বছর আগে এখানে ইজরায়েলিরা শহর গড়ে তুলতে শুরু করে। খ্রিষ্টপূর্ব ৯৫৭ সালে কিং সলোমন নির্মাণ করেন ফার্স্ট টেম্পল বা 'বাইতু ল মুকাদ্দাস'। দ্বিতীয় লৌহ যুগে দুটি ইজরায়েলি রাজ্যের আবির্ভাব হয়েছিল- ইজরায়েল ও জুডা। ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিকরা একমত যে ইজরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব ছিল খ্রিষ্টপূর্ব নবম শতাব্দী পর্যন্ত এবং জুডা রাজ্যের অস্তিত্ব ছিল খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ শতাব্দী পর্যন্ত। ইহুদিরা দিনে তিনবার প্রার্থনা করত 'বাইতু ল মুকাদ্দাস'এর দিকে মুখ করে। আবার ইসলাম ধর্মের গোড়ার দিকে নবী হজরত মহম্মদ মক্কা ছেড়ে মদিনায় চলে যাবার (৬২২ খ্রিষ্টাব্দ) সতেরতম মাস পর্যন্ত নামাজ আদায়ের অভিমুখ ছিল 'বাইতু ল মুকাদ্দাস'। যদিও সেই পুরনো কাঠামোটি আর ছিল না।
৫৮৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে ব্যাবিলনীয়রা ধ্বংস করে দেয় ফার্স্ট টেম্পল। কিন্তু পারস্য অঞ্চলের গভর্নর জেরুবাবলের পৃষ্ঠপোষকতায় ৫১৬ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে ওই জায়গাতেই নির্মিত হয় সেকেন্ড টেম্পল, যার নাম হয় 'জেরুবাবেল' বা 'বাবলের বীজ'। বাবেল মানে ব্যাবিলন। কিন্তু ওই অঞ্চলে রোমান বিজয় ও রোমান সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইহুদি জনগোষ্ঠীর পরপর ব্যর্থ সামরিক অভ্যূত্থানের পরে ৭০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ রোমানরা সেকেন্ড টেম্পল বা জেরুবাবেলকে ধ্বংস করে দেয় এবং সেখানে রোমান দেবতা জুপিটারের মন্দির তৈরি করে। ইহুদি জনগোষ্ঠীকে কার্যত গণবিতারণ করা হয়। তারা ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ।
প্রায় ৬০০ বছর পরে খলিফা হজরত উমর রোমানদের সাথে চুক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হন। রোমানরা জেরুজালেম ছেড়ে চলে যায়। হজরত উমর 'বাইতু ল মুকাদ্দাস'এর সামনে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। পরে খলিফা আব্দুল আল মালিক (৬৮৫-৭০৫ খ্রিস্টাব্দ) বা খলিফা আল ওয়ালিদ (৭০৫-৭১৫ খ্রিস্টাব্দ) বা দু'জনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মসজিদটি নতুন করে তৈরি হয়। নাম হয় 'মসজিদুল আকসা'। প্রসঙ্গত, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছেও জেরুজালেম অত্যন্ত পবিত্র শহর, কারণ, এখানেই এক পাথরের উপরে হেলান দিয়ে নবী হজরত মহম্মদের দেহান্ত হয়েছিল।
খ্রিষ্টানরা বিশ্বাস করে এই জেরুজালমেই জিসু খ্রিস্ট প্রথম ধর্মপ্রচার করেন। তারা মনে করে, জিসু ক্রুশবিদ্ধ হবার পর এখানেই কোনও গুহায় তাঁর দেহ রাখা হয় এবং তাঁর পুনঃআবির্ভাব এখানেই হয়েছিল। 'কনস্টানটাইন দ্য গ্রেট'এর উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় Church of the Holy Sepulchre বা Basilica of the Resurrection। এটির নির্মাণ কাজ ৩২৬ খ্রিষ্টাব্দে শুরু হয়ে শেষ হয় ৩৩৫ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ। পরে খলিফা আল হাকিম ১০০৯ খ্রিষ্টাব্দে Church of the Holy Sepulchre'কে ধ্বংস করে দেন। পরবর্তী কালে খলিফা আজ জাহিরের নির্দেশ ও ব্যবস্থাপনায় চার্চটি পুনঃনির্মিত হয়। এই চার্চের সামনেই খলিফা হজরত উমর নামাজ পড়েছিলেন। পরে মুসলিমরা সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করে। সেটির নাম দেওয়া হয় 'মসজিদে উমার'।
দেখা যাচ্ছে, জেরুজালেম এমন এক 'পবিত্র' নগরী যা ইহুদি, মুসলিম, খ্রিষ্টান- তিন ধর্মের কাছেই পবিত্র। আবার খ্রিষ্টানদের একটা বড় অংশ মনে করে জিসু খ্রিস্টের মৃত্যুর জন্য ইহুদিরাই দায়ী। আর ইহুদি ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী, 'বাইতু ল মুকাদ্দাস' বা 'পবিত্র ঘর' এখন সেখানে না থাকলেও তৃতীয়বারের জন্য নির্মিত হবে। সেটি কোথায় হবে? অনুমান করা হয় টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরিফ এলাকাই সেই জায়গা। ফলে, এই জায়গাটিকেই এখন 'বাইতু ল মুকাদ্দাস' বলা হয়, কোনও নির্দিষ্ট কাঠামোকে নয়।
সংক্ষেপে এবার দেখে নেওয়া যাক বিখ্যাত সোনালী গম্বুজ বা 'ডোম অফ দ্য রক'এর ইতিহাস। এটিকে আরবিতে বলে 'কুব্বাতু স সাখরাহ', আর হিব্রুতে 'কিপ্পা হা-সেলা'। এটি নির্মাণ করেন খলিফা আব্দুল মালিক ৬৯১ খ্রিষ্টাব্দে। এটি তিনি ঠিক সেই জায়গাতেই নির্মাণ করেন যেখানে সেকেন্ড টেম্পলকে ধ্বংস করে রোমানরা বানিয়েছিল তাদের জুপিটারের মন্দির। এই গম্বুজটি ১০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ধ্বংস হয়ে যায় এবং ১০২২-২৩ খ্রিষ্টাব্দে পুনর্নির্মিত হয়। এটি ইসলামি স্থাপত্যবিদ্যার প্রাচীন নিদর্শন একটি আট কোণা গম্বুজ। এই 'ডোম অফ দ্য রক' হচ্ছে টেম্পল মাউন্টের অন্তর্গত এবং মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র পাথর। এটির সোনালী গম্বুজ জর্ডনের রাজার পাঠানো সোনা গলিয়ে নির্মিত। আপাতত হামাসের আক্রমণে একটি অংশ ধ্বংসপ্রাপ্ত।
প্রসঙ্গত ১৫৩৮ খ্রিষ্টাব্দে সুলতান সুলেমান পুরনো জেরুজালেম শহরের চারপাশে পাঁচিল তুলে দেন। সেই পাঁচিল দেখেই ওল্ড সিটিকে চেনা যায়। পুরনো শহর ঐতিহ্যগত ভাবে চার অংশে বিভক্ত হয়ে বসতি সেটলমেন্ট রয়েছে- আর্মেনীয়, ইহুদি, মুসলিম ও খ্রিষ্টান অংশ। 'ডোম অফ দ্য রক' জর্ডন-প্যালেস্টাইন ওয়াকফ বোর্ডের অধীনে। ১৯৮১ সালে ওল্ড সিটিকে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই ওল্ড সিটিতে ঢোকবার জন্য গেট আছে মোট ১৭টি। তার মধ্যে ৬টি স্থায়ীভাবে বন্ধ। বাকি ১১টি গেট দিয়ে ভিতরে ঢোকা যায়, যার ১০টি মুসলিমদের জন্য আর মাত্র ১টি ইহুদিদের জন্য খোলা। এই আশ্চর্য ব্যবস্থা কেন, এ প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। কারণ, ইহুদিরা টেম্পল মাউন্ট বা হারাম শরিফ এলাকাটিকে এতটাই পবিত্র মনে করে যে তার পবিত্রতা রক্ষার্থে ওই এলাকাতে তারা পা ফেলতেও চায় না। ধারণা করা হয়, 'ডোম অফ দ্য রক'এর ঠিক নিচেই ওই জায়গা।
ক্রমশ...
No comments:
Post a Comment