Thursday 29 September 2022

উত্তাল ইরান

ধর্মীয় অনুশাসনে দেশ চলবে না

নীলকন্ঠ আচার্য


 

গত দু' সপ্তাহ ধরে ইরানের রাজধানী সহ প্রায় ৮০টি শহরের রাজপথ ও আকাশ বাতাস হাজার হাজার ইরানি তরুণী ও তরুণদের দীপ্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। তাদের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শ্লোগান উঠেছে, 'জান, জিন্দেগি, আজাদী' (নারী, জীবন, স্বাধীনতা)', 'আমরা সবাই মাহশা', 'ইসলামি শাসন নিপাত যাক', 'স্বৈরাচারের মৃত্যু হোক', 'যারা আমাদের বোন-ভাইকে হত্যা করেছে তাদের আমরা খতম করব' ইত্যাদি।  

ঘটনার সূত্রপাত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২। ইরানের কুর্দিস্তান অঞ্চলের বাসিন্দা ২২ বছরের মেয়ে মাহশা আমিনি তার মা, বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে একটি গাড়িতে যখন তেহরানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আসছিল তখন সেখানে বিশেষ পুলিশের একটি দল ('নীতি পুলিশ') তাদের পথ আটকায় এবং মাহশা ঠিকমতো হিজাব পরেনি এই অভিযোগে(!) তার মা-বাবার সামনেই তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় ও আটক করে। হিজাবে তার চুল নাকি ঠিক মতো ঢাকা ছিল না! তাই দেশের ইসলামি আইন লঙ্ঘনের(!) কারণে পুলিশ তাকে গাড়ির মধ্যেই শারীরিক নির্যাতন চালায় যা তাদের হেফাজতে চূড়ান্ত রূপ নেয়। মাহশা অসুস্হ হয়ে চির অজ্ঞানে নিমজ্জিত হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু ঘটে। 

এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই রাজধানী তেহরান সহ ইরানের বেশ কিছু শহরে তরুণীরা তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের সমর্থনে ‌দেশের তরুণরাও বিক্ষোভে অংশ নিতে শুরু করে। বিক্ষোভ ক্রমশ  ব্যপক রূপ ধারণ করে। এক সপ্তাহের মধ্যেই তা দাবানলের মতো ইরানের ছোট-বড় প্রায় ৪৫টি শহরে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী এই বিক্ষোভের ওপর দমন-পীড়ন নামিয়ে আনলে তা আগুনের মতো আরও প্রসারিত হয়। বহু জায়গায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ বেঁধে যায়। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশ নির্মমভাবে গুলি চালাতে থাকে। এই প্রতিবেদন লেখার সময়, সংবাদ সূত্র অনুসারে প্রায় ৭৬ জনের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে (BBC, Al Jazeera), ১০০ জনের বেশি মানুষ গুরুতর আহত এবং প্রায় ১২০০ বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। 

তরুণী ও প্রৌঢ়া সহ শত শত নারীরা মাহশা আমিনির এই হত্যা এবং ইরানের শাসকের মৌলবাদী পুরুষতান্ত্রিক হিজাবনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাস্তায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় গণহারে নিজেদের হিজাব খুলে আগুনে পোড়ানো শুরু করে। এমনকি প্রকাশ্যে নিজেদের চুল কেটে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। শহরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে তাদের কেটে ফেলা লম্বা চুল দিয়ে প্রতিবাদের 'কেশধ্বজা' বানিয়ে তা টাঙ্গিয়ে দেয়। এক অভূতপূর্ব রোষে বৃহৎ তরুণ ও যুবসমাজ পুলিশ বাহিনীর সামনে প্রতিরোধের প্রাচীর  গড়ে তোলে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো একযোগে এই প্রতিবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বয়কট করে চলেছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল, শহরের বিভিন্ন স্থানে টাঙানো দেশের প্রধান ধর্মীয় নেতা রোহউল্লা খোমেইনির বড় ছোট সব ধরনের প্রতিকৃতিকে জনতা টেনে ছিঁড়ে নামিয়ে ফেলছে। উল্লেখ্য যে, এই বিক্ষোভ আন্দোলনে ইরানের দু'বারের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হাশেমি রাফসানজানির মেয়েও সামিল হয় এবং বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে আটক। বিখ্যাত ইরানি ফুটবলার আলি করিমিও এই আন্দোলনকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। বেশ কিছু জায়গায় এই উত্তাল গণরোষের সামনে সুরক্ষা কর্মীদের পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। ইরানের  বিচার বিভাগের প্রধান দফতর থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষীরা ক্লান্ত। তারা নাকি কয়েকদিন ধরে ঠিকমতো শুতে যেতে বা বিশ্রাম নিতে পারছে না। অর্থাৎ, এই বিক্ষোভ‌ আন্দোলন ক্রমশ যেন বিশেষ‌ মাত্রা অর্জন করে চলেছে। 

ইতিমধ্যে প্রতিবেশী দেশ  তুরস্ক ও সিরিয়ায় এই আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি, গ্রিস, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে বসবাসকারী ইরানি জনতাও এই আন্দোলনের সমর্থনে সেইসব দেশের ইরানি দূতাবাসগুলোর সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এদিকে ইরানের পশ্চিম সীমান্তে ইরাকী ভূখণ্ডে অবস্থিত কুর্দিস্তান অটোনমাস রিজিওন নামের একটি স্বশাসিত অঞ্চলে গত পাঁচ দিন ধরে ইরানি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কামানের গোলা বর্ষণ, ড্রোন ও মিসাইল আক্রমণ শুরু করা হয়েছে যা পরিস্থিতিকে হয়তো আরও জটিল করে তুলতে পারে।          ‌      

ইরানে মহিলাদের উপর এই বাধ্যতামূলক হিজাব আইন ঘোষিত হয় ১৯৭৯ সালের মার্চে ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর। এর বিরুদ্ধে ওই সময় সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার মহিলারা বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তোলেন। একই সময়ে পুরুষদের জন্য বহুবিবাহ প্রথার আইনও লাগু করা হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হিজাব বিরোধী এবং নারীদের সমান অধিকারের দাবিতে বড় বড় প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২০০৬ ও ২০১৪ সালের আন্দোলনগুলো ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়াও, প্রতি বছর ১২ জুলাই সরকারি হিজাব দিবস পালনের সময় ইরানের সাহসী নারীরা বিভিন্ন স্থানে হিজাব খুলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে থাকেন। এই অপরাধে(!) বহু নারী পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন।


 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কয়েক মাস আগে ভারতের বেঙ্গালুরুর স্কুলে হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অর্থাৎ, মুসলমান স্কুল ছাত্রীদের হিজাব না পরার জন্য বাধ্য করা হয়। কর্নাটক হাইকোর্টও স্কুল প্রশাসনের পক্ষেই রায় দেয়। এর বিরুদ্ধে মুসলমান স্কুল ছাত্রীরা দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করে। বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন। 

হিজাব প্রশ্নে ভারত ও ইরানের ঘটনাক্রম আপাতভাবে বিপরীত মনে হলেও বিষয়টি কিন্তু একই। অর্থাৎ, দুটি ক্ষেত্রেই সরকার, শাসক বা কর্তৃপক্ষ মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবনের স্বাধীনতার উপর বলপূর্বক নিয়ম চাপিয়ে দিচ্ছে যা নারীদের নিজস্ব পছন্দের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে। দুই ক্ষেত্রেই ধর্মীয় মৌলবাদী কর্তৃত্ব পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকে  বজায় রাখতে চায়। তাই, নারীর অস্তিত্ব, জীবন এবং  স্বাধীনতা অর্জনের যে মৌলিক দাবি আদায়ের পথে ইরানি নারীরা আজ যেভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে নৃশংস মৌলবাদী শাসক শক্তির চোখে চোখ রেখে, ইরানের শুধু নয়, সারা দুনিয়ার অর্ধেক আকাশের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে আনতে চলেছে, তাকে সহস্র কুর্নিশ জানাই।


Sunday 25 September 2022

স্বাধীনতার ৭৫ বছর: ২

ভারতবর্ষ কোন পথে?

সমর বাগচী

 

যারা এই লেখাটির প্রথম ভাগ পড়তে চান তাঁরা ক্লিক করুন:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2022/09/blog-post_21.html 

 

রবীন্দ্রনাথ প্রশ্ন তুলছেন সভ্যতাকে নিয়ে। কাকে সভ্যতা বা উন্নয়ন বলব? যে বছর উনি রক্তকরবী’ লিখছেন (১৯২৪), চিনে গিয়ে এক বক্তৃতায় বলছেন, ‘ধনী পশ্চিম একশো বছরেরও বেশি তাদের রথে আমাদের টেনে নিয়ে চলেছে। তার ধুলোয় আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে, আওয়াজে কানে তালা লাগছে, আমাদের নিজেদের অসহায়তায় আমরা বিনম্র হচ্ছি এবং রথের গতিবেগে বিহ্বল হচ্ছি। আমরা স্বীকার করে নিয়েছি যে, এই রথযাত্রাই হচ্ছে উন্নয়ন এবং সেই উন্নয়নই সভ্যতা। যদি কেউ প্রশ্ন করার সাহস করে, ‘কীসের জন্য উন্নয়ন এবং কার জন্যে উন্নয়ন’ তাহলে তা অদ্ভুত এবং হাস্যকরভাবে পূর্বদেশীয় বলে মনে করা হবে।’ প্রয়াণের বছরে (১৯৪১), লিখছেন ‘সভ্যতার সংকট’: ‘কম বয়সে ইউরোপের সভ্যতার অন্তরের দানকে আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেছিলাম। কিন্তু আজ আমার এই বিদায়ের দিনে সেই বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল।’ ১৯৪০ সালে কালিম্পং থেকে কবি অমিয় চক্রবর্তীকে এক চিঠিতে তিনি লিখছেন, ‘ব্রাহ্মণের মাথা, ক্ষত্রিয়ের শক্তি এবং শূদ্রের কাজকে ব্যবহার করে আজকের ব্যবসায়ী মনোবৃত্তির ইউরোপকে আর ঠেকানো যাচ্ছে না। কিন্তু, আমি দেখতে পাচ্ছি যে তাদের পা এক আনত তলে বিলুপ্তির পথে।’       

আজ যদি ভারত ও চিনের প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ সিদ্ধান্ত নেয় যে তারাও লুক্সেমবার্গের মতো মাথাপিছু ১৪ global hectare (gha) বা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা অথবা আমেরিকার মতো ৮ gha-এর বেশি বাস্তুতান্ত্রিক পায়ের ছাপ (Ecological Footprint) ফেলবে, যেখানে পৃথিবীর ধারণ  ক্ষমতা হচ্ছে মাথাপিছু মাত্র ১.৯ gha, তাহলে কয়েক দশকেই পৃথিবী মরুভূমি হয়ে যাবে।

পৃথিবীর এই শিল্পায়িত নাগরিক সমাজের বিপদের কথা রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন। গান্ধী বলছেন, সময় আসছে যখন আজ যারা পাগলের মতো তাদের চাহিদা বাড়িয়ে চলেছেতারা একদিন তাদের পথ বদলাবে এবং বলবে, ‘এ আমরা কী করলাম’?’ তাই, ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন ‘স্বদেশী সমাজ’ এবং গান্ধী ১৯০৭ সালে গুজরাতিতে ‘হিন্দ স্বরাজ’। ‘স্বদেশী সমাজ’-এ রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘আমাদের সমাজ এখন আর এরূপভাবে চলিবে না। কারণ বাহির হইতে যে উদ্যত শক্তি প্রত্যহ সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে তাহা ঐক্যবদ্ধ, দৃঢ়- তাহা আমাদের বিদ্যালয় হইতে আরম্ভ করিয়া প্রতিদিনের দোকানবাজার পর্যন্ত সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য স্থুলসূক্ষ্ম সর্ব আকারেই প্রত্যক্ষ্যগম্য করিয়াছে (জনান্তিকে, রবীন্দ্রনাথ যেন আজকের শিক্ষা, খুচরো ব্যবসা ইত্যাদিতে কর্পোরেট ও বহুজাতিক সংস্থার অনুপ্রবেশের কথা বলছেন)। এখন সমাজকে ইহার বিরুদ্ধে আত্মরক্ষা করিতে হইলে অত্যন্ত নিশ্চিতরূপে তাহার আপনাকে দাঁড় করাইতে হইবে। সমাজের প্রত্যেক ব্যক্তি প্রত্যহ অতি অল্প পরিমাণেও কিছু স্বদেশের জন্য উৎসর্গ করিবে। বহু সম্বন্ধবিশিষ্ট গ্রাম সমাজের পরিবর্তন এনে দেশের পুনরুজ্জীবন আনতে হবে।’        

ক্রমেই রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী দুজনেই গ্রাম পুনর্গঠনের কাজে যুক্ত হচ্ছেন। এল্মহার্স্টকে নিয়ে আসছেন। শ্রীনিকেতন স্থাপন করছেন। সমবায়ের ওপর রবীন্দ্রনাথের চারটি প্রবন্ধ আছে। ১৯২২ সালে ‘সমবায়-২’ প্রবন্ধে কবি স্বাবলম্বনের কথা লিখছেন, ‘দেশের সমস্ত গ্রামকে নিজের সর্বপ্রকার প্রয়োজনসাধনক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে (এ প্রায় গান্ধীর গ্রাম স্বরাজের কথা)। এজন্য কতকগুলি পল্লী নিয়ে এক একটি মণ্ডলী স্থাপন করা দরকার। সেই মণ্ডলীর প্রধানগণ যদি গ্রামের সমস্ত কর্মের ও অভাবমোচনের ব্যবস্থা করে মণ্ডলীকে নিজের মধ্যে পর্যাপ্ত করে তুলতে পারে তবেই স্বায়ত্তশাসনের চর্চা সর্বত্র সত্য হয়ে উঠবে। নিজ পাঠশালা, শিল্প শিক্ষালয়, ধর্মশিক্ষা, সমবেত পণ্যভাণ্ডার ও ব্যাঙ্ক স্থাপনের জন্য পল্লীবাসীদের সাহায্য ও উৎসাহ দান করতে হবে। এমনি করে পল্লীগুলি আত্মনির্ভরশীল ও ব্যূহবদ্ধ হয়ে উঠলেই আমরা রক্ষা পাব। কিভাবে বিশিষ্ট পল্লীসমাজ গড়ে তুলতে হবে সেই হচ্ছে আমাদের প্রধান সমস্যা।’

১৯৪৫ সালের ৫ অক্টোবর এক চিঠিতে গান্ধী নেহেরুকে লিখছেন, ‘তোমার সঙ্গে আমার চিন্তার মধ্যে যদি গভীর ফারাক থাকে তবে দেশবাসীর তা জানা দরকার।আমি নিশ্চিত যে ভারতকে যদি সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে হয় এবং ভারতের মধ্যে দিয়ে সারা পৃথিবীকেও, তাহলে শীঘ্র অথবা কিছু পরেই আমাদের বুঝতে হবে যে মানুষকে গ্রামে বাস করতে হবে শহরে নয়, কুঁড়েঘরে প্রাসাদে নয়। কোটি কোটি মানুষ শহর ও প্রাসাদে নিজেদের মধ্যে শান্তিতে থাকতে পারবে না। তাদের তখন হিংসা এবং অসত্য ছাড়া আর অন্য কোন পথ থাকবে না... তুমি এটা ভেব না যে আমি আজকের মতো গ্রাম সমাজের কথা কল্পনা করছি। আমার স্বপ্নের গ্রাম আজও আমার মনে গাঁথা আছে। প্রতিটি মানুষই তার স্বপ্নের জগতে বাস করে। আমার আদর্শ গ্রামে বুদ্ধিমান মানুষ বাস করবে। তারা জন্তুর মতো ময়লা ও অন্ধকারে বাস করবে না। স্ত্রী এবং পুরুষ মুক্ত থাকবে এবং পৃথিবীর যে কোনও মানুষের সামনে নিজের স্বকীয়তা বজায় রাখবে।’ নেহেরু চারদিন পরে ৯ অক্টোবর উত্তরে বলছেন, ‘হিন্দ স্বরাজ ৩৮ বছর আগে লেখা হয়েছিল। সেদিনের চেয়ে আজ বিশ্ব সম্পূর্ণ পাল্টে গেছে, বোধহয় একটা ভুল পথে... আপনি ঠিকই বলেছেন যে পৃথিবী বা তার একটি বড় অংশ মনে হচ্ছে আত্মহত্যা করার জন্য উদগ্রীব। তার কারণ বোধহয় একটি দুষ্ট বীজ সভ্যতায় পোঁতা হয়েছিল।’ নেহেরু তাঁর ‘আত্মজীবনী’তে লিখছেন, ‘আমরা পরিবর্তনের নদীকে থামাতে পারি না অথবা তার থেকে আলাদা হয়ে থাকতে পারি না এবং মনের দিক থেকে আমরা যারা একবার ইডেন-এর আপেল খেয়েছি তার স্বাদ ভুলতে পারি না এবং আদিমতায় ফিরে যেতে পারি না।’ তা, স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর শিল্প আপেল খেয়ে ভারতের কী হাল হয়েছে তা আগেই আলোচনা করা হয়েছে।

মারা যাবার এক বছর আগে ১৯৬৩ সালে নেহেরু প্রায় বুক চাপড়ে কাঁদছেন। ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে দিল্লিতে ‘Social Welfare in a Developing Economy সেমিনারে নেহেরু বলছেন, ‘আমার মন এই বোধ আনার চেষ্টা করছে, যে দেশের ৫ লাখ ও ৫০,০০০ গ্রাম এবং সেখানে যে সব মানুষ বাস করে তাদের নিয়ে কী করবআমি যদি শুধু উৎপাদনের কথা ভাবি তাহলে এই সমস্ত বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ কারখানা কৃষির মতো অত গুরুত্বপূর্ণ নয়গান্ধী যা ভেবেছিলেন তা খুবই ঠিক। তিনি সবসময় ভারতের গ্রামের কথা এবং ঐসব গ্রামে অনুন্নত মানুষের কথা ভাবতেন এবং কিছু একটা পরিকল্পনা করেছিলেন। তা শুধু তাঁতই ছিল না। সেটি তো ছিল একটি প্রতীক মাত্র। তিনি গ্রামীণ শিল্পের ওপর জোর দিয়েছিলেন যা আবার আধুনিক মানুষ কোনও কাজের জিনিস বলে মনে করে না।’               

১৯৬৩-র ২৩ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে পরিকল্পনার ওপর একটি বিতর্কে নেহেরু বলছেন, ‘আমি বেশি বেশি করে মহাত্মা গান্ধীর দৃষ্টিভঙ্গির কথা ভাবছি। এটি অদ্ভুত যে আমি এই বিষয়ে তাঁর নাম করছি। আমি সবদিক থেকে আধুনিক যন্ত্রের প্রশংসক। আমি সবচেয়ে ভাল মেশিনারি এবং প্রযুক্তি চাই। কিন্তু, আজ ভারতের যা অবস্থা, আমরা যত তাড়াতাড়িই না যন্ত্রের দিকে এগোই… বিরাট সংখ্যক মানুষকে তা বেশ কিছুকাল ধরে ছোঁবে না।’ এই বোধ যদি নেহেরুর আগে আসত তাহলে হয়তো ভারতের ইতিহাস অন্যরকম  হত।

রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী দুজনেই গ্রাম পুনর্গঠনের কথা বলছেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর পুত্র রথীন্দ্রনাথ এবং তাঁর প্রিয় সন্তোষ কুমার মজুমদারকে কৃষিবিদ্যা এবং নিজের জামাই নগেন্দ্রনাথকে ডেয়ারি শিখতে আমেরিকা পাঠালেন। বহু গ্রামে কাজ করছেন। রবীন্দ্রনাথ যখন দেখলেন যে শান্তিনিকেতনের পাঠভবনে তাঁর শিক্ষার আদর্শ পুরোপুরি পালন করা যাবে না তখন তিনি শ্রীনিকেতনে ‘শিক্ষাসত্র’ খুলছেন গ্রামের গরিব শিশুদের জন্য, যেখানে তাঁর শিক্ষাদর্শ পালন করা যাবে।

১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে গান্ধী ঠিক করলেন বিনা পাসপোর্টে পায়ে হেঁটে পাকিস্তান যাবেন। যখন দিল্লি পৌঁছলেন তখন দেখছেন সেখানে বিরাট দাঙ্গা চলছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থীরা মুসলমানদের বাড়ি, মসজিদ দখল করছে। গান্ধী ১৩ জানুয়ারি অনশন শুরু করলেন। ১৪ জানুয়ারি এক বিবৃতিতে তাঁর স্বপ্নের ভারতের কথা বলছেন, ‘যেখানে একে অপরের ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধালু হবে, যেখানে নারীর ইজ্জত রক্ষিত হবে, যেখানে অস্পৃশ্যতা থাকবে না, থাকবে না কোনও মাদক দ্রব্যে আসক্তি। যেখানে নিঃস্ব বা ভিক্ষাজীবী বলে কেউ থাকবে না, থাকবে না উচ্চ নীচের ভেদ- একদিকে ধনীর অসীম বৈভব আর অন্যদিকে অর্ধাশনে দিবস যাপনকারী শ্রমজীবী মানুষের বৈষম্য। যেখানে সবাই স্বেচ্ছায় সানন্দে কায়িক শ্রমের দ্বারা জীবিকা উপার্জন করতে গর্ব বোধ করবে। কায়িক শ্রম ও বৌদ্ধিক শ্রমের মধ্যে কোনও পার্থক্য থাকবে না। আমি সেই সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আমরণ অনশন চালিয়ে যেতে চাই।’ তাঁকে আর অনশন চালাতে হয়নি। হিন্দু মহাসভার এক আতঙ্কবাদী ২৮ জানুয়ারি তাঁকে হত্যা করল। তারাই আজ দেশে আবার আতঙ্ক সৃষ্টি করছে।

এই আলোচনার আলোকে ভবিষ্যৎ সমাজের এই রূপটি আমি সমাজের কাছে পেশ করতে চাই:

·       প্রকৃতির জমি, মাটি, জল, বাতাস, অরণ্য, নদী, সমুদ্র, পর্বত ইত্যাদির স্বাস্থ্য বজায় রেখে সমাজে অর্থনৈতিক সামাজিক সাম্য সৃষ্টি করতে হবে এবং তা শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্যই নয়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঁচার অধিকারকেও মনে রাখতে হবে;

·       ধাতু নির্ভর সমাজ নয়, জৈব নির্ভর সমাজ;

·       সবার জন্য প্রয়োজন মতো খাদ্য;

·       রাসায়নিক পদ্ধতিকে বর্জন করে জৈব পদ্ধতিতে কৃষি;

·       প্রত্যেকের জন্য স্বাস্থ্যপূর্ণ নানারকম খাদ্যের ব্যবস্থা;

·       রবীন্দ্রনাথের কথা মনে রাখতে হবে, ‘সহজ ও সরল সমাজই সভ্যতার মাপকাঠি এবং অপরিমিত হচ্ছে বর্বরতা।’

·       শহর সভ্যতাকে বর্জন করে এক সহজ সরল গ্রাম সমাজ নির্মাণ করতে হবে। সবাইকে বাস্তুতন্ত্রের দিক থেকে সুস্থায়ী গৃহে বাস করতে হবে। বাড়িগুলো এমন হবে যে সেগুলো তারাই নির্মাণ এবং সংরক্ষণ করতে পারবে। বাড়ি হবে শক্তির দিক থেকে দক্ষ। কিছু কিছু বাড়িকে ভাঙতে হবে। কিন্তু, সমস্ত ভেঙ্গে ফেলা জিনিসকে পুনর্ব্যবহার করতে হবে;

·       ভাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার আয়োজন করতে হবে;

·       যে সমস্ত অপ্রয়োজনীয় জিনিস সবাই ব্যবহার করতে পারবে না তার উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। এটি করা গেলে শক্তি এবং নানারকমের ধাতুর প্রয়োজনও কমে যাবে;

·       সমস্ত পুরনো এবং ফেলে দেওয়া জিনিসকে আবার ব্যবহার করতে হবে;

·       সমস্ত উৎপাদন হবে কো-অপারেটিভের মধ্যে দিয়ে। বেশিরভাগ জিনিস স্থানীয়ভাবে উৎপাদন ও ব্যবহার করতে হবে। এতে জিনিসপত্র এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় পরিবহন করার প্রয়োজন হবে না। এটি হলে শক্তি, পরিবহন, জিনিসপত্র, রাস্তা, ব্রিজ ইত্যাদির প্রয়োজন অনেক কমে যাবে;

·       বেশিরভাগ মানুষ গ্রামেরই বিভিন্ন কাজে নিযুক্ত থাকবে। মার্কস কম্যুনিস্ট সমাজে এই Associated Producers-দের কথাই বলেছিলেন। নগরায়নের প্রয়োজনীয়তা কমে যাবে;

·       লিঙ্গসাম্য আনতে হবে;

·      Associated Producers-দের এই গ্রামভিত্তিক সমাজে এক নতুন রকমের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে, সেই শিশুকাল থেকে যা চেষ্টা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী। যে শিক্ষা শিশুকে আত্মনির্ভর হতে শেখাবে;

·       শিশুকাল থেকে শিশুকে নতুন এক উন্নত সংস্কৃতিতে উদবুদ্ধ করতে হবে যা নিজের সঙ্গে অপরের ভাবের মিলন ঘটাতে পারে। এর ফলে বর্তমান শিল্প সমাজে যে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান হবে। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এক বহু সম্বন্ধবিশিষ্ট সমাজের নির্মাণ হবে। ভোগবাদকে পরিহার করে এক সরল কিন্তু উচ্চ চিন্তার সংস্কৃতি নির্মিত হবে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে রেখে, ‘না রে না হবে না তোর স্বর্গসাধন, যতই করিস সুখের সাধন।’ মার্কস, রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীর ভাষায় শ্রম হবে মানুষের জীবনের আনন্দের এক অংশ;

·       কিন্তু কী করে আসবে এই সমাজ? এর জন্য চাই অহিংস সংঘর্ষ ও নির্মাণ। একদিকে সমাজ বদলাবার জন্য মানুষকে সঙ্গে নিয়ে অহিংস সংগ্রাম এবং অন্যদিকে সমাজ নির্মাণের কাজ যেমন শুরু করেছিলেন গান্ধী এবং শঙ্কর গুহ নিয়োগী।

·       এই প্রবন্ধের প্রায় প্রতিটি বিষয় নিয়ে একটি করে প্রবন্ধ লেখা যেতে পারে।

      

(শেষ)

Friday 23 September 2022

ডিজে'র ব্যবহার নিষিদ্ধ হোক

আন্দোলনের পথে বলাগড়ের মানুষ

 অয়ন মুখোপাধ্যায়


পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের মতো আমাদের বলাগড় ব্লকের বিভিন্ন প্রান্ত ভয়াবহ ডিজের শব্দ দূষণে আক্রান্ত। যে কোনও অনুষ্ঠানে ডিজের বিকট শব্দে আজ সাধারণ মানুষ  অতিষ্ঠ। কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।যে যত পারছে বেশি করে ডিজে বাজাচ্ছে। ক্ষমতার আস্ফালন। সকাল থেকে সারারাত বিভিন্ন পূজা মণ্ডপে বিকট শব্দ করে ডিজে বেজে চলে একটানা ডুমডুম ডিপডিপ গুড়গুড় ইত্যাদি শব্দে।

সামনেই দুর্গাপুজো, লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, রাস উৎসব, শীতকালীন পিকনিকের ঘনঘটা। চলবে ডিজে'র বেলাগাম ব্যবহার। তারপর তো রয়েছেই মাইকের চিৎকার। ফলে, সর্বত্র শব্দ দূষণ ঘটে।মানুষের কষ্ট বাড়ে। বাড়ে শারীরিক ক্ষতি। বিশেষ করে আক্রান্ত হয় শিশু ও বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা। ডিজের দাপটে হার্ট ও উচ্চ রক্তচাপ জনিত রোগীরা বিপদে পড়ে বেশি। মানসিক অস্থিরতাও বেড়ে যায়। দুর্ঘটনা ঘটে রাস্তায়।

অন্যদিকে, ডিজে চালিয়ে উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার প্রবণতা বাড়ে, মদ খেয়ে মারামারির মতো ঘটনা আমরা প্রায়শই দেখতে পাই। আর এইসব দেখে আমরা যদি প্রতিবাদ না করি, প্রতিরোধ না গড়ে তুলি, তাহলে কীসের সংস্কৃতি চর্চা! পৃথিবীর গভীরতর অসুখ বলে আমরা পালিয়ে যেতে পারি না। অদ্ভুত আঁধার এসেছে বলে আমরা কি তাহলে ঘরের মধ্যে বসে থাকব? আমাদের মননে আছে সাংস্কৃতিক বোধ, আছে সামাজিক দায়বদ্ধতা আর সেই তাগিদ থেকেই আমাদের এই আন্দোলন, এই লড়াই।

আমরা মনে করি, সংস্কৃতি মানে শুধু নাচ গান আবৃত্তি চর্চা নয়। সংস্কৃতি বলতে বুঝি সমাজের সদস্য হিসেবে অর্জিত নানা আচরণ, যোগ্যতা, জ্ঞান, বিশ্বাস, শিল্পকলা, নীতি, আদর্শ ও আইন সহ বিভিন্ন  উপায়ের যৌগিক সমন্বয়। আমাদের মতে, সংস্কৃতি বলতে সেই সব পন্থাকে বোঝায় যার মধ্যে দিয়ে মানবজাতি তার প্রকৃত বর্বরতাকে কাটিয়ে উঠে পূর্ণরূপে মানুষে পরিণত হয়। আমাদের প্রশ্ন, ডিজে'র ব্যবহার কি বর্বরতা কাটিয়ে ওঠা? নাকি মানুষকে বর্বরতর সংস্কৃতির দিকে ঠেলে দেওয়া?

আমরা সাংস্কৃতিক কর্মীরা, গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের সদস্য-সদস্যারা প্রশাসনের কাছে এই আবেদন রাখছি যে, আসন্ন উৎসবের দিনগুলিতে অবিলম্বে ডিজে বন্ধ হোক। বন্ধ হোক তারস্বরে মাইক বাজানো। সরকারি নিয়ম বিধি মেনে চলুক বক্স ও মাইক।

সমস্ত পুজো কমিটির কাছে আবেদন, সুস্থ সংস্কৃতির স্বার্থে আপনারা নিজে থেকে ডিজে বন্ধ রাখতে এগিয়ে আসুন। সামাজিক মানুষ হিসেবে আমাদের কিছু দায়িত্ব আছে। আসুন, দীর্ঘদিন ভুল করার অভ্যাস ত্যাগ করি। প্রশাসন ও সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনুরোধ, ভবিষ্যতের কথা ভেবে  আপনি-আপনারা শব্দ দূষণের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনের সাথী হোন।

আমাদের দাবি:

১) শব্দ দূষণ সংক্রান্ত আইন মেনে চলতে হবে;

২) বিনা অনুমতিতে উচ্চ শব্দ করার যন্ত্রগুলি বাজানো যাবে না;

৩) ডিজে'কে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হোক;

৪) প্রশাসনের প্রতি আবেদন, জনগণ এবং পুজো কমিটিগুলোকে নিয়ে বিকট শব্দের খারাপ দিকগুলি সম্পর্কে সচেতনতা শিবির করতে হবে।

৫) প্রশাসনকে সংবিধানের ২১ নম্বর ধারার মর্যাদা দিয়ে নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ জীবন যাপনের অধিকার সুরক্ষিত  রাখতে হবে ।

পরিশেষে আবারও বলি, আসুন আনন্দের দিনগুলোতে আমরা যেন নিরানন্দ না হয়ে যাই। শব্দ দূষণকে রুখে দিয়ে আসুন আমরা আগামী প্রজন্মের কাছে এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করি। সবচেয়ে আনন্দের কথা, ডিজে বন্ধের ব্যাপারে সই সংগ্রহ শুরু হয়েছে। খুব শিগগিরই আমরা প্রশাসনকে এই দাবিপত্র পাঠাব। পরিতোষ হাই স্কুল, রাধারাণী উচ্চ বিদ্যালয়, বলাগড় উচ্চ বিদ্যালয়, সোমরা দুর্গাচরণ উচ্চ বিদ্যালয়, খামারগাছি কামালপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষিকা ও ছাত্রছাত্রীরা সমর্থন জানিয়েছেন।এছাড়া বলাগড় ব্লকের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মী, সাধারণ মানুষ আমাদের সমর্থন করেছেন।

গত কয়েক দিন ধরে আমার সঙ্গে আমাদের সংগঠনের সভাপতি সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়, অন্যতম সহ-সভাপতি সৈকত বাগচী, সন্ধ্যা ঘোষ ও আশীষ চক্রবর্তী, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যা মৌসুমী মজুমদার এবং সংস্কৃতি কর্মী সানন্দা গুণ বিশ্বাস এই ব্যাপারে সই সংগ্রহে সহযোগিতা করে  আসছেন।

সংযোজন:

এ ব্যাপারে স্থানীয় বিধায়ক মনোরঞ্জন ব্যাপারী তাঁর মতামত জানিয়েছেন:

'একজন মানুষ যার নাম অয়ন মুখার্জী। যিনি সিপিএম পার্টির নেতা। যার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা চুঁচড়া ভোট গণনা কেন্দ্রে। যিনি সেদিন মুখ বিকৃত করে আমাকে বলেছিলেন, 'আপনি চল্লিশ হাজার ভোটে হেরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি যাবেন!'

'আপনারা জানেন আমি হারিনি। ভবিষ‍্যৎবাণী সফল হয়নি অয়নবাবুর। দিদি মমতা ব‍্যানার্জীর আশীর্বাদ ও কঠোর পরিশ্রম আর আপনাদের ভোট আর ভালোবাসায় জনসংঘ নেতা শ‍্যামাপ্রসাদের জন্মভূমিতে গত লোকসভার ভোটে ছত্রিশ হাজার ভোটে এগিয়ে থাকা বিজেপিকে প্রায় নয় হাজার ভোটে পরাজিত করতে পেরেছি। তবে পরে আমার সঙ্গে অয়নবাবুর আবার দেখা হয় এবং ধীরে ধীরে বুঝতে পারি, সিপিএম হলেও মানুষটির মনে সমাজ সেবার অকৃত্রিম ভাবনা আছে। তাই খানিকটা বন্ধু মতো হয়ে গেছেন। 

'সেই অয়ন মুখার্জী একটি আন্দোলন গড়ে তুলতে সচেষ্ট  হয়েছেন। কী আন্দোলন, কেন আন্দোলন উনি নিজেই সেটা  লিখেছেন। আমি সিপিএম বিরোধী হলেও তাঁর কথার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করছি। উনি সিপিএম করেন বলেই তার সঠিক বা সত‍্য কথনের সঙ্গে বিরোধিতার জন‍্য বিরোধিতা করব মাত্র- আমি এমন মনোভাব পোষণ করি না। 

'তাই আমি অয়নবাবুর ডিজে বন্ধের আন্দোলনকে সমর্থন করছি। চাইছি, দলমত নির্বিশেষে সবাই এটাকে সমর্থন করুন। বন্ধ হোক পরিবেশ দূষণ। একটা সুন্দর সুস্থ  উৎসব হোক। আমার আনন্দ যেন অন‍্যের কষ্টের কারণ না হয়ে ওঠে।' 


Wednesday 21 September 2022

স্বাধীনতার ৭৫ বছর: ১

ভারতবর্ষ কোন পথে

সমর বাগচী

 


সম্প্রতি ‘স্বরাজ ইন্ডিয়া’ পার্টির প্রধান যোগেন্দ্র যাদব বিহারে নীতিশ কুমার বিজেপি পার্টির জোট ছেড়ে নতুন সরকার গঠন করার পর আমায় এবং অনেককেই এক চিঠিতে ২০২৪’এর লোকসভা ভোটে বিজেপি হারবে বলে ভবিষ্যৎবাণী করেন।

আমি তাঁকে একটা চিঠি দিয়ে প্রশ্ন করেছিলাম, যদি তাই হয়, তাহলে বিহার এবং ভারতের ভবিষ্যৎ উন্নয়নের মডেল কী হবে? পশ্চিমবঙ্গের গত বিধানসভা ভোটে টিএমসি’র বিরুদ্ধে প্রচুর দুর্নীতি ইত্যাদির বিরুদ্ধে বিজেপি, সিপিএম এবং কংগ্রেসের বিপুল প্রচার স্বত্ত্বেও, যা বহুলাংশে সত্যি, বিজেপিকে ভালভাবে হারিয়ে টিএমসি তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসে। যে বামফ্রন্ট ৩৪ বছর ক্ষমতায় ছিল সেই ফ্রন্ট এবং কংগ্রেস বিধানসভায় শূন্য হয়ে যায়। এইরকম যে হবে তা আমি ভাবতে পারিনি। টিএমসি’র জেতার কারণ পরে ভেবে দেখেছি তিনটি। প্রথম দুটি প্রধান

এক) টিএমসির গ্রামের মানুষের জন্য উন্নয়নের কাজ; যা আমার গ্রামে শিক্ষা নিয়ে কাজ করার ও গ্রামের মানুষের সঙ্গে কথা বলার এবং দু-একটা এনডিটিভি’র মতো চ্যানেলের গ্রামের মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎকার থেকে বুঝেছি;

দুই) গ্রামের মহিলাদের ক্ষমতায়ন;

তিন) মোদি, অমিত শাহ এবং বহিরাগত বিজেপি নেতাদের বাঙালিদের অস্মিতার ওপর আক্রমণ।

কিন্তু প্রশ্ন হল, কী দাঁড়াল ভারতের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর পশ্চিমি মডেলে উন্নয়নের পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করে? প্রায় ৭ কোটি মানুষ এই উন্নয়নের যূপকাষ্ঠে ঘরছাড়া হয়েছে। এইসব কিছু মানুষদের আমি দেখেছি আশির দশকে, যখন পুরুলিয়াতে বিজ্ঞান মিউজিয়াম নির্মাণ করছি, পাঞ্চেত বাঁধে ঘরছাড়া হয়ে বসবাসকারী বাঁধের পাশে বাঘমারা ও শিউলিবাড়ি গ্রামে। সে এক অবর্ণনীয় দুর্দশার জীবন। নব্বইয়ের দশকে মেধা পাটকার আমায় অনুরোধ করেন কলকাতার ডিভিসি-র প্রধান অফিসে গিয়ে ডিভিসি থেকে উচ্ছেদ হওয়া মানুষদের সম্বন্ধে কোনও খবর পাওয়া যায় কিনা দেখতে। গিয়ে জানি যে ওদের কোন আর্কাইভ নেই। আমি ডিভিসি লাইব্রেরিতে দু-তিন দিন কাজ করি এবং ডিভিসি'র প্রথম অ্যানুয়াল রিপোর্টে পাঞ্চেত বাঁধের উদ্বোধনের খবর পড়ি। জহরলাল নেহেরু বুধনি শবরকে দিয়ে ঐ বাঁধের উদ্বোধন করান। ঐ অনুষ্ঠানে জলমন্ত্রী তাঁর জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বলেছিলেন, পাঞ্চেত বাঁধ হওয়ায় বাঁধের পাশের গ্রামের মানুষদের জীবন পাল্টে যাবে। হ্যাঁ, সত্যিই পাল্টে গেছে। তা আমি দেখে এসেছি ২০০৮ সাল নাগাদ যখন পাঞ্চেতের কাছে গড়পঞ্চকোটে বেড়াতে যাই। তখনও আগের মতো ঐ একই অবস্থায় দেখে এসেছি বাঘমাড়া ও শিউলিবাড়ি গ্রামের মানুষদের। 

গত ২০ বছরে ১০ থেকে ১২ কোটি মানুষ কর্মপ্রযুক্ত হয়েছে। কাজ পেয়েছে মাত্র ৩০ লক্ষ। কিন্তু কোটিপতিদের সম্পদ বেড়েছে ১১২ গুণ। আজকের শিল্প কারখানা চলে উন্নত প্রযুক্তি দিয়ে। চালু হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবটিক্স। খুব কমই দক্ষ কর্মী লাগবে। তাই, শিল্প-কারখানা নির্মাণ করে ভারতের ১৩৯ কোটি লোকের দেশে চাকরি দেওয়া যাবে না। ‘ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরাম’ প্রকাশিত ২০২২ সালের ‘ওয়ার্ল্ড ইনইকুইলিটি রিপোর্ট’ জানাচ্ছে যে, ভারতের জনসংখ্যার ওপরের ১০ শতাংশ মানুষ দেশের ৬৫ শতাংশ সম্পদ দখল করে আছে। ২০২১ সালে গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইন্ডেক্স-এ ১৫৬টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান ১৪০। FAO-এর রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে ২০১৯-২০২১ সালের হিসেবে ২২.৪৩ কোটি লোক অপুষ্টিতে ভুগছে। ২০২০ সালে ১০,৬৭৭ জন চাষি আত্মহত্যা করেছে।  

এদিকে প্রকৃতি ভেঙ্গে পড়ছে। শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই নয়, পৃথিবীর অরণ্য, জীববৈচিত্র, জল, মাটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। জমির বন্ধ্যাকরণ হচ্ছে এবং মরুভূমি এগিয়ে আসছে, উত্তর-দক্ষিণ মেরু ও গ্রিনল্যান্ডের বরফ এবং পৃথিবীর সমস্ত হিমবাহ গলে যাচ্ছে, ওজোন গহ্বর সৃষ্টি হচ্ছে, সমুদ্র দুষিত হয়ে সামুদ্রিক প্রাণী বিপন্ন হচ্ছে। সমুদ্রতল উঁচু হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতেই চেন্নাই, মুম্বাইয়ের মতো সমুদ্রতটবর্তী শহর ও গ্রাম জলের তলায় তলিয়ে যাবে। সারা পৃথিবী জুড়ে বর্জ্যের পাহাড় তৈরি হচ্ছে যার এক বড় অংশ বিপজ্জনক। দ্রুত হারে বিভিন্ন ধাতু শেষ হয়ে  যাচ্ছে। পৃথিবীর মানুষ ও অন্যান্য জীবপ্রজাতি আজ অস্তিত্বের সংকটে। স্ট্যানফোর্ড, প্রিন্সটন ও বার্কলের বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে, পৃথিবীর মানুষরা যদি একইরকমের জীবন যাপন করে তাহলে ষষ্ঠ গণবিলুপ্তি আসন্ন। তাহলে যে প্রজাতি সব থেকে আগে বিলুপ্ত হবে তা হচ্ছে মনুষ্য প্রজাতি। পৃথিবীর এই আগামী বিপর্যয়ের সময়ে আমরা ভারতের উন্নয়নের কথা ভাবছি।

কেন আজ এই অবস্থা? এর মূল কারণ, পৃথিবীর ধনী মানুষদের ক্রমান্বয়ে ভোগবাদের বৃদ্ধি। এই ধনীদের মধ্যে যেমন পশ্চিমের উন্নত দেশের মানুষ আছে, তেমনই তৃতীয় বিশ্বের ধনী ও উচ্চ মধ্যবিত্তরাও আছে। ১৭৬০ থেকে ১৮৩০ সালের মধ্যে শিল্প বিপ্লব সম্পন্ন হয় এবং শিল্প-পুঁজিবাদ শুরু হয় ১৮০০ সালে যখন একজন আমেরিকান বাজারে যেত, সে প্রায় ১৫০০ বর্গ ফুট বাজারে ৩০০ রকমের জিনিস কেনাকাটার সুযোগ পেত। আর ২০০০ সালে এক লক্ষ লোক বাস করে এমন এক শহরে যখন একজন আমেরিকান বাজারে যায় সে ১০ লক্ষ রকমের জিনিস বাছাই করে কেনাকাটার সুযোগ পায় ১ কোটি ৫০ লক্ষ বর্গ ফুট বাজারে। গত কুড়ি-তিরিশ বছরে কলকাতা এবং ভারতের যে কোনও শহরে শপিং মলের বাড়বাড়ন্ত থেকে ভোগবাদের বৃদ্ধি আমরা বুঝতে পারি। সেইসব মলে আমরা বঙ্কিমের হুসেন শেখ বা রামা কৈবর্তকে দেখতে পাই না। এই আগ্রাসী ভোগবাদই আজ পৃথিবীকে ধ্বংসের কিনারায় এনে ফেলেছে। আমেরিকান লেখক মার্ক টোয়েন তাই লেখেন, ‘Civilization is a limitless multiplication of unnecessary necessities.’ 

রবীন্দ্রনাথ ১৯০৫ সালে ‘বিলাসের ফাঁস’ প্রবন্ধে লিখছেন, ‘এখনকার দিনে ব্যক্তিগত ভোগের আদর্শ বাড়িয়া উঠিয়াছে। এইজন্য বাহবার শ্রোত সেই মুখেই ফিরিয়াছে। এখন পরিচ্ছদ, বাড়ি, গাড়ি, জুড়ি, আসবাবপত্র দ্বারা লোকে আপন মাহাত্ম্য ঘোষণা করিতেছে। ধনীতে ধনীতে এখন এই লইয়া প্রতিযোগিতা। ইহাতে যে কেবল তাহাদেরই চাল বাড়িয়া যাইতেছে তাহা নহে, যাহারা অশক্ত তাহাদেরও বাড়িতেছে।’ ইতালির তুরিন শহরে ‘City and Civilization’ বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘অতীব ভোগবাদী জীবনযাপনের আকাঙ্ক্ষা, যা জনসাধারণের খুব এক ক্ষুদ্র গোষ্ঠীর মধ্যে সীমিত, তা বহুদা বিস্তৃত হচ্ছে। এই যে ক্রমবর্ধমান বোঝা তা যে কোনও সভ্যতার পক্ষে  মারাত্মকবিরাট সম্পত্তির অধিকারী হওয়া এবং বিলাসবহুল জীবন পাহাড়ের মতো বিচ্ছিন্নতার দেওয়াল তোলে যা প্রাকৃতিক পাঁচিলের মতো উঁচুপশ্চিমে যাকে গণতন্ত্র বলা হয় তা একটি সমাজে কখনও সত্যি হতে পারে না যেখানে লোভ লাগামছাড়া হয়। জনসাধারণ তাকে শুধু উৎসাহিতই করে না প্রশংসাও করে।’ ১৯৩০ সালের ২৯ ডিসেম্বর লন্ডন থেকে রাণী মহলানবিশকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘এমন সময়ে আমেরিকায় এসে চোখে পড়ল মানুষ কতই অনাবশ্যক ব্যর্থতায় সমাজকে ঝাঁঝরা করে তুলেছে, আবর্জনাকে ঐশ্বর্যের সাড়ম্বরে সাজিয়েছে, আর তার পেছনে দিনরাত্রি নিযুক্ত হয়ে আছে... পৃথিবীর ওপর কি অভ্রভেদী বোঝা চাপিয়েছে।’

এই বোঝা আমেরিকাকে কোথায় এনে ফেলেছে তা দেখুন আমেরিকার এক চিন্তকের বক্তৃতায় পৃথিবীর মিউজিয়ামের একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আছে যার নাম ইন্টারন্যাশানাল কাউন্সিল অফ মিউজিয়াম (ICOM) সেই প্রতিষ্ঠানের প্রতি তিন বছর অন্তর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন হয়। ১৯৮৯ সালে হল্যান্ডের দেন হাগ শহরে তেমন এক সম্মেলনে আমি উপস্থিত ছিলাম সম্মেলনের মুখ্য বক্তা ছিলেন আমেরিকার এক চিন্তক নিল পোস্টম্যান; উনি আমেরিকার সমাজ সম্বন্ধে বলছেন, ‘যতরকমের প্রযুক্তিগত উন্নতি হচ্ছে তা ব্যবহার করার জন্য আমাদের সমাজকে আমরা প্রস্তুত করেছি। আমরা পাগলের মতো, স্বইচ্ছায়, কিছু চিন্তা না করে তার যে কী পরিণাম হতে পারে তা না ভেবে তাকে অবহেলা করেছি। এবং যেহেতু প্রযুক্তির তা প্রয়োজন তাই আমরা ধর্ম, পরিবার, শিশু, ইতিহাস এবং শিক্ষা থেকে আমাদের মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি। আমরা যা করেছি তার জন্য আমেরিকান সভ্যতা ধ্বসে পড়ছে। সবাই জানে যে এটি সত্যি কিন্তু তার মোকাবিলা করবার জন্য তারা শক্তিহীন। আমাদের প্রযুক্তির স্বপ্নের একটি আংশিক বিবরণ দিই। ১৯৯৫ সালের মধ্যে আমাদের শিশুরা হয় মা নয় বাবার কাছে থাকবে (অর্থাৎ, বিবাহ বিচ্ছেদ হবে)। আমাদের বড় বড় শহরে ৫০ শতাংশের কম ছাত্র হাই স্কুলের দরজা পেরয়। এটি ঘটছে এমন একটি সংস্কৃতিতে যা সাধারণের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের চিন্তা আবিষ্কার করেছে... আমাদের জনসাধারণের এক-চতুর্থাংশ, অর্থাৎ ছয় কোটি মানুষ নিরক্ষর। প্রতি বছর চার কোটি লোক বাড়ি বদল করে এবং বহু লক্ষ মানুষের কোনও গৃহ নেই, রাস্তায় কিংবা সাবওয়েতে বাস করে। ১৯৫৯ সাল থেকে আজ পর্যন্ত (অর্থাৎ ১৯৮৯) হিংসাত্মক অপরাধ ১১,০০০ শতাংশ বেড়ে গেছে। প্রতি দশজন আমেরিকানের মধ্যে দুজন তাদের জীবনের কিছু সময় মানসিক প্রতিষ্ঠানে কাটাবে আমাদের শহরগুলো ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাচ্ছে; আমাদের পানীয় জল সীসা ও মেডিক্যাল বর্জ্য দ্বারা বিষাক্ত; আমাদের বৃষ্টিতে অ্যাসিড; পৃথিবীর অন্য যে কোনও দেশের চেয়ে আমাদের দেশের মানুষ মাথাপিছু সবচেয়ে বেশি অ্যাস্পিরিন খায়; পশ্চিম দেশের মধ্যে আমাদের দেশে শিশু মৃত্যুর হার সর্বাধিক এবং আমাদের কিশোর-কিশোরীরা তাদের মাথা ড্রাগ দিয়ে ভাজছে।’ 

এই হছে পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশের অবস্থা। সেই দেশে আমাদের শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা, বেশির ভাগ উচ্চবিত্ত, যাদের শিক্ষিত করবার জন্য দেশ কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে, দেশ ছেড়ে সেই দেশে পাড়ি দিচ্ছে ভোগবাদী জীবন যাপন করার জন্য। তাদের বেশির ভাগ কাজ করছে এমন সব কর্পোরেট সংস্থায় যারা তৃতীয় বিশ্বকে শোষণ করছে নানা উপায়ে। তাদের মধ্যে খুব কম জনই আছে যারা উচ্চপর্যায়ের জ্ঞানের ক্ষেত্রে নতুন অবদান রাখার কাজ করছে।     

ক্রমাগত অর্থনৈতিক বৃদ্ধি শিল্প-পুঁজিবাদের ধর্ম গান্ধী বলছেন, ‘আমি ভীত যে শিল্পবাদ মানুষের পক্ষে অভিশাপ হবে। একটি দেশ অন্য দেশকে শোষণ করবে তা চিরদিন চলতে পারে না। শিল্পবাদ নির্ভর করে বিদেশি বাজারকে শোষণ করা এবং প্রতিযোগিতার অনুপস্থিতির ওপর।’ তাই গান্ধী ভারতবাসীকে সাবধান  করছেন, ‘ঈশ্বর করুন ভারত যেন কোনওদিন পশ্চিমের মতো শিল্পায়ন না করে। একটি ছোট্ট দ্বীপ-দেশ আজ সমস্ত পৃথিবীকে শৃঙ্খলিত করেছে। আজ যদি ৩০ কোটির সমস্ত দেশ (অর্থাৎ, ভারত) একইরকম অর্থনৈতিক শোষণ করে তাহলে সমস্ত পৃথিবী পঙ্গপাল পড়ার মতো নিঃস্ব হয়ে যাবে।’

ক্রমশ...

এই লেখার দ্বিতীয় ভাগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2022/09/blog-post_25.html 

 

Saturday 17 September 2022

জঁ ল্যুক গদার (১৯৩০-২০২২)

শ্বাসরুদ্ধকর দক্ষতা ও গতিতে চলচ্চিত্র নির্মাণ

উত্তান বন্দ্যোপাধ্যায়


যে গল্প বলতে গেলে প্রবন্ধে হারিয়ে যায়। যা ফর্ম্যাটকে গ্রহণ করে, পরিবর্তন করে, ফর্ম্যাটকে বর্জন করে ও ব্যাকরণ-সদৃশ হয় না, পাঠযোগ্য না হলেও যে ভাষা একদম নিজের মতো, তাকে পাঁচটা আর শিল্পের কাছ থেকে ভাড়া করার প্রয়োজনই পড়ে না। হয়তো সেটাই চলচ্চিত্র। আজ চলচ্চিত্র কেন তার ভাষা খুঁজবে সাহিত্যের কাছে ?

জঁ ল্যুক গদার প্রয়াত।

শুটিং লোকেশনে গিয়ে তিনি চিত্রনাট্য লিখতেন, আর ক্যামেরা চালুর আগে চরিত্রদের মুখে সংলাপের জোগান দিতেন। ফরাসি রথী-মহারথীদের মতো স্টুডিওতে গিয়ে, বিশাল লটবহর নিয়ে স্টোরিবোর্ড মেনে শুটিং করার ঐতিহ্যকে তিনি গুঁড়িয়ে দেন প্রথম ছবিতেই। প্রাকৃতিক আলোতে হাতে ধরা ক্যামেরা নিয়ে শ্যুট করায় তাঁর ছবির ভেতর এক ধরনের প্রামাণ্যচিত্রের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়, যা পরবর্তী সময়ে বেশ অনুকরণীয় হয়ে ওঠে অন্যদের মধ্যে। 

এই ফরাসি-সুইস পরিচালক- যিনি ন্যুভেল ভ্যেগ (ফরাসি নিউ ওয়েভ)-এর একজন গুরুত্বপূর্ণ পরিচালক- ১৯৫০ এবং '৬০ এর দশকের শেষের দিকে চলচ্চিত্রে বিপ্লব এনেছিলেন। ৯১ বছর বয়সে তাঁর চিরবিদায়। আইকনোক্লাস্টিক চরিত্রে চূড়ান্তভাবে অধার্মিকতা, আপাতদৃষ্টিতে ইম্প্রোভাইজড ফিল্মিং ও শৈলীর পাশাপাশি অবাঞ্ছিত মৌলবাদের বিরুদ্ধে সর্বাধিক পরিচিত প্রতিবাদী গদার এখনকার মতো একটি অসম্ভাব্য কেরিয়ারের পুনরুজ্জীবন উপভোগ করার আগে অথবা ডিজিটাল প্রযুক্তি নিয়ে পরীক্ষা করারও আগে ১৯৬০-এর দশকে তাঁর নির্মিত ধারাবাহিক রাজনৈতিক ছবিগুলো যেন ছিল এক-একটা প্রতীক। এক-একটা চিহ্ন তৈরি করে যেন তার যুক্তি খুঁজতেন গদার। 

ফরাসি সংবাদমাধ্যম রিপোর্ট করেছে যে তিনি সুইজারল্যান্ডে 'শান্তিপূর্ণভাবে' তাঁর সঙ্গী অ্যানিমারি মিভিলের পাশে মারা গেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিবারের সদস্যের উদ্ধৃতি দিয়ে 'লিবারেশন' রিপোর্ট করেছে যে তাঁর মৃত্যুতে সহায়তা করা হয়েছে, যা সুইজারল্যান্ডে বৈধ: 'তিনি অসুস্থ ছিলেন না, তিনি কেবল ক্লান্ত ছিলেন। তাই নিজেকে শেষ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। এটা তার নিজের সিদ্ধান্ত ছিল।' গদারের আইনজীবী প্যাট্রিক জেনারেট এক সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, 'একাধিক অক্ষম রোগের' মেডিকেল রিপোর্টের পরে গদারের মৃত্যু হয়েছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ট্যুইট করেছেন: 'আমরা একটি জাতীয় ধন হারিয়েছি, এক প্রতিভাবান চোখ।' যে চলচ্চিত্র নির্মাতারা শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন 'লাস্ট নাইট ইন সোহো'র পরিচালক এডগার রাইট, যিনি তাঁকে 'সকলের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আইকনোক্লাস্টিক ফিল্ম-মেকারদের একজন' বলে অভিহিত করেছিলেন। 

১৯৩০ সালে প্যারিসে গদার জন্মগ্রহণ করেন, পরে সুইজারল্যান্ডের জেনেভা হ্রদের তীরে নিয়নে বেড়ে ওঠেন। আবার প্যারিসে ফিরে যাওয়ার পর ১৯৪৯ সালে তিনি 'সিনে-ক্লাব'এ একটি প্রাকৃতিক আবাস খুঁজে পান যা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের একটি শক্তিশালী স্তম্ভকে প্রমাণ করে। তিনি ছিলেন চলচ্চিত্রের তাত্ত্বিক ও সমালোচক আন্দ্রেঁ বাঁজার অন্যতম বন্ধু ও ছাত্র। বাঁজার অন্য ছাত্রদের সঙ্গে (যেমন, ভবিষ্যতের পরিচালক ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো, ক্লদ শ্যাব্রল, এরিক রোহমার এবং জ্যাক রিভেত) তিনি দেখা করেন। এর মধ্যে বাঁজা শিগগিরই ইনফ্লুয়েনশিয়াল 'কাহিয়ার্স দ্যু সিনেমা' সহ নতুন ফিল্ম ম্যাগাজিনের জন্য লেখা শুরু করে দিয়েছেন। সম্পাদক ছিলেন আন্দ্রে বাঁজা আর গদার ছিলেন এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের সাথী। 

সাবেক হলিউড ফিল্ম-মেকিংকে রক্ষা করে গদার শুরু থেকেই একটি প্রচলিত ন্যারেটিভকে তছনছ করার মতো নোট তৈরি করতে থাকেন তাঁর ফিল্মি মণীষায়। হামফ্রে বোগার্টের প্রতিও তাঁর শ্রদ্ধা ছিল; ১৯৬০ সালে তাঁর প্রথম বৈশিষ্ট্যসূচক প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্যের ফিকশন ফিল্ম 'ব্রেথলেস'-এ তা প্রকাশ পায়। এর আগে তিনি 'শ্লাট এট্ ভেরোনিক'এর মতো শর্ট ফিল্মের একটি সিরিজের মাধ্যমে ফিল্ম-মেকিং'এ তাঁর পথ সহজ করে নিয়েছিলেন। ১৯৫৭ সালে 'অল দ্য বয়েজ আর কলড প্যাট্রিক' তাঁর ঢিলেঢালা, দৃশ্যত স্লিপড মেকিং শৈলীকে প্রাধান্য দিয়েছিল। এক ক্ষুদ্র অপরাধী এবং তার গার্লফ্রেন্ড সম্পর্কে ত্রুফোর নিটোল মর্মন্তুদ ধারণায় তিনি গেলেন না, কিন্তু গদার ভেবেছিলেন যে তিনি এটিকে একটি অন্যরকম বৈশিষ্ট্যে পরিণত করতে পারেন এবং তা পারেন কিনা সেই অনুমতিও চেয়েছিলেন বন্ধু ত্রুফো ও বাঁজার কাছ থেকে। ত্রুফো তার 'দ্য 400 ব্লোজ' ফিচারের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করেছিলেন এবং তার প্রভাব গদারকে তাঁর প্রকল্পটি (ব্রেথলেস) বাস্তবায়িত করতে সাহায্য করেছিল। এবারে গদার সজোরে চলচ্চিত্র থেকে আহ্বান পেলেন কিছু করার, তাঁর দৌড় আর থামল না। 

১৯৬৯ সালে প্যারিসের রাস্তায় নগণ্য কৃত্রিম আলোকসজ্জা এবং প্রতিদিনের লিখিত একটা স্ক্রিপ্ট সহ শ্যুট করা হয়েছিল, তবু থার্ড গ্রেডেড অত্যন্ত পাতি একটি হলিউডি থ্রিলারকে কী বানানো যায়- 'ব্রেথলেস' হয়ে গেল একটি সর্বোত্তম সাংস্কৃতিক ঘটনা; যা জঁ-পল বেলমন্দকে তারকা বানিয়েছে এবং বার্লিন ফিল্মে গদার সেরা পরিচালকের পুরস্কার জিতেছেন। উৎসব ও তার পরবর্তী চলচ্চিত্র Le Petit Soldat ফরাসি সরকারের নির্যাতনকে তুড়ি মেরে প্রত্যাখ্যানের মাধ্যমে রেজিস্ট্যান্স আনার পরামর্শ দিয়েছিল এবং ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু এটি ছিল সেই চলচ্চিত্র যার ভিত্তিতে গদার তাঁর প্রথম স্ত্রী আনা কারিনার সাথে দেখা করেছেন এই ছবিতে; সেই সঙ্গে তাঁর সিনেমার প্রতি বিখ্যাত অমোঘ উক্তি করেছিলেন: 'সিনেমা প্রতি সেকেন্ডে ২৪ ফ্রেমেই সত্য। অর্থাৎ, প্রতি সেকেন্ডে সিনেমা ২৪ বার মিথ্যে কথা বলে। কারণ, স্থিরচিত্রগুলি সেকেন্ডে ২৪ বার চালনা করে একটি চলমানতার বিভ্রম তৈরি করে। এটাই সিনেমা।' 

নিজে নির্মাতা হওয়ার আগে সিনেমা দেখেছেন দিনরাত এক করে। একই ছবি বহুবার। বন্ধুদের মতোই তিনি প্রথমে ছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচক। সমালোচনাকালে যে যুক্তি দিয়ে প্রতিষ্ঠিত পরিচালকের ছবি নাকচ করতেন, সেই ধারণাগুলোই পরবর্তী সময়ে নিজের ছবিতে কাজে লাগাতে থাকেন। ৯১ বছরের জীবনে দু' হাত ভরে সিনেমা বানিয়েছেন— চল্লিশের অধিক পূর্ণ দৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র ছাড়াও প্রামাণ্যচিত্র, স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, টিভি সিরিজ সব মিলিয়ে তাঁর সৃষ্টি।

গদার একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, চলচ্চিত্র বানাতে নারী আর বন্দুকই যথেষ্ট। তার প্রমাণ তিনি দিয়েছেন ১৯৬০ সালে নির্মিত প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘ব্রেথলেস’এর মাধ্যমে। ক্রাইম ড্রামাটির ভেতর থাকা প্যাট্রিসিয়া প্রেমে পড়ে মিশেল নামে এক অপরাধী ব্যক্তির। চলচ্চিত্রের শেষ অঙ্কে পুলিশের গুলিতে মারা যায় মিশেল, তবে ওই ছবি দেখে বিশ্ব চলচ্চিত্র গা ঝাড়া দিয়ে জেগে ওঠে, কারণ, ছবিটির অভিনবত্ব। সম্পাদনায় জাম্পকাট, চরিত্রের ট্রিটমেন্ট এবং হলিউডের ক্রাইম জঁরার প্লট নিয়ে নিজস্ব ভঙ্গিতে উপস্থাপন গদারকে সে সময় শুধু আলাদাই করে দেয়নি, বিশ্ব চলচ্চিত্রে স্থায়ী আসন করে দিয়েছে। গদার প্রথম ছবিতে সম্পাদনার যে রীতি ব্যবহার করেছেন তা দর্শককে ধাক্কা দেয়, আর চলচ্চিত্র দেখার চোখকেও পাল্টে দেয়। সে সময়ের ছবিতে যে ধরনের সম্পাদনা হত, তাতে ‘মন্তাজ’ সম্পর্কে দর্শকের সচেতন হওয়ার কোনও সুযোগই ছিল না। কিন্তু গদার যেন আধমরা দর্শকদের ঘা মেরে জাগাতে চাইলেন। একই সঙ্গে ঘা মেরে ভাঙতে চাইলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের চিরাচরিত ব্যাকরণকেও।

১৯৬৫ সালের মধ্যে করিনার সঙ্গে গদারের বিবাহ বিচ্ছেদে শেষ হয়েছিল। ষাট ও সত্তরের দশকের যুগে বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গেও তিনি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিচিত ছিলেন এবং তাঁর ফিল্ম-মেকিং রিফ্লেক্স এটিকে ধারণ করে নিরন্তর। তিনি 'জিগা ভের্তভে' নামে একটি দল করেছিলেন। সোভিয়েত পরিচালক ভের্তভে'র ১৯২৯ সালের ছবি 'ম্যান উইথ এ মুভি ক্যামেরা'র মাধ্যমে প্যারিসে ছাত্র অভ্যুত্থানের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছিলেন। এই আন্দোলন ১৯৬৮ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল বন্ধ করতে সাহায্য করেছিল। সত্যিই তিনি বিপ্লবী রাজনীতির সঙ্গে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরিচিত ছিলেন। নিজের রাজনীতি ও ব্যক্তিজীবনকে তিনি মিলিয়ে দিয়েছিলেন। কোনওদিন ভণ্ডামি করেননি। ব্যক্তিজীবন, প্রেম, বিবাহ, বিচ্ছেদ ও বামপন্থা কোনওটাকেই তিনি আলাদা করে দেখতে চাননি। ১৯৭০'এর দশকের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গদারের কঠোর রাজনৈতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক অবস্থানগুলি তাদের পুরনো ভাবনা হারাতে শুরু করে, কিন্তু তার ২০০১ সালের ফিচার ফিল্ম 'ইন প্রেজ অফ লাভ' একটি প্রত্যাবর্তন চিহ্নিত করে। ২০১৪ সালের 'গুড বাই টু ল্যাঙ্গুয়েজ'এর জন্য কান-এ জুরি পুরস্কার পেয়েছিলেন এবং ২০১৮ সালে 'দ্য ইমেজ বুক' একটি বিশেষ পুরস্কার 'পালমে ডি'অর' পেয়েছিল।

তাঁর বন্য বিভ্রান্তি, সাউন্ডট্রাকে ডিফেক্টিভ সংলাপদৃশ্য, ঠিকঠাক লোকেশনের কাজ, নন-ন্যারেটিভ ট্যুর এবং 'জাম্প-কাটস' কখনও একটি স্বজ্ঞাত, অশিক্ষিত লেখক দ্বারা অনুপ্রাণিত, অর্ধ-ইচ্ছাকৃত ভুল সম্পাদনা করে তিনি দেখিয়েছেন ফিল্মে ব্যাকরণ ইচ্ছাকৃতভাবে কেমন ভাঙতে হয় ও কেন ভাঙতে হয়, ঠিক বিপ্লবের সময় সমাজের প্যারাডাইমকে তছনছ করা যেমন। ১৯৬০-এর দশক ছিল তাঁর গৌরবময় সময় যখন ছবি এবং স্লোগান বিশ্বকে বদলে দিতে পারে; তিনি শ্বাসরুদ্ধকর দক্ষতা এবং গতির সঙ্গে ফিল্ম তৈরি করছিলেন। গদার ছিলেন গর্বিত, কার্যকরীভাবে ফ্যাশনেবল, মহাদেশীয় যেন এক শীতলতার প্রতীক।  ফিল্মের একটি রোল ধরে রাখা এবং এটি দর্শককে পরিদর্শন করা যেন বেশ আইকনিক- তবে ক্ষুব্ধ অপ্রত্যাশিত ধরনের লোকেরা ভাবছিল যে তারা যদি অন্ধকার চশমা খুলে ফেলে তবে তা আরও ভালভাবে দেখতে সক্ষম হবে না। 

যৌন নৈতিকতা ও ঘনিষ্ঠতা এবং প্রেমের যন্ত্রণাদায়ক অসম্ভাব্যতা ছিল তাঁর থিম। Bande à Part (১৯৬৪) এবং 'টু বা থ্রি থিংস আই নো অ্যাবাউট হার' (১৯৬৭)'এ একটি বিস্ময়কর শক্তি ও শৈলী রয়েছে: তারা আনন্দের জন্য লাফ দেয় এবং নামার পথে মাধ্যাকর্ষণকে অস্বীকার করে। ভিস্যুয়াল পলিটিক্স তার কয়েনেজ। আসলে যেন সেল্যুলয়েডের মাধ্যমে এক পরিপক্ক অথচ সহজলভ্য মাস্টারপিস প্রবন্ধ। মাচা মেরিল হল অত্যাশ্চর্য সুন্দর একজন শ্লাট, আর একজন অল্পবয়সী বিবাহিত মহিলা একজন সুদর্শন অভিনেতার সঙ্গে একটি সম্পর্ক পরিচালনা করছেন। এটি তীব্রভাবে কামোত্তেজক, একটি বিশুদ্ধ ফ্রি-হুইলিং তেজ সহ; এটি একটি ডিগ্রেসিভ সিনেপ্রবন্ধ এবং প্যারিসের মধ্য দিয়ে একটি মুভি- আর কোথায়? ম্যাগাজিন ইন্টারভিউ এবং বিজ্ঞাপনের আইকনোগ্রাফিতে ব্যাপকভাবে জনসাধারণের আগ্রহ রয়েছে, অন্তর্বাসের জন্য একটি ফেটিশস্টিক ছেদন (rupture)। প্রায় অসংলগ্ন, নিজের মধ্যেই শ্যুটের কিছু বিতর্কিত ব্যাধিকে শোষণ করে তৈরি হয় আ্যাকশন: যা হবে উন্মত্ত, প্রায় প্রহসনমূলক- হলিউডের শিশুসুলভতার উপর একটি ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য, মেলোড্রামা- তবুও দীর্ঘ বুদ্ধিবৃত্তিক বিতর্কের জন্য সবসময় উন্মুক্ত।