Tuesday 18 June 2019

জুনিয়র ডাক্তারদের সেলাম!

রোগীদের দু-চার কথা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য

জীব বিজ্ঞানী ব্রুস লিপটন তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ ‘বায়োলজি অফ বিলিফ’এ বলেছেন, ডাক্তারি সিলেবাসে যদি শুধু ‘প্লেসেবো এফেক্ট’ই ৫০ শতাংশ পড়ানো হয় তাহলে স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রভূত উন্নতি হতে পারে। ‘প্লেসেবো এফেক্ট’ হল রোগীর ওপর স্বান্ত্বনা বা ভরসার এক নিরাময়কারী প্রভাব। অর্থাৎ, ডাক্তারবাবু যদি বলেন, আপনি এখন ফার্স্ট ক্লাস আছেন বা সামান্য একটা ভিটামিন বড়ি দিয়ে বললেন, এই ওষুধটি রোজ একটা করে সাতদিন খেলেই আপনি ১০০ শতাংশ ফিট হয়ে যাবেন, তাহলে রোগী বিশ্বাসের বলেই অনেকটা ভাল হয়ে যেতে পারেন। যে কারণে, অনেক সময় হোমিওপ্যাথী চিকিৎসায় রোগী ভাল হয়ে গেছেন জেনে অ্যালোপ্যাথির ডাক্তারবাবুরা বলেন, আসলে রোগী ভাল হয়েছেন হোমিওপ্যাথিতে নয়, ‘প্লেসেবো এফেক্ট’এ। অর্থাৎ, ভরসা বা বিশ্বাস এখানে এক অমূল্য পাথেয়।

আমরা সামান্য গেঁয়ো অশিক্ষিত জীব। এ জগৎ-সংসারের কীই বা জানি! ডাক্তারি তো নয়ই! ডাক্তার আমাদের মা-বাপ। আমরা কেজো রোগী, রোগী স্বার্থ আন্দোলনের কর্মী বন্ধুবর উত্তান সেদিন বলল, ডাক্তারের কাছে যাওয়াটা স্বাস্থ্যের লক্ষণ নয়, না-যাওয়াটাই স্বাস্থ্যের লক্ষণ। তো তথ্য ঘেঁটে দেখি: According to a recent study by Johns Hopkins, more than 250,000 people in the United States die every year because of medical mistakes, making it the third leading cause of death after heart disease and cancer. (Feb 22, 2018)। বুঝুন কাণ্ড, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর আড়াই লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছেন চিকিৎসায় গাফিলতির কারণে, যা কিনা হার্টের রোগ ও ক্যানসারে মৃত্যুর পর তৃতীয় বৃহত্তম মৃত্যুর কারণ। এই ‘ব্যাধি’র নাম দেওয়া হয়েছে: iatrogenic disease। তাহলে রোগব্যাধি হলে কী করব?

আমার মনে হয়, জুনিয়র ডাক্তারেরা যে অসীম সাহসের সঙ্গে গত সাতদিন এক প্রায়-অসম লড়াই লড়ে কিছু বিষয় সরকারের থেকে আদায় করেছেন তার মধ্যে রোগীর স্বার্থের কথা বেশ কিছুটা জায়গা জুড়ে আছে। সেটা বেশ ভরসার। এতে আমার ও অনেকের শরীর ও মন বেশ চনমনে হয়ে গেছে (প্লেসেবো এফেক্ট), আরও এই কারণে যে, অন্তত ভাবতে পারছি, এবার সরকারি হাসপাতালে নিজের বা আত্মীয়স্বজন অথবা বন্ধুবান্ধবদের চিকিৎসার প্রয়োজনে কোনও রেফারেন্স ও আশঙ্কা ছাড়াই যে কোনও ডাক্তারের পরামর্শ নিতে যেতে পারব। ১৯৮৩ সালের ঐতিহাসিক জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনে রোগীদের কথা ভেবেই ধর্মঘটের পাশাপাশি সমান্তরাল ওপিডি ও ইমার্জেন্সি চালু ছিল, যে কারণে বহু পুলিশি দমনপীড়ণ সত্ত্বেও সে আন্দোলন ব্যাপক মানুষের সমর্থন আদায় করতে পেরেছিল। তাই এবারের আন্দোলনেও রোগীরা ভরসা রেখেছিলেন অন্তত ইমার্জেন্সি বিভাগ চালু থাকবে। ছিল কি ছিল কিনা, কতটা ছিল, সর্বত্র ছিল কিনা, সে তর্কে এখন গিয়ে আর লাভ নেই, কিন্তু এই প্রয়োজনটার কথা আমার কিছু ঘনিষ্ট মহলে জানাবার চেষ্টা করেছিলাম। কেউ বুঝেছিলেন কেউ বোঝেননি। কেউ ডাক্তারি শিক্ষার বড়াই করেছিলেন (যেন বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার, শিল্পী, লেখক, গায়ক বা একজন দক্ষ কৃষকও কম মেধাবী), কেউ আবার, আমরা রোগীরা যে মিনমিন করে হলেও দু-চারটে কথা তোলার অধিকারী, সে কথাটাকেও মানতে চাননি। তবে, অধিকাংশরাই ভরসা দিয়েছেন। সেই ভরসার জায়গাটাই প্রধান। প্লেসেবো এফেক্ট। চেঙ্গাইলে, বেলুড়ে, শ্রীরামপুরে, সরবেরিয়ায় চেনা-অচেনা ডাক্তারেরা যে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে চিকিৎসাশাস্ত্রের অন্যতর অনুশীলনে এক অনির্বচনীয় সদর্থক পরিচয় রাখছেন, তাতেই আমরা অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠছি। এবারের আন্দোলনের সময়ে যে জুনিয়র ডাক্তারেরা নিজেদের রক্ত দিয়ে ইমার্জেন্সির রোগীদের অপারেশন করেছেন, প্রাণ বাঁচিয়েছেন, সেইসব অত্যাশ্চর্য তরুণদের কথা জেনে আমরা আরও বেশি সুস্থ হয়ে উঠছি। প্লেসেবো এফেক্ট। নবান্ন’এর বৈঠকে যখন তরুণ ডাক্তাররা বলছেন, রোগীদের অভিযোগ জানানোর কুঠুরিটা সিঁড়ির তলায় অগোচরে থাকে, তাকে দৃশ্যমান করতে হবে; বা, ‘সেবাসাথী’ প্রকল্পে রোগীদের বিভিন্ন ক্লিনিকাল পরীক্ষাগুলি খরচসাপেক্ষ, সেগুলোকে এই প্রকল্পের মধ্যে আনা উচিত; অথবা, রোগীদের আত্মীয়দের তাৎক্ষনিক শলা-পরামর্শ দেওয়ার জন্য (যেমন, রোগীকে নিয়ে কোন বিভাগে যাবেন বা রোগীর এখন কী অবস্থা ইত্যাদি) ভেলোরের খ্রিশ্চিয়ান মেডিকেল হাসপাতালের মতো এক-জানালা ব্যবস্থা চালু করা উচিত, তখন নীলরতন সরকার হাসপাতালে বসে অপেক্ষারত যে সমস্ত রোগী ও তাঁদের আত্মীয়রা জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গেই নিবিড় ভাবে টিভিতে চোখ রেখে অধীরভাবে শুনছিলেন, তাঁরাও অনেকটাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। প্লেসেবো এফেক্ট।
যে কোনও পেশাতেই ভুল বা মতান্তর হতে পারে। তার জন্য কারও গায়ে হাত তোলা যায় না। যে কারণে সাংবাদিক, ইঞ্জিনিয়ার বা বিডিওকে পেটানো যায় না। আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে মাত্র। আর নির্দ্বিধায় স্বীকার্য, ডাক্তারি পেশা সব থেকে দুরূহ, কারণ তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষের জীবন-মৃত্যু। নীলরতনের যে দুজন জুনিয়র ডাক্তার আক্রান্ত হলেন তাকে নিন্দা জানাবার কোনও ভাষা নেই। তাঁরা দ্রুত সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। আক্রমণকারীদের যোগ্য ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক। ভবিষ্যতে এমন ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। হলেও, তাকে উপযুক্ত ভাবে মোকাবিলা করতে হবে। কড়া হতে হবে। সেই সঙ্গে রোগীরাও যথার্থ চিকিৎসা পাওয়ার অধিকারী। তাঁরাও যেন না ভেবে বসেন, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় না। কর্পোরেট হাসপাতালগুলি এই ভাবনা যোগাতে সদা ব্যস্ত - আমাদের এখানে এসো, তবে ঠিকঠাক চিকিৎসা পাবে। তারপর দায়ে পড়ে সেখানে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন সাধারণ রোগী ও তাঁদের পরিজনেরা। এই দুষ্ট চক্রকে ভাঙ্গতে হবে। আর তা পারেন চিকিৎসাশাস্ত্রে উদ্বুদ্ধ ডাক্তারেরা ও তাঁদের রোগীরা। রোগীরাই ডাক্তারদের সব থেকে বড় সুরক্ষা আর ডাক্তারেরা রোগীদের জীবনদায়ী অনুপ্রেরণা। আর সরকার? তার ভূমিকা তো মুখ্য! ডাক্তার ও রোগীদের সুরক্ষা দেওয়া, সমস্ত ওষুধের সরবরাহ হাসপাতালে ঠিকঠাক রাখা, দালাল চক্রদের নির্মূল করা, চিকিৎসার যন্ত্রপাতিগুলোকে সতেজ রাখা ও সর্বোপরি, সুচিকিৎসাকে ১০০ শতাংশ নিশ্চিত করা - তা তো সরকারেরই মূল দায়িত্ব। ছোট মুখে বড় কথা বলা এই অধম, জুনিয়র ডাক্তারদের অসম্ভব মনের জোরকে পাথেয় করেই, রোগীদের হয়ে তাই সকলের কাছে মার্জনা চেয়ে এই সামান্য কিছু কথা নিবেদন করতে সাহস করতে পারল। দীর্ঘ দীর্ঘ দিন সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকুন সকলে।  
     

    

Tuesday 4 June 2019

মায়ের কথা


মাতৃত্ব না  জীবিকা?
অভিষিক্তা রায়চৌধুরী 
 
একটা সম্পূর্ণ নিজের কোমল শিশু পরম নির্ভরতায় আঁকড়ে ধরছে এ স্বপ্ন কোন মানুষ না দেখে?  অথচ, সন্তানের জন্মের আগে ও পরে জীবনটা সম্পূর্ণভাবে বদলে যায় মায়ের, এটাই ছিল দস্তুর।  এখন কিন্ত পাল্টাচ্ছে সময়। আমরা বন্ধুরা মজা করে বলি, আমরা জন্ম দিয়ে আর মাতৃসুধা খাইয়ে ৯০ শতাংশ দায়িত্ব পালন করে ফেলেছি।  এবার পেঙ্গুইন বাবার মতো তোমরা শাবককে তা দাও। আজ্ঞে হ্যাঁ মি লর্ড, ঐ দুটি কাজ ছাড়া বাবাদের অসাধ্য কাজ কিছুই নেই,  অবশ্যই যদি সাধ থাকে তো। কোলে নিয়ে ঘুরতে বাবাদের জুড়ি মেলা ভার,  ডায়পার পাল্টানো,  চান করানো, খাওয়ানো,  আশকারা দেওয়া বা শাসন করা কোনওটার জন্য‌ই  ফিমেল অর্গ্যন লাগে না বিশ্বাস করুন। তাহলে কী ভাবছেন?  মায়েদের হাতে র‌‌ইল পেন্সিল?  একদম না!  র‌ইল আমাদের বিপুল অপরাধ বোধ।

কাঠগড়ায় মায়েরা
বাচ্চা যথেষ্ট স্বাস্থ্যবান নয়  বা বাবা-মা উচ্চশিক্ষিত হ‌ওয়া সত্বেও  ছেলেমেয়েরা সেরকম ঝকঝকে রেজাল্ট করল না, সবের মূলেই একটাই কারণ- মা সময় দিতে পারেনি।  এ নিদান শুধু সমাজের নয়, পরিবারের, কর্তামশাই'এরও সব সময় নয়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ অপরাধ বোধ নিজের। শিশু সন্তান যখন দুঃখ করে- তোমার মতো তো সবাই কাজে যায় না, তাকে বোঝান যোগ্যতা না থাকলে তো কাজ সবাই পায় না, বা সবার বাবা তোমার বাবার মতো সোনাবাবা নয় তাই তাদের মাম্মারা কাজে যেতে পারে না, বন্দী হয়ে থাকে। ট্যুরে যেতে হলেও ঘাবড়াবার কিছু নেই, একসঙ্গে দুজন না গেলেই হল। বাবার ট্যুরে যাওয়া মেনে নিতে পারলে মায়েরটাতেও অভ্যাস হয়ে যাবে।

আমার কর্মরতা মা আমার মাতৃত্ব ইনিংস শুরু হবার পর অমোঘ টিপস দিয়েছিল- সারাদিন বাড়ি থাকিস না বলে বাচ্চাকে ঘুষ দেবার জন্য হাতে করে জিনিস নিয়ে ঢুকবি না।  সমস্ত দিন আমোদপ্রমোদ করতে যাই না আমরা।  কাজ করতে যাই।  আমার বেতনটা না হলে বাড়িতে হা‌ঁড়ি চড়ত কিনা, অথবা সেই বেতনটার জোরে একটা অজানা দেশ অদেখা থেকে গেলেই কি সুখের ভা‌ঁড়ারে কম পড়ত কিনা এসব প্রশ্ন নিষ্প্রয়োজন। কলার তুলে বলো- ‌ জাতীয় আয়ে আমার অবদান আছে। আপনারা তো এক্ষুণি হৈ হৈ করে বলবেন হোমমেকারদের কি অবদান নেই সেটার স্বীকৃতি নেই বলে? আমি বলব নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু ছদ্মবেশে লুকনো  বেকারত্ব‌ও আছে।  আমাদের দেশের নিরিখে নিরক্ষর পা‌ঁচুর মা যে রান্নাটা করতে পারেন আপনি এমএ/ এমএসসি বা ল' পাশ করে সেই রান্নাগুলোই যদি বারো মাস তিরিশ দিন করেন তাহলে কি আপনার কুড়ি বছরের রক্ত জল করা অধীত বিদ্যার সঠিক প্রয়োগ হল? বাচ্চার পছন্দের টিফিনটায় মায়ের হাতের ছোঁয়া রোজ না দেওয়া গেলেও সপ্তাহের শেষে তো দেওয়াই যায়, ঠিক যেমন দেখে দেওয়া যায় তার লেখা প্রশ্নের উত্তর বা কষা অঙ্কগুলো দিনের শেষেও। আর শুধু আপনার শিশু সন্তানকে পড়ানোর জন্য তো এর অর্ধেক পড়াশুনো জানলেও হত।  কটা বাড়িতে থাকা মাই বা তার সন্তানকে আইআইটি বা অনার্স কোর্সের জন্য  পড়াতে পারেন? তার জন্য তো সেই টিউশন, কারণ, ততদিনে বাবা মা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুলে যায় তাদের উচ্চশিক্ষার সিলেবাস।

আরে দা‌ঁড়ান, দা‌ঁড়ান। তাহলে কি বলছেন ছোট্ট থেকেই টিউশন দিতে হবে? কারণ , আমাদের দেশে যেখানে শিক্ষক ও ছাত্র-ছাত্রীর অনুপাত এত খারাপ সেখানে বাড়িতে না পড়ালে চলবে কী করে? আর বাচ্চাটাকে পড়াতে গেলে অন্তত সন্ধের মধ্যে তো ফিরতে হবে? আচ্ছা, আপনি না ফিরতে পারলে দেখুন তো বাচ্চার বাবা ফিরতে পারে কিনা তার ঘুম পাবার আগেই হোম ওয়ার্কটা করিয়ে দেওয়ার জন্য?  হ্যাঁ হ্যাঁ মানছি ঠিক সময়ে অফিস থেকে বেরলে প্রমোশনটা একটু দেরি করে হবে, কিন্তু গিন্নিকে চাকরি ছাড়তে হলে যে মাইনেটা বন্ধ হয়ে যাবে তার থেকে বেশি ক্ষতি তো আর হবে না? অর্থাৎ, হিসেবটা করার সময় যুগল লাভের কথাটা ভুলে যাবেন না। অতএব, এখানেও অর্থনীতি। আর ই‌ঁদুর দৌড়ের প্রসঙ্গ তুললে বলি, পার্টনারশিপ ফার্ম চালাচ্ছেন,  অ্যাসেট দুজনের, দায়ভার একজনের কখনও হয়? 

সময়ের পদানত আমরা
এই পর্যন্ত পড়েই আপনি হতাশ,  কারণ ঠিক সময়ে বাড়ি না ফেরাটা আপনাদের দুজনের কারুর‌ই চয়েস নয়, বর‌ং মজবুরি।  হয় দুজনেই কর্পোরেট দাস যেখানে ঠিক সময়ে বাড়ি ফিরলে চাকরিটা চলেও যেতে পারে, ওয়র্ক ফ্রম হোম ইউটোপিয়ান ধারণা,  যাতায়াত আর যানজটে পাক্কা চার ঘন্টা কাটিয়ে ফেরেন যখন, তখন আপনি জীবন্ত লাশ; বা আপনারা ডাক্তার বা উকিল যাদের আসল প্র্যাকটিসের সময় ঐ সন্ধেবেলাই, অথবা আপনি প্রফেসর যাকে পরের দিনের ক্লাসের প্রস্তুতি নিতে হবে তাদের বলি- এত চিন্তা কীসের? আপনি তো স্বয়ম্ভূ নন। আপনাদের বাবা মা যারা আপনাদের শিক্ষার বনিয়াদটা শক্তপোক্ত করেছেন তারা কি পারেন না তাদের উত্তর-প্রজন্মকে নিয়ে একটু পড়াতে বা পার্কে নিয়ে গিয়ে দাদু ঠাকুমার অ্যাসোসিয়েশন বানিয়ে নিতে? আর যদি আপনাদের এক পিস ভাই বা বোন থাকে আর থাকে তাদের ছেলে মেয়ে, গরমের বা শীতের ছুটিতে থাকুক না এ ওর বাড়ি।  ভালবাসায় ভরে থাক কাকা পিসি মামা মাসির। আর যৌথ পরিবার বা নিদেনপক্ষে এক পাড়ায় থাকা গেলে তো কথাই নেই।

কিন্ত যদি আপনি থাকেন দূর প্রদেশে যেখানে না আছে ক্রেশ না পাওয়া যায় কাজের লোক, বাবা মাও থাকেন দূরে,  তাহলে দেখুন না, দুজনে দুটো শিফট নিতে পারেন কি না, অথবা বাড়িতেই খুলতে পারেন কিনা আপনার নিজস্ব অফিস, নিদেনপক্ষে বাড়ি থেকেই দিন অনলাইন বা এমন টিউশন যখন আপনার জীবনের বন্ধুটি বাড়ি ফিরে এসে ক্ষুদে দস্যিটার সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। মোট কথা, বুদ্ধি আর দক্ষতার গোড়ায় জল দিয়ে বাড়িয়ে তুলুন আমাদের হিউম্যান ক্যাপিটাল।  যেন পরে আফশোস করে বলতে না হয়, ‌'আহা, এমন মানবজমিন র‌‌ইল পতিত,  আবাদ করলে ফলত সোনা , মন রে কৃষি কাজ জান না'। আর হয়ে উঠুন শুধু স্নেহময়ী নয় ধীময়ী সুপারমম।

Monday 3 June 2019

২০১৯'এর নির্বাচন

অর্থনীতির সামান্য কথা
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পর নানা মত, বিশ্লেষণে বিগ মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া এখন ভারাক্রান্ত। তাই আরও একটি বাড়তি বিশ্লেষণে এই ভার বাড়বে বই কমবে না। কিন্তু বলতেই হয়, এইসব রকমফের আলোচনায় যে উপাদানটি কোথাও নজরে এল না তা হল, রাজনৈতিক অর্থনীতির আলোকে বিষয়টিকে দেখা। এর অর্থ, অর্থনীতির এমন কি কোনও প্রধান সড়ক বা গলিঘুঁজি ছিল যা সকলের দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল? অন্যথায়, গত দু বছরে অর্থনীতির তথাকথিত খারাপ সূচকগুলিকে বহন করেই মোদি সরকার আবার কী করে আরও বেশি জনমত নিজেদের পক্ষে নিতে পারল! এই আলোচনাটা না করলে আমরা বাস্তবতার গহীন অবস্থাটা বুঝতে হয়তো সক্ষম হব না!

প্রথমেই ধরা যাক বেকারত্বের প্রশ্নটিকে। সকলেই একমত, বেকারত্বের হার গত দু’ বছরে সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। ভোটের আগে না হলেও পরে নতুন সরকারের প্রকাশিত তথ্যে তা স্পষ্ট ধরাও পড়েছে।এ নিয়ে বিরোধীরা কম হইচইও করেনি। কিন্তু তবু ভোট রণাঙ্গনে এর প্রতিফলন তেমন ভাবে পড়ল না। স্বাভাবিক দৃষ্টিতে এতে সকলের আশ্চর্য হওয়ারই কথা। তথ্যগুলিকে একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক। উল্লেখ্য, এনএসএসও’র তথ্যে প্রকাশিত, ২০১৭-১৮ সালে সারা দেশে বেকারত্বের গড় হার ছিল ৬.১ শতাংশ যার ৭.৮ শতাংশ ও ৫.৩ শতাংশ ছিল যথাক্রমে শহর ও গ্রামীণ এলাকায়। কিন্তু শুধু এইটুকু দেখলেই হবে না। এর সঙ্গে মেলাতে হবে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রশ্নটিকেও। নিচের টেবিলটিকে ভাল করে নিরীক্ষণ করুন:
দেখা যাচ্ছে, শিক্ষাগত যোগ্যতা যত বেশি বেকারত্বের হারও তত বেশি। ২০১৭-১৮ সালে শহুরে পুরুষদের ক্ষেত্রে যাদের কোনও শিক্ষা নেই তাদের বেকারত্বের হার যেখানে ২.১ শতাংশ সেখানে মাধ্যমিক ও তার বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে তেমনদের ক্ষেত্রে বেকারত্বের হার ৯.২ শতাংশ। শহুরে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই হার শিক্ষা নেই এমনদের ক্ষেত্রে যেখানে ০.৮ শতাংশ সেখানে মাধ্যমিক ও তার বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে এমনদের ক্ষেত্রে ১৯.৮ শতাংশ। গ্রামীণ পুরুষ ও মহিলাদের ক্ষেত্রেও প্রায় একই চিত্র উঠে আসছে। তাহলে কি বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অন্তরায়? আজকের রাজনৈতিক অর্থনীতির প্রেক্ষাপটে এটি অত্যন্ত মৌলিক প্রশ্ন। সামগ্রিক ভাবে এই জায়গাটিকে ধরতে না পারলে অর্থনীতির আজকের চেহারাটা তো বোঝা যাবেই না, উপরন্তু, তা বহু দিশাহীনতার জন্ম দেবে।

এখানে ছোট পরিসরে বোঝার বিষয় হল, প্রযুক্তি-তাড়িত অর্থনীতি আজ প্রায় সমস্ত কাজকে মেশিন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রতিস্থাপন করে এনেছে যেখানে খুব অল্প সংখ্যক বৌদ্ধিক বা দক্ষ মানব ছাড়া আর তেমন কর্মীকুলের দরকার নেই। কিন্তু অদক্ষ কাজের এলাকাগুলিতে কায়িক শ্রম করে তেমন মজুর ও কর্মীর প্রয়োজন এখনও ফুরিয়ে যায়নি, বিশেষত সেইসব এলাকাগুলি যেগুলো এখনও পশ্চাৎপদ। ভারতের মতো দেশে এই কাজের ক্ষেত্রগুলি এখনও অনেকটা পরিসর জুড়ে বিরাজমান। তাই কম শিক্ষিত বা নিরক্ষর মানুষের কাজের প্রয়োজন এত সহজে ফুরোবার নয়। অবশ্য, এইসব কাজে মজুরির হারও খুব সামান্য তাই স্বল্প মজুরিতে কর্মনিয়োজনের সুযোগ এখনও দীর্ঘদিন ভারতীয় অর্থনীতিতে থেকে যাবে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে এইসব প্রত্যন্ত গরিব মানুষের কাছে সামাজিক সুরক্ষা ও আয় পৌঁছে দেওয়ার নানা কার্যক্রম যা বিভিন্ন ভাবে নানান শাসক দলগুলির প্রতি গরিব মানুষের আস্থাকে কখনও কখনও বাড়িয়েছে। আর সেই সঙ্গে বর্তমান গিগ অর্থনীতির পরিসরে কাজেরও এমন অনেক ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছে যা চিরায়ত অর্থে চাকরি নয়, স্বল্পস্থায়ী এমন এমন কাজ, যাকে তথ্যের আকরে ধরা এখনও পদ্ধতিগত কারণে কিছুটা দুরূহ। তাই তথ্যে যা দেখা দিচ্ছে, তা বাস্তবে হয়তো অন্য কথা বলতে চাইছে। কম শিক্ষিত মানুষের বেকারত্বের হার কম হলেও দেখা যাবে তাদের আয় যথাযথ নয়, যেগুলো হয়তো প্রতিবেদনে সে ভাবে আসেনি। আবার শিক্ষিত মানুষের বেকারত্বের হার বেশি হলেও এমনটাও সম্ভব যে তারা যে কাজগুলিতে জড়িত সেগুলোকে তাদের কর্মসংস্থান বলে মনে হচ্ছে না। বাস্তব এই যে, সংগঠিত শিল্পে কর্মসংস্থানের হার সামগ্রিক ভাবে নিম্নমুখি, কিন্তু তা দিয়ে আজকের নতুন কর্মসংস্থানের জটিলতাকে বোঝাটা দুষ্কর। এইসব সমস্যার কারণে বেকারত্বের প্রশ্নটি এবারের নির্বাচনে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়নি। উপরন্তু, বেকারত্ব দূরীকরণের দায় কার- কেন্দ্র না রাজ্যের- এ নিয়েও রয়ে গেছে নানা ধন্দ।

এর সঙ্গে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ জুড়ে গেছে। আজ থেকে ১০ কি ১৫ বছর আগে রাজ্যে রাজ্যে, এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারেরও নানা ঘোষণায় জুড়ে থাকত বিদেশি পুঁজি, দেশি পুঁজি, বৃহৎ শিল্প স্থাপনা ইত্যাদির নানা বাগাড়ম্বর। সেইসব এখন বিদায় নিয়েছে। কারণ, অভিজ্ঞতায় মানুষ বুঝেছেন, বড় আধুনিক শিল্পে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাপনা খুবই সীমিত। তাই দলগুলির তরফে এইসব প্রসঙ্গ তুললেও ভবি ভুলবার নয়, তাই তার থেকে বিরত থাকাই শ্রেয়। এখন বরং সকলেই এই প্রতিযোগিতায় নেমেছে যে কে কত জনমুখি প্রকল্প মারফত জনগণের একটা বড় অংশকে নানারকমের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারছে বা তাদের আয় বাড়াতে সক্ষম হচ্ছে। নবীন পট্টনায়েকের কালিয়া প্রকল্প, মমতার সবুজসাথী, কন্যাশ্রী, চন্দ্রশেখর রাওয়ের প্রজাবন্ধু প্রকল্প অথবা মোদির কিষাণ যোজনা বা শৌচালয় প্রকল্প ইত্যাদি ইত্যাদির মধ্যে এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে কে কতটা জনগণের কাছাকাছি এসে পৌঁছতে পারছে। ফলে, মানুষও এইসব বাস্তব কার্যাবলী দিয়ে ভোটপ্রার্থীদের বিচার করছেন। বহু উড়িষ্যাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, তাঁরা লোকসভায় মোদির পক্ষে কিন্তু বিধানসভায় নবীনবাবুর দিকে। কারণ, তাঁরা রাজ্য ও কেন্দ্র দুই সরকারেরই সুবিধাগুলি পেতে চান। তার ফল ভোটেও প্রকাশ পেয়েছে।

এই নির্বাচনে হিন্দুত্বর ইস্যু একটা স্তরে কাজ করেছে ঠিকই কিন্তু সামগ্রিক ভাবে নয়। কেন্দ্রীয় অনেক প্রকল্পের সুবিধা সাধারণ মানুষ বিভিন্ন রাজ্যে পেয়েছেন। যেমন, জনধন যোজনা, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা, মুদ্রা ঋণ, শৌচালয়– এইসব প্রকল্পের সুবিধা অনেকে পেয়েছেন। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে স্থানীয় সমস্যাগুলি। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে জোরালো হয়েছিল নিচের স্তরে সরকারি প্রকল্প নিয়ে শাসক দলের দুর্নীতি ও দাদাগিরি যা গ্রামীণ মানুষের একটা বড় অংশকে তৃণমূল দল থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু উড়িষ্যা বা তেলেঙ্গানায় রাজ্য পার্টিগুলিকে এই সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়নি, যে কারণে তাদের ফল অনেক আশাব্যঞ্জক হয়েছে। তবে সবটাই আপতকালীন একটা পর্যায় মাত্র। এক বছর পর কোথাকার জল কোথায় গড়াবে তা দেখার আছে। যেমন, মধ্যপ্রদেশ ও রাজস্থানে ৩-৪ মাস আগেই বিধানসভায় বিজেপি পরাজিত হয়েও লোকসভায় আশাতীত ফল করেছে।

এর সঙ্গে মজার ব্যাপার যেটি হয়েছে, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের হতবাক অবস্থাটি। তাঁরা খুব বিশ্লেষণ-টিশ্লেষণ করে নানা তত্ত্ব আউড়ে যা দেখালেন তা এক্কেবারে ফক্কা। সমাজের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে যাঁদের কোনও সঙ্গ নেই, কিছু বই পড়ে ও সেমিনার করে তাঁদের বর্গ নির্মাণের যে অনুশীলন, তা এবারে একেবারে মাঠে মারা গেছে। তাঁদের ইন্ডিয়া আর আসলি ভারত যে দুই প্রান্তের দুই ভিন্ন পরিসর, তা এবারে একেবারে হাতেকলমে ধরা দিয়েছে।

মোদ্দা যেটুকু বুঝেছি, দেশের মানুষ গরিব হতে পারেন, ‘অশিক্ষিত’ও, কিন্তু বেশ সমঝদার ও সেয়ানা। তাঁরা দ্বন্দ্বরত শাসকের দুর্বলতাগুলি ঠিক ধরে ফেলেছেন এবং যেখানে যাকে ঘা দেওয়ার দিয়েছেন। সবটাই যে ঠিকঠাক দিতে পেরেছেন তা নয় কিন্তু তাঁদের সে এলেম আছে, সে প্রমাণ তাঁরা রেখেছেন। সর্বোপরি, তাঁরা সুদূরপ্রসারী চিন্তারও অধিকারী। আজ তাঁরা যাঁদের ক্ষমতায় এনেছেন, কাল যে তাঁদের প্রতি আস্থা থাকবে তেমন কথাও তাঁরা দেননি। তা আরও বোঝা গেল, কর্নাটকে বিজেপিকে লোকসভায় প্রচুর আসন দিয়েও ছ’ দিন পরেই স্থানীয় নির্বাচনে তাদের হাত থেকে বহুলাংশে তা কেড়ে নেওয়ার মধ্যেই। তাই সবটা মিলিয়ে, এ দেশের সংসদীয় রাজনীতি বেশ জমে উঠেছে। দেওয়াল লিখন হল: বেশি বাড় বেড়ো না, ঝড়ে পড়ে যাবে।