Thursday, 7 November 2019

ধর্মের কল...

ধর্ম ও রাজনীতি
একটি আলোচনা
সম্পাদনা ও সংকলন: উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়
যারা ধর্ম মানেন তাঁদের উচিত কুসংস্কার থেকে যথার্থ ধর্মকে আলাদা করা - এমন কথা অনেকেই বলেন।
তাদেরকে বলা উচিত - একটু কথাটা ব্যাখ্যা করতে পারেন ? দেখুন, মানুষ নানান প্রকার। কোনও মডেলে ফেলে কিছুই ছোঁয়া যায় না মানুষকে। আইনস্টাইন নিজেও ঈশ্বরে বিশ্বাসী ছিলেন, শোনা যায়। আজ আমি যে ব্যাপারে যুক্তিবাদী, সেই আমিই হয়তো অন্য ব্যাপারেই অযৌক্তিক - করা উচিত নয় বলেও অনেকেই আমরা সজ্ঞানে হয়তো সেটাই করি, অনেক কাজই এমনি করি। এখন কোনও ব্যাপারকে বিচার যখন করব শুধু সেইটুকু পরিসরে নিজেকে জিজ্ঞাসা করা উচিত যে আমি কি উক্ত ব্যাপারটিতে নির্মোহ? এটাকেই হয়তো সততা বলা হয়।

কুসংস্কার কী, আর ধর্মই বা কী। দুটো কি সমানুপাতিক? নাকি, অসম্পর্কিত? মানে, কী হওয়া উচিত। আবার একজন মানুষ দু' জায়গায় দুরকম আচরণ করে। তার অবস্থান কিরকম সেইটাকে ধরেই এটা হয়। ধরা যাক, কেউ ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস রাখেন না। এটাও একটা ধর্ম। কিন্তু তিনি যখন ধর্ম ও কুসংস্কার নিয়ে প্রকাশ্যে কিছু বলছেন তখন বলবেন, 'ধর্মকে কুসংস্কারের ভিতরে যোগ করা উচিত নয়।' এই আপনিই একজন নাস্তিক হয়ে যখন ঘরোয়া ভাবে আপনারই ধারণার কাছাকাছি মানুষদের নিয়ে বৈঠক করছেন, তখন আপনার অনুধাবন, ধর্মীয় সংস্কারই কুসংস্কারের জন্ম দেয়। মানুষ কুসংস্কারকে সরাতে সম্পূর্ণ পারবেই না যতদিন ধর্ম থাকবে। এটাই প্যারাডক্স, এটাই ডাইকোটমি। অতএব, আলোচনাটা খুব ভারী, গম্ভীর।

আমার মনে হয়, কেউ যে ভাবে চলে জীবনে স্বস্তি পান, ছন্দ খুঁজে পান, নিজেকে এবং অন্যকে বোঝার মরমী মনের অধিকারী হতে পারেন, তাই তার ধর্ম। এসব সহজে অর্জন করা যায় না। ঈশ্বর বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে আসতে পারে, নাও আসতে পারে। ব্যক্তি বিশেষের ওপর তা নির্ভর করে। বুদ্ধদেব ঈশ্বরের কথা বলেননি। অষ্টমার্গের কথা বলেছেন--Right Thinking,  Right Word, Right Action, Right Profession ইত্যাদির কথা যে বলেছেন তা গুরুত্বপূর্ণ। পরার্থে কাজ করলে মন প্রসারিত হয়। এটাও ধর্ম। ধর্মের নানা রূপ। মনকে প্রসারিত করে কারও ক্ষোভের কারণ বুঝতে পারাটাও মানব ধর্ম। নিরপেক্ষ অবস্থান নেওয়ার চেষ্টা। এসব নিরন্তর প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া যত বিস্তার লাভ করে ততই নিজের অবস্থানে সামঞ্জস্য আনা যায়। সংঘাতকে অনেকটা এড়ানো যায়। নিজের পথটা ঠিক চিনতে হয়। সকলেই এক পথের পথিক হন না। আমাদের আচরণে ফুটে ওঠে আমরা যথার্থ ধার্মিক কিনা। সমাজের সর্বতো কল্যানের পথের সন্ধানই ধর্মের লক্ষ্য। ঠিকই। ধর্মের নির্যাস এটাই। ছিলও এটাই, হয়ও এটাই। কিন্তু সংস্কার, আধার, রিচ্যুয়ালগুলো ধর্মের সাথে ঐতিহাসিক ভাবে মিশে গেছে। ফলে, পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ পরা মানে ইসলাম ধর্ম বা দেবদেবী পুজো দেওয়া বা মারা যাবার পর দাহ করা বা কবর দেওয়া, তা সবই বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন চিহ্ন। এভাবেই আচার বা সংস্কৃতি বা ব্যবহারগুলোই এখন ধর্মের রূপ নিয়ে বসে আছে। কাজেই নিজেকে ও অন্যকে মরমী মনের বোঝাটা তার এখন যেন মূল যে ধর্মের কথা এটা বা এই ধারণাটাই অন্তরীণ হয়ে গেছে। তার মানে, এই যে ধর্মের অর্থের যে পরিবর্তন ঘটল তা কিন্তু ঐতিহাসিক বা বাস্তব।

এবারে আসি রাজনীতিতে। ধর্মকে ধরেই শাসনকার্য শুরু হয়ে যায়। তাই রাষ্ট্র, ধর্ম ও শাসন ব্যবস্থা মিলেমিশে থাকে। কিন্তু এই ধর্ম হল চিহ্নের। তার মানে রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ধর্মের সার্বিকতা ত্যাগ করে খোলস বানিয়ে দিল ধর্মের সংস্কৃতি ও আচারের আইডেন্টিটি'তে। বিজ্ঞানের প্রগতির পথে ধর্ম প্রতিবন্ধক, এমন একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়। কথাটার সপক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণও আছে। গ্যালিলিওকে ধর্মযাজকদের হাতে নিগ্রহ স্বীকার করতে হয়েছিল। জীব হিসেবে মানুষের ক্রমবিকাশ সম্বন্ধে ডারউইনের মত খৃষ্টধর্ম সহজে মানতে চায়নি। নতুন সত্যের পথে কুসংস্কার বারবারই বাধা হয়েছে। এসবই স্বীকার্য। তবু ধর্মের প্রতিবন্ধকতাকে খুব বড় করে দেখাবার আগে ঐতিহাসিক সাক্ষ্যের অন্য দিকটার প্রতিও একটু নজর দেওয়া উচিত। মধ্যযুগের শেষভাগে বিজ্ঞান চর্চা ইউরোপে নতুন করে শুরু হয় ধর্মের ছায়াতে;  ধর্ম প্রতিষ্ঠানের ধার ঘেঁষে নতুন প্রয়াস বেড়ে ওঠে। চার্চের আওতা থেকেই খ্রিস্টিয় তের শতকের রোজার বেকন গণিত ও জ্যোতিষ, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র বিষয়ে অধ্যয়ন গবেষণার মহত্ব ঘোষণা করেন। সেই থেকে আজ অবধি বহু বৈজ্ঞানিক বিভিন্ন অর্থে ঈশ্বরে বিশ্বাসী। ধার্মিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন ঈশ্বরের নিজের হাতে লেখা বই, তাই এর সূত্রোদ্ধার মহৎ কাজ, এমনই ভাবতেন আস্তিক বিজ্ঞানীরা।

ধর্মকে কেন্দ্র করেই বহু কুসংস্কার জমে ওঠে। বিজ্ঞানের প্রগতির পথে তারা বাধা হয়। সে বাধা অতিক্রম করেও বিজ্ঞান এগিয়ে চলে। আর কুসংস্কার ছাড়িয়েও ধর্মের বাণীর কিছু অর্থ হয়তো অবশিষ্ট থাকে। হয়তো এটা বিবেচ্য যে তা থাকে কিনা। তার আগে অন্য একটি প্রসঙ্গ চলে আসে স্বাভাবিকভাবেই। বিজ্ঞানের প্রগতি অন্ধবিশ্বাসে বাধা পেয়েছে, এটাই ধর্মান্ধতার একমাত্র বিপদ নয়। তার চেয়েও বড় বিপদ দেখা দিয়েছে অন্য পথে। ধর্মান্ধতার তিক্ততম ফল সাম্প্রদায়িক বিরোধ। যেমন, ষোড়শ শতকে জার্মানি ছিল শিল্পে-বাণিজ্যে-সংস্কৃতিতে ইউরোপের অগ্রগণ্য দেশগুলির অন্যতম। তদানীন্তন ইংল্যান্ডের তুলনায় জার্মানিকেই অপেক্ষাকৃত অগ্রসর দেশ বলে ঐতিহাসিকরা স্বীকার করেন। অথচ, আরও এক শতাব্দী পরে জার্মানি ইউরোপের একটি পিছিয়ে পড়া দেশ হয়ে গেল। এর প্রধান কারণটি কী? সতের শতকে খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক ও প্রটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের মধ্যে রক্তাক্ত সংগ্রামের ক্ষমতার লড়াই। তারই সাংঘাতিক পরিণতি হিসেবে জার্মানি বহুকালের জন্য কি রাজনীতিতে, কি অর্থনীতিতে, কি সংস্কৃতিতে, জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে। এর বিষময় ফল পৃথিবীকে বিশ শতক পর্যন্ত ভোগ করতে হয়েছে। সতের শতকে অবশ্য শুধু জার্মানিতেই নয়, ইউরোপের অধিকাংশ দেশেরই সমাজজীবনে সাম্প্রদায়িক বিরোধে আলোড়ন হয়, আর বহু দেশই এর ফলে অল্পবিস্তর ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

তাই, বহু রক্তক্ষয়ের ভিতর দিয়ে একটা কথা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, পরধর্মসহিষ্ণুতা ছাড়া সুস্থ সমাজজীবন সম্ভব নয়। এটা ইতিহাসের শিক্ষা। কথাটা আর এক ভাবে ধরা যাক। শোনা যায় নাকি মানুষ বাস্তব স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত। স্বার্থসিদ্ধির কিন্তু দুটো পথ আছে। একটাকে বলা যায় বিরোধ অথবা দস্যুবৃত্তির পথ অর্থাৎ অপরের ক্ষতিসাধন করে নিজের লাভ, অন্যটি সহযোগিতার পথ অর্থাৎ সহযোগিতায় সকলের উন্নতি। বিরোধ ও সহযোগিতার মধ্যে কোন পথটি  মানুষ বেছে নেবে তা শুধু বাস্তব অবস্থা দিয়েই নির্ধারিত হয় না, ব্যক্তি ও সম্প্রদায়ের মানসিকতার উপরেও নির্ভর করে। সাম্প্রদায়িক বুদ্ধিতে যখন আমরা উন্মত্ত হয়ে উঠি তখন বিরোধের পথকেই একমাত্র পথ বলে মনে হয়। হিন্দু আমি ভাবি মুসলমান নিধন করেই আমার জয় সম্ভব; মুসলমান আমি ভাবি হিন্দুকে বধ করে আমার জয়। হিন্দু মুসলমানের ভিতরে যে উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের স্বার্থসিদ্ধির আরও একটা পথ খোলা আছে সাময়িকভাবে হলেও সে কথাটা আমরা বিস্মৃত হই; ফলে দেশ বিভক্ত হয়। বেড়ার ওপারে যে আমারই ভাই-বোন সে অপর হয়ে যায়। কে সেই বেড়া দেয় ? আর তার কুফল ভোগ করে কারা?

No comments:

Post a Comment