Friday, 11 October 2019

জলাতঙ্ক

নিজেরা সচেতন হই
সঞ্জয় মজুমদার
শিউরে ওঠারই কথা। আমাদের পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ শুধু জল। তার মাত্র ২ শতাংশ ব্যবহারযোগ্য, যার আবার ১.৩ শতাংশ হিমবাহ আর পোলার আইস-ক্যাপে মোড়া। অথচ বছরের পর বছর আমাদের দেশ এই দুর্লভ ব্যবহারযোগ্য জলসম্পদের পরিকল্পনাবিহীন যথেচ্ছ ব্যবহার করে আসছে। বিশ্বব্যাপী জল-সূচকের সমীক্ষায় ১২২টি দেশের মধ্যে আমাদের দেশের স্থান ১২০। নীতি আয়োগের কম্পোজিট ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট ইন্ডেক্স ২০১৮'র তথ্য বলছে, ২০২০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের প্রায় সমস্ত মাঝারি ও বড় শহরের ভূগর্ভস্থ জলস্তর শূন্যে গিয়ে দাঁড়াবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হিসেব করে দেখিয়েছে, প্রতিদিন একজন ব্যক্তির ২৫ লিটার জল দৈনন্দিন কাজে প্রয়োজন হয়, শুধু বেঁচে থাকার প্রয়োজনে অর্থাৎ রান্নাবান্না এবং পানীয় হিসেবে। আমাদের দেশের বর্তমানে সামগ্রিক জনসংখ্যাকে ২৫ দিয়ে যদি গুন করি তাহলে যে পরিমাণ ব্যবহারযোগ্য জলের মাথাপিছু প্রতিদিন প্রয়োজন, তার জোগান সরকার সুনিশ্চিত করতে পারছে কি? অথবা, পারবে তো?

পরিকাঠামো এবং নির্মাণ ক্ষেত্রে ব্যবহৃত জলের পরিমাণের কোনও হিসেব নেই। এরপর খেলাধুলো, বিনোদন, পর্যটন এবং আরও কত অজস্র ক্ষেত্র পড়ে রয়েছে যেখানে একজন নাগরিকের খেয়ে বেঁচে থাকার বাইরেও জলের প্রয়োজন। না হলে বাণিজ্যে বসতি লক্ষ্মী হবে না। কোন দিকে যাবে সরকার ঠিক করুক। বিনে পয়সায় খাবার জল দেবে নাকি ব্যবসার প্রয়োজনে জল খরচা করবে। রাষ্ট্রপতি ভবনের মুঘল গার্ডেনস বাঁচিয়ে রাখার জন্য কত লিটার জল লাগে? আমাদের জলশক্তি মন্ত্রক হিসেব করে দেখেছে? আইপিএল প্রসঙ্গ টেনে আনা অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। যদিও সেটা প্রতীকী, কিন্তু ভাবতে হবে, এক টুকরো সবুজ মাঠ প্রয়োজন। কিন্তু স্পন্সর ও কর্পোরেট দুনিয়ার চাপে এত ঘনঘন মুনাফা অর্জনকারী টুর্নামেন্টের প্রয়োজন কতদূর? সাধারণ মানের একটা রেস্তোরাঁয় খেতে গেলেও ওয়েটার জিজ্ঞেস করেন, মিনারেল ওয়াটার নাকি রেগুলার ওয়াটার? একে তো প্লাস্টিকের বোতল, তার মধ্যে মিনারেল ওয়াটার! সুস্থ মস্তিষ্কে যার ব্যাখ্যা মেলে না। 'মিনারেল' এই অক্ষর সমষ্টি দিয়ে দেশের জনগণকে বোঝানো হয়েছে যে একমাত্র এই জল পান করলেই সুস্থ থাকা নিশ্চিত। ঠিক যেমন প্রজন্মের পর প্রজন্ম বোঝানো হয়েছে, গঙ্গাতে একমাত্র বিশুদ্ধ জল পাওয়া যায়; যার ধর্মীয় সংস্করণ 'পবিত্র' এবং তা শিব ঠাকুরের মাথায় ঢাললে দেবাদিদেব সব পাপ ধুয়ে দেবেন। সরকারি প্ররোচনায় শুধু পাপ ধুতেই দেশের জনগণ কতটা জল খরচ করে? মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটা করা যাবে না, খুন হয়ে যেতে পারি। সত্যজিৎ রায়ের 'গণশত্রু' ছবির প্রতিটি সংলাপ যেন জীবন্ত।

যে জল না খেতে পেলে আমি মরে যাব, সেই পানীয় জল নিয়েও সূক্ষ্ম শ্রেণিবিভাগ। এই সাজানো প্রহসনের মানে কী? ভারতের নদ-নদী বিশ্বব্যাপী জলসম্পদের মাত্র ৫-৬ শতাংশ বয়ে নিয়ে যায়। আমাদের জানা আছে, নদী শুধু জল বহন করে না, পলিও বহন করে। তার পরিমাণ নেহাৎ কম নয়, প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ। ভারতের কৃষি ব্যবস্থা এখনও বৃষ্টির জল নির্ভর। অনুন্নত এবং অপ্রতুল সেচ ব্যবস্থা সমস্যা আরও বাড়িয়েছে। রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং, ওয়াটার শেড ম্যানেজমেন্ট, ইন্টিগ্রেটেড ওয়াটার রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট এসব সরকারি পরিকল্পনাতেই আটকে আছে; দিনের আলোর যেটুকু মুখ দেখেছে তার বেশির ভাগটাই দালালদের পকেটে গেছে। পবিত্র গঙ্গাকে নিয়ে অপবিত্র অ্যাকশন প্ল্যান বছরের পর বছর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। পূর্বসুরীদের কথা ছেড়েই দিলাম, বারাণসীর মাননীয় সাংসদ আজ আমাদের সম্মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। নিন্দেমন্দ করছি না, কিন্তু প্রশ্ন তো করতেই পারি। এর সঙ্গে আছে অচেতন নাগরিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন নদীর জলের ব্যবহার এবং শিল্প-বর্জ্য। গোদের উপর বিষফোঁড়া।

ভারতের ৭০ শতাংশের উপর ব্যবহারযোগ্য জল দূষিত হয়ে গেছে এমনি এমনি নয়। একটার পর একটা স্থানীয় জলাভূমি, পুকুর বুজিয়ে বাড়ি উঠেছে। ভোট ব্যাংকের রাজনীতি করতে গিয়ে প্রোমোটার-রাজকে যথেচ্ছভাবে প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। আমাদের নিজেদের বোধবুদ্ধিও তারিফযোগ্য। নির্দিষ্ট পাত্রে প্রয়োজন মতো জল ধরে যেটুকু দরকার সেটুকুই পরিবারের সদস্যরা ব্যবহার করব, এটুকুও কি আমরা করি? সরকারকে গালমন্দ করার আগে, কর্পোরেট দুনিয়াকে ঢিল মারার আগে নিজের দিকটা ভেবে দেখতে হবে। দিনের শেষে ঘুমের দেশে যাওয়ার আগে সুরাপায়ীরা(নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত) কত গ্যালন জল খরচ করে? পণ্ডিতেরা বলছেন, দূরদর্শীরাও বলছেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ নাকি জলের জন্যই হবে। এখনই কি যুদ্ধ কিছু কম হচ্ছে? আচ্ছা, একটা পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ পরিচালনা করতে কত জল লাগে?  হিজিবিজবিজ হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাসি থামছেই না।


No comments:

Post a Comment