Tuesday, 31 January 2023

'অজ্ঞানের অন্ধকারে আড়ালে ঢাকিছ যারে'

অমর্ত্য সেন ও বিশ্বভারতী

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত 



সম্পর্কে তিনি ক্ষিতিমোহন সেনের দৌহিত্র, অমিতা সেনের পুত্র। এই পরিচয় সরিয়ে রেখে শান্তিনিকেতন ছেড়ে যেতে পারেন না তিনি। তিনি অমর্ত্য সেন। তাঁর সম্পর্কে আগেই লিখেছি (অন্যত্র), আবারও লিখব? লিখতে বাধ্য করলেন বিশ্বভারতীর উপাচার্য  মহাশয় (যাঁর কালো হাতের ছোঁয়ায় 'আলাপিনী' থেকে 'কারুসংঘ' সবই আজ বন্ধ)। তাঁর সম্পর্কেও লিখেছি, তাতে কী, তিনি বুঝি দু'কান কাটা, চোখেও দেখেন কম।

প্রমথ চৌধুরি লিখেছিলেন, 'পৃথিবীতে এমন কোনও মত জন্মাতে পারে না যার পিঠ-পিঠ তার উল্টো মত না জন্মায়।' হায় প্রমথবাবু, আপনি বুঝি কদাচ কল্পনাও করেননি যে সমাজ ও সংসারে বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর মতো কেউ থাকতে পারেন যিনি পায়ে পা বাঁধিয়ে যুদ্ধ করায় বুঝি ডক্টরেট! মত নাই তো নাই, বিপরীত মতটা চাপাতে তাঁর জুড়ি নেই। আপাতত অমর্ত্য সেনকে শান্তিনিকেতন ছাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। বিদ্যুৎ চক্রবর্তী হেলাফেলা করার মতো মানুষ নন। জানি না তিনি প্রখর বিষয়বুদ্ধি সম্পন্ন বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ কিনা, হয়তো তাই। তবে বর্তমানে তিনি রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতীর উপাচার্য। অবশ্য, এই উপাচার্য মহাশয়ের দেশ বা পরিচয় আছে কিনা তা নিয়েও সংশয় বেড়েই চলেছে তাঁর কাজে, আচরণে। 

রবীন্দ্রনাথ বহু সাধনায় নাকি পেয়েছিলেন ক্ষিতিমোহনকে। ক্ষিতিমোহন তখন চম্বার মহারাজার দরবারে; সেখান থেকে সামান্য পারিশ্রমিকে কাজ করতে রাজি হয়ে এলেন রবীন্দ্রনাথের কাছে। তখনও অনেক পারিবারিক দায় তাঁর কাঁধে। এমন মানুষকে রবীন্দ্রনাথ ধরে রাখতে চান, পারলে বেঁধে রাখেন শান্তিনিকেতনের চৌহদ্দিতে। অনেক পরে বিশ্বভারতী তাঁকে জমি দেয় লিজে। সে কি অন্যায়? অমর্ত্য সেনের মধ্যে এমন আর এক সুসন্তানকে পেয়েছি আমরা। তাঁকে ধরে রাখবে না আজকের শান্তিনিকেতন? তিনি তো পার্থিব কিছু চাননি। জমিও না। চেয়েছেন শান্তি আর গণতন্ত্র।

আমার মা বলতেন, বেড়াল দিয়ে হালচাষ হয় না। হায় রে মা, তুমি জানো কি রবীন্দ্রনাথ  ঠাকুরের লেখা সেই গানটি- 

'এরা তোমায় কিছু দেবে না, দেবে না- মিথ্যা কহে কত কী ভাণে'...

এ কথা সত্য যে, খুব অর্থকষ্টে ভুগেছে প্রতীচী। ক্রাউড ফান্ডিং ইত্যাদি নানা পথ বিবেচনা করা হয়েছে। সুরাহা মেলেনি। তাই শেষ অবধি নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনই ভরসা। তাঁর টাকাতেই গড়ে উঠেছে প্রতীচী ট্রাস্ট, সেখানে জোর কদমে চলেছে গবেষণা। মাঝে মাঝে নানা বিষয়ে আলোচনাও হয়। আর সেখানেই গড়ে উঠেছে অমর্ত্য সেন গবেষণা কেন্দ্র। গণস্বাস্থ্য, প্রাথমিক শিক্ষা, সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার ইত্যাদি হরেক বিষয় নিয়ে গবেষণার পাশাপাশি  নিয়মিত আলোচনাও হয়। এভাবেই যেন অমর্ত্য সেন তথা তাঁর প্রতিষ্ঠান বুঝিয়ে দিয়েছে, ভালো কাজে অর্থাভাব বাধা হয় না। বাধা হয় না সরকারি উদ্যমহীনতা বা এমনকি সরকারের অনীহা তথা বাধাদানও। কথা এই, কেন্দ্রীয় সরকার প্রতীচী ও অমর্ত্য সেনের কাজে বাধা দিতে খুবই তৎপর, অন্তত কেন্দ্রীয় সরকারের নোটবন্দী নামের রহস্যে মোড়া বিচিত্র খেলা শুরু হবার পর থেকে বাধা তারা দিয়েই চলেছে নানাভাবে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব কার্যত ছিনিয়ে নেওয়া হল তাঁর হাত থেকে। 

 এর মধ্যে বারবারে স্পষ্ট বোঝা গেল যে, নোটবন্দী নিয়ে সরকারের সব উদ্যোগই ব্যর্থ। সামনে এসে পড়েছে আদানি কেলেংকারী, বিবিসি-র তথ্যচিত্র। তাই বুঝি এবার আসরে নেমেছেন স্বয়ং উপাচার্য। নাকি, যেই শুনেছেন অমর্ত্য সেন বলেছেন মমতার মধ্যে রয়েছে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বেশ কিছু গুণ, অমনি তিনি ঝাঁপ দিয়ে আসরে নেমেছেন। ভাবছেন, কী ভাবে অমর্ত্য সেন নামের মানুষটার বদনাম করা যায়। পাশে পেয়েছেন বঙ্গ বিজেপির কিছু উন্মাদকে যারা তাঁর নোবেল প্রাপ্তি নিয়ে নানাবিধ বোকা বোকা মন্তব্য করে চলেছেন। এঁদের, বা বলা ভালো এই অশিক্ষিতদের বলব যে, আপনারা তো ছায়াধরার ব্যবসা করার যোগ্যও ন'ন যে আপনাদের বলব 'ছায়ার সঙ্গে যুদ্ধ করে গাত্র হল ব্যথা'। আপনারা থাকুন আপনাদের স্বর্গে। আপনাদের ছোঁবই না। নোবেল প্রসঙ্গে তাই জবাব দেব না। পাঠকরা জানেন যে, নোবেল কমিটির সিদ্ধান্ত মেনেই অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয় ১৯৬৯ সাল থেকে আল্ফ্রেড নোবেলের স্মৃতিতে। আপনারা তো জানেনই না বা দেখেনইনি অথবা হতে পারে শোনেনইনি, মমতা প্রসঙ্গে পুরোটা কী বলেছেন অমর্ত্য সেন। তাই উপাচার্য যেই খুঁচিয়ে তুলেছেন জমি প্রসঙ্গ, আপনারাও তাতে নেচে উঠেছেন।

তর্ক বা আলোচনার সুবিধার্থে যে ধরে নেব, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যা বলছেন তা সত্য, তার উপায় নেই। নাক গলিয়েছেন জেলার কর্তারা। তাঁরা নাক না গলালেও পারতেন। তাঁরা তো জানেনই এমন হিসেব পুরো সত্য নাও হতে পারে। জমি মাপজোকের হিসেবটাই গেছে বদলে। তবু তাঁদের কিছু বলতেই হয়, বুঝি 'দিদিকে' খুশি করতে! খুশি হতাম যদি অধ্যাপক বা ছাত্ররা কিছু বলতেন। যেমন উপাচার্যের নিন্দা করেছেন আশ্রমিকদের কেউ কেউ।

প্রতীচীতে বসে কথা হচ্ছিল সেদিন, সম্ভবত অমর্ত্য-নবনীতার কন্যা অন্তরাও ছিলেন। বুঝেছিলাম তাঁর ও অন্যদের কথায় - শান্তিনিকেতনে থাকা বা না থাকায় অমর্ত্য সেনের কিছু তেমন যায় আসে না। তবু তিনি আসেন। প্রায় ৯০ বছর বয়সেও তিনি ভোলেননি তাঁর প্রিয় শান্তিনিকেতনকে। একে একে বিদায় নিয়েছেন অনেকে - যাঁরা ছিলেন আপনজন বা বন্ধু। প্রিয় সাইকেলে চাপা বা কালোর দোকানের সেই আড্ডাটায় যাবার সুযোগ নেই আর। এই লাঞ্ছনা সয়েও তিনি ভবিষ্যতে আসবেন তো? 

আসুন, অনুগ্রহ করে আসুন - অন্তত ওদের কথা ভেবে। এখনও ওরা সংখ্যায় অনেক- ওরা  শান্তিনিকেতনে বেড়াতে আসেন। ওঁরা খোঁজ করেন দেশে এলে কোথায়, কোন বাড়িতে বাস করেন অমর্ত্য সেন। ওঁরা জানেন যে এখনও এ দেশের নাগরিকত্ব ছাড়েননি আপনি। ওঁরা শুধু যে শান্তিনিকেতন বা প্রতীচী দেখতে আসেন তা তো নয়, যদি তাই হত তবে তো যে বাড়িতে প্রতীচীর বর্তমান অফিস (সেটাও তো একজনের দান) সেটা দেখতে ছুটতেন তাঁরা। এ কালে পর্যটন নাকি এক শিল্প! 

ওরা মূর্খ, নির্বোধ, ওরা চোখে কম দেখে, ওদের ক্ষমা করে দিন অধ্যাপক। কে না জানে যে এই মহান দার্শনিক-অর্থনীতিবিদই অন্যতম এক ভরসা আমাদের, শান্তি ও গণতন্ত্র ফিরে পাবার যুদ্ধে।


5 comments:

  1. অসিত রায়31 January 2023 at 19:12

    ভালো লেখা, ধন্যবাদ

    ReplyDelete
  2. আরো একটু বেশি হলে ক্ষতি কি ছিল?

    ReplyDelete
  3. Very good comments

    ReplyDelete
  4. বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর মুখোশ উন্মোচন করা আরো বেশি পরিমাণে দরকার।

    ReplyDelete