Monday, 2 October 2023

নজরদারির চোখ

আপনি নজরবন্দী!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

ঘটনাটি মাত্র কয়েকদিন আগের। হতাশায় নিমজ্জিত ২৮ বছরের এক যুবক মুম্বইয়ের মুলভানি অঞ্চলে বসে গুগল সার্চে খুঁজছিলেন ‘best way to commit suicide’ সম্পর্কিত কিছু তথ্য। বিষয়টা ইন্টারপোলের নজরে আসে, তারা তৎক্ষণাৎ মুম্বই পুলিশকে উক্ত সার্চের আইপি অ্যাড্রেস সহ ইমেইলে সতর্কবার্তা পাঠায়। পুলিশ সেই আইপি অ্যাড্রেস ধরে যুবকের অবস্থানে পৌঁছে যায় এবং তাকে সম্ভাব্য আত্মহত্যার হাত থেকে উদ্ধার করে।

উপর উপর দেখলে, ঘটনাটি শেষত মানবিক। মনে হতে পারে, ভালই তো! প্রযুক্তির সুবাদে আমরা জীবনরক্ষা করতেও পারঙ্গম হয়েছি। কিন্তু যে প্রযুক্তিগত নজরদারির সুবাদে এই ভাল কাজটি করা গেল, তা কি সর্বত্রই এমনতর ভাল ও সুখপ্রদ? খেয়াল করে দেখুন, এখানে কথিত যুবক গুগলে তার ব্যক্তিগত পরিসরে একান্ত গোপনে কিছু একটা খুঁজছিলেন, কিন্তু তা নজরে পড়ে গেল কোন সুদূরে অবস্থিত ইন্টারপোলের অফিসারদের। বুঝুন কাণ্ড! তাহলে কি আমরা প্রতিনিয়ত যে ইন্টারনেট সার্চগুলি করি, অথবা, বিভিন্ন ওয়েবসাইটে ঘোরাঘুরি করি, কিংবা ইমেইলে কিছু লিখি বা কারও সঙ্গে চ্যাট করি, ফোনে কথা বলি- তা সম্পূর্ণতই কারও না কারও নজরদারির ফ্রেমে বন্দী? আমাদের ব্যক্তিগত পরিসর ও গোপনীয়তা বলে সত্যিই কিছু নেই?

সকলের মনে থাকবে, বেশ কয়েক বছর আগে এডওয়ার্ড স্নোডেন এই বিস্তৃত নজরদারি সম্পর্কে আমাদের অবহিত করেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের NSA (National Security Agency) বিশ্বের তাবৎ কথাবার্তার ওপর আড়ি পাতে এবং তথাকথিত শত্রুদের চিহ্নিত করে। এনএসএ’র সুবিধা হল, বিশ্বের অধিকাংশ যোগাযোগ প্রযুক্তির সার্ভার ও ট্রাফিক যেহেতু আমেরিকা অথবা তাদের বন্ধু দেশ ব্রিটেনের মধ্যে অবস্থিত, অতএব, এনএসএ তার কারিগরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে এই বহমান ট্রাফিককে ট্যাপ করতে পারে। এই ট্যাপিং অপারেশন চারটি কোড নামে চলে- BLARNEY, FAIRVIEW, OAKSTAR STORMBREW। স্নোডেন দেখিয়েছেন, নজরদারির এই কার্যক্রম এনএসএ বড় বড় টেলিকম ও ইন্টারনেট কোম্পানিগুলির যোগসাজসেই চালায়। এমনকি গুগল, ফেসবুক, অ্যাপল, ইয়াহু ও অন্যান্য বড় বড় ইন্টারনেট কোম্পানিগুলির সার্ভারে তাদের পূর্ণ অভিগম্যতা পর্যন্ত আছে। উপরন্তু, encryption’এর সুবিধার কথা বলে ইন্টারনেট কোম্পানিগুলি ব্যবহারকারীদের তথ্য সম্পর্কে যে সুরক্ষার আশ্বাসবাণী দেয়, তাও মোটেই বিশ্বাসযোগ্য নয়। স্নোডেন জানিয়েছেন, এইসব কোম্পানি পিছনের দরজা দিয়ে সমস্ত তথ্যের হাট মালদার ক্রেতাদের কাছে খুলে দেয়।

এই গোপন কীর্তিগুলি ফাঁসের দায়ে মার্কিন প্রশাসনের হাতে গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়ানো স্নোডেন ২৭টি দেশে বসবাসের আবেদন জানিয়ে অবশেষে বছর দুয়েক আগে রাশিয়ার নাগরিকত্ব পেয়ে এখন সেখানেই বাস করছেন। কিন্তু তিনি যে প্যান্ডোরার বাক্সটি খুলে দিয়েছিলেন তা এটাই প্রমাণ করে যে, নজরদারির ভয়াবহতা আজ এমন জায়গায় পৌঁছেছে, যেখানে আপনার কোনও তথ্য ও কার্যাবলী আর বিন্দুমাত্র ব্যক্তিগত বা গোপনীয় নয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নজরদারির আরও ভয়ানক সব ইজরায়েলি প্রযুক্তি, যা আপনার অজান্তেই অথবা আপনাকে ভুল করারও কোনও সুযোগ না দিয়ে, নিঃশব্দে ঘাতকের মতো বসে যাবে আপনার ব্যবহৃত মোবাইল অথবা ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপে। এইগুলিরই অন্যতম ‘পেগাসাস’ নামে এক ঘাতক সফটওয়ার সম্পর্কে আজ আমরা অনেকেই অবহিত। এই সফটওয়ার যে তারপর কী কাণ্ড ঘটাতে পারে তা আপনার কল্পনারও বাইরে। আপনার অজান্তেই সে আপনার ডিভাইসটি ব্যবহার করে যা খুশি করতে পারে- এমনকি ডার্ক নেটে ঢুকে অস্ত্র বা ড্রাগ কেনাবেচার ব্যবসাও। আপনি আদপেই যা করেননি অথবা ঘুণাক্ষরেও যা জানেন না, তেমন কোনও অপরাধ কর্মের জন্য আপনার মোবাইল বা ল্যাপটপটি সহ আপনার ফেঁসে যাওয়া এবার সময়ের অপেক্ষা মাত্র।

বলাই বাহুল্য, এই নজরদারি আজ এক ভয়ঙ্কর পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। বলা হচ্ছে, আপনি মনে মনে যা চিন্তা করছেন, তাও ধরা পড়ে যেতে পারে কোনও নজরদারির ফাঁদে। এই মুহূর্তে কথাটা খানিক বাড়িয়ে বলা হলেও, আংশিক সত্য তো বটেই। প্রবাদে বলে, বোবার কোনও শত্রু নাই। আপনি যদি নিতান্ত শুধু চিন্তাই করেন, তার কোনও প্রকাশ না থাকে, তাহলে এখনও এমন কোনও প্রযুক্তির উদ্ভব হয়নি যা আপনার মস্তিষ্কের তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করে আপনার অপ্রকাশিত চিন্তাকে পড়ে ফেলতে পারবে। কিন্তু যদি কোনও অসতর্ক মুহূর্তে আপনার চিন্তাকে বিন্দুমাত্র কারও সঙ্গে ফোনের বার্তালাপে অথবা মুখোমুখি কোনও ব্যক্তিকেও আপনি জানিয়ে বসেন, তাহলে কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে তার নজরদারি-বন্দীত্ব কঠিন বাস্তব সত্য।

অর্থাৎ, এক ‘নেটওয়ার্ক সাম্রাজ্যবাদ’ আজ দুনিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। এই নিয়ন্ত্রণের দুটি উদ্দেশ্য আছে: ১) বাণিজ্যিক ও ২) রাজনৈতিক। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যটি হল, আপনার তথ্যগুলি ক্যাপচার করে অন্যের কাছে বিক্রি করা যারা আপনাকে সম্ভাব্য ক্রেতা বা উপভোক্তা হিসেবে পেতে থাকবে; রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি বিবিধ এবং তা শাসক শ্রেণির চরিত্রের ওপর নির্ভরশীল যেখানে নাগরিকদের তথ্যগুলিকে সমবেত করে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করা ও তাদের ভাবনাকে প্রভাবিত করা থেকে শুরু করে, এমনকি বিরুদ্ধবাদীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনে তাদের নানা উপায়ে শায়েস্তা করা পর্যন্ত হতে পারে। যেমন, গত দু-এক বছরে আমাদের দেশে দেখা গেছে, বহু সাধারণ সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের অ্যাকাউন্টগুলিকে (X, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদি) হয় সাসপেন্ড অথবা পুলিশি খবরদারি কিংবা আইনি প্যাঁচে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে, যারা মোদি বা বিজেপি বিরোধী নানারকম পোস্ট করছেন, তাদেরই বেছে বেছে এইভাবে টার্গেট করা হচ্ছে। অথচ, তারা যে খুব প্রভাবশালী ব্যক্তি তা কিন্তু নয়। এটা আসলে সাধারণ নাগরিকদের কাছে এই বার্তা দেওয়া যে, সোশ্যাল মিডিয়ায় মোদি বিরোধী প্রচার করে নির্বিবাদে টিকে থাকা যাবে না। বরং প্রভাবশালীদের ক্ষেত্রে ততটা কড়াকড়ি নেই। কারণ, তাদের নিয়ে বেশি নাড়াচাড়া করলে তা সামাজিক বলয়ে নানারকম ঘাত-প্রতিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। অতএব, অকিঞ্চিৎকরদের টাইট দিয়েই বাকী আমজনতার গলার স্বর যতটা নিচু করা যায়! কথাটা হল, ইন্টারনেট ও সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলি ক্ষমতায় আসীন কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেই এই নজরদারি ও অনুশাসনগুলি নির্দ্বিধায় চালিয়ে যাচ্ছে।

উল্লেখ্য, গত ৩১ অগস্ট ‘ইন্ডিয়া টুডে’ একটি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার এয়ারটেল, জিও ও বিএসএনএল’এর মতো সংস্থাগুলিকে- সমুদ্রের তলদেশ দিয়ে যে যোগাযোগ প্রযুক্তির কেবলগুলি গেছে- সেগুলিকে ট্যাপ করে নজরদারি চালানোর জন্য উপযুক্ত সরঞ্জাম বসাতে বলেছে। নজরদারির এই সরঞ্জামগুলি জোগান দিচ্ছে ইজরায়েলের Cognyte Septier ‘এর মতো কোম্পানি। এই কেবলগুলি দিয়ে যে অজস্র তথ্য বয়ে চলে, সেগুলিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ডাটা অ্যানালিটিক্স মারফত কপি করে ভারতীয় নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির হাতে তুলে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এই নজরদারিতে আপনার-আমার ইমেইল, হোয়াটসঅ্যাপ কল পর্যন্ত ধরা পড়ে যাবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অনুশাসিত এই ব্যবস্থাপনায় শাসক কর্তৃক নির্দিষ্ট স্পর্শকাতর কীওয়ার্ডগুলিকে ছাকনির মতো ব্যবহার করে নির্দিষ্ট বক্তব্য ও ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হবে। অথচ, এই কুকর্মের জন্য ব্যক্তির স্বাধিকার ও গোপনীয়তা ভঙ্গ করার অভিযোগও আর তোলা যাবে না। কারণ, অতি সম্প্রতি দেশে লাগু হয়ে গিয়েছে ‘ডিজিটাল পার্সোনাল ডাটা প্রোটেকশন অ্যাক্ট ২০২৩’, যা এই ধরনের কাজগুলিকে আইনি মান্যতা দিচ্ছে ‘দেশের অখণ্ডতা, নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে’র নাম করে।

অর্থাৎ, কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে সেন্ট্রাল ভিস্তা নির্মাণ করে ও সংবিধানকে আমূল বদলে দিয়ে যে হিন্দুবাদী ‘সাংবিধানিক রাজতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার খোয়াব দেখছে কেন্দ্রীয় শাসক, সেখানে নজরদারির মাধ্যমে গোটা দেশটাকেই জাতীয় কারাগার বানিয়ে দেওয়াটা হল আবশ্যিক প্রাকশর্ত। সেই লক্ষ্যেই নজরদারির পূর্ণ অনুশীলনে সিদ্ধ হতে চাইছে শাসককুল, যাতে দেশটা অচিরেই হীরক রাজার সভাসদদের মতো ‘ঠিক ঠিক’ বলা প্রজাকুলে ছেয়ে যায়।

এই গভীর বিপন্নতার সামনে দাঁড়িয়ে নতুন করে ভাবতে হবে, কীভাবে আমরা মোকাবিলা করতে পারি একনায়কের অভিলাষ! তাই, মানুষজনও পালটা রণকৌশল বানিয়ে নিচ্ছেন। ভরসাটাও সেখানে।       

4 comments:

  1. ভয় ধরিয়ে ভক্তি আদায়।
    ভয় পেলে চলবে না। তারা যা পারে করুক। সাধারণ মানুষ এমনি ভীতু।
    লেকাটি ভালো।
    অসিত

    ReplyDelete
  2. সুন্দর লেখা। অন্য অন্য লেখা গুলো র মতন এ প্রবন্ধ খুব গভীর তথ্য পূর্ণ এবং আমাদের চিন্তার বিষয় । লেখক কে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন

    ReplyDelete
  3. উত্তম ভট্টাচার্য2 October 2023 at 22:38

    লেখা টা খুবই ভালো লাগলো । আমাদের ভাবনার জগতে দুশ্চিন্তা র খোরাক। লেখক কে অনেক অনেক অভিনন্দন

    ReplyDelete
  4. Bhalo laghlo. E bisoye aro tothyo somriddho lekha chai. -Subrata

    ReplyDelete