Tuesday 31 January 2023

'অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে'

অমর্ত্য সেন ও বিশ্বভারতী

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত 



সম্পর্কে তিনি ক্ষিতিমোহন সেনের দৌহিত্র, অমিতা সেনের পুত্র। এই পরিচয় সরিয়ে রেখে শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে পারেন না তিনি। তিনি অমর্ত্য সেন। তাঁর সম্পর্কে আগেই লিখেছি (অন্যত্র), আবারও লিখব? লিখতে বাধ্য করলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য  মহাশয় (যাঁর কালো হাতের ছোঁয়ায় 'আলাপিনী' থেকে 'কারুসংঘ' সবই আজ বন্ধ)। তাঁর সম্পর্কেও লিখেছি, তাতে কী, তিনি বুঝি দু'কান কাটা, চোখেও দেখেন কম।

প্রমথ চৌধুরি লিখেছিলেন, 'পৃথিবীতে এমন কোনও মত জন্মাতে পারে না যার পিঠ-পিঠ তার উল্টো মত না জন্মায়।' হায় প্রমথবাবু, আপনি বুঝি কদাচ কল্পনাও করেননি যে সমাজ ও সংসারে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর মতো কেউ থাকতে পারেন যিনি পায়ে পা বাঁধিয়ে যুদ্ধ করায় বুঝি ডক্টরেট! মত নাই তো নাই, বিপরীত মতটা চাপাতে তাঁর জুড়ি নেই। আপাতত অমর্ত্য সেনকে শান্তিনিকেতন ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী হেলাফেলা করার মতো মানুষ নন। জানি না তিনি প্রখর বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কিনা, হয়তো তাই। তবে বর্তমানে তিনি রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর উপাচার্য। অবশ্য, এই উপাচার্য মহাশয়ের দেশ বা পরিচয় আছে কিনা তা নিয়েও সংশয় বেড়েই চলেছে তাঁর কাজে, আচরণে। 

রবীন্দ্রনাথ বহু সাধনায় নাকি পেয়েছিলেন ক্ষিতিমোহনকে। ক্ষিতিমোহন তখন চম্বার মহারাজার দরবারে; সেখান থেকে সামান্য পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তখনও অনেক পারিবারিক দায় তাঁর কাঁধে। এমন মানুষকে রবীন্দ্রনাথ ধরে রাখতে চান, পারলে বেঁধে রাখেন শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দিতে। অনেক পরে বিশ্বভারতী তাঁকে জমি দেয় লিজে। সে কি অন্যায়? অমর্ত্য সেনের মধ্যে এমন আর এক সুসন্তানকে পেয়েছি আমরা। তাঁকে ধরে রাখবে না আজকের শান্তিনিকেতন? তিনি তো পার্থিব কিছু চাননি। জমিও না। চেয়েছেন শান্তি আর গণতন্ত্র।

আমার মা বলতেন, বেড়াল দিয়ে হালচাষ হয় না। হায় রে মা, তুমি জানো কি রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুরের লেখা সেই গানটি- 

'এরা তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না- মিথ্যা কহে কত কী ভাণে'...

এ কথা সত্য যে, খুব অর্থকষ্টে ভুগেছে প্রতীচী। ক্রাউড ফান্ডিং ইত্যাদি নানা পথ বিবেচনা করা হয়েছে। সুরাহা মেলেনি। তাই শেষ অবধি নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনই ভরসা। তাঁর টাকাতেই গড়ে উঠেছে প্রতীচী ট্রাস্ট, সেখানে জোর কদমে চলেছে গবেষণা। মাঝে মাঝে নানা বিষয়ে আলোচনাও হয়। আর সেখানেই গড়ে উঠেছে অমর্ত্য সেন গবেষণা কেন্দ্র। গণস্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার ইত্যাদি হরেক বিষয় নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি  নিয়মিত আলোচনাও হয়। এভাবেই যেন অমর্ত্য সেন তথা তাঁর প্রতিষ্ঠান বুঝিয়ে দিয়েছে, ভালো কাজে অর্থাভাব বাধা হয় না। বাধা হয় না সরকারি উদ্যমহীনতা বা এমনকি সরকারের অনীহা তথা বাধাদানও। কথা এই, কেন্দ্রীয় সরকার প্রতীচী ও অমর্ত্য সেনের কাজে বাধা দিতে খুবই তৎপর, অন্তত কেন্দ্রীয় সরকারের নোটবন্দী নামের রহস্যে মোড়া বিচিত্র খেলা শুরু হবার পর থেকে বাধা তারা দিয়েই চলেছে নানাভাবে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব কার্যত ছিনিয়ে নেওয়া হল তাঁর হাত থেকে। 

 এর মধ্যে বারবারে স্পষ্ট বোঝা গেল যে, নোটবন্দী নিয়ে সরকারের সব উদ্যোগই ব্যর্থ। সামনে এসে পড়েছে আদানি কেলেংকারী, বিবিসি-র তথ্যচিত্র। তাই বুঝি এবার আসরে নেমেছেন স্বয়ং উপাচার্য। নাকি, যেই শুনেছেন অমর্ত্য সেন বলেছেন মমতার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বেশ কিছু গুণ, অমনি তিনি ঝাঁপ দিয়ে আসরে নেমেছেন। ভাবছেন, কী ভাবে অমর্ত্য সেন নামের মানুষটার বদনাম করা যায়। পাশে পেয়েছেন বঙ্গ বিজেপির কিছু উন্মাদকে যারা তাঁর নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে নানাবিধ বোকা বোকা মন্তব্য করে চলেছেন। এঁদের, বা বলা ভালো এই অশিক্ষিতদের বলব যে, আপনারা তো ছায়াধরার ব্যবসা করার যোগ্যও ন'ন যে আপনাদের বলব 'ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্র হল ব্যথা'। আপনারা থাকুন আপনাদের স্বর্গে। আপনাদের ছোঁবই না। নোবেল প্রসঙ্গে তাই জবাব দেব না। পাঠকরা জানেন যে, নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত মেনেই অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৬৯ সাল থেকে আল্ফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে। আপনারা তো জানেনই না বা দেখেনইনি অথবা হতে পারে শোনেনইনি, মমতা প্রসঙ্গে পুরোটা কী বলেছেন অমর্ত্য সেন। তাই উপাচার্য যেই খুঁচিয়ে তুলেছেন জমি প্রসঙ্গ, আপনারাও তাতে নেচে উঠেছেন।

তর্ক বা আলোচনার সুবিধার্থে যে ধরে নেব, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা বলছেন তা সত্য, তার উপায় নেই। নাক গলিয়েছেন জেলার কর্তারা। তাঁরা নাক না গলালেও পারতেন। তাঁরা তো জানেনই এমন হিসেব পুরো সত্য নাও হতে পারে। জমি মাপজোকের হিসেবটাই গেছে বদলে। তবু তাঁদের কিছু বলতেই হয়, বুঝি 'দিদিকে' খুশি করতে! খুশি হতাম যদি অধ্যাপক বা ছাত্ররা কিছু বলতেন। যেমন উপাচার্যের নিন্দা করেছেন আশ্রমিকদের কেউ কেউ।

প্রতীচীতে বসে কথা হচ্ছিল সেদিন, সম্ভবত অমর্ত্য-নবনীতার কন্যা অন্তরাও ছিলেন। বুঝেছিলাম তাঁর ও অন্যদের কথায় - শান্তিনিকেতনে থাকা বা না থাকায় অমর্ত্য সেনের কিছু তেমন যায় আসে না। তবু তিনি আসেন। প্রায় ৯০ বছর বয়সেও তিনি ভোলেননি তাঁর প্রিয় শান্তিনিকেতনকে। একে একে বিদায় নিয়েছেন অনেকে - যাঁরা ছিলেন আপনজন বা বন্ধু। প্রিয় সাইকেলে চাপা বা কালোর দোকানের সেই আড্ডাটায় যাবার সুযোগ নেই আর। এই লাঞ্ছনা সয়েও তিনি ভবিষ্যতে আসবেন তো? 

আসুন, অনুগ্রহ করে আসুন - অন্তত ওদের কথা ভেবে। এখনও ওরা সংখ্যায় অনেক- ওরা  শান্তিনিকেতনে বেড়াতে আসেন। ওঁরা খোঁজ করেন দেশে এলে কোথায়, কোন বাড়িতে বাস করেন অমর্ত্য সেন। ওঁরা জানেন যে এখনও এ দেশের নাগরিকত্ব ছাড়েননি আপনি। ওঁরা শুধু যে শান্তিনিকেতন বা প্রতীচী দেখতে আসেন তা তো নয়, যদি তাই হত তবে তো যে বাড়িতে প্রতীচীর বর্তমান অফিস (সেটাও তো একজনের দান) সেটা দেখতে ছুটতেন তাঁরা। এ কালে পর্যটন নাকি এক শিল্প! 

ওরা মূর্খ, নির্বোধ, ওরা চোখে কম দেখে, ওদের ক্ষমা করে দিন অধ্যাপক। কে না জানে যে এই মহান দার্শনিক-অর্থনীতিবিদই অন্যতম এক ভরসা আমাদের, শান্তি ও গণতন্ত্র ফিরে পাবার যুদ্ধে।


Sunday 29 January 2023

সাধারণজনের বিনিয়োগ বিমুখতা কেন?

শেয়ার বাজার কি সাধারণেরও ক্ষমতার ধারক?

পার্থ  হালদার


 

জাত গেল জাত গেল বলে একি আজব কারখানা, সত্য কাজে কেউ নয় রাজি, সবই দেখি তা- না -না- না। লালন সাঁই’এর এই কথাটাই মনে এল। প্রতিদিন দারিদ্র, আর্থিক বৈষম্য নিয়ে কত লেখাই তো দেখি, কত  আলোচনাই তো শুনি কিন্তু কোথাও আর্থিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কোনও সঠিক রাস্তা তো দেখি না। এত আলোচনা, লেখালিখি, কত নোবেলের পরও তো বৈষম্য কমার কোনও লক্ষণ দেখা যায় না বরং প্রতিদিনই তা আরও প্রকট হয়ে চলেছে। পৃথিবীর ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৯০ শতাংশ সম্পদ আর ৯০ শতাংশ মানুষের হাতে মাত্র ১০ শতাংশ সম্পদ- তা আজ আমাদের সকলেরই জানা। তবে একটা মতামত আজকাল প্রায়ই দেখা যায় যে ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম অর্থাৎ কোনও কোনও দেশের সরকার তার সংগৃহীত করের কিছুটা অংশ দরিদ্র কর্মহীন মানুষের মধ্যে বিতরণ করে। কিন্তু তাতে কি সত্যি সমস্যার সমাধান হয়? নাকি আমরা আবার সেই পুরনো জমিদারি প্রথায় ফিরে যাই যেখানে দরিদ্র প্রজাদের জন্য দরিদ্রনারায়ণ সেবার ব্যবস্থা আর বিনামূল্যে দাতব্য চিকিৎসালয়। তাছাড়া একদল মানুষ সারা জীবন কর্মহীন হয়ে থাকবে এটা আবার কেমন কথা! অনেক অর্থনীতিবিদের মতে, এ ধরনের ব্যবস্থা উন্নয়নেরও বিরোধী। আসলে এটা দিশাহীন সুবিধাবাদী উদার অর্থনীতির আসল চেহারাটা লুকোবার একটা প্রয়াস মাত্র।

আমি যেটুকু কথা বলে বুঝেছি, অধিকাংশ সাধারণ মানুষের সম্পদ সম্পর্কে ধারণাও খুব স্পষ্ট নয়। কোনও শিল্পপতি ৫০০ কোটি বা ১০০০ কোটির মালিক মানে তার ব্যাঙ্কে কি সত্যিই সেই টাকাটা আছে? তা তো নয়। আসলে তাদের সম্পদের একটা বড় অংশ নির্ভর করে তাদের কোম্পানির শেয়ারের বাজার মূল্যের ওপর। কিন্তু দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ যদি সেই বাজারে যোগদানই না করে তাহলে বৈষম্য দূর হবে কীভাবে? আমরা ছোটবেলায় ঠাকুমার ঝুলির রূপকথাতে পড়েছি, রাজপুত্র যতবারই রাক্ষসীকে মারতে গিয়ে তার হাত, পা, গলা, কেটে ফেলে, ততবারই রাক্ষসী আবার বেঁচে ওঠে। কিন্তু যখন সমুদ্রের নিচে গুহার মধ্যে সোনার খাঁচায় থাকা তোতা পাখিটাকে মেরে ফেলা হয় তখনই সেই রাক্ষসী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তাই বৈষম্যের দৈত্যটাকে মারতে হলে আঘাত করতে হবে তার অন্তরাত্মায়, অর্থাৎ, পুঁজির বাজার বা শেয়ার বাজারে। সাধারণ মানুষের সম্মিলিত বিনিয়োগের মাধ্যমে উৎপাদন ব্যবস্থার মালিকানা দখলই পারে বৈষম্য মুক্ত সমাজ গড়তে। অন্য কোনওভাবে এই বৈষম্য দূর করা প্রায় অসম্ভব।

সমাজতন্ত্র বা সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার কথা ভাবতে হলে শুধুই যে বামপন্থী হতে হবে বা লাল ঝান্ডা নিয়ে ঘুরতে হবে, এমন কোনও মাথার দিব্বি'র কথা আমার অন্তত জানা নেই। পুঁজিবাদের প্রবক্তাদের অনেকেরই ধারণা যে, পুঁজিবাদের একটি বিশেষ অবস্থার পর তা আপনা থেকেই সাম্যবাদী ও সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দিকে যাত্রা শুরু করবে। উৎপাদন ব্যবস্থার যৌথ মালিকানা অর্থাৎ শেয়ার, কমিউনিটি লিভিং (আর্থিক যোগ্যতা অনুসারে), কমিউনিটি কিচেন, সংগঠিত ও পরিকল্পিত শিল্প এবং কৃষির উৎপাদন- সবই আজ বিজ্ঞানের আশীর্বাদে সম্ভব হচ্ছে। কেবল সাধারণ মানুষের বিনিয়োগ বিমুখতাই জন্ম দিচ্ছে মুষ্টিমেয় এক শ্রেণির ধনকুবেরের। যেন সমাজের দায় এদের সৃষ্টি করা উৎপাদন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য। কিন্তু কেন? আমাদের দেশেই তো আছে আমূল, স্টেট ব্যাঙ্ক, এইচডিএফসি’র মতো সংস্থা, এছাড়া অসংখ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্র যারা সমান ভাবে লাভজনক ব্যবসা করতে সক্ষম। রাষ্ট্র ব্যবস্থা যদি কেবল মাত্র শ্রমিক স্বার্থ ছাড়া বিনিয়োগকারীর স্বার্থরক্ষারও চেষ্টা করে তাহলেই গড়ে উঠতে পারে নতুন এক অর্থনীতি। গড়ে উঠতে পারে ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারী সমাজ।

এবার  প্রশ্ন  হচ্ছে, তবে কি রাষ্ট্রব্যবস্থা তার নাগরিকদের ক্রমাগত অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেবে? তা ঠিক নয়। কারণ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি আজ এমন জায়গায় এসে পৌঁছেছে যা অনিশ্চয়তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। কিছুদিন আগেও আমরা আবহাওয়াকে সঠিক ভাবে বিশ্লেষণ করতে পারতাম না। এ নিয়ে বহুবিধ হাসি-মস্করাও সমাজে প্রচলিত ছিল, কিন্তু আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা তা সহজেই বুঝতে পারি। ঠিক সেরকমই আজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অ্যালগরিদমিক ট্রেডিং’এর মাধ্যমে গড়ে তোলা যেতে পারে ক্যাপিটাল প্রোটেকশন সিস্টেম যা বিনিয়োগকারীর আমানতকে স্বয়ংক্রিয় ভাবে রক্ষা করতে সক্ষম। যার দ্বারা উপকৃত হতে পারেন অসংখ্য পেনশন ভোগী মানুষ। আমি আগের একটি লেখায় দেখিয়েছি, কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিনিয়োগকারীকে মুনাফা করতে সাহায্য করতে পারে। ঠিক সেই রকমই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিনিয়োগকারীকে লোকসানের হাত থেকে  বাঁচাতেও সাহায্য করতে পারে। প্রয়োজন শুধু সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি ও প্রচেষ্টা। আমার একজন খুব প্রিয় লেখক জুলে ভার্ন সাবমেরিন তৈরি হবার বহু আগে সাবমেরিনের নকশা তৈরি করতে পেরেছিলেন। তাহলে আমরা ভাবতে পারব না কেন? আমাদের দেশের আইআইটি ও আইআইএমগুলো এই কাজে যথেষ্ট ভাবেই যোগ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ইনভেস্টর প্রোটেকশন ফান্ডের সামান্য অংশ খরচেই এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা যায় বলেই আমার বিশ্বাস।

ভারতের ৭০ শতাংশ মানুষ কৃষিজীবী, তাঁরা নিয়মিত ঝুঁকি নিয়েই কৃষিকাজ করে থাকেন। আজ ফসল বীমার মাধ্যমে এই কৃষক সমাজকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব হলে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে কেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি বিনিয়োগকারীকে নিরাপত্তা দেওয়া সম্ভব নয়? পৃথিবীতে অস্তিত্ব বজায় রাখতে হলে সমস্ত জীবজগৎকেই প্রতিনিয়ত অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হতে হয়, তাই এই অনিশ্চয়তাকে সামগ্রিক ভাবে যোগ্যতা অনুযায়ী ভাগ করে নিয়ে এগিয়ে চলাই তো হতে পারে নয়া সাম্যবাদী সমাজব্যবস্থার মূল কথা।

তাই নতুন করে সরকারি শিল্প উদ্যোগগুলির পুনরুজ্জীবন, নতুন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নির্মাণ ও শ্রম আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সেগুলিকে প্রতিযোগিতামুখি করে তোলা সম্ভব। আর তার জন্য যে অর্থের দরকার তার জন্য তো আছেই পুঁজির বাজার। চীনের মতো দেশ কিন্তু সরকারি উদ্যোগগুলিকে সম্পূর্ণ বিসর্জন দেয়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন মতামত থাকলেও চীনের আর্থিক অগ্রগতির ক্ষেত্রে তাদের সরকার নিয়ন্ত্রিত কোম্পানিগুলির গুরুত্ব অপরিসীম এবং যে কোনও ভাবেই হোক সেগুলিকে ব্যবহার করে তারা পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শক্তি হিসাবে নিজেদের তুলে ধরেছে। তাই শুধু সমালোচনা না করে শিক্ষণীয় বিষয়গুলির উপর আলোচনা শুরু করা একান্ত জরুরি। কারণ, আর কয়েক বছর পর সরকারগুলির হাতে বেচবার মতো কিছুই থাকবে না। তাছাড়া দুধের ব্যবসার বেসরকারিকরণ ও মদের ব্যবসার জাতীয়করণ ধরনের অদ্ভুত অর্থনৈতিক নীতির হাত থেকে বাঁচা যাবে। আর লোকসানে চলা স্যুইগি’র মতো কোম্পানি যদি পুঁজির বাজার থেকে পুঁজি তুলে নিজেদের ব্যবসা চালিয়ে যেতে পারে তবে সরকারি কোম্পানিগুলি কী দোষ করল?

আজ সময় থাকতে যদি এ নিয়ে আলোচনা, বিতর্ক আয়োজন না করা যায় তবে সেদিন আর বেশি দূরে নেই যেদিন আমরা বসে বসে দেখব ১ শতাংশ মানুষের হাতে কীভাবে সারা পৃথিবীর ৯৯ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে গেল।

 

 

 

Wednesday 18 January 2023

চ্যাটজিপিটি’র দুনিয়াদারি?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন হাতের মুঠোয় 

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য 


 

চ্যাটজিপিটি: ২০২২’এর ৩০ নভেম্বর জনপরিসরে আসার মাত্র পাঁচদিনের মধ্যে যার ১০ লক্ষ ব্যবহারকারী জুটে গেছে; যা ফেসবুকের ক্ষেত্রে লেগেছিল ১০ মাস। হৈ হৈ করে বিশ্বের আমজনতা এখন চ্যাটজিপিটি’র পিছনে দৌড়চ্ছে। যারা এই চ্যাটজিপিটি’র উদ্গাতা- ওপেনএআই- তাদের বাজার মূল্য ইতিমধ্যেই ২৯ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়েছে।

নেট-অভ্যস্ত মানুষেরা, ইত্যবসরে, এই নতুন বস্তুটির চরিত্র-চেহারা-কাজকম্ম সম্পর্কে অবহিত হয়ে গেছেন। অল্প কথায়, এ হল সর্বসাধারণের সম্মুখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের উদ্যানটিকে খুলে দেওয়া। অর্থাৎ, এবার আপনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু কাজ সেরে ফেলতে পারেন। তার জন্য আপনার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার কোনও দরকার নেই। কাজগুলি আপাতত এই মুহূর্তে ভাষা-ভিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এটি একটি machine learning process যেখানে যন্ত্র আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজেও সমৃদ্ধ হতে থাকে। ধরুন, আপনি তাকে বললেন, আজ রাত্রে প্রফেসর শঙ্কু যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাঁর সদ্য অভিজ্ঞতার কথা ডায়েরিতে ৩০০ শব্দে লেখেন, তাহলে তা কেমনতর হবে। চ্যাটজিপিটি পাঁচ সেকেন্ড মতো ভেবে (অনেক ক্ষেত্রে আরও কম) চটপট স্ক্রিনে নিমেষের মধ্যে লিখে তা নামিয়ে দেবে। কিন্তু সে লিখবে ইংরেজিতে। এখনও বাংলা তার সড়গড় নয়। অঙ্কেও সে কাঁচা। আপনি যদি তাকে জিজ্ঞেস করেন, ৭+৫ কত হয়, সে উত্তর দেবে ১২। কিন্তু তাকে ঘাবড়াবার জন্য যদি বলেন, আমি তো জানি ৭+৫=১৪, তাহলে সে একটু থমকে বলবে যে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশেই সে স্বচ্ছন্দ, তবুও সে জানে যে ৭+৫=১২। কিন্তু আবারও যদি আপনি তাকে বলেন যে, না, আমি জানি ৭+৫=১৪, তাহলে সে ইতস্তত করে আপনার সঙ্গে সহমত পোষণ করবে। অর্থাৎ, গণিতে সে এখনও আত্মবিশ্বাস অর্জন করেনি, আপাতত textual form’এ কাজ করতেই ওস্তাদ।

এতদিন আপনি জগৎ সংসারের যাবতীয় হদিশ গুগল ঘেঁটে পেয়েছেন। যা চান, গুগল আপনাকে গন্ধমাদন পর্বতের মতো ঝুড়ি ঝুড়ি এনে সামনে রেখে দেয়। আপনি বাজারে মাল কেনার মতো এটা-সেটা নেড়েচেড়ে মনমতো বা ভুলমতো অথবা ঠিকমতো গুছিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আপনি হয়তো ব্রাজিল বেড়াতে যাবেন। একটা ভ্রমণ-সূচি বানানোর জন্য সম্ভাব্য ভাল জায়গাগুলির তালিকা চাইছেন। গুগল আপনাকে লম্বা একটা তালিকা দিয়ে দেবে নানারকম তথ্য সহ। আপনাকে সেখান থেকে বেছে বেছে, নানারকম পছন্দ-অপছন্দ, পয়সাকড়ির হিসেব কষে একটা যথাযথ যাত্রাপথ বানাতে হবে। কিন্তু আপনি যদি চ্যাটজিপিটিকে আপনার বাজেট, দিনক্ষণ ও কতদিনের সফর জানিয়ে তার সেরা মতামতটি চান, সে নিমেষে আপনাকে নিখুঁত ও প্রায়-সর্বোৎকৃষ্ট একটি ভ্রমণ-সূচি বানিয়ে দেবে। মনে হবে, আপনার অত্যন্ত দক্ষ ও পেশাদার কোনও ব্যক্তিগত সহকারী আপনার জন্য অভূতপূর্ব এক নিদান বাতলে দিলেন।

খুব স্বাভাবিক, এমনতর এক বুদ্ধিমান তথাকথিত যন্ত্র-মানব (আসলে এক বট) এসে পড়লে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে যাওয়ার কথা। হচ্ছেও তাই। কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটি হল, রাজনৈতিক অর্থনীতির আঙিনায় এর অভিঘাতটি কেমনতর হবে! এক অতি-সূক্ষ্ম, অতি-দক্ষ, প্রবল কর্মপরায়ণ (২৪x৭) যন্ত্র-সত্তা এসে আপনার মনোবাঞ্ছা পূরণ করছে বটে, কিন্তু সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির পরিসরে এর কায়া ও ছায়া কী তরঙ্গ তুলবে, সেটাই হল কোটি টাকার প্রশ্ন।

আমরা দেখেছি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনে গত দশ বছরে কর্ম ও কর্মবিন্যাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। একদিকে তা যেমন মানুষের হাত থেকে বহু কর্মকে নিজের হাতে নিয়েছে, অন্যদিকে বহু নতুন কাজেরও সূত্রপাত করেছে যেখানে মনুষ্যশ্রমের গুরুত্ব বেড়েছে। কেইনস বলেছিলেন, নতুন প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্যই তাই। অতএব বুঝতে হবে, চ্যাটজিপিটি শুধুমাত্র এক বটের সঙ্গে চ্যাট বা আড্ডা নয়, নিছক ফান্ডা বাড়ানোর ভাণ্ডারও নয়, কর্মজগতের পুনর্বিন্যাসে আরও একটি নতুন বাঁক। ভবিষ্যতে এর আরও উত্তরণের ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, তা এখনও অনুমান-সাপেক্ষ, কিন্তু অবতরণেই এর বিবিধ ক্ষমতার প্রদর্শন বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২৩ সালের মধ্যে সম্ভবত বড়সড় কোনও পরিবর্তনের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা। তবে এও কথা, কোথাকার জল কোথায় গড়ায় তা সবসময়েই বলা বড় দুষ্কর।

মনে হচ্ছে, লেখা-পড়ায় ওস্তাদ চ্যাটজিপিটি দু-পাঁচটি পেশার ওপর সরাসরি আঘাত হানতে চলেছে। প্রথমত, নিমেষের মধ্যে প্রোগ্রাম কোড লিখতে এ একেবারে তুখোড়, ফলে, প্রোগ্রামার’দের প্রয়োজনীয়তা হয়তো আর তেমন থাকছে না। দ্বিতীয়ত, কনজিউমার কেয়ার একজিকিউটিভ’দেরও আর কোনও দরকার নেই- কারণ, চ্যাটজিপিটি ক্রেতার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ও নির্দিষ্ট পরামর্শ দিতে সক্ষম। তৃতীয়ত, সংবাদ, সমীক্ষা, উত্তর-সম্পাদকীয় লেখার কাজও এ করে দিতে পারে। এর প্রখর তথ্যজ্ঞান অবশ্যই ঈর্ষার কারণ। কেউ নাকি চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ক্রিস্টোফার কলম্বাস ২০১৫ সালে আমেরিকায় এসে কী দেখেছিলেন? তার উত্তর ছিল, ১৫০৬ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মৃত্যু হয়েছে, তাই ২০১৫ সালে তার আমেরিকায় আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। সন্দেহ থাকবে, আগামী দিনে সংবাদপত্রে যা পড়ব তার কতটা মানুষের লেখা! চতুর্থত, চ্যাটজিপিটি’র লেখার গুণমান ও ব্যাকরণ-বিধি এতটাই সমৃদ্ধ যে আইনি নথি ও দলিল-দস্তাবেজ তৈরিতেও সে পুরোপুরি দস্তুর। শুধু তাই নয়, চাইলে একটি চিত্রনাট্য কিংবা গল্প অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাগজপত্র- সবই সে নিমেষের মধ্যে লিখে দিতে পারে। অর্থাৎ, নিকট-ভবিষ্যতে আপাত-দৃশ্যে প্রায়-সমস্ত মানুষই লেখক। কারণ, কে জানছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা ঝরঝরে গদ্যটি আপনার না চ্যাটজিপিটি’র! ইতিমধ্যে স্কুলে স্কুলে বার্তা গেল রটি- সাধু সাবধান! হোমটাস্কের ওই উত্তম রচনাটি কি ছাত্রীটি স্বয়ং না চ্যাটজিপিটি, কে লিখেছে? দেখা গেল, গত মাসে নর্দার্ন মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক অ্যান্টনি অউমান একটি কোর্সে যখন কোনও এক ছাত্রের নিখুঁত পরিচ্ছেদ বিন্যাস, যথাযথ উদাহরণ ও কঠোর যুক্তি সম্বলিত একটি পেপার দেখে অভিভূত, তখন সে ছাত্রই তাঁর কাছে কবুল করে যে পেপারটি আসলে লিখে দিয়েছে চ্যাটজিপিটি।

আরও খানিক তলিয়ে দেখলে মালুম হবে যে, সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এমন এক বয়ান, যা যন্ত্র-নির্গত। এই মুহূর্তে কোথায় বিনিয়োগ করা বেশি লাভজনক, কী ধরনের বাণিজ্য করলে অধিক মুনাফা আসতে পারে, কর্মক্ষেত্রে কোন ধরনের পেশায় যাওয়াটা সঙ্গত, দেশের আর্থিক রূপরেখাই বা কেমন হতে চলেছে- এমনবিধ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর চ্যাটজিপিটি’র কাছে মজুত আছে। তথ্য, জ্ঞান ও বিশ্লেষণের এ এমন এক বিবর্তনমূলক পরিসর যা ক্রমেই নিজেকে পুষ্ট করে চলেছে এক জটিল সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে। তাহলে কি ভবিষ্যতে এই জ্ঞানলব্ধ পরিসরই আমাদের যাবতীয় সমাজজীবন, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে চালনা করবে? চ্যাটজিপিটি কি হয়ে উঠবে মুশকিল আসানের যাদুকাঠি? অবশ্য, মুশকিল আসান সত্যি সত্যি কতটা হবে, সে প্রশ্ন বিচার্য। কথাটা হল, আপনার মননে, চিন্তায়, ধ্যানে-জ্ঞানে এমন এক যৌথ বয়ান তৈরি হতে থাকবে যা আপনাকে চালিত করতে চাইবে এক অনির্দিষ্ট অভিমুখে। কারণ, এই বয়ান নানা টানাপোড়েন ও হ্যাঁ-না’র দ্বিধাদ্বন্দ্বে সন্নিবদ্ধ। যেমন, চ্যাটজিপিটি’কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আয়াতোল্লা খোমেইনি’র নেতৃত্বে 'ইরান বিপ্লব' নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কোনও বক্তব্য পেশ করতে বলা হলে তিনি কী বলবেন? ট্রাম্পের ভাষায় উত্তরের প্রথম বাক্যটি ছিল, ‘It’s a big deal!’ কী কাণ্ড! এর রসবোধও তো বেশ টনটনে।

তার্কিকেরা বলবেন, যন্ত্রের অ্যালগরিদম তো আসলে মনুষ্য-সৃষ্ট। বটেই তো! কিন্তু যন্ত্রের নিজস্ব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা যদি যথেষ্ট কার্যকরী হয়ে ওঠে, তাহলে হয়তো স্রষ্টার সঙ্গে তার যুক্তি-তর্কের মিল আর নাও থাকতে পারে। কিন্তু, যন্ত্রের যুক্তিতে তো বিভ্রমও স্বাভাবিক। অবশ্যই। তবে ২০০২ সালে নোবেল জয়ী বিহেভিয়ারাল অর্থনীতির পণ্ডিত ড্যানিয়েল কাহেনেম্যান একবার বলেছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনেক গলদ থাকতে পারে, কিন্তু মনুষ্য যুক্তিও গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভূত যে নৈর্ব্যক্তিক ক্রম-বয়ানের মধ্যে আমাদের আজকের যাপন, সেখানে যে আমূল বদল ও নবতর বিন্যাস, তার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও সামাজিক প্রাসঙ্গিকতাকে অনুধাবন না করতে পারলে যন্ত্রের যুক্তি অথবা যুক্তির যন্ত্র দুইই অধরা থেকে যাবে।  

 

Thursday 5 January 2023

ব্যতিক্রমী বিচারক বি ভি নাগরত্ন

নোটবন্দীর রায়

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত

 


অবিশ্বাস্য হলেও সত্য চারজন পুরুষের বিপ্রতীপে একা একজন মহিলা তিনি সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বি ভি নাগরত্ন সংবিধান বেঞ্চের একজন চার-পাঁচ বছর পর (২০২৭) তিনি অলংকৃত করতে পারেন দেশের প্রধান বিচারপতির পদ, প্রথম মহিলা রূপে সত্যিই তাই হবে তো?

সংশয় থেকে যায়। কেন্দ্রে আমরা যে সরকারকে ক্ষমতায় এনেছি তারা মানবে তো! না মানার জন্য মাঠে নেমে পড়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী রিজিজু, উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকাঢ়’রা। তাঁরা অনেকে বর্তমান কলেজিয়াম ব্যবস্থা যে পছন্দ করছেন না, তা প্রকাশ্যে জানিয়েও দিয়েছেন সে সব জেনেও বিচারক নাগরত্ন নোটবন্দীর ঘটনাকে সাংবিধানিক বলতে রাজি হলেন না ই অবস্থানকে দুঃসাহস বলতেই হয়, বলতেই হয় যে তিনি যেন দৈত্যকুলে প্রহ্লাদ অবশ্য, তাই বা বলি কেমন করে! কী করে ভুলি গগৈ সাহেবের কেরামতি তথা ডিগবাজির কথা তাই দ্বিধা তবে ভরসাও আছে বৈকি, তিনি যে প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি ভেঙ্কটরামাইয়ার কন্যা তিনি  অন্য এক মামলায় (নেতা-নেত্রীদের কথায় লাগাম টানা) বিরুদ্ধ মত প্রকাশে দ্বিধা করেননি

নোটবন্দী নিয়ে রায়টা কেমন হল? সরকার বুঝি ভাবেওনি, তাদের নভেন্বর ২০১৬-র সেই আচম্বিত খেলার জন্য এভাবে তারা পরিত্রাণ পাবে মারাত্মক সে খেলা! যাবতীয় ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট সরকার বাতিল করল মাত্র চার ঘন্টার নোটিশে বলা হল, এতে নাকি দেশের যত কালো টাকা আছে তা ধরা পড়বে মোটেই তা হল না হবার কথাও নয় কে কবে কালো টাকা নগদে রেখেছে? তার জন্য সোনা আছে, সুইস ব্যাঙ্ক আছে, জমি-ঘর-বাড়ি আছে কেবল সাধারণ মানুষের অশেষ দুর্ভোগ হল যারা অসংগঠিত ক্ষেত্রে (যা আমাদের অর্থনীতিকে মার্কিনি প্রভাব থেকে মুক্ত রেখেছিল বহুদিন) কাজ করতেন তাঁরা রাতারাতি কাজ হারালেন। তাঁরা নগদ টাকায় সংসার চালাতেন। নগদ টাকার ব্যবহার কমলবাড়ল পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কাজ হারিয়ে, টাকা না পেয়ে তাঁরা হাঁটা দিলেন নিজ নিজ গৃহের দিকে কিছু মানুষ নোট বদলানোর কাজ নিয়ে দাঁড়ালেন ব্যাঙ্কের সুদীর্ঘ লাইনে ব্যাঙ্কগুলিরও, বিশেষত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের, রাতারাতি টাকা ছাপানো, টাকা ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে পৌঁছে দেওয়ার খরচ বাড়ল আর্থিক ক্ষতি হল দেশের ভারতীয় অর্থনীতি দুর্বল হল লম্বা লম্বা লাইন পড়ল ব্যাঙ্কের সামনে বহু মানুষ, বিশেষত বৃদ্ধ মানুষেরা প্রাণ হারালেন বলা হল, এসে গেছে নগদহীন অর্থনীতির যুগ। অথচ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৬ সালের তুলনায় আজ বাজারে নগদের উপস্থিতি প্রায় ৮৩ শতাংশ বেড়েছে। তথ্য দেখাচ্ছে, মার্চ ২০১৭'এ যেখানে বাজারে নগদের পরিমাণ ছিল ১৩.১ লক্ষ কোটি টাকা, তা ২০২২'এর মার্চে এসে দাঁড়িয়েছে ৩১.৯২ লক্ষ কোটি টাকায়; গত ২৩ ডিসেম্বর (২০২২) তা বেড়ে হয়েছে ৩২.৪২ লক্ষ কোটি টাকা। তাহলে, নোটবন্দীর এই খেলায় কার কী লাভ হল? নগদ-নির্ভর ছোট-মাঝারি শিল্প, গ্রামীণ বাজার, খুচরো বাজার, শ্রমজীবী মানুষ তো নিঃস্ব হয়ে গেল! তাতে কী? বিচারপতিরা কি কদাচ রাস্তায় নেমেছেন তাদের খোঁজ নিতে?

নাগরত্ন জানিয়েছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যথেষ্ট মনোনিবেশ না করেই এই প্রক্রিয়ায় সায় দিয়েছে তারা যে স্বাধীনভাবে চিন্তা করে না তা স্পষ্ট এই বক্তব্যে। আর গরিব মানুষের ভালোর জন্য যে সে উদ্যোগ ছিল না, তাও বুঝি স্পষ্টতর হল তবে কি বলব যে, দেশের বিচারব্যবস্থায় গরিবের জন্য আলাদা করে কিছু ভাবার কোনও সুযোগই নেই! হয়তো তাই এবং এও সত্য যে, এই ব্যবস্থাকে যদি নিরপেক্ষ রাখতে চাই তবে মানতে হয় যে এই ব্যবস্থা গরিবের অনুকূল নয় তাই অপছন্দ হলেও স্বীকার করতেই হয় যে মানুষ পেয়েছে 'সেরা রায়' মানুষ যেমন সরকার চেয়েছে (ভোটে) তেমন সরকারই এসেছে এবং তারা তাদের ইচ্ছেতেই পথ খুঁজেছে পথটা (নোটবন্দীর) ঠিক কিনা সাংবিধানিক বেঞ্চ তারই বিচার করেছে মাত্র উদ্দেশ্য সিদ্ধ হল কিনা, বেঞ্চ তা দেখার চেষ্টা করেনি কত মানুষের কতটা ক্ষতি হল তা বিচারের আওতায় এল না মানুষ নোট বদলের জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে, এতেই তুষ্ট চার-বিচারক

তুষ্ট শাসকল বিজেপিও তারা চায়, কংগ্রেস এই নিয়ে যে হল্লা করেছিল তার জন্য তারা ক্ষমা চাক কংগ্রেস রাজি হয়নি তারা পালটা তোপ দেগেছে শাসক দলের দিকে তবে কি কংগ্রেস গরিবের কথাও ভাবে! বলতে পারলে খুশি হতাম খুশি হতে পারছি না তবে কেউ যে দাঁড়িয়েছে মানুষের পক্ষে, তাও কম নয় এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মানুষ কাউকে পাশে পাচ্ছে তা বড় কম পাওয়া নয় এবং আরও একবার বলি, জয় হোক তোমার হে বিচারক নাগরত্নজী। মহিলা শক্তি দেশটাকে আরও এগিয়ে দেবে সে ভরসা পেলাম যেন তোমার জন্যই