Thursday 9 May 2024

‘একটু পা চালিয়ে, ভাই…’

দেশান্তরই এখন চালিকাশক্তি!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

এখনও নাকি ওরা গুলতানি মারে, দীর্ঘশ্বাস ফেলে; সান্ধ্য গোদি-টিভি’র জলসায়, সুখী মধ্যবিত্তের নিরিবিলি গৃহ অবসরে, অলস বৃদ্ধকুলের চায়ে পে চর্চায়, আধ-চোখ বোজা হতাশ যুবকের সোশ্যাল মিডিয়া’র পাতায়। আরও যেন কোথায় কোথায়। বলে, রাজ্যে কর্মসংস্থান কই; শিল্প কই; বিনিয়োগ কই! কে তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে যে, আজকের কর্মসংস্থান আর ভূ-নির্দিষ্ট নয়; কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স’এর বর্তমান যুগে শিল্পের সঙ্গে কর্মসংস্থানের কোনও প্রত্যক্ষ যোগ নেই; বিনিয়োগের চরিত্র আজ বহুধা বিচিত্র, তার নানান আকার-প্রকার, অতএব, তার গতিবিধিও উথাল-পাথাল। ফলে, চোখকান খোলা, তথ্যনিষ্ঠ, আধুনিক যুবকটি ঠিকানা খুঁজে নিচ্ছে, হয়তো কতকটা আপাত ঠিকঠাক। আমূল বদলে গেছে বিশ্ব। তার ভালমন্দের বিচারও চলবে! কিন্তু বাস্তব বদলগুলির দিকে চোখ ফিরিয়ে থাকার অর্থ আত্মঘাত।



৭ মে ২০২৪- রাষ্ট্রসংঘের The International Organization for Migration (IOM) প্রকাশ করল World Migration Report 2024চমক জাগানো এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে ভারত, মেক্সিকো ও চীন ছিল প্রবাস থেকে নিজ দেশে অর্থ আসার তালিকার শীর্ষে। ২০২০ সালে ভারতে যেখানে ৮৩ বিলিয়ন ডলার ‘প্রবাসী অর্থ’ (remittances) ঢুকেছিল, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১১১ বিলিয়ন ডলারে। সামগ্রিক ভাবে, ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রবাসী অর্থ বা remittances ১২৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৮৩১ বিলিয়ন ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রায় ৬৫০ শতাংশ। প্রতিবেদনের মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই বিপুল প্রবাসী অর্থের সঞ্চালন জিডিপি’র বৃদ্ধিতে সহায়তার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক দেশান্তরের এই বিপুল প্রবণতাকে প্রতিবেদনটি বলছে, আজকের অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের চালিকাশক্তি। উল্লেখ্য, ৮৩১ বিলিয়ন ডলারের এই প্রবাসী অর্থের মধ্যে ৬৪৭ বিলিয়ন ডলার ঢুকেছে শুধুমাত্র নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশগুলিতে। তবে প্রতিবেদনে এও স্বীকার করা হয়েছে যে, দেশান্তরের সমস্ত পর্বটা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়, কারণ, বহু মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে, সহিংস উচ্ছেদের বলি হয়ে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। তাদের সংখ্যাও কম নয়- সারা বিশ্বে বর্তমানে ২৮.১ কোটি দেশান্তরীদের মধ্যে আনুমানিক ১১.৭ কোটি মানুষ এই বাধ্যত দেশান্তরের শিকার।

কিন্তু যে দেশান্তরগুলি অর্থনৈতিক বিচারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটেছে, তার ফলাফল কিন্তু সাড়া জাগানো। IOM’এর একটি ম্যাপে দেখাচ্ছে, সংযুক্ত আরবশাহী, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবে যথাক্রমে ৩৪.৭ লক্ষ, ২৭ লক্ষ ও ২৫ লক্ষ প্রবাসী ভারতীয় বসবাস করছেন। বলাই বাহুল্য, দেশে মোট প্রবাসী অর্থ আসার ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বে সবার শীর্ষে; এবং প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে ভারতে আসা এই অর্থের পরিমাণ ৫৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১১১.২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ভারতের পরে ক্রমানুসারে যে চারটি দেশে সব থেকে বেশি প্রবাসী অর্থ প্রবেশ করেছে সেগুলি হল: চীন, মেক্সিকো, ফিলিপিন্স ও ফ্রান্স; যদিও এই দেশগুলি নিজেদের মধ্যে নানা সময়ে ক্রম বদল করেছে কিন্তু ভারত সদাই শীর্ষে থেকেছে। অন্যদিকে, ২০১০ সাল ও পরবর্তী সময়ে যে দেশগুলি থেকে প্রবাসী অর্থ নির্গত হয়েছে তার শীর্ষে সব সময়েই থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২০২২ সালে যার মোট পরিমাণ ছিল ৭৯.১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, বিশ্ব অর্থনীতি আজ দেশকালের সীমানা পেরিয়ে যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে এমন এক অবয়ব পেয়েছে যেখানে শ্রমের অবাধ যাতায়াত যেন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়ার মতোই সাবলীল ও অনায়াস; ফলে, যেখানে যে দেশে কাজের সুযোগ ও মজুরি বেশি, শ্রমিক ও শ্রম সেদিকেই বইতে চাইছে। ২০২৩ সালে আমাদের দেশে প্রবাসী অর্থ ঢুকেছে ১২৫ বিলিয়ন ডলার যা জিডিপি’র ৩.৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে কেরল রাজ্যের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সারা বিশ্বে ১৮২টা দেশে কেরল থেকে দেশান্তরী হয়ে কাজ করছেন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। ইতিমধ্যে দাবি উঠেছে রাজ্য স্তরে ‘প্রবাস মন্ত্রক’ তৈরির এবং তেলেঙ্গানা, হরিয়ানা ও ঝাড়খণ্ডের মতো কিছু রাজ্যে তা গড়ে তোলার কাজও শুরু হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।

এই বাস্তবতা সম্ভব হয়েছে মূলত দুটি কারণে। এক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স’এর ব্যাপক প্রয়োগের ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং ও পরিষেবা ক্ষেত্রের সংগঠিত পরিসরে শ্রমের চাহিদা প্রায় ফুরিয়েছে। অর্থাৎ, ‘শিক্ষিত’ ও ‘দক্ষ’ শ্রমের অধিকাংশ কাজগুলি যন্ত্রই করে দিতে সক্ষম। দুই, ধনী দেশগুলিতে গড় বয়স বেড়ে যাওয়া ও নানাবিধ কারণে বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রে ব্লু-কলার বা কায়িক শ্রমের অভাব বেশ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। একেক দেশে তা একেকরকম। যেমন, মরিশাসে নারকেল-কুড়োনো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ যার মজুরি বার্ষিক ৪.৫ লক্ষ টাকা, সঙ্গে বিনামূল্যে থাকার জায়গা ও কাজের সময় ফ্রি মিল। প্রচুর ভারতীয় এই কাজগুলিতে যোগ দিয়ে সচ্ছল আয় করে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। এছাড়াও, এই মুহূর্তে যে কাজগুলির চাহিদা বেশ তুঙ্গে: জার্মানিতে ফিটার, জাপানে কসাই, অস্ট্রিয়াতে প্লামবার ও রাশিয়াতে লিফট অপারেটর। এইসব কাজের খোঁজ এনে, উৎসাহী লোকজনদের প্রশিক্ষিত করে, তাদের ভিসার বন্দোবস্ত করে দেশান্তরের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। মহারাষ্ট্র, গোয়ায় এই ধরনের কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে যাদের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা ও সরকারি প্রতিষ্ঠান জুড়ে গিয়ে কাজটাকে গতি দেওয়ার চেষ্টা করছে।

এই কাজগুলি সম্পর্কে একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন (The Great Indian Outplacement) ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় ৫ মে ২০২৪’এ প্রকাশ পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, হরিয়ানায় যে স্বাস্থ্যকর্মী মাসে ৮ হাজার টাকা রোজগার করতেন, তিনি জাপানে গিয়ে একই কাজে মাসিক ১ লক্ষ টাকা কামাচ্ছেন। গুরগাও’তে যে ব্লু-কলার শ্রমিক মাসে ২০ হাজার টাকা কামাচ্ছিলেন, তিনি দুবাই’তে গিয়ে বাউন্সার হিসেবে পাচ্ছেন ১.৫ লক্ষ টাকা। আগে আমরা NRI বলতে জাঁদরেল, পয়সাওলা ব্যবসায়ী অথবা উচ্চ-চাকুরে কিংবা উদ্যোগপতি লোকজনদের যে ছবিটা কল্পনা করতাম তা আজ পালটে যাচ্ছে ব্লু-কলার NRI’র গল্পে। এখন ধনী দেশগুলিতে দরকার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাড়ির চালক, বাউন্সার, স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, প্লামবার, বেবি-সিটার, কেয়ার-গিভার, কুকুর-হাঁটানো ব্যক্তি, পাচক, রেস্টুরেন্টের বয়, বাগান পরিচর্যাকারী, রাজমিস্ত্রী এবং আরও বিবিধ ও বিচিত্র কর্মের শ্রমবাহিনীর। এর জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষা তেমন প্রয়োজনীয় নয়, দরকার কিছু কর্মের প্রশিক্ষণ ও স্ব স্ব দেশের আচার-বিচার সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বোধগম্যতা ও মান্যতা।

অতএব, যে সমস্ত বিরক্তিকর প্রাচীনপন্থীরা নিজ গ্রামে, শহরে বা রাজ্যে অথবা দেশে যাবতীয় কর্মসংস্থানের অলীক রূপকল্প তৈরি করেন, তাঁরা ভুলে যান যে কোনও একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক প্রাঙ্গণে দুনিয়ার যাবতীয় কাজের হাব আজ তৈরি হতে পারে না। কর্মের প্রক্রিয়া আজ বিশ্বজোড়া- তার মুড়োটা যদি বিশ্বের উত্তর প্রান্তে থাকে, ল্যাজাটা হয়তো পূব প্রান্তে। বড় বড় শিল্প আজ আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে না, তারা যন্ত্র দিয়েই কাজ সারে। যে পরিষেবা ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কিং ও বিমা ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা গত ৭০ বছরে, সর্বোপরি, তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গত ৩০ বছরে এক বড় মাপের কর্মসংস্থানের আয়োজন করেছিল, তাদের নিয়োগ গতিও যন্ত্রের দাপটে আজ অস্তমিত। তাই বলে, এমএ পাশ করে চাকরি না পেয়ে অটোরিকশা টানার গ্লানি সহ্য করতে হবে? তা কেন? নিজেকেই জিজ্ঞেস করতে হবে, বিএ, এমএ সত্যি সত্যিই পাশ দেব কেন? চাকরির জন্য নাকি নিজের জ্ঞান, পাণ্ডিত্য অথবা নিছক ডিগ্রি অর্জনের জন্য? যদি দ্বিতীয়টা হয়, তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। যারা বাবু ও পণ্ডিতদের কাজ দেবেন, তারা বিচার করে দেখবেন, অত সহস্র বাবু ও পণ্ডিত সত্যি সত্যিই আজ আর লাগে কিনা! আর যদি প্রথমটা হয় (চাকরি), তাহলে বুঝতে হবে, আজ আর বেশি পড়াশোনা বা অধিক ডিগ্রিতে কাজ নাই! কিন্তু আচারে আছে, গরিব বামুন ভিক্ষা করবে, তবুও কায়িক শ্রমে ‘হাত নোংরা করবে না’। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে কায়িক শ্রম হীন, ঘৃণ্য। তাই, ‘বাবুগিরির কাজ’ না পেলে বামুন ও উচ্চজাতের যত আক্ষেপ আর বিলাপ! অবশ্য, যারা ফাঁকতালে দেশান্তরী হচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের লোটা-কম্বল বিসর্জন দিয়ে দিব্যি সেখানে গাড়ি চালাচ্ছেন অথবা রেস্টুরেন্টে বাসন মেজে আয় করে ‘প্রবাসী অর্থ’ দেশে পাঠাচ্ছেন। শুধু দেশের লোকেরা জানেন না, তাঁদের ছেলে বা মেয়ের কাজটা ঠিক কী!

বিশ্ব জুড়ে মজুরি সমস্যাই আজ সব থেকে বড় সমস্যা। উচ্চ মজুরির টানেই দেশান্তর। কারণ, পুঁজিবাদের পুরনো ফরম্যাটে যে স্থানিক কারখানা-ভিত্তিক সংগঠিত ব্যবস্থা ছিল, যেখানে এক শেডের তলায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, তার আজ অবসান হয়েছে। সে জায়গায় এসেছে বিশ্বায়িত ডিজিটাল গ্লোবাল ফরম্যাট, যেখানে যন্ত্রই আজ প্রায় সমস্ত কাজের ধারক ও বাহক। মনুষ্য শ্রমের কতটুকুই বা প্রয়োজন আর? কাজের স্থানিক চরিত্রও অতএব উধাও। যা থাকছে তা অসংগঠিত ক্ষেত্রের এমন শ্রমের চাহিদা, যেখানে যন্ত্র এখনও পারদর্শী নয়; যেমন, সুস্বাদু রান্না অথবা অসুস্থ মানুষের শুশ্রূষা, এই কাজগুলিতে (পাচক অথবা স্বাস্থ্যকর্মী) যান্ত্রিক নিপুণতার থেকেও আরও বড় প্রয়োজন পরিপাট্য ও মানসিক সান্নিধ্য। অতএব, শ্রমও ছুটছে কাজের নতুন আঙিনা ও চাহিদায়। মূলত কায়িক শ্রমই এখন দেশান্তরের চালিকাশক্তি। তাতে স্ব স্ব দেশ, রাজ্য ও গ্রাম বা শহরের সার্বিক লাভও হচ্ছে।

   

Sunday 5 May 2024

'নিস্তব্ধ করিয়া দিব মুখরা নগরী'

'মজবুত' কেন্দ্র বনাম আমার অঙ্গ রাজ্য

মালবিকা মিত্র



বেশ মনে আছে, আমাদের এক বন্ধু সহ-শিক্ষক, চন্দ্রশেখরকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি কখনও। কেমন যেন খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ঠিক প্রধানমন্ত্রী মানায় না। একবারও ভেবে দেখেননি যে, খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ছিলেন প্রায় চন্দ্রশেখর সদৃশ্য। একইরকম মনোভাব প্রকাশ করত ট্রেনে আমার সহযাত্রী এক শিক্ষিকা। সে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদিকে দেখে বলেছিল, এতদিনে একটা মানানসই ফিগার, মুষ্টিবদ্ধ হাত, পেশীবহুল কাঁধ, 'না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা' পাওয়া গেল- এইরকম প্রধানমন্ত্রীই তো চাই। মনমোহন সিং কেমন যেন মিনমিনে, দাদু-দাদু সুলভ। আসলে, শাসক সম্পর্কে কল্পনায় বিরাজ করে পরাক্রমশালী, দীর্ঘ দেহী, বলিষ্ঠ বাহুর ছবি। সেই ছবিতে কখনই দয়াশীল, স্নেহশীল কর্তব্যপরায়ণ হরিশচন্দ্র বা যুধিষ্ঠির মার্কা ভাবমূর্তি গড়া হয়নি। 

লক্ষ করবেন, রাজা রামচন্দ্রের সৌম্য শান্ত স্থিতধী মূর্তিটি বহুদিন হল বিদায় নিয়েছে। পরিবর্তে রাম রাজ্যের রামের চেহারা বদলে গেছে--  বলিষ্ঠ বাহু, চওড়া কাঁধ, সরু কোমর, সিক্স-প্যাক মার্কা রামের ছবি চিত্রিত হচ্ছে। এমনকি ভুঁড়ি সর্বস্ব ভোলানাথ বাবার 'শ্মশানে থাকে গায়ে ভস্ম যে মাখে' ছবিটাও পাল্টে গিয়ে ইদানীং জিম থেকে বেরিয়ে আসা সিক্স-প্যাক'এর শিব মূর্তি খুব প্রাধান্য পাচ্ছে। মানুষের মধ্যে শাসক ও প্রভু সম্পর্কে একটা ভিন্ন ভাব জাগানোর জন্য ফিজিক্যালি একটা ভিন্ন মূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। শক্তি ও ক্ষমতা যার মূল কথা। শাসককে হতে হবে শক্তিশালী, বলিষ্ঠ, নির্দয়। 'ঠোক দো শালেকো'..., 'গোলি মারো শালেকো'..., 'এনকাউন্টার স্পেশাল'..., 'বুলডোজার বাবা'-- এই মনোভাবের সঙ্গে আমাদের 'এক দেশ এক ধর্ম এক ভাষা এক নেতা'র মানানসই চেহারাটা অবশ্যই নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির সঙ্গেই খাপ খায়। রাহুল সাবালক হল না, অরবিন্দের মাফলার সমস্যা ঘুচল না; আর যদি নেতা নারী হয়, তবে তো কথাই নেই। মমতা ও হাওয়াই চটি, মমতার পা ভাঙা এসব নিয়ে কত গল্প। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মুকেও সটান দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। এমনই এক শক্তির প্রতীক তিনি। 

এর বিরুদ্ধে আপনি কি বিকল্প এক জন আব্রাহাম বা সলমন খান খুঁজবেন? নাকি আপনাকে শাসক সম্পর্কে ধারণাটা পাল্টাতে হবে। ভিন্ন আখ্যান রচনা করতে হবে। আসুক রাজা হরিশচন্দ্র, রাজা গোবিন্দ মানিক্য, তবে তো নতুন আখ্যান তৈরি হবে। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি পেশি বহুল ছাতিকে মোকাবিলা করতে আটান্ন ইঞ্চি ছাতি খুঁজবেন? পারবেন ধূর্ততা ও চালাকির দ্বারা মানুষকে কিছু উত্তরবোধক প্রশ্ন দিয়ে নিজের কথা বলিয়ে নিতে? যিনি তা করছেন তাকে সুবক্তা বলবেন? হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা, আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে নিত্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে নিয়ে সংযুক্তি তৈরি করা ও তার সমাধানের রাস্তা খোঁজা- সেটা যিনি পারেন তিনি সুবক্তা নন? কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, বিজেপি বিরোধী দলগুলিও আজ মঞ্চে ভাষণ দিতে গিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে মোদিসুলভ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মানুষকে কিছু বলানোর চেষ্টায় রত। 

মোদির বিরুদ্ধে উপযুক্ত বিকল্প হতে গিয়ে শরীরচর্চা, টি-শার্ট, একমুখ দাড়ি-- এসবের মধ্য দিয়ে 'পাপ্পু' নাম ঘোচানোর চেষ্টা অর্থহীন। বরং 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র মধ্য দিয়ে যে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় রাহুল গান্ধী করেছিলেন, সেটাই তাঁকে ভিন্ন আখ্যান রচনায় সাহায্য করেছিল। 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র পর রাহুল গান্ধীর যে সাক্ষাৎকার, পরিণতমনস্ক কথাবার্তা, তা যেন হঠাৎই ভোটের প্রতিযোগিতায় কোথাও হারিয়ে গেল। ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রেম-প্রীতি-ইনসানিয়াৎ'এর রাজনীতির সেই স্লোগানটাই আর দেখতে পাই না। 

আখ্যান রচনার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় দল হিসেবে কংগ্রেস সর্বভারতীয় স্তরে দীর্ঘদিন প্রাধান্য করেছে। এমনকি সেই মধ্য গগনে সূর্যের দিনগুলিতে কংগ্রেস সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে শক্তিশালী কেন্দ্র গঠন করার চেষ্টা চলছে। দেবকান্ত বড়ুয়ার সেই উক্তি এখনও অনেকেরই মনে আছে- 'ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা।' আমার মনে হয় না, বিজেপির 'এক দেশ এক দল এক ধর্ম এক নেতা' আখ্যানকে প্রতিহত করার জন্য কংগ্রেস উপযুক্ত। কারণ, সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসের মধ্যেও এই প্রবণতাগুলি ছিল এবং ভবিষ্যতেও পুনরায় দেখা দেবে। সম্প্রতি কর্নাটক নির্বাচনের পরেও সেই মনোভাব দেখা দিয়েছিল। আজ যে ৩৭০ ধারা নিয়ে এত  শোরগোল চলছে, মনে রাখতে হবে, কংগ্রেস শাসনে ধারাবাহিকভাবে এই ৩৭০ ধারার ক্ষয় ধরানো হয়েছে অন্তত ৫৬টি সংশোধনীর মাধ্যমে। কংগ্রেস শাসনেই তো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নয়/ বারোটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও নেতারা বিভিন্ন সময় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন রাজ্যের অধিকার রক্ষার দাবিতে। ফলে, মোদি'র অমিতবিক্রম পেশীবহুল ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে দাঁড় করানো যাবে না। কারণ, সেই মূর্তির আপাত জরাজীর্ণ অবস্থা হলেও ভেতরের খড়ের কাঠামোটি একইরকম। বরং আঞ্চলিক শক্তিগুলি তার নিজস্ব আঞ্চলিক সত্তা, স্বতন্ত্র স্বপ্ন, আবেগ, ভিন্ন রুচির অধিকার, এগুলিকে সযত্নে লালন করে শক্তিশালী, একমাত্রিক স্বরকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে নিজেদের স্বার্থেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ভিন্ন স্বর সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। তা না হলে সংসদীয় শাসন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সবই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। দেখাও গেল, একটি স্টিং অপারেশনে বিজেপি'র স্থানীয় মণ্ডল সভাপতির স্বীকারোক্তিতে, সন্দেশখালি'তে কীভাবে 'মহিলা নির্যাতনের' অভিযোগগুলিকে নির্মাণ করা হয়েছিল। 

বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যখন বাংলা ও বাঙালির স্বার্থের কথা বলেন, সেটা চটকদারি ভোটের ফায়দা শুধু নয়, অতি কেন্দ্রিক দানবীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক, ক্ষুদ্র এককের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার স্লোগান। শুধু বাংলা নয়, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, কেরল, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, কাশ্মীর এই সমগ্র আঞ্চলিক এককগুলির পক্ষে যা একান্ত জরুরি। অন্যথায় আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান বিপন্ন হতে বাধ্য। আঞ্চলিক দল ও শক্তিগুলির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটা আজ জরুরি চাহিদা ও শর্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, বৃহৎ এককের চাপের সামনে ক্ষুদ্র এককের লড়াইয়ে ক্ষুদ্র একক বৃহৎ এককের অনুরূপ কৌশল অনুকরণ করছে। আম আদমি পার্টি সর্বভারতীয় হয়ে উঠতে চাইছে। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস অল ইন্ডিয়া তৃণমূল হতে চাইছে। সিপিআইএম যতই আঞ্চলিক শক্তি হোক না কেন নিজেকে সর্বভারতীয় শক্তি হিসেবেই দেখে। ফলে, শক্তিশালী কেন্দ্র, এক দেশ, এক দল, এক নেতার বিপরীতে ভিন্ন ভাষ্য বা আখ্যান তৈরি হচ্ছে না; যে আখ্যান আঞ্চলিকতার কথা বলবে, বৈচিত্র্যময় ভারতের কথা বলবে, বিবিধের মিলনের কথা বলবে। 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাটাই মনে পড়ছে- 'ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান, তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ, কোন নর লজ্জা পায়?' শক্তিশালী কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিকল্প শক্তিশালী কেন্দ্র হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। জনমত যাচাই করলে তাই নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের পক্ষে এখনও ৬৭ শতাংশ মানুষ সমর্থন দেয়। কিন্তু একবারও কি আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য, আমার ভাষা, আমার পোশাক, আমার খাদ্যাভ্যাসের উপরে কোনও জনমত যাচাই হয়েছে? আমি নিশ্চিত সেটা হলে শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে অবশ্যই ৬৭ শতাংশ সমর্থন জুটত না। দুঃখজনক বিষয় হল, একদা কংগ্রেসের সুদিনে ইন্দিরা গান্ধী শক্তিশালী কেন্দ্র ও স্থায়ী সরকার গড়ার গ্যারান্টি দিয়ে ভোটে জিতেছেন। আবার পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরাও স্থায়ী সরকারের স্লোগান দিয়েছে নিজের রাজ্যে। ফলে, বিকল্প ভাষ্য ও আখ্যান তৈরি হল না। যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতিটা সঠিকভাবে অনুশীলন করাই হল না। কেবলই শক্তিশালী কেন্দ্রের অনুশীলন। আজ মোদি যেটা খোলামেলা ভাবে ডাবল ইঞ্জিন সরকার বলছেন, বাস্তবে ব্যবহারিক অনুশীলন কংগ্রেস জমানাতে তার সূচনা। 

খবরের কাগজে দেখলাম, মে মাসের ৩ তারিখে কলকাতায় উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী অধ্যাপকদের এক সভায় পরকাল প্রভাকর স্মরণ করিয়ে দেন, ওই তারিখটিতে মনিপুরের জাতি দাঙ্গার বীভৎসতা ও হিংস্রতার এক বছর পূর্ণ হল। আরও মনে করান যে, মনিপুরে ডবল ইঞ্জিন সরকার। তিনি বলেন, এবারের ভোট খুব ভেবে চিন্তে না দিলে ভবিষ্যতে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে এখনকার রূপে আর দেখা যাবে কিনা তা নিয়েই আশঙ্কা আছে। মনে রাখবেন, সভাটি ছিল উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত অধ্যাপকদের সভা। সেই সভায় একজন শ্রোতা প্রশ্ন করেন, কেন্দ্রে মজবুত সরকার গঠিত না হলে বিনিয়োগ আসবে কীভাবে? অর্থনীতির ভিত শক্ত হবে কীভাবে? পরকাল প্রভাকর জবাব দেন, মজবুত সরকার ও আর্থিক মাপকাঠিগুলি ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও গত ১০ বছরে বিনিয়োগকারীরা হাত খোলেননি, জিডিপি'র নিরিখে সঞ্চয় তলানিতে ঠেকেছে, কমেছে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি। 

বোঝা গেল, উচ্চবর্গের চেতনাতেও একটি লোমশ মজবুত পেশীবহুল কেন্দ্র বিরাজ করে। প্রভাকর যখন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তখন পণ্ডিত প্রশ্নকর্তা মজবুত সরকার ও বিদেশি লগ্নি নিয়ে চিন্তিত। পশ্চিমবঙ্গের একজন বামপন্থী নেতা বলতেন, সরকারটা যদি জনবিরোধী, পশ্চাতে বাঁশ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেটা কম মজবুত, কম স্থায়ী, ভঙ্গুর হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এবারের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির পেশীবহুল শক্তিশালী কেন্দ্রের বিপরীতে আঞ্চলিক রাজনীতির প্রচার ও উত্থান সম্ভব ছিল। শেষাবধি কত দূর তার বাস্তবায়ন হবে, ভবিষ্যৎ সে কথা বলবে।