বঙ্গে জোট INDIA'র জটিলতা
কল্যাণ সেনগুপ্ত
রাজ্য রাজনীতিতে মমতা বিরোধিতার সুযোগ নিয়ে শুভেন্দু অধিকারী কংগ্রেস ও সিপিএম নেতা কর্মীদের আহ্বান জানিয়েছে, 'নো ভোট টু মমতা' আওয়াজ তুলে সব ভোটকে তাদের দলে ভেড়াতে। একমাত্র এ পন্থাতেই নাকি মমতার দলকে পরাস্ত করা সম্ভব। যদিও এই অনুশীলন চলছে সেই ২০১৯'এর নির্বাচন থেকেই এবং তার সুফল সিপিএম পেয়েছে অনেকখানি চাপ মুক্ত হয়ে বিজেপির চমকপ্রদ ১৮টি লোকসভার আসন জয়ের কারণে। কিন্তু সেই চমক আর বিজেপি ধরে রাখতে পারেনি পরবর্তী নির্বাচনগুলোতে। ক্রমাগত তৃণমূল তার হারানো জমি পুনরুদ্ধার করেছে। সদ্য সমাপ্ত ধূপগুড়ির নির্বাচনেও তার প্রমাণ মিলেছে। এই সাফল্যের কারণ, একদিকে বিজেপির বিভাজন ও ঘৃণার রাজনীতি, সাংগঠনিক অনৈক্যের বিশ্রী চেহারা, অপরদিকে মমতার তরফে ভোটারদের মন জয় করতে নানাবিধ প্রকল্প রূপায়ণে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ।
এখন প্রশ্ন, এমতাবস্থায় সিপিএম ও কংগ্রেস কী করবে? সিপিএম কেন্দ্রীয় স্তরে জোট ইন্ডিয়াতে ভিড়লেও রাজ্য নেতৃত্বের তরফে স্পষ্ট জানানো হয়েছে, তাদের পক্ষে তৃণমূলের সঙ্গী হওয়া অসম্ভব এবং তা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও ভাবেই নয়। এই মনোভাবকে সিপিএম'এর সর্বোচ্চ নেতৃত্ব পলিটব্যুরো তাদের সদ্য সমাপ্ত বৈঠকে অনুমোদন দিয়েছে। সিপিএম স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছে, তারা INDIA জোটে আছে, কিন্তু জোটের সমন্বয় কমিটিতে নেই। কারণ, তারা এই জোটের কোনও সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলাকে পছন্দ করছে না। অথচ, জোটের অন্যান্য কমিটিগুলিতে কিন্তু তারা বেশ সোৎসাহে রয়েছে; সে সব কমিটিতে তৃণমূলের প্রতিনিধি থাকা সত্ত্বেও। তাহলে রাগটা কি শুধুমাত্র অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জনিত? তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ? তাহলে কীভাবে লালুপ্রসাদ যাদব, শরদ পাওয়ার, এমনকি সোনিয়া ও রাহুল গান্ধীদের পাশে বসা যাচ্ছে? তাঁদেরও তো ইডি,সিবিআই সময়ে-অসময়ে তলব করছে! আর লালুপ্রসাদ তো আদালতে দোষী হিসেবে সাব্যস্তও হয়েছেন! আসলে, এরা জোট ইন্ডিয়াকে নিয়ে এমন এক তাত্ত্বিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে চলছে যে, ভবিষ্যতে এ নিয়ে সাংগঠনিক সংকট দেখা দিলেও আশ্চর্য হব না।
বোঝাই যাচ্ছে, ইন্ডিয়া নিয়ে কেরল ও বঙ্গ নেতৃত্বের ভাবনা যথেষ্ট প্যাঁচালো ও অস্পষ্ট, সর্বোপরি অবাস্তব এবং কাণ্ডজ্ঞানহীন। সম্প্রতি, দলের রাজ্য সম্পাদক এক টিভি বাইটে জোটের নাম উচ্চারণ করতে গিয়ে বিজেপি নেতাদের মতোই ডট দিয়ে দিয়ে I.N.D.I.A.বলেছেন। আর ত্রিপুরার নেতৃত্বকে দেখে মনে হয়, বিজেপির ভয়ে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে বসে আছে, লড়াই করার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। ফলে, এদের মতামত ক্রমেই গুরুত্বহীন ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে। সাম্প্রতিক উপনির্বাচনে ত্রিপুরার দুটি আসনে লড়াইয়ের ফল সবাইকে চূড়ান্ত হতাশ করেছে। অবশ্য, বঙ্গ নেতৃত্বের এত লম্ফঝম্প সত্ত্বেও ধূপগুড়ি আসনে সিপিএম ও কংগ্রেস একসাথে লড়ে মাত্র সাড়ে ছয় শতাংশ ভোট পেয়ে জামানত খুইয়েছে। তবুও হম্বিতম্বির খামতি নেই।
কংগ্রেসের বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। তাদের পক্ষে এতখানি দায়িত্বজ্ঞানহীন, অবিবেচক হওয়া সম্ভব নয়। আগামী ২০২৪'এর লড়াইয়ে কংগ্রেস দলের দায়িত্ব অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বলা যায়, মূল ও সিংহভাগ। রাজ্য কংগ্রেসের বর্তমান প্রধান অধীর চৌধুরী যদিও এখানে সিপিএমের মতোই মমতার সঙ্গী হতে নারাজ, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাতীয় নেতৃত্ব যে তাঁর মতকেই চূড়ান্ত বলে মেনে নেবে, তেমনটা নাও হতে পারে। কারণ, কংগ্রেস দলের কাছে এটা নিছকই এক নির্বাচন নয়, এর সঙ্গে দেশরক্ষার প্রশ্ন জড়িত। এই ভোটে সবাই মিলে মোদীকে পরাস্ত করতে না পারলে দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো ইত্যাদি কিছুই অক্ষুন্ন থাকবে না। চরম ধর্মান্ধ অরাজক বাহিনীর হাতে নিগৃহীত হবে সংখ্যালঘু নারী ও খুন হবে পুরুষরা। দলিত নারী, পুরুষ এমনকি মহিলারাও চূড়ান্ত নিগ্রহের শিকার হবে। হিন্দিভাষীদের দাপটে ওষ্ঠাগত হবে অন্য ভাষাভাষীদের জীবন। গণতন্ত্র থাকবে স্রেফ কাগজে কলমে, রূঢ় বাস্তবে সবাই উপলব্ধি করবে রাজতন্ত্রের অনুশাসন।
এ হেন পরিস্থিতিকে মাথায় রেখে কোনও ঝুঁকি নেওয়া কি সম্ভব কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষে? মনে হয় না। ফলে, শেষ পর্যন্ত হয়তো কংগ্রেস তৃণমূলের সঙ্গী হবে সমস্ত দিক বিবেচনা করে। কংগ্রেসের লক্ষ্য হবে, যতটা সম্ভব বেশি আসনে বোঝাপড়া করে জয়ী হওয়া এবং বিজেপিকে যতটা সম্ভব কম আসনে আটকে রাখা, সম্ভব হলে শূন্যে নামিয়ে আনা। সিপিএম, কংগ্রেস ও তৃণমূল একসঙ্গে লড়াই করলে তা নিশ্চিত ভাবেই সম্ভব। কিন্তু সিপিএম রাজী না হলে কয়েকটা আসন বিজেপি পেলেও পেতে পারে। আর যদি তৃণমূল ও কংগ্রেসের বোঝাপড়াও সম্ভব না হয় অর্থাৎ ত্রিমুখি লড়াই হয়, সে ক্ষেত্রে বিজেপি'র ১০-১২টা আসন পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। ফলে, কংগ্রেস ও তৃণমূলের বোঝাপড়া আশা করাই যায়।
সর্বশেষে বলা যায়, সিপিএমের পক্ষে যা সম্ভব, তা আদপেই সম্ভব নয় কংগ্রেসের পক্ষে। কারণ, কংগ্রেসের কোনও ভুলের জন্য যদি মোদী আবার ক্ষমতায় ফেরে তাহলে দেশের তো বটেই, কংগ্রেসেরও ক্ষতি হবে অপূরণীয়। দেশ রসাতলে গেলেও ইতিহাস থেমে থাকবে না, কিন্তু সামান্য ভুলের কারণেও কংগ্রেসের স্থান হতে পারে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আর সিপিএম জানে, ল্যাংটার নেই বাটপারির ভয়। তারা জানে, ২৪'এ মোদী জিতলেও লাভ, হারলেও লাভ। হারলে সবার সাথে কৃতিত্ব নেওয়া যাবে আর জিতলে ২০২৬'এ ভোটের আগেই মোদী মমতা সরকারকে ফেলে দেবে। ব্যাস, কাজ হাসিল। আর কী চাই? ফলে, যদি কোনও বোঝাপড়া না হয়, ত্রিমুখি লড়াই হয়, তখন ইন্ডিয়া বনাম বিজেপি লড়াইয়ে সিপিএম-কংগ্রেসের যেটুকু ভোট অবশিষ্ট আছে তাও যুযুধান দুই শিবিরের মধ্যে ভাগ হয়ে গেলে নিজেদের ভোট প্রাপ্তি ২ শতাংশেরও নিচে নেমে যেতে পারে।
আশা করি, দু' দলের নেতৃবৃন্দ গোটা বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সঠিক সিদ্ধান্ত নেবেন এবং প্রার্থনা করি, সবার শুভবুদ্ধির উদয় হোক।
মোদী মমতাকে ২০২৬ এ ফেলে দেবে এটা সরলীকরণ। বাংলায় ইক্যুয়েশনটা কি দাঁড়াবে বলা মুশকিল আর সেই ইক্যুয়েশনের রেজাল্টটাও যথেস্ট আনপ্রেডিক্টেবল। দাবার বোর্ডে শুভেন্দু সুজন সেলিম মমতা অধীর অভিষেক বসে… এক অদৃশ্য হাত এদের মুভমেন্ট করাচ্ছে। আমরা শুধু তাকিয়ে আছি।
ReplyDeleteসরলীকরণ বলাটাই বড় সরলীকরণ। যেন বিজেপি এমন কিছু করেনা। "অদৃশ্য হাত" আছে কিন্তু বিজেপির দুষ্কর্মের সম্ভাবনা হয়ে গেল সরলীকরণ।। বিজেপিকে আড়ালের অপচেষ্টা।। এক দেশ এক নির্বাচন স্লোগান কি সরল না জটিল?
ReplyDelete