Wednesday 30 August 2017

কালো টাকার পর্দা ফাঁস



'কোথায় বা কি ভূতের ফাঁকি...'

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য 


আজ (৩০ অগস্ট ২০১৭) রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রকাশিত একটি রিপোর্ট থেকে জানা গেল যে, বিমুদ্রাকরণের ফলে কালো টাকা উদ্ধারের যে ঘোষণা মোদি সরকার দিয়েছিল তা গুড়ে বালি! রিপোর্টে প্রকাশ, বাতিল হওয়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের প্রায় ৯৯ শতাংশ টাকাই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ঘরে ফেরত এসেছে। তাহলে ‘কালো টাকা’গুলি সব গেল কোথায়? হিসাব মোতাবেক, ১৫ হাজার কোটি টাকা ফেরত আসেনি। ধরে নেওয়া যাক, এইগুলি সব কালো টাকা। এদিকে নোট ছাপানোর খরচ পড়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা। তাহলে দাঁড়াল এই, ১৫ হাজার কোটি টাকার কালো টাকা উদ্ধার করতে নেট লোকসান ৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করে সাংবাদিকদের আজ জানিয়েছেন, আসলে সরকারের উদ্দেশ্য ছিল নগদ লেনদেন কমিয়ে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ানো। ‘কালো টাকা’ উদ্ধারের বাহানায় এটাই যে আসল উদ্দেশ্য, তা ‘একক মাত্রা’র মার্চ সংখ্যায় ‘অর্থনীতির সাতপাঁচ’ কলামে স্পষ্টতই লিখেছিলাম। আর কেন, তাও পরিষ্কার ভাবে বলেছিলাম। তাহলে মশা মারতে কামান দাগা কেন? সে কথাও এই ব্লগেই বিমুদ্রাকরণ অভিযান শুরুর দ্বিতীয় রাতেই লিখেছিলাম। ভেবে ভাল লাগছে যে সেই আশঙ্কা ও অনুমানগুলি মিথ্যা হয়নি।

এই ব্লগেই ‘কালো টাকার রহস্য’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ও তারও আগে আরেকটি লেখায় পরিষ্কার জানিয়েছিলাম, অর্থনীতিতে ‘কালো টাকা’ বলে কিছু হয় না। আসলে ‘কালো টাকা’ বলতে যে টাকাগুলির দিকে ইঙ্গিত করা হয় তা হল, বেআইনি পথে টাকা আদায়, যার কোনও হিসাব আইনি ভাবে এই টাকার মজুতদারেরা রাখে না, সরকারের কাছেও থাকে না। কীভাবে এই বেআইনি টাকা আদায় করা হয়? মূলত, ঘুষ মারফত, তোলাবাজি, ডাকাতি ও স্মাগলিং করে, কমিশন খেয়ে, বেআইনি ব্যবসা ও লেনদেন চালিয়ে, ধর্মীয় বাবা ও রাজনৈতিক নেতাদের কাছে বেআইনি পথে আদায় করা টাকা গচ্ছিত রেখে ইত্যাদি ইত্যাদি। অর্থাৎ, টাকা টাকাই থাকে, কিন্তু বেআইনি পথে সমান্তরাল অর্থনীতি তৈরি করে সে টাকা বহাল তবিয়তে ঘোরে এবং পেশি ও রাজনৈতিক ক্ষমতার জোরে তা মুষ্টিমেয় এক শ্রেণির মানুষের হাতে কেন্দ্রীভূত হয়। এই বেআইনি পথে টাকা লুঠ রুখতে সরকারের নানান নজরদারি ও আইনি সংস্থা আছে – যেমন, ইডি, সেবি, সিবিআই ইত্যাদি ইত্যাদি। সবাই জানেন, এদের রাজনৈতিক ভাবে অকেজো করে রেখেই সমান্তরাল অর্থনীতির ধারা প্রবহমান।

তাহলে, বিমুদ্রাকরণ করে তথাকথিত কালো টাকা উদ্ধারের ফন্দিটা কোন ভূতের মাথা থেকে গজালো? সে কথাগুলোও আমার আগের লেখাটায় গুছিয়ে বলা আছে। আবারও অল্প করে বলি, বিমুদ্রাকরণের সঙ্গে কালো টাকা উদ্ধারের কোনও সম্পর্কই ছিল না। কারণ, কালো টাকা বলে কিছু নেই; বেআইনি পথে বিপুল টাকা মুষ্টিমেয় ও তার বশংবদদের হাতে কেন্দ্রীভূত করার পথ ও উপায়গুলিকে যদি রুদ্ধ করা যায় তবেই তথাকথিত ‘কালো টাকা’ আর তৈরি হতে পারে না। কিন্তু, এতদিনকার সঞ্চিত যে ‘কালো টাকা’গুলি, সেগুলির কী হবে? মোদি সাহেব তো সেগুলোকেই উদ্ধার করতে গিয়েছিলেন নাকি! ‘কোথায় বা কী ভূতের ফাঁকি মিলিয়ে গেল চট করে’। আসলে, ছিল রুমাল হয়ে গেল বেড়াল, এ তো হামেশাই হচ্ছে!! সব টাকাই তো দেখা গেল সাদা! মাদারি-কা-খেলটা কী? তা হল, সঞ্চিত কালো টাকাগুলিকে নানান খাতে নানান উপায়ে বিমুদ্রাকরণের নীতি ঘোষণার বহু আগে থেকেই, আইনি মোড়কে বিশ্বব্যাপী সাজিয়ে ফেল। যারা আগাম খবর পেলেন না, তাদের একটু ল্যাজেগোবরে অবস্থা হল বটে, কিন্তু কুছ পরোয়া নেই। কারণ, ‘কালে কো সফেদ ঔউর সফেদ কো কালে’ করতে নগদ টাকা এদিক ওদিক পাচার করার কোনও দরকার পড়ে না। ভুবনায়িত পুঁজির জোরে তা কাগজপত্র বানিয়ে, ডিজিটাল লেনদেনেই করে ফেলা সম্ভব। কোনও লেনদেন ব্যাকডেটে করতে হলে সফটওয়ার নির্মাতা ও দেখভাল করা সংস্থারা ব্যাক-এন্ড থেকে অনায়াসে তা করে দেয়। এরজন্য আলাদা রফা করা থাকে। মোদ্দা ব্যাপারটাই হল, মেলাবেন তিনি মেলাবেন। তাই, সঞ্চিত নগদ টাকাগুলি বস্তায় বেঁধে ফেলে দিলে বা পুড়িয়ে ফেললেও কিছু যায় আসে না। যেটা ঘটল, 'কালো টাকা'গুলি 'সাদা' হয়েই ব্যাঙ্কে জমা পড়ল।

তাহলে মোদি সাহেব বিমুদ্রাকরণের পথে গেলেন কেন? এত হাঙ্গামার কী দরকার ছিল? পুরনো কথাগুলো আবার বলব, নাকি আমার আগের লেখাগুলি এই ব্লগেই আরেকবার পড়ে নেবেন? খুব ছোট করে আরেকবার যদি বলি, তাহলে - এক, উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে বিরোধীদের তাৎক্ষণিক বোকা বানিয়ে সাময়িক ‘ক্যাশ অ্যাডভান্টেজ’এ থাকা; দুই, অর্থনীতির প্রায় ৯০ শতাংশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অসংগঠিত ক্ষেত্র ও ছোট শিল্পগুলিকে শায়েস্তা করতে ডিজিটাল লেনদেনকে বাধ্যত চালু করা, যাতে কর্পোরেটরা ব্যবসাপত্রে দেশের সিংহভাগে চড়ে বেড়াতে পারে।

উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনে উনি সাফল্য পেয়েছেন (তার অবশ্য আরও নানা কারণ আছে আর এই ব্যাপক সাফল্য উনি আশাও করেননি) কিন্তু ভারতীয় অর্থনীতিকে সম্পূর্ণত কর্পোরেটের লেজুড় বানাতে এই সস্তা চালে হবে না, ওনাকে গৃহযুদ্ধের পথে এগোতে হবে। তবে কথায় বলে, অতি চালাকের গলায় দড়ি!    

Tuesday 29 August 2017

Women Cricket

The Modern Laxmi Bais of Jhansi

Surya Shekhar Das


Somebody may say it was so near, yet so far. But the comment just illustrates a criminally bare story. Indian women's performance in the world cup last month was breathtakingly brilliant. They missed the world cup by a whisker in the final against a dynamic, contemporary and an extremely well-equipped England.

Captain Mithali Raj bats like a magnificent painter. Surely, Mithali Raj's sheer strength of will power was palpable throughout this global competition. Veda Krishnamurthy uses her willow as if she is a jazz pianist... playing each and every shot with creative yet surgical precision. Then came the wild, uninhibited poet who writes free verse for Team India, Harmanpreet Kaur. Kaur's era defining, magnum opus 171 not out off 115 balls against the mighty Australians in the semi-final has redefined the women's approach towards the game. Such was the powerful innings by Harmanpreet Kaur that it has lifted not only Indian women's performance in the world cup but also catapults this global silverware to unimaginable dizzy heights. Even you may say that at times she batted like a poet, at times she responded with the strongest gun powder. Just rethink about her monstrously hit sixes against a high quality bowling lineup. And there is the quintessential Bengali Express from Chakdah, Jhulan Goswami. Jhulan bowled with passion as well as fire throughout the world cup. Her rousing bowling effort in the final against England virtually turned the game on its head. Jhulan has given us the impression that she is an ageless bowler. In another words, Jhulan is a Titan/ dignified rock star in Indian cricket. And there is one Deepti Sharma. While bowling as well as fielding, she has put everything on display - grit, passion, hunger, anticipation and above all, the unqualified statement of enormous self -belief. To me, along with Veda Krishnamurthy and Harmanpreet Kaur, Deepti Sharma will serve Indian cricket for a long, long time.

It is already noted that mainstream media does not give the necessary coverage to women's game on a regular basis. But in a cricketing world dominated by the billionaires like Virat Kohli, MS Dhoni, Shikhar Dhawan - to name a few, these women cricketers had to go through enormous difficulties and then only they have got a chance to represent for the national side. The list of difficulties is quite a long one- lack of infrastructure, lack of money/sponsorship, dyspeptic attitude of mainstream media towards women's cricket et al. India is such a country where parents expect their daughters to be competent engineers, doctors, school /college teachers or even business managers. But cricketers? Where there is hardly any financial security! The answer is obvious. We all have to admit that these women have achieved something unique. I would like to say, they have fought in this world cup like the indomitable Laxmi Bai of Jhansi. They deserve rich praise.

The eventual champions England, the six time world cup winners Australia are already blessed with proper infrastructure. If Indian women get proper guidance from the competent authorities, I have no doubt in my mind that for these women, sky is the limit.

Wednesday 23 August 2017

প্রসঙ্গ তিন তালাক

কিছু উষ্মা কিছু প্রশ্ন
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

তালাক-ই-বিদ্দাতকে শীর্ষ আদালত অসাংবিধানিক ও বেআইনি ঘোষণা করেছে। চোখের পলকে তিন তালাক উচ্চারণ করে যে কোনও বিবাহিত মুসলমান মহিলাকে ঘরছাড়া করার প্রায় ১৪০০ বছরের রীতি এই রায়ে নিকেশ হল। সারা দেশ জুড়ে এই প্রথার বিরুদ্ধে যেভাবে মুসলমান মহিলারা গর্জে উঠেছেন ও সুপ্রিম কোর্টে যারা মামলা চালিয়েছেন শত হুমকি, ধমকানি ও চোখ রাঙানি এড়িয়ে, তা দেশবাসী মনে রাখবে। গত শতকের ৮০'র দশকে শাহবানু কিছুটা এমন ধরনেরই এক মামলা চালিয়ে শীর্ষ আদালতে জিতলেও, তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের নির্মম সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও 'ধর্ম নিরপেক্ষতার' জোরে সংসদে নতুন আইন পাশ করে রাষ্ট্র অসহায় এক নারীর বিরুদ্ধে তার দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখায়। তারপরেই বাবরি মসজিদের তালা খোলা আর কার হাত ধরে ধর্মীয় বিভাজনের কোন উদ্দেশ্যে দেশকে ঠেলে দেওয়া হয়, তাও আবার এক তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ পার্টির তরফে, তা আজ অবশ্য অনেকের কাছেই পরিষ্কার। ধর্ম নিয়ে কংগ্রেসের ছলচাতুরীও আজ ধরা পড়ে গেছে এবং এখন তাদের অবস্থা হয়েছে ধ্বংসস্তূপের মতো। ধর্ম নিরপেক্ষতার অর্থ যে সব ধর্মকে তা দেওয়া নয়, বরং ধর্ম থেকে রাষ্ট্রকে দূরে রাখা - এই প্রতিপাদ্যটিকেই কৌশল করে এতদিন আড়াল করা ছিল। যারা ধর্মীয় রাজনীতি করে তারা তো ধর্মের নামেই তাদের এজেন্ডা ঠিক করবে, তারা চিহ্নিত, কিন্তু যারা তথাকথিত ধর্ম নিরপেক্ষ বলে নিজেদের প্রতিপন্ন করে তাদের ধর্মীয় রাজনীতিটা আরও গোলমেলে।

দেশের স্বাধীনতার পর পরই প্রস্তাব উঠেছিল ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি নীতি চালু কর। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু বলেছিলেন, এখনও উপযুক্ত সময় আসেনি। অর্থাৎ, তিনি এই ধরনের নীতির বিরোধী ছিলেন না, দাঙ্গাদীর্ণ দেশের সংখ্যালঘু মুসলমানদের আস্থা ফেরাতে তিনি তাদের ধর্মীয় আইনগুলিতে তখুনি হস্তক্ষেপ করতে চাননি, আরও কিছুটা সময় চেয়েছিলেন। তা মানা যায়। কিন্তু ৭০ বছর পরেও অভিন্ন দেওয়ানি বিধি লাগু করার ব্যাপারে যদি কারও আপত্তি থাকে তাহলে বুঝতে হবে ধর্ম নিরপেক্ষতা নয়, কোনও নির্দিষ্ট ধর্মকে তা' দেওয়া হচ্ছে। ধর্ম থাকবে ব্যক্তিগত বিশ্বাস ও অনুশীলনের জায়গায়। তার সঙ্গে দেওয়ানি অভিন্ন বিধি থাকলে সমস্যা কোথায়? ফৌজদারি বিধির ক্ষেত্রে তো আছে! কোনও ধর্মই একমাত্রিক বা একবগগা নয় যে তার মধ্যে কোনও মতান্তর বা ভিন্ন ধারার স্থান নেই। কীভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে অভিন্ন বিধির ব্যাপারে কোনও ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে একমত একসুর বাজে? যেমন, ভোপালের প্রাচীন শরিয়তি আদালত দার-উল-কাজা দীর্ঘদিন ধরেই তালাক-ই-বিদ্দাতকে মান্যতা দেয়নি। পরন্তু, তারা 'খুলা' প্রথা বজায় রেখেছে যেখানে মহিলারা ডিভোর্স চাইতে পারেন। পাকিস্তান ও বাংলাদেশেও তালাক-ই-বিদ্দাতকে মানা হয় না। এমত বহু ধারা ও প্রথা একেক জায়গায় একেকরকম ভাবে বহমান অথচ স্বঘোষিত ধর্ম নিরপেক্ষবাদীরা একটি একমাত্রিক, হোমোজেনাস ধর্মীয় গোষ্ঠীর কল্পনা করে নিয়ে কিছু ধর্মীয় মাতব্বরদের সঙ্গে রাজনৈতিক আঁতাত গড়ে পরিস্থিতিকে বিষাক্ত করেছেন। এই কাজ উগ্র ধর্মীয় কারবারীদের আরও মদত যুগিয়েছে।

আম্বেদকার গণ পরিষদে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি গ্রহণ করার জন্য মত দিয়েছিলেন। তা যখন গ্রহণ হল না তখন তিনি সংবিধানের ৪৪ ধারায় নির্দেশক নীতিতে অভিন্ন দেওয়ানি নীতি গ্রহণ করার প্রস্তাবকে সঙ্কল্প হিসেবে রাখলেন। কোনও ধর্মীয় বা জাতি গোষ্ঠীকেই ভেড়ার পাল হিসেবে ভাবার কারণ নেই যে তাদের মাতব্বররা যা বলবে সেটাই তারা অন্ধের মতো অনুসরণ করবে। এই ভাবনা তথাকথিত আধুনিকতার জনকদের, যারা 'অপর'কে এইরকম ভেড়ার পাল হিসেবে দেখে বলেই, তাদের মাতব্বরদের সঙ্গে আঁতাত করে রাজনীতির ফায়দা লোটে। আশ্চর্য লাগছে, যখন মুসলিম সম্প্রদায়ের এক ব্যাপক সংখ্যক মানুষ, বিশেষত মহিলারা, দু হাত তুলে শীর্ষ আদালতের এই রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন তখন এ রাজ্যের শাসক দল এক অদ্ভুত নীরবতা অবলম্বন করে সন্দেহজনক অবস্থান নিয়েছে। উপরন্তু, তাদেরই এক মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী তিন তালাকের পক্ষে মত দিয়ে ও শীর্ষ আদালতের রায়কে সমালোচনা করে নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। এইসব বার্তা ধর্মীয় বাতাবরণকে আরও বিষাক্ত করে তুলছে। কারা আসলে প্রকারান্তরে বিজেপি'র অবস্থানকে শক্তিশালী করছেন একটু ভাবতে পারেন। খেয়াল রাখা উচিত, উওরপ্রদেশের নির্বাচনে এই তিন তালাকের প্রশ্নটিকে ধরেই বিজেপি কিন্তু বহু মুসলমান মহিলাদের ভোট অর্জন করেছেন। তাই ভাবার কোনও কারণ নেই যে কিছু ধর্মীয় মুসলমান নেতা কী বললেন সেটাই সমগ্র মুসলমান সমাজের বক্তব্য।এমনটা হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। তাই সর্বতোভাবে, ধর্মকে রাজনৈতিক অনুশীলন থেকে দূরে না রাখলে রাজনৈতিক দলগুলির বিপদ আরও বাড়বে। সে যে দলই হোক না কেন! আজ যার সুদিন তার দুর্দিন আসতে ক'দিন? অন্ততপক্ষে ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত যেখানে যথেষ্ট!

Thursday 3 August 2017

রায়গঞ্জের নাগরিক সমাজ

আদিবাসী মহিলা ধর্ষণ ও রায়গঞ্জের প্রতিবাদ
জয়ন্ত ভট্টাচার্য 



গত ৯ জুলাই রবিবার কয়েকজন দুষ্কৃতী আগ্নেয়াস্ত্র দেখিয়ে দুই নাবালিকা, এক যুবতী, এক শিক্ষিকা সহ চার আদিবাসী মহিলাকে গণধর্ষণ করে রায়গঞ্জ পৌর বাসস্ট্যান্ডের বিশ্রামাগারে এবং পাশের এক হোটেলে  এই নারকীয় ঘটনার প্রতিবাদে উত্তর দিনাজপুর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের আদিবাসীরা ১৪ জুলাই সশস্ত্র বিক্ষোভ মিছিল করে তাতে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে রায়গঞ্জ শহর আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয় শহর জুড়ে যদিও সে আতঙ্ক প্রধানত ছিল দুষ্কৃতিদের মধ্যে আদিবাসীদের অবদমিত ক্ষোভের মিছিলে কিছু কিছু ভাংচুরের ঘটনা ঘটলেও, যাতে ছোট ব্যবসায়ীরাই মূলত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, প্রায় ব্যতিক্রমহীনভাবে আপামর মানুষ এই সাহসী প্রতিবাদকে সমর্থন জানিয়েছেন, কেউ কেউ প্রকাশ্যে কুর্ণিশও ব্যবসায়ী সমাজ সহ সমস্ত রায়গঞ্জবাসী সেদিন দেখেছিলেন প্রায় ২০,০০০ আদিবাসীর প্রতিবাদী মিছিলের সময় পরিপূর্ণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা প্রশাসনিক ব্যর্থতার প্রতিবাদে দুটি ব্যবসায়ী সংগঠন পরপর দুদিন রায়গঞ্জ বনধ ডাকে সব মিলিয়ে এক নৈরাজ্যের পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, জনজীবনে ভীতি চেপে বসে সম্ভবত এতাবৎ কালে রায়গঞ্জের মতো political society-তে (যেখানে কলকাতা বা দক্ষিণবঙ্গের অনেক অঞ্চলের মতো সিভিল সোসাইটি গড়ে ওঠেনি) বিভাজিত শহরে প্রথমবারের মতো স্বতস্ফুর্তভাবে 'We Want Justice' শ্লোগান দিয়ে রাজনীতিকে অতিক্রম করে  যুবসমাজের এক সুসজ্জিত মিছিল হয় ১৭ জুলাই

এরকম এক পরিস্থিতিতে প্রতিবাদে সামিল হল রায়গঞ্জ নাগরিক সমাজ পুলিশ সুপার এবং পরবর্তীতে রায়গঞ্জ থানার ওসি-কে সরিয়ে দেওয়া হলেও যে নাগরিক সমাজের রোষ বিন্দুমাত্র প্রশমিত হয়নি তার প্রমাণ মিলল ২০ জুলাইয়ের বিক্ষোভ মিছিলে নাগরিক সমাজের দাবি তিনটি – () নাবালিকা ও আদিবাসী ধর্ষণকান্ডে যুক্ত সমস্ত দোষীদের ধরতে হবে ও উপযুক্ত বিচারের ব্যবস্থা করতে হবে, () পৌরসভা ও পুলিশ প্রশাসনকে দায়িত্ব নিতে হবে রায়গঞ্জকে দুষ্কৃতিমুক্ত করার ক্ষেত্রে এবং () জাগ্রত হোক নাগরিক সমাজ, জাগ্রত হোক প্রতিবাদী নাগরিক বিবেক এই শহর শিল্পী, সংষ্কৃতিপ্রেমী মানুষের এই শহরে অবাধে মেয়েরা ঘোরাফেরা করে থাকে, তাদের শহর খুনিদের শহর নয়, সম্প্রীতির শহর রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক বা যে কোনও গোষ্ঠীগত পরিচয়কে অতিক্রম করে জন্ম নেওয়া এই সুবৃহৎ মিছিলে আওয়াজ উঠল মানুষের শহরে ক্রিমিনালদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতেই হবে

মিছিলের পুরোভাগে ছিলাম আমি, বণিক সমাজের নেতা শংকর কুন্ডু, আইনজীবী নাট্যকর্মী অশোক ব্যনার্জী, রায়গঞ্জ করোনেশন স্কুলের প্রধান শিক্ষক শুভেন্দু মুখার্জী ও অন্যান্য স্কুলের শিক্ষকেরা, ডঃ সুদেব সাহা, রায়গঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, বিভিন্ন মহিলা ও নারী সংগঠনের কর্মী সহ বহুল সংখ্যক ছাত্র-যুবক-যুবতী এবং বিভিন্ন পেশার সাথে যুক্ত কয়েক হাজার মানুষ পরের দিন সন্ধ্যার পর থেকেই ছন্দে ফিরতে শুরু করে রায়গঞ্জ শহর
এরপরে ৩০ জুলাই নাবালিকা আদিবাসী ধর্ষণে জড়িতদের শাস্তি ও সমাজকে দুর্বৃত্তায়ন ও দুষ্কৃতিমুক্ত করে তোলার লক্ষ্যে নাগরিক কনভেনশন হয় চোখে পড়ার মতো, প্রত্যাশা  ছাপিয়ে উপস্থিতি ছিল কনভেনশনে ছাত্র-যুবক-শিক্ষক-চিকিৎসক সহ উপস্থিত ছিলেন নাট্যকার-কবি-চিত্রশিল্পী-আইনজীবী সহ বিশিষ্ট নাগরিকরা এই কনভেনশনে তাৎক্ষনিক আবেদনে প্রায় ৬,৫০০ টাকা সংগৃহীত হয় আক্রান্ত আদিবাসীদের হাতে তুলে দেবার জন্য কয়েকশ মানুষের কথা আগামীতে নিশ্চিতভাবেই গর্জনের রূপ নেবে এ বিষয়ে আশাবাদী 'রায়গঞ্জ নাগরিক সমাজ'

পল ফারমার তাঁর Pathologies of Power গ্রন্থে হাইতিতে ভূমিসন্তান যুবতী অ্যাসেফি-র ভূমি থেকে উৎখাত হওয়া এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন করুণ ও বিপজ্জনক অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়ে AIDS আক্রান্ত হবার কাহিনি বিবৃত করেছেন ক্ষমতা কীভাবে প্যাথলজিকাল হয়ে ওঠে তার নিখুঁত বিবরণ দিয়েছেন, বিশেষ করে স্বাস্থ্যের জগতে নারী হবার জন্য হাইতির অ্যাসেফি এবং রায়গঞ্জের আদিবাসী ক্যারোলাইনারা বারেবারে আক্রান্ত হয় স্বাস্থ্যের গবাক্ষ দিয়ে দেখলে হাইতিতে হয় এইডস, রায়গঞ্জের কিশোরী post-traumatic syndrome-এর শিকার স্তরায়িত সমাজে (stratified society) প্রান্তের স্বর, প্রান্তের আর্তনাদ এমনকি রায়গঞ্জের মতো প্রান্তিক শহরের কানে কিংবা মননে প্রবেশ করে না আমরা এভাবেই নির্মিত হই, এটাই আমাদের স্বাভাবিকতা এখানে একটি রাজনীতি-ধর্ম-নিজস্ব সংস্কৃতি ও কৌম পরিচয়কে অতিক্রম করে একটি সক্রিয় নাগরিক সমাজের উপস্থিতি ঐতিহাসিকভাবে প্রয়োজনীয় আমলাতন্ত্র, প্রশাসন ও রাষ্ট্রের যৌগ্যপদ্যে যে সামাজিক কাঠামো গড়ে ওঠে সেখানে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা একজন নাগরিককে (বেশিরভাগ ক্ষমতার সম্পর্কে নিতান্ত দুর্বল) মুছে ফেলতে পারে এর সাথে যুক্ত হবে একজন ব্যক্তির শ্রেণিগত অবস্থান যেখানে এমনকি মূল নাগরিক সমাজের সঙ্গেও সম্পর্কের ধরণ অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারিত হয় নাগরিক সমাজ তো বৃহত্তর সমাজের একটি রেপ্লিক, আবার রেপ্লিকা নয়ও রায়গঞ্জের বর্তমান নাগরিক আন্দোলনে এ বিষয়গুলো নজর থেকে হারিয়ে যায়নি