সংস্কৃতির বহুত্ব বনাম বিশ্ব বাজারের সংস্কৃতি
অরুণাভ বিশ্বাস
সমাবেশের ছবি
'একক মাত্রা'র মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠান পাঠক-সম্পাদক-লেখকের ত্রিবেণী সঙ্গম। বিগত কয়েকটি সংখ্যার মতোই ৫মে বিকেলে পত্রিকার মে'১৮ সংখ্যা (প্রচ্ছদ বিষয় : লোকাচার লোকধর্ম)-র আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয় কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের তিনতলায় বই-চিত্র সভাঘরে। ছিল একজোড়া বক্তৃতার আয়োজন।
বলছেন অচিন চক্রবর্তী
মার্কসের দ্বিশততম জন্মদিনে আজকের প্রেক্ষাপটে তাঁর রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রাসঙ্গিকতার পুনর্বিচার করতে গিয়ে অচিন চক্রবর্তী বলেন ২০০৮ পরবর্তী বিশ্বসঙ্কটের পর থেকে সর্বত্রই মার্কসকে নতুন করে পাঠ করার প্রবল আগ্রহ দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে মার্কস ফিরে আসছেন। অন্যদিকে যেসব অল্পবয়সীরা ক্লাসে মার্কসকে পড়তে আসছে তারা শুধু দাস ক্যাপিটালের কোন পাতায় কী লেখা আছে তার চর্চা করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, তারা এটাও বুঝে নিতে চাইছে কিভাবে মার্কসকে ব্যবহার করে সমসাময়িক সমাজকে ব্যাখ্যা করা যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নম্বর পাওয়ার পড়াশোনার অ্যাকাডেমিক ঘেরাটোপে মার্কসের মূল্যতত্ত্ব ও সারপ্লাস ভ্যালু ব্যবহার করে সমাজ বোঝার প্রয়াস সত্যিই নতুন। এর পাশাপাশি হালফিলের মার্কস চর্চার আরেকটি নতুন দিক হল দাস ক্যাপিটালের প্রথম খণ্ডের সাথে দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডের উপরেও জোর দেওয়া। এর ফলে মার্কসের রাজনৈতিক-অর্থনীতির চর্চায় শ্রেণি কাঠামোর ধারণার পাশাপাশি শ্রেণি প্রক্রিয়ার ধারণাটিও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
অচিনবাবু বোঝান যদি শ্রেণি প্রক্রিয়ার জায়গা থেকে পুঁজিবাদকে চিহ্নিত করা হয় তাহলে দেখা যাবে মালিকানা এবং বাজার দুটি আলাদা বিষয়। আমরা সচরাচর উৎপাদন প্রক্রিয়া বলতে এক বিশেষ ধরনের পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া বুঝি যেখানে উপকরণ ও উৎপাদিতের মালিকানা বিশেষ প্রাসঙ্গিক। কিন্তু একই জিনিস শ্রেণি প্রক্রিয়ার ধারণা থেকেও বুঝতে হবে। পুঁজিবাদী শ্রেণি প্রক্রিয়ার দুটি পর্যায়। প্রথমটি চরিত্রে মূলগত বা fundamental যেখানে উৎপাদন (production) হল মূল বিষয় এবং দ্বিতীয়টি চরিত্রে অন্তর্গত বা subsumed যেখানে গ্ৰহণ (appropriation) এবং বন্টন (distribution) হল মূল বিষয়। উৎপাদন প্রক্রিয়া শ্রমিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণে থাকলেও কোনও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তার পুঁজিবাদী চরিত্র হারাবে না যতক্ষণ না পর্যন্ত উৎপাদিত পণ্যের গ্ৰহণ ও বন্টনে শ্রমিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে। আর ঠিক এই কারণেই টিমটিম করে টিকে থাকা সমবায়গুলিকে অচিনবাবু পুরোপুরি অপুঁজিবাদী প্রক্রিয়া বলতে রাজি নন। অনেক সময়েই দেখা যায় কোনও সমবায়ে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় শ্রমিক শ্রেণি পরিচালকের ভূমিকায় থাকলেও উৎপাদিত পণ্যের গ্ৰহণ ও বন্টনে সুবিধাভোগী রাজনৈতিক নেতা বা দুর্নীতিপরায়ণ আমলাদের কথাই শেষ কথা। অন্যদিকে, শ্রেণি প্রক্রিয়ার দৃষ্টিতে শ্রেণি অবস্থান ব্যক্তি-কেন্দ্রিক নয়, বরং একজন ব্যক্তির একাধিক শ্রেণি অবস্থান থাকতে পারে। তা নির্ভর করছে উৎপাদন-গ্ৰহণ-বন্টন এই তিনটি স্তরের প্রতিটিতে ঐ ব্যক্তির ভূমিকা কীরকম। যাই হোক, অচিনবাবুর কথায়, সময় খারাপ হলে ভাবনার জগৎ খুলে যায়। তাই হয়তো বিশ্বমন্দা পরবর্তী সময়ে পুঁজিবাদের চেহারা কেমন হবে তা নিয়ে নিরন্তর চর্চা চলছে। সেই চর্চায় অসাম্য বা বৈষম্যের ধারণাটিও গুরুত্ব পাচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত ভারী শিল্প নিয়ে যে সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল তারও বাস্তবায়নের কোনও আশা দেখা যাচ্ছে না। বুঝতে হবে যে রাষ্ট্রীকরণ কখনই একটি অপুঁজিবাদী প্রক্রিয়া নয়, কারণ সেখানে গ্ৰহণ ও বন্টনের ভার শ্রমিক শ্রেণির হাতে থাকে না। এই সব মিলিয়ে মার্কসের রাজনৈতিক-অর্থনীতি পুনরায় চর্চিত হচ্ছে।
কুমার রাণা
গত ৪মে'১৮ তারিখে জলপাইগুড়িতে আশি বছর বয়সে গলার ক্যানসারে ভুগে মারা গেলেন বিশিষ্ট বামপন্থী নেতা ভাস্কর নন্দী। স্মৃতিচারণায় কুমার রাণা বলেন ভাস্কর নন্দীর কাজের ক্ষেত্র ছিল অসম ও উত্তরবঙ্গ। আমৃত্যু তিনি ছিলেন সিপিআই(এমএল)-র প্রভিশনাল সেন্ট্রাল কমিটির পলিটব্যুরোর মেম্বার তথা সাধারণ সম্পাদক। ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পাশ করলেও সমাজবিদ্যা নিয়ে পড়তে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যান এবং সেখানে পড়াতেও শুরু করেন। এ সময় ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভে সক্রিয় অংশ নেন। পরে উত্তাল সত্তরের দশকে নকশালবাড়ির অমোঘ আকর্ষণে সাড়া দিয়ে সস্ত্রীক গাড়ি চালিয়ে রওনা দেন ইংল্যান্ড থেকে এবং সমগ্ৰ ইউরোপ আর পশ্চিম এশিয়া পার করে উত্তরবঙ্গে পৌঁছান। সেখানে বাম আন্দোলনের প্রচার ও প্রসারে বিশেষ ভূমিকা নেওয়ার পাশাপাশি রাজবংশী, চা-শ্রমিক তথা সে অঞ্চলে আগত আদিবাসীদের দুঃখ-দুর্দশা মোচনেও নানান কর্মসূচি গ্ৰহণ করেন। ১৯৮৬ সালে কলকাতায় বামপন্থী দলগুলির একটি বড় সম্মেলনে সংখ্যালঘু ও দলিতদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে ভাস্কর নন্দীও জাতপাত দূরীকরণে সই সংগ্ৰহ অভিযানে নেমে পড়েন। উত্তর-পূর্ব ভারতের শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষদের জানতে গেলে ভাস্কর নন্দীকে জানতে হবে। আমৃত্যু ফ্যাসীবিরোধী এই মানুষটি মার্কসবাদকে নতুন ভাবে বুঝতে চেয়েছিলেন। আমাদের দুর্ভাগ্য তিনি বেশি লেখালিখি করে যাননি, যদিও তিনি পিসিসি, সিপিআই(এমএল)-র মুখপত্র For a New Democracy'র মুখ্য-সম্পাদক ছিলেন।
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
সদ্যপ্রয়াত বামপন্থী বুদ্ধিজীবী অশোক মিত্রের সাথে নিজের ঘনিষ্ঠতার দাবি করতে চান না সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। দুজনের আলাপ হয়েছিল লতিকা গুহ সম্পাদিত বইয়ে 'বুদ্ধিজীবী ও নানান প্রশ্ন' শীর্ষক একটি লেখাকে কেন্দ্র করে। পরে সে আলাপ বদলে রূপ নিয়েছে বয়োজ্যেষ্ঠর স্নেহে ও কনিষ্ঠের মুগ্ধতায়। সেই সম্পর্কে কোনও প্রভাব ফেলতে পারেনি ব্যক্তিগত কারণে অশোক মিত্রের 'আরেক রকম' পত্রিকায় সঞ্জয়বাবুর লিখতে অস্বীকার করা। যাই হোক, স্মৃতিচারণায় সঞ্জয়বাবু অভিমত ব্যক্ত করেন যে অশোক মিত্র যতই "আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট" বলে থাকুন না কেন, আদতে তিনি ছিলেন সাবেকি বাঙালি ভদ্রতাবোধের শীর্ষবিন্দু। তাই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌহদ্দিতে অধ্যাপিকা দময়ন্তি সিংকে যথোচিত সম্মান প্রদর্শনে এতটুকু কার্পণ্য করেননি, যদিও বয়স খ্যাতি এবং রাজনৈতিক ক্ষমতায় অনেকটাই এগিয়ে ছিলেন তিনি। একইভাবে প্রথম যৌবনে জীবনানন্দের স্বকৃত মূল্যায়নকে পরিণত বয়সে সলজ্জ ভঙ্গিতে অগ্ৰাহ্য করতেও তিনি পিছপা ছিলেন না। নিজে মার্কসবাদী অর্থনীতির মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তাঁর চর্চার ক্ষেত্র ছিল শ্রেণি সংগ্ৰাম ও বাণিজ্য অর্থনীতি। অন্যদিকে মার্কসবাদের সাথে রোমান্টিক আন্দোলনের প্রাথমিক ধারণাগুলির সাযুজ্য খুঁজে পেতেন তিনি। মার্কসের লেখা বইপত্র যেমন ক্যাপিটালকে উঁচুদরের সাহিত্য বলে মনে করতেন। ইংরেজি ও বাংলা দুই ভাষাতেই সমান স্বচ্ছন্দ ছিলেন তিনি। তাঁর
Calcutta Diary যেমন পাঠকের সমাদর পেয়েছে তেমনি তাঁর স্মৃতিকথা
আপিলা চাপিলা শিক্ষিত বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন পাকা করেছে। স্বভাবে বিনয়ী হলেও ওপার বাংলা বিশেষত ঢাকা জেলার লোকের উপর পক্ষপাত তিনি আড়াল করতে পারতেন না। এ কারণেই জ্যোতিবাবুর সাথে তাঁর সম্পর্কের সমীকরণটি স্বকীয়তা দাবি করে। নিজের বাচনভঙ্গিও ছিল ঢাকাই। বাঙালসুলভ মানসিকতা ছিল তাঁর স্বভাব বৈশিষ্ট্য। এই একরোখা মনোভাবের সাথেই তিনি বামপন্থাকে মনে করতেন নোয়ার নৌকা। এ ব্যাপারে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কোনও সমঝোতায় রাজি ছিলেন না তিনি। বামপন্থার সাথে যাবে না এমন যে কোনও কিছুকেই মুখের ওপর 'না' বলতে এতটুকু দেরি হত না তাঁর। বলতে গেলে বামপন্থা ছিল তাঁর জীবনদর্শন যার প্রতি মুগ্ধতা তথা দায়বদ্ধতা তাঁর আমৃত্যু অটুট ছিল। সঞ্জয়বাবুর মূল্যায়নে অশোক মিত্র অবশ্য যত না মার্কসিস্ট তার চেয়েও বেশি র্যাডিকাল। বলা যেতে পারে, তিনি ছিলেন ব্রহ্মবান্ধব, বিপিন পাল বা সমর সেন ধারার শেষ প্রতিনিধি। বাস্তব অবস্থার সাথে যোগাযোগের অভাবে তাঁর চেতাবনি রাজ্যের তৎকালীন বামপন্থী শাসকদলটি উপলব্ধি করতে পারেনি। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। যদিও কঠিন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও তিনি এই বিশ্বাসে অটুট ছিলেন যে সাধারণ মধ্যবিত্তের পরিত্রাণের পথ আছে, এবং তা বামপন্থায়।
'ক্যানসারের অন্য পরিচয়' বইয়ের প্রকাশ
অনুষ্ঠানে মূল বক্তৃতার আগে ডা মনু কোঠারি ও ডা লোপা মেহতা লিখিত
The Nature of Cancer নামক ৯৩২ পাতার আকর গ্ৰন্থটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ
The Other Face of Cancer বইটির বাংলা অনুবাদ
ক্যানসারের অন্য পরিচয় বইটির (উপপথ প্রকাশনী) আনুষ্ঠানিক প্রকাশ হয়। বইটি সম্পর্কে বলেন অনুবাদক ডা স্থবির দাশগুপ্ত।
The Nature of Cancer প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ক্যান্সার আক্রান্ত বিশিষ্ট সমাজবিজ্ঞানী ইভান ইলিচ (বিশ্বচর্চিত
Medical Nemesis'এর রচয়িতা)-এর পরামর্শে এই বইটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ (
The Other Face of Cancer) ১৯৭৯ সালে আমেরিকা, ব্রিটেন, জার্মানি এবং হল্যাণ্ড থেকে, ইলিচের ভূমিকা সহ প্রকাশিত হবার পর বিশ্বব্যাপী আলোড়ন ওঠে। ইতোমধ্যে বাংলা সহ ছয়টি ভাষায় এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটি প্রকাশিত হয়েছে। বর্তমান বইটিতে ২০১৮ পর্যন্ত প্রথাসিদ্ধ ক্যান্সার চিকিৎসা প্রগতির(!) বিস্তারিত পর্যালোচনা করে লেখকদ্বয় দেখিয়েছেন যে ১৯৭৩ সালে ক্যানসার এবং তার চিকিৎসা প্রসঙ্গে তাঁদের প্রায় প্রত্যেকটি সমালোচনা আজ স্বীকৃতি পাচ্ছে। আজ মেনে নেওয়া হচ্ছে যে :
● ক্যানসার আদৌ কোনও বাহ্য কারণের জন্য হয় না, তা আমাদের সহজাত, সময় নির্ধারিত, জীর্ণন প্রক্রিয়ার অভিব্যক্তি।
● আর্লি ডিটেকশন অফ ক্যানসার আসলে একটি মিথ, যাকে কবরস্থ করা অত্যধিক জরুরি।
● যেহেতু এই রোগটির জন্য কোনও কারণের দরকার পড়ে না (অর্থাৎ, সেটি causeless), তাই তার নিরাময়ের প্রশ্নই ওঠে না (অর্থাৎ, তা cureless)।
● ক্যান্সার মুখ্যত যন্ত্রণাদায়ক নয়। কেমোথেরাপি, রেডিয়োথেরাপির মতো প্রাণান্তকর চিকিৎসাই রোগটিকে যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে।
● বাস্তবিকতা হল এই যে কেবলমাত্র উপশমকারী (প্যালিয়েটিভ) চিকিৎসাই কাম্য, সমস্তরকম আগ্রাসী আরোগ্যকারী (ক্যুরেটিভ) চিকিৎসা যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যুকে তরান্বিত করে এবং আর্থিক ভাবে রুগীর পরিবারকে সর্বস্বান্ত করে।
● অচিকিৎসিত ক্যানসার রুগী অবশ্যই চিকিৎসিত রুগীর থেকে আরামে, বেশিদিন বাঁচেন।
স্থবির দাশগুপ্ত
আমন্ত্রিত বক্তা জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে নতুন করে 'একক মাত্রা'র পাঠকদের কাছে চেনানোর নেই। তিনি এই পত্রিকার নিয়মিত লেখকই শুধু নন, সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্যও বটে। তবে তার বাইরে জয়ন্তবাবুর কাজের পরিসর বহুধাবিস্তৃত। আর সেসবের সাথে সংক্ষেপে পরিচয় করালেন তুষার চক্রবর্তী। পরিবেশ ও উন্নয়ন সম্পর্কে সঠিক নীতি যে কী হতে পারে তা নিয়ে যে কজন বাঙালি আন্তর্জাতিক স্তরে কাজ করেছেন জয়ন্তবাবু তাঁদের অন্যতম। কানপুর আইআইটি থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে এমআইটিতে যান। ফিরে এসে ব্যাঙ্গালোর ও কলকাতার আইআইএম'এ পড়ান। কলকাতার ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানটিতে তিনিই সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট এন্ড এনভায়রনমেন্ট পলিসি প্রতিষ্ঠা করেন। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তাঁকে নদীবাঁধের কর্মক্ষেত্রে নিয়ে আসে। কিন্তু সেখান থেকে তাঁর কর্মজীবন বাঁক নেয় নদীবাঁধ নির্মাণের রাজনীতির মুখোশ উন্মোচনে। হিমালয় হতে উৎপন্ন নদীগুলির চরিত্র নির্ধারণে নিরন্তর চর্চা তাঁকে বর্তমানে কাঠমান্ডুর ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর ইন্টিগ্ৰেটেড মাউন্টেন ডেভেলপমেন্ট এবং টাফ্টস বিশ্ববিদ্যালয়ের জলদৌত্য কর্মসূচির অন্যতম সদস্যপদ এনে দিয়েছে। এইভাবে প্রাতিষ্ঠানিক প্রযুক্তিবিদ্যার পরিসর ছেড়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখেন পরিবেশবিদ্যা তথা পরিবেশ আন্দোলনে। বর্তমানে তিনি জেনেভার ইন্টারন্যাশনাল আকাদেমি অফ এনভায়রনমেন্ট'এর সদস্য এবং আইইউসিএন'এর একজন উপদেষ্টা। বিশ্ব জুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার পাশাপাশি ১৪টি বিশ্বসমাদৃত বই এবং একশটিরও বেশি প্রবন্ধ লিখেছেন।
জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
দু ঘন্টার অনুষ্ঠানে মার্কস থেকে মনু কোঠারি, লোকাচার থেকে বিশ্ববাজার, ইত্যাদিকে ধরানো একমাত্র 'একক মাত্রা'র পক্ষেই সম্ভব। এমন সরস উক্তি দিয়ে মূল বক্তৃতা শুরু করেন জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রায় উনিশ বছরের পত্রিকার শতাধিক প্রচ্ছদ বিষয়ের বৈচিত্র্যকে উচ্চপ্রশংসিত করলেও উপস্থিত পাঠকবন্ধুদের তিনি সতর্ক করে দেন যে প্রবন্ধপাঠের অভ্যাসকে যেন পল্লবগ্ৰাহীতা গ্ৰাস না করে ; যা-ই পড়া হবে তা যেন মৌলিক এবং নিবিড় হয়। জয়ন্তবাবুর বক্তৃতার শীর্ষক ছিল 'বহুত্ববাদ বনাম বিশ্ববাজারের সংস্কৃতি'। 'একক মাত্রা'র প্রচ্ছদ বিষয়ে লোকাচার বা লোকধর্মের অন্তর্ভুক্তিকে তিনি বহুত্ববাদের চর্চা বলেই মনে করেন। তবে বর্তমানে একবিংশ শতাব্দীতে বহুত্ববাদবিনাশকারী শক্তির অভাব নেই, বিশ্ববাজার যাদের অন্যতম। এ প্রসঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের ১৯০৪ সালে লেখা 'স্বদেশী সমাজ' (
আত্মশক্তি ) নামক প্রবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি পড়ে শোনান :
আমাদের সমাজ এখন আর এরূপভাবে চলিবে না। কারণ , বাহির হইতে যে উদ্যত শক্তি প্রত্যহ সমাজকে আত্মসাৎ করিতেছে, তাহা ঐক্যবদ্ধ, তাহা দৃঢ় -- তাহা আমাদের বিদ্যালয় হইতে আরম্ভ করিয়া সর্বত্রই নিজের একাধিপত্য স্থুলসূক্ষ্ম সর্ব আকারেই প্রত্যক্ষগম্য করিয়াছে।
রবীন্দ্রনাথের এই অমোঘ সাবধানবাণীকে মাথায় রেখে জয়ন্তবাবু তাই সিদ্ধান্তে আসেন যে প্রাক-শিল্পযুগের কৃষি-অর্থনীতির ভিত্তিতে চলা লোকাচার লোকধর্ম বা লোকশিল্পের সাথে বিশ্বায়ন পরবর্তী যুগের বাজার অর্থনীতির সম্পর্কটি ব্যাস্তানুপাতী। সম্পর্কের এই সমীকরণটির বিস্তারিত ব্যাখ্যায় জয়ন্তবাবু না গেলেও প্রায় একই বিষয় নিয়ে তাঁর অন্য একটি লেখার অনুবাদকর্মের অভিজ্ঞতা থাকায় কিছু অতিরিক্ত লেখার স্বাধীনতা গ্ৰহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। 'আধুনিকতার জন্য উন্নয়ন' এই ধারণাকে প্রশ্ন করার ক্ষমতা হাতেগোনা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মধ্যেই সীমায়িত থাকায় ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে নাগরিকদের ভালোমন্দের দায়ভার আরোপিত হয়েছে উন্নয়ন ও আধুনিকতার তথাকথিত কাণ্ডারী খোলা বাজারে হাতে, যেখানে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়ে ওঠে উন্নয়নের একমাত্র সূচক। ধনী উচ্চবিত্তের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা গণমাধ্যমের কল্যাণে এমন ভাবে প্রচারিত হতে থাকে যেন তা সকলের অভীষ্ট। মনন তথা জীবনদর্শনের এই অবনমন বাঞ্ছনীয় মানুষোচিত গুণাবলীর কোনও সর্বজনগ্ৰাহ্য সুসংহত প্রতিরূপ গড়তে বাধা দেয়। ফলে, জিডিপি'র জনপ্রিয়তা বাড়তেই থাকে আর স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা থেকে আন্তর্জাতিক মিডিয়া সকলের কাছেই উন্নয়নের একরৈখিক ভোগবাদী ধারণাটিই গ্ৰহণযোগ্য হয়ে ওঠে। প্রত্যাশিত ভাবেই এই সরলরৈখিক ধারণায় বহুত্ববাদের কোনও ঠাঁই নেই। সেখানে আছে শুধু জিডিপি নামক সীলমোহরকে হাতিয়ার করে উন্নয়নের ঢক্কানিনাদে প্রযুক্তিলব্ধ জ্ঞানকে পণ্যায়িত করার মুনাফাকামী অপপ্রয়াস। তাই সাজপোশাক, খাদ্যাভ্যাস, ক্রীড়াবিনোদন, জীবনযাপনের নিত্যপ্রয়োজনীয় যে কোনও কিছুতে কৃত্রিম চাহিদা এমনভাবে তৈরি হচ্ছে যাতে ভারতবর্ষের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ বিনষ্টির পথে গিয়ে পশ্চিমি ভোগবাদী আধুনিকতার অন্ধ অনুকরণের পথ সুগম হয়। অন্যদিকে দেশজ লোকাচার বা লোকধর্মকে যেহেতু কেবলমাত্র প্রান্তিক মানুষেরাই তাঁদের যাপনে বহন করে চলেন সেহেতু তা আজ পুঁজির আগ্ৰাসনে ভোগবাদী প্যাঁচপয়জারে বিলুপ্ত হওয়ার পথে চলেছে। এ বড় কঠিন সময়। জয়ন্তবাবুর মতে এর মোকাবিলায় 'dynamism in small scale' বজায় রাখতে হবে। আর এই ব্যাপারটা সম্ভবপর হবে তখনই যখন 'লোক' অনুষঙ্গে যে কোনও কিছুকে আমরা পৃষ্ঠপোষকতা করতে থাকব। অর্থাৎ, এখানে জয়ন্তবাবু macrocosmic capitalist-consumerist (যেমন MNC, বিগ মিডিয়া) আগ্ৰাসনের বিরুদ্ধে microcosmic level'এ লোকবিচারে প্রতিরোধ গড়ার কথা বলেছেন। এই প্রসঙ্গে জনৈক শ্রোতার প্রশ্নের উত্তরে জয়ন্তবাবু বলেন লোকাচার লোকধর্ম বা লোকশিল্পের সাথে বিশ্ববাজারের সমানুপাতি সম্পর্ক একেবারেই যে অসম্ভব তা নয়, তবে সে ক্ষেত্রে সম্পর্কের ভিত্তি হবে অসম সমন্বয়। যেমন ঘর সাজানোর শৌখিন জিনিস তৈরিতে একজন ডোকরা শিল্পী বা মধুবনি চিত্রকর হয়তো প্লাস্টিক বা রাবারে তৈরি চীনা আমদানির বা মূলধারার চিত্রশিল্পীদের সাথে পেরে উঠবেন না, কিন্তু টিঁকে থাকার জন্য বিপণনের কৌশল করায়ত্ত করতে তিনি অনলাইন সংস্থার সাহায্য নিতেই পারেন।
'একক মাত্রা'র মে সংখ্যার প্রকাশ (প্রচ্ছদ বিষয়ঃ লোকাচার লোকধর্ম)
বাঁদিক থেকেঃ অরুণাভ বিশ্বাস, অনিন্দ্য ভট্টাচার্য, অচিন চক্রবর্তী, সেখ আসাদ আলি,
কল্যাণ কুমার সরকার ও জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
বিশ্ববাজারের সাথে লোকাচার লোকধর্মের মতো বহুত্ববাদী উপকরণের সম্পর্কের স্বরূপটি উন্মোচনের পাশাপাশি জয়ন্তবাবু সাবধান করে দেন 'লোক' অনুষঙ্গে আচার ধর্ম শিল্প সাহিত্য গান নাচ ইত্যাদির চর্চা জনপ্রিয় হলেও আসন্ন বিপদগুলি সম্পর্কে আমরা অবহিত নই। বহুত্ববাদবিনাশী পশ্চিমি সাংস্কৃতিক আগ্ৰাসন ছাড়াও অন্যান্য বিপদ বলতে তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং উন্নত জৈবপ্রযুক্তির চর্চাকে বুঝিয়েছেন। এর সাথে রয়েছে বিজ্ঞানের রাজনীতি ও কুক্ষিগত বিদ্যার অধিকার। শহরের রোয়াক বা গ্ৰামের চন্ডীমণ্ডপে বসে গল্পগুজব করার দিন শেষ। এখন সোশাল মিডিয়ার যুগ। লোকের হাতে হাতে স্মার্টফোন, তাতে যে computational skill ভরা আছে তা আমেরিকার নাসার প্রথম অ্যাপোলো অভিযান সমাধা করতে যতটুকু লেগেছিল তার প্রায় দ্বিগুণ। এর উপর আগামীতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগ আসন্নপ্রায়। তখন মানুষের প্রয়োজনে মানুষকে যাতে দরকার না হয় তার জন্য চেষ্টা চলছে human brain-computer link up গঠনে। পৃথিবীর উপর নির্ভরশীলতা কমাতে global space civilization স্থাপনের চেষ্টা চলছে। আর তার জন্য প্রয়োজন যে inter-planetary transport system সেটা গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। এইভাবে মানবপ্রজাতির মনন ও চর্যা, কর্ম ও যাপনে যে সামূহিক পরিবর্তন আসতে চলেছে তাতে বহুত্ববাদ আদৌ টিঁকে থাকবে কিনা তা ভবিষ্যতই বলবে। অন্যদিকে বহুত্ববাদের সাপেক্ষে জৈবপ্রযুক্তি বা কৃষিপ্রযুক্তি আশীর্বাদ না অভিশাপ তা নিয়েও দ্বিধায় রয়েছেন জয়ন্তবাবু। বিস্তারিত না বোঝালেও ব্লগের পাঠকদের জন্য বলা যায় যে এককালে মায়ান-আজটেক-ইনকা সভ্যতায় জৈবপ্রযুক্তির প্রয়োগে ভুট্টা চাষে অভাবনীয় বৈচিত্র্য আনা হয়েছিল, ইউরোপ ও পার্শ্ববর্তী এশিয়ায় নানান গোলাপচারার পরিচর্যা হতো বা বাংলা-বিহার-ঢাকায় নবাবী আমলে আমের নানা প্রজাতির চাষ হত। কিন্তু বর্তমানে কৃষিপ্রযুক্তিকে শুধুই উচ্চফলনশীলতার কাজে ও সময়-শ্রম কমানোর কাজে ব্যবহার করায় বহুরকম ধানের প্রজাতি, আমগাছ, ফুলগাছ বিরল অথবা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বহুত্ববাদের এও এক বিপদ বৈকি।
সবশেষে জয়ন্তবাবুর প্রশ্ন, এরকমটা হতে চলেছে কেন। তাঁর মতে, বিজ্ঞানের রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা বা উদাসীনতা এর জন্য দায়ী। ছাত্রছাত্রীদের পাঠক্রমে যেভাবে নিউটনের গতিসূত্র ইত্যাদি পড়ানো হয় তাতে বিজ্ঞান পড়াটাই শুধু হয়, পড়াটাকে সমাজের কাজে লাগানো যায় না। বিজ্ঞানের রাজনীতির প্রাথমিক পাঠে আমাদের বুঝে নিতে হবে, এই যে বলা হয় "Knowledge is power" সেটা আসলে আপেক্ষিক সত্য। বাস্তবিক সত্য হল "Knowledge is power when knowledge is western"। সেই কারণে Tibetan medicine গুরুত্ব পায় না। আবার নলেজকে শুধু ওয়েস্টার্ন হলেই চলবে তাকে প্রয়োজনমতো কুক্ষিগত করে রাখতে হবে। যেমন ১৯৬৩ সালে আবিষ্কার হওয়া ইন্টারনেটকে মার্কিন সামরিক বিভাগ ঠান্ডা লড়াইয়ের কারণে গোপন রেখেছিল নয়ের দশক পর্যন্ত এবং সোভিয়েত অবসানে তা খোলা বাজারে ছেড়ে বিশ্বায়নের সময়ে বিপুল আর্থসামাজিক বা রাজনৈতিক ফায়দা লোটা হয়। বহুত্ববাদকে বাঁচাতে বিজ্ঞানের রাজনীতির এই মুখোশ উন্মোচন প্রয়োজন। তার জন্য চাই বহুত্ববাদকে মাথায় রেখে বিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের মেলবন্ধন।
প্রত্যেকটি বক্তব্য সুবিন্যস্ত বিস্তারে তুলে ধরবার জন্য অরুণাভকে ধন্যবাদ। অভিনন্দন
ReplyDelete