Wednesday 18 January 2023

চ্যাটজিপিটি’র দুনিয়াদারি?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যখন হাতের মুঠোয় 

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য 


 

চ্যাটজিপিটি: ২০২২’এর ৩০ নভেম্বর জনপরিসরে আসার মাত্র পাঁচদিনের মধ্যে যার ১০ লক্ষ ব্যবহারকারী জুটে গেছে; যা ফেসবুকের ক্ষেত্রে লেগেছিল ১০ মাস। হৈ হৈ করে বিশ্বের আমজনতা এখন চ্যাটজিপিটি’র পিছনে দৌড়চ্ছে। যারা এই চ্যাটজিপিটি’র উদ্গাতা- ওপেনএআই- তাদের বাজার মূল্য ইতিমধ্যেই ২৯ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়েছে।

নেট-অভ্যস্ত মানুষেরা, ইত্যবসরে, এই নতুন বস্তুটির চরিত্র-চেহারা-কাজকম্ম সম্পর্কে অবহিত হয়ে গেছেন। অল্প কথায়, এ হল সর্বসাধারণের সম্মুখে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রয়োগের উদ্যানটিকে খুলে দেওয়া। অর্থাৎ, এবার আপনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে বেশ কিছু কাজ সেরে ফেলতে পারেন। তার জন্য আপনার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠার কোনও দরকার নেই। কাজগুলি আপাতত এই মুহূর্তে ভাষা-ভিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পন্ন হবে। এটি একটি machine learning process যেখানে যন্ত্র আপনার সঙ্গে কথা বলতে বলতে নিজেও সমৃদ্ধ হতে থাকে। ধরুন, আপনি তাকে বললেন, আজ রাত্রে প্রফেসর শঙ্কু যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে তাঁর সদ্য অভিজ্ঞতার কথা ডায়েরিতে ৩০০ শব্দে লেখেন, তাহলে তা কেমনতর হবে। চ্যাটজিপিটি পাঁচ সেকেন্ড মতো ভেবে (অনেক ক্ষেত্রে আরও কম) চটপট স্ক্রিনে নিমেষের মধ্যে লিখে তা নামিয়ে দেবে। কিন্তু সে লিখবে ইংরেজিতে। এখনও বাংলা তার সড়গড় নয়। অঙ্কেও সে কাঁচা। আপনি যদি তাকে জিজ্ঞেস করেন, ৭+৫ কত হয়, সে উত্তর দেবে ১২। কিন্তু তাকে ঘাবড়াবার জন্য যদি বলেন, আমি তো জানি ৭+৫=১৪, তাহলে সে একটু থমকে বলবে যে ভাষার মাধ্যমে প্রকাশেই সে স্বচ্ছন্দ, তবুও সে জানে যে ৭+৫=১২। কিন্তু আবারও যদি আপনি তাকে বলেন যে, না, আমি জানি ৭+৫=১৪, তাহলে সে ইতস্তত করে আপনার সঙ্গে সহমত পোষণ করবে। অর্থাৎ, গণিতে সে এখনও আত্মবিশ্বাস অর্জন করেনি, আপাতত textual form’এ কাজ করতেই ওস্তাদ।

এতদিন আপনি জগৎ সংসারের যাবতীয় হদিশ গুগল ঘেঁটে পেয়েছেন। যা চান, গুগল আপনাকে গন্ধমাদন পর্বতের মতো ঝুড়ি ঝুড়ি এনে সামনে রেখে দেয়। আপনি বাজারে মাল কেনার মতো এটা-সেটা নেড়েচেড়ে মনমতো বা ভুলমতো অথবা ঠিকমতো গুছিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেন। আপনি হয়তো ব্রাজিল বেড়াতে যাবেন। একটা ভ্রমণ-সূচি বানানোর জন্য সম্ভাব্য ভাল জায়গাগুলির তালিকা চাইছেন। গুগল আপনাকে লম্বা একটা তালিকা দিয়ে দেবে নানারকম তথ্য সহ। আপনাকে সেখান থেকে বেছে বেছে, নানারকম পছন্দ-অপছন্দ, পয়সাকড়ির হিসেব কষে একটা যথাযথ যাত্রাপথ বানাতে হবে। কিন্তু আপনি যদি চ্যাটজিপিটিকে আপনার বাজেট, দিনক্ষণ ও কতদিনের সফর জানিয়ে তার সেরা মতামতটি চান, সে নিমেষে আপনাকে নিখুঁত ও প্রায়-সর্বোৎকৃষ্ট একটি ভ্রমণ-সূচি বানিয়ে দেবে। মনে হবে, আপনার অত্যন্ত দক্ষ ও পেশাদার কোনও ব্যক্তিগত সহকারী আপনার জন্য অভূতপূর্ব এক নিদান বাতলে দিলেন।

খুব স্বাভাবিক, এমনতর এক বুদ্ধিমান তথাকথিত যন্ত্র-মানব (আসলে এক বট) এসে পড়লে হুলুস্থুল কাণ্ড বেঁধে যাওয়ার কথা। হচ্ছেও তাই। কিন্তু মৌলিক প্রশ্নটি হল, রাজনৈতিক অর্থনীতির আঙিনায় এর অভিঘাতটি কেমনতর হবে! এক অতি-সূক্ষ্ম, অতি-দক্ষ, প্রবল কর্মপরায়ণ (২৪x৭) যন্ত্র-সত্তা এসে আপনার মনোবাঞ্ছা পূরণ করছে বটে, কিন্তু সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতির পরিসরে এর কায়া ও ছায়া কী তরঙ্গ তুলবে, সেটাই হল কোটি টাকার প্রশ্ন।

আমরা দেখেছি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আগমনে গত দশ বছরে কর্ম ও কর্মবিন্যাসে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে। একদিকে তা যেমন মানুষের হাত থেকে বহু কর্মকে নিজের হাতে নিয়েছে, অন্যদিকে বহু নতুন কাজেরও সূত্রপাত করেছে যেখানে মনুষ্যশ্রমের গুরুত্ব বেড়েছে। কেইনস বলেছিলেন, নতুন প্রযুক্তির বৈশিষ্ট্যই তাই। অতএব বুঝতে হবে, চ্যাটজিপিটি শুধুমাত্র এক বটের সঙ্গে চ্যাট বা আড্ডা নয়, নিছক ফান্ডা বাড়ানোর ভাণ্ডারও নয়, কর্মজগতের পুনর্বিন্যাসে আরও একটি নতুন বাঁক। ভবিষ্যতে এর আরও উত্তরণের ফলাফল কী দাঁড়াতে পারে, তা এখনও অনুমান-সাপেক্ষ, কিন্তু অবতরণেই এর বিবিধ ক্ষমতার প্রদর্শন বুঝিয়ে দিচ্ছে যে, ২০২৩ সালের মধ্যে সম্ভবত বড়সড় কোনও পরিবর্তনের সাক্ষী হতে চলেছি আমরা। তবে এও কথা, কোথাকার জল কোথায় গড়ায় তা সবসময়েই বলা বড় দুষ্কর।

মনে হচ্ছে, লেখা-পড়ায় ওস্তাদ চ্যাটজিপিটি দু-পাঁচটি পেশার ওপর সরাসরি আঘাত হানতে চলেছে। প্রথমত, নিমেষের মধ্যে প্রোগ্রাম কোড লিখতে এ একেবারে তুখোড়, ফলে, প্রোগ্রামার’দের প্রয়োজনীয়তা হয়তো আর তেমন থাকছে না। দ্বিতীয়ত, কনজিউমার কেয়ার একজিকিউটিভ’দেরও আর কোনও দরকার নেই- কারণ, চ্যাটজিপিটি ক্রেতার সমস্ত প্রশ্নের উত্তর ও নির্দিষ্ট পরামর্শ দিতে সক্ষম। তৃতীয়ত, সংবাদ, সমীক্ষা, উত্তর-সম্পাদকীয় লেখার কাজও এ করে দিতে পারে। এর প্রখর তথ্যজ্ঞান অবশ্যই ঈর্ষার কারণ। কেউ নাকি চ্যাটজিপিটিকে জিজ্ঞেস করেছিল, ক্রিস্টোফার কলম্বাস ২০১৫ সালে আমেরিকায় এসে কী দেখেছিলেন? তার উত্তর ছিল, ১৫০৬ সালে ক্রিস্টোফার কলম্বাসের মৃত্যু হয়েছে, তাই ২০১৫ সালে তার আমেরিকায় আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। সন্দেহ থাকবে, আগামী দিনে সংবাদপত্রে যা পড়ব তার কতটা মানুষের লেখা! চতুর্থত, চ্যাটজিপিটি’র লেখার গুণমান ও ব্যাকরণ-বিধি এতটাই সমৃদ্ধ যে আইনি নথি ও দলিল-দস্তাবেজ তৈরিতেও সে পুরোপুরি দস্তুর। শুধু তাই নয়, চাইলে একটি চিত্রনাট্য কিংবা গল্প অথবা ব্যবসা-বাণিজ্যের কাগজপত্র- সবই সে নিমেষের মধ্যে লিখে দিতে পারে। অর্থাৎ, নিকট-ভবিষ্যতে আপাত-দৃশ্যে প্রায়-সমস্ত মানুষই লেখক। কারণ, কে জানছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আপলোড করা ঝরঝরে গদ্যটি আপনার না চ্যাটজিপিটি’র! ইতিমধ্যে স্কুলে স্কুলে বার্তা গেল রটি- সাধু সাবধান! হোমটাস্কের ওই উত্তম রচনাটি কি ছাত্রীটি স্বয়ং না চ্যাটজিপিটি, কে লিখেছে? দেখা গেল, গত মাসে নর্দার্ন মিচিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শনের অধ্যাপক অ্যান্টনি অউমান একটি কোর্সে যখন কোনও এক ছাত্রের নিখুঁত পরিচ্ছেদ বিন্যাস, যথাযথ উদাহরণ ও কঠোর যুক্তি সম্বলিত একটি পেপার দেখে অভিভূত, তখন সে ছাত্রই তাঁর কাছে কবুল করে যে পেপারটি আসলে লিখে দিয়েছে চ্যাটজিপিটি।

আরও খানিক তলিয়ে দেখলে মালুম হবে যে, সমাজ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকবে এমন এক বয়ান, যা যন্ত্র-নির্গত। এই মুহূর্তে কোথায় বিনিয়োগ করা বেশি লাভজনক, কী ধরনের বাণিজ্য করলে অধিক মুনাফা আসতে পারে, কর্মক্ষেত্রে কোন ধরনের পেশায় যাওয়াটা সঙ্গত, দেশের আর্থিক রূপরেখাই বা কেমন হতে চলেছে- এমনবিধ সমস্ত প্রশ্নের উত্তর চ্যাটজিপিটি’র কাছে মজুত আছে। তথ্য, জ্ঞান ও বিশ্লেষণের এ এমন এক বিবর্তনমূলক পরিসর যা ক্রমেই নিজেকে পুষ্ট করে চলেছে এক জটিল সংশ্লেষের মধ্য দিয়ে। তাহলে কি ভবিষ্যতে এই জ্ঞানলব্ধ পরিসরই আমাদের যাবতীয় সমাজজীবন, অর্থনীতি ও রাজনীতিকে চালনা করবে? চ্যাটজিপিটি কি হয়ে উঠবে মুশকিল আসানের যাদুকাঠি? অবশ্য, মুশকিল আসান সত্যি সত্যি কতটা হবে, সে প্রশ্ন বিচার্য। কথাটা হল, আপনার মননে, চিন্তায়, ধ্যানে-জ্ঞানে এমন এক যৌথ বয়ান তৈরি হতে থাকবে যা আপনাকে চালিত করতে চাইবে এক অনির্দিষ্ট অভিমুখে। কারণ, এই বয়ান নানা টানাপোড়েন ও হ্যাঁ-না’র দ্বিধাদ্বন্দ্বে সন্নিবদ্ধ। যেমন, চ্যাটজিপিটি’কে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আয়াতোল্লা খোমেইনি’র নেতৃত্বে 'ইরান বিপ্লব' নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কোনও বক্তব্য পেশ করতে বলা হলে তিনি কী বলবেন? ট্রাম্পের ভাষায় উত্তরের প্রথম বাক্যটি ছিল, ‘It’s a big deal!’ কী কাণ্ড! এর রসবোধও তো বেশ টনটনে।

তার্কিকেরা বলবেন, যন্ত্রের অ্যালগরিদম তো আসলে মনুষ্য-সৃষ্ট। বটেই তো! কিন্তু যন্ত্রের নিজস্ব ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণী ক্ষমতা যদি যথেষ্ট কার্যকরী হয়ে ওঠে, তাহলে হয়তো স্রষ্টার সঙ্গে তার যুক্তি-তর্কের মিল আর নাও থাকতে পারে। কিন্তু, যন্ত্রের যুক্তিতে তো বিভ্রমও স্বাভাবিক। অবশ্যই। তবে ২০০২ সালে নোবেল জয়ী বিহেভিয়ারাল অর্থনীতির পণ্ডিত ড্যানিয়েল কাহেনেম্যান একবার বলেছিলেন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অনেক গলদ থাকতে পারে, কিন্তু মনুষ্য যুক্তিও গভীরভাবে ত্রুটিপূর্ণ।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্ভূত যে নৈর্ব্যক্তিক ক্রম-বয়ানের মধ্যে আমাদের আজকের যাপন, সেখানে যে আমূল বদল ও নবতর বিন্যাস, তার অন্তর্নিহিত রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও সামাজিক প্রাসঙ্গিকতাকে অনুধাবন না করতে পারলে যন্ত্রের যুক্তি অথবা যুক্তির যন্ত্র দুইই অধরা থেকে যাবে।  

 

9 comments:

  1. ভালো লাগছে জেনে।কে কীভাৎবে কাজে লাগায় দেখতে হবে। রাষ্ট্রে দুশ্চরিত্র ও নাগরিক অধিকার, ব্যক্তি স্বার্থ ও জনস্বার্থ কীভবে অগ্রসর হয় দেখতে হবে। লেখাটি ভালো।
    অসিত রায়

    ReplyDelete
  2. বাহ্ বাহ্ বেশ তো!!
    চমৎকার!!!!

    ReplyDelete
  3. ভালো লেখা।👌

    ReplyDelete
  4. সমৃদ্ধ হলাম

    ReplyDelete

  5. অপেক্ষায় থাকলাম আগামী দিনে এর উত্তরণ দেখার জন্য।

    ReplyDelete
  6. খুব ভালো লাগলো পড়ে, অনেক নতুন তথ্য পেলাম। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  7. ভয়ংকর সুন্দর!!

    ReplyDelete
  8. খুব, খুব ভালো !!!!!

    ReplyDelete