Monday 30 July 2018

একটি সংলাপ


যদুবংশ ধ্বংসের প্রকল্প
যাদববন্ধু


একান্ত আলাপে প্রথম ও তৃতীয় পাণ্ডব)

প্রঃ পাঃ - কবেই বরিষ্ঠ দুই মুনি যদুবংশ ধ্বংসের অভিশাপ দিয়েছেন, আজও ব্যাটারা দিব্যি বেঁচেবর্তে আছে। অর্জুন, তোমারই ওপর তো দায়িত্ব ছিল তাদের ধ্বংসপর্বের তত্ত্বাবধান এবং শেষপর্যন্ত একেবারে তাদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করার। তবেই না আমরা নিশ্চিন্ত হয়ে স্বর্গারোহণ করতে পারি! হে কুশলী সব্যসাচী, এই কাজটুকু তুমি করে উঠতে পারছ না?
তৃঃ পাঃ – এটা যে ঘোর কলি, মহারাজ! আমার ক্ষমতা আগের চেয়ে অনেক খর্বিত।
প্রঃ পাঃ – তোমার সখা পার্থসারথি মানে কৃষ্ণই বা কি করছে? সে তো যাদবদেরই মধ্যে অবস্থান করে! ভেতর থেকে ভাঙন ধরাতে পারছে না?
তৃঃ পাঃ – বললাম না, ঘোর কলি! সেই বিশ্বামিত্র, নারদদের যুগে যা হতে পারত তা আজ চট করে হবে কেন! স্থান, কাল, পাত্র সবই বদলে গেছে। হায়, কোথা সে দ্বারকা, কোথা সে দ্বাপর যুগ, আর কোথা সেই বীর যাদবরা যারা নিজেদের মধ্যে মুষলযুদ্ধ করে পট পট মরে গেল! তাছাড়া, এযুগে আসলে পার্থসারথিও তো আমি, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নয়মানে আমাকেই চালাতে হয় বাসুদেবকে। বড়ই মেদামারা হয়ে গেছে ভগবান
প্রঃ পাঃ – তুমি পার্থ, আবার তুমিই পার্থসারথি? ও, বুঝেছি - ‘পার্থের সারথি’র বদলে ‘যে পার্থ সেই সারথি’ব্যাসবাক্যটা বদলে গেছে , সমাসটাও
তৃঃ পাঃ  - কি বললেন? সমস্যা? ও না, সমাস! মানে ব্যাকরণ? বাপ রে, সেসব আমি জানি না! আপনার মত জ্ঞানার্জনের সুযোগ তো হয় নি - আচার্য দ্রোণ তীরন্দাজি ছাড়া কিছুই শেখান নি। তাছাড়া ওসব ব্যাকরণ-ট্যাকরণ আমরা এখন এমনিতেই মানি নাকিন্তু সমস্যা যদি বলেন, তার সমাধানের জন্য কি চেষ্টার ত্রুটি রাখছি! স্বয়ং কৃষ্ণ ছাড়া আরও লোক ঢুকিয়ে দিয়েছি যাদবদের মধ্যে, কিন্তু কিছুতেই সুবিধে হচ্ছে না। আজকের যাদব হতভাগাগুলো সব যুদ্ধ না করে পড়াশোনা করে, আগে যেটা শুধু ব্রাহ্মণরাই করত আর তারা সবাই আমাদের নিতান্ত অনুগত ছিল কলিযুগে এখন গণতন্ত্র চলছে তো, সকলেই বিদ্যার্থী তা বিদ্যাচর্চাই নাহয় করল - আরো কতজনই তো করছে! অন্য কত বিদ্যাস্থানে ভয়ঢুকিয়ে দিয়েছি - ছাত্রদের হাতে মুষল থুড়ি রড-লাঠি-বাঁশ ধরিয়ে তাদের যোদ্ধৃজাতিতে পরিণত করেছি, তারা নিজেদের মধ্যে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব করে প্রায়ই রণকুশলতা দর্শায়, আর দারুণ ভয়ের আবহ ঘনিয়ে তোলে যাদবরা কিন্তু কিছুতেই সেসব করবে না! জেদি, অবাধ্য সব ছেলেমেয়ে! তারা তাদের মত পড়াশোনা করবে, আমার কোনও কথা শুনবে না!
প্রঃ পাঃতবে তোউলটা বুঝলি রামহল মৌষলপর্ব এসে গেল অন্যত্র, যাদবরা দিব্যি আছে
তৃঃ পাঃ – আরও আছে অন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মুষলধারী ছাত্রনেতারা ছাত্রভর্তির জন্য শুল্ক আদায় করছে দোর্দণ্ডপ্রতাপে যাদবরা তা-ও করবে না, নতুন ছাত্রও ভর্তি করবে নিজেদের নিয়মে আমি যে আমার ছেলেদের ঢোকাব, ঢুকিয়ে প্রথম থেকে তাদের আনুগত্য আদায় করব, সে উপায় নেই আর ওদের গুরুমশাইগুলোও কম শয়তান নয় সর্বক্ষণ ছাত্রদের উশকানি দিচ্ছে! গুরু না ছাই, ঢ্যাঁটা গোরু!
প্রঃ পাঃ ওদের মুষল-রাজনীতির আওতায় আনার ব্যাপারে কেন তোমার এমত ব্যর্থতা, পার্থ?
তৃঃ পাঃ আসলে কি জানেন জ্যেষ্ঠ ভ্রাতঃ, হোগলা-ঘাস থেকে লৌহমুষল তৈরি করা যায় যাদুমন্ত্রে, যেটা অন্য অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে করতে  পেরেছি যাদবদের হাতে যে সোনার কাঠি, রুপোর কাঠি সোনা-রুপো থেকে লোহা বানানো মুশকিল
প্রঃ পাঃ - তবে যা খবর পেলাম, কিছু কিছু গোলমালের চিহ্ন যাদবদের মধ্যেও দেখা যাচ্ছে - ঐ দ্বাপরের যদুবংশের বেলায় যেমন হয়েছিল আর কি, এবং সেটা আমাদের পক্ষে শুভলক্ষণ তখন যেমন গাভীর গর্ভে গর্দভ জন্মেছিল, সারস পাখি প্যাঁচার মতো ডাকছিল, তেমনি শুনছি ইদানীং যাদবদের কোনও কোনও মান্যগণ্য অধ্যাপক বা অধ্যক্ষের লিখনে বানান বিপর্যস্ত, কারও লিপি প্রলাপের মতো পড়তে লাগে
তৃঃ পাঃ গোলমাল এমনি এমনি হয়নি, ভ্রাতঃ আমাকেই অনুসন্ধান করে, উদ্যোগ নিয়ে এমন সব রত্নপ্রভ শিক্ষক-আধিকারিক নিয়োগ করতে হয়েছে ছাত্রদের যখন কায়দা করতে পারছি না, মাস্টারদেরই চেষ্টা করি অন্যদেরও পথে আনার চেষ্টা করছি এদেরই সাহায্যে এদের দুয়েকজন নিয়মিত সোমরস পান করে এবং যথোচিত প্রমত্ত অবস্থায় গভীর রাতের নিরিবিলি অবকাশে যাদবদের জনে জনে ফোন করে আমাদের মতবাদ প্রচার করে কিন্তু তাতেও খুব কিছু সুবিধে হচ্ছে না এরা চেয়ারে সমাসীন এবং মণিরত্নভূষিতও বটে, কিন্তু তেমন দিব্যকান্তি দেখাচ্ছে না তাছাড়া এরা যাদবদের মধ্যে সংখ্যালঘুও বটে
প্রঃ পাঃ তবে শ্রীকৃষ্ণকে তুমি যা জব্বর চেয়ারখানা দিয়েছ, তাতে অনেকটা কাজ হবে বলে মনে হয় কোথায় পেলে গো এমন যাদু-কেদারা? চেয়ারে বসলে নাকি তার একরকম মতবাদ, চেয়ার ছেড়ে উঠলে আরেক রকম! সেদিন নিজেই দেখি ছাত্রদের সে কথা বলছে মানে বলতে চাইছে চেয়ারের বাইরে আমি যাদবদের স্বাধিকারে বিশ্বাসী, চেয়ারে থাকলে ক্ষমতার অনুগত আমি প্রথমে ভেবেছিলাম ঐ আজকাল কিসব বলে না - বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা স্কিটজোফ্রেনিয়ার মত কোন অসুখে ভুগছে বেচারা বাসুদেব ওর অসুস্থতার কথা ক’দিন ধরেই শুনছিলাম তা নারদমুনি সেদিন এসেছিলেন অনেকদিন বাদে, বললেন - না, ওটা চেয়ারেরই যাদু উনি আবার ঢেঁকি, চেয়ার ইত্যাদির যাদুকরণের ব্যাপারগুলো ভাল বোঝেন
তৃঃ পাঃ কৃষ্ণের এই বর্তমান অবতার বরাবরই সুশীল কেদারারঞ্জন দাসশেষপর্যন্ত সবসময়ে ক্ষমতারই দিকে সম্প্রতি ভর্তি নিয়ে আমাদের আদেশ লাগু করতে যে ব্যর্থ হল, তা নিয়ে বেচারা খুবই মুষড়ে পড়ছে কিন্তু ওর আরেকটু ডাকাবুকো হওয়া দরকার ছিল সুদর্শন চক্রটাই খুইয়ে বসে আছে - সকলের চোখের সামনে দিয়ে আকাশে উড়ে চলে গেল! চেয়ারের কি আর চক্রের মত জোর আছে! এর আগে তবু আরেক অবতার কেদারানাথ নিজে হাতে না পারলেও পুলিশ ডেকে যাদবদের বেশ করে ঠেঙিয়ে দিয়েছিল
প্রঃ পাঃ তার কথা আর বোলো না সে তো আমাদের মুখ পোড়ালো! যাদবরা স্রেফ কলরোল করে তাকে তাড়িয়েই ছাড়ল
তৃঃ পাঃ তা ঠিক তবে কেদারানাথদের একটু শক্তপোক্ত না হলে চলে, যতই যাদু-কেদারা হোক!
প্রঃ পাঃ আচ্ছা, তোমার সখা কেদারারঞ্জনকে বল, এরপর আর কিছু না পেলে চেয়ারের হাতল খুলে নিয়ে ছাত্রদের পেটাতে
তৃঃ পাঃ দেখা যাক, এরপর কবে কিভাবে সুযোগ আসে অপেক্ষায় আছি
প্রঃ পাঃ আমি কিন্তু ভয় পাচ্ছি মুনিরা অভিশাপ ফলছে না দেখে শেষে আমাদেরই না অভিশাপ দেয় যুগন্ধর মুনি, যুগপতি মুনির প্রভূত তপস্যাবল
(দরজায় করাঘাত, দৌবারিকের প্রবেশ এবং প্রথম পাণ্ডবের হাতে একটি পত্র প্রদান)
দৌবারিক – মহামান্য মহারাজাধিরাজ দূত পাঠিয়েছেন, মাননীয় মহারাজ
প্রথম পাণ্ডব চিঠিটি পড়তে লাগলেন, তাঁর মুখমণ্ডল ক্রমশ গম্ভীর ও ভ্রুযুগল কুঞ্চিত হয়ে উঠতে লাগল। পড়ে নিয়ে তিনি তৃতীয় পাণ্ডবকে বললেন – মহারাজাধিরাজ যাদবদের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানিয়েছেন। বলে পাঠিয়েছেন – তাদের ওপর কড়া নজরদারির ব্যবস্থা হচ্ছে এবং তাদের বাধ্যতামূলক কেন্দ্রীয় কর্মসূচির আওতাতেও আনা হচ্ছে। কৃষ্ণের জীবনী লেখার জন্য যাদবদের ইতিহাস বিভাগ, তাঁর জন্মস্থানের সঠিক ভূগোল নির্ণয়ের জন্য ভূগোল বিভাগ ও মন্দির নির্মাণের জন্য সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে আদেশ দেওয়া হচ্ছে। এসবের জন্য সহস্রকোটি স্বর্ণমুদ্রা তাদের অনুদানও দেওয়া হবেতিনি আশা করেন, মুদ্রার বিনিময়ে তাদের আনুগত্য সুনিশ্চিত করা যাবে। আর তাতে তারা অস্বীকৃত হলে তাদের ধংস ত্বরান্বিত করার উপযুক্ত অজুহাতও মিলে যাবে। আরো বলে পাঠিয়েছেন যে, তিনি নাকি শুনেছেন আমরা মাঝে মাঝেই শিক্ষাগুরুদের গোরু বলে গোমাতাদের অপমান করে থাকি। এ ব্যাপারে তিনি আমাদের সাবধান করে দিয়েছেন, বলেছেন এতে ফল ভাল হবে না।
শুনতে শুনতে তৃতীয় পাণ্ডবের মুখমণ্ডলও রক্তবর্ণ হয়ে উঠল, কিন্তু দ্রুত মুখে শান্ত ভাব এনে তিনি দৌবারিককে বললেন – মহারাজাধিরাজের দূতকে বলে দাও, আমাদের প্রশাসনে যেন তিনি নাক না গলান। আমরা আমাদের মাধব, যাদব, গো-গর্দভদের নিয়ে কি করব সেটা আমাদের ব্যাপার। তিনি যেন মনে রাখেন এটা গণতন্ত্র এবং আগামী নির্বাচনে নিজেই তিনি ধ্বংস হতে যাচ্ছেন। যাদবদের ধ্বংসের ভার নাহয় আমাদের হাতেই ছেড়ে দিন।
দৌবারিক – যথা আজ্ঞা, মহারাজ!
(দৌবারিকের প্রস্থান)

প্রঃ পাঃ – পার্থ, এটা কিন্তু চিন্তার বিষয় হল। আমরা মুষল-কৌশলে যা পারি নি, এরা না মুদ্রারাক্ষসের সাহায্যে সেটা করে ফেলে! অর্থবাণেই যাদবদের বধ থুড়ি বশ করে ফেলবে হয়ত!
তৃঃ পাঃ – চিন্তা করবেন না মহারাজ। আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করছি। নতুন কোন কৌশল ঠিক বের করে ফেলব।
প্রঃ পাঃ – তাড়াতাড়ি কর। আমাদের স্বর্গারোহণ পর্বটা বড্ড পিছিয়ে যাচ্ছে।

                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                                      

Saturday 21 July 2018

নির্বিকার শাসক


মেডিকেল ছাত্রদের কোনও অঘটন ঘটলে সরকার দায়ী থাকবে
ডাঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য



কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ৬জন ছাত্র শনিবার পর্যন্ত ১২ দিন ধরে অনশনে অনড়। পরে এদের সাথে যোগ দিয়েছে আরও ১৫ জনসব মিলিয়ে ২১জনএবং আজ ২১শে জুলাই

অনশন শুরু হবার পরে তিন বার কলেজের প্রিন্সিপাল বদল হয়েছেএকজন দুদিনের জন্য ছিলেনকিন্তু হস্টেল সমস্যা নিয়ে ছাত্রদের যে দাবি সে বিষয়ে কোনও সমাধানসূত্র এখনও অধরানির্বিকার প্রশাসনআজও ডিএমই-র ছাত্র প্রতিনিধিদের আলোচনায় বলা হয়েছিল বেলা ১.৩০-এ ডিএমই-র প্রতিনিধি হোস্টেল নিজেরা দেখে সিট অ্যালটমেন্টের সিদ্ধান্ত নেবেনকেউ আসেননিছাত্ররা এখনও অনশনেক্রমাগত শরীর ভাঙ্গছেরক্তচাপ কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে রক্তে শর্করার পরিমাণএরা লাঠি বোমা বন্দুক নিয়ে শুয়ে নেই, নিতান্ত নিরীহ গান্ধী-অনুসৃত অনশনের পথে হেঁটেছেএদের মধ্য থেকেই ভাবী চিকিৎসকেরা জন্ম নেবেন যারা বারবার ফিরিয়ে দেবেন আর্ত মানুষের জীবনকিন্তু এরা আজ ১২দিন ধরে একটানা অনশনের পথে

আমরা কি আরেকজন যতীন দাসের খোঁজ করছি? আমরা সামাজিকভাবে এত নিস্পৃহ হয়ে পড়ছি?
ঠিক কী দাবিতে অনশন এই ছাত্রদের? গত তিন বছর ধরে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে কোনও স্বচ্ছ কাউন্সেলিং হয়নি। অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে তিন বছর কাটিয়েছে বহু ছাত্র। যে কেউ চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের জন্য মেডিক্যাল কলেজের মেইন হস্টেলে গিয়ে একবার ঘুরে আসতে পারেনকোনও কোনও ছাত্রকে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে থাকতে হয়েছে, কাউকে পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে বলা হয়েছে নিজেরটা নিজের মতো করে বুঝে নিতে। কর্তৃপক্ষ বুঝিয়েছিল নতুন নির্মীয়মাণ বিল্ডিং তৈরি হলেই কাউন্সেলিং হবে। ছাত্রদের হস্টেল সমস্যার সমাধান হবেসে প্রতিশ্রুতি আজ আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে

নতুন নাটক শুরু হয় এই বিল্ডিং তৈরি হওয়ার পরে। দেখা যায়, অ্যালটমেন্টের ব্যাপারে গত তিন বছর ধরে হস্টেল পায়নি যে ছাত্ররা বা তিনজনের ঘরে পাঁচজন থাকা ছাত্ররা কোনও অগ্রাধিকারই পাচ্ছে না। অভিযোগ ওঠে, নিজেদের ইচ্ছে মতো কর্তৃপক্ষ কোনও কাউন্সেলিং ছাড়াই হস্টেলের ঘর দেওয়া হচ্ছে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের। এমনও অভিযোগ করা হয়, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদেরও নতুন হস্টেলের ঘর পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য এমসিআই-এর নিয়মের দোহাই দিয়ে বলে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্রদের রাখা যাবে না। ছাত্ররা তখন প্রশ্ন তোলেন— তা হলে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীরা নতুনদের সঙ্গে থাকবেন কোন যুক্তিতে। প্রশ্ন ওঠে, নতুন পিজিটি-র ছাত্রীদের হস্টেলের মান ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও।

এই প্রশ্নগুলির যোগ্য উত্তর না পেয়েই অনশনে বসেন ৬ ছাত্রছাত্রী। কয়েকদিনের মধ্যে নাটকের ভোল বদলাতে থাকে মুহুর্মুহু। কখনও রাতে আলো নিভিয়ে দেওয়ার নির্দেশ, কখনও পুলিশ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়েদের ভয় দেখানো— এই সবই এর মধ্যে ছিল বলে অভিযোগ করেন ছাত্রছাত্রীরা। অনশনে অনড় ছাত্রদের দাবি, স্বচ্ছ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ছাত্রদের হস্টেল দিতে হবে। তৃণমূলের কোনও নেতাকে হস্টেল সুপার হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না বলেও দাবি ওঠে।
আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক ছাত্র অনিন্দ্যকুমার মণ্ডল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘আমাদের পুলিশ দিয়ে অনশন তোলার ভয় দেখানো হচ্ছে। এদিকে অনিকেতদা (অনশনকারী ছাত্র)-রা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পর পর আসা দু’জন প্রিন্সিপালের কেউ কোনও দিশা দেখাতে পারলেন না। তাঁদের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ তৈরি করছে উপরমহল। বর্তমান প্রিন্সিপাল অশোক ভদ্রর সঙ্গে শনিবার সিনিয়ররা কথা বলবেন। জানি না, সমাধান হবে কি না।’’ প্রসঙ্গত কারও ব্লাড সুগার ৫০ , কারও পালস রেট ৬০।
 এই হল হস্টেলের বর্তমান চেহারা। এর পরিবর্তন চেয়েছে ছাত্ররা।

১৯৭৭ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকার এক জেলে বন্দী স্টিভ বিকো নামে ৩১ বছরের এক যুবক। সাহিত্যিক, সামাজিক আন্দোলনের পুরোভাগের, বিশেষ করে বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের, নেতৃত্ব এবং সাংস্কৃতিক কর্মী। সেদিন বিকেল থেকে শুরু হয়েছিল নিঃসঙ্গ বিকোর মাথায় পুলিসের ক্রমাগত ঘুষি। শেষ অবধি স্রেফ ঘুষি মেরে মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলল ছেলেটাকে। সমস্ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল এ খবর।

বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার ব্লগারদের হত্যা করা কিংবা এ দেশে সংবেদী মননশীল মানুষদের হত্যা করা কিংবা সিরিয়া বা ইরাকে বা প্যালেস্তাইনে গণহত্যা করা - এসব কিছুর মধ্যে আছে বিরোধী স্বরকে হিংস্রভাবে নিশচুপ করানোর ভয়ংকর জিঘাংসা। এগুলো সহজেই বোঝা যায়। অনন্তমূর্তির মতো সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার পাওয়া বৃদ্ধ সাহিত্যিক ভারতে ক্রমাগত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মুক্তচিন্তা হত্যা সহ্য করতে না পেরে লিখে ফেললেন Hindutwa or Hind  Swaraj-এর মতো বই। সে বইয়ে লিখছেন - The hunting that corporates do today we call globalisation. Those who help in a hunting operation get a small share of the kill, just like we do in the capital market.

কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়া এই অনশন নিয়ে প্রিন্সিপাল উচ্ছ্বল ভদ্রের এত জিঘাংসা কেন? জানি সমাজ জিঘাংসু হয়ে উঠছে ক্রমাগত। তিনি কি সেই ধারাকে বহন করতে চাইছেন? কিন্তু এটা তো এশিয়ার প্রথম আধুনিক মেডিসিন শিক্ষা দেবার কলেজ। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, রোগী-চিকিৎসক বন্ধন, প্রসূতি মায়ের প্রথম সন্তানলাভের সেই ঝলমলে মুখ - সবই তো এখানে। এখানে শেখানো হয় art of healing. ভদ্রলোক তো শিক্ষক হিসেবে জেবি মুখার্জী, সুজিৎ চৌধুরীদের পেয়েছেন। মেডিসিনের ক্লাসে আর এন রায়। সার্জারিতে বি এন গুহর মতো মানব সন্তানদের। তাঁরা জিঘাংসু হতে শিক্ষা দিতেন? ছাত্রদের প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করে বলতেন - 'দ্যাখ ব্যাটা, সবক কাকে বলে!?' ফ্রয়েড কিংবা লাঁকা দিয়েও তো এর থই করতে পারছিনা। কী চাইছেন আপনি? ছেলেগুলোর মৃত্যু ঘটুক? আপনারা শবসাধনা করবেন? ইতিহাসের আরেকটি পাঠ একেবারে ভুলে গেলেন? এরা যদি যতীন দাস হয়ে যায়! তখন সামলাতে পারবেন তো? "এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না" - নিশ্চয়ই শুনেছেন এই অমোঘ লাইনটি।

ওরা কী চেয়েছে আপনার কাছে? ঠিকঠাক হোস্টেল কাউন্সেলিং আর প্রথা-রীতি-ন্যায় মেনে ঘরের অ্যালটমেন্ট। আপনি এ সামান্য জায়গাটিকে ছাত্রদের প্রতিপক্ষ এবং প্রতিস্পর্ধী করে তুলে কোথায় নিয়ে গেলেন? এ তো মিলিটারি ক্যাম্পে ঘটে। মেডিক্যাল কলেজকে মিলিটারি ক্যাম্পের চেহারা দিয়ে দিলেন? এই উজ্জ্বল ছাত্রগুলো গুলি-বন্দুক-পেটো চালাতে জানে না। এদের কানে স্টেথো, হাতে স্ক্যালপেল। আপনি ছাত্রাবস্থায় যখন ডিএসএ নামের সংগঠনটি করতেন তখন আশা করি পৃথিবীখ্যাত কার্ডিওথোরাসিক সার্জনকে নিয়ে লেখা The Scalpel, the Sword বইটি পড়েছিলেন।

কেন কেবল আত্মগরিমা, প্রতিহিংসা আর 'দেখিয়ে দেবার' জন্য নেওয়া পন্থা দিয়ে স্ক্যালপেলকে সোর্ড হিসেবে রূপান্তরিত করার পথে যাচ্ছেন? ন্যূনতম বিচক্ষণ মানুষ কি এটা করে বা করতে পারে? ভেবে দেখুন। এটা সময়ের দাবি।

এবার শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যর পর্যবেক্ষণ দেখা যাক

রাজ্য সরকার আর মেডিকালের স্টুডেন্টরা এখন যে জায়গাতে, সেটাকে পাতি জার্গনে মেক্সিকান স্ট্যান্ড অফ বলে। দুজনেই দুজনের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আছে। কেউ নামাতে সাহস করছে না, পাছে অন্য পক্ষ গুলি চালিয়ে দেয়।

মেডিকালের ছাত্রদের এই ভয়ের কারণ আছে। তৃণমূল কংগ্রেস যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিতে মাটি ধরেছে এর আগে। ফলে এবার ইগোতে নিয়ে নিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। তাই, ছাত্রদের এখন অনশন তুলে নেওয়া পলিটিকাল সুইসাইড হবে। ভবিষ্যতে অন্য যে কোনও শিক্ষাক্ষেত্রে যে কোনও দাবিতে যদি অনশনে বসে ছাত্ররা, সরকার পাত্তাই দেবে না যদি বর্তমান অনশন উইথড্র করে নেওয়া হয়। সরকার এবং ছাত্র, দুই পক্ষই এটা জানে। সরকার অপেক্ষা করে আছে, কখন সহ্যের শেষ সীমায় গিয়ে ছাত্ররা সারেন্ডার করে। মানে, একটা দুর্গকে অবরোধ করে রাখবার মতো। মাসের পর মাস। যতক্ষণ না খাবার ফুরিয়ে গিয়ে দুর্গের অধিবাসীরা আত্মসমর্পণ করে।

ছাত্ররা সারেন্ডার যে করবে না, সরকার এটা পাতি ইগো-র কারণেই বুঝতে চাইছে  না। স্বাভাবিক কারণেই বুঝছে না সরকারের পেটোয়া কণ্ঠগুলোও। কারণ সারা জীবন মাথা নুইয়ে বসের কাছে হাত কচলিয়ে হেঁ হেঁ করবার যাপন দিয়ে এই রাজনীতি বোঝা সম্ভব নয়। তাই শেষ উপায়, অনশনকে খিল্লি করা বা ম্যালাইন করা।

তো, মেক্সিকান স্ট্যান্ড অফ যখন ঘটে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটা জনপ্রিয় উপায় হল, নেগোশিয়েটরের সাহায্য নেওয়া। এ ক্ষেত্রে সেটা করতে পারেন এমন একটা দল, যার মধ্যে মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি, ডাক্তার ইত্যাদিরা থাকবেন। অথবা কোনও একক ব্যক্তি, যাঁর দুই তরফেই অ্যাকসেপ্টিবিলিটি রয়েছে। তাঁরা দুই তরফে কথা বলে একটা আপস মীমাংসায় আসুন।

ছাত্রদের অনশন তুলতে বলে লাভ নেই। এখন নো পাসারানে পৌঁছে গেছে ওরা। এখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। সেটা ঠিক না ভুল পরের কথা, কিন্তু প্র্যাক্টিকালি অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হয়ে  নেগোশিয়েটরের ব্যবস্থা করুক। এবং খুব তাড়াতাড়ি। না হলে, যদি একটা ছেলেমেয়েরও কিছু হয়ে যায়, সাদা পাতায় লিখে সই করে দিতে পারি ২০২১ সালে তৃণমূল সরকারকে কেউ বাঁচাতে পারবে না