Friday, 9 September 2022

উন্নয়নের সলিল সমাধি!

জলে ভেসে যায় বেঙ্গালুরু 

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


 

বেঙ্গালুরু ডুবু ডুবু, মহেঞ্জোদারো ভেসে যায়! পাকিস্তানে বন্যাতাতে কী? কিন্তু যদি আর ফিরে না পাই মহেঞ্জোদারো, ফিরে না পাই ভারতীয় সংস্কৃতির আদি ঠিকানা? মহেঞ্জোদারো–হরপ্পা একসাথে উচ্চারিত দুই নাম, একটি থাকবে, অন্যটি? তো, সেও ভাবায়। আর ভাবতে পারি না, এমন বৃষ্টিবিহীন দিনে। ওদিকে বৃষ্টিতে ডুবতে বসেছে আমাদের দেশেরই এক প্রিয় শহর।
 

শহরটার নাম বেঙ্গালুরু। আমাদের গর্বের সিলিকন সিটি বা প্রধান আইটি নগরী এ দেশে প্রধান নগর বলতে এই সেদিনও আমরা মুম্বই, চেন্নাই, দিল্লীর পাশে দেখতে অভ্যস্ত ছিলাম আমাদের অতি প্রিয় শহর কলকাতাকে। এখনও আমরা চাই বটে, কিন্তু বিশ্ব যে মানে না। তাদের কেউ পছন্দের তালিকায় রাখে হায়দ্রাবাদ, কেউ রাখে আমেদাবাদ, কেউ বলে পুনে– এখন অবশ্য অনেকেই বলে বেঙ্গালুরুর নাম। হায়দ্রাবাদকে হটিয়ে দিয়ে এখন সেই শহরই হয়েছে প্রধান আইটি নগরী। 

 

এর মধ্যে অন্য কোনও সূত্র (যথা রাজনীতি, প্রাদেশিকতা ইত্যাদি) খোঁজা বৃথা। আমরা যারা সবেতে রাজনীতি বা প্রাদেশিকতা খুঁজি, তারা দুঃখ পেতে পারি। তাদের দুঃখ কমাতেই বুঝি আসরে নেমেছেন স্বয়ং পরিবেশের দেবতা। এই দেবতা ইন্দ্র না বরুণ, জানি না। তাঁদের যেন দয়ামায়া নেই- তাই আমাদের জন্য খরা, বৃষ্টিহীন মাস, আর ওদের ভাসাতে ব্যস্ত বৃষ্টি।

 

এমন বৃষ্টি পারে নাকি একটা শহরের পতন ঘটাতে? মহেঞ্জোদারো ডুবে যাক, ভেসে যাক। সবাই জানে, আমরা আর ‘দিবে আর নিবে’ নীতি বা ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিতে বিশ্বাস রাখি না। তাই, হে প্রভু, ডোবালে ডোবাও পাকিস্তান, কিন্তু বেঙ্গালুরুকে বাঁচাও যে কোনও মূল্যে। 

 

ওদিকে দেখছি, হায়, হায়! বেঙ্গালুরুর বড় বিত্তশালীদের ব্যবসা থেকে প্রিয় বাসস্থান সব ভেসে যায় যে। দেখ, কেমন অঝোরে ঝরেই চলেছে বারিরাশি। নগর ভাসছে। সেই ২০০৬ সালে একবার দেখেছিলাম এই শহরে এমন বৃষ্টি। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কংগ্রেসের বাসবপুন্নিয়া বলেছিলেন, এই শহরকে তিনি বিশ্বের সেরা শহর করে দেবেন। এমন হবে এর উন্নয়ন। এই বুঝি সেই উন্নয়ন! বলা হচ্ছে, বিগত ৯০ বছরে নাকি এই শহর এমন বৃষ্টি দেখেনি। স্কুল-কলেজ বন্ধ, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ।

 

যে যা বলে বলুক, হোটেল মালিকদের সংগঠন, সরকার কিছু বলেনি! জানি বলবেও না। সরকার চালায় যে দল তাদের তো দল চালাতে টাকা লাগে, নাকি? আমাদের চাঁদা না পেলে ওদের চলবে? তাই তো আমরা হোটেলওয়ালারা, এ হেন পরিস্থিতিতে ঘরভাড়া বাড়িয়েছি অবিশ্বাস্য হারে। এক রাতের ভাড়া এখন মাত্র ৪০,০০০ টাকা! লাল সঙ্কেত শহর জুড়ে। আর কী বা করা যায়? সেই জমা জল যে বেরচ্ছেও না। কিন্তু কেন? নিশ্চয় দেশকে খুশি করার জন্য নয়, বা কর্নাটকের রাজনীতি বদলে দিতে নয়। যদিও যে সব অঞ্চল ভাসছে বা অতি বর্ষণে ডুবতে বসেছে, সেখানকার অধিকাংশ বিধায়ক ঘোড়া কেনাবেচার আগে থেকেই বিজেপি দলের। বেঙ্গালুরু পুরসভার আয় বিস্তর। দেশে তার আয়ের তুলনা চলে একমাত্র বৃহৎ মুম্বই পুরসভার সঙ্গে। আর রাজ্যের যা আদায় তার কম-বেশি ৬০ শতাংশ তো এই পুরসভাই দেয়।

 

তবে, নেতাদের দায় ঝেড়ে ফেলার প্রবণতা এখানেও সমান তালে বহমান। সবচেয়ে বড় সমস্যা পরিবেশ সংক্রান্ত। কেউ সেদিকে নজরই দেয়নি। দিকে দিকে গড়ে উঠেছে মল, বহুতল। বড় ব্যবসায়ীরা চাইলেই যত্রতত্র বুজিয়ে ফেলা হয়েছে পুকুর-দীঘি। খালি জায়গা পেলেই হল। শহরে গাছও কমেছে, শিশুদের খেলাধুলোর জায়গা নিত্য কমেছে (অবশ্য তাদের নানা কিসিমের শিক্ষায়তন বাড়ছে), শহরের ৭০ শতাংশের বেশি অংশ কংক্রিটের ঢালাই।  ওদিকে রাজ্য সরকার নাকি ভাবছে, নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি ঘটাতে তারা কিছু জলাশয়ে স্লুইস গেট বসাবে! এমন প্রতিশ্রতিও যে অতি বিপজ্জনক, কে বোঝাবে কর্তাদেরকে বোঝাবে যে শুধু শিল্প, নিয়ন্ত্রণহীন শিল্প কেবল জিডিপি বাড়ায় না, দূষণও বাড়ায়। পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য নষ্ট করে। মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশন কর্তারা যেন হঠাৎ টের পেলেন যে তাঁরা পরিবেশের গুরুত্ব অস্বীকার করে ব্যক্তিগত সুখ-সাধনায় মেতে ছিলেন এতকাল! এখন কী হবে?

 

আপাতত একে অন্যকে প্রবোধ দিচ্ছেন- কিছু হবে না, পাগল প্রকৃতি ফের শান্ত হবে।  যেমন ২০০৬-এ শান্ত হয়েছিল নিজ খেয়ালে। এবারও তাই হবে। ফের আমরা ঘোড়া কেনাবেচায় মন দেব। দিতেই হবে। তবে কিছু কাজ তো দেখাতে হবে। নতুবা লোকে মানবে কেন? এই রাজ্যের ঘোড়াদের মতির স্থিরতা কম, কবে বলবে বেশ ছিলাম আমরা কুমারস্বামী বা সিদ্ধারামাইয়ার রাজত্বে, অতএব...।

 

ব্যবসায়ীদের মতিগতিও বোঝা ভার। তবে, ভরসা এই যে তাদের একটা বড় অংশ আজও মোদী ভাইদের সঙ্গে আছে। থাকবেও। সবাই তো মোহনদাস পাই নয়। তিনিই বা কোন সাধুপুরুষ! ইনফোসিসের প্রাক্তন কর্তা তিনি, সুযোগ নেননি? যতদিন ব্যাঙ্ক ব্যবস্থা আছে, ঋণ শোধ না করার ব্যবস্থা আছে বা অর্থমন্ত্রী নির্মলা আছেন, আছে পরিবেশের আইনকানুন অগ্রাহ্য করার সুযোগ, বিদেশি ব্যাঙ্কে অ্যাকাউন্ট খোলার সুযোগ, অন্তত ততদিন তো তারা আছেই মোদীভাই-এর সঙ্গে। থাকতেই হবে। নইলে আয়কর, ইডি, সিবিআই ধরবে না? কংগ্রেস আমলেও তারা এসব সুযোগ পেয়েছে তবে কংগ্রেসিরা জানত না বহু কিছু। এখন মোদিজীর রাজত্বে তারাও শিখেছে অনেক। তাই ভয়, কংগ্রেস যদি তাদের অন্যভাবে পুষিয়ে দেবার চক্রান্ত করে, আমরা যদি তাদের সেই চক্রান্তের শিকার হতে দিই, তবে তো...।

 

ওসব নিয়ে পরে ভাবলেও চলবে। এখন এই বৃষ্টি বা জলদস্যুর হাত থেকে উদ্ধার পাওয়াটাই বড় ব্যাপার। তারপর একদিন নিশ্চয় বলতে পারব যে, 'এমন শহরটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি’- অন্তত যদি হোটেলের ঘরভাড়া দেখেন। যদিও জানি, সব দেশেই এক নিয়ম। বরং, চলো গান করি– এমন উন্নয়ন দেখি নাই কভু, শুনি নাই প্রভু!

 



6 comments:

  1. ভাল লাগল। ঘটনা জানা হলেও লেখার গুণে অন্য মাত্রা পেল।

    ReplyDelete
  2. ভাবা যায় না।

    ReplyDelete
  3. খুবই বাস্তবসম্মত

    ReplyDelete
  4. বেশ ভাল লাগল।

    ReplyDelete
  5. চূড়ান্ত শহর বেঙ্গালুরুর সবকিছুই তো চূড়ান্ত হবে এতে আর আশ্চর্য কী।কয়েক ঘন্টা র বৃষ্টি অনির্বচনীয় ভিলা গুলিকে বিপর্যস্ত করল। চতুর্দিকে খালি জল আর জল কিন্তু বেঙ্গালুরুতে শুনেছি পানীয় জলের বড় ই অভাব। উন্নয়ন আর উন্নয়ন,তার মন নাই,তাই কাত করলে এক ফোঁটা জল ও পড়ে না।আর কলকাতার কথা বলি। গতবছর পূজোর আগে মুকুন্দ পুর এলাকা জুড়ে বৃষ্টির জল জমে ওখানকার সমস্ত হাসপাতাল, হাউসিং বাজার, রাস্তা ঘাট দীর্ঘদিন ভেসে থাকতে দেখেছি ।আর এন টেগোরে প্রয়োজনে দীর্ঘ দিন যাবার কারণে লক্ষ্য করেছি গোটা
    হাসপাতাল তল্লাট জুড়ে জলের স্রোতে বিপর্যস্ত রুগি আর পরিজনদের ।ভেবে
    আনন্দ হোলো গত ত্রিশ চল্লিশ বছর জুড়ে চলতে থাকা উন্নয়ন তান্ডব কলকাতা আর তার লাগোয়া এলাকাকে স্বপ্নে র বেঙ্গালুরু করে তুলবে ।

    ReplyDelete