Wednesday 22 March 2023

প্রসঙ্গ ডিএ ও কর্মচারী আন্দোলন

এঁরাও কি 'আন্দোলনজীবী'?

সংযুক্তা মিত্র



বুদ্ধদেব বসু বলতেন, কবিতার মূল্যায়ন করতে হলে একটু সময়ের দূরত্ব দরকার। আজকের কবিতার ভাল মন্দ আজকে দাঁড়িয়ে করলে তাতে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা। শুধু কবিতা নয়, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অনেক ইস্যুকেই একটু সময়ের স্রোতে খাবি খেতে দেওয়া উচিত বলেই মনে হয়। সেদিক থেকে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ-র ইস্যুটা নিয়ে আজ বেশি হইচই হলেও আসলে এটা বেশ অনেকটাই পুরনো প্রসঙ্গ। তাই এবার বোধহয় কিছু কথা বলা দরকার। কারণ, বিষয়টা নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে প্রচুর আর তাতে চুনো মাছ শিকারেও অনেকে দিব্যি নেমে পড়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই নিয়ে শুনানি স্থির হয়ে আছে- তার পরে কর্মচারীদের কপালে তাঁদের প্রাপ্য জুটবে কি না সেও লাখ টাকার প্রশ্ন। তবু আশায় বাঁচে চাষা। 

কিন্তু মূল ব্যাপারটা কী? সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের মূল বেতনের সঙ্গে নির্দিষ্ট মহার্ঘ ভাতা পেয়ে থাকেন, আজ নয় দীর্ঘকাল ধরেই। প্রধানত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে কালোবাজারি, মূল্যবৃদ্ধি এইসব সমস্যাগুলি দেখা দিতে থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তার কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতার প্রচলন করে। তারপর থেকে স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা এই বিবেচনায় মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার অধিকারী হন। মনে রাখা দরকার, ১৯৩৫ সালে যে ‘ভারত শাসন আইন’ হয়েছিল (Government of India Act 1935), সেই আইনগুলিকে ভিত্তি করেই স্বাধীন ভারতে সরকারি ব্যবস্থা, তার কর্মচারীদের দায়-দায়িত্ব-সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা সবটাই তৈরি করা হয়েছিল। শুধু সরকারি দফতরের কর্মচারীরা নন, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীরাও মহার্ঘভাতা পান। পান বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিকরাও। আর এই মহার্ঘ ভাতা কী কতটা হবে, তা ঠিক হয় ‘সারা ভারত খুচরো মূল্য সূচক’ অনুযায়ী যা নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের অধীন একটি স্বশাসিত সংস্থা। তারা সারা দেশের রাজ্যগুলি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মূল্য সূচকের কমা বাড়া ঠিক করে, তার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার ডিএ-র হার নির্ধারণ করে দেয় যা অনুসৃত হয় অন্যান্য রাজ্য সরকারগুলির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোয় এইটাই নিয়ম। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

সমস্যাটা হল, এই রাজ্যের প্রশাসনের সর্বময় কর্তারা কর্মচারীদের  ডিএ পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়ে ওঠা আন্দোলন ও পাবলিক ডোমেনে এসে পড়া বিতর্কটাকে নানাভাবে গুলিয়ে দিতে চাইছেন। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ইতিমধ্যেই ডিএ নিয়ে যে সব মন্তব্য করেছেন তাতে তাঁর এই বিষয়টি নিয়ে সীমাহীন অজ্ঞতাই প্রকাশ পেয়েছে, অথবা ধরে নিতে হবে তিনি যা বলেছেন তা তাঁর উচ্চপর্যায়ের আমলাদের শিখিয়ে দেওয়া কথা, যে আমলারা মূলত কেন্দ্রীয় ক্যাডারের আধিকারিক ও তাঁর সূত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত হারেই ডিএ পান, তাদের কোনও ডিএ বকেয়া নেই। রাজ্যের ডি-ফ্যাক্টো অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র কয়েক বছর আগে বলেই দিয়েছিলেন কর্মীদের ডিএ না দিয়ে তিনি ‘সাফল্যের সঙ্গে’ রাজ্যের কোষাগারের অর্থ সাশ্রয় করছেন। রাজ্যের সর্বশেষ বেতন কমিশনের প্রধান, কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর অর্থনীতির অধ্যাপক তাঁর রিপোর্টে কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে চাননি, যদিও তিনি নিজে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ‘মহার্ঘ ভাতা’ কোনওদিন ফেরত দিয়েছেন বলে আমরা শুনিনি। বিধানসভায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি যেটুকু পেরেছেন ডিএ দিয়েছেন, এর বেশি পারবেন না। তাঁর বক্তব্যে এমনকি তিনি পেনশন প্রাপক ও সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির জন্য বলতে চেয়েছেন, পেনশন দিতে হচ্ছে বলে তিনি ডিএ দিতে পারছেন না। এই রাজ্যেই একমাত্র নাকি পেনশন চালু আছে আর কোথাও নেই, এটা তারই প্রকাশিত বক্তব্য। তাঁর এইসব বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে ‘অনুপ্রাণিত’ হয়ে তাঁর চ্যালা-চামুন্ডারা কেউ বলছেন, না পোষালে ছেড়ে দিন; কেউ নিদান হাঁকছেন, কেন্দ্রীয় হারে ডিএ চাইলে কেন্দ্রের চাকরি করুন; কেউ দাবি করছেন, এই রাজ্যে কাজ করলে কেন্দ্রের ডিএ চাওয়া চলবে না। মারমুখি ঔদ্ধত্য ও আকাট নির্বুদ্ধিতা জট পাকিয়ে গেলেই এইসব সুবচন নির্গত হয়। 

একটা কথা প্রথমেই বলতে হবে, হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ খুব স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছে ডিএ পাওয়া কর্মীদের অধিকার। কারণ, কর্মচারীরা যে সরকারের কাজ করেন তাদের নীতি প্রণয়নে কর্মীদের কোনও ভূমিকা থাকে না। তাই সরকারি নীতি বা কোনও সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে যদি মূল্যবৃদ্ধি হয়, তার ফলে কর্মীদের মূল বেতন ক্ষয় হয়, অর্থাৎ ওই পরিমাণ বেতনের বিনিময়ে তাঁরা তাদের জীবন চালানোর উপযোগী ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন না। এই ক্ষয় রোধ করার জন্যই মহার্ঘ ভাতা। কে কতটা ‘ভালবেসে’ দেবে বা কতটা দিতে না পারলে তার ‘মুণ্ডচ্ছেদ’ করা হবে, এরকম কোনও অস্পষ্টতা এর ভিতরে আদৌ নেই। এর সঙ্গে বলে রাখা দরকার, ডিএ-র ‘কেন্দ্রীয় হার’ বলে কিছু পূর্ব নির্ধারিত বিষয় নেই। সর্বভারতীয় মূল্যবৃদ্ধির সূচকের রিপোর্টের ভিত্তিতেই ডিএ-র হার ঠিক হয়, এখানে কোনও সরকারের ভূমিকা নেই। কেন্দ্রীয় সরকার সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ছ-মাস অন্তর ডিএ-র হিসেব ঠিক করে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় এটা ঠিক হয় বছরে চারবার- এমনকি কোনও ত্রৈমাসিকে যদি দেখা যায় মূল্যবৃদ্ধি হয়নি বা মূল্যহ্রাস হয়েছে তার ভিত্তিতে কর্মীদের ডিএ বাড়ে না বা কমেও যায়। সবটাই একটা সুশৃঙ্খল পদ্ধতি, এর মধ্যে কোনও ব্যক্তির সাধ আর সাধ্যের অকুলানের মতো ছেঁদো বিষয় নেই। 

পেনশন আর ডিএ-কে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? সাংবিধানিকভাবে সরকারি চাকুরেরা পেনশন পান, কারণ, বলা হয় তাঁরা হচ্ছেন ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ অর্থাৎ ‘জনগণের সেবক’। তাই অবসরের পর সরকার তাদের জীবিকার জন্য একটা আনুপাতিক বেতন দিয়ে থাকে। সেনা বিভাগে যারা কাজ করেন, শারীরিক কারণে তাঁদের পঁয়ত্রিশ বছরে অবসর নিতে হয়, তাঁরাও এরপরে চাকরি বা ব্যবসার সুযোগ পান, পেনশন-ও পান। রাজ্যের বিধায়ক, সাংসদরা যেহেতু জনপ্রতিনিধি বলে বিবেচিত হন, তাঁরা একটা দফায় (পাঁচ বছর) বিধানসভায় বা সংসদে থাকলেই সারা জীবন পেনশন পান। সরকারি কর্মীদের পুরো পেনশন পেতে গেলে কুড়ি বছর চাকরি করতে হয়। সরকারি কর্মীদের পেনশন ব্যবস্থায় সংস্কার শুরু হয়েছিল প্রথম এনডিএ সরকারের আমলে (২০০১)— আর্থিক দায় এড়ানোর জন্য তখনই কেন্দ্রীয় সরকার ‘ন্যাশনাল পেনশন স্কিম’ নিয়ে আসে যাতে কর্মীদের যোগ দিতে বলা হয়। এতে সরকারের আর্থিক দায় এড়াতে কর্মীদের বেতনের একটা ভাগ আর সরকারের দেয় অংশের একটা ভাগ চাকরি জীবনের প্রথম থেকে সরিয়ে ওই পেনশন ফান্ডে বিনিয়োগ করা হয়। অবসরের পরে ওই ফান্ডের যা লাভ হয় তা-ই কর্মীরা পেনশন হিসেবে পান। তবে এই ফান্ড-নির্ভর ব্যবস্থা কর্মীদের কোনও সুনিশ্চিত পেনশনের আশ্বাস দেয় না। কারণ, ফান্ডের টাকা শেয়ার বাজারে লগ্নি করা হয়। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। 

‘ন্যাশনাল পেনশন স্কিম’ যে সময়কালে চালু হয় তখন কেন্দ্রের শাসক জোটের শরিক ছিলেন এই রাজ্যের শাসক দল। লোকসভায় এই ব্যবস্থার তারা সরকারিভাবে বিরোধিতা করেছিল বলে জানা নেই। বাম দলগুলি এইভাবে সরকারি কর্মীদের কষ্টার্জিত অর্থ শেয়ারে বিনিয়োগের বিরোধিতা করেছিল এবং সেই সময় তাদের পরিচালনাধীন রাজ্য সরকারগুলি এই স্কিমে তাদের কর্মচারীদের নিয়ে আসেনি। পশ্চিমবাংলার কর্মচারীরা তাই পুরনো পেনশন স্কিমের আওতাতেই আছেন। রাজ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও (২০১১) আগের সিদ্ধান্ত বাতিল করে নতুন পেনশন ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়নি, তার দায় কর্মচারীদের নয়। আর এই রাজ্যের সরকারি কর্মীদের মতোই অন্য রাজ্যেও রাজ্যের অ্যাক্যাউন্টান্ট জেনারেল (এজি) সেই রাজ্যের সরকারি কর্মীদের পেনশন অনুমোদন করে। গুগল  সার্চ  করে খুঁজলেই যে কেউ দেখে নিতে পারেন এজি ওয়েস্টবেঙ্গল বা এজি বিহার বা মধ্যপ্রদেশ কীভাবে কর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করছে, পেনশন অনুমোদন করছে। তাই, এই রাজ্যেই একমাত্র পেনশন চালু আছে, অন্য রাজ্যে নেই- এই বক্তব্য একটি ডাহা মিথ্যে কথা। 

কর্মচারীদের সংগঠিত আন্দোলনকে নানারকম বিভ্রান্তির দুর্বিপাকে জড়িয়ে দিতে আরও কিছু তথ্য বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে যার উৎস বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। তা হল, কেন্দ্রীয় সরকার অনেক প্রকল্পের অর্থ বকেয়া রাখার কারণেই নাকি ডিএ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই কি? কেন্দ্রীয় সরকার যে সব প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে বলে শোনা যায়, তা মূলত ‘আবাস যোজনা’ ও ‘একশো দিনের কাজ’এর- যদি সত্যিই অন্যায্য ভাবে এই বরাদ্দ আটকে রাখা হয় তা প্রতিবাদযোগ্য, কিন্তু এইসব প্রকল্পের বকেয়া অর্থ তো ওই চিহ্নিত প্রকল্পগুলিতেই খরচ করতে হবে! সেই অর্থ থেকে কি কর্মীদের ডিএ দেওয়া যায়? আর্থিক শৃঙ্খলার স্বার্থে কোনও সরকারই এই কাজ করতে পারে না, তারপরেও ওই বকেয়ার সঙ্গে ডিএ-র বকেয়াকে মিলিয়ে দিয়ে স্পষ্টত ভুল বোঝানো হচ্ছে মানুষকে। দ্বিতীয়ত, সরকার নানা জনকল্যাণমুখি কাজ করছে বলে নাকি কর্মীদের ডিএ মেটানো যাচ্ছে না। এটা আরেকটা পরিকল্পিত ভুল প্রচার। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রে সরকার তার নাগরিকদের জন্য নানা জনমুখি প্রকল্প রূপায়ন করবে এটা তো সেই সরকারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। দেশের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে নানা প্রদেশের সরকার সবাই নানা ধরনের জনমুখি কল্যাণ প্রকল্প চালায়। তার জন্য কি তাদের কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা থেকে বঞ্চিত করতে হয়? তথ্য বলছে, সারা দেশে এই রাজ্যের সরকারি কর্মীরাই সব থেকে কম হারে মহার্ঘ ভাতা পান। অথচ সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই রাজ্যে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কর্মচারী পদ শূন্য। তাহলে ওই সংখ্যক কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ আর্থিক দায় সরকারকে বহন করতে হচ্ছে না। একটা সরকার যখন তার অর্থ দফতরের মাধ্যমে বাজেট তৈরি করে তখন তার কতটা আর্থিক দায়, কতটা পরিকল্পিত ব্যয় এইসব হিসেব-নিকেশ করেই তা ঠিক করতে হয়। তাহলে কি ধরে নিতে হবে এই রাজ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে মূল্যবৃদ্ধি-জনিত সম্ভাব্য মহার্ঘভাতা বাবদ ব্যয়কে সরিয়ে রেখেই বছরের পর বছর বাজেট করা হয়েছে? আর তাই মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ব্যাপারটা ব্যক্তি-বিশেষের ‘মর্জি’ বা ‘ভালবাসার’ ওপরেই  মূলত দাঁড়িয়ে আছে? 

পূর্বতন বাম সরকারও যে নিয়মিত কেন্দ্রীয় হারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ডিএ দিতে পারত তা নয়, কিস্তি বাকি থাকত। কিন্তু একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে আবার সেগুলো মিটিয়েও দিয়েছে, অন্তত এই মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বিষয়টাকে ‘কর্মীদের উপহার’ বলে কখনও বিজ্ঞাপিত করেনি। বাম আমলে শেষ যে বেতন কমিশন হয়েছিল (রোপা ২০০৯) তার বকেয়া টাকা তিনটে কিস্তিতে সরকার মিটিয়ে দিয়েছিল। তখন বর্তমান রাজ্য সরকারের ‘কারাগার নিবাসী’ ভূতপূর্ব শিক্ষামন্ত্রী রাইটার্স বিল্ডিং'এর ক্যান্টিন হলে কর্মীদের সভায় বলেছিলেন তাঁরা সরকারে এলে সব বকেয়া একদিনে মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকারের আওতায় যে বেতন কমিশন হয়েছে (রোপা ২০১৬) সেখানে ২০১৬ থেকে প্রাপ্য বকেয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। শাসক দলের কর্মী নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন, সরকারি কর্মীরা ‘অনেক টাকা’ মাইনে পান, আবার বাড়তি চাইছেন কেন? বেশি বা কম একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোও তো তুলতে হবে, গত দশ বছরে বিধায়কদের বেতন ভাতা সহ অন্যান্য সুবিধে তিন তিনবার বাড়ানো হয়েছে কীসের ভিত্তিতে? সরকারি কোষাগারের ‘বেহাল’ অবস্থাই যদি হয় তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহারের জন্য গত দু বছর ধরে কেন একটি চার্টার্ড বিমান ভাড়া করে রাখা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে? কেন তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের বাজেট বরাদ্দের সিংহভাগ খরচ করা হচ্ছে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন ও প্রচারের কাজে? একটা সরকার নিজে যেভাবে ‘মিথ্যে গুজব’ ছড়িয়ে তার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, এই উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীতে বিরল। 

তবে এই ‘কদাচার’ মনে রেখেও দুয়েকটা দরকারি কথা বলা প্রয়োজন। সরকারি কর্মচারীরা পেশাগত দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামলেও আদপে তাঁরা সামাজিক মানুষ। একটা সরকার তাঁর যাবতীয় উন্নয়ন ও পরিষেবা দেন এঁদের উপরে ভিত্তি করেই। তাই, সমাজের অন্য অংশের মানুষের কাছে সরকারের মুখ ও জানালা এরাই। এই বিষয়টা খেয়াল রাখলে নিজেদের দাবি দাওয়ার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ গড়ে তোলা একটা বড় দায়, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে এই বার্তা না যায় যে এই অংশটা একেবারেই নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে আন্দোলন করছেন। এইটুকু করতে না পারলে তাঁদের আন্দোলনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হওয়া সম্ভব নয় আর জনমনে তাঁদের আন্দোলন বিষয়ে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ ছড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে আরও বেশি। এই পরিস্থিতির লাভ তুলবে কিন্তু উচ্চতর প্রশাসন। এই পরিস্থিতির মধ্যেই তারা খুঁজে নেবে নিজেদের অপদার্থতার দায় ঝেড়ে ফেলার ওষুধ, তাতে কর্মচারীদের লাভ নেই। তাই নিজেদের দাবি দাওয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষিত নিয়ে আরও বেশি বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা মনে হয় এবার আন্দোলনকারীদেরও ভেবে নিতে হবে।   

এখনও অবধি যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, আন্দোলনরত শিক্ষক- সরকারি কর্মচারী- পেনশন প্রাপকরা তাঁদের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে মরিয়া। শুধু নিজেদের মহার্ঘ ভাতার দাবিই নয়, এর সঙ্গে তাঁরা জুড়ে নিয়েছেন অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের স্থায়ীকরণ বা দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ করে সরকারি পদপূরণের মতো দাবি- দ্বিতীয় ও তৃতীয় দাবির সঙ্গে সার্বিক মানুষের যোগ গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু সংবেদনহীন সরকার এখনও পর্যন্ত কোনও কিছুতেই তাপ উত্তাপ দেখাচ্ছে না। আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে, নয়াদিল্লির প্রান্তসীমায় বসে থাকা কৃষক আন্দোলনের কথা। এই রাজ্যের প্রতিবাদী সরকারি কর্মীদের কপালেও কি তাহলে এবার ‘আন্দোলনজীবী’ তকমা জুটবে?

 

Thursday 16 March 2023

সন্দীপ দত্ত

উজান পথের পথিক

প্রবুদ্ধ বাগচী


(২৪ জুলাই ১৯৫১ - ১৫ মার্চ ২০২৩)

সেদিন ওঁর বাড়ির সেগুন কাঠের সাবেক দু-পাল্লার দরজাটায় যখন কলিং বেল দিয়েছিলাম, ভিতর থেকে আওয়াজ এসেছিল, ‘কে?’ অভয় পেয়ে দরজা ঠেলে যখন ভিতরে ঢুকলাম, প্রথমে চিনতে পারেননি। তারপর একটু চোখ সইয়ে নিয়ে বললেন, ও তুমি, এসো। অনেকদিন পর। সত্যিই অনেকদিন পর মুখোমুখি বসলাম আমরা। এই তো মাত্র মাসখানেক আগেই। এক শীতের দুপুরে। ওঁর কিংবদন্তি লাইব্রেরি তখন সদ্য খুলছে, পাঠকের ভিড় তখনও বাড়েনি। চারদিকে বই আর বই, তারই মধ্যে কম্পিউটারের প্রিন্ট করা বিষয়ের নাম। আমায় বললেন, 'তুমি অনেকদিন পরে এলে। দ্যাখো, আমরা আমাদের সমস্ত সংগ্রহগুলোকে ৬৫টা বিষয়ে ভাগ করে রেখেছি।' ঘুরে ঘুরে দেখলাম। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনার কবিতার বইয়ের সংগ্রহগুলো? উনি দেখালেন পাশের ঘরটা। বললেন, দক্ষিণ কলকাতায় একজন বইপ্রেমী তাঁর বাড়ির একটা তলা আমাদের ছেড়ে দিচ্ছেন, ওখানেই সব কবিতার বইয়ের সংগ্রহ চলে যাবে আস্তে আস্তে। ওই পাশের ঘরটায় ঢুকতেই এক ঝলক পুরনো স্মৃতির পালক উড়ে এল আমার ভিতরে। 

সেটা ১৯৯৩-৯৪ সাল হবে। নানা রকম লেখালিখির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখব বলে মনে মনে ভেবে ফেলেছি তখনই। আর সেই সময়ই অব্যর্থ ভাবে আলাপ হয়ে গিয়েছিল এই আশ্চর্য মানুষটির সঙ্গে। যিনি প্রথম দিন থেকেই উজান পথের পথিক। তখন কবিতা আর কবিতা-বিষয়ক নিবন্ধ লেখায় পেয়েছিল আমায়। ‘রক্তকরবী’ পত্রিকার অধুনা প্রয়াত সম্পাদক বলেছিলেন, বাংলার মহিলা কবিদের নিয়ে লিখতে। সেই লেখার মালমশলা, কবিতার বই সবই জুগিয়ে দিয়েছিলেন এই প্রিয় অভিভাবকসম মানুষটি। তখন থেকেই ওই কবিতা-ঘরে আমার আসা যাওয়া। এরপরে যখন ষাটের দশকের বাংলা কবিতার বিভিন্ন আন্দোলনগুলি বিষয়ে লিখব বলে ঠিক করলাম তখনও মুশকিল আসান করে দিয়েছিলেন এই মানুষটি। এক রথযাত্রার বৃষ্টিস্নাত  বিকেলে তাক থেকে বই পেড়ে দিচ্ছেন সন্দীপদা আর আমি নোট নিচ্ছি আমার খাতায়— এই দৃশ্য যেন স্থির হয়ে আছে আমার স্মৃতির পটে।

সেইসব দিন থেকেই সন্দীপদা চিনতেন আমায়, আমি তাঁকে। মনে পড়ে সেই কবেকার কলকাতা শহরের পথে আপনার সঙ্গে আমাদের দেখা, আপনার ঘরে বসে কথা-বলা, পুরনো বইয়ের ধুলো ঘেঁটে সোনা খুঁজে বেড়ানো আর পাপড়ভাজা সহযোগে চা-খাওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই, এই সেদিন যখন দেখা হল, নিজের মনেই বললেন, দেখতে দেখতে তোমার সব চুল দাড়ি সাদা হয়ে গেল! সেই কতদিন আগে তুমি আসতে, তখন তোমার তরুণ বয়স। কী করব, সন্দীপদা? সময় যে মস্ত বড় ঘাতক! না হলে কি আজ আপনাকে এইভাবে এসএসকেএম'এর সাদা বিছানায় নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে হয়? আর আপনাকে নিয়ে আমায় বুনে যেতে হয় অতীতচারিতার অক্ষরমালা?

শুরুটা হয়েছিল তাঁর ছাত্রাবস্থায়। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যাতায়াতের সূত্রে তাঁর চোখে পড়ে লাইব্রেরির একটা ঘরে অবহেলায় স্তূপীকৃত হয়ে রয়েছে বিপুল লিটল ম্যাগাজিনের সম্ভার। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, লাইব্রেরি কর্তৃপক্ষ ওগুলি নষ্ট করে দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছেন, কারণ, ওগুলো নাকি ঠিক মতো সংরক্ষণ করার নানা অসুবিধে। বিদ্রোহী সন্দীপ প্রতিবাদ করেন এই ঘটনার। দেখা করেন আচার্য সুকুমার সেনের সঙ্গে; তিনি বলেন, কেন ওইসব আবর্জনার স্তুপ নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছেন! অতঃপর বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে সন্দীপ সিদ্ধান্ত নেন, সাহিত্যের চিরকালীন ধারা বয়ে চলেছে যে লিটল ম্যাগাজিনের মধ্যে দিয়ে তাদের সংরক্ষণের জন্য তিনিই কিছু করে দেখাবেন। শুরু হল তাঁর পথচলা। নিজের বাড়ির একতলার তিনটে ঘরে প্রতিষ্ঠা হল তাঁর লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি। 

নিয়মিত চাকরির বাইরে একটি দৈনিক পত্রে পার্ট-টাইম চাকরি, টিউশনি— এই বাড়তি অর্থের সবটাই খরচ হয়ে যেত নতুন নতুন পত্রিকা কিনে লাইব্রেরি সাজানোয়। গোড়ার দিকে বিকেলের মুখোমুখি 'পাতিরাম' বুক স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিনি, উৎসাহী পাঠকদের ডেকে ডেকে নিয়ে যেতেন তাঁর স্বপ্নের লাইব্রেরিতে। এইভাবে তিল তিল করে নিজের সর্বস্ব দিয়ে, নিজের ব্যক্তিগত পারিবারিক জীবনকে কিছুটা পাশে সরিয়ে রেখে গড়ে তুলেছেন একটা প্রতিষ্ঠান, যা ক্রমশ অঙ্গীভূত হয়ে উঠেছে আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে, আমাদের সাংস্কৃতিক গবেষণার সঙ্গে— আমাদের বইপাড়ার ঐতিহ্যে যুক্ত করেছে আরেকটা পালক। 

আজকের কলেজ স্ট্রিট মানে প্রেসিডেন্সি কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, সংস্কৃত কলেজ, কফি হাউস  বা পাতিরাম বুক স্টল আর নয়- ১৮/এম টেমার লেনের এই ‘কলকাতা লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণা কেন্দ্র’ আজ এই শহরের সারস্বত সাধনার অন্যতম উৎকর্ষ কেন্দ্র। অন্তত বাংলা সাহিত্য বা সামাজিক বিজ্ঞানের নানা শাখায় যারা গবেষণা করেন, তাদের কোনও না কোনও সময় হাজির হতেই হয় এই প্রতিষ্ঠানটির দরজায়। যতদূর জানি, লাইব্রেরির সংগ্রহে এখন প্রায় এক লক্ষ বই, পত্র-পত্রিকা- মধ্য কলকাতার এক সাবেক বাড়ির একতলায় নিয়মিত পাঠক গবেষকের আনাগোনায় সরগরম হয়ে ওঠে লাইব্রেরির ইট কাঠ পাথর কড়ি বরগা- আর তাঁর প্রাণপুরুষ সন্দীপ দত্ত, সকলের সন্দীপদা। 

কাল থেকে কী হবে সন্দীপদা? কে দরজা খুলবে লাইব্রেরির? কে নিবিড় নিষ্ঠায় হাজারও তথ্য জুগিয়ে তুলে দেবে উৎসুক পাঠকের হাতে? কে গবেষকদের দাবি মতো ফটোকপি করা লেখার বান্ডিল গুছিয়ে রাখবে? কে উৎসাহী কবি লেখক গবেষকদের পাশে বিরাট ছাতার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে? কে সীমিত সাধ্যের মধ্যে প্রতি বছর তরুণ কবি প্রাবন্ধিক গবেষক ও লিটল ম্যাগাজিনকে পুরস্কৃত করবে কাল থেকে? প্রশ্নগুলো আজ এই স্তব্ধ হয়ে যাওয়া শোকের ভিতর থেকেও ভারী হয়ে উঠে পথ আটকাচ্ছে আমাদের।

হয়তো ‘প্রতিষ্ঠান’ শব্দটা খুব পছন্দের ছিল না সন্দীপদার। কারণ, যিনি লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে ঘর করেছেন, যিনি কলকাতা বইমেলার মাঠে সেই আশির দশকের শেষ থেকেই মাথায় প্রকান্ড কাগজের টুপি মাথায় ঘুরে বেড়াতেন, যাতে লেখা থাকত— ‘লিটল ম্যাগাজিন কিনুন, লিটল ম্যাগাজিন পড়ুন, লিটল ম্যাগাজিন ভাবুন’- তাঁর চোখে ‘লিটল ম্যাগাজিন’  মানেই স্রোতের উজানে চলা, তথাকথিত প্রতিষ্ঠানকে অস্বীকার করে নিজেদের পথ খুঁড়ে খুঁড়ে চলা। কিন্তু সাড়ে চার দশকের সময়ের স্রোতে এই ব্যঞ্জনাগুলি যে ক্রমশ ফিকে হয়ে যাচ্ছে, এটা বুঝতে তাঁর দেরি হয়নি। তাঁর এই টুকরো ভাবনা ভেসে আসতে দেখেছি গত কয়েক বছরে তাঁর ফেসবুক ওয়ালে লেখা বিক্ষিপ্ত মন্তব্যে, অসহায় উচ্চারণে। যে লিটল ম্যাগাজিনের স্বপ্নে তিনি সর্বস্ব পণ করে তাদের জন্য নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন একটি অপাপবিদ্ধ ভূমিতল— সে ভূমি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তলায় তলায়— এটা বুঝে নিতে তাঁর অসুবিধে হয়নি। তাই তাঁর নামের পাশে ‘প্রতিষ্ঠান’ শব্দটি ব্যবহারে আজ আর তাঁর আপত্তি থাকত বলে মনে হয় না। ‘প্রতিষ্ঠান’ মানেই খারাপ, এমন সঙ্কীর্ণ স্বতঃসিদ্ধ থেকে দূরে থাকার কথাই ইদানিং ভাবছিলেন তিনি। তাই লাইব্রেরির উন্নতির জন্য নানা প্রতিষ্ঠানের অনুদান নিয়েছেন। বেশ করেছেন। কারণ, ওই অর্থে তাঁর ভাত কাপড় হয়নি, ক্রমশ নানা উৎকর্ষ ঘটেছে লাইব্রেরির, নানা প্রাচীন পত্রিকার ডিজিটাইজেশনের কাজ এগিয়েছে তারই সূত্রে। আর এটা তো সকলেই আজ জানেন, ১৯৭৮ থেকে চালু হওয়া এই ব্যাতিক্রমী উদ্যোগে এক আনা পয়সাও সরকারি সাহায্য পাওয়া যায়নি ‘সংস্কৃতির স্বর্গরাজ্য’ এই পশ্চিমবাংলায়! ইতিহাসে ব্যক্তির ভূমিকা ফেলনা নয়।  

সন্দীপদাকে নিয়ে কথা বলতে গেলে আরেকটা প্রসঙ্গের উল্লেখ জরুরি। তাঁর লাইব্রেরির 'হোলটাইমার' হয়েও নিজের পড়াশোনা ও গবেষণায় তাঁর কিন্তু কোনও ঘাটতি ছিল না। এমন বেশ কিছু প্রকাশনা তিনি করেছেন যা রীতিমতো সমীহ আদায় করে নেওয়ার মতো। যেমন বাংলার অশিষ্ট ভাষা নিয়ে 'স্ল্যাংগুয়েজ' বা বাংলার বিবাহের নানা রীতিনীতি নিয়ে তৈরি 'বিবাহ-মঙ্গল'। এছাড়া 'পত্রপুট' প্রকাশনার উদ্যোগে তাঁর সংকলিত 'উজ্জ্বল উদ্ধার' সিরিজের বইগুলি আজও সাহিত্যপ্রেমী মানুষের হাতে হাতে ফিরবার মতো আইটেম। এই হলেন তিনি। নিরলস উদ্যোগী, নিরন্তর পাঠক, সোৎসাহী গবেষক। অনীক দত্ত পরিচালিত 'মেঘনাদ বধ রহস্য' ছবিতে তাই ছবির চরিত্র এক অধ্যাপককে (চরিত্রাভিনেতা সব্যসাচী চক্রবর্তী) দেখা যায়, একটা তথ্যের খোঁজে তিনি এসেছেন 'লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি'র সন্দীপ দত্ত-র কাছে- ওই চলচ্চিত্রের খণ্ড দৃশ্যে অন্তত এইটুকু প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে এমন একটি প্রতিষ্ঠান কলকাতায় আছে যেখানে প্রতিষ্ঠিত অধ্যাপককেও তথ্যের সন্ধানে ঢুঁ মারতে হয়। এটাও এক ধরনের স্বীকৃতি বইকি!

এইসব মিলিয়েই তিনি। আমাদের সঙ্গে তাঁর তুমুল সখ্য, অনাবিল প্রশ্রয়, অবিমিশ্র শ্রদ্ধা। আজ সেই স্মৃতির সরোবরে কেবলই বিষাদের ঢেউ- আমাদের শহর ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে, সন্দীপদা! মনে পড়ে, এক সময় আপনি প্রতি বছর কবি-লেখকদের জন্মদিনে নিজে হাতে পোস্টকার্ড লিখে তাঁদের শুভেচ্ছা জানাতেন। আমিও অপেক্ষা করতাম কবে আপনার অলংকরণ করা পোস্টকার্ড উঁকি মারবে আমার ডাকবাক্সে। এমনই ছিল আপনার নিবিড় ভালবাসা। পোস্টকার্ডের দিন গিয়েছে আর সেই সঙ্গে আমাদের জীবন থেকেও হারিয়ে গিয়েছে এই সব কোমল স্পর্শের আখ্যান।

সন্দীপদা, আপনার কি মনে পড়ে, আপনি আপনার প্রকাশনা থেকে একসময় 'জন্মদিন' শিরোনামে একটি সংকলন করবেন বলে আমার থেকে লেখা নিয়েছিলেন। আমি সেই লেখায় লিখেছিলাম, 'নায়ক' ছবির অরিন্দমের মতো আমিও ক্রমশ মৃত্যু বিষয়ে 'ক্যালাস' হয়ে পড়ছি। আপনি সেই লেখা পড়ে আমায় বকে দিয়েছিলেন। আজ এই মৃত্যু-মাখা গোধূলিবেলায় আপনার অনুপস্থিতি সত্যিই আমার মধ্যে আবার ফিরিয়ে আনতে চাইছে সেই 'ক্যালাস' মনোভঙ্গিমা... বিশ্বাস করুন। এত এত মৃত্যুর মধ্যে দাঁড়িয়ে ক্রমশ অবশ হয়ে আসে ইন্দ্রিয়ের সংবেদন। উদাসী হাওয়ার পথে পথে জীবন থেকে ঝরে গেল আরও একটি মুকুল। আমাদের দাঁড়াবার জায়গার বড় অভাব হয়ে গেল আজ!


Tuesday 7 March 2023

কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া

খ্যাপারা মরে না 

বিশ্বজিৎ মিত্র



আমার ধারণা হয়েছিল, একেবারে যারা হাঘরে তাদের নিয়ে ফিল্ম বানানো এখন আর সম্ভব নয়। ঋত্বিক পারতেন, কারণ তিনি এ বিষয়ে যাজক ছিলেন না, ছিলেন খ্যাপা। এমন খ্যাপা আর ভূ-ভারতে তৈরি হয়নি। যদিও বাড়তি আবেগে মাখোমাখো হয়ে যাওয়ার দুর্দশা কিঞ্চিৎ উপহার দিয়ে গেছেন, কিন্তু খ্যাপা বলেই একদম অন্ত্যজদের কথা বলবার সাহস তাঁর ছিল। ক্ষমতাও। ভাবতাম, তিনি অনন্য। কিন্তু খ্যাপা বেশি গজায় না। তাই এমনটাই মনে হত। কারণ বলতে গেলে, এক তো সিনেমার অক্ষ চূড়ান্তভাবেই শহুরে- পরিচালকের বাসস্থান কি প্রযুক্তির প্রকৌশল– তায় সিনেমার নতুন ঢেউ তো অনেকদিনই পুরনো হয়ে গেছে। এক দোকানে দেখেছিলাম– বিশ্বাস মৃত, ধার তাহাকে হত্যা করিয়াছে। তেমনই বলতে হচ্ছিল, চলচ্চিত্রে ছন্নছাড়াদের আখ্যান বলার দিন গতাসু, শহর ও বাণিজ্য তাহাকে নিধন করিয়াছে। বাণিজ্যিক চোখরাঙানি, হুকুম-হুঁশিয়ারি এড়িয়ে প্রযুক্তির প্যাঁচঘোঁচ শিখে কোনও শহুরে মানুষের পক্ষে কি আর সত্যিই সম্ভব সত্যিকারের প্রান্তিক মানুষের কথা বলা? এক অঙ্গে এত রূপ কি সাধ্য? পরিচালককেও তো খেয়েপরে বাঁচতে হবে। তাই সম্ভাবনা গণিত ঠারেঠোরে বলছিল, সম্ভাবনা ক্ষীণ। এটা মাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের এক ইদানীং'এর খামতি, বোধ হত। 

কিন্তু ক্ষীণ হলেও সম্ভাবনা সবসময়ই থেকে যায়। পরিচালক মুহাম্মদ কাইউমের ‘কুড়া পক্ষীর শূন্যে উড়া’ সেই সম্ভাবনাকে আকার দিয়েছে। ওনার অতীত জীবনের আভাস না পেলেও জানলাম, কুড়ি বছর অপেক্ষা করেছেন উনি এই ছবি তৈরির জন্যে। এবং তিনিই প্রযোজক। অর্থনৈতিক দায় তাঁরই। বিশ্বাস করা শক্ত হয়ে দাঁড়ায় যে, দুর্মদ আবেগ কতদিন পুইয়ে রেখে তিনি ঋতুর পর ঋতু মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অনামী শিল্পীদের নিয়ে কাজ করার বুকের পাটা দেখিয়ে আর বড় কল্পনা করে শেষে এই পরশপাথরটি পেয়েছেন। আর আমাদের সওগাত দিয়েছেন। তাঁকে সেলাম দিই। বিহ্বলতায় এখনও দিন কাটছে।

দ্বিতীয় অনুভবের কথা বলা যাক। সবসময়েই মনে হয়েছে, জীবন, সৌন্দর্য আর শিল্প এই তিন মহীরূহের এক জটিল ত্রিঘাত সমীকরণ আছে। একে অপরকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করবে না, নির্ভর করার দায়ও নেই পরস্পরের, কিন্তু আশ্রয় করবে সুবিধেমতো। এদের কেউই শুধু নিজের পায়ে খাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। সব মিলে মিশে এক চমৎকার আমাদের সামনে উদ্ভিন্ন হবে, এ-ই আমরা চাই। জীবন বা শিল্পকে সুন্দর হতেই হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি– দেবতা বা রাজনৈতিক নেতা অথবা সুবিমল মিশ্র। 

‘কুড়া’তেও এই কুড়ান আমার অব্যাহত। যখন স্থির নির্ঝরিণীর মতো ছবির পর ছবি সৌন্দর্যচেতনার দখল নিচ্ছিল, তখনই হাওড়ের ঢেউয়ে ঢেউয়ে অভিঘাত জন্ম নিল। রূঢ়তার, বৈষম্যের। অবশ্যই জীবনের। মনে হয়েছে, এই বৈচিত্র, বৈপরীত্য বা কন্ট্রাস্টই ফিল্মটির কেন্দ্রীয় চরিত্র। এবার, কায়ুম সাহেবের কাছে কৃতজ্ঞ থাকব এইজন্য যে, অতি-গাঢ় কোনও আবেগ-উচ্চারণে এই অভিঘাতের পরিবেশন হয়নি। আবার একেবারে নিরাবেগ কবিত্বহীনও নয় তা। বরং, বেশ স্বাভাবিক তার চয়ন, চলন। এই ভারসাম্য বাঁচিয়ে চলা খুবই স্বস্তির। যদিও কঠিন। জীবন অনেক বড় বস্তু, বিষমও। সবার চেয়ে বড়। সুন্দর-অসুন্দর, সম্পূর্ণ-অসম্পূর্ণ, শরীর-মন সব নিয়েই তার রঙের বহু মাত্রা।  কিন্তু আমরা যখন একটি ছবি দেখতে বসেছি, তখন কিন্তু ভেতরে ভেতরে শিল্পই আমাদের চাহিদা। এ ক্ষেত্রে শিল্প যে জীবনের অসুন্দরকে সুন্দর করে দেখাতে চায়নি– বা কুৎসিত ক’রেও- এ বড় নিশ্চিন্দির কথা। গভীর শিল্পচিন্তার ফসল। বিশিষ্ট জীবনবোধেরও।

জীবনই উপজীব্য এখানে। এই অসুন্দর জীবনেও যে সঙ্গীত আছে, লোকাচার আছে, লোকমুখে শোনা কাহিনীর অধিবাসীদের মনে উপস্থিতি আছে, গরিবজনের সঙ্গতিপূর্ণ অনুচ্চকিত প্রেম আছে, মানুষের ঘিরে ঘিরে থাকা আছে, আকীর্ণ হাওড়ের মতোই সরল মানুষের সময়বিশেষের আবেগ প্রকাশ আছে। হাওড় গিলে খাচ্ছে জীবন, কিন্তু তার সঙ্গে বাসিন্দাদের এ কেমন খুনখুনে ঘুরঘুরে আশ্লেষ। আলিঙ্গন। আবার রুকু বলছে সেই কুড়া পাখির কথা, যার কোনও দুখ্যু নেই, যার জীবন সতত আরামের। এই তো পড়ে-যাওয়া মানুষের হাত ধরে কেউ যেন বলছে, ওঠো, আবার উঠে পড়ো। পাশাপাশি, পরিবেশের অনুচ্চার সাবধানবাণীও শুনতে পেলাম যেন। সব মিলিয়ে ব্যাপারটি মহাকাব্যিক। ও বহুমাত্রিক। প্রকাশ মাত্রার সংখ্যা এক বা দুই হলে শিল্পের অভিঘাত তত দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু কুড়া-র পাখনার ঢেউয়ের মাত্রা এত বেশি যে, ভালোমন্দের ওপর পৌঁছে মন কেমন যেন ছেয়ে মতো থাকে। আছে। দেখার আঠারো ঘন্টা পার হয়েও। থাকবেও বহু দিন।

ছায়াছবির রঙ, মনে হল, যাচাই ক’রে বাছাই করা। মাটো। বিষয়বস্তুর সঙ্গে মেজাজের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে। অভিনয় খুবই যথাযথ। কলাকুশলীদের নির্বাচন চমৎকার। শুধু রুকুকে শহরের মেয়ে বলে মনে হয়েছে সামান্য হলেও। তবে আমি ভুলও হতে পারি। ছেলে হারানো মায়ের কষ্ট, মরে যাওয়া ধান কোলে নিয়ে চাষীর কান্না, রুকুর সন্ধান করা মায়ের আর তার হবু বাবার মিলনের ছোট গল্প বোকা আমার চোখে জল এনে দিয়েছিল। 

আর একটা কথা। সুনামগঞ্জের হাওড়ের মানুষ কি এতই হতভাগা যে সরকারি কোনও স্বল্পমেয়াদি ব্যবস্থাও তাদের জোটেনি? জুটে থাকলে তার সুবিধে-অসুবিধের কথা বললে আর একটা মাত্রা যোগ হত, এই আর কি।

শেষে বলব কায়ুম সাহেবকে, এমন খ্যাপামি করে চলুন। দেখেছি, খ্যাপারা মরে না।