Saturday 29 April 2023

'আমাদের মন কি বাতও শুনুন'

ক্রীড়া জগৎ'ও পথে

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত



মন কি বাত! ১০০ দফা পার। 

আমার মায়ের খুব পছন্দ ছিল এই কথাটি: 'একবার না পারিলে, দেখো শতবার'। মনে হচ্ছে, মোদিজীরও বুঝি খুব পছন্দ কথাটা। পছন্দ হবারই কথা, তবে সংশয় একটা থাকছেই- বারবার বলেও মানুষকে বোঝানো যাচ্ছে না যে দেশটা হিন্দুদের। আর, 'হিন্দু দেশ' বানানোর কাজে সংঘকে পাশে রাখার গুরুত্বও যেন লোকে বুঝছে না। এর জন্য ব্রিজভূষণদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা সহ একাধিক অভিযোগ  থাকলেও তা উপেক্ষা  করতে হয়।

দিনের পর দিন কুস্তিগিররা পথে বসে আছেন। বিনেশ ফোগট, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া প্রমুখ কুস্তিগির যারা আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পদক জিতে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন, গত ২৩ এপ্রিল থেকে টানা সাতদিনেরও বেশি দিল্লির যন্তর-মন্তরে বসে আছেন জাতীয় কুস্তিগির ফেডারেশন'এর সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণের অপসারণ ও শাস্তির দাবিতে। বিনেশ ফোগট জানিয়েছেন, মোদিজী নিজের 'মন কি বাত' বলতে যতটা উৎসাহী, ঠিক ততটাই নিরুৎসাহী অন্যের মন কি বাত শুনতে। এমনকি, কুস্তিগিরদের তরফে ব্রিজভূষণের বিরুদ্ধে কোনও লিখিত অভিযোগও দিল্লি পুলিশ গ্রহণ করতে নারাজ। অবশেষে বিনেশ, সাক্ষীদের তরফে সুপ্রিম কোর্টে দ্বারস্থ হয়ে তবে দিল্লি পুলিশকে এই এফআইআর গ্রহণ করতে বাধ্য করা গেছে। 

প্রশ্ন হল, কে এই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্রিজভূষণ, যার বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করতে স্বয়ং মোদিজীও ভয় পাচ্ছেন? ইনি হলেন জাতীয় কুস্তিগির ফেডারেশন'এর সভাপতি ও উত্তরপ্রদেশ থেকে নির্বাচিত সেই বিজেপি বাহুবলী সাংসদ, যার বিরুদ্ধে গত তিন দশকেরও বেশি সময় জুড়ে অসংখ্য অভিযোগ ও মামলা দেশের বিভিন্ন থানা ও আদালতে ঝুলে রয়েছে। খুন-খারাপি, ডাকাতি, যৌন হেনস্থা, অপহরণ সহ নানান মামলায় সে ইতিমধ্যেই খ্যাতি অর্জন করেছে। এছাড়াও, কুস্তিগির ফেডারেশনের সর্বোচ্চ পদ অধিকার করে কুস্তিগিরদের যৌন হেনস্থা ও নানান অপকর্মে সে ইতিমধ্যেই আরও হাত পাকিয়েছে। উপরন্তু, তার মাথার ওপর রয়েছে আরএসএস'এর কঠিন আশীর্বাদ। এ হেন ব্যক্তিদের নিয়েই তো বিজেপি-আরএসএস'এর ভারত জয়ের যাত্রা। তাই, তার বিরুদ্ধে যে কোনও অভিযোগেরই কোনও সারবত্তা থাকতে নেই।

কুস্তিগিরদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন নীরজ চোপড়া, কপিল দেব, বীরেন্দ্র সাহবাগ, সানিয়া মির্জা'দের মতো ক্রীড়াবিদরাও। আশার কথা যে, ক্রীড়া জগতের কতিপয় বিখ্যাত তারকাদের বাদ দিলে, অন্য বহু ক্রীড়াবিদরা আজ পথে নেমে বা মতামত জ্ঞাপন করে কুস্তিগিরদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। মুশকিল হচ্ছে, ক্রীড়া সংস্থার মাথায় বসানো হচ্ছে এমন সমস্ত রাজনৈতিক বাহুবলীদের, যাদের খেলাধুলোর থেকে অন্য বিষয়ে আগ্রহ বেশি। এদিকে খেলোয়ারেরা সংস্থার দিক থেকে তেমন কোনও সাহায্য ব্যতিরেকেই দিনাতিপাত করছেন উৎকর্ষে পৌঁছনোর জন্য। তাঁরা তাকিয়ে থাকেন সরকারি বদান্যতার দিকে- কবে আসবে সরকারি সাহায্য? কোন খেলায় কে হবেন কর্তা, তা ঠিক হয় সরকারি সাহায্য আনায় কার কার্যকারিতা কতখানি তার ওপর। তবে রাজনীতির লোকেদের শীর্ষ আসনে বসালে সাফল্য পাওয়া যে অসম্ভব, আমরাও নাকি তা বুঝতে শুরু করেছি ইদানীং। কিন্তু এখানেও কেমন খেলা দেখুন! পি টি ঊষা ভারতীয় অলিম্পিক সংস্থার প্রধানা হলেন। রাজ্যসভার মনোনীত সদস্যা হলেন। আরও পাবেন নিশ্চয়। এমন আশা নিয়েই তো তিনি মহিলা কুস্তিগিরদের পাশে না থেকে সমর্থন দিতে এগোলেন ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ব্রিজভূষণের দিকে, পকসো আইন কী বলছে তা উপেক্ষা করেই।

একটা সময় ছিল যখন খেলাধুলো ছিল নেহাত মনোরঞ্জনের এক পন্থা।  আজ আর তা নেই। এখন নানা  গল্পগাছা ছাপিয়ে তা হয়ে উঠেছে প্রকৃত অর্থেই প্রতিযোগিতামূলক খেলা। সুনামের পাশাপাশি অনেক অর্থও আছে কোনও কোনও খেলায়। কিন্তু অতি প্রাচীন ও অবশ্যই জনপ্রিয় কুস্তিতে তেমন অর্থ নেই। তবু নাম তো আছে, অন্তত এই উপমহাদেশে। সেই নামের লোভেই হয়তো ক্ষমতাসীন দলের সাংসদ ব্রিজভূষণ আঁকড়ে রয়েছে কুস্তিগিরদের প্রধান সাংগঠনিক পদ। তাছাড়াও সংঘ রয়েছে পাশে। তারও  গুরুত্ব আছে অনুরাগ ঠাকুর থেকে মোদি বা অন্য সকলের কাছে। তাই তো কথা দিয়েও ব্যবস্থা নিতে কুন্ঠিত তাঁরা। দিল্লীর পুলিশ এফআইআর নিতেও ভয় পায়। সুপ্রিম কোর্টে দাঁড়িয়ে সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে এফআইআর নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিতে হয়।

শীর্ষ আদালতের নির্দেশে দিল্লি পুলিশ অবশেষে এফআইআর দায়ের করলেও এখনও এই লড়াই শেষ হয়নি বলে বিনেশ ফোগট ও অন্যান্য কুস্তিগিররা জানিয়েছেন। তাঁরা যন্তর-মন্তর'এর ধর্না থেকে উঠবেন না যতক্ষণ না পর্যন্ত ব্রিজভূষণ গ্রেফতার হচ্ছে। আজ দেশ জুড়ে রাজনৈতিক বাহুবলীদের বিরুদ্ধে যে লড়াই, সেখানে কুস্তিগির ও অন্যান্য ক্রীড়াবিদরা সর্বতোভাবে সামিল হয়ে এক ভয়ঙ্কর বাহুবলীকে অনেকটা পরাভূত করতে পারবেন বলে যে বিশ্বাসটা গড়ে উঠছে, সেটাও কম কথা নয়।


Monday 24 April 2023

বিস্মৃতির গহ্বর থেকে

চীনে ভারতের মেডিক্যাল মিশনকে কেই বা মনে রাখল? 

প্রদ্যুম্ন বন্দ্যোপাধ্যায়

বাঁদিক দিক থেকে: ডাঃ বিজয় কুমার বসু, ডাঃ এম আর চোলকার, ডাঃ মদন মোহনলাল অটল, ডাঃ দেবাশিস মুখার্জি ও ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিস


আজীবন পুঁথি চর্চাকারী সংস্কৃত পণ্ডিত চিন্তাহরণ চক্রবর্তী একবার ‘Indoctrination'এর বাংলা করেছিলেন ‘কর্নেজপন’। এই পরিভাষা চালু করার সপক্ষে তিনি জোরদার সওয়াল করলেও তা হালে পানি পায়নি। তবে সুভাষচন্দ্রের জন্মদিনকে ‘জাতীয় পরাক্রম’ দিবস ঘোষণা আর এই অমোঘ উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের সমস্ত তল্লাট জুড়ে একশো মিডিয়ায় ওৎ পেতে থাকা কাঙসকন্ঠি ভাষণবিদদের এই নিয়ে কানের কাছে অবিরাম নামতা পাঠ হারিয়ে যাওয়া, সেই শব্দবন্ধের মোক্ষম উদাহরণ। 

রাষ্ট্রীয় পরাক্রমের জমাট প্রকাশ আমরা লক্ষ‍ করছি বেশ কয়েক বছর। জালিয়ানওয়ালাবাগ অথবা  সবরমতি আশ্রমের সেই গভীর নির্জন স্মৃতি-উদ্রেককারী পরিবেশের উৎপাটন ঘটেছে সশব্দে। সৈনিকের কড়া পোশাক পরিহিত সুভাষচন্দ্রের মূর্তি এই কর্মসূচিরই প্রকাশ। দেশ জুড়ে দৃশ্য-তাণ্ডবের এই আয়োজন জল, জমি, জঙ্গলের মতো স্মৃতিরও উচ্ছেদ ঘটিয়েই চলে নিঃশব্দে। এই বিপুল প্রচার কাণ্ডের ব‍্যূহচক্রের মধ‍্যে ধ্বস্ত হতে হতে পুরোপুরি নিঃস্ব হবার আগে সুভাষচন্দ্র আর তাঁর সময়ের কিছু  স্মৃতি ফেরানো বোধহয় জরুরি, বিশেষ করে চূড়ান্ত 'দুর্ভাবনাময় জটিল সাম্প্রতিক' এই সময়ে।দোর্দন্ডপ্রতাপ রাষ্ট্রের সুভাষচন্দ্র আর অন‍্যান‍্য নির্মাণের আড়ালে চলে যায় আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ে ওঠার সেই আশ্চর্য আখ্যান। উপমহাদেশের নানা প্রান্ত থেকে রঙ্গিবিরঙ্গি মানুষজনের স্বাদেশিকতার টানে ফৌজে সামিল হওয়া, স্বেচ্ছায় চূড়ান্ত অনিশ্চিত অজানা পথ বেছে নেওয়া- ঐতিহাসিক মুকুল কেশভনের কথা ধার করে বলা যায়, আজাদ হিন্দ ফৌজ যেন বাইবেল কথিত নোয়ার আর্ক, যেখানে সমস্ত ভারতীয় ধর্মগোষ্ঠী আর ভাষাভাষি মানুষজনের ঠাঁই মেলে অবাধে।

ভারতীয় রাষ্ট্র নির্মাণের মনমতো পরাক্রমী সুভাষচন্দ্রকে তুলে ধরার সশব্দ অভিসন্ধির সযত্ন আড়ালে চলে যায় জাপানি আক্রমণে বিধ্ব‍স্ত চীনে সুভাষচন্দ্র এবং নেহেরুর উদ‍্যোগে মেডিক্যাল মিশন পাঠানোর স্নিগ্ধ অনুপম স্মৃতি। সরকারে বিমুগ্ধ অগুন্তি প্রচারযন্ত্রের ‘অন্তবিহীন ফ‍্যাক্টরি ক্রেনের’ কর্নেজপন, ধ্বংসকারী জেসিবি যন্ত্রেরই কথ‍্যরূপ। সরকারি প্রচারযন্ত্রের ঘনীভূত রূপ জেসিবি'র উপকারিতা যোগী রাজ‍্যে বারবার প্রমাণিত।

ঘটনাটি দীর্ঘদিন ধরে চলা বিশ শতকের তিরিশের দশকের। জাপানি আক্রমণে বিধ্বস্ত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা চু' তে নেহেরুকে চিঠি লিখে অনুরোধ করেন ভারতীয় চিকিৎসক দল পাঠাতে।প্রায় এক দশক জুড়ে লাগাতার জাপানি আক্রমণে বিপর্যস্ত চীনে রণাঙ্গনে আহত মৃত‍্যুপথযাত্রী সৈনিকদের চিকিৎসায় সহায়তা করার জন‍্য এই অনুরোধ চীনা নেতৃবৃন্দ করেন। এই আবেদনে সাড়া দিয়ে তৎকালীন কংগ্রেস সভাপতি সুভাষচন্দ্র এবং নেহেরু সহ অন‍্যান‍্য নেতৃবৃন্দ সারা দেশ জুড়ে চীনের সাহায‍্যার্থে জনমত গড়ে তোলেন। হরিপুরা অধিবেশনে (১৯৩৮) এই মর্মে প্রস্তাবও নেওয়া হয়। পাঁচজন ভারতীয় ডাক্তার চীনের রণাঙ্গনে যাবার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দেশের নানা প্রান্ত থেকে সাড়া দেওয়া ডাক্তারদের মধ‍্যে ছিলেন ডাঃ মদন মোহনলাল অটল, মোরেশ্বর রামচন্দ্র চোলকার, দ্বারকানাথ কোটনিস, বিজয় কুমার বসু ও দেবেশ চন্দ্র মুখার্জী। ১৯৩৮ সালের সেপ্টেম্বরে বোম্বাই থেকে তাঁরা চীনের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। বিদায়কালে সেখানে হাজির ছিলেন কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। কলকাতায় উপস্থিত ছিলেন সুভাষচন্দ্র।

চীনে জাপানের ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে উপমহাদেশে জনমত গড়ে ওঠে। কংগ্রেস অধিবেশনে জাপানি পণ্য বর্জনের দাবি ওঠে। অথচ এর কিছুদিন আগে পর্যন্ত জাপানের উত্থান নিয়ে উপমহাদেশে ছিল তুমুল উদ্দীপনা। পশ্চিমী আধিপত্যের বিরুদ্ধে এশিয় দেশ জাপানের জাগরণ গোটা মহাদেশের কাছে স্বাধীনতার বার্তা নিয়ে আসে। সুভাষচন্দ্রের কাছেও আদর্শ আবাস ভূমি জাপান। তাঁর কাছে জাপানের জাগরণ পশ্চিমী সাম্রাজ‍্যবাদী শক্তিগুলির অনন্ত অপরাজেয়তায় একটা ছেদ। কিন্তু দূরপ্রাচ‍্যে ইউরোপীয়দের অপসারণে জাপানের ভূমিকার পেছনে সাম্রাজ্যবাদী অভিসন্ধিও সক্রিয় ছিল। প্রাচীন সভ‍্যতার চারণভূমি চীনকে তাঁবে আনাই ছিল জাপানি সমরনায়কদের উদ্দেশ্য। ১৯৩৭'এর অক্টোবরে 'মডার্ন রিভিউ' পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখায় সুভাষচন্দ্র এশিয়বাসীর জাগরণে জাপানের ভূমিকাকে স্বীকার করলেও, তিনি দ্বিধাহীন যে তাঁর হৃদয় কিন্তু জাপানি আক্রমণে পর্যুদস্ত চীনা মানুষজনের সঙ্গেই একান্তভাবে রয়েছে। চীনে জাপানের ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে ভারতীয়দের তৎকালীন মনোভাব ধরা পড়ে সরলাদেবী চৌধুরাণীর অনুপম স্মৃতিচারণ ‘জীবনের ঝরাপাতা’ বই'য়ে। সুভাষ মুখোপাধ‍্যায় লেখেন 'চীন -উনিশশো আটত্রিস' কবিতা। সুভাষচন্দ্র আর তাঁর সতীর্থরা কল্পভূমি জাপানের সাম্রাজ্যবাদী কীর্তিকলাপের সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হন না। ভারতীয় ডাক্তারদের তাঁরা পাঠান সুদূর চীন দেশের রণক্ষেত্রে আহত চীনাদের সেবাশুশ্রূষার জন্যে। এই ভূমিকা বাম মতাদর্শী দলগুলির কাছে শিক্ষণীয় আজও।

ভারতীয় মেডিক্যাল মিশনের সদস্যরা প্রথমে উহান শহরে যান (সেই উহান)। সেখান থেকে তাঁদের পাঠানো হয় ইয়েনানে, যে ইয়েনান ছিল চীন বিপ্লবের কেন্দ্র। রণক্ষেত্রে ভারতীয় চিকিৎসকরা গড়ে তোলেন চলমান চিকিৎসা কেন্দ্র। চিকিৎসার সরঞ্জাম, ওষুধপত্রের অপ্রতুলতা সত্ত্বেও তাঁদের অদম্য মনোভাব কিন্তু ভেঙে পড়েনি বা রণক্ষেত্র থেকে তাঁরা পালিয়েও আসেননি।

তারপর একদিন তো যুদ্ধ শেষ হল। ভারতীয় চিকিৎসকদের এবার দেশে ফেরার পালা। সবাই ফিরলেও ডাঃ কোটনিস কিন্তু তাঁর পূর্বসূরি ডাঃ নর্মান বেথুনের নামাঙ্কিত 'ইন্টারন‍্যাশন‍্যাল পিস হাসপাতাল'এ অধ‍্যক্ষের দায়িত্ব নিয়ে সেখানেই রয়ে গেলেন। চীনা সহকর্মীকে বিয়েও করেন। মারা যান বত্রিশ বছর বয়সে। রণক্ষেত্রে দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধের পাশাপাশি কোটনিস এবং তাঁর সহকর্মীরা একই কায়দায় চিকিৎসা চালু রাখেন। যুদ্ধবিধ্বস্ত গ্রামগুলিতে স্থানীয় মানুষজন ধ্বংসস্তুপের মধ্যেও গড়ে তুলতেন চিকিৎসাকেন্দ্র। অনবরত এই কেন্দ্রগুলিকে গড়তে হত, কারণ, খুব বেশিদিন এগুলি স্থায়ী হতে পারত না। কোটনিসের সেবাপরায়ণতায় অভিভূত আহত সৈনিকরা তাঁর নামকরণ করেন ’ব্ল‍্যাক মাদার’। ভারতে সাম্প্রতিক বাম আন্দোলনে সুদূর কিউবার গণচিকিৎসায় সাফল্য, বিশেষ করে আর্জেন্টিনার চিকিৎসক বিপ্লবী চে গেভারা আজ যতখানি জায়গা নেয় সেখানে কোটনিস বা তাঁর সহকর্মীদের ঠাঁই মেলে না। অথচ কোটনিসের মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যেই কিন্তু তাঁর জীবন নিয়ে ভি শান্তারাম সিনেমা তৈরি করবেন। তাহলে কি মেডিক্যাল মিশনের সদস‍্যরা চে বা নর্মান বেথুনের মতো যথেষ্ট আন্তর্জাতিকতাবাদী হতে পারলেন না। গেঁয়ো যোগী, তাই বোধহয় তাঁদের 'আন্তর্জাতিকতাবাদ কম পড়িতেছে' বলে মনে হল। অথচ মিশনের নেতা ডাঃ অটল স্পেনের গৃহযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, সেখানকার অভিজ্ঞতা দেশে প্রচার করেন। স্পেন থেকে ফিরেই তিনি চীনের রণাঙ্গনে যেতে প্রস্তুত হন। তিনি জানতেন যে চীনের লড়াই স্পেনের তুলনায় অনেক বেশি কঠিন। কারণ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ ছিল মূলত ট্রেঞ্চের লড়াই। অন‍্যদিকে চীনা রণাঙ্গন ছিল সচল আর দীর্ঘস্থায়ী। নাগপুরবাসী ডাঃ চোলকার ছিলেন আদ‍্যন্ত গান্ধীর অনুগামী আর সদস্যদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ। তাঁর বয়স তখন  আটান্ন ছুঁয়েছে। প্রায় বাণপ্রস্থে যাবার বদলে বাকী চিকিৎসকদের সঙ্গে তিনি চীনে যান। সমানতালে চিকিৎসাও চালান।

স্বাধীনতার আগে এবং পরে নানা উচ্চকিত কোলাহলে এই কজন আশ্চর্য মানুষজনের ততোধিক আশ্চর্য ভূমিকা চলে গেছে বিস্মৃতির গহ্বরে। স্মৃতির উচ্ছেদ ঘটেছে। সুভাষচন্দ্র ও তাঁর সতীর্থদের এই উদ্যোগ এবং মিশনের চিকিৎসকদের বিরল, ব‍্যতিক্রমী কর্মকাণ্ড কিন্তু উপমহাদেশের জনস্মৃতির অঙ্গ হয়নি। জাতীয় আন্দোলনের নানা ছন্দের মধ্যে অন‍্যতম বিরল এই ছন্দের উত্থান ঘটানো ছিল জরুরি। জাতীয় গণ আন্দোলন আর কিংবদন্তি হয়ে ওঠা গণনায়কদের নিয়ে উদ্দীপনা কিন্তু আজও সাদামাটা লোকায়ত জীবনের বৈশিষ্ট্য। কেতাবী ভাষায় ‘ন‍্যাশনাল পপুলার'। মূলধারার বাম রাজনীতির নাগালের বাইরেই রয়ে গেল জনজীবনে বয়ে চলা এই তরঙ্গগুলি। গণপ্রতিরোধের গভীরতর সম্ভাবনা কিন্তু এখানেই রয়ে গেছে আজও। 

জাপানি  আক্রমণে বিধ্বস্ত চীনে ভারতীয় চিকিৎসকরা মানববেদনাকে অনুভব করতেন নির্জনে। বিপন্ন মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁরা বিষণ্ণ হন। আর্তের সেবায় ব‍্যস্ত কোটনিস পিতার মৃত্যুসংবাদ পেলেও স্বদেশে ফিরতে পারেন না। করুণা যে কোন পথ দিয়ে তাঁদের হৃদয়ে ছায়া ফেলে তা বোঝা দুষ্কর।

এসবই এখন অলীক। মানুষজনের হৃদয় এখন কঠিন থেকে কঠিনতর। কর্পোরেট বাহিত চিকিৎসার সুযোগ এখন অনির্বচনীয় কিছু উঁচু লোকের হাতে, সকলের জন্য নয়। গরিবগুর্বো মানুষজন হেমন্তের পাতার মতো ভেসে যেতে যেতে এখনও ভরসা খোঁজেন এখানে ওখানে মানববেদনাকে অনুভব করা বিষন্ন কিছু  চিকিৎসকের মধ্যে। এই আকালেও তাঁরা চেষ্টা চালিয়ে যান মানুষের ভেসে যাওয়া আটকাতে। এঁদেরই দেখা মেলে দেশের নানা প্রান্তে ঘটে চলা ঘোষিত, অঘোষিত রণক্ষেত্রে। ভোপালে গ‍্যাসপীড়িতদের পাশে অচিরে হাজির হন দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা ডাক্তাররা। নন্দীগ্রামে আক্রান্ত মানুষজনের পাশেও হাজির তাঁরা। ভারতের গহনতম প্রান্তে নিঃস্ব মানুষজনের চিকিৎসা বজায় রাখেন বিনায়ক সেন ও তাঁর সহযোগীরা। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকারও হন তাঁরা। সাধারণ মানুষজনের জন‍্য চিকিৎসাকে সহজলভ্য করতে নিঃশব্দে গড়ে ওঠে 'শ্রমজীবী হাসপাতাল'। 

এই তো ক' মাস আগে প্রয়াত হলেন বালি উত্তরপাড়ার পাঁচ টাকা দক্ষিণা নেওয়া চিকিৎসক শ‍্যামল চট্টোপাধ্যায়। কালনা শহরের ডাক্তার গৌরাঙ্গ গোস্বামীও সদ‍্য চলে গেলেন চিরকালের মতো। তাঁরও ভিজিট ছিল পাঁচ টাকা। এঁদের মতো ভিন্ন গ্রহের অধিবাসীরা দেশের নানা প্রান্তে রয়ে গেছেন আজও। আসলে, সুভাষচন্দ্র, তাঁর সহযোগীরা আর মেডিক্যাল মিশনের সদস্যদের উত্তরাধিকার থেকে যায় কোনও কোনও মানবের হাতে।


Saturday 15 April 2023

বঙ্গাব্দের ইতিহাস-যাত্রা

জ্ঞানে পাপে অস্পষ্ট অর্ধসত্যে

মালবিকা মিত্র



'জলের উপর পানি না পানির উপর জল

বল খোদা বল খোদা বল খোদা বল।'

এই উতর চাপানে আমার আগ্রহ নেই। এতে গায়ের ঝাল মেটানো যায় বটে কিন্তু কোনও সত্য প্রতিষ্ঠা হয় না। আলোচনা শেষে পাঠক শ্রোতার মাথা ঝিমঝিম, 'সবই তো শুনলাম গোপাল দা, বোঝলাম না ব্যাপারডা কী খাড়াইলো।' একজন স্কুল ছাত্রও সহজ পাটিগণিতের নিয়মে বুঝতে পারে, ২০২৩ খৃষ্টাব্দে যদি ১৪৩০ বঙ্গাব্দ হয় তাহলে (২০২৩-১৪৩০=৫৯৩) ৫৯৩ খৃষ্টাব্দ থেকে বঙ্গাব্দ গণনা শুরু। প্রশ্ন হল, কেন ৫৯৩ অব্দ? 

ধরে নেওয়া হয়, গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক, কনৌজ উজ্জয়িনী অধিপতিদের আধিপত্য অস্বীকার করে বঙ্গের স্বাধীনতা ঘোষণা করছেন। তারই স্মারক হিসেবে এই নতুন অব্দ বঙ্গাব্দ। যুক্তি নির্ভুল। কিন্তু শশাঙ্কের সিংহাসনে আরোহণ কাল স্পষ্ট নয়। অনেক তথ্যে বলা হচ্ছে ৬০৬ খৃষ্টাব্দ, ৫৯৩ নয়। তাহলে তো শশাঙ্কের সিংহাসনে আরোহণ করার সাথে বঙ্গাব্দ সম্পর্কিত হয় না। থাক সেই উতোর চাপান। ধরেই নিলাম, মাত্র ১২/১৩ বছরের ব্যবধান উপেক্ষণীয়। দুটি ঘটনাই প্রাচীন ইতিহাসের হাজার হাজার বছরের নিরিখে সমসাময়িক। নীহাররঞ্জন রায় তাঁর 'বাঙালীর ইতিহাস' গ্রন্থেও বলেছেন, 'এ তথ্য নিঃসংশয় যে, ৬০৬-০৭ খৃষ্টাব্দের আগে কোনো সময়ে শশাঙ্ক গৌড়ের স্বাধীন নরপতি রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।' বেশ তো, শশাঙ্ক একজন হিন্দু রাজা, তাঁর প্রবর্তিত বঙ্গাব্দ নাকি 'আকবরের নামে গায়েব করে দিচ্ছিল মুসলমান তোষামোদকারীর দল'। আরএসএস বলবে, মন্দির প্রতিষ্ঠার মতো এটাও একটা ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। তাহলে বলি, রাজা শশাঙ্ক যতটা না হিন্দু তার ঢের বেশি গোঁড়া হিন্দু ছিলেন সেন রাজারা। লক্ষ্মণ সেনের পুত্র মধু সেনের সময়ের একটি হস্তলিখিত প্রাচীন সংস্কৃত গ্রন্থে উল্লেখ আছে, 'পরম ভট্টারক মহারাজাধিরাজ পরম সৌগত 'মধুসেন' ১১৯৪ শকাব্দে বিক্রমপুরে আধিপত্য করতেন।' বেঙ্গল গভর্নমেন্ট কর্তৃক সংগৃহীত এই গ্রন্থ। অর্থাৎ, সেন রাজারা নিজেরাই বঙ্গাব্দ গণনা করতেন না। পাল রাজারাও করতেন না। শকাব্দ-ই বেশি প্রচলন ছিল। আজকের গোঁড়া হিন্দু কোটি টাকার স্যুট পরেন, চার্টার্ড প্লেনে ওড়েন, হাট বাজার চিকিৎসার জন্য বিদেশ সফর করেন। তাঁরা স্বভাবতই রাজার চেয়েও রাজকীয়। তাই, শশাঙ্কের স্বীকৃতি নিয়ে চিন্তিত। 

ভেবে দেখুন, প্রাচীন ও মধ্য যুগের বেশ কিছু খোদাইয়ে 'বিক্রম সম্বৎ'এর উল্লেখ আছে। কিংবদন্তির মহান হিন্দু সম্রাট বিক্রমাদিত্য শকদের পরাজিত করে ৫৭ খৃষ্ট পূর্বাব্দে এই অব্দ চালু করেন। ‘Samvat’ is a Sanskrit term for ‘year’. Emperor Vikramaditya of Ujjain started Vikram Samvat in 57 BC and it is believed that this calendar follows his victory over the Saka in 56 BC.। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আল বেরুনী উল্লেখ করেন, বিক্রমাব্দ ও শকাব্দের মধ্যে পার্থক্য ১৩৫ বছর। শকাব্দের যাত্রা শুরু পরে। তথাপি গুজরাট, পঞ্জাব, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র, দাক্ষিণাত্য, দিল্লি, তামিলনাড়ু ও বাংলায় শকাব্দ গণনা হত। এমনকি বখতিয়ার খলজী যখন বাংলা আক্রমণ করেন তখনও এখানে শকাব্দ বর্ষপঞ্জীর অনুসরণ করা হত। সুলতানরা পরে হিজরী অব্দও অনুসরণ করতেন। এটা নিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা নীরব কেন? কারণ, সম্রাট বিক্রমাদিত্য রাজত্ব করতেন উজ্জয়িনীতে। ওটা উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের ঘাঁটি। বাংলায় তারা দুর্বল। অতএব, বাংলায় জিগির তোলার ইস্যু চাই। বঙ্গাব্দ সেই ইস্যু। 

এই সত্য গোপন করা যাবে না যে বঙ্গাব্দ ছিল একটি কার্যত অব্যবহৃত লুপ্ত অব্দ। পাল সেন রাজারা কেউ ব্যবহার করতেন না। আকবর তাঁর ক্ষমতা লাভের ২৮তম বর্ষে প্রশাসনিক কাজে বঙ্গাব্দ ফিরিয়ে আনলেন। মানে, আরএসএস নেতারা আজ যা নিয়ে হইচই করতে চাইছেন, সেটা অনেক বেশি দায়িত্ব সহকারে আকবর করেছিলেন। আকবর ঠিক কী করেছিলেন বঙ্গাব্দ নিয়ে? 

সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণ কাল ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দ। চার বছর ছিল বৈরাম খাঁর তত্ত্বাবধানে শাসন। ১৫৬০ থেকে পাকাপোক্তভাবে সম্রাটের নিজের শাসন শুরু হয়। সে ক্ষেত্রে ২০২৩'এ দাঁড়ায় ৪৬৭ বা ৪৬৩ বঙ্গাব্দ। কেন ক্ষমতা লাভের ২৮ বছর পর আকবর নতুন অব্দ চালু করার কথা ভাবলেন? আকবর বহির্প্রভাব মুক্ত প্রকৃত সার্বভৌম জাতীয় রাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতেন। যে রাজতন্ত্র কোরান বেদ বাইবেল জেন্দাবেস্তার নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হবে। সে কারণেই ইবাদৎখানায় সুদীর্ঘ আলাপ আলোচনা চর্চার মাধ্যমে গ্রহণ করেন দীন-ই-ইলাহী। এটা কোনও নতুন ধর্ম নয়। ছিল না উপাসনা গৃহ, ছিল না ধর্ম প্রচারের আয়োজন, ছিল না ধর্মগ্রন্থ। এটার মূল নির্যাস ছিল পারস্পরিক সম্মান ও সহিষ্ণুতা। ঐতিহাসিক মাখনলাল রায়চৌধুরীর মতে, আকবর জানতেন সমস্ত ধর্মের মূল সত্য অভিন্ন হলেও ধর্মগ্রন্থ, উপাসনা গৃহ, আচরণবিধি ভিন্নতা সৃষ্টি করে। অতএব, দীন-ই-ইলাহী রইল দার্শনিক বিমূর্ত জগতে। অনুরূপ ভাবে, তিনি তাঁর সাম্রাজ্যের স্বতন্ত্র বর্ষপঞ্জী তারিখ ই-ইলাহী চালু করলেন। তাঁর সিংহাসনে আরোহণের বর্ষকে ভিত্তি ধরে নিয়ে তারিখ ই-ইলাহী চালু হল। ১৫৫৬ খৃষ্টাব্দকে শূন্য ধরে নতুন তারিখ ই-ইলাহী তৈরি হল। উল্লেখ করা যেতে পারে, হিন্দুস্থানের প্রচলিত সব ধরনের বর্ষপঞ্জী হিজরি, শকাব্দ, বিক্রম সম্বৎ, বঙ্গাব্দ, ইরানি, পারসিক পঞ্জিকা মেলালেন। আবার সেই সমন্বয়ের প্রয়োগ। জাতীয় রাজতন্ত্র, তার জাতীয় ধর্মীয় আদর্শ, তার পৃথক জাতীয় বর্ষপঞ্জী। কিন্তু এগুলি কোনওটি তিনি কঠোর ভাবে আরোপ করার চেষ্টা করেননি। ফলে, দীন-ই-ইলাহীর মতোই তারিখ ই-ইলাহী দীর্ঘায়ু লাভ করেনি। কিন্তু মূলত বঙ্গাব্দকে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা বঙ্গাব্দ আকবরের হাতে পুনর্জন্ম লাভ করে। 

আসল কথা হল, মুঘলদের সরকারি কাজকর্ম চলত চান্দ্রমাস হিজরি সনের মোতাবেক। চন্দ্রের প্রাত্যহিক আবর্তনের সময়কাল আর পৃথিবীর প্রাত্যহিক আহ্নিক গতির সময়কালে পার্থক্য রয়েছে। এর ফলে পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার সময়কাল যখন ৩৬৫ দিন ৫ ঘন্টা ৪৮ মিনিট ৪৬ সেকেন্ড, তখন চন্দ্রের সময় লেগেছে অনেক বেশি। আবুল ফজল দেখালেন, এই ব্যবধানটি হল ৩২টি সৌরবর্ষের সমান ৩৩টি চান্দ্রবর্ষ। রাজস্ব আদায় হত চান্দ্র বর্ষ হিজরি অনুসারে। এর ফলে রাজস্ব আদায়ের সময়কাল ক্রমাগত পরিবর্তন হয়। কৃষকরা সমস্যার মুখোমুখি হয়। প্রতি ৩২ বছরে একবার বেশি রাজস্ব দিতে হয়। এই অসংগতিও দূর করার চেষ্টা হয়। অতঃপর ১৫৮৪ খৃষ্টাব্দে ফতেউল্লাহ সিরাজি চালু করলেন নতুন 'ফসলি সন'। সংশ্লেষণ হল নানান বর্ষপঞ্জী। তবে নিশ্চিত ভাবে বলা যায়, বহু প্রচলিত শকাব্দ, বঙ্গাব্দ এ ক্ষেত্রে গুরুত্ব পেল বেশি। হারিয়ে যাওয়া বর্ষপঞ্জী বঙ্গাব্দ আকবর পুনরুদ্ধার করলেন। আরও উল্লেখযোগ্য, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন বঙ্গাব্দের নামগুলো নেওয়া হয়েছে ৭৮ খ্রিস্টাব্দে সাকা জাতির রাজত্বের সময় প্রচলিত শকাব্দ থেকে: ১) বিশাখা থেকে বৈশাখ; ২) জাইষ্ঠা থেকে জ্যৈষ্ঠ; ৩) আষাঢ়া থেকে আষাঢ়; ৪). শ্রাবণা থেকে শ্রাবণ; ৫) ভাদ্রপাদা থেকে ভাদ্র; ৬) আশ্বিনী থেকে আশ্বিন; ৭) কৃতিকা থেকে কার্তিক; ৮) পূস্যা থেকে পৌষ; ৯) আগ্রৈহনী থেকে অগ্রহায়ণ; ১০) মাঘা থেকে মাঘ; ১১) ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন; ১২) চিত্রা থেকে চৈত্র। প্রায় ৯৬৩ বঙ্গাব্দে সরকারি প্রশাসনিক কাজে বঙ্গাব্দ ফিরে এল।

প্রশ্ন উঠবেই, ২৮ বছর পরে কেন? লক্ষ করুন, আকবর তার ধাত্রী মা মাহাম আনঘা, অভিভাবক বৈরাম খাঁ ও বাপের বয়সী অভিজাতদের প্রভাব মুক্ত হয়ে প্রতিপক্ষ পাঠান শক্তিকে দমন করা, রাজপুতদের কাছে টানা, প্রশাসনিক কাঠামো ও রীতিনীতি প্রচলন করা, সর্বোপরি উত্তর ভারতের সামরিক বিজয় সম্পূর্ণ করা ইত্যাদি কাজে মনোসংযোগ করেন। এরপর সাম্রাজ্যের সংশ্লেষণ ও আত্তীকরণের কাজে মন দেন। এই দ্বিতীয় পর্বে দীন-ই-ইলাহী, তারিখ ই-ইলাহী, প্রশাসনিক ছোটখাটো পরিবর্তন ইত্যাদি কাজ করেন। 

আকবর শুধু নয়, বলা ভালো, ইসলামিক যুগটাই ছিল লাগাতার সংশ্লেষণ। চালে ও পলে (মাংস) সিদ্ধ খাদ্য যা বৈদিক সাহিত্যে 'পলৌদন' ক্লাসিক্যাল সাহিত্যে 'ওদন মাংস' এবং অর্বাচীন সংস্কৃত বাংলায় কাশীরাম দাসের 'পলান্ন' নামে পরিচিত ছিল। তা এ যুগে ফার্সি 'পলাও' বা 'পোলাও' নামে হিন্দুর পাতে পরিবেশন হতে লাগল। সংস্কৃত শূল্য পল হল ফার্সি 'শিক কাবাব', উল্লুপ্ত পল (কিমা)'র বড়া হল 'সামি কাবাব', সংস্কৃত ব্যঞ্জন হল ফার্সি 'তরকারি', স্মৃতির সংয়াবু পরে মোহন ভোগ হয়ে আরবি 'হালুয়া'য় পরিণত হল। 

সঙ্গীত গবেষকদের মতে, 'প্রথমে আমীর খসরু ভারতীয় সঙ্গীতের মধ্যে পারসিক সুর (মোকাম) মেলান। পরে সম্রাট আকবর আরও বিদেশ জাত সুর তন্মধ্যে প্রবিষ্ট করান। এ জন্যই উত্তরের (হিন্দুস্তানি) ও দক্ষিণের (কর্ণাটি) সঙ্গীতের পার্থক্য দৃষ্ট হয়।' অনুরূপ ভাবে, পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী থেকে উত্তর ভারতের স্থাপত্যে শীর্ষদেশে গোলাকার গম্বুজের প্রাধান্য লক্ষণীয়। বিপরীতে, প্রাক্ মুসলিম শাসনের ভারতীয় স্থাপত্য শীর্ষদেশের দিকে ক্রমশ ছোট হয়ে যাওয়া করবেল প্রথার প্রাধান্য। এভাবে যে স্থাপত্যশৈলী জন্ম নিল, তা ইন্দো-ইসলামী স্থাপত্য। মুঘল চিত্রকলাও পারসিক ঘরানা থেকে সরে আসে, রাজপুত ও অন্যান্য দেশীয় ঘরানার সংশ্লেষ ঘটিয়ে স্বতন্ত্র মুঘল চিত্রকলার জন্ম দেয়। আজও উত্তর চব্বিশ পরগণার সীমান্ত জেলায় মুসলমান নারী তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বালিয়ে শঙ্খ ধ্বনি দিয়ে আল্লাহ'র শরণ নেন। বাংলাদেশে বৈষ্ণব পদাবলীর শতাধিক মুসলমান পদকর্তার নাম পাওয়া যায় এনামুল হকের লেখায়। 

এভাবেই ভাষা পোশাক ধর্ম সর্বত্র ছড়িয়ে আছে সংশ্লেষণের চিহ্ন। তাই তো ভারতীয় সমাজ সংস্কৃতি এত বর্ণময় বহু মাত্রিক। এক্কেবারে জমে যাওয়া অদ্বিতীয় সুস্বাদু পুডিং। রাজনৈতিক ফয়দা লুটতে গিয়ে পুডিং থেকে ডিম পৃথক করার মূর্খামি করবেন না। ধরুন আপনি বলবেন: শশাঙ্ক একজন সুশাসক। ইতিহাস তাঁকে যোগ্য মর্যাদা দেয়নি। আমি বললাম, ঠিকই। তিনি পশ্চিম ভারতের আধিপত্য আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রতিবাদ। কি মশাই? এটা কিন্তু এক দল, এক নেতা, ডবল ইঞ্জিন সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে। 

আবার ধরুন আপনি বললেন: শশাঙ্ক বঙ্গাব্দ চালু করলেন। আর এই সত্যটা বিলকুল গায়েব করে দিয়েছিল মোল্লার দল। আমি বললাম, ঠিকই। শশাঙ্ক বুদ্ধগয়া আক্রমণ করে বোধিবৃক্ষ ছেদন করেছিলেন। বুদ্ধ মূর্তি ভেঙে সেখানে শিবের মূর্তি স্থাপন করেন। বাণভট্ট, হিউ এন সাঙ, আর্যমঞ্জুশ্রীমূলকল্প'এ এমন বর্ণনা ছড়িয়ে আছে। এই সত্যগুলোও গায়েব হয়ে গেছে। ক্ষমতাবান শাসক সকলেই প্রতিপক্ষের ধর্মস্থানে আঘাত হানে। ওটা ক্ষমতা জাহির করা। 

অতএব, কালের নিয়মে যা বিবর্তিত, পরিবর্তিত তাকে কচলালে তিক্ততাই বাড়ে। কে হায়, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে ভালোবাসে। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায় না- 'জলের উপর পানি না পানির উপর জল'।


Thursday 13 April 2023

'গোদি সোশ্যাল মিডিয়া?'

অনলাইন সেন্সরশিপ

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 



কলকাতা টেলিভিশন, অর্থাৎ, আজকের দূরদর্শন তখন সবে শুরু হয়েছে। টালিগঞ্জের রাধা স্টুডিও থেকে তখন টেলিকাস্ট হয়। সময়টা ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট। তার ঠিক আগেই ২৫ জুন দেশে ঘোষণা হয়েছে জরুরি অবস্থা আর সেন্সরশিপ। সেই সেন্সরশিপ থেকে ছাড় পায়নি কলকাতা টেলিভিশনের ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি’ অনুষ্ঠানও। এই বিভাগের প্রথম তথ্যচিত্র ছিল ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন’। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন এবং অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন নিয়ে চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। অবনীন্দ্রনাথের যাত্রাপালার নির্বাচিত অংশ পাঠ করা হয়। তার একটা লাইন ছিল- 'তখন ইন্দ্রের ভয়ে ঘরে কুলুপ দিয়েছেন ব্রহ্মা'। স্টেশন ডিরেক্টরের কাঁচিতে কোতল হল সেই লাইনটি। কর্তৃপক্ষের যুক্তি, দর্শকদের কাছে ‘ইন্দ্র’ যাতে ‘ইন্দিরা’ না হয়ে যায়। 

পাঠক মনে রাখবেন, ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর নিকটজনেরা অনেকেই 'ইন্দু' বলে ডাকতেন। উচ্চারণ  ভেদে 'ইন্দু' তো 'ইন্দ্র' হতে পারেই। জরুরি অবস্থা ঘোষণার দু'দিন পরে ২৭ জুন 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের 'চিত্ত যেথা ভয় শূন্য' কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ছাপতে দেওয়া হয়নি। এসবই আমাদের সংবাদমাধ্যমের ওপর শাসকের রুদ্রদৃষ্টির প্রকাশ। 

ঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে না, তবে তারই পদধ্বনি ফের শোনা যাচ্ছে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) অথবা সরকারের অন্য কোনও দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ কোনও তথ্যকে ‘ভুয়ো অথবা অসত্য’ চিহ্নিত করলে কোনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা কোনও ডিজিটাল বা অনলাইন মাধ্যম তা প্রকাশ বা প্রচার করতে পারবে না। প্রকাশিত হলেও তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। অর্থাৎ, এই নয়া নির্দেশিকায় কোন খবরটি ‘ভুয়ো’ আর কোনটি ‘ভুয়ো’ নয়- তা নির্ণয়ের ১০০ শতাংশ দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিকস ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর জানিয়ে দিয়েছেন, একটি ফ্যাক্ট চেক ইউনিট তৈরি করবে সরকার। এই ফ্যাক্ট চেক ইউনিট সরকার সম্পর্কিত সব অনলাইন তথ্য পরীক্ষা করবে। আর তারপর গুগল, ফেসবুক, টুইটারের মতো ইন্টারনেট সংস্থা যদি সরকারের চিহ্নিত ওই কনটেন্ট সরিয়ে না দেয় তাহলে তারা ‘সুরক্ষা’ পাবে না। 

এই ভাষ্যের মধ্যে একটা পরিষ্কার 'ধমকি' আছে। একে বলা যায় অনলাইন সেন্সরশিপ। প্রেস সেন্সরশিপ বললেও সত্যের অপলাপ হবে না। এমন উদ্যোগ যে নেওয়া হতে চলেছে, গত বছর অক্টোবর মাসেই সরকার সেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। এরপরেও আমাদের বলতে হবে 'সব ঠিক হ্যায়', 'গণতন্ত্র মজবুত আছে', 'কোথাও কোনও বিপদ নেই'। কিন্তু বিপদ বুঝতে পারছে চতুর্থ স্তম্ভ। তাই কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেছে এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া। গিল্ড এক বিবৃতিতে বলেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন্দ্র সংক্রান্ত কোনও পোস্ট ‘ভুয়ো’ বা ‘মিথ্যা’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ কিনা- এই সংশোধনীর মাধ্যমে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চরম ক্ষমতা নিজেই নিজেকে দিল সরকার। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের সত্যতা যাচাই করার সরকারি পদ্ধতি বা কাঠামো কী হবে। এসবই ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী এবং সেন্সরশিপের সমতুল্য। এই সংশোধনী দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দানবীয় বিধি আরোপ করা হয়েছে। এখনই তা প্রত্যাহার করে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব স্টেক-হোল্ডারদের  সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে সরকারকে, যাতে সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বিরোধীদের বক্তব্য, সরকার এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে মুক্ত ও স্বাধীন কণ্ঠস্বর চাপা দিতে চাইছে। গিল্ড তাই জানিয়ে দিয়েছে, ২০২১ সালেই তারা সরকারের এই ধরনের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল। 

আসলে, সরকার চায় এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে বিরোধিতার মধ্যে পড়তে না হয়। তাই তারা চায় না এমন কিছু প্রকাশ পাক যাতে সরকার বিব্রত বোধ করে। সব সরকারের এটাই শাসনবিধি।  যদিও এই সরকারের পক্ষে এইভাবে বুলডোজার চালানো নতুন নয়। ‘গদি মিডিয়া’ তৈরি হয়েছে মোদী শাসনে। এবার তারা ‘গোদি সোশ্যাল মিডিয়া’ তৈরি করতে চাইছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার মনে করছে, ডিজিটাল মিডিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হল ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়ো খবর। সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো অনেক ভুয়ো খবর মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেও মত কেন্দ্রের। এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ভুয়ো খবরের বাড়বাড়ন্ত। আর এটাও ঘটনা, বেশির ভাগ মানুষ এই খবরগুলোর সত্যাসত্য যাচাই না করেই তাকে অনিবার্য সত্য বলে ঠাউরে নেয়। আমরা তো জানি সেই চিনা প্রবাদ- When finger points at the moon, idiot looks at the finger.। ফলে, সত্য হারিয়ে যায় বহু কল্পনা ও জল্পনার আড়ালে। সাধারণ মানুষের কাছেও কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট নেই এই সত্যাসত্য নির্ণয়ের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় কি সরকারি নিযুক্ত কোনও কমিটি বা কর্তৃপক্ষ নিরপেক্ষভাবে করতে পারে? সে কারণেই এ প্রসঙ্গে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও' ব্রায়েনের কটাক্ষ, ‘মোদী-শাহর বিজেপি, যারা ভুয়ো খবর ছড়ানোর কর্ণধার, তারাই ফেক নিউজ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। আমাদের তো হাসি থামছেই না।’ কংগ্রেসের জাতীয় যোগাযোগ  বিভাগের প্রধান জয়রাম রমেশ বলেন, ‘সব থেকে বেশি ফেক নিউজ প্রচার করে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি।’ প্রাক্তন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারির প্রতিক্রিয়া, 'সরকারের এই পদক্ষেপ তাদের নিরাপত্তাহীনতার প্রমাণ দিচ্ছে। এটা সেন্সরশিপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনটা আসল আর কোনটা নকল, সে ব্যাপারে সরকার শেষ কথা বলবে! এটা খুব অদ্ভুত।’ 

উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকা প্রথমে একটি 'গোপন' বৈঠকের খবর প্রকাশ করেছিল। সেই খবরে বলা হয়েছিল, তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০০ (আইটি আইন)-এর ৭৯ ধারার অধীনে বিধিগুলির সংশোধনের প্রস্তাব আলোচনা করা হয়েছে এই গোপন বৈঠকে৷ আইটি আইনের ধারা ৭৯ সেই মধ্যস্থতাকারীদের একটি 'নিরাপদ আশ্রয়' প্রদান করে যারা ব্যবহারকারীর তৈরি প্রোডাক্ট হোস্ট করে এবং তাদের প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীদের ক্রিয়াকলাপের দায় থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়। তবে এই রক্ষাকবচ মেলে যদি তারা সরকার দ্বারা নির্ধারিত নির্দেশিকা মেনে চলা হয়। এই খবরটি করা নিয়ে ওই সংবাদপত্রের সাফাই ছিল, আমরা মধ্যস্থতাকারী দায়বদ্ধতার নির্দেশিকাগুলির সংশোধন সংক্রান্ত সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিদের এই ব্যক্তিগত বৈঠক সম্পর্কে জানার পরে খসড়া নিয়মগুলির একটি সম্পূর্ণ অনুলিপি হাতে পেয়েছি। আর এ সবটাই করা হয়েছে, কারণ সেখানে জনস্বার্থ যথেষ্ট ঝুঁকিতে ছিল। মজার কথা, সেদিন প্রথমে, ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক এই জাতীয় কোনও বৈঠক এবং প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলির বিষয়ে কোনও খসড়া তৈরি হয়েছে বলে স্বীকার করেনি। তারপর নানা কারণে, বিশেষ করে করোনা অতিমারির কারণে, গোটা ব্যাপারটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। এখন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে ও বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। উঠেছে প্রতিবাদ ও সমালোচনা। এখন দেখার, সত্যান্বেষী কোন পথে হাঁটে। মনে রাখতে হবে, মিথ্যের একটা অমোঘ শক্তি আছে সত্যকে কব্জা করার! তাই সত্যের সত্যতা নির্ণয় যেমন জরুরি, তেমনই কঠিন।

এক বন্ধু ফেসবুকে পোস্টিয়েছেন একটি কবিতা, যার শেষের তিনটি পঙক্তি এরকম: 'সুতোকাবাবের মাতন ধোঁয়ায় গহরজান/ শুনতে শুনতে কী যেন হচ্ছে, আইটি সেল,/প্রোপাগাণ্ডীবে ছিলা টঙ্কার... গরল ভেল'। বেশ তাৎপর্যময়। তাঁর কটাক্ষ, ভুয়ো খবরের জোগানদারের হাতে তবে কি এখন থেকে সত্যাসত্য নির্ধারণের দায়িত্বভার!


Monday 3 April 2023

রামনবমীর হিংসা!

ধর্মকে রাজনীতি থেকে আলাদা করতেই হবে

সুমন সেনগুপ্ত



গত তিন দিন ধরে রামনবমীকে কেন্দ্র করে সারা দেশের পাশাপাশি আমাদের রাজ্যেরও বেশ কিছু জায়গা অশান্ত হয়েছে। বহু ছবি, বহু ভিডিও এসেছে। সচেতনভাবেই সেই ছবি কিংবা ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে দিতে চাইনি। মনে হয়েছে, এই ছবিগুলো ভয়ের ছবি, এই ছবি যত বেশি প্রচার করা হবে তত বেশি মানুষ ভয় পাবে। দ্বিতীয় দিনেও যখন হাওড়াতে গণ্ডগোল হয়, পুলিশ প্রশাসন অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে বেশ কিছু মানুষকে গ্রেফতার করেছে; যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁদের কারও হাতে বন্দুক, কারও হাতে খোলা তলোয়ার দেখা গেছে।

কেন্দ্রের শাসক দল অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এবারের রামনবমীতে হিংসা ছড়ানোর পরিকল্পনা করেছিল এবং সেটা শুধু এই রাজ্যে নয়, সারা দেশে। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই অশান্তি হতে পারে তা পুলিশ ও প্রশাসনের কাছে আগাম খবর থাকা সত্ত্বেও তারা আগে থেকে কেন কোনও পদক্ষেপ নেয়নি? গতকাল রাজাবাজারের ভেতর দিয়ে যাওয়ার সময়ে দেখলাম, বিশাল হনুমানের মুখ আঁকা গেরুয়া পতাকা। এইরকম বড় পতাকা আমি আগে দেখেছি বলে মনে করতে পারি না। এইগুলো কেউ নিশ্চিত ব্যক্তিগত টাকা খরচ করে বানায়নি। এগুলো বানানো হয়েছে সচেতনভাবে, যাতে রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে অশান্তি সৃষ্টি করা যায়। আর হয়েছেও তাই। 

কেউ ব্যক্তিগতভাবে রামের পুজো করলে তাতে আপত্তির কোনও প্রশ্নই নেই। কিন্তু রামের পুজোর নাম করে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে ঝামেলা সৃষ্টি করাই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে তা নিয়ে কথা উঠবেই। প্রশ্ন, এই গণ্ডগোলের পরিস্থিতি তৈরি করে কার লাভ হল? সামনে কর্নাটক নির্বাচন। যা বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি যথেষ্ট অসুবিধায় আছে। এবিপি নিউজ-সি ভোটার সমীক্ষায় বিজেপির পরাজয় সুনিশ্চিত বলে গত সপ্তাহেই দেখানো হয়েছে। উপরন্তু, কিছুদিন ধরে যেভাবে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে সমস্ত সংবাদমাধ্যমে আলোচনা চলছে, তাতে বিজেপি স্পষ্টতই বেশ আতান্তরে পড়েছে। সুতরাং, বিজেপির প্রয়োজন ছিল এই ন্যারেটিভ বা ভাষ্যকে নিজেদের চেনা ছকে ফেলার। তারা সেটাই করার চেষ্টা করেছে। 

অনেকে বলছেন, বাংলায় সামনে পঞ্চায়েত নির্বাচন তাই মেরুকরণের রাজনীতি করতে পারলে আখেরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিছুটা হলেও লাভবান হবেন। কিন্তু যাঁরা এই সরল সমীকরণে বিষয়টি দেখছেন, তাঁদের কাছে একটা বিনীত প্রশ্ন আছে। যদি বাংলায় দাঙ্গা পরিস্থিতির সৃষ্টি করলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লাভ হয়, তাহলে বিহারেও নিশ্চিত নীতিশকুমার এবং আরজেডি'র লাভ হবে, রাজস্থানেও সুনিশ্চিত কংগ্রেসের লাভ হবে? কিন্তু সত্যিই কি তাই হবে? নাকি এই ধরনের দাঙ্গা করতে পারলে বিজেপির 'হিন্দু ভোট' আরও জোটবদ্ধ হবে? এই ধরনের পরিস্থিতি ওঁদের চেনা ছক, যা দিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তৈরি করে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে চর্চা করাটা বন্ধ করা যায়! রাহুল গান্ধীকে সামনে রেখে হোক বা পাশে নিয়ে, যখন সমস্ত বিরোধী দল ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তখন এই ধরনের সাম্প্রদায়িক ছক তৈরি করা ছাড়া বিজেপির আর কোনও রাস্তা আছে কী?   

বাংলার ক্ষেত্রে এটা সত্যি যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর দল আকণ্ঠ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত। প্রমাণ হল কি হল না তা পরের বিতর্ক। মুসলমান সমাজ, বিশেষ করে বাংলা ভাষী মুসলমান মানুষজন তাঁর দিক থেকে ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছেন। সাগরদীঘি তার অন্যতম উদাহরণ। মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে ধীরে ধীরে কংগ্রেসের প্রতি বিশ্বস্ততা তৈরি হচ্ছে। অনেকেই ভাবতে শুরু করেছেন, দেশব্যাপী বিজেপিকে রুখতে একমাত্র রাহুল গান্ধীই হয়তো পারবেন, তাই তাঁরাও আবার কংগ্রেসমুখি হচ্ছেন। তাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও হয়তো চেয়েছেন, তিনিই মুসলমান মানুষদের রক্ষা করতে পারেন- এই বার্তা যাতে পৌঁছয়। সেই জন্যেই তিনি হয়তো বলেছেন, রমজানের সময়ে মুসলমান অঞ্চল দিয়ে যাতে রামনবমীর মিছিল না যায়। কিন্তু মুখে বললেও তাঁর প্রশাসনের গাফিলতিতেই কিন্তু এই ঘটনা ঘটেছে। 

যাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাঁরা যেহেতু ধর্ম পরিচয়ে হিন্দু- তাঁদের হয়ে এখন বিরোধী দলনেতা থেকে শুরু করে বহু কেন্দ্রীয় মন্ত্রীই গলা ফাটাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ'র তদন্ত চাইছেন। এই এনআইএ এলে কী হবে? তারা সবার আগে বেছে বেছে মুসলমান যুবকদের তুলবে। গণমাধ্যমগুলো একযোগে এমন শিরোনাম করবে যে দেখে মনে হবে মুসলমানেরাই মূলত হাওড়াতে দাঙ্গা করিয়েছে। অথচ ছবি এবং ভিডিওতে স্পষ্ট যে, গেরুয়া ঝান্ডাধারীরাই এই কাজটির মূল হোতা। আমরা আবারও বিশ্বাস করতে শুরু করব, মুসলমান মাত্রই দাঙ্গাকারী, সন্ত্রাসবাদী। অথচ, এনআইএ আসা মানে যে আসলে কোনও তদন্ত হবে না, তা কি আমরা জানি না? আমাদের সংবিধানের অন্যতম বৈশিষ্ট্য যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো। সেই কাঠামোকে বারংবার বিজেপি যে ভেঙেছে, ভাঙছে, তা কি আমরা দেখছি না? আমরা কি তখন এই পদক্ষেপের বিরোধিতা করব? না করব না। কারণ, আমাদের মাথায় আছে, তৃণমূল চোর- এই চোরদের সরাতে পারলেই বাম থুরি রাম রাজ্য আসবে। আসলে অন্তর থেকে যে আমরা সাম্প্রদায়িক তা কি আমরা জানি?  

আমি একবারও বলছি না, তৃণমূলকে রেখে দিতে হবে, তাঁরাই বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। না, তা করবে না। কারণ, বিজেপির সমস্ত নীতিকেই তাঁরা এই রাজ্যে লাগু করেছে প্রাথমিক বিরোধিতার নাটক করে। কিন্তু আমাদের বিকল্পটা ভাবতে হবে, বিকল্প ভাষ্য তৈরি করতে হবে। কিন্তু বামেরা, যাঁদের প্রতি মানুষের এত আশা, তাঁরা কি সেই বিকল্প ভাষ্য বা চেহারা দেখাতে পারছেন? তাঁরা যদি ভাবেন, বিজেপিকে ছাড় দিয়ে তৃণমূলকে অনবরত আক্রমণ করে যাবেন, তাতে আখেরে কাদের লাভ হচ্ছে? একটা শেষ কথা (হয়তো অপ্রিয়)- একজন গড়পড়তা হিন্দু বাঙালির থেকে একজন মুসলমান বাঙালি যুবক কিন্তু রাজনীতি অনেক পরিষ্কার বোঝেন। তিনি তাঁর জীবন দিয়ে বোঝেন। তাই কোনও দল যদি ভাবে যে তারা মুসলমান ভোট কেটে তৃণমূলের হারার পথ সুগম করবে, তাহলে তারা মুর্খের স্বর্গে বাস করছে।  

আগামী দিনে কী হবে তা সময় বলবে। কিন্তু তা যে বাংলা তথা দেশের জন্য খুব সুখকর নয়, তা সবাই বুঝতে পারছেন। এই সময়টা আরও বেঁধে বেঁধে থাকার সময়। তার পরিবর্তে আমরা যদি ক্ষুদ্র স্বার্থে নিজেদের মধ্যে লড়াই করি, তাতে কি আখেরে আমাদের ভালো হবে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন তাঁর ওপর ভরসা রাখতে, তিনি দোষীদের গ্রেফতার করবেন। কিন্তু যাঁরা এই দাঙ্গার মূল মাথা, তাঁদের কি গ্রেফতার করার সাহস দেখাতে পারবেন তিনি? ভারতীয় রাজনীতিতে লালুপ্রসাদ সবাই হতে পারে না। যাঁর সেই শক্তি ছিল তিনি সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে কোনওদিন মাথা নত করেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি পারবেন অমিত মালব্য সহ অন্যান্য নেতানেত্রীদের গ্রেফতার করতে, যাঁরা এখনও উস্কানি দিয়ে চলেছেন। ভালো প্রশাসক হওয়া কিন্তু কঠিন কাজ, সেই পরীক্ষা তাঁকেই দিতে হবে। হিন্দু ভোট বা মুসলমান ভোটের অঙ্ক কষা কিন্তু একজন ভালো প্রশাসকের কাজ নয়। রাজনীতি এবং ধর্মকে আলাদা করা একজন দক্ষ প্রশাসকের কাজ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি পারবেন সেই জায়গা তৈরি করতে?

যদি খেয়াল করা যায়, বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলোতেই কিন্তু গণ্ডগোল পাকানো হচ্ছে। রাজস্থান, বিহার, বাংলা। বাংলায় কিছুটা স্তিমিত হলেও বিহার এখনও জ্বলছে, মানুষ মারা যাওয়ার খবরও আসছে। তার মধ্যে রাজস্থানের একটি ভিডিও এসেছে। এমনিতে আমি এই ধরনের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখি, কিন্তু এই ভিডিওটা সবার দেখা উচিত। 



রাজস্থানে একটি রামনবমীর মিছিল যখন মুসলমান অঞ্চলে ঢোকে তখনই চালু হয় ডিজে। উস্কানিমূলক গান, সঙ্গে নাচ। ‘যব ভাগওয়া লেহেরায়েগা, তব মিয়াঁ কাটে যায়েগা’- অর্থাৎ, গেরুয়া পতাকা নিয়ে মোল্লাদের কাটতে হবে। ঠিক সেই সময়ে একটি দুর্ঘটনা ঘটে। ঐ ডিজে বক্সের ইলেক্ট্রিকের তারে শক খেয়ে তিনজন গেরুয়াধারী যুবক মারা যায়। এখনও অবধি কিন্তু এ নিয়ে কোনও খবর দেখতে পাবেন না, কোনও হিন্দু নেতার ট্যুইট পাবেন না। কারণ, এঁরা তো কেউ নেতা-নেত্রী নন, এঁরা হচ্ছেন সাধারণ মানুষ, যাঁদের কিছু টাকা দিয়ে উস্কে দাঙ্গা করানো যায়, দিনের শেষে তাঁরা সেই টাকা নিয়ে মদের দোকানে লাইন দেয়। এঁদের মা-বাবাদের ক্ষমতা নেই বাইরে পড়াতে নিয়ে যাওয়ার, তাই মুসলমান মারতে গিয়ে মারা গেলেও তাঁদের জন্য কোনও নেতা-মন্ত্রী চোখের জল ফেলবেন না। আসলে এঁরা প্রত্যেকেই দাবার ‘বোড়ে’; আর কে না জানে, 'বড়' কিছুর জন্য এই ছোটখাট বোড়েদের আত্মাহুতি দেওয়াটাই দস্তুর।

 

Saturday 1 April 2023

'যশোর রোডের দু' ধারে বসত'

গাছ বাঁচাও ঐতিহ্য বাঁচাও

সুমিত



১৯৭১ সালে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রখ্যাত আমেরিকান কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ যশোর রোড নিয়ে একটি অনবদ্য কবিতা লিখেছিলেন: September on Jessore Road। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান থেকে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুর্দশা এবং অপরিসীম যন্ত্রণার চিত্র কবিতাটিতে ফুটে উঠেছিল। প্রায় তিন দশক পরে, ওই কবিতাটি অবলম্বন করেই মৌসুমী ভৌমিক তাঁর বিখ্যাত গান রচনা করেন 'যশোর রোড':

শত শত চোখ আকাশটা দেখে

শত শত শত মানুষের দল

যশোর রোডের দু’ ধারে বসত

বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল

কাদামাটি মাখা মানুষের দল

গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে

কাদামাটি-মাখা অগুনতি মানুষের ভিড় সেই সময় আশ্রয় নিচ্ছে যশোর রোডের দু’ধারে শতাব্দী প্রাচীন বৃক্ষরাজির তলে। চিরসবুজ মেহগনি, বট, অশ্বথ, শিশু গাছের নীচে। বাঁশের ছাউনি বেঁধে, দরমার দেয়াল তুলে। যশোর রোড ও তার আশেপাশের নানান জায়গায়- চাঁদপাড়া, ঠাকুরনগর, গোবরডাঙা, মছলন্দপুর, হাবড়া, বাণীপুর, গাইঘাটা, অশোকনগর, বারাসাতে অসংখ্য শরণার্থী শিবির। পাশাপাশি গড়ে উঠছে একের পর এক মুক্তিযুদ্ধের ক্যাম্পগুলিও। যশোর রোড ধরেই বন্দুক কাঁধে মুক্তিসেনানিরা জীবন হাতে নিয়ে সীমান্ত পাড়ি দিচ্ছেন। সে এক দুরন্ত সময়; যে সময়ের অংশীদার এবং প্রত্যক্ষ সাক্ষী যশোর রোডের ওই গাছগুলি।

সেই সময়টাকে, সেই ইতিহাসটাকে আজ মুছে দেবার এক গভীর চক্রান্ত চলছে। এ বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি ভারতের উচ্চতম আদালত বিনা অপরাধে যশোর রোডের ঐতিহ্যবাহী ৩৫৬টি গাছের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছে। সড়ক প্রশস্তকরণের তাগিদে, উন্নয়নের নামে। আসলে, পুঁজির স্বার্থে, মুনাফার পাহাড় গড়ার লক্ষ্যে।

১১২ নম্বর জাতীয় সড়ক যশোর রোডের প্রশস্তকরণ এবং তার জন্য ৪,০৩৬টি গাছ কাটা পড়ার খবর প্রথম জানা যায় ২০১৪-১৫ সালে সংবাদমাধ্যম মারফত। যানজট এড়াতে বারাসাত-চাঁপাডালির মোড় থেকে বনগাঁ পর্যন্ত ৬০-৭০ কিলোমিটার সড়কের মোট পাঁচটি জায়গায় রেল ওভারব্রীজ (hump) গড়তে হবে এবং তার জন্যই নাকি এই প্রশস্তিকরণের প্রয়োজন। গাছ কাটা হবে খবর পেয়ে স্বভাবতই স্থানীয় সংবেদনশীল মানুষজন এবং পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীরা উদ্বিগ্ন, আশঙ্কাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। দানা বাঁধতে শুরু করে গাছ কাটা বিরোধী প্রতিবাদ আন্দোলন। RTI করা হয় সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরগুলিতে, স্থানীয় বিধায়ক ও সাংসদের কাছে। পরিতাপের বিষয়, আজও সেই RTI-এর কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। এরপর ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতি (APDR) কলকাতা হাই কোর্টে Trees (Protection and Conservation in Non-forest Areas) Act, 2006 অনুসারে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে।

কয়েকদিন পরেই, ২রা এপ্রিল বনগাঁ পৌঁছে যায় রাজ্য সরকারের গাছ কাটার দল। আন্দোলনকারীরা ছুটে যান। যারা গাছ কাটতে এসেছিলেন তারা কোনও কাগজ দেখাতে পারেন না। ফিরে যেতে হয় তাদের। কিন্তু ২১ এপ্রিল হাবড়ায় ও ২২ এপ্রিল অশোকনগরে আবার চালু হয় বৃক্ষ নিধনের আয়োজন। আবার ছুটে যান প্রতিবাদীরা। বেশ কিছু স্কুলের ছাত্রী-ছাত্ররাও যোগ দেয় এই প্রতিবাদে। ‘চিপকো’ আন্দোলনের ঢং’য়ে তারা গাছগুলিকে জাপটে জড়িয়ে ধরে। কবিতায়-গানে-নাটকে, উৎসবের মেজাজে বাঙ্ময় হয়ে ওঠে গাছ কাটা বিরোধী আন্দোলন। গাছ বাঁচানোর আন্দোলন পরিণত হয় এক সাংস্কৃতিক আন্দোলনে। ২৩ এপ্রিল তৈরি হয় ‘যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটি’।

এই কমিটিও হাই কোর্টের দ্বারস্থ হয়। প্রথমে হাই কোর্ট গাছ কাটায় স্থগিতাদেশ জারি করে। কিন্তু ৩১ আগস্ট ২০১৮- ৩৫৬টি গাছ কাটার অনুমতি দেয়। প্রতিবাদীরা বাধ্য হয় সুপ্রিম কোর্টে যেতে। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ সুপ্রিম কোর্ট গাছ কাটায় আবার স্থগিতাদেশ জারি করে। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে APDR ও ‘গাছ বাঁচাও কমিটি’র করা দু’টি মামলা একত্র করে শুনানি চলতে থাকে। পক্ষে-বিপক্ষে দুই যুযুধান আইনজীবী– গাছ-কাটা বিরোধীদের হয়ে প্রশান্ত ভূষণ এবং রাজ্য সরকারের তরফে অভিষেক মনু সিংভি– আদালতে যুক্তি-প্রতিযুক্তির জাল বিস্তার করেন। অবশেষে, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি বি আর গাভাইয়ের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দেয় এবং ৩০৬টি গাছ কাটার (ইতিমধ্যে ৫০টি গাছের মৃত্যু হয়েছে) হাই কোর্টের আগের নির্দেশকেই বহাল রাখে।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গাছ কাটার পক্ষে প্রধানত যে দু’টি কারণ উচ্চারিত হয়েছে তার প্রথমটি অবশ্যই যানজট। যশোর রোড বর্তমানে ২৫-৩০ ফুট চওড়া, পাঁচটি রেল ওভারব্রিজ গড়তে একে ১২০ ফুট চওড়া করতে হবে। তা না হলে দ্রুত ট্রাক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হবে, যার ফলে নিকটবর্তী বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই যুক্তি মানবেন না যারা যশোর রোড এবং বাংলাদেশ সীমান্ত পোস্টগুলির সঙ্গে সুপরিচিত। তাদের মতে, যানজটের আসল কারণ ঘুষের দর-কষাকষির জন্যে বর্ডার পোস্টগুলিতে দিনের পর দিন আটকে থাকা শ’য়ে শ’য়ে ট্রাক। যে কোনও দিন ঠাকুরনগর থেকে পেট্রাপোল, বেনাপোল বর্ডার পরিদর্শন করলেই এ দৃশ্য দেখা যাবে। ট্রাকগুলি সাধারণত পচনশীল পণ্য– চাল, ডাল, চিনি, সবজি, ফল– বয়ে নিয়ে আসে এবং দীর্ঘদিন আটকে থাকার ফলে রফতানি বাণিজ্য বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানকার পার্কিং লটগুলি কৃষিজমি দখল করেই গড়ে উঠেছে এবং এখানে চলে স্থানীয় মস্তান রাজ ও প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকাদের দাদাগিরি। তাই, যানজটের সাথে গাছের কী সম্পর্ক!

বলা হয়েছে, যশোর রোড সংকীর্ণ হবার জন্য রুগী নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স দ্রুত কলকাতার হাসপাতালে পৌঁছতে পারছে না। কেউ কি এ প্রশ্ন করছেন যে চিকিৎসার জন্য কেন কলকাতায় ছুটে আসতে হবে! স্বাধীনতার ৭৬ বছর পরেও কেন বনগাঁ, মছলন্দপুর, হাবড়া, বারাসাত ইত্যাদি জায়গায় সুচিকিৎসার বন্দোবস্ত হল না!

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে গাছ কেটে ফেলার আরেকটি বড় যুক্তি হল বড় বড় গাছের ডাল ভেঙে পড়ে এ পর্যন্ত ৬০০ লোকের নাকি মৃত্যু হয়েছে এবং বহু মানুষ আহত হয়েছেন। এই দুর্ঘটনাগুলি কোন সময়ে অর্থাৎ কবে থেকে কবে তার কোনও উল্লেখ নেই। নিহত ও আহতদের নামধামের কোনও তালিকাও দেওয়া হয়নি। তাই মনে করা হচ্ছে, এটা একটা মনগড়া তথ্য ব্যতীত আর কিছু নয়। দেশের সর্বোচ্চ আদালতের কাছে প্রমাণ কিংবা সূত্র ছাড়া এ ধরনের তথ্য পরিবেশন কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। ‘গাছ বাঁচাও কমিটি’ দাবি করছে, এই ৬০০ মানুষের তালিকা প্রকাশ করা হোক এবং নিহত-আহত পরিবারগুলিকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। তারা মেনে নিয়েছে যে মাঝেমধ্যে ডাল ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে ঠিকই কিন্তু তা ঘটে গাছ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে, যার দায় রাজ্য ও কেন্দ্রীয় উভয় সরকারের ওপরেই বর্তায়।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে অবাক হবার কিছু নেই। ইদানিং কালে দেখা যাচ্ছে, দেশের বিচারব্যবস্থা ক্রমাগত সর্বগ্রাসী বিশ্ব পুঁজির আজ্ঞাবহ হয়ে উঠছে, উন্নয়নের নামে কর্পোরেট লুঠতরাজকে মদত দিচ্ছে। জল-জঙ্গল-জমি জোর করে কেড়ে নেওয়া, প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্র অবলীলায় ধ্বংস করা, আদিবাসী মানুষের জীবন ও জীবনধারাকে বিপন্ন করে তোলা, সব কিছুকেই বিনা প্রশ্নে তারা সায় দিয়ে চলেছে। আমাদের রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। পুরুলিয়ার অযোধ্যা (মারাং বুরু) পাহাড়ে ঠুড়গা বিদ্যুৎ প্রকল্প মামলায় হাই কোর্টের জনবিরোধী রায় সে কথাই প্রমাণ করে। দেওচা-পাঁচামী মামলারও একই পরিণতি হবে বলেই মনে হয়।

যশোর রোডের প্রশস্তিকরণ আসলে একটি আন্তর্জাতিক পুঁজির প্রকল্প। ২০,৫৩৭ কিলোমিটার এশিয়ান হাইওয়ে গড়ে তোলা হবে এখান থেকেই- যা একদিকে যাবে বাংলাদেশ, মায়ানমার, কাম্বোডিয়া হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব চিনের সাংহাই পর্যন্ত, আরেক দিক চলে যাবে মধ্য এশিয়া। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক এই সড়ক প্রকল্পের মূল পৃষ্ঠপোষক। উল্লেখযোগ্য, উত্তর ২৪-পরগণা জেলার বিস্তীর্ণ এলাকায় মাটির নিচে তেলের খনি পাওয়া গিয়েছে– বেঙ্গল বেসিন- যার ওপর দিয়েই চলে গেছে যশোর রোড। এখানেই পুঁজির কাছে যশোর রোডের গুরুত্ব। আন্তর্জাতিক অয়েল করিডর-এর কেন্দ্রস্থল হতে চলেছে যশোর রোডই। তাই যশোর রোডের গাছগুলি আক্রান্ত, তাদের মাথার ওপর ঝোলানো হয়েছে মৃত্যু পরোয়ানা।

একটু ভেবে দেখা যাক। আসলে, মৃত্যু পরোয়ানাটা যে আমাদের মাথার ওপরেও তা আমরা বুঝেও বুঝি না। পুঁজিবাদী উন্নয়নের চাকচমক দেখে আমরা ভুলে যাই এক একটি গাছ বিপুল অক্সিজেনের সম্ভার। কোভিড মহামারির সময় হা-হুতাশ করেছি অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্য, অথচ গাছ কাটা হলে আমরা নির্লিপ্ত। আমরা ভুলে যাই আমরা নিঃশ্বাস ফেলে যে কার্বন-ডাইঅক্সাইড ছাড়ি গাছই তা শুষে নেয়। যা কার্বন নিঃসরণ কিছুটা হলেও কমিয়ে দেয়। আজ জলবায়ু বিপর্যয়ের মুহূর্তে গাছই আমাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন।

গাছ বর্ষার জল ধরে রাখে, মাটিকে উর্বর করে তোলে। গাছ ছায়া দেয়, গ্রীষ্মের দাবদাহে পরিবেশ শীতল করে, তাপমাত্রা কমিয়ে আনে, প্রখর রোদে গাছের নিচেই আমরা আশ্রয় পাই। আশ্রয় পায় আরও কত শত প্রাণী জগতের বাসিন্দারা। কত পাখি বাসা বাঁধে; গাছের ডালে বাস করে বাদুর, বাঁদর, ছুটে বেড়ায় কাঠবিড়ালি; কত প্রজাপতি, মাকড়সা; কত ক্ষুদ্র প্রাণী, কত অনুজীব থাকে গাছকে জড়িয়ে; কত পরজীবী উদ্ভিদ। প্রতিটি গাছই অনন্ত জীববৈচিত্রের আধার। গাছের নিচেই আবার গড়ে ওঠে চায়ের দোকান, চুল কাটার সেলুন, আড্ডার ঠেক। জীবনের স্রোত বয়ে চলে গাছেরই তলায়। গাছ ছাড়া এই পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকা দায়। তার মৃত্যু পরোয়ানা মানে পৃথিবীর মৃত্যু ঘোষণা।

উল্লেখ্য, মামলা চলাকালীন সুপ্রিম কোর্ট বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত একটি সার্ভে টিম পাঠায় যশোর রোডে। তারা একটি ১৬১ পাতার রিপোর্ট পেশ করে। সেই রিপোর্টের একটি অংশ:

‘আকার, আকৃতি, গঠন, প্রস্থ, উচ্চতা, ঘের, বয়স, বাস্তুতান্ত্রিক মূল্য, অনন্য প্রজাতির বৈশিষ্ট, ঐতিহাসিক ও নান্দনিক মান দেখে মনে হয় গাছগুলি হেরিটেজ তকমা পাবার যোগ্য।’

যশোর রোডের গাছ বাঁচানোর লড়াইটা ঐতিহ্য বাঁচানোরও লড়াই।