Saturday 21 July 2018

নির্বিকার শাসক


মেডিকেল ছাত্রদের কোনও অঘটন ঘটলে সরকার দায়ী থাকবে
ডাঃ জয়ন্ত ভট্টাচার্য



কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ৬জন ছাত্র শনিবার পর্যন্ত ১২ দিন ধরে অনশনে অনড়। পরে এদের সাথে যোগ দিয়েছে আরও ১৫ জনসব মিলিয়ে ২১জনএবং আজ ২১শে জুলাই

অনশন শুরু হবার পরে তিন বার কলেজের প্রিন্সিপাল বদল হয়েছেএকজন দুদিনের জন্য ছিলেনকিন্তু হস্টেল সমস্যা নিয়ে ছাত্রদের যে দাবি সে বিষয়ে কোনও সমাধানসূত্র এখনও অধরানির্বিকার প্রশাসনআজও ডিএমই-র ছাত্র প্রতিনিধিদের আলোচনায় বলা হয়েছিল বেলা ১.৩০-এ ডিএমই-র প্রতিনিধি হোস্টেল নিজেরা দেখে সিট অ্যালটমেন্টের সিদ্ধান্ত নেবেনকেউ আসেননিছাত্ররা এখনও অনশনেক্রমাগত শরীর ভাঙ্গছেরক্তচাপ কমে যাচ্ছে, কমে যাচ্ছে রক্তে শর্করার পরিমাণএরা লাঠি বোমা বন্দুক নিয়ে শুয়ে নেই, নিতান্ত নিরীহ গান্ধী-অনুসৃত অনশনের পথে হেঁটেছেএদের মধ্য থেকেই ভাবী চিকিৎসকেরা জন্ম নেবেন যারা বারবার ফিরিয়ে দেবেন আর্ত মানুষের জীবনকিন্তু এরা আজ ১২দিন ধরে একটানা অনশনের পথে

আমরা কি আরেকজন যতীন দাসের খোঁজ করছি? আমরা সামাজিকভাবে এত নিস্পৃহ হয়ে পড়ছি?
ঠিক কী দাবিতে অনশন এই ছাত্রদের? গত তিন বছর ধরে মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রাবাসে কোনও স্বচ্ছ কাউন্সেলিং হয়নি। অত্যন্ত বিপজ্জনক ভাবে তিন বছর কাটিয়েছে বহু ছাত্র। যে কেউ চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জনের জন্য মেডিক্যাল কলেজের মেইন হস্টেলে গিয়ে একবার ঘুরে আসতে পারেনকোনও কোনও ছাত্রকে অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে থাকতে হয়েছে, কাউকে পত্রপাঠ বিদায় দিয়ে বলা হয়েছে নিজেরটা নিজের মতো করে বুঝে নিতে। কর্তৃপক্ষ বুঝিয়েছিল নতুন নির্মীয়মাণ বিল্ডিং তৈরি হলেই কাউন্সেলিং হবে। ছাত্রদের হস্টেল সমস্যার সমাধান হবেসে প্রতিশ্রুতি আজ আশা দুরাশায় পরিণত হয়েছে

নতুন নাটক শুরু হয় এই বিল্ডিং তৈরি হওয়ার পরে। দেখা যায়, অ্যালটমেন্টের ব্যাপারে গত তিন বছর ধরে হস্টেল পায়নি যে ছাত্ররা বা তিনজনের ঘরে পাঁচজন থাকা ছাত্ররা কোনও অগ্রাধিকারই পাচ্ছে না। অভিযোগ ওঠে, নিজেদের ইচ্ছে মতো কর্তৃপক্ষ কোনও কাউন্সেলিং ছাড়াই হস্টেলের ঘর দেওয়া হচ্ছে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের। এমনও অভিযোগ করা হয়, পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রদেরও নতুন হস্টেলের ঘর পাইয়ে দেওয়া হচ্ছে। কর্তৃপক্ষ অবশ্য এমসিআই-এর নিয়মের দোহাই দিয়ে বলে প্রথম বর্ষের ছাত্রদের সঙ্গে তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের ছাত্রদের রাখা যাবে না। ছাত্ররা তখন প্রশ্ন তোলেন— তা হলে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ছাত্রছাত্রীরা নতুনদের সঙ্গে থাকবেন কোন যুক্তিতে। প্রশ্ন ওঠে, নতুন পিজিটি-র ছাত্রীদের হস্টেলের মান ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও।

এই প্রশ্নগুলির যোগ্য উত্তর না পেয়েই অনশনে বসেন ৬ ছাত্রছাত্রী। কয়েকদিনের মধ্যে নাটকের ভোল বদলাতে থাকে মুহুর্মুহু। কখনও রাতে আলো নিভিয়ে দেওয়ার নির্দেশ, কখনও পুলিশ দিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বাবা-মায়েদের ভয় দেখানো— এই সবই এর মধ্যে ছিল বলে অভিযোগ করেন ছাত্রছাত্রীরা। অনশনে অনড় ছাত্রদের দাবি, স্বচ্ছ কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে ছাত্রদের হস্টেল দিতে হবে। তৃণমূলের কোনও নেতাকে হস্টেল সুপার হিসেবে নিয়োগ করা যাবে না বলেও দাবি ওঠে।
আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত এক ছাত্র অনিন্দ্যকুমার মণ্ডল সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘‘আমাদের পুলিশ দিয়ে অনশন তোলার ভয় দেখানো হচ্ছে। এদিকে অনিকেতদা (অনশনকারী ছাত্র)-রা খুবই অসুস্থ হয়ে পড়ছে। পর পর আসা দু’জন প্রিন্সিপালের কেউ কোনও দিশা দেখাতে পারলেন না। তাঁদের ওপর প্রতিনিয়ত চাপ তৈরি করছে উপরমহল। বর্তমান প্রিন্সিপাল অশোক ভদ্রর সঙ্গে শনিবার সিনিয়ররা কথা বলবেন। জানি না, সমাধান হবে কি না।’’ প্রসঙ্গত কারও ব্লাড সুগার ৫০ , কারও পালস রেট ৬০।
 এই হল হস্টেলের বর্তমান চেহারা। এর পরিবর্তন চেয়েছে ছাত্ররা।

১৯৭৭ সাল। দক্ষিণ আফ্রিকার এক জেলে বন্দী স্টিভ বিকো নামে ৩১ বছরের এক যুবক। সাহিত্যিক, সামাজিক আন্দোলনের পুরোভাগের, বিশেষ করে বর্ণবৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের, নেতৃত্ব এবং সাংস্কৃতিক কর্মী। সেদিন বিকেল থেকে শুরু হয়েছিল নিঃসঙ্গ বিকোর মাথায় পুলিসের ক্রমাগত ঘুষি। শেষ অবধি স্রেফ ঘুষি মেরে মাথা ফাটিয়ে মেরে ফেলল ছেলেটাকে। সমস্ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছিল এ খবর।

বাংলাদেশে মুক্তচিন্তার ব্লগারদের হত্যা করা কিংবা এ দেশে সংবেদী মননশীল মানুষদের হত্যা করা কিংবা সিরিয়া বা ইরাকে বা প্যালেস্তাইনে গণহত্যা করা - এসব কিছুর মধ্যে আছে বিরোধী স্বরকে হিংস্রভাবে নিশচুপ করানোর ভয়ংকর জিঘাংসা। এগুলো সহজেই বোঝা যায়। অনন্তমূর্তির মতো সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার পাওয়া বৃদ্ধ সাহিত্যিক ভারতে ক্রমাগত সাহিত্যিক, সাংবাদিক, মুক্তচিন্তা হত্যা সহ্য করতে না পেরে লিখে ফেললেন Hindutwa or Hind  Swaraj-এর মতো বই। সে বইয়ে লিখছেন - The hunting that corporates do today we call globalisation. Those who help in a hunting operation get a small share of the kill, just like we do in the capital market.

কিন্তু মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের এক সপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়া এই অনশন নিয়ে প্রিন্সিপাল উচ্ছ্বল ভদ্রের এত জিঘাংসা কেন? জানি সমাজ জিঘাংসু হয়ে উঠছে ক্রমাগত। তিনি কি সেই ধারাকে বহন করতে চাইছেন? কিন্তু এটা তো এশিয়ার প্রথম আধুনিক মেডিসিন শিক্ষা দেবার কলেজ। ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক, রোগী-চিকিৎসক বন্ধন, প্রসূতি মায়ের প্রথম সন্তানলাভের সেই ঝলমলে মুখ - সবই তো এখানে। এখানে শেখানো হয় art of healing. ভদ্রলোক তো শিক্ষক হিসেবে জেবি মুখার্জী, সুজিৎ চৌধুরীদের পেয়েছেন। মেডিসিনের ক্লাসে আর এন রায়। সার্জারিতে বি এন গুহর মতো মানব সন্তানদের। তাঁরা জিঘাংসু হতে শিক্ষা দিতেন? ছাত্রদের প্রতিপক্ষ হিসেবে খাড়া করে বলতেন - 'দ্যাখ ব্যাটা, সবক কাকে বলে!?' ফ্রয়েড কিংবা লাঁকা দিয়েও তো এর থই করতে পারছিনা। কী চাইছেন আপনি? ছেলেগুলোর মৃত্যু ঘটুক? আপনারা শবসাধনা করবেন? ইতিহাসের আরেকটি পাঠ একেবারে ভুলে গেলেন? এরা যদি যতীন দাস হয়ে যায়! তখন সামলাতে পারবেন তো? "এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না" - নিশ্চয়ই শুনেছেন এই অমোঘ লাইনটি।

ওরা কী চেয়েছে আপনার কাছে? ঠিকঠাক হোস্টেল কাউন্সেলিং আর প্রথা-রীতি-ন্যায় মেনে ঘরের অ্যালটমেন্ট। আপনি এ সামান্য জায়গাটিকে ছাত্রদের প্রতিপক্ষ এবং প্রতিস্পর্ধী করে তুলে কোথায় নিয়ে গেলেন? এ তো মিলিটারি ক্যাম্পে ঘটে। মেডিক্যাল কলেজকে মিলিটারি ক্যাম্পের চেহারা দিয়ে দিলেন? এই উজ্জ্বল ছাত্রগুলো গুলি-বন্দুক-পেটো চালাতে জানে না। এদের কানে স্টেথো, হাতে স্ক্যালপেল। আপনি ছাত্রাবস্থায় যখন ডিএসএ নামের সংগঠনটি করতেন তখন আশা করি পৃথিবীখ্যাত কার্ডিওথোরাসিক সার্জনকে নিয়ে লেখা The Scalpel, the Sword বইটি পড়েছিলেন।

কেন কেবল আত্মগরিমা, প্রতিহিংসা আর 'দেখিয়ে দেবার' জন্য নেওয়া পন্থা দিয়ে স্ক্যালপেলকে সোর্ড হিসেবে রূপান্তরিত করার পথে যাচ্ছেন? ন্যূনতম বিচক্ষণ মানুষ কি এটা করে বা করতে পারে? ভেবে দেখুন। এটা সময়ের দাবি।

এবার শাক্যজিৎ ভট্টাচার্যর পর্যবেক্ষণ দেখা যাক

রাজ্য সরকার আর মেডিকালের স্টুডেন্টরা এখন যে জায়গাতে, সেটাকে পাতি জার্গনে মেক্সিকান স্ট্যান্ড অফ বলে। দুজনেই দুজনের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে আছে। কেউ নামাতে সাহস করছে না, পাছে অন্য পক্ষ গুলি চালিয়ে দেয়।

মেডিকালের ছাত্রদের এই ভয়ের কারণ আছে। তৃণমূল কংগ্রেস যাদবপুর বা প্রেসিডেন্সিতে মাটি ধরেছে এর আগে। ফলে এবার ইগোতে নিয়ে নিয়েছে পুরো ব্যাপারটা। তাই, ছাত্রদের এখন অনশন তুলে নেওয়া পলিটিকাল সুইসাইড হবে। ভবিষ্যতে অন্য যে কোনও শিক্ষাক্ষেত্রে যে কোনও দাবিতে যদি অনশনে বসে ছাত্ররা, সরকার পাত্তাই দেবে না যদি বর্তমান অনশন উইথড্র করে নেওয়া হয়। সরকার এবং ছাত্র, দুই পক্ষই এটা জানে। সরকার অপেক্ষা করে আছে, কখন সহ্যের শেষ সীমায় গিয়ে ছাত্ররা সারেন্ডার করে। মানে, একটা দুর্গকে অবরোধ করে রাখবার মতো। মাসের পর মাস। যতক্ষণ না খাবার ফুরিয়ে গিয়ে দুর্গের অধিবাসীরা আত্মসমর্পণ করে।

ছাত্ররা সারেন্ডার যে করবে না, সরকার এটা পাতি ইগো-র কারণেই বুঝতে চাইছে  না। স্বাভাবিক কারণেই বুঝছে না সরকারের পেটোয়া কণ্ঠগুলোও। কারণ সারা জীবন মাথা নুইয়ে বসের কাছে হাত কচলিয়ে হেঁ হেঁ করবার যাপন দিয়ে এই রাজনীতি বোঝা সম্ভব নয়। তাই শেষ উপায়, অনশনকে খিল্লি করা বা ম্যালাইন করা।

তো, মেক্সিকান স্ট্যান্ড অফ যখন ঘটে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার একটা জনপ্রিয় উপায় হল, নেগোশিয়েটরের সাহায্য নেওয়া। এ ক্ষেত্রে সেটা করতে পারেন এমন একটা দল, যার মধ্যে মানবাধিকার কর্মী, ছাত্র প্রতিনিধি, সরকারের প্রতিনিধি, ডাক্তার ইত্যাদিরা থাকবেন। অথবা কোনও একক ব্যক্তি, যাঁর দুই তরফেই অ্যাকসেপ্টিবিলিটি রয়েছে। তাঁরা দুই তরফে কথা বলে একটা আপস মীমাংসায় আসুন।

ছাত্রদের অনশন তুলতে বলে লাভ নেই। এখন নো পাসারানে পৌঁছে গেছে ওরা। এখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। সেটা ঠিক না ভুল পরের কথা, কিন্তু প্র্যাক্টিকালি অসম্ভব। সে ক্ষেত্রে সরকার উদ্যোগী হয়ে  নেগোশিয়েটরের ব্যবস্থা করুক। এবং খুব তাড়াতাড়ি। না হলে, যদি একটা ছেলেমেয়েরও কিছু হয়ে যায়, সাদা পাতায় লিখে সই করে দিতে পারি ২০২১ সালে তৃণমূল সরকারকে কেউ বাঁচাতে পারবে না

4 comments:

  1. I would request the authorities to immediately and urgently make an effort to solve the issue
    They are our future and our brightest
    It is our duty to do so.

    ReplyDelete
  2. Khub sundar protibedon. Jedin theke sikkhakhetre rajniti dhukhechhe, sedin thekei sabkichhui olot-palot hoye gyachhe. Asha kori Sarkar bahadurer suvobuddhir bodhodoy khub sighroi habe.

    ReplyDelete
  3. Trinomul will not survive in 2021 in either way.খুনে,গুন্ডা, নোংরা লোকেরা মিলে কিভাবে একটা পুরো রাজনৈতিক দল গড়তে পারে সেটা ত্রিনমুল কে না দেখলে বোঝা জায় না।

    ReplyDelete