অনলাইন সেন্সরশিপ
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
কলকাতা টেলিভিশন, অর্থাৎ, আজকের দূরদর্শন তখন সবে শুরু হয়েছে। টালিগঞ্জের রাধা স্টুডিও থেকে তখন টেলিকাস্ট হয়। সময়টা ১৯৭৫ সালের ৯ আগস্ট। তার ঠিক আগেই ২৫ জুন দেশে ঘোষণা হয়েছে জরুরি অবস্থা আর সেন্সরশিপ। সেই সেন্সরশিপ থেকে ছাড় পায়নি কলকাতা টেলিভিশনের ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি’ অনুষ্ঠানও। এই বিভাগের প্রথম তথ্যচিত্র ছিল ‘জন্মদিন মৃত্যুদিন’। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুদিন এবং অবনীন্দ্রনাথের জন্মদিন নিয়ে চিত্রনাট্য লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ। অবনীন্দ্রনাথের যাত্রাপালার নির্বাচিত অংশ পাঠ করা হয়। তার একটা লাইন ছিল- 'তখন ইন্দ্রের ভয়ে ঘরে কুলুপ দিয়েছেন ব্রহ্মা'। স্টেশন ডিরেক্টরের কাঁচিতে কোতল হল সেই লাইনটি। কর্তৃপক্ষের যুক্তি, দর্শকদের কাছে ‘ইন্দ্র’ যাতে ‘ইন্দিরা’ না হয়ে যায়।
পাঠক মনে রাখবেন, ইন্দিরা গান্ধীকে তাঁর নিকটজনেরা অনেকেই 'ইন্দু' বলে ডাকতেন। উচ্চারণ ভেদে 'ইন্দু' তো 'ইন্দ্র' হতে পারেই। জরুরি অবস্থা ঘোষণার দু'দিন পরে ২৭ জুন 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথের 'চিত্ত যেথা ভয় শূন্য' কবিতার ইংরেজি অনুবাদ ছাপতে দেওয়া হয়নি। এসবই আমাদের সংবাদমাধ্যমের ওপর শাসকের রুদ্রদৃষ্টির প্রকাশ।
ঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে না, তবে তারই পদধ্বনি ফের শোনা যাচ্ছে। নতুন সংশোধনী অনুযায়ী, প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরো (পিআইবি) অথবা সরকারের অন্য কোনও দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ কোনও তথ্যকে ‘ভুয়ো অথবা অসত্য’ চিহ্নিত করলে কোনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম অথবা কোনও ডিজিটাল বা অনলাইন মাধ্যম তা প্রকাশ বা প্রচার করতে পারবে না। প্রকাশিত হলেও তা প্রত্যাহার করে নিতে হবে। অর্থাৎ, এই নয়া নির্দেশিকায় কোন খবরটি ‘ভুয়ো’ আর কোনটি ‘ভুয়ো’ নয়- তা নির্ণয়ের ১০০ শতাংশ দায়িত্ব থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে। কেন্দ্রীয় ইলেকট্রনিকস ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী রাজীব চন্দ্রশেখর জানিয়ে দিয়েছেন, একটি ফ্যাক্ট চেক ইউনিট তৈরি করবে সরকার। এই ফ্যাক্ট চেক ইউনিট সরকার সম্পর্কিত সব অনলাইন তথ্য পরীক্ষা করবে। আর তারপর গুগল, ফেসবুক, টুইটারের মতো ইন্টারনেট সংস্থা যদি সরকারের চিহ্নিত ওই কনটেন্ট সরিয়ে না দেয় তাহলে তারা ‘সুরক্ষা’ পাবে না।
এই ভাষ্যের মধ্যে একটা পরিষ্কার 'ধমকি' আছে। একে বলা যায় অনলাইন সেন্সরশিপ। প্রেস সেন্সরশিপ বললেও সত্যের অপলাপ হবে না। এমন উদ্যোগ যে নেওয়া হতে চলেছে, গত বছর অক্টোবর মাসেই সরকার সেই ইঙ্গিত দিয়েছিল। এরপরেও আমাদের বলতে হবে 'সব ঠিক হ্যায়', 'গণতন্ত্র মজবুত আছে', 'কোথাও কোনও বিপদ নেই'। কিন্তু বিপদ বুঝতে পারছে চতুর্থ স্তম্ভ। তাই কেন্দ্রের এই সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা করেছে এডিটর্স গিল্ড অফ ইন্ডিয়া। গিল্ড এক বিবৃতিতে বলেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় কেন্দ্র সংক্রান্ত কোনও পোস্ট ‘ভুয়ো’ বা ‘মিথ্যা’ বা ‘বিভ্রান্তিকর’ কিনা- এই সংশোধনীর মাধ্যমে সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চরম ক্ষমতা নিজেই নিজেকে দিল সরকার। সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে কোথাও উল্লেখ করা হয়নি, সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্টের সত্যতা যাচাই করার সরকারি পদ্ধতি বা কাঠামো কী হবে। এসবই ন্যায়বিচারের নীতির পরিপন্থী এবং সেন্সরশিপের সমতুল্য। এই সংশোধনী দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপরে গভীর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে দানবীয় বিধি আরোপ করা হয়েছে। এখনই তা প্রত্যাহার করে নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব স্টেক-হোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে সরকারকে, যাতে সংবাদপত্র ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। বিরোধীদের বক্তব্য, সরকার এই সংশোধনীর মধ্য দিয়ে মুক্ত ও স্বাধীন কণ্ঠস্বর চাপা দিতে চাইছে। গিল্ড তাই জানিয়ে দিয়েছে, ২০২১ সালেই তারা সরকারের এই ধরনের উদ্যোগের বিরোধিতা করেছিল।
আসলে, সরকার চায় এমন একটা ব্যবস্থা যেখানে বিরোধিতার মধ্যে পড়তে না হয়। তাই তারা চায় না এমন কিছু প্রকাশ পাক যাতে সরকার বিব্রত বোধ করে। সব সরকারের এটাই শাসনবিধি। যদিও এই সরকারের পক্ষে এইভাবে বুলডোজার চালানো নতুন নয়। ‘গদি মিডিয়া’ তৈরি হয়েছে মোদী শাসনে। এবার তারা ‘গোদি সোশ্যাল মিডিয়া’ তৈরি করতে চাইছে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার মনে করছে, ডিজিটাল মিডিয়ার সবচেয়ে বিপজ্জনক দিক হল ‘ফেক নিউজ’ বা ভুয়ো খবর। সামাজিক মাধ্যমে ছড়ানো অনেক ভুয়ো খবর মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে বলেও মত কেন্দ্রের। এটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই যে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ভুয়ো খবরের বাড়বাড়ন্ত। আর এটাও ঘটনা, বেশির ভাগ মানুষ এই খবরগুলোর সত্যাসত্য যাচাই না করেই তাকে অনিবার্য সত্য বলে ঠাউরে নেয়। আমরা তো জানি সেই চিনা প্রবাদ- When finger points at the moon, idiot looks at the finger.। ফলে, সত্য হারিয়ে যায় বহু কল্পনা ও জল্পনার আড়ালে। সাধারণ মানুষের কাছেও কোনও ইনস্ট্রুমেন্ট নেই এই সত্যাসত্য নির্ণয়ের। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয় কি সরকারি নিযুক্ত কোনও কমিটি বা কর্তৃপক্ষ নিরপেক্ষভাবে করতে পারে? সে কারণেই এ প্রসঙ্গে তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ ডেরেক ও' ব্রায়েনের কটাক্ষ, ‘মোদী-শাহর বিজেপি, যারা ভুয়ো খবর ছড়ানোর কর্ণধার, তারাই ফেক নিউজ নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে। আমাদের তো হাসি থামছেই না।’ কংগ্রেসের জাতীয় যোগাযোগ বিভাগের প্রধান জয়রাম রমেশ বলেন, ‘সব থেকে বেশি ফেক নিউজ প্রচার করে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি।’ প্রাক্তন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী মণীশ তিওয়ারির প্রতিক্রিয়া, 'সরকারের এই পদক্ষেপ তাদের নিরাপত্তাহীনতার প্রমাণ দিচ্ছে। এটা সেন্সরশিপ ছাড়া আর কিছুই নয়। কোনটা আসল আর কোনটা নকল, সে ব্যাপারে সরকার শেষ কথা বলবে! এটা খুব অদ্ভুত।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ২৪ ডিসেম্বর 'ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস' পত্রিকা প্রথমে একটি 'গোপন' বৈঠকের খবর প্রকাশ করেছিল। সেই খবরে বলা হয়েছিল, তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০০ (আইটি আইন)-এর ৭৯ ধারার অধীনে বিধিগুলির সংশোধনের প্রস্তাব আলোচনা করা হয়েছে এই গোপন বৈঠকে৷ আইটি আইনের ধারা ৭৯ সেই মধ্যস্থতাকারীদের একটি 'নিরাপদ আশ্রয়' প্রদান করে যারা ব্যবহারকারীর তৈরি প্রোডাক্ট হোস্ট করে এবং তাদের প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীদের ক্রিয়াকলাপের দায় থেকে তাদের অব্যাহতি দেয়। তবে এই রক্ষাকবচ মেলে যদি তারা সরকার দ্বারা নির্ধারিত নির্দেশিকা মেনে চলা হয়। এই খবরটি করা নিয়ে ওই সংবাদপত্রের সাফাই ছিল, আমরা মধ্যস্থতাকারী দায়বদ্ধতার নির্দেশিকাগুলির সংশোধন সংক্রান্ত সরকারি কর্মকর্তা ও বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিনিধিদের এই ব্যক্তিগত বৈঠক সম্পর্কে জানার পরে খসড়া নিয়মগুলির একটি সম্পূর্ণ অনুলিপি হাতে পেয়েছি। আর এ সবটাই করা হয়েছে, কারণ সেখানে জনস্বার্থ যথেষ্ট ঝুঁকিতে ছিল। মজার কথা, সেদিন প্রথমে, ইলেকট্রনিক্স ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রক এই জাতীয় কোনও বৈঠক এবং প্রস্তাবিত পরিবর্তনগুলির বিষয়ে কোনও খসড়া তৈরি হয়েছে বলে স্বীকার করেনি। তারপর নানা কারণে, বিশেষ করে করোনা অতিমারির কারণে, গোটা ব্যাপারটা চাপা পড়ে গিয়েছিল। এখন গা-ঝাড়া দিয়ে উঠেছে ও বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছে। উঠেছে প্রতিবাদ ও সমালোচনা। এখন দেখার, সত্যান্বেষী কোন পথে হাঁটে। মনে রাখতে হবে, মিথ্যের একটা অমোঘ শক্তি আছে সত্যকে কব্জা করার! তাই সত্যের সত্যতা নির্ণয় যেমন জরুরি, তেমনই কঠিন।
এক বন্ধু ফেসবুকে পোস্টিয়েছেন একটি কবিতা, যার শেষের তিনটি পঙক্তি এরকম: 'সুতোকাবাবের মাতন ধোঁয়ায় গহরজান/ শুনতে শুনতে কী যেন হচ্ছে, আইটি সেল,/প্রোপাগাণ্ডীবে ছিলা টঙ্কার... গরল ভেল'। বেশ তাৎপর্যময়। তাঁর কটাক্ষ, ভুয়ো খবরের জোগানদারের হাতে তবে কি এখন থেকে সত্যাসত্য নির্ধারণের দায়িত্বভার!
No comments:
Post a Comment