Sunday 24 September 2023

'জওয়ান'এর সত্যি-মিথ্যে

ফ্যান্টাসির জগতে কিছু সাহসী বাচন

সৌভিক দত্ত



জয়, রাজ, সোম আর দীপেন- চার বন্ধু এই রবিবার দুপুরে গিয়েছিল 'জ‌ওয়ান' দেখতে। জয়ের ফ্ল্যাটটা আইনক্সের কাছেই। ওই বলল, চল আমার ওখানে একটু আড্ডা মেরে তারপর যাবি। চার বন্ধু আর জয়ের স্ত্রী পৃথার আড্ডায় কান পাততে হল 'একক মাত্রা'র জন্যে।

সোম- এই নিয়ে তোর কবার হল জয়?

জয়- মাত্র ছ' বার।

সোম- তোর মতো পাগলরাই ছবিটাকে হিট করে দিবি।

জয়- ওরে এটা অর্ডিনারি হিট না বুঝলি, প্রথম ১৭ দিনে জ‌ওয়ান শুধু ইন্ডিয়াতে ৫৪৫ কোটি টাকার বিজনেস করেছে আর গোটা বিশ্বে ধরলে হাজার কোটির কাছাকাছি। ধারেকাছে কেউ নেই রে! এটা শুধু আমার মতো কয়েকজন করতে পারে?

রাজ- এটা কিন্তু ঠিক। শাহরুখের কমিটেড ফ্যানবেস এই মেগাহিট দিতে পারত না। সিনেমাটা কিন্তু শাহরুখ ফ্যানদের বাইরেও একটা সাড়া ফেলেছে। 

পৃথা- তা তো ফেলেইছে। ফর দ্যাট ম্যাটার, আমি তো সেভাবে শাহরুখ ফ্যান না, কিন্তু আমার তো খুব ভালো লেগেছে। আমিও জয়ের সাথে দুবার দেখেছি।

রাজ- সে কি, শাহরুখ তো মেয়ে মহলেই বেশি পপুলার!

পৃথা- কম বয়সে আমিও ছিলাম তো, কিন্তু ওর ম্যানারিজম একটা সময় থেকে একটু একঘেয়ে লাগতে শুরু করে।

সোম- বেশ, পৃথা একসময় ফ্যান থাকলেও এখন তো আর নেই, তবু তোমার এই মুভিটা কেন ভালো লাগল একটু বলো!

পৃথা- দেখুন, আমার কাছে গোটা ফিল্মটা ভালো লেগেছে। শাহরুখের ফিল্ম বলে না। আইডিয়াটা বেশ ভালো। এই যে রিয়েল লাইফ সমস্যাগুলোকে সিনেমায় তুলে আনা- এটা বেশ নতুন। 

সোম- নতুন বলা যায় কী? রাজকুমার হিরানির 'লগে রহো মুন্নাভাই', 'থ্রি ইডিয়টস', নীরজ পান্ডের 'এ ওয়েডনেসডে', রাকেশ মেহেরার 'রং দে বাসন্তী' এগুলোও তো রিয়েল লাইফ প্রবলেমের ওপর দাঁড়িয়ে তৈরি করা।

পৃথা- এটাতে কিন্তু একটা নয়, একের পর এক বার্নিং ইস্যু তুলে আনা হয়েছে- কৃষি ঋণ জনিত কারণে কৃষক আত্মহত্যা, হাসপাতালের দুরবস্থা, ইন্ডাস্ট্রিয়াল পল্যুশন, কর্পোরেট ফান্ডিং- আজকের ভারতের প্রতিটা বড় সমস্যাকে হাইলাইট করা হয়েছে। ধ্রুব রাঠি নামে একটি ছেলের ইউটিউব চ্যানেল আছে। ওটাতে 'জ‌ওয়ান' নিয়ে এপিসোডটা একবার দেখবেন (https://www.youtube.com/watch?v=HodJLhRV7gY)। ও আলোচনা করেছে, জ‌ওয়ানের প্রতিটা ইস্যু কোন কোন সত্যি ঘটনার ওপর দাঁড়িয়ে আছে।

সোম- আচ্ছা পৃথা, এই সমস্যাগুলো যে আছে তা কি আমরা একটা সিনেমা দেখে জানব? নাকি একটা হিট ছবিতে দেখলে তবে তা নিয়ে ভাবতে শুরু করব?

পৃথা- তা নিশ্চয়ই নয় সোমদা। যারা আপনার মতো সচেতন মানুষ, দেশের হালহকিকতের খবর রাখেন তাঁদের কথা তো হচ্ছে না, আমি বলছি দেশের আমজনতার কথা। যারা বিবিসি নিউজ চ্যানেল দেখে না, ব্লুমবার্গ বা হিনডেনবার্গ কী তা জানে না, তাদের কাছে তো এইসব খবর পৌঁছে দেওয়ার দরকার আছে!

রাজ- আলবাত আছে। বিশেষ করে আজকের মোডিফায়েড ইন্ডিয়ায় আরও বেশি দরকার আছে। দেশি মিডিয়াকে তো পুরো পকেটে পুরে ফেলেছে। কেউ একটা ট্যাঁফোঁ করতে সাহস পায় না। করলেই ইডি সিবিআই লেলিয়ে দেবে। অঘোষিত এমার্জেন্সি!

জয়- আর এই জামানায় এরকম একটা ফিল্ম বানানোর মতো বাপের ব্যাটা একজন‌ই আছে- বলিউড বাদশাহ শাহরুখ খান! মাইরি দম আছে লোকটার। আর এটা তো ওর বাবার প্রতি একটা ট্রিবিউট। ওঁর বাবা তো ফ্রিডম ফাইটার ছিলেন। ওর ধমনীতে সেই ফাইটারের রক্ত ব‌ইছে। যত‌ই সাকসেস পাক, ওর পা'টা এখনও মাটিতে। ওর মধ্যে একটা রেবেল বেঁচে আছে!

পৃথা- শাহরুখ যে কারণেই করে থাকুক, আমার মতে, কতকগুলো ভাইটাল ইস্যুকে একাডেমিক আর ইন্টেলেকচুয়ালদের চার দেওয়ালের বাইরে টেনে একদম পাবলিক ডোমেইনের বড় রাস্তায় এনে ফেলেছে। 

রাজ- আর সে জন্যই দিল্লি আর নাগপুরে ধুকপুকুনি শুরু হয়েছে। আমি তো বলব, ওই INDIA জোটের চেয়েও এটা বড় ধাক্কা। ওই জোট ঘোঁটের খেলায় বিজেপি ওস্তাদ খেলোয়াড়। সেটা ওদের চেনা মাঠ। কিন্তু এই খেলায় তেমন প্লেয়ার ওদের হাতে নেই। ওই বিবেক অগ্নিহোত্রী, অনুপম খের আর কঙ্গনা রানাওয়াত'এর কাদা ছোড়াছুড়ি দিয়ে এই ঢেউকে সামলানো যাবে না। 

জয়- ইয়েস! শাহরুখের সামনে এইসব চুনোপুঁটিরা জাস্ট ভেসে যাবে! আরে, অন্য কেউ বানালে এই ছবি রিলিজ করতেই দিত না । নেহাৎ বেতাজ বাদশাহ শাহরুখ বলে সাহস পায়নি। সারা দুনিয়ায় মুখ পুড়ত।

পৃথা- তাছাড়া আজকের নেট দুনিয়ায় ছবি ব্যান করে দেখা আটকানো যায় নাকি? বরং নিষিদ্ধ হলে লোকে আরও গোগ্রাসে গিলত!

সোম- আরে, গোমাতার সন্তানরা অতশত ভাবে না। আসল কথা হল, শাহরুখ-গৌরী, অ্যাটলি'রা বুদ্ধি করে ফিল্মটাতে কয়েক ফোঁটা দেশপ্রেমের জোলাপ‌ও মিশিয়ে দিয়েছে! তাকে ব্যান করলে তো সেমসাইড হয়ে যাবে না?

সোম- নামটাই ধর। সেটার মধ্যেই এই ন্যাশনালিস্ট সেন্টিমেন্টকে ধরার চেষ্টা আছে। গল্পের যা প্লট তাতে এই নামটা খুব obvious choice নয়। আর যে ইস্যুগুলো তোলা হয়েছে বলে তোরা সবাই এত উত্তেজিত, সেগুলো যে রিয়েল তা নিয়ে কারও মনে কোনও সন্দেহই নেই। কিন্তু সেগুলোর যে অ্যাবসার্ড সল্যুশন দেখানো হয়েছে সেটা তো ইস্যুগুলোকে ডাইলিউট করে দেয়। কৃষি ঋণ সমস্যার সমাধান হচ্ছে মেট্রো রেল হাইজ্যাক করে। হাসপাতালের হাল ফেরানো হচ্ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বুকে গুলি চালিয়ে তাকে কিডন্যাপ করে। এই ট্রিভিয়ালাইজেশন‌ও এক ধরনের সাবভার্সন। এর থেকে লোকের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল হবে যে এই সমস্যাগুলো নিয়ে বড়জোর আকাশকুসুম কল্পনা করা যায়। কিন্তু কোনও প্র্যাক্টিকাল সলিউশন খুঁজতে যাওয়া বৃথা। দ্য সলিউশনস আর ওনলি ইন দ্য রিলম অফ চাইল্ডিস ফ্যান্টাসি।

রাজ- আরে ভাই, তুই কি এক্সপেক্ট করছিস শাহরুখ খান লেনিনের মতো 'What is to be done' গোছের ব‌ই লিখবে? কেন ভুলে যাচ্ছিস যে এটা একটা মেনস্ট্রিম কমার্শিয়াল মুভি! এর প্রধান উদ্দেশ্য হল ব্যবসা আর এন্টারটেইনমেন্ট। 

জয়- আর সেই কাজে শাহরুখ টু হান্ড্রেড পার্সেন্ট সাকসেসফুল!

সোম- পথে এসো বাছারা। তোমরাই তো বাবা 'জ‌ওয়ান'কে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছিলে যেন এটা একটা কাউন্টার হেজিমনি মুভমেন্ট সূচনা করেছে। শাহরুখ খান যেন চে গুয়েভারা! বরং আমার মনে হয়, এটা একটা কমপ্লেক্স লেভেলের পারসুয়েসিভ হেজিমনির উদাহরণ। ক্ষমতা তার ক্ষতস্থানগুলো দেখানো ও সেগুলো নিরাময়ের মন ভোলানো কিন্তু আষাঢ়ে গল্প শোনানোর প্রকল্পটাও নিজেই আত্মসাৎ করবে। 

জয়- সে তুমি হেজিমনি হেজিমনি বলে যত‌ই হেজাও, মেন কথা হচ্ছে যে পাবলিক খাচ্ছে- একেবারে চেটেপুটে খাচ্ছে। আর গণতন্ত্রে পাবলিকই হল শেষ কথা!

পৃথা- হয়তো পাবলিকের মধ্যেও এই ইস্যুগুলো চাপা ছিল, কিন্তু তাদের বলার কোনও ফোরাম পাচ্ছিল না। একজন হিরো তাঁদের কথাগুলো বলছে দেখে তাঁরা এরকম স্বতঃস্ফূর্তভাবে সাড়া দিচ্ছে আর সেটাই টিকিটের লাইনে রিফ্লেক্টেড হচ্ছে।

রাজ- শুধু টিকিটের লাইনে না, ভোটের লাইনেও হবে। সত্যজিৎ রায় তো রিয়েলিস্টিক ছবি করতেন। 'হীরক রাজার দেশে' উনিও দেখিয়েছিলেন যে 'দড়ি ধরে মারো টান রাজা হবে খান খান'। বাস্তবে কি আর ওইভাবে রাজতন্ত্রের পতন হয়? এগুলো হলো সিম্বলিক। কাউ-ডাং খোরগুলো এবার বিদেয় হবে। সিস্টেমকে এই জোর ধাক্কা দেওয়াটা খুব জরুরি ছিল। ধাক্কা খেয়ে যদি একটু ঠিকঠাক হয়।

সোম- আমি কিন্তু কিছুতেই ওইরকম অপটিমিস্ট হতে পারছি না। সিস্টেমকে ধাক্কা দেওয়া কি এতই সোজা? বিশেষ করে সেই সিস্টেমের একজন তল্পিবাহকের পক্ষে? তোরা যেগুলো রিয়েল ইস্যু বলছিস, সেই ঋণখেলাপি বা ভেঙে পড়া জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা- এগুলো হচ্ছে রিয়েল ইস্যু'র এক একটা উপসর্গ। আর রিয়েল ইস্যুকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য ক্ষমতা যে অসংখ্য মনোরঞ্জনমূলক জুমলার আয়োজন করে থাকে এই উপমহাদেশে তার প্রধান দুটো হল সিনেমা আর ক্রিকেট। আইপিএল'এ শাহরুখের মালিকানাধীন যে 'রেড চিলিজ এন্টারটেইনমেন্ট' একটা অন্যতম বড় ফ্রাঞ্চাইজি সেটাই এই ছবির প্রযোজক। আমার মজা লাগছে এই দেখে, যে লোকটা এই সিস্টেমের একজন প্রধান বেনিফিশিয়ারি তাকেই তোরা এটা ভাঙ্গার জন্য মসীহ ঠাওরেছিস। রাজ আর জয় তোরা আসলে একটা ফিক্সড ধারণার প্রিজনার হয়ে গেছিস।

পৃথা- আমিও কিন্তু কোনও মৌলিক বা বড় পরিবর্তন আশা করছি না। 

দীপেন- আচ্ছা রাত কিন্তু অনেক হল, আমার মনে হয় এবার বেরতে হবে।

জয়- না, ওই কচুরিগুলো শেষ না করে উঠতে দেব না। আর দীপেন এতো চুপচাপ কেন? তুই ও তো 'জ‌ওয়ান' দেখলি, তোর কি কিছুই বলার নেই? 

দীপেন- না আসলে, জানিস‌ই তো আমি একটু কনফিউজড মানুষ। তোদের সবার মতো এত সিওর হয়ে কিছু বলতে পারি না। 

পৃথা- বেশ একটু আনসিওর হয়েই বলুন না কী মনে হয়!

দীপেন- হয়তো আমি ভুল বলছি, কিন্তু আমার মনে হয় যে সিস্টেম বদলানোর ব্যাপারে বা ক্ষমতা বলতে আমরা যে মূলত রাষ্ট্রকেই বোঝাই, এটা হয়তো পুরোপুরি ঠিক নয়। মানে, রাষ্ট্রই ক্ষমতার একমাত্র কেন্দ্র নয়, আরও অনেক কেন্দ্র আছে।

সোম- জিও গুরু, গুটিগুটি মিশেল ফুকোর দিকে এগোচ্ছে মনে হচ্ছে ...

পৃথা- সোমদা প্লিজ, দীপেনদা এতক্ষণ একটা কথাও বলেননি, একটু বলতে দিন না।

দীপেন- দেখ সোম, আমি তোর মতো অত পড়াশোনা করিনি, বিশেষ করে পোস্ট-মডার্নিজম এসব একেবারেই জানি না। ফুকো-টুকো আমার সিলেবাসের বাইরে। সাধারণ বুদ্ধিতে যা মনে হয় তাই বলছি। আমার ধারণা, সব বিষয়ে আমাদের চিন্তা বড় বেশি রাষ্ট্র নির্ভর। আমরা আদর্শ রাষ্ট্র আশা করি, কিন্তু সমাজের কুৎসিত বিশ্বাস ও ব্যবস্থা দূর করার চেষ্টা করি না। আমরা আমাদের পারিবারিক কুপ্রথাগুলো সংশোধন করার কোনও উদ্যোগ নিই না। নিজেদের বা সন্তানদের মানুষ হিসেবে উন্নত করে তোলার বিষয়ে আমাদের কোনও উৎসাহ নেই। আর সে জন্য আমরা সমস্যাগুলোর সমাধান হিসেবে আমাদের ম্যাজিক দেখতে ভালো লাগে। যেরকম ম্যাজিক শাহরুখরা দেখিয়েছেন 'জ‌ওয়ান' ছবিতে। 

রাজ- সামাজিক আর পারিবারিক কুপ্রথা বলতে কি তুই জাতপাত এসব বোঝাচ্ছিস?

দীপেন- সেগুলো তো অনেক বড় সমস্যা। ছোটখাটো অনেক কিছু আছে যা আমাদের হাতের মধ্যে। সে সব নিয়েও কি আমরা কিছু করি? যেমন ধর, বিয়ে শাদী উপলক্ষে যে বিরাট অপচয়ের একটা বিচ্ছিরি খেলায় আমরা মেতে উঠি আমাদের মতো দেশে, যেখানে এত দারিদ্র্য, এত অনাহার তেমন দেশ বা সমাজের পক্ষে কি তা মানানস‌ই? আজ যদি আমি টুকুনের বিয়ে দিই- অন্তত পঞ্চাশ লাখ টাকার বাজেট নিয়ে নামতে হবে। ন‌ইলে সোসাইটিতে আমাদের তথাকথিত প্রেস্টিজ থাকবে না। আমি তোদের পঞ্চব্যঞ্জনে আপ্যায়ন করব আর তোরাও অহেতুক দামী দামী উপহার নিয়ে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবি।  পুরো অনুষ্ঠানটা ঘিরে যে কোটি টাকার মতো উড়ে যাবে, যার বেশিরভাগই গয়নাগাটির পেছনে, সেটার কিন্তু অনেক ভালো বিকল্প ব্যবহার হতে পারত। এবং লাখ দুয়েক খরচ করেই একটা যথেষ্ট সুন্দর ছিমছাম বিয়ের ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু সেটা কিছুতেই হবার নয়। কেউ আমাদের বাধ্য করবে না অথচ আমরা নিদারুণ অসহায়। আমি নিজের দিকে যখন তাকাই তখন ওই বড় বড় সমস্যা নিয়ে লম্বা চ‌ওড়া কথা বলতে নিজের কানেই বাজে।

জয়- যাহ্ টুকুনের বিয়েতে খুব হুল্লোড় করব, কব্জি ডুবিয়ে খাব ভাবছিলাম কিন্তু এখন তো হাওয়া সুবিধের ঠেকছে না। 

রাজ- বিয়েবাড়ি কী, তোরা আজই যা খাইয়েছিস জয়, আমার পেটটা কেমন আইঢাই করছে। পৃথা, বাড়িতে জোয়ানের আরক জাতীয় কিছু আছে?

সোম- আরে জোয়ানের আরক টারক কিছু লাগবে না। আজ 'জ‌ওয়ান'এর আরকের যা ডোজ পড়েছে, চল হেঁটে ফিরি পেট হাল্কা হাল্কা হয়ে যাবে।

জয় আর পৃথাকে বিদায় জানিয়ে তিন বন্ধু হাসতে হাসতে বেরিয়ে পড়ে রাস্তায়।


Saturday 23 September 2023

জলে নামব বেণী ভেজাব না

বঙ্গে জোট INDIA'র জটিলতা

কল্যাণ সেনগুপ্ত



রাজ্য রাজনীতিতে মমতা বিরোধিতার সুযোগ নিয়ে শুভেন্দু অধিকারী কংগ্রেস ও সিপিএম নেতা কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছে, 'নো ভোট টু মমতা' আওয়াজ তুলে সব ভোটকে তাদের দলে ভেড়াতে। একমাত্র এ পন্থাতেই নাকি মমতার দলকে পরাস্ত করা সম্ভব। যদিও এই অনুশীলন চলছে সেই ২০১৯'এর নির্বাচন থেকেই এবং তার সুফল সিপিএম পেয়েছে অনেকখানি চাপ মুক্ত হয়ে বিজেপির চমকপ্রদ ১৮টি লোকসভার আসন জয়ের কারণে। কিন্তু সেই চমক আর বিজেপি ধরে রাখতে পারেনি পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে। ক্রমাগত তৃণমূল তার হারানো জমি পুনরুদ্ধার করেছে। সদ্য সমাপ্ত ধূপগুড়ির নির্বাচনেও তার প্রমাণ মিলেছে। এই সাফল্যের কারণ, একদিকে বিজেপির বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতি, সাংগঠনিক অনৈক্যের বিশ্রী চেহারা, অপরদিকে মমতার তরফে ভোটারদের মন জয় করতে নানাবিধ প্রকল্প রূপায়ণে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ।

এখন প্রশ্ন, এমতাবস্থায় সিপিএম ও কংগ্রেস কী করবে? সিপিএম কেন্দ্রীয় স্তরে জোট ইন্ডিয়াতে ভিড়লেও রাজ্য নেতৃত্বের তরফে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, তাদের পক্ষে তৃণমূলের সঙ্গী হওয়া অসম্ভব এবং তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও ভাবেই নয়। এই মনোভাবকে সিপিএম'এর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পলিটব্যুরো তাদের সদ্য সমাপ্ত বৈঠকে অনুমোদন দিয়েছে। সিপিএম স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে, তারা INDIA জোটে আছে, কিন্তু জোটের সমন্বয় কমিটিতে নেই। কারণ, তারা এই জোটের কোনও সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলাকে পছন্দ করছে না। অথচ, জোটের অন্যান্য কমিটিগুলিতে কিন্তু তারা বেশ সোৎসাহে রয়েছে; সে সব কমিটিতে তৃণমূলের প্রতিনিধি থাকা সত্ত্বেও। তাহলে রাগটা কি শুধুমাত্র অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জনিত? তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ? তাহলে কীভাবে লালুপ্রসাদ যাদব, শরদ পাওয়ার, এমনকি সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীদের পাশে বসা যাচ্ছে? তাঁদেরও তো ইডি,সিবিআই সময়ে-অসময়ে তলব করছে! আর লালুপ্রসাদ তো আদালতে দোষী হিসেবে সাব্যস্তও হয়েছেন! আসলে, এরা জোট ইন্ডিয়াকে নিয়ে এমন এক তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলছে যে, ভবিষ্যতে এ নিয়ে সাংগঠনিক সংকট দেখা দিলেও আশ্চর্য হব না। 

বোঝাই যাচ্ছে, ইন্ডিয়া নিয়ে কেরল ও বঙ্গ নেতৃত্বের ভাবনা যথেষ্ট প্যাঁচালো ও অস্পষ্ট, সর্বোপরি অবাস্তব এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন। সম্প্রতি, দলের রাজ্য সম্পাদক এক টিভি বাইটে জোটের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে বিজেপি নেতাদের মতোই ডট দিয়ে দিয়ে I.N.D.I.A.বলেছেন। আর ত্রিপুরার নেতৃত্বকে দেখে মনে হয়, বিজেপির ভয়ে সম্পূর্ণ  আত্মসমর্পণ করে বসে আছে, লড়াই করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ফলে, এদের মতামত ক্রমেই  গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে ত্রিপুরার দুটি আসনে লড়াইয়ের ফল সবাইকে চূড়ান্ত হতাশ করেছে। অবশ্য, বঙ্গ নেতৃত্বের এত লম্ফঝম্প সত্ত্বেও ধূপগুড়ি আসনে সিপিএম ও কংগ্রেস একসাথে লড়ে মাত্র সাড়ে ছয় শতাংশ ভোট পেয়ে জামানত খুইয়েছে। তবুও হম্বিতম্বির খামতি নেই।

কংগ্রেসের বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের পক্ষে এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন, অবিবেচক হওয়া সম্ভব নয়। আগামী ২০২৪'এর লড়াইয়ে কংগ্রেস দলের দায়িত্ব অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, মূল ও সিংহভাগ। রাজ্য কংগ্রেসের বর্তমান প্রধান অধীর চৌধুরী যদিও এখানে সিপিএমের মতোই মমতার সঙ্গী হতে নারাজ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতীয় নেতৃত্ব যে তাঁর মতকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেবে, তেমনটা নাও হতে পারে। কারণ, কংগ্রেস দলের কাছে এটা নিছকই এক নির্বাচন নয়, এর সঙ্গে দেশরক্ষার প্রশ্ন জড়িত। এই ভোটে সবাই মিলে মোদীকে পরাস্ত করতে না পারলে দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ইত্যাদি কিছুই অক্ষুন্ন থাকবে না। চরম ধর্মান্ধ অরাজক বাহিনীর হাতে নিগৃহীত হবে সংখ্যালঘু নারী ও খুন হবে পুরুষরা। দলিত নারী, পুরুষ এমনকি মহিলারাও চূড়ান্ত নিগ্রহের শিকার হবে। হিন্দিভাষীদের দাপটে ওষ্ঠাগত হবে অন্য ভাষাভাষীদের জীবন। গণতন্ত্র থাকবে স্রেফ কাগজে কলমে, রূঢ় বাস্তবে সবাই উপলব্ধি করবে রাজতন্ত্রের অনুশাসন।

এ হেন পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে কোনও ঝুঁকি নেওয়া কি সম্ভব কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষে? মনে হয় না। ফলে, শেষ পর্যন্ত হয়তো কংগ্রেস তৃণমূলের সঙ্গী হবে সমস্ত দিক বিবেচনা করে। কংগ্রেসের লক্ষ্য হবে, যতটা সম্ভব বেশি আসনে বোঝাপড়া করে জয়ী হওয়া এবং বিজেপিকে যতটা সম্ভব কম আসনে আটকে রাখা, সম্ভব হলে শূন্যে নামিয়ে আনা। সিপিএম, কংগ্রেস ও তৃণমূল একসঙ্গে লড়াই করলে তা নিশ্চিত ভাবেই সম্ভব। কিন্তু সিপিএম রাজী না হলে কয়েকটা আসন বিজেপি পেলেও পেতে পারে। আর যদি তৃণমূল ও কংগ্রেসের বোঝাপড়াও সম্ভব না হয় অর্থাৎ ত্রিমুখি লড়াই হয়, সে ক্ষেত্রে বিজেপি'র ১০-১২টা আসন পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে, কংগ্রেস ও তৃণমূলের বোঝাপড়া আশা করাই যায়।

সর্বশেষে বলা যায়, সিপিএমের পক্ষে যা সম্ভব, তা আদপেই সম্ভব নয় কংগ্রেসের পক্ষে। কারণ, কংগ্রেসের কোনও ভুলের জন্য যদি মোদী আবার ক্ষমতায় ফেরে তাহলে দেশের তো বটেই, কংগ্রেসেরও ক্ষতি হবে অপূরণীয়। দেশ রসাতলে গেলেও ইতিহাস থেমে থাকবে না, কিন্তু সামান্য ভুলের কারণেও কংগ্রেসের স্থান হতে পারে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আর সিপিএম জানে, ল্যাংটার নেই বাটপারির ভয়। তারা জানে, ২৪'এ মোদী জিতলেও লাভ, হারলেও লাভ। হারলে সবার সাথে কৃতিত্ব নেওয়া যাবে আর জিতলে ২০২৬'এ ভোটের আগেই মোদী মমতা সরকারকে ফেলে দেবে। ব্যাস, কাজ হাসিল। আর কী চাই? ফলে, যদি কোনও বোঝাপড়া না হয়, ত্রিমুখি লড়াই হয়, তখন ইন্ডিয়া বনাম বিজেপি লড়াইয়ে সিপিএম-কংগ্রেসের যেটুকু ভোট অবশিষ্ট আছে তাও যুযুধান দুই শিবিরের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে নিজেদের ভোট প্রাপ্তি ২ শতাংশেরও নিচে নেমে যেতে পারে। 

আশা করি, দু' দলের নেতৃবৃন্দ গোটা বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন এবং প্রার্থনা করি, সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।


Sunday 17 September 2023

গোদি মিডিয়ার সঞ্চালক বয়কট

এবার ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ হোক

প্রশান্ত ভট্টাচার্য



'INDIA finally identified & marked the star cast of the Godi media team. Good.' X হ্যান্ডেলে এই প্রতিক্রিয়া বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের। এই অ্যাক্টিভিস্ট আইনজীবীর এমন প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। প্রশান্ত ভূষণের মতো অনেকেই INDIA জোটের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেন অবশ্যই, কিন্তু বিপ্রতীপ প্রতিক্রিয়াও তো আছে। যেমন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অথচ তাদেরই কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা কংগ্রেস বহুদিন ধরে করে আসছে। জওহরলাল নেহেরু বাক-স্বাধীনতা রোধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বলায় সাংবাদিকদের গ্রেফতার করতে বলেছিলেন। আর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এই বিষয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। এমনকী, রাজীব গান্ধীও মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা করেছিলেন।'

সংবাদচর্চার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িয়ে থাকার কারণে নাড্ডার এই মন্তব্যের একটি পয়েন্টের সঙ্গেও আমি ডিফার করতে পারি না। কিন্তু মজা হচ্ছে, অর্ধ সত্য দিয়ে সত্যকে ঢেকে দেওয়ার এই নাড্ডা মডেলটিও অতি পুরনো। নরেন্দ্র মোদীর এই মোসাহেবটি কি বুক চিতিয়ে বলবেন, ৫৬ ইঞ্চির প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাড়ে ৯ বছরের রাজত্বকালে ক'টা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন? নিজের বশংবদ মিডিয়া ছাড়া কোথায় এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দিয়েছেন? নাড্ডা বা অমিত মালব্য কি বলবেন, সদ্য শেষ হওয়া জি২০ শীর্ষ সম্মলনে কেন সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল? জি২০ শীর্ষ সম্মেলন সেরে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে কেন বলতে হল, 'আমি সব সময় মানবাধিকার রক্ষা, নাগরিক সমাজের ভূমিকা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছি। ভারতেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছি। শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।' বাইডেনের ফোঁস করার কারণ, জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগের সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আবেদন জানানো সত্ত্বেও সেই বৈঠকের সাংবাদিক সম্মেলনের অনুমতি দেওয়া হয়নি দিল্লির তরফে, এমনটাই দাবি করা হয়েছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম সূত্রে। শুধু তাই নয়, ঝাঁ-চকচকে দিল্লি শহর ও ভারতমণ্ডপম বিদেশি অতিথিদের কাছে তুলে ধরার জন্য যে সংখ্যক বসতিকে উৎখাত করতে হয়েছে বা যে সংখ্যক স্ট্রিট ডগকে নির্মমভাবে বাক্সবন্দি করা হয়েছে, সে খবরও করতে দেওয়া হয়নি। গোদি মিডিয়া তা নিয়ে কোনও চ্যাটব্যাটও করেনি। 

করবে কেন? দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিধর পুরুষ যখন থেকে ভারতের মসনদে বসেছেন তখন থেকে নানা অছিলায় মোদী সরকার ও তার সমর্থকরা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রায় ‘গেরিলা' কায়দায় আক্রমণ শানিয়ে তাদের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নিয়েছে। তার নিট ফল, 'ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম' ইনডেক্স অনুযায়ী ভারতের ক্রম অবনমন। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে আরও ১১ ধাপ নেমে গেছে ভারত। এই নিয়ে একটানা দ্বিতীয় বছর প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে নিচে নামল ভারত। ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০ দেশের মধ্যে ভারতের স্থান দাঁড়িয়েছে ১৬১। গত বছর এই র‍্যাঙ্কিং-এ ভারতের স্থান ছিল ১৫০। ২০২১-এ ছিল ১৪২। তার মানে মাত্র তিন বছরে আমাদের পতন ১৯ ধাপ। 'অচ্ছে ভারত' একেই বলে। 

অবনমন আরও স্পষ্ট। মোদী এসেছেন ২০১৪ সালে। ভারতে সাংবাদিকতার নিম্নমুখিনতার পর্যায়টি  কীরকম? ২০১৬ সালে ১৩৩, ২০১৭-য় ১৩৬, ২০১৮ সালে ১৩৮ আর ২০১৯ সালে ১৪০। অথচ আমাদের 'চিরশত্রু রাষ্ট্র' পাকিস্তান সেই তুলনায় তালিকায় অনেক ওপরে রয়েছে। গত বছর যেখানে ১৫৭তম স্থানে ছিল তারা, এ বছর ১৫০তম স্থান দখল করেছে। এগিয়ে রয়েছে তালিবান শাসনের দেশ আফগানিস্তানও। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় ভারতের চেয়ে ঢের এগিয়ে রয়েছে আরেক প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা। ২০২২ সালে ১৪৬তম স্থান দখল করেছিল তারা। এ বছর আরও ওপরে উঠে ১৩৫তম স্থান দখল করেছে। ফেলে আসা সাড়ে ন' বছরে দেশের তাবড় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর বার বার আঘাত নেমে এসেছে, আক্রান্ত মৌলিক অধিকার, সর্বোপরি ভারতীয় বোধ। ভারতীয়ত্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারণাটাই আজ সংকটের মুখে। সাংবাদিকের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার এই ক্রমপতন তারই সঙ্গে যেন সাযুজ্য রেখে চলেছে। 

অনিবার্যভাবে দেখা গিয়েছে, এই আমলে গণপরিসরে ঘৃণাভাষণের প্রবণতা (বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি কটূক্তি) বেড়ে গিয়েছে। মণিপুরে গত চার মাসে যা হয়ে চলেছে, তাও ঘৃণারই আরেক রূপ। এ ক্ষেত্রেও গোদি মিডিয়া আশ্চর্য উদাসীন। পাশাপাশি, সমাজমাধ্যমে যে কোনও বিষয় নিয়ে হেনস্থা করতে উদ্যোগী ট্রোল বাহিনীর উত্থান ঘটেছে। পথেঘাটে গণপ্রহারে মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারতীয়দের কাছে এসব আর কোনও ‘খবর’ নয়। ভারতবাসীরা আর তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে আদৌ ভাবিত নন। কেউ যদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায় বাস্তবের প্রকৃত ছবিটি কেমন, ভারতীয়রা তা শুনতে আর আগ্রহী নন। কেননা, চিৎকারজীবী সংবাদ পরিবেশকরা জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমের ফেরিওয়ালা হয়ে এইসব অনাচারকে কার্পেটের তলায় ফেলে রাখছেন, ফলিত স্বৈরাচারের সুরে একরকমের আগ্রাসী আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। 

এই অবস্থায় গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ঘৃণা এবং জাল খবর ছড়ানোকে বর্জন করা ছাড়া কোনও গভীর নির্জন পথে মৈত্রীর খোঁজ করা সম্ভব নয়। এটা বুঝেছেন INDIA জোটের নেতারা। পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল আগেই। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল গত বৃহস্পতিবার INDIA জোটের মিডিয়া কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে। এক ধাক্কায় ১৪ জন সরকার-ঘনিষ্ঠ নিউজ অ্যাঙ্কর বা সঞ্চালক দ্বারা পরিচালিত শো বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিরোধী শিবির। বৃহস্পতিবার কংগ্রেস নেতা পবন খেরা টুইট করে এই তথাকথিত সরকার ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের সঞ্চালকদের নাম প্রকাশ্যে আনেন। বিরোধীরা বয়কটের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে জানিয়েছে, ওই টিভি চ্যানেল সঞ্চালকদের তারা ঘৃণা করে না, কিন্তু দেশকে তার চেয়েও বেশি ভালবাসে। পবন খেরার ভাষায়,  'প্রতি সন্ধ্যায় ওই সঞ্চালকরা ঘৃণার দোকান খুলে বসেন।' 

কার্যত, বিজেপির ঘৃণা ও জাল খবর ছড়ানোর অ্যাজেন্ডার অংশ হয়ে উঠেছে এই টিভি চ্যানেলগুলো ও তাদের তারকা সঞ্চালকরা। এই সঞ্চালকরা অধীত অভ্যাস বশে ঘৃণা এবং মিথ্যা ছড়াচ্ছেন। এর কারণ এটা নয় যে তাঁরা বিজেপি-বিরোধী দলগুলির বন্ধু নন, কারণটা হচ্ছে, তাঁরা সাংবাদিকতার মূল মন্ত্রগুপ্তিকে পাশে সরিয়ে বিজেপি-আরএসএস'এর প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করেছেন। এঁদের কাজ শুধু গণমাধ্যমকে বিপথে চালিত করছে না, তা একটি মুক্ত প্রজাতন্ত্রের মুক্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে, বিরোধী জোট খুব নির্দিষ্ট করেই এঁদের শো বয়কটের ডাক দিয়েছে, কেননা, সঙ্ঘ ব্রিগেড এবং গোদি মিডিয়া প্রতিটি ইস্যুকে ক্ষতিকর মোচড় দিয়ে সুস্থ ভাবনাচিন্তাকেই ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আসল ইস্যুকে অস্পষ্ট করা এবং বিষয়টিকে উল্টে দেওয়ার জন্য একটি বানানো বিতর্ক তৈরি করা ফ্যাসিবাদী প্রচারের একটি আদর্শ কৌশল। যেমন এখন তাঁরা ভারত এবং ইন্ডিয়া'র মধ্যে একটি মিথ্যা বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছেন।  

এই সঞ্চালকদের অনেকেই বিজেপির মিডিয়া ও আইটি সেলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রেখে চলেন। আর যাঁরা এখনও অতটা এগোতে পারেননি, তাঁরাও দলের প্যাসিভ ক্যাডারের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এমনটা নয় যে এঁরা জানেন না, চাপিয়ে দেওয়া সেন্সরশিপ এবং নিজস্ব সেন্সরশিপের মধ্যে পার্থক্য কী! সত্য এবং অপপ্রচারের মধ্যে পার্থক্য কী! সাংবাদিকতা এবং দেশপ্রেমের মধ্যে পার্থক্য কী! আসলে প্রেস ফ্রিডম ফাইটার বলে যাঁরা সকাল থেকে গলাবাজি করেন, এগিয়ে রাখেন, মিডিয়া ট্রায়াল করেন, তাঁরা জানেন না তলে তলে তাঁরা কতখানি নিঃস্ব, তাই শাসকের মুখাপেক্ষী। তাই আদালতে বিচারের আগেই সংবাদমাধ্যমে বিচার করার নামে পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ বা খবর দেখানোর নামে চালিয়ে যান মিডিয়া ট্রায়াল। সুপ্রিম কোর্টের মতে, মিডিয়া ট্রায়ালের নামে পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন বা সংবাদ পরিবেশনা সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। আদালতের রায় বেরনোর আগেই অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলা হয়, যা একাধারে অমানবিক অন্যদিকে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন; পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আদর্শ বিচারব্যবস্থার যা পরিপূর্ণ পরিপন্থী। 

এইরকম একটা সময়ে রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি জারি করে ১৪ গোদি সঞ্চালকের শো থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত INDIA জোটের একটি পরিণত পদক্ষেপ। হ্যাটস অফ টু INDIA।


Wednesday 13 September 2023

ক্রিপ্টো সম্পদ নিয়ে এত চিন্তা কেন?

জি-২০'র মাথাব্যথা!

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

দিল্লিতে জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির সম্মেলনে উত্থাপিত নানা বিষয় নিয়ে মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলে বহুবিধ পর্যালোচনা হয়েছে। কিন্তু সকলের নজর এড়িয়ে গিয়েছে এমন একটি আলোচ্য বিষয় যা এই মুহূর্তে ও আগামী দিনে বিশ্বের খোলনলচে বদলে দিতে চলেছে। দেখা গেল, জড়ো হওয়া দেশগুলির প্রতিনিধিদের মধ্যে, বিশেষত পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সামনের সারিতে দণ্ডায়মান দেশগুলির মধ্যে সেই বিষয়ে প্রকারান্তরে এক সহমতও গড়ে উঠেছে। বিষয়টি আর কিছুই নয়, যে ক্রিপ্টোমুদ্রা ও ক্রিপ্টোসম্পদের ভয় তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বড় বড় মহারথীদের, তাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যায়। যে কারণে জি-২০’র তরফে আইএমএফ ও এফএসবি (ফিনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বোর্ড)’কে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ক্রিপ্টো দুনিয়া সম্পর্কে যথাযথ অবস্থান স্থির করতে, যাতে তারা একটি উপযুক্ত বিশ্ব নীতি প্রণয়ন অভিমুখে এগোতে পারে। সেই মোতাবেক, গত ৭ সেপ্টেম্বর আইএমএফ-এফএসবি’র পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় এই শিরোনামে- IMF-FSB Synthesis Paper: Policies for Crypto-Assets

জি-২০ বৈঠকে এই প্রতিবেদনটিকে মান্যতা দেওয়া এবং সেই অনুসারে এগোনোর কথাও ঘোষিত হয়েছে। অতএব, এই ঔৎসুক্য খুব স্বাভাবিক- প্রতিবেদনটিতে কী পরামর্শ দেওয়া হয়েছে? ক্রিপ্টো দুনিয়া নিয়ে ধনী দেশগুলি এত সচকিত কেন? ক্রিপ্টোমুদ্রা কি আধুনিক অর্থনীতির খোলনলচে আমূল বদলে দিতে পারে?

বলাই বাহুল্য, এখনও বিশ্ব আর্থিক দুনিয়ার মোট সম্পদের তুলনায় ক্রিপ্টো সম্পদের অনুপাত অনেক কম। এমনকি ক্রিপ্টো সম্পদের মূল্যে যে অতি-অস্থিরতার কথা বলা হয়, তা ক্রিপ্টো দুনিয়ার মধ্যেই মোটের উপর সীমাবদ্ধ। হয়তো, দু-একটি ব্যাঙ্ক এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কোনও কোনও শেয়ার বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। এও বাস্তব, খুব জটিল লেনদেনে ক্রিপ্টোমুদ্রা এখনও তেমন ব্যবহৃত হয় না। তাহলে, মূলধারার অর্থনীতির শক্তিশালী দেশগুলি ক্রিপ্টোমুদ্রাকে আটকাতে এত মরীয়া কেন? এর কিছু উত্তর হয়তো প্রতিবেদনটি থেকেই পাওয়া যাবে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হচ্ছে, যদিচ এখনও ক্রিপ্টো সম্পদ আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় কোনও গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, তথাপি, এটি যদি লেনদেন ও খুচরো বিনিয়োগে এক আকর্ষণীয় ক্ষেত্র হয়ে ওঠে, তাহলে তা কিন্তু সম্ভাব্য বিপদের সূত্র হিসেবে দেখা দেবে। উপরন্তু, আশঙ্কা এও যে, যদি ক্রিপ্টো সম্পদ ও সাবেক আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে যোগাযোগ আরও বেড়ে ওঠে, তাহলে ক্রিপ্টোসম্পদের বাজার থেকে উপছে পড়া উপাদানগুলি বৃহত্তর আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে বাড়বাড়ন্ত হয়ে বিপদের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িতে তুলবে। এই শঙ্কা থেকে উত্থিত দুটি মাত্রাকে বিশদে বোঝার আছে:

১) লেনদেনে ক্রিপ্টোমুদ্রার ব্যবহার যদি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে;

২) সাধারণ মানুষ যদি ক্রিপ্টো সম্পদে খুচরো লগ্নি করেন।

অর্থাৎ, রাষ্ট্রপ্রধান ও নীতিপ্রণেতারা ধরে নিচ্ছেন যে ক্রিপ্টো সম্পদের একটা সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা গড়ে উঠতে পারে (প্রতিবেদনের ভাষায়, ‘… in the event of widespread adoption of crypto-assets.’)। উপরে উল্লিখিত এই দুই প্রবণতাই কিন্তু রাষ্ট্র ও একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজির কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্র অবশ্য সোরগোল তুলবে যে, কোনও কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ক্রিপ্টো দুনিয়ায় ফাটকাবাজ ও লুম্পেন পুঁজির দাপটে সাধারণ মানুষেরা নাজেহাল ও বিপর্যস্ত হবেন। তা যে হচ্ছে না, তাও নয়।

কিন্তু তবুও কেন ক্রিপ্টো বাজারের জনপ্রিয়তা তৈরি হচ্ছে? আর তাকে রুখতে রাষ্ট্রপ্রধানেরা মরীয়াই বা কেন? আদর্শগত ভাবে প্রথমে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, ক্রিপ্টোমুদ্রার আবির্ভাব কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে সাব-প্রাইম সংকটের সময়কালে ধনী দেশগুলিতে যখন বড় বড় আর্থিক সংস্থা ও ব্যাঙ্কগুলি তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ছিল। কারও কারও মনে ভাবনা এল, কেন্দ্রীয় আর্থিক সংস্থার নানারকম বিধিনিষেধ ও নজরদারি থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সংস্থাগুলি এইভাবে ভেঙ্গে পড়ছে কেন? তাহলে কি গোড়াতেই গলদ? এমন ভাবে আর্থিক নীতিগুলিকে কি তৈরি করা হয় যা বিশেষ ধরনের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির মুনাফাকে বর্ধিত করে? নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের নামে আসলে এক বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকারে রাখা হয়? তাহলে তেমন কর্তৃত্ব বা খবরদারিকে মানতে হবে কেন? এই ভিত্তি থেকেই পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কের এমন এক ভাবনা সূত্রায়িত হল যেখানে কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ব্যতিরেকেই, উদ্ভাবিত বিশেষ মুদ্রার মাধ্যমে এক বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ, ক’এর সঙ্গে খ বিনিময় করছে বাজার চলতি কোনও মুদ্রা দিয়ে নয়, এমন এক মুদ্রা মারফত যার কোনও স্পর্শযোগ্য অস্তিত্ব নেই, এক সাংকেতিক ঘোষণা আছে মাত্র। বিটকয়েন নামে এর আত্মপ্রকাশ; সাতাশি নাকামোতো নামে এক জাপানি প্রযুক্তিবিদ এর উদ্গাতা বলে কথিত, কিন্তু তিনি কোনও বাস্তবিক ব্যক্তি না কারও ছদ্মনাম বা কোনও গোষ্ঠীর পরিচয়, সে নিয়ে ধন্দ এখনও কাটেনি। কম্পিউটার নেটওয়ার্কে ব্লকচেইন প্রযুক্তি মারফতই এর লেনদেন। ইতিমধ্যে বিটকয়েন ব্যতিরেকে আরও বহু ক্রিপ্টোমুদ্রা বাজারে এসে গেছে এবং ক্রিপ্টো জগতের উত্থান-পতনের রেখা বিশ্বের মানচিত্রে এক নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অতএব, জি-২০ বৈঠকে তা যে মাথাব্যথার কারণ হবে, সহজেই অনুমেয়।

অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে, সাপের ছুঁচো গেলার মতো। ক্রিপ্টো লেনদেনকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে না, কারণ, তাতে এক বড় পরিমাণ সম্পদ সাবেক অর্থনৈতিক পরিসর থেকে ছিটকে ক্রিপ্টো বাজারে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়বে, যেখানে নাগাল পাওয়া দুষ্কর; কারণ, নানা দেশে ক্রিপ্টো বাজার ও বিনিময় কেন্দ্রের অস্তিত্বের ফলে ক্রিপ্টো বাজারে পরদেশি লেনদেনে কোনও সমস্যা নেই। জি-২০ দেশগুলি তাই বুঝেছে, কোনও একটি দেশে ক্রিপ্টো বাজারকে বেআইনি করে সুবিধা মিলবে না, যতক্ষণ না একটি বিশ্বায়িত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভবপর হচ্ছে। মুশকিল হল, ক্রিপ্টো বাজারের বিনিয়োগকারীরা যখন সে বাজারে ধাক্কা খায় তখন তারা নগদ সংগ্রহের জন্য সাবেক বাজারের সম্পদের কেনাবেচা শুরু করে দেয় যা এক সামাজিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, দুটি বাজার পরস্পরের সঙ্গে এমন ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে যে, আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির এখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা’।

কিন্তু দিনের শেষে ক্রিপ্টো বাজার ও সম্পদকে রুখতে জি-২০ বৈঠক থেকে কি কঠিন দাওয়াই কিছু বেরল? একেবারেই না। আইএমএফ-এফএসবি’র নিদানে গোল গোল কিছু উপদেশে ক্রিপ্টো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ করার কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টাটি কীভাবে বাঁধা হবে, তার কোনও হদিশ নেই। শুধু,

উপদেশ ১: ক্রিপ্টো সম্পদকে নিষিদ্ধ করা যাবে না, তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে;

উপদেশ ২: আকর্ষিত হয়ে কোনওভাবেই যেন ক্রিপ্টোমুদ্রাকে সরকারি মুদ্রার স্বীকৃতি দেওয়া না হয়;

উপদেশ ৩: কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি যেন কখনই ক্রিপ্টো সম্পদকে নিজেদের গচ্ছিত সম্পদের অংশভাক না করে।

অর্থাৎ, ক্রিপ্টো বাজার থাকবে স্বমহিমায়, রাষ্ট্রপ্রধানেরা ঐক্যবদ্ধ উপায়ে নানা রকমফেরে তাকে সবক শেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু সে দৌড় কি আদৌ সফল হওয়ার? যদিও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ক্রিপ্টো করের ওপর একটি শক্তপোক্ত আইন লাগু করেছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও সে ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে। ভারত সরকার বাজেটে ক্রিপ্টো আয়ের ওপর ৩০ শতাংশের একটি করব্যবস্থার সূত্রপাত করেছে। কিন্তু যেহেতু সকলেই একমত যে, একটি দেশে আইন প্রণয়ন করে ক্রিপ্টো সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, কারণ, তার আন্তর্জাতিক চলাচলের নমনীয়তার দরুণ তাকে দেশকালের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। বরং ভাবতে হবে, কর্তৃত্বহীন ক্রিপ্টো সম্পদের লেনদেনের যে ব্যবস্থা ব্লকচেইন প্রযুক্তি মারফত আজ এক দুর্নিবার সর্বজনীন প্রকল্প হয়ে উঠেছে, তা কি পুঁজিবাদের সুবৃহৎ একচেটিয়া পুঁজি ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে? আমাদের আলোচনাগুলি যদি এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে ধাবিত হয় তাহলে হয়তো এক নতুন পট পরিবর্তনের চিত্র সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে।