এক অনন্য তপস্বী
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
২০০২ সালে ঢাকায় ‘একুশে’ গ্রন্থ বিপণিতে একজন হাতের সামনে একটি বই এগিয়ে
দিলেনঃ পরমাভাষার বোধন উদবোধন। লেখক কলিম খান। বইটি নিয়ে খানিক নাড়াচাড়া করার পর মুদ্রাদোষেই
জিগেস করি, লেখক কি ঢাকার?
সে বইটির ভূমিকা দোকানে দাঁড়িয়েই পড়ে ফেললাম। তারপর আর কালক্ষেপ নয়, কলকাতায় ফিরেই ‘একুশে’ থেকে সংগ্রহ করে আনা দূরভাষের নং’এ
তাঁর সঙ্গে আলাপ ও তাঁর বাসায় গমন। বইটি পড়ে যতটা না বুঝেছি, আলাপে আরও সাবলীল হল
তাঁর ভাবনা। আরও দু-তিনটি বই তাঁর থেকেই সংগ্রহ করলাম। প্রথম যা আমাকে আকর্ষণ করল
তা ভাষা। এত সাবলীল ও স্বচ্ছন্দ বাংলায় তিনি এমন এক গভীর বিষয় নিয়ে লিখছেন, আমাকে
মোহিত করল। ‘একক মাত্রা’র জন্য লেখা তো চাইলামই, আর ওঁর বইগুলোও বোঝার চেষ্টা
করলাম প্রাণপণ। তিনি তখন গভীর অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। কিছুদিন অর্থের বিনিময়ে ‘একক
মাত্রা’র কম্পোজিং’এরও কাজ করলেন নির্দ্বিধায়। বাড়িতে কম্পিউটার বসিয়ে তিনি তখন
ডিটিপি’রও কাজ করেন। বাড়িতে স্ত্রী, দুই মেয়ে ও এক ছেলে। সন্তানেরা সকলেই নাবালক।
থাকেন এক পুরনোকালের ভাড়া বাড়িতে।
তিনি হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের উত্তরাধিকার। ‘বঙ্গীয়
শব্দকোষ’এ হরিচরণ যেখানে শেষ করেছেন বর্ণের অর্থ ও একই শব্দের বিবিধ অর্থ
উদ্ধারে, কলিম খান ও রবি চক্রবর্তীর যাত্রা শুরু সেইসব শব্দের ক্রিয়াভিত্তিক অর্থ
নিষ্কাশনে। হরিচরণের রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, কলিম খানের কিছু চাকরিজীবী অনুরাগী। তীব্র
দারিদ্র্যের মধ্যেও তিনি সে কাজ এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে আরও অধোগামী, কলিম
খানের ভাষায় ১৯৪৭’এর পর শারীরিক ভাবে স্বাধীন কিন্তু মানসিক ভাবে পরাধীন বাঙালি,
তাঁর এই কাজকে বোঝার অবস্থাতেই আর রইল না। তবুও লালনের যেমন কাঙাল হরিনাথ ছিলেন,
কলিমের ছিল কিছু লিটল ম্যাগাজিন আর পড়ুয়া বাঙালির একটি ছোট অংশ যারা তাঁকে প্রশ্রয়
দিয়েছেন, তাঁর সংসারের অর্থকষ্টকে লাঘব করার চেষ্টা করেছেন সর্বতোভাবে জীবনের
শেষদিন পর্যন্ত, যে কারণে তিনি এই দু’ মাস আগেও আস্থার সঙ্গে বলতে পেরেছেন তাঁর
কাজ শেষ।
কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যার পুরোধা রজার পেনরোজ তাঁর ‘দ্য এম্পেরার্স নিউ মাইন্ড’
গ্রন্থে বলেন, এ বিশ্বের সমস্ত প্রজাতিরই চৈতন্য আছে, মানুষের সঙ্গে তাদের ফারাক
হল ভাষায়। অর্থাৎ, মানুষের ভাষা আছে যা অন্যদের নেই। কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী
তাঁদের সমস্ত কাজের সার সংকলন করে তাঁদের শেষ বইটির নাম দিয়েছেন ‘ভাষাই পরম আলো’।
পেনরোজের সঙ্গে যেন ভাবনাগুলি কোনও মৌলিক জায়গায় জুড়ে গেল। লোকে বলে, Great Men Think Alike।
আদিম মানুষের যখন কোনও ভাষা ছিল না, তারা দৃশ্য জগতের বাইরে কিছু ভাবতেও পারত
না। খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য তাদের লড়াই ছিল আর অন্য সব প্রজাতির মতোই। সেই লড়াইয়ের
এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গকে কলিম খান বলছেন, ঝাঁক ম্যানেজমেন্ট। সমুদ্রের তলদেশে
থাকা মাছেরা যেমন তাদের নির্দিষ্ট বাসস্থানের পরিধিতে থাকা খাদ্যসামগ্রী ফুরিয়ে
এলে অন্যত্র নতুন বাসস্থান খোঁজে, যে জন্য ছোট দল করে এক ঝাঁক মাছ খুঁজতে যায় নতুন
বাসস্থান ও ফিরে এসে খবর দেয় অন্যান্য মাছেদের, ঠিক সেভাবে মানুষও তাদের প্রয়োজনে একইভাবে
একদল মানুষকে পাঠিয়ে দিত তাদের নতুন বাসস্থানের খোঁজে যারা ফিরে এসে খবর দিলে
মানুষের গোটা ঝাঁকটাই চলে যেত সেখানে। এরজন্য ভাষার কোনও দরকার ছিল না। আকার
ইঙ্গিত ও কিছু ধ্বনিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মানুষ যখন অদৃশ্য জগতের কিছু কথাও বলতে চাইল,
যেমন, যে নতুন বাসস্থানের হদিশ পাওয়া গেছে সেখানকার চিত্র বাকীদের যদি বুঝিয়ে বলতে
হয় বা কারও আগের দিনের কোনও উল্লেখযোগ্য ঘটনা যা সে অন্যদের বলতে চাইছে, দরকার পড়ল
ভাষার। সেই আদিপর্বে ভাষার উদ্ভব ঘটল ক্রিয়ার হাত ধরে। সে শুধু ঘটমানতাকেই বলতে পারে। ধ্বনি, বর্ণ ও শব্দের উদ্ভব ঘটল এইভাবেই।
তাই কলিম খানের মতে, সমস্ত ভাষার শিকড় একই। ইতিহাস সেই ক্রিয়াভিত্তিক ভাষার মধ্যেই
বিধৃত হয়ে আছে।
ধীরে ধীরে সভ্যতার বিকাশে, শ্রেণি বিভাজনে, ক্ষমতার নানান আকারপ্রকারের
উদ্ভবের সঙ্গে সঙ্গে ভাষাকেও ক্ষমতাশালীরা কব্জা করে নিল। তারা ভাষাকে শিকড়চ্যুত করে
তাকে প্রতীকী অবয়ব দেবার প্রচেষ্টায় মত্ত হয়ে উঠল। কারণ, শব্দকে প্রতীকী করে ফেললেই
তার অর্থ সীমায়িত হয়ে আসে, সে ক্ষমতার ভাষা হয়ে ওঠে, তার অর্থ দাঁড়ায় একটি বা দুটি
তাৎপর্যে। তাই ভাষা আজ বিপন্ন। অন্যদিকে যারা শ্রমজীবী গাঁয়ের মানুষ, সামাজিক
পরম্পরায় দীর্ঘদিন বেঁচে আছেন, সেখানে ক্ষীণ হলেও ভাষার বৈচিত্র্য ও ব্যাপ্তি এখনও
বহমান। সবচেয়ে বড় অঘটন ঘটল, যে ভাষা আজ বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সেই ইংরেজি, কঠিন,
কঠোর কর্পোরেট শাসকের হাতে পড়ে একেবারেই
শিকড়চ্যুত হয়ে প্রতীকী ভাষায় অধঃপতিত হল। তাই কলিম খান বলেন, বাংলা ভাষাই সভ্যতাকে
বাঁচাবে। তা কেন তা তিনি বিস্তারিত বলেছেন গত ৩ মার্চ ‘একক মাত্রা’র অনুষ্ঠানে ‘বাংলা
ভাষার সম্পদ কোথায়’ শীর্ষক আলোচনায়।
তিনি যখন বলেন শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শোনেন। ৭০ দশকে কলেজের পড়াশোনা ছেড়ে মুক্তির
দশক গড়ার স্বপ্নযুদ্ধে সামিল হয়েছিলেন। যখন আন্দোলন ছত্রভঙ্গ, পুলিশের দৃষ্টি
এড়াতে হকারি করে বেড়িয়েছেন। কিন্তু জিজ্ঞাসু মনের অতন্দ্র তৃষ্ণাকে নিভতে দেননি।
হকারদের বিচিত্র শব্দভাণ্ডার ও নিত্যনতুন শব্দের নির্মাণ তাঁকে মোহিত করেছিল।
অনুসন্ধিৎসু ছাত্র হিসেবে তিনি শুরু করলেন ভারতীয় ইতিহাসের স্বপাঠ। তাঁর কাছে
কৃত্তিবাসী রামায়ণ এক নতুন অর্থে ধরা দিল। তিনি হন্যে হয়ে খুঁজছেন সে মহাকাব্যের প্রতিটি
শব্দের অন্তর্নিহিত অর্থ। এদিক সেদিক পণ্ডিতদের কাছেও দৌড়চ্ছেন। উত্তর মিলছে না। একদিন
পাগলের মতো চলে গেলেন এশিয়াটিক সোসাইটির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদকের কাছে। গেলেন
অম্লান দত্তের কাছেও। এই দুজন মানুষই তাঁর কথা মন দিয়ে শুনলেন। দুজনেই প্রায় একই
কথা বললেন যে আপনি নেমেছেন এক গভীর সমুদ্রের তলদেশে রত্নভাণ্ডারের খোঁজে , সে
সন্ধান আমাদের কাছে নেই, আপনিই পারেন সে সব উদ্ধার করতে।
আদ্যন্ত এই সাবেকি মানুষটি, প্রত্যন্ত গ্রামবাংলার জল-হাওয়ায় বেড়ে ওঠা, যিনি
আধুনিক ভাষাচর্চার সমস্ত প্রয়াসকে গভীর ভাবে জেনেবুঝে তবেই সেগুলোর সমস্যা কোথায়
তা অকপটে বলে তাঁর সাধনমার্গের উপান্তে এসে পৌঁছেছিলেন। তপস্বীরা তাই বেঁচে থাকেন
কালকে পরোয়া না করেই। কালাতীত এই সাধককে আমার বিনম্র প্রণাম।
ধন্যবাদ অনিন্দ্য দা! কলিম খানের বইগুলি কিভাবে কিনতে পারি জানাবেন ? এবং একক মাত্রার একটি ইস্যু কলিম খান যে নিয়ে।
ReplyDeleteকলিম খানের বইয়ের জন্য যোগাযোগ করুন নারায়ণ চন্দ্র দাশের সঙ্গে - 7980797285
Deleteওনার বলা আমার কখনো মুগ্ধ হয়ে শোনার সৌভাগ্য হয়নি।
ReplyDeleteকলিম খানের বইয়ের জন্য যোগাযোগ করুন নারায়ণ চন্দ্র দাশের সঙ্গে - 7980797285
ReplyDelete