Saturday 30 September 2017

নিউটন - এক অকথিত কাহিনি



নির্বাচনী মসকরা ও বর্বরতার কথা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


নূতন কুমার। বাবার দেওয়া নাম। বড় হয়ে নূ’কে পালটে করলেন ‘নিউ’ আর ‘তন’কে ‘টন’- নিউটন। সেই থেকে তিনি নিউটন কুমার। সরকারি চাকরি পাওয়ার পর বাবা-মা নিয়ে গেলেন পাত্রী দেখাতে। গিয়ে দেখেন পাত্রীর বয়স ষোল। বেঁকে বসলেন, নাবালিকা বিয়ে করবেন না। এ হেন নিউটন কুমার এবার চলেছেন দণ্ডকারণ্যের মাওবাদী অঞ্চলে লোকসভা নির্বাচনে প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে।

গল্পটা বলে দিলে ছবি দেখার উত্তেজনাটাই মাটি হবে। বলার এইটুকুই, যে গ্রামের স্কুলে নিউটন অবশেষে পৌঁছলেন ভোট নিতে, সেই গ্রাম ও স্কুল তখন ভগ্নস্তূপ। গ্রামের মানুষেরা আশ্রয় নিয়েছেন সরকারি রিলিফ ক্যাম্পে আর স্কুলটি পড়ে আছে ভাঙ্গাচোড়া চেহারা নিয়ে। কেন? নিউটনের করা এই প্রশ্নে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা অফিসারের উত্তর, ও নিয়ে আপনি ভাবছেন কেন, আপনি ডিউটিতে এসেছেন আমরাও ডিউটি করছি। সঙ্গে থাকা স্থানীয় মেয়েটি জানিয়ে দিল, এখানে খনির কাজ হবে, তাই মাওবাদী দমনের নাম করে নিরাপত্তারক্ষীরা গ্রামটিকে জ্বালিয়ে দিয়েছে।

ভোট পর্বের আয়োজন শুরু হয়। বেলা গড়ায়। একটি মানুষকেও দেখা যায় না ভোট দিতে আসতে। ওদিকে ডিআইজি ফোনে জানান দেন, বিদেশি এক টেলিভিশন crewকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আসছেন মাওবাদী অঞ্চলে নির্বাচনী পর্ব কত শান্তিপূর্ণ ভাবে হচ্ছে তা দেখাতে। আধা-সামরিক বাহিনী নেমে পড়ে তৎক্ষণাৎ। বন্দুকের ডগায় ভোটার ধরে আনতে। বাকীটা দেখে নিন ছবিতে।

সরকারি অফিসের এক সামান্য কেরানি নিউটন তাঁর স্বাভাবিক ডিউটির খাতিরেই বিধি অনুযায়ী যে ভাবে নির্বাচন সমাধা করার কথা, সে ভাবেই করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভারতীয় নির্বাচনী মসকরার বীভৎস মজা এই যে, তা বাস্তবের মাটির সঙ্গে একেবারেই মেলে না। পদাধিকারীরাও চান না তা মিলুক। তাই যা হবার তাই হল। লাঞ্ছিত, প্রহৃত নিউটন অবশেষে প্রাণে বেঁচে ফিরলেন। মাঝখানে ঘটে গেল যা ঘটে, যা প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে।

অমিত মুসকারা পরিচালিত ‘নিউটন’ ভারতীয় নির্বাচনী ব্যবস্থার এই করুণ ও হাস্যকর চিত্রটি দ্ব্যর্থহীন ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছে। নিউটনের ভূমিকায় রাজকুমার রাও অনবদ্য অভিনয়ে এক সাধারণ মানুষের ভেতরের যন্ত্রণা ও কিছু করার তাগিদকে তুলনারহিত ভাবে পেশ করেছেন।

এই ছবিটি থেকে যাবে বালকের সেই দ্বিধাহীন প্রশ্নবাণের মতোঃ রাজা তোর কাপড় কোথায়?

Tuesday 26 September 2017

ডাক্তারদের আবেদন

West Bengal Doctors' Forum Leaflet for the People of West Bengal

ডাক্তারদের কাছ থেকে খোলা চিঠি

সংবাদপত্রের খবর, বিগত সাত-আট মাসে পশ্চিমবঙ্গে চিকিৎসকের ওপর শারীরিক আক্রমণের সংখ্যা পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে। অবশ্য অধিকাংশ নিগ্রহ খবরের কাগজ-টিভিতে আসেনা, তাদের ধরলে অবস্থা আরও অনেক খারাপ, এক বছর আগের তুলনায় তিনগুণ তো বটেই।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম আপনাকে শুধু দেখাতে চাইছে, তাতে পশ্চিমবঙ্গের মানুষের ঠিক কতটা লাভ হল।

এবছর ফেব্রুয়ারিতে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী বেসরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তাদের খুব ধমকালেন, টিভিতে তা সরাসরি সম্প্রচার হল। বেসরকারি হাসপাতালের ত্রুটি তাতে কতটা কমল সে ব্যাপারে স্বাস্থ্যমন্ত্রক কোনো পরিসংখ্যান পেশ করে নি, কিন্তু সেদিন থেকে আজ ডাক্তারদের ওপর আক্রমণ ঘটেই চলছে। শুধু বেসরকারি ডাক্তাররা মার খাচ্ছেন তা নয়, সরকারি ডাক্তাররা সংখ্যার বিচারে বেশিবার আক্রান্ত হয়েছেন।

কারা মারছেন ডাক্তারদের? ক্ষুদ্ধ রোগী নেই যে তা নয়, কিন্তু প্রায় প্রতিটি ঘটনার পরে দেখা যাচ্ছে, তাঁদের ন্যায্য বা অন্যায্য বিক্ষোভের পর যখন ভাঙ্গচুর মারধোর শুরু হচ্ছে তখন রাশ চলে যাচ্ছে অন্য লোকেদের হাতে। আর আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না রোগীরাও—সেদিন জোকা-র সরকারি হাসপাতালে রোগীমৃত্যুর পরে একদল আক্রমণকারী আইসিইউ-তে চড়াও হয়ে এক বয়স্কা রোগিণীর অক্সিজেন-স্যালাইন খুলে তাঁকে মেরে ফেললেন। অতএব ডাক্তারের ওপরে রোগী ক্ষেপে গেছে, কেবল এমনটা নয়। একবার ভাঙ্গচুর শুরু হলে গুণ্ডা আর রাজনীতিতে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে আগ্রহীরা আসছেন, তোলাবাজরাও বাদ নেই। বর্বর আক্রমণ হচ্ছে ডাক্তার-নার্স থেকে অন্য রোগীদের ওপরেও। সরকারি জিনিসপত্রের ক্ষতি হচ্ছে, সরকারি কর্মীরা কাজে বাধা পাচ্ছেন, রোগীরা হয়রান হচ্ছেন—সরকার ফিরে দেখছেনও না্। বেসরকারি হাসপাতাল হোক আর সরকারি, অপরাধীরা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে, পুলিশ তাদের নামে কেস নিচ্ছে না, নিলেও ধরছে না। সন্দেহ হয়, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে কী নির্দেশ আছে? অন্যদিকে, বড় মিডিয়া দিনের পর দিন অপরাধীদের হিরো বানিয়ে দিচ্ছে, আর ডাক্তারদের ভিলেন।

এর ফল ফলতে শুরু করেছে। কিছু ডাক্তার চাকরি ছেড়েছেন, কিছু ডাক্তার বিশেষ দায়িত্ব ছেড়েছেন। আজ ডাক্তারদের জন্য সরকারি চাকরি দেবার বিজ্ঞপ্তিতে সাড়া কম, চাকরিতে যোগদান আরও কম। সরকারি স্বাস্থ্যপরিষেবায় ডাক্তারের অভাব চিরকালের, কিন্তু এবার তা সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম। সরকার বয়স্ক ও রোগগ্রস্ত ডাক্তারদের রিটায়ার না করিয়ে আর বন্ড দিয়ে সদ্য-পাশকরা ডাক্তারদের তিনবছর গ্রামে পাঠিয়ে ডাক্তারের অভাব কমিয়ে দেখাচ্ছেন। কিন্তু এঁদের দিয়ে দায়ঠেলা হয়, মানুষের জীবন বাঁচানোর কাজটা দায়ঠেলা করে হয় না।

কিন্তু এ হল সমস্যার চূড়া, আরও গভীরে তার ডালপালা, শিকড়। আসল কথাটা হল, ডাক্তার এখন চিকিৎসা করতেই ভয় পাচ্ছেন। মনোযোগ না দিয়ে রোগী ঠিকভাবে দেখা যায় না। এতদিন বেশ কিছু ডাক্তার ছিলেন যাঁরা পয়সাটাকেই মুখ্য করে দেখতেন, রোগীর কাছ থেকে কেমন করে পয়সা হাতানো যায় তাই ভাবতেন। তাঁরা ডাক্তারি পেশাটাকেই জনমানসে অনেক হেয় করেছেন। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে সবথেকে রোগীদরদী ডাক্তারও রোগী দেখার সময় পুরো মনোযোগ সেদিকে দিতে পারছেন না; ভাবছেন, কী করলে আক্রমণ আসবে না, প্রেসক্রিপশনে কী লিখলে পরে রোগীর শুভার্থী-ভোটপ্রার্থী হঠাৎ-আপনেরা তাঁর দরজায় হানা দেবে না, আদালতে কোন কথাটা মান্য হবে। এমন পরিবেশে ভাল চিকিৎসা অসম্ভব। রাতবিরেতে শহরে-মফস্বলে ডাক্তার আর বাড়ি গিয়ে রোগী দেখছেন না, কেন না যথাসাধ্য চেষ্টার পরও যদি খারাপ কিছু ঘটে তবে রোগীর বাড়ির লোক হয়তো ছেড়ে দেবেন, কিন্তু পাড়ার দাদারা ছাড়বেন না—জনদরদী সাজার সহজ রাস্তা এখন ডাক্তার পেটানো, আর পুলিশ এব্যাপারে ঠুঁটো জগন্নাথ।

টাকাকড়ি যত বেশি মানুষের মূল্যবিচারের মাপকাঠি হয়ে উঠেছে, লোকের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেবা করার মতো ডাক্তার ততো কমেছে। তারপর এল ডাক্তারের জন্য ক্রেতাসুরক্ষা আইন, বাড়ল চিকিৎসা-গাফিলতির মোকদ্দমা। ডাক্তারকে বাধ্য হয়েই সতর্ক হতে হল। সামান্য উপকরণে রোগীর সাধ্যমত চিকিৎসা করার দায় নেওয়া আর সম্ভব হল না। বিজ্ঞানের নিয়মেই সব রোগী ভাল হবে না, তাঁরা যদি আদালতে অভিযোগ করেন তো ডাক্তার রোগীর কথা ভেবে কম পয়সায় চিকিৎসা করিয়েছেন এমন কথা জজসাহেব মানবেন না। শ্রেষ্ঠ প্রমাণিত চিকিৎসা না-করানোর অভিযোগে ডাক্তারের সাজা হবে। ফলে ডাক্তারদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করিয়ে, দামী ওষুধ না দিয়ে, চিকিৎসার উপায় রইল না। আর সাধারণ লোক ভাবলেন, নির্ঘাত ল্যাবরেটরির কমিশন খেয়ে বেশি পরীক্ষা করছে, ওষুধ কোম্পানির পয়সা নিয়ে দামি ওষুধ লিখছে! যেহেতু কিছু ডাক্তার (যাদের অনেকেই ভূয়ো ডাক্তার বলে ধরাও পড়েছেন) এসব করেন, সেহেতু গোটা পেশাটাই কালিমালিপ্ত হল। এভাবে রোগী আর ডাক্তার—উভয়েরই ক্ষতি বেড়ে চলল, পাল্লা দিয়ে বাড়ল অবিশ্বাস।

কেন এমন হল?  এর উত্তর পেতে গেলে গত আড়াই-তিন দশকের খবরের কাগজের পাতাগুলো উলটে দেখতে হবে। ১৯৯০ সালেও কলকাতায় বড় কর্পোরেট হাসপাতাল ছিল না বললেই চলে। সেই সময় সমস্ত খবরের কাগজ সরকারি হাসপাতালগুলোর দোষ দেখাতে উঠেপড়ে লাগল। নোংরা, পরিষেবা খারাপ, ব্যবহার খারাপ। এর পুরোটা অসত্য, তা নয়। সরকার এব্যাপারে কিছু করলে, দোষ শোধরাত। কিন্তু তা হল না। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষ কষ্ট করেও নার্সিং হোমে যাওয়া অভ্যাস করে ফেললেন, একটু পয়সাওলারা গেলেন চেন্নাই-মুম্বাই-দিল্লী, আর বড়লোকেদের জন্য অল্প কিছু দামী জায়গা তো ছিলই। ক্রমে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হলে সামাজিক মর্যাদাহানি হতে শুরু করল। ততদিনে একে একে অনেকগুলো বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতাল এসে গেছে কলকাতায়। এবার লোকে যেন বুঝে গেল, সরকারি হাসপাতাল মানে সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। ঝাঁ-চকচকে হাসপাতালগুলো কোনো কাজ করেনি, কেবল পয়সা নিয়েছে, তাও নয়। কিন্তু অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের সঙ্গে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যও যে মানুষের পাওনা একটা দাবি, তা না মেটানোর সংকটবোধ আর মধ্যবিত্ত-উচ্চমধ্যবিত্তের মননে ঠাঁই পেল না। প্রাইভেট স্কুল আর প্রাইভেট হাসপাতালের রমরমাতে অধিকার-এর ব্যাপারটা হারিয়ে গেল।

পড়ে রইলেন গ্রাম-মফস্বলের মানুষ এবং শহরের হতদরিদ্রজন। চিকিৎসাবিজ্ঞান বর্তমানে কী পারে আর কী পারে না, কতটা চিকিৎসা পরিষেবা কোথায় পাওয়া সম্ভব, সেটা তাঁরা জানেন না। ফলে এঁদের দিয়ে ডাক্তারের মুখে বিষ্ঠা মাখানো মারধর করানো সম্ভব, কিন্তু যথার্থ পরিষেবার জন্য চিন্তা করে দাবী রাখা বা আন্দোলন করা প্রায় অসম্ভব। আর এঁদের পাশে শহুরে মধ্যবিত্তের দাঁড়ানোর বাস্তবভূমি নেই, কেননা তাঁরা সরকারি পরিষেবা নেন না, তা নিয়ে তেমন ভাবিত নন। অন্যদিকে সরকারি চিকিৎসকদের হয় আজ্ঞাবহ ভৃত্যে পরিণত করা হয়েছে বা করার চেষ্টা হয়েছে, অথবা তাড়ানো হয়েছে।

আমাদের স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সব মানুষের অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষার অধিকারের কথা বলেন সব দল, অথচ ক্ষমতায় গেলে সেসব অধিকার দেন না। তাঁদের একটা আড়াল চাই। ভারতে ধনীদের সেবা করতে চাইলেও দরিদ্র ও সাধারণ মধ্যবিত্তের ভোটেই জিততে হয়। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে দায়িত্ব সরকারের কাঁধ থেকে নামাতে চাইলে, সেখানে গোপনে বড় ব্যবসাদারদের লাভের পুরো সুযোগ করে দিতে চাইলে, আর সেটা করতে গিয়ে মানুষের ক্ষোভের মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইলে মানুষের চোখের সামনে একটা কাকতাড়ুয়া-শ্রেণীশত্রু খাড়া করতে হয়। ডাক্তার সেই কাকতাড়ুয়া, কেন না তাকেই চিকিৎসাক্ষেত্রে সবচেয়ে আগে দেখা যায়। আর ডাক্তারই সেই শ্রেণীশত্রু, কেন না এই গরীবের দেশে সে তুলনায় অবস্থাপন্ন। অতএব অসুর নির্মাণ, হাতে খড়্গ, গলায় স্টেথোস্কোপ, পেশায় রক্তচোষা।

কিছু ক্ষমতাবান ও ক্ষমতালিপ্সু মানুষ ও দল কাকতাড়ুয়া-শ্রেণীশত্রুর ওপর মানুষের ক্ষোভকে কাজে লাগাচ্ছে, ডাক্তারের চিকিৎসার ভুল-ঠিক বিচার করছে তারা, হাতেগরম শাস্তি দিচ্ছে, মানুষ খুশি হছেন, বা আতঙ্কে নিশ্চুপ। ক্ষমতাধরদের হিসেব সোজা। মানুষকে স্বাস্থ্যের অধিকার দেওয়া কঠিন কাজ, কিন্তু মানুষ সেটাই চায়। অতএব বানিয়ে দাও হাসপাতাল-ইমারত, টিভি-তে খবরের কাগজে ঘোষণা করে দাও চিকিৎসার সব ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, রোগী বুকে বড় আশা নিয়ে যাক হাসপাতালে। হাসপাতালের দেওয়াল জুড়ে লিখে রাখো, সকল ব্যবস্থা আছে। ডাক্তারের মুখ থেকে সে যেন প্রথম শোনে, বেড নেই, ওষুধ নেই, ডাক্তার-নার্স-স্বাস্থ্যকর্মীদের ইত্যাদিও খুব কম। সে নিজের মতো করে বুঝে নেবে সরকারের দোষ নয়, ডাক্তারের দোষ। আর রোগী যদি নাও বোঝে, আশেপাশে শুভার্থী-ভোটপ্রার্থীরা আছেন, তাঁরা গলার জোরে বা গায়ের জোরে রোগীর জন্য বেড আদায় করবেন, তাঁর সঙ্গে সুরে সুর না মিলিয়ে অসহায় রোগী করবেই বা কী?

ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম মনে করে ডাক্তার ও রোগীর স্বার্থ এক ও অভিন্ন—রোগকে প্রতিরোধ করা, রোগ হলে তাকে সারানো, সারাতে না পারলে যতটা সম্ভব আরাম দেওয়া। চিকিৎসাবিজ্ঞান এখনও সবকিছু নিশ্চিত করে বলে দিতে পারে না। তাই ডাক্তারকে বিশ্বাস না করে রোগীর উপায় নেই। অপরপক্ষে, ডাক্তারেরও রোগীকে সারানোর সাধ্যমতো চেষ্টা না করে উপায় নেই, নইলে সে নিজের কাছেই প্রত্যহ মরে যাবে, প্রত্যহ অর্থহীন এক জীবন টেনে নেবার গ্লানিতে তার দমবন্ধ হয়ে আসবে।

ডাক্তারকে আপনারাই বাঁচাতে পারেন। কেবল শারীরিক আক্রমণের হাত থেকে নয়, তার ডাক্তারিবিদ্যাকে নিছক টাকা রোজগারের এক যন্ত্র হয়ে ওঠার হাত থেকে।

তাই জেলায় জেলায় রোগী, তাঁর পরিজন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা সকলে ঐক্যবদ্ধ হোন। ডাক্তার ও স্বাস্থ্যকর্মী নিগ্রহ বন্ধ করা ও সুচিকিৎসা পাবার দাবিতে জনমত গড়ে তুলুন।

ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টরস’ ফোরাম,‌ ২৪৫, রামকৃষ্ণ রোড, নব ব্যারাকপুর, কলকাতা ৭০০ ১৩১'এর তরফে ডা. অর্জুন দাশগুপ্ত কর্তৃক প্রকাশিত

Monday 18 September 2017

তর্কপটু ভাঙড়



গ্রামবাসীদের প্রশ্নে পাওয়ার গ্রিড কর্তারা দিশেহারা
তুষার চক্রবর্তী
 
ভাঙ্গড়ের সভার একাংশ

যে কাজ শুরু করার কথা প্রকল্প হাতে নেবার আগে, অনেক বিপর্যয়ের পর অবশেষে পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার কর্তাব্যক্তিরা থমকে যাওয়া সেই প্রকল্প নিয়ে গ্রামবাসীদের সঙ্গে আলোচনার সোজা রাস্তায় পা রাখলেন গত শনিবার (১৬/৯/২০১৭)l পাওয়ার গ্রিড সংক্রান্ত এই বিশেষ আলোচনাসভা অনুষ্ঠিত হল পোলেরহাট হাই স্কুলেl গ্রামবাসীদের স্বসংগঠিত 'জমি জীবিকা বাস্তুতন্ত্র ও পরিবেশ রক্ষা কমিটি'র সঙ্গে ১২ সেপ্টেম্বর বারুইপুর জেলার পুলিশ সুপারের মিটিংএ, পুলিশ সুপারের তত্বাবধানে ও জেলা পরিষদের সদস্য কাইজার আহমেদের আয়োজনে এই আলোচনা সভার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়l সভায় গ্রামবাসীদের জন্যে ২০০টি গেটপাস ছাপানো হয় যার অর্ধেক কাইজার নিজের অনুগতদের মধ্যে বিলি করেন ও বাকী অর্ধেক জমি রক্ষা কমিটির হাতে দেওয়া হয়l কিন্তু, এই সভার সব চাইতে লক্ষণীয় দিক হল এই যে তা সত্বেও সভায় গ্রামবাসীদের মধ্যে বিন্দুমাত্র বিভাজন দেখা যায়নিl ভরাট সভা একযোগে জমি রক্ষা কমিটির আমন্ত্রিত বিশেষজ্ঞদের প্রতিটি বক্তব্য বিপুলভাবে করতালি দিয়ে সমর্থন করেন ও পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষকে বারংবার বেআইনি কাজের অভিযোগে জর্জরিত করেনl আর পাওয়ার গ্রিড কর্তাদের যোগাড় করা দুজন বিশেষজ্ঞ এ সব দেখে কোনও কথা না বলে সভা থেকে চুপি চুপি মাঝপথে পালিয়ে যানl

সভায় পাওয়ার গ্রিড কর্পোরেশনের  তরফে ছিলেন মোট ১১ জন, যাদের ৭ জন নিজেদের পরিচয় দেনl এঁদের নেতৃত্ব দেন এস কে লাহিড়িl কলকাতা ছাড়াও দিল্লি থেকেও এঁদের কয়েকজন এসেছিলেনl সম্পূর্ণ সভার কাজ পাওয়ার গ্রিডের তরফে ভিডিও রেকর্ড করা হয়l পাওয়ার গ্রিডের আমন্ত্রণে শিবপুর ও প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন অধ্যাপক নির্বাক শ্রোতা হিসেবে সভায় প্রথম দিকে ছিলেন  এবং গ্রামবাসীদের প্রশ্নে পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষ যখন দিশেহারা হচ্ছেন, তখন তাঁরা সেমিনার ত্যাগ করেনl একটি সংবাদপত্রে তাঁদের নাম করে যে বক্তব্য ছাপা হয়েছে তার কোনও বাস্তব অস্তিত্ব সভার রেকর্ডিং'এ তাই পাওয়া যাবে নাl

জমি রক্ষা কমিটির তরফে সভায় যোগ দেন বিজ্ঞানী নিশা বিশ্বাস, জীববিজ্ঞানী তুষার চক্রবর্তী, যাদবপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জীব আচার্য, কম্পুটার সায়েন্সের ছাত্র প্রিয়ম বসু ও ভাঙড় সংহতি কমিটির সভাপতি শংকর দাসl প্রিয়ম বসু এঁদের তরফ থেকে পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষের বেআইনি কাজের তালিকা পেশ করা শুরু করতেই গ্রামবাসীদের পূর্ণ সমর্থন দেখে উদ্বিগ্ন কাইজার পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষের কাছে উঠে আসা প্রশ্নের একে একে জবাব চাইতে শুরু করেনl সম্ভবত, মতলব ছিল পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষকে গুরুত্ব দিয়ে অবস্থা বাগে আনাl কিন্তু, পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষ সাফাই গাইতে গিয়ে আরও বিপদে পড়ে যানl শেয়ার বাজারে শেয়ার বিক্রি করতে গিয়ে SEBI'র কাছে দেওয়া নথিতে পাওয়ার গ্রিড যে সব আশংকা ও ক্ষতির কথা স্বীকার করেছে, তার ব্যখ্যা দিতে গিয়ে হাস্যকরভাবে আমতা আমতা করে বলে ফেলেন যে 'সরকার আমাদের ওসব লিখতে বলে, তাই ওগুলো আমাদের লিখতে হয়l' IFC'র আন্তর্জাতিক নিয়মে যে জলাভূমির ওপরে ট্রান্সমিশন লাইন টানার নিষেধ আছে, অথচ এখানে একাধিক জলাভূমির ওপর দিয়ে লাইন টানা হয়েছে সেই অপরাধ তারা মেনে নিতে বাধ্য হনl ইটভাটার ৫০০ মিটারের মধ্যে লাইন টানার নিষেধ আইনে থাকা সত্বেও তাঁরা কেন একেবারে ইটভাটার ওপর দিয়েই লাইন টেনেছেন তার উত্তরে তাঁরা নতুন প্রযুক্তির যুক্তি দিতে ব্যগ্র হয়ে ওঠেন, কিন্তু সেই যুক্তি যাই হোক, আইন না ভেঙ্গে দরকার হলে আগে যে আইন বদলাতে হবে সে কথা গ্রামবাসীরা সমস্বরে মনে করিয়ে দিলে তাঁরা দিশেহারা হয়ে যানl বসতবাড়ি এমনকি প্রাথমিক স্কুলের ওপর দিয়ে বেআইনি ভাবে কেন  লাইন টানা হয়েছে এর জবাব দিতেও তাঁরা ব্যর্থ হনl এমনকি এর জন্যে লাইনের দু' পাশে আইনগত ভাবে যে ছাড় দেবার কথা সেই ৪৬ মিটার ROW'এর (right of way) প্রশ্ন উঠলে তাঁরা ৩০ মিনিট ধরে বিষয়টি না বোঝার ভান করে কালক্ষেপ করা শুরু করে দেন; যা গ্রামবাসীরা ধরে ফেলেনl গ্রামবাসীরা পাওয়ার গ্রিডের সরকারি বিবৃতিতে এর নাম 'রাজারহাট প্রকল্প' এবং কোনও নথিতে ভাঙড় উল্লেখিত না থাকার অসংগতির জবাব চাইলে কর্তৃপক্ষ দিল্লির কাছে 'যা রাজারহাট তাই ভাঙড়' বলে আরও বিপদে পড়ে যানl আসলে, রাজারহাট অ্যাকশন এরিয়া ৩ যে পাওয়ার গ্রিডের জন্যে ধার্য ছিল সেই ঘোষণা ও সাইনবোর্ড ভাঙড় এলাকাবাসী দেখেছেনl তৃণমূল সরকার ক্ষমতায়  আসার পরে যার পরিবর্তন ঘটেছে এদের  চোখের সামনেl দিল্লির অজ্ঞতা দেখিয়ে সেই অপ্রিয় সত্যকে ঢাকার চেষ্টা তাই মাঠে মারা যায়l
সভার শেষ দিকে
সময় তখন প্রায় পাঁচটাl পাওয়ার গ্রিড কর্তৃপক্ষ পালাতে চাইছেনl বিতর্ক যে শুরু হয়েছে তার ইতিবাচক দিক মেনে ও পাওয়ার গ্রিড যেন আরও দক্ষতা সম্পন্ন বিশেষজ্ঞ এনে ও প্রশ্ন না এড়িয়ে অনতিবিলম্বে ঠিক ঠিক জবাব দেন সেই আশা রেখে কাইজার আহমেদ সভা শেষ করে দেনl সভায় পাওয়ার গ্রিডের পরাজয়ে কার্যত বিপুল বিরক্তি তিনি চোখে মুখে প্রকাশ করে ফেলেনl  

তর্কে নেমে গ্রামবাসীরা যে কথাটা সোজাসাপ্টা জানিয়ে দিয়েছেন তা হল, এলাকায় না এসে, উদ্বিগ্ন গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথাবার্তা না বলে যারা বাড়িতে বা দফতরে বসে প্রকল্পের ফলে ক্ষতি হবে কী হবে না সেই বিধান দেবেন, তাঁদের কথা তাঁরা কখনই মানবেন নাl কলকাতা হাইকোর্ট অন্যায়ভাবে UAPA ধারা প্রয়োগ ও কর্তব্যে গাফিলতির জন্যে নিম্ন আদালতের বিচারকদের তিরস্কার করেছিলl পুলিশ সুপার কয়েকদিন আগে স্বীকার করেছেন যে গ্রামবাসীদের আন্দোলন গণতান্ত্রিক, অথচ তা নাকি বে-আইনিl বোঝা গেল, তিনি প্রবাদপ্রতিম সোনার পাথরবাটির সমঝদার! আর, গ্রামবাসীরা এককাট্টা হয়ে যেভাবে আজ তর্কের নামে বিভাজনের পাশা উল্টে দিয়ে পাওয়ার্ গ্রিড কর্তাদের খাবি খাওয়ালেন, আশা করি তা থেকে শিক্ষা নেবে এ রাজ্যের  সরকারl সভা শেষে, গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে এটাই জানলাম যে তাঁরা আশা করছেন, এবার অন্তত মুখ্যমন্ত্রী প্রকল্পকে ভাঙড় থেকে পাততাড়ি গুটিয়ে নেবার নির্দেশ দেবেনl

Thursday 7 September 2017

সেপ্টেম্বর সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন

'আমার জীবন ও সাহিত্য' - আনসারউদ্দিন
অরুণাভ বিশ্বাস
 উপস্থিত শ্রোতাদের একাংশ

রথ দেখতে এসে যদি কলা বেচা যায়, তাহলে 'একক মাত্রা'র সাম্প্রতিকতম সংখ‍্যার প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে অতিথি বক্তৃতা শুনে আর হাতে গরম সংখ‍্যা নিয়ে বাড়ি ফেরাও যায়। এই উদ্দেশ‍্যে গত ২ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টেয় কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের ব‌ই-চিত্র গ‍্যালারিতে পত্রিকার যে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়েছিল তাতে বৃষ্টি উপেক্ষা করে পাঠকবন্ধুদের উপস্থিতি ছিল আশাতীত। মূল অনুষ্ঠান শুরুর আগে মনসিজ দত্ত সাম্প্রতিক উত্তরবঙ্গের ভয়াবহ বন‍্যা পরিস্থিতিতে সরকারি ত্রাণ ও সাহায‍্যের অপ্রতুলতার কথা বলে এই প্রসঙ্গে 'একক মাত্রা'র হোয়াট্‌স‌অ্যাপ গ্ৰুপের সদর্থক ভূমিকার কথা তুলে ধরেন। মনসিজবাবুর তত্ত্বাবধানে এ পর্যন্ত প্রায় চল্লিশ হাজার নগদ টাকার বন‍্যাত্রাণ তহবিল গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও বহু ওষুধপত্র, জামাকাপড়, শুকনো খাবারও সংগ্রহ করা হয়। প্রসঙ্গত তিনি জানান অপরিকল্পিতভাবে নির্মিত ন‍্যাশনাল হাইওয়ে উঁচু বাঁধের কাজ করায় অতিরিক্ত বৃষ্টির জল বেরতে না পেরে এই বন‍্যার সৃষ্টি হয়েছে।

'একক মাত্রা'র বন্যাত্রাণের উদ্যোগ নিয়ে বলছেন মনসিজ দত্ত

এরপর বিমল দেব ২ সেপ্টেম্বর কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ‍্যায়ের জন্মদিনটিকে স্মরণ করেন। বিমলবাবু বলেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ছিলেন সেই ঘরানার কবি যিনি প্রতিবাদী চেতনা জাগরিত করেন, জিজ্ঞাসার জানলা খুলে দেন, আবার লোকায়ত চিরায়ত শাশ্বতর প্রতিও শ্রদ্ধা পোষণ করেন। আফ্রিকার ব্ল‍্যাক পোয়েট্রি, ল‍্যাংস্টন হিউজ বা বেঞ্জামিন মোরালেসের কবিতার প্রতিও আকৃষ্ট ছিলেন তিনি। ঋত্বিক ঠাকুর এরপর বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কবিতা আবৃত্তি করেন। অমিত চৌধুরি বন্দীমুক্তি আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ‍্যায়ের অগ্ৰণী ভূমিকার কথা বলেন। তিনি জানান এই কবি শুধু নানান কবিতা পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতাই করতেন না, কবিদের তৈরি করতেন।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় স্মরণে বলছেন বিমল দেব

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা আবৃত্তি করলেন ঋত্বিক ঠাকুর

অনুষ্ঠানের মূল অংশে দেবলীনা ভট্টাচার্য অতিথি বক্তা আনসার‌উদ্দিনের হাতে গোলাপ ফুলগাছের চারা উপহার স্বরূপ তুলে দেন। মোড়ক উন্মোচনের জন‍্য  'একক মাত্রা'র সেপ্টেম্বর'১৭ সংখ‍্যার কপি তাঁর হাতে তুলে দেন মধুময় পাল। আলোক চট্টোপাধ‍্যায় অতিথি বক্তা আনসার‌উদ্দিনের সাথে উপস্থিত সকলের পরিচয় করিয়ে দেন। নদীয়া জেলার নাকাশিপাড়ায় জন্মানো এই লেখকের বর্তমান নিবাস ঐ জেলার‌ই ধুবুলিয়ায়। পেয়েছেন বহু সম্মান (সোমেন চন্দ পুরস্কার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রদত্ত ইলা চন্দ পুরস্কার, গল্পমালা পুরস্কার, লিট্‌ল ম‍্যাগাজিন সংগ্রহশালা প্রদত্ত পুরস্কার)। প্রিয় গল্পকার সুবোধ ঘোষ এবং প্রিয় লেখক প্রেমচন্দ। এরপর আলোকবাবু আনসার‌উদ্দিনের গো-রাখালের কথকতার গুণমুগ্ধ পাঠক শ্রদ্ধেয় সৌমিত্র চট্টোপাধ‍্যায়ের দীর্ঘ একটি চিঠি পড়ে শোনান। উপন‍্যাসটি সৌমিত্রবাবুর মতে গ্ৰামবাংলার রাখালগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার এক মহাকাব‍্যিক বয়ান যা আনসার‌উদ্দিনের নিজস্ব অভিজ্ঞতা ও জীবনচর্যার রসে জারিত হয়ে সার্থক রূপ পেয়েছে। এই কারণেই তিন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের লেখাকে সৌমিত্রবাবু শহুরে সীমানা পেরিয়ে মাটির কাছাকাছি নেমে আসা লেখা বললেও গো-রাখালের কথকতাকে মাটির ভিতর থেকে উঠে আসা আখ‍্যান বলে মনে করেন। তাঁর মতে সতীনাথ ভাদুড়ী বা অদ্বৈত মল্লবর্মনের মতোই আনসার‌উদ্দিন বাংলা সাহিত‍্যের ব‍্যতিক্রমী তথা বিরল জাতের লেখক।

আনসারউদ্দিনের হাতে 'একক মাত্রা'র তরফে স্মারক হিসেবে গাছের চারা তুলে দেন দেবলীনা ভট্টাচার্য

'একক মাত্রা'র সেপ্টেম্বর সংখ্যার মোড়ক উন্মোচন
বাঁদিক থেকে অমিত চৌধুরী, অনিন্দ্য ভট্টাচার্য, মধুময় পাল ও আনসারউদ্দিন

পাঠক ও শ্রোতাদের সঙ্গে আনসারউদ্দিনের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন আলোক চট্টোপাধ্যায়

'আমার জীবন ও সাহিত্য' - এই বিষয়ে আনসার‌উদ্দিন তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। ছোটবেলা থেকে দৈন‍্যের মধ‍্যে মানুষ। লেখাপড়া শিখেও চাকরি পাননি বা কোনও ব্যবসা করেননি। চিরকাল মাটির সাথে যুক্ত। তাই নিজেকে প্রান্তিক চাষি বা কৃষিজীবী মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলতে শুরু করেন আনসার‌উদ্দিন। গায়ে পাট পচাইয়ের গন্ধ নিয়ে শহুরে শিক্ষিত বিদ্বজ্জনকে নিজের বক্তব‍্য আদৌ কতটা বোঝাতে পারবেন সে নিয়ে প্রাথমিক দ্বিধা কাটিয়ে, 'একক মাত্রা'র পাঠকেরা তাঁর লেখার সাথে পূর্বপরিচিত আছেন সেই ভরসায় কথার মায়াজাল বিস্তার করেন তিনি। যাত্রা থিয়েটার নিয়ে মেতে থাকা বাবা ছিলেন স্বভাব বাউন্ডুলে। হঠাৎ হঠাৎ দলের সাথে উধাও হয়ে যেতেন। বেশ কয়েকদিন পর হঠাৎ করে একাধিক বন্ধুবান্ধব নিয়ে ফিরে এসে সকলকে ভাত বেড়ে দিতে বলতেন। মা পড়তেন বিড়ম্বনায়। বাড়িতে হাত ধোওয়ার জল ছাড়া আর কিছু দেবার মতো থাকত না। অন‍্যদিকে অনাহুত অতিথিদের উদরপূর্তির হাত থেকে বাঁচাতে হাঁস-মুরগিগুলোকে প্রতিবেশীদের ঘরে লুকিয়ে রাখতেন মা। কাজেই অতিথি সৎকারের জন‍্য হাত পাততে হতো প্রতিবেশীদের কাছে। চেয়ে আনতে হতো চাল যা তাঁদের নিজেদের‌ই জুটত না। বলা বাহুল‍্য, বৈষয়িকী জ্ঞানহীন এমন গৃহকর্তা অচিরেই শরিকি বঞ্চনার শিকার হবেন। পরিবারের গবাদিপশু বাঁটোয়ারার সময় শীর্ণ রোগগ্ৰস্থ গরুগুলিই ভাগে পড়বে। বিঘে দশেক জমি হাতছাড়া হবে। নিদারুণ অভাব হয়ে উঠবে নিত‍্যসঙ্গী। খিদে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়া আবার খিদে নিয়েই জেগে ওঠা। তবুও আনসার‌উদ্দিন অভাবকে অভাব বলে মনে না করায় টলেননি কোনওদিন।

'আমার জীবন ও সাহিত্য' বলছেন আনসারউদ্দিন

ছোটবেলায় মামার বাড়ি গিয়েও কাজ করে খেতে হত আনসার‌উদ্দিনকে। বাচ্চাদের দাঁড় করিয়ে ম‌ইটানা হত। তাঁকেও মামারা সকালে পান্তাভাত খাইয়ে মাথায় ফেট্টি বেঁধে জ্যৈষ্ঠের প্রখর তাপে ম‌ইয়ের উপর দাঁড় করিয়ে দিতেন। শরীর থেকে অতিরিক্ত জল বেরিয়ে যাওয়ার ফলে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যেত। সারাদিন কাজের পর প্রবল মাথা যন্ত্রণায় বেহুঁশ হয়ে গেলে সন্ধ‍্যেবেলায় মামারা কলতলায় শুইয়ে দিয়ে গায়ে পলিমাটি লেপে দিতেন। পলি গা থেকে তাপ শুষে নেওয়ার পর চোখ খুলে দেখতেন রাত হয়ে গেছে। মামার বাড়িতে জলঙ্গী নদীতে স্নান করতে হত। প্রথম দিকে নদীতে নামতে ভয় ছিল। কুমিরের ভয়। পরে ভয় কেটে গেলে কখনও নদীর ঢেউ দু' হাতে থাবড়িয়ে আবার কখনও ডুব সাঁতার দিয়ে চলত নদী পারাপার। ঢেউগুলোকে বালিশ বানিয়ে শুয়ে থাকতে ইচ্ছা হত। সাঁতারে এতটাই দক্ষ হয়ে ওঠেন যে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় গেলেই প্রথম বা দ্বিতীয় স্থান ছিল বাঁধা। ফিরে এলে মা বেড়ে দিতেন বহুকাঙ্ক্ষিত এক থালা গরম ভাত। কোথাও একজনের নিমন্ত্রণ থাকলে বাবা নিজে না গিয়ে পাঠিয়ে দিতেন দুটো ছোট ছেলেকে। একজনের বদলে দুজন তো পেটপুরে গরম ভাত খেতে পারবে -- এই ছিল যুক্তি। খাওয়ার পর শোওয়া আর তাতেও দারিদ্রের থাবা। ছোট্ট কুঁড়েঘরে দুপা গুটিয়ে শুয়ে থাকতে হত সারারাত। মনে হতো ঐভাবে শোওয়ার চেয়ে দেওয়ালে ঠেসে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়ানোও বোধ হয় অনেক আরামদায়ক। পরিণত বয়সে তাই তার সরস আক্ষেপ হয়তো আরও একটু লম্বা তিনি হতে পারতেন ছোটবেলায় ঐভাবে শুতে না বাধ‍্য হ‍লে। লেপ-কম্বলের অভাবে শীতকাল ছিল অসহনীয়। শীতের রাতে উষ্ণতার অভাব বাবার মনকেও করে তুলেছিল শীতল। তাই কারও ধানের গোলায় আগুন লেগে গেলে বাবা দুই শিশুপুত্রকে বসিয়ে দিতেন আগুনের ধারে। প্রতিবেশীর সর্বনাশের থেকেও বড় হয়ে উঠত নিজ সন্তানের স্বার্থচিন্তা -- অন্তত এক রাতের জন‍্য হলেও তো শীতের হাত থেকে ছেলে দুটোর রেহাই।

এভাবেই চরম দারিদ্র্য আর অনটনের মধ‍্যে বড় হয়ে ওঠা। একে তিনি ভুলতে পারবেন না কোনওদিন। ভোলা উচিত‌ও নয় তাঁর মতে। অভাব বা অনটন তাই তাঁর গল্প উপন‍্যাসে ফিরে ফিরে আসে। এ নিয়ে তাঁর খেদ নেই। কোনও হীনম্মন‍্যতা নেই। দারিদ্র্য তাঁর কাছে এক অনুভব যা তিনি "enjoy" করতেন। এখন‌ও তিনি যখন ধান কাটা খড় কাটার ফলে তাঁর দু হাতের ফোস্কাগুলোকে দেখেন তখন নিজের ছোট ছোট দুই ছেলেকে লজেন্স কিনে দিতে না পারার দুঃখ তিনি ভুলে যান। কায়িক শ্রমের চিহ্নস্বরূপ ঐ ফোস্কাগুলোকে মনে হয় ছেলেদের জন‍্য কিনে আনা লজেন্স। শ্রোতাদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান তাঁর নিজের পরিবার বা গ্ৰাম হয়তো অনেক পাল্টেছে। গ্ৰামের ছেলেরা দুবাই মুম্বাই বা কেরালায় কাজ করতে গিয়ে বাড়িতে অনেক টাকা নিয়ে আসছে যা দিয়ে নানান বৈদ‍্যুতিন গৃহসরঞ্জাম কেনা হচ্ছে। শিলনোড়া ঢেঁকি কুলো এসব বিরল হয়ে উঠছে। শহুরে অপসংস্কৃতি গ্ৰামকে কলুষিত করছে। গ্ৰামের মেয়ে-ব‌উরা পৃথুলা হয়ে নানা রোগের শিকার হয়ে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে তিনি যদি শহুরে মধ‍্যবিত্ত পাঠকের চাহিদা মাথায় রেখে শহরের কথা লেখেন, নগরজীবনের কথা লেখেন, মাটি থেকে বিচ্ছিন্ন শহুরে সচ্ছল নরনারীর শরীরী প্রেমের বিবরণ লেখেন তাহলে তা বাংলা টিভি সিরিয়ালের থেকে নতুন কিই-বা হবে! তিনি উপস্থিত শ্রোতাদের পাল্টা প্রশ্ন করেন -- ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ গ্ৰামে বাস করলেও ভারতীয় সাহিত‍্যের কত শতাংশ গ্ৰাম বা গ্ৰামীণ জীবন নিয়ে লিখিত হয়? তাই সাবেক গ্ৰামবাংলার অভাবী বা প্রান্তিক মানুষজনকে নিয়ে লেখালিখিকে তিনি অতীতে নিমজ্জিত থাকা বা অতীত বিলাসিতা বলে মনে করেন না। তাঁর কাছে এটি অতীতের প্রতি দায়বদ্ধতা। দারিদ্র্যকে সম্মান করা। তাঁর মতে, গ্ৰাম এবং গ্ৰামের মানুষের অভাবকে এতটাই কাছ থেকে দেখেছেন যে তিনি যদি এ নিয়ে না লেখেন তবে আর কেই-বা লিখবেন! যেমন গো-রাখালের কথকতা উপন‍্যাসে যে নিদারুণ দারিদ্র্যের ছবি তিনি এঁকেছেন তা তিনি স্বচক্ষে ছোটবেলায় দেখেছিলেন বলেই লিপিবদ্ধ করতে পেরেছেন। ছেলে যেন ছাগল চরানো থেকে উন্নীত হয়ে গো-রাখাল হতে পারে এটাই রাখালের বাবার প্রার্থনা। বাবুর বাড়ি কাজের সূত্রে জামাপ‍্যান্ট পেলে অন‍্য বাড়িতে কাজ করতে যাওয়ার আগে তা গা থেকে জোর করে খুলে নেয় বাবুরা। উদোম হয়ে রাখাল ঘরে ফেরে। ছোটবেলায় নিজের চোখে দেখা রাখালিয়া এই বাপছেলে তাঁর উপন‍্যাসে প্রাণ ফিরে পায়। তাই যখন উপস্থিত কেউ প্রশ্ন করেন নিজের অভিজ্ঞতার বাইরে লেখার ইচ্ছা কি তাঁর হয় না, তখন তিনি বলেন লেখকের অভিজ্ঞতার রসের ভিয়ানে সিক্ত না হলে লেখা বড়জোড় একটা "try" হতে পারে, কিন্তু তা ভিতর থেকে উঠে আসা লেখা হয় না।

শ্রোতাদের একাংশ

অকপট স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ছাত্র হিসেবে আনসার‌উদ্দিন বিশেষ ভালো ছিলেন না কোনোদিন‌ই। সিঁড়িভাঙ্গা অঙ্ক বুঝতেই পারতেন না। কারণ, সিঁড়িওয়ালা কোনও বাড়িতে থাকতে পারাটা তাঁর স্বপ্নের‌ও অতীত ছিল। মাটির ঘর আর বাঁশের বেড়াতেই অনেক নিরাপত্তা ও স্বাচ্ছন্দ‍্য অনুভব করতেন। যে সিঁড়িতে পা রেখে উনি কোনওদিন‌ই নামাওঠা করতে পারবেন না তার অঙ্ক শেখার কোনও তাগিদ তাঁর ছিল না। অঙ্কের প্রতি এ হেন বীতরাগ থাকলেও অঙ্কের খাতার সাদা পাতাতেই তাঁর প্রথম গল্প লেখা ১৯৯১ সালে। আর এখানেও রয়েছে দারিদ্র্যের আখ‍্যান। ঐ সময় একটি স্কুল তিনি চালাতেন। সেখানকার গরিব ছাত্ররা যাতে একটু অঙ্ক অনুশীলন করতে পারে সেহেতু অন‍্যদের বাতিল অঙ্ক খাতার পিছনদিকের অব‍্যবহৃত সাদা পৃষ্ঠাগুলোকে কেটে জমিয়ে রাখতেন। এই কেটে রাখা পৃষ্ঠাতেই হঠাৎ করে তাঁর প্রথম গল্পটি লিখে ফেলেন। ছাপা হয় লিট্‌ল ম‍্যাগাজিনে। এভাবে পাঁচটা গল্প লেখা হলে তিনি আনন্দবাজার পত্রিকার অধীর বিশ্বাসের নজরে আসেন। মূলধারার সংবাদমাধ‍্যম বা প্রকাশনার অনুরোধ আসতে থাকে। যদিও তাঁর শ্লথতার কারণে বেশিরভাগ অনুরোধ‌ই পূরণ করা সম্ভবপর হয় না। অঙ্কে ভালো না হলেও সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ গড়ে উঠেছিল সেই ছোটবেলায় মামার বাড়ি থাকতেই। মামারা নদীর ওপারে বড় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন যেখানকার লাইব্রেরির ব‌ই কোনও বাছবিচার না করে পড়তেন। রাতের পর রাত জেগে শরৎচন্দ্র বিভূতিভূষণ মানিক তারাশঙ্কর শৈলজানন্দ সতীনাথের গল্প বা উপন‍্যাস পড়েই যেতেন। প্রয়োজনে মামার বাড়ির কেরোসিন রাখার পাত্র থেকে তেল চুরি করেও পড়তেন। অন‍্যদিকে জীবনানন্দ ছিলেন প্রিয় কবি যাঁর 'সুচেতনা' নামক কবিতাটির দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তিনিও একটি কবিতা লেখেন। ইচ্ছা ছিল তাঁর মতো কবি হ‌ওয়া। কিন্তু তাঁর সেই প্রথম লেখা কবিতায় তাঁর গৃহিণী যখন পড়েন যে সুচেতনার আঁচলে তিনি মুখ মুছেছেন তখন গৃহশান্তি বজায় রাখার স্বার্থে কবি হ‌ওয়ার বাসনা তিনি চিরতরে ত‍্যাগ করেন। তাঁর সরস আক্ষেপ তিনি তাঁর স্ত্রীকে বোঝাতে অপারগ ছিলেন যে সুচেতনা আর কেউ নয় তাঁর muse, তাঁর মানসী। এর কারণ বাংলার মুসলিম ঘরের গৃহবধূরা নবী আর স্বামীর বাইরে কিছু ভাবতেই চান না। বাংলায় মুসলিম ঘরের মেয়েদের এই পশ্চাদ্‌মুখিনতার জন‍্য মোল্লাতন্ত্রকেই দায়ী করেন তিনি। তাঁর অভিযোগ মৌলবীরাই তিন তালাক প্রথাকে প্রশ্রয় দেয়, মসজিদে শয়তান আর নারীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করে রাখে।

এই প্রসঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও হানাহানি নিয়ে জনৈক শ্রোতার প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন মোল্লাতন্ত্রের ছত্রছায়ায় আইসিস বোকো হারাম আল-কায়দা হিজবুল ইত‍্যাদি জঙ্গিগোষ্ঠীর বাড়বাড়ন্ত। অথচ ইসলাম কিন্তু বিদ‍্যালয় পোড়ানোর কথা বলে না, শিশু হত‍্যার কথা বলে না, যা এইসব জঙ্গিরা লাগাতার করে আসছে। অন‍্যদিকে দেশে আজ কেউ স্বাধীনভাবে নিজস্ব মতামত ব‍্যক্ত করতে পারছে না। বলিউডের জনপ্রিয় তিন খান‌ও সোশাল মিডিয়ায় বিরূপ মন্তব‍্যের স্বীকার হচ্ছেন। দেশরক্ষার দায়িত্ব যেন সেনাবাহিনীর হাত থেকে চলে এসেছে কিছু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের হাতে। সাধারণ দেশবাসীর মনে মুসলিম জনগোষ্ঠীর রীতিনীতি আচার‌অনুষ্ঠানের প্রতি অজ্ঞতা ও অবহেলা কাজ করছে। গ্ৰামে গ্ৰামে 'কলম' নামক পত্রিকার প্রচার বাড়ছে, কিন্তু কোরান বা হাদিসের সদর্থক উক্তিগুলি প্রচারিত হচ্ছে না। ঈদ-উদ্‌যোহার দিনে তিনি এই বক্তৃতা দিচ্ছেন। অথচ এ নিয়ে প্রকৃত ত‍্যাগের কথা কুরবানির কথা কোথাও তিনি আসার পথে শোনেননি। এর‌ই মাঝে বাংলার মুখ‍্যমন্ত্রী ভুল উচ্চারণ ও আদবকায়দায় মুসলিমদের মন পেতে চাইছেন। দ্বিচারী সিদিকুল্লা নমাজে মহিলা হয়েও মমতা ব‍্যানার্জীর উপস্থিতিকে মেনে নিচ্ছেন আবার তিন তালাকের পক্ষে গলা ফাটাচ্ছেন। এসব দেখে আনসার‌উদ্দিনের সংবেদী মন ব‍্যাথিত হয়ে ওঠে। তাঁর মতে ইসলাম ধর্মের একজন রামমোহন বা বিদ‍্যাসাগরের মতো সংস্কারক প্রয়োজন।

দ্ব‍্যর্থহীন ভাষায় আনসার‌উদ্দিন ব‍্যক্ত করেন যে সঙ্কীর্ণতার উর্দ্ধে যদি ওঠা না যায়, মানুষকে যদি মানুষের মতো করে দেখা না যায়, তাহলে কখনই ভালো লেখা যায় না। ভালো লিখতে গেলে ভালো মন দরকার, প্রসারিত হৃদয় দরকার। সেই সাথে দরকার লেখার বিষয়ের মধ‍্যে ঢুকে যাওয়া। লেখককে ভুললে চলবে না নিজের গল্প উপন‍্যাসের চরিত্রের নির্মাতা তিনি নিজে। সেই চরিত্রকে সৃষ্টি করার মালিক তিনিই। আর এই জায়গাতেই একজন লেখক হয়ে ওঠেন ঈশ্বর বা আর‌ও বেশি কিছু। ব‍্যক্তিগতভাবে আনসার‌উদ্দিন সেইসব লেখকদের‌ই উঁচু আসন দিতে চান যাঁরা লিখতে লিখতে নিজেদেরই গড়েন নিজেদের‌ই ভাঙ্গেন; আর এই ভাঙ্গাগড়ার মধ‍্যেই চরিত্র নির্মাণ করেন। তিনি আশা করেন একজন লেখকের বাঁচামরা বা জীবনস্রোত তাঁর লেখার বিষয়ের মধ‍্যে দিয়ে প্রবাহিত হবে। উদাহরণস্বরূপ তিনি শিবতোষ ঘোষ এবং অদ্বৈত মল্লবর্মনের নামোল্লেখ করেন। তিনি আক্ষেপ করেন 'খেলনাপাতি', 'আমগাছ' ইত‍্যাদি অসামান‍্য গল্পের লেখক শিবতোষ ঘোষ কোনওদিন‌ই প্রচারের আলো পাননি। আবার জনপ্রিয়তা লাভ করলেও তিতাস একটি নদীর নাম-এর লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মন আজ অবধি আঞ্চলিক ঔপন‍্যাসিকের তকমাই পেয়ে এসেছেন। যেন প্রান্তিক মানুষের জীবনকথা মূলধারার সাহিত‍্যরচনার বিষয় হতে পারে না। অন‍্যদিকে বিভূতিভূষণ আরণ‍্যক  লিখলে বা মানিক পদ্মা নদীর মাঝি  লিখলে সেগুলি মূলধারার‌ই ব‍্যতিক্রমী উপন‍্যাস হিসেবে গণ‍্য হয়। জাতিতে মালো বলেই অদ্বৈত মল্লবর্মনের প্রতি অ্যাকাডেমিশিয়ানদের এই দ্বিচারিতা কিনা জানতে চান তিনি। তিনি নিজেও বরাবর প্রচারের আলোর বাইরে। তাই গ্ৰামে তাঁর খোঁজে প্রকাশনা বা মিডিয়ার লোক গেলে তাঁদের মিথ‍্যে কথা বলে ফিরিয়ে দেন তাঁর হিতাকাঙ্ক্ষী প্রতিবেশীরা যাঁরা ভেবে নেন শহর থেকে নির্ঘাৎ পাওনাদারেরা আনসার‌উদ্দিনের খোঁজে এসেছে। সরল গ্ৰামবাসীরা ভেবে পান না তাঁদের চেনা আনসার‌উদ্দিনের সাথে শহরের বাবুদের কি কাজ!

অন‍্যদিকে জীবনসংগ্ৰামের কোনও অকিঞ্চিৎকর বা কম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা থেকেও লেখক সন্ধানী দৃষ্টিতে খুঁজে নেবেন গল্পের রসদ। তাই দুর্যোগ বা দুর্ঘটনায় বহুলোকের মৃত‍্যুর থেকেও আনসার‌উদ্দিনকে নাড়া দেয় হাত কাটাপড়া কোনও মানুষের সকরুণ আকুতি যিনি ধর্মবিশ্বাসী হয়েও ঈশ্বরের কাছে আর কোনওদিন‌ই করজোড়ে কিছু নিবেদন প্রার্থনা বা ক্ষমাভিক্ষা করতে পারবেন না। অথবা তাঁর নজর এড়ায় না যে গ্ৰামের কোনও হতদরিদ্র পরিবারে হঠাৎ করে কেউ একটি চাদর উপহার দিলে সেটি শীতের রাত্রে কার গায়ে থাকবে তা নিয়ে মীমাংসা না হলে চাদরটি শেষ পর্যন্ত সারারাত দাওয়ায় টাঙানো থাকে আর ভোরবেলা শিশিরের ফোঁটা চাদরের কোণা বেয়ে কান্না হয়ে ঝরে পড়ে। এই ঘটনাটিকে তিনি 'চাদর' গল্পে রূপায়িত করেন। তবে শ্রোতাদের তিনি সাবধান করে দেন শুধু ঘটনা দিয়ে লেখা হয় না। বীজের ভেতর যেমন প্রাণ সুপ্ত থাকে, পানার নিচে যেমন স্রোত বয়ে যায়, তেমনি ঘটনার ভেতরে লুকিয়ে থাকে গল্পের রসদ। কখনও কখনও তিনি নিজেও এই রসদ খুঁজে পান না। কী লিখবেন স্থির করতে পারেন না। লেখা না এলে তখন হাত গুটিয়ে বসে থাকেন। সাদা কাগজকে কাফন বলে মনে হয়। মাঝে মাঝে তিনি ভাবনাবিলাসী হয়ে পড়েন। আবার ভয় হয় ভাবনার মধ‍্যে প্রাতিষ্ঠানিকতা চেপে বসছে না তো। লিখতে বসলেও অতিরিক্ত খুঁতখুতানি চেপে বসে। শ্লথ হয়ে পড়েন তিনি।

একজন জাতলেখক যে কোনও মানুষের জীবন থেকে গল্প খুঁজে নিতে পারেন বলে মনে করেন আনসার‌উদ্দীন। ব‍্যাপারটা বোঝানোর জন‍্য তিনি দুটি এমন ঘটনা উপস্থিত শ্রোতাদের শোনান যেখানে গল্পের বীজ লুকিয়ে আছে। পরে হয়তো তিনি লিখবেন‌ও। কিন্তু কোন পথে সেই লেখা এগোবে তা তিনি ব‍্যাখ‍্যা করেন প্রায় লেখন কর্মশালা (creative writing workshop)-র প্রশিক্ষকের কায়দায়। পরিমল নামে এক আমীন সোনাতলা গ্ৰামে পনের দিন ধরে কাজ করেও জমির মাপজোখ সম্পূর্ণ করতে পারে না শুধুমাত্র নানান শরিকি ঝামেলার কারণে। গ্ৰামবাসীরা কমিশনের বড় সার্ভেয়ারকে ডেকে পাঠালে তাঁর গাড়ি পেট্রোল ফুরিয়ে যাওয়ায় গ্ৰামের দেড় কিমি আগে দাঁড়িয়ে যায়। পায়ে হেঁটে র‌ওনা দিলে পথে লরির ধাক্কায় গুরুতর জখম হন তিনি। বহুদিন পরে ঐ সার্ভেয়ারের সঙ্গে দেখা হয় আনসার‌উদ্দিনের। তিনি তখনও কর্মরত। কিন্তু ক্রাচে ভর করে হাঁটতে হয়, কারণ অপারেশানের পর একটি পা ছোট হয়ে যাওয়ায় মাটির দু ইঞ্চি উপরে ভেসে থাকে। বাস্তব ঘটনা যেখানে এই পর্যন্ত থেমে যায়, সেখানে আনসার‌উদ্দিন খুঁজে পান এক  irony -- জীবনের অধিকাংশ জুড়ে যে মানুষটাকে জমিজমা মেপে যেতে হচ্ছে তাঁর‌ই একটা পা কোনওদিন‌ই ছোঁবে না জমিকে। দ্বিতীয় যে ঘটনা তিনি শোনান সেখানে এক দর্জির কাছে এক মহিলা এসেছিলেন তাঁর বিয়ের শাড়ির ব্লাউজ বানাবেন বলে। ব্লাউজের কাপড় যে শাড়ির সাথেই দেওয়া আছে তা খেয়াল না করে দর্জি তাড়াহুড়োয় ঐ শাড়ি থেকেই কাপড়ের টুকরো কেটে নেন। এবার যখন শাড়িটি মহিলাটির হাতে ফেরত দেন ঐ মহিলা ক্ষুব্ধ হন এবং ঐ শাড়িটি দর্জিকেই কিনে নিতে বাধ‍্য করেন। বাস্তব ঘটনার এখানেই ইতি। এরপর আনসার‌উদ্দিনের কল্পনার জাদুকাঠির ছোঁয়ায় ঘটনা অন‍্যদিকে মোড় নেয়। গরিব দর্জি দামি শাড়িটির কাটা টুকরোটা আবার জোড়া লাগিয়ে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীকে উপহার দেন। এমন দামি শাড়ি পেয়ে গৃহিণী খুব খুশি। কিন্তু অচিরেই এই খুশি ক্ষোভে পরিণত হয় যখন সেলাইটা চোখে পড়ে। তখন অভিমানী ক্ষুব্ধ ব‌উকে সান্ত্বনা দিতে গিয়ে দর্জি যে কথা বলেন তা উপস্থিত শ্রোতাদের উপলব্ধির স্তরে উন্নীত করে -- ঐ শাড়ি হয়তো পরতে পরতে ছিঁড়ে যাবে ফেঁসে যাবে, তবুও সেলাইটা কোনওদিন‌ই যেমন খুলবে না, ঠিক তেমন‌ই তাঁদের দাম্পত‍্য নানা ওঠাপড়ায় ঘাতপ্রতিঘাতে সম্পৃক্ত হবে, তবুও তাঁরা দুজন কোনওদিন‌ই আলাদা হবেন না।

সময় থেমে থাকে না। শহর নির্মাণ হয়। গ্ৰাম নির্মাণ হয়। মৃত‍্যু অপঘাত জ্বরজ্বালা বন্ধ হয় না। তবু তার‌ই মধ‍্যে মানুষের বেঁচে থাকা, মানুষের উঠে আসা। আর তার‌ই মধ‍্যে আনসার‌উদ্দিন মনে করেন লেখকের ঈশ্বর হয়ে ওঠা। লেখকের নিজেকে ভাঙ্গাগড়া। সব শেষে, নিজের স্বল্প সংখ‍্যক পাঠককুলের সাথে 'একক মাত্রা'র মতো পত্রিকার প্রকাশ অনুষ্ঠানের অতিথি বক্তা হ‌ওয়ার সম্মান ভাগাভাগি করে নেন আনসার‌উদ্দিন। উপস্থিত সকলের প্রভায় তিনি প্রভাবিত হলেন, সম্মাননীয় শ্রোতাদের উপস্থিতিতে তিনিও সম্মানিত হলেন, এই বলে সকলের শুভ কামনা করে এবং সকলকে তাঁর অভিনন্দন শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানিয়ে তাঁর বক্তৃতা শেষ করেন।

'একক মাত্রা'র অন‍্যান‍্য আড্ডা বা জমায়েতের মতোই এবারেও অনুষ্ঠানের শেষে আগত পাঠকবন্ধুরা পত্রিকার পুরনো সংখ‍্যা ও ব‌ইপত্র কেনেন। কেউ কেউ গ্ৰাহক হন। সব থেকে আনন্দের কথা আনসার‌উদ্দিনের লেখা ব‌ই ঢেলে বিক্রি হয়। এখন পরের সংখ‍্যার মোড়ক উন্মোচনের দিন ৪ঠা নভেম্বরের জন‍্য অপেক্ষা। সেদিনের অতিথি বক্তা আশীষ লাহিড়ী। বিষয়ঃ তথ্য নিছক তথ্য নয়।