Wednesday 22 March 2023

প্রসঙ্গ ডিএ ও কর্মচারী আন্দোলন

এঁরাও কি 'আন্দোলনজীবী'?

সংযুক্তা মিত্র



বুদ্ধদেব বসু বলতেন, কবিতার মূল্যায়ন করতে হলে একটু সময়ের দূরত্ব দরকার। আজকের কবিতার ভাল মন্দ আজকে দাঁড়িয়ে করলে তাতে বিভ্রান্তির সম্ভাবনা। শুধু কবিতা নয়, আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে অনেক ইস্যুকেই একটু সময়ের স্রোতে খাবি খেতে দেওয়া উচিত বলেই মনে হয়। সেদিক থেকে রাজ্যের সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্য ডিএ-র ইস্যুটা নিয়ে আজ বেশি হইচই হলেও আসলে এটা বেশ অনেকটাই পুরনো প্রসঙ্গ। তাই এবার বোধহয় কিছু কথা বলা দরকার। কারণ, বিষয়টা নিয়ে জলঘোলা হচ্ছে প্রচুর আর তাতে চুনো মাছ শিকারেও অনেকে দিব্যি নেমে পড়েছেন। দেশের সর্বোচ্চ আদালতে এই নিয়ে শুনানি স্থির হয়ে আছে- তার পরে কর্মচারীদের কপালে তাঁদের প্রাপ্য জুটবে কি না সেও লাখ টাকার প্রশ্ন। তবু আশায় বাঁচে চাষা। 

কিন্তু মূল ব্যাপারটা কী? সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের মূল বেতনের সঙ্গে নির্দিষ্ট মহার্ঘ ভাতা পেয়ে থাকেন, আজ নয় দীর্ঘকাল ধরেই। প্রধানত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরে কালোবাজারি, মূল্যবৃদ্ধি এইসব সমস্যাগুলি দেখা দিতে থাকায় তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তার কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতার প্রচলন করে। তারপর থেকে স্বাধীন ভারতের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারীরা এই বিবেচনায় মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার অধিকারী হন। মনে রাখা দরকার, ১৯৩৫ সালে যে ‘ভারত শাসন আইন’ হয়েছিল (Government of India Act 1935), সেই আইনগুলিকে ভিত্তি করেই স্বাধীন ভারতে সরকারি ব্যবস্থা, তার কর্মচারীদের দায়-দায়িত্ব-সাংবিধানিক সীমাবদ্ধতা সবটাই তৈরি করা হয়েছিল। শুধু সরকারি দফতরের কর্মচারীরা নন, বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার কর্মীরাও মহার্ঘভাতা পান। পান বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিকরাও। আর এই মহার্ঘ ভাতা কী কতটা হবে, তা ঠিক হয় ‘সারা ভারত খুচরো মূল্য সূচক’ অনুযায়ী যা নির্ধারণ করে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রকের অধীন একটি স্বশাসিত সংস্থা। তারা সারা দেশের রাজ্যগুলি থেকে তথ্য সংগ্রহ করে মূল্য সূচকের কমা বাড়া ঠিক করে, তার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় সরকার ডিএ-র হার নির্ধারণ করে দেয় যা অনুসৃত হয় অন্যান্য রাজ্য সরকারগুলির কর্মচারীদের ক্ষেত্রে। একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় শাসন কাঠামোয় এইটাই নিয়ম। তাহলে সমস্যাটা কোথায়?

সমস্যাটা হল, এই রাজ্যের প্রশাসনের সর্বময় কর্তারা কর্মচারীদের  ডিএ পাওয়া নিয়ে তৈরি হয়ে ওঠা আন্দোলন ও পাবলিক ডোমেনে এসে পড়া বিতর্কটাকে নানাভাবে গুলিয়ে দিতে চাইছেন। রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান ইতিমধ্যেই ডিএ নিয়ে যে সব মন্তব্য করেছেন তাতে তাঁর এই বিষয়টি নিয়ে সীমাহীন অজ্ঞতাই প্রকাশ পেয়েছে, অথবা ধরে নিতে হবে তিনি যা বলেছেন তা তাঁর উচ্চপর্যায়ের আমলাদের শিখিয়ে দেওয়া কথা, যে আমলারা মূলত কেন্দ্রীয় ক্যাডারের আধিকারিক ও তাঁর সূত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত হারেই ডিএ পান, তাদের কোনও ডিএ বকেয়া নেই। রাজ্যের ডি-ফ্যাক্টো অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র কয়েক বছর আগে বলেই দিয়েছিলেন কর্মীদের ডিএ না দিয়ে তিনি ‘সাফল্যের সঙ্গে’ রাজ্যের কোষাগারের অর্থ সাশ্রয় করছেন। রাজ্যের সর্বশেষ বেতন কমিশনের প্রধান, কেন্দ্রীয় সরকারের ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইন্সটিটিউট-এর অর্থনীতির অধ্যাপক তাঁর রিপোর্টে কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে চাননি, যদিও তিনি নিজে কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া ‘মহার্ঘ ভাতা’ কোনওদিন ফেরত দিয়েছেন বলে আমরা শুনিনি। বিধানসভায় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, তিনি যেটুকু পেরেছেন ডিএ দিয়েছেন, এর বেশি পারবেন না। তাঁর বক্তব্যে এমনকি তিনি পেনশন প্রাপক ও সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টির জন্য বলতে চেয়েছেন, পেনশন দিতে হচ্ছে বলে তিনি ডিএ দিতে পারছেন না। এই রাজ্যেই একমাত্র নাকি পেনশন চালু আছে আর কোথাও নেই, এটা তারই প্রকাশিত বক্তব্য। তাঁর এইসব বিভ্রান্তিকর বক্তব্যে ‘অনুপ্রাণিত’ হয়ে তাঁর চ্যালা-চামুন্ডারা কেউ বলছেন, না পোষালে ছেড়ে দিন; কেউ নিদান হাঁকছেন, কেন্দ্রীয় হারে ডিএ চাইলে কেন্দ্রের চাকরি করুন; কেউ দাবি করছেন, এই রাজ্যে কাজ করলে কেন্দ্রের ডিএ চাওয়া চলবে না। মারমুখি ঔদ্ধত্য ও আকাট নির্বুদ্ধিতা জট পাকিয়ে গেলেই এইসব সুবচন নির্গত হয়। 

একটা কথা প্রথমেই বলতে হবে, হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ খুব স্পষ্ট ভাবে বলে দিয়েছে ডিএ পাওয়া কর্মীদের অধিকার। কারণ, কর্মচারীরা যে সরকারের কাজ করেন তাদের নীতি প্রণয়নে কর্মীদের কোনও ভূমিকা থাকে না। তাই সরকারি নীতি বা কোনও সরকারি সিদ্ধান্তের ফলে যদি মূল্যবৃদ্ধি হয়, তার ফলে কর্মীদের মূল বেতন ক্ষয় হয়, অর্থাৎ ওই পরিমাণ বেতনের বিনিময়ে তাঁরা তাদের জীবন চালানোর উপযোগী ব্যয় নির্বাহ করতে পারেন না। এই ক্ষয় রোধ করার জন্যই মহার্ঘ ভাতা। কে কতটা ‘ভালবেসে’ দেবে বা কতটা দিতে না পারলে তার ‘মুণ্ডচ্ছেদ’ করা হবে, এরকম কোনও অস্পষ্টতা এর ভিতরে আদৌ নেই। এর সঙ্গে বলে রাখা দরকার, ডিএ-র ‘কেন্দ্রীয় হার’ বলে কিছু পূর্ব নির্ধারিত বিষয় নেই। সর্বভারতীয় মূল্যবৃদ্ধির সূচকের রিপোর্টের ভিত্তিতেই ডিএ-র হার ঠিক হয়, এখানে কোনও সরকারের ভূমিকা নেই। কেন্দ্রীয় সরকার সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে ছ-মাস অন্তর ডিএ-র হিসেব ঠিক করে, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থায় এটা ঠিক হয় বছরে চারবার- এমনকি কোনও ত্রৈমাসিকে যদি দেখা যায় মূল্যবৃদ্ধি হয়নি বা মূল্যহ্রাস হয়েছে তার ভিত্তিতে কর্মীদের ডিএ বাড়ে না বা কমেও যায়। সবটাই একটা সুশৃঙ্খল পদ্ধতি, এর মধ্যে কোনও ব্যক্তির সাধ আর সাধ্যের অকুলানের মতো ছেঁদো বিষয় নেই। 

পেনশন আর ডিএ-কে লড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে কেন? সাংবিধানিকভাবে সরকারি চাকুরেরা পেনশন পান, কারণ, বলা হয় তাঁরা হচ্ছেন ‘পাবলিক সার্ভেন্ট’ অর্থাৎ ‘জনগণের সেবক’। তাই অবসরের পর সরকার তাদের জীবিকার জন্য একটা আনুপাতিক বেতন দিয়ে থাকে। সেনা বিভাগে যারা কাজ করেন, শারীরিক কারণে তাঁদের পঁয়ত্রিশ বছরে অবসর নিতে হয়, তাঁরাও এরপরে চাকরি বা ব্যবসার সুযোগ পান, পেনশন-ও পান। রাজ্যের বিধায়ক, সাংসদরা যেহেতু জনপ্রতিনিধি বলে বিবেচিত হন, তাঁরা একটা দফায় (পাঁচ বছর) বিধানসভায় বা সংসদে থাকলেই সারা জীবন পেনশন পান। সরকারি কর্মীদের পুরো পেনশন পেতে গেলে কুড়ি বছর চাকরি করতে হয়। সরকারি কর্মীদের পেনশন ব্যবস্থায় সংস্কার শুরু হয়েছিল প্রথম এনডিএ সরকারের আমলে (২০০১)— আর্থিক দায় এড়ানোর জন্য তখনই কেন্দ্রীয় সরকার ‘ন্যাশনাল পেনশন স্কিম’ নিয়ে আসে যাতে কর্মীদের যোগ দিতে বলা হয়। এতে সরকারের আর্থিক দায় এড়াতে কর্মীদের বেতনের একটা ভাগ আর সরকারের দেয় অংশের একটা ভাগ চাকরি জীবনের প্রথম থেকে সরিয়ে ওই পেনশন ফান্ডে বিনিয়োগ করা হয়। অবসরের পরে ওই ফান্ডের যা লাভ হয় তা-ই কর্মীরা পেনশন হিসেবে পান। তবে এই ফান্ড-নির্ভর ব্যবস্থা কর্মীদের কোনও সুনিশ্চিত পেনশনের আশ্বাস দেয় না। কারণ, ফান্ডের টাকা শেয়ার বাজারে লগ্নি করা হয়। সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। 

‘ন্যাশনাল পেনশন স্কিম’ যে সময়কালে চালু হয় তখন কেন্দ্রের শাসক জোটের শরিক ছিলেন এই রাজ্যের শাসক দল। লোকসভায় এই ব্যবস্থার তারা সরকারিভাবে বিরোধিতা করেছিল বলে জানা নেই। বাম দলগুলি এইভাবে সরকারি কর্মীদের কষ্টার্জিত অর্থ শেয়ারে বিনিয়োগের বিরোধিতা করেছিল এবং সেই সময় তাদের পরিচালনাধীন রাজ্য সরকারগুলি এই স্কিমে তাদের কর্মচারীদের নিয়ে আসেনি। পশ্চিমবাংলার কর্মচারীরা তাই পুরনো পেনশন স্কিমের আওতাতেই আছেন। রাজ্যে নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পরেও (২০১১) আগের সিদ্ধান্ত বাতিল করে নতুন পেনশন ব্যবস্থার কথা ভাবা হয়নি, তার দায় কর্মচারীদের নয়। আর এই রাজ্যের সরকারি কর্মীদের মতোই অন্য রাজ্যেও রাজ্যের অ্যাক্যাউন্টান্ট জেনারেল (এজি) সেই রাজ্যের সরকারি কর্মীদের পেনশন অনুমোদন করে। গুগল  সার্চ  করে খুঁজলেই যে কেউ দেখে নিতে পারেন এজি ওয়েস্টবেঙ্গল বা এজি বিহার বা মধ্যপ্রদেশ কীভাবে কর্মীদের তথ্য সংগ্রহ করছে, পেনশন অনুমোদন করছে। তাই, এই রাজ্যেই একমাত্র পেনশন চালু আছে, অন্য রাজ্যে নেই- এই বক্তব্য একটি ডাহা মিথ্যে কথা। 

কর্মচারীদের সংগঠিত আন্দোলনকে নানারকম বিভ্রান্তির দুর্বিপাকে জড়িয়ে দিতে আরও কিছু তথ্য বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছে যার উৎস বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না। তা হল, কেন্দ্রীয় সরকার অনেক প্রকল্পের অর্থ বকেয়া রাখার কারণেই নাকি ডিএ দেওয়া যাচ্ছে না। তাই কি? কেন্দ্রীয় সরকার যে সব প্রকল্পের টাকা আটকে রেখেছে বলে শোনা যায়, তা মূলত ‘আবাস যোজনা’ ও ‘একশো দিনের কাজ’এর- যদি সত্যিই অন্যায্য ভাবে এই বরাদ্দ আটকে রাখা হয় তা প্রতিবাদযোগ্য, কিন্তু এইসব প্রকল্পের বকেয়া অর্থ তো ওই চিহ্নিত প্রকল্পগুলিতেই খরচ করতে হবে! সেই অর্থ থেকে কি কর্মীদের ডিএ দেওয়া যায়? আর্থিক শৃঙ্খলার স্বার্থে কোনও সরকারই এই কাজ করতে পারে না, তারপরেও ওই বকেয়ার সঙ্গে ডিএ-র বকেয়াকে মিলিয়ে দিয়ে স্পষ্টত ভুল বোঝানো হচ্ছে মানুষকে। দ্বিতীয়ত, সরকার নানা জনকল্যাণমুখি কাজ করছে বলে নাকি কর্মীদের ডিএ মেটানো যাচ্ছে না। এটা আরেকটা পরিকল্পিত ভুল প্রচার। একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রে সরকার তার নাগরিকদের জন্য নানা জনমুখি প্রকল্প রূপায়ন করবে এটা তো সেই সরকারের সাংবিধানিক দায়বদ্ধতা। দেশের কেন্দ্রীয় সরকার থেকে নানা প্রদেশের সরকার সবাই নানা ধরনের জনমুখি কল্যাণ প্রকল্প চালায়। তার জন্য কি তাদের কর্মচারীদের প্রাপ্য মহার্ঘ ভাতা থেকে বঞ্চিত করতে হয়? তথ্য বলছে, সারা দেশে এই রাজ্যের সরকারি কর্মীরাই সব থেকে কম হারে মহার্ঘ ভাতা পান। অথচ সরকারি তথ্য অনুযায়ী এই রাজ্যে প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কর্মচারী পদ শূন্য। তাহলে ওই সংখ্যক কর্মীদের বেতন-ভাতা বাবদ আর্থিক দায় সরকারকে বহন করতে হচ্ছে না। একটা সরকার যখন তার অর্থ দফতরের মাধ্যমে বাজেট তৈরি করে তখন তার কতটা আর্থিক দায়, কতটা পরিকল্পিত ব্যয় এইসব হিসেব-নিকেশ করেই তা ঠিক করতে হয়। তাহলে কি ধরে নিতে হবে এই রাজ্যে ইচ্ছাকৃতভাবে মূল্যবৃদ্ধি-জনিত সম্ভাব্য মহার্ঘভাতা বাবদ ব্যয়কে সরিয়ে রেখেই বছরের পর বছর বাজেট করা হয়েছে? আর তাই মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার ব্যাপারটা ব্যক্তি-বিশেষের ‘মর্জি’ বা ‘ভালবাসার’ ওপরেই  মূলত দাঁড়িয়ে আছে? 

পূর্বতন বাম সরকারও যে নিয়মিত কেন্দ্রীয় হারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ডিএ দিতে পারত তা নয়, কিস্তি বাকি থাকত। কিন্তু একটা শৃঙ্খলার মধ্যে থেকে আবার সেগুলো মিটিয়েও দিয়েছে, অন্তত এই মহার্ঘ ভাতা দেওয়ার বিষয়টাকে ‘কর্মীদের উপহার’ বলে কখনও বিজ্ঞাপিত করেনি। বাম আমলে শেষ যে বেতন কমিশন হয়েছিল (রোপা ২০০৯) তার বকেয়া টাকা তিনটে কিস্তিতে সরকার মিটিয়ে দিয়েছিল। তখন বর্তমান রাজ্য সরকারের ‘কারাগার নিবাসী’ ভূতপূর্ব শিক্ষামন্ত্রী রাইটার্স বিল্ডিং'এর ক্যান্টিন হলে কর্মীদের সভায় বলেছিলেন তাঁরা সরকারে এলে সব বকেয়া একদিনে মিটিয়ে দেবেন। কিন্তু বর্তমান রাজ্য সরকারের আওতায় যে বেতন কমিশন হয়েছে (রোপা ২০১৬) সেখানে ২০১৬ থেকে প্রাপ্য বকেয়ার বিষয়টা সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হয়েছে। শাসক দলের কর্মী নেতারা বলে বেড়াচ্ছেন, সরকারি কর্মীরা ‘অনেক টাকা’ মাইনে পান, আবার বাড়তি চাইছেন কেন? বেশি বা কম একটা আপেক্ষিক ব্যাপার। কিন্তু এই প্রশ্নগুলোও তো তুলতে হবে, গত দশ বছরে বিধায়কদের বেতন ভাতা সহ অন্যান্য সুবিধে তিন তিনবার বাড়ানো হয়েছে কীসের ভিত্তিতে? সরকারি কোষাগারের ‘বেহাল’ অবস্থাই যদি হয় তাহলে মুখ্যমন্ত্রীর ব্যবহারের জন্য গত দু বছর ধরে কেন একটি চার্টার্ড বিমান ভাড়া করে রাখা হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে? কেন তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের বাজেট বরাদ্দের সিংহভাগ খরচ করা হচ্ছে শুধুমাত্র বিজ্ঞাপন ও প্রচারের কাজে? একটা সরকার নিজে যেভাবে ‘মিথ্যে গুজব’ ছড়িয়ে তার কর্মচারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে, এই উদাহরণ সাম্প্রতিক অতীতে বিরল। 

তবে এই ‘কদাচার’ মনে রেখেও দুয়েকটা দরকারি কথা বলা প্রয়োজন। সরকারি কর্মচারীরা পেশাগত দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামলেও আদপে তাঁরা সামাজিক মানুষ। একটা সরকার তাঁর যাবতীয় উন্নয়ন ও পরিষেবা দেন এঁদের উপরে ভিত্তি করেই। তাই, সমাজের অন্য অংশের মানুষের কাছে সরকারের মুখ ও জানালা এরাই। এই বিষয়টা খেয়াল রাখলে নিজেদের দাবি দাওয়ার সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগ গড়ে তোলা একটা বড় দায়, যাতে সাধারণ মানুষের কাছে এই বার্তা না যায় যে এই অংশটা একেবারেই নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থে আন্দোলন করছেন। এইটুকু করতে না পারলে তাঁদের আন্দোলনের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হওয়া সম্ভব নয় আর জনমনে তাঁদের আন্দোলন বিষয়ে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ ছড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে আরও বেশি। এই পরিস্থিতির লাভ তুলবে কিন্তু উচ্চতর প্রশাসন। এই পরিস্থিতির মধ্যেই তারা খুঁজে নেবে নিজেদের অপদার্থতার দায় ঝেড়ে ফেলার ওষুধ, তাতে কর্মচারীদের লাভ নেই। তাই নিজেদের দাবি দাওয়ার বৃহত্তর প্রেক্ষিত নিয়ে আরও বেশি বেশি করে মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা মনে হয় এবার আন্দোলনকারীদেরও ভেবে নিতে হবে।   

এখনও অবধি যা খবর পাওয়া যাচ্ছে, আন্দোলনরত শিক্ষক- সরকারি কর্মচারী- পেনশন প্রাপকরা তাঁদের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে মরিয়া। শুধু নিজেদের মহার্ঘ ভাতার দাবিই নয়, এর সঙ্গে তাঁরা জুড়ে নিয়েছেন অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের স্থায়ীকরণ বা দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ করে সরকারি পদপূরণের মতো দাবি- দ্বিতীয় ও তৃতীয় দাবির সঙ্গে সার্বিক মানুষের যোগ গড়ে তোলা সম্ভব। কিন্তু সংবেদনহীন সরকার এখনও পর্যন্ত কোনও কিছুতেই তাপ উত্তাপ দেখাচ্ছে না। আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছে, নয়াদিল্লির প্রান্তসীমায় বসে থাকা কৃষক আন্দোলনের কথা। এই রাজ্যের প্রতিবাদী সরকারি কর্মীদের কপালেও কি তাহলে এবার ‘আন্দোলনজীবী’ তকমা জুটবে?

 

3 comments:

  1. সরকারি কর্মচারী এবং সাধারণ মানুষ একই বাজার বা দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনেন। মূল্য বৃদ্ধি হলে উভয় পক্ষই ক্ষতিগ্রস্ত হন। আমার মনে হয়, প্রকৃত জনগণের সরকারের উচিৎ, DA র বদলে মূল্য বৃদ্ধির হার আটকানো। কিন্তু কেউই সেটা বলছে না। এটা করলে, সরকার প্রকৃত অর্থে জনগণের সরকার হবে। DA আন্দোলনকারীরা একবারও তাঁদের কথা ভাবছে না। এরা অত্যন্ত স্বার্থপর। এপয়েন্টমেন্টমেন্ট লেটার এ কোথাও DA দেওয়ার কথা লেখা থাকে না। কাজেই এটা অধিকার নয়, পরম্পরা।
    DA আন্দোলনকারীরা বলছে, আমাদের মতো লোক না কি সরকারি চাকরি না পেয়ে হতাশা থেকে এর বিরোধতা করছি।
    তবে জানিয়ে রাখি, ওরা ভাবতে পারবে না, আমি প্রথম জীবনে কর্পোরেট কোম্পানিতে চাকরি করার পরে, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য উভয় সরকারের চাকরি পেয়েছিলাম। দুটোরই বেতন পছন্দ হয়নি। আমি জানি, আমার বাজারদর অনেক বেশি। আর ফ And পেনশন হলো " Deferred wage ". আজ আমি যা গেস্ট ও IT দেই তা দিয়ে বেশ কয়েকজন class-I Gezzeted officer এর সারা বছরের বেতন হয়। আমাদের মতো লোকেরা সরকারের Asset. আর সরকারি কর্মচারী liability -- as per accounts term. তো এই, আমাদের মতো লোকগুলোকে কি কেউ স্বীকৃতি দেওয়ার কথা ভাবেন? Even the আন্দোলন কারীরা ? এরা আসলে সিপিম - যারা পাতি মধ্যবিত্ব, মধ্যমেধা সম্পন্ন লোক ( মার্ক্স্ সাহেবের ভাষায় বললাম )। মূল্যবৃদ্ধির জন্য তো মূল দায়ী কেন্দ্রীয় সরকার। তাঁদের নামে তো এরা কিছুই বলেন না। বামে ফুটকি মেরে এরা আসলে রাম হয়েছে।।

    ReplyDelete
    Replies
    1. কৌশিক হালদার23 March 2023 at 04:43

      🙏🏼
      গা দিয়ে ক্ষমতার আঁশটে গন্ধ বের হচ্ছে । যারা DA র জন্যে আন্দোলন করছেন তারা সকলেই সিপিএম-- এরকম গর্ধবের মত কথা দাম্ভিক মানুষেরই মুখে শোভা পায় ; যদিও গর্ধব দাম্ভিক নয় বলেই মনেহয় । যাইহোক, মুখমণ্ডলে ফুলচন্দন পরুক। 😁

      Delete
  2. কৌশিক হালদার23 March 2023 at 04:49

    একটি খুবই ভালো ও বিস্তারিত লেখা । ধন্যবাদ লেখককে । 👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼💗🌹😊

    ReplyDelete