এবার ঘৃণা ছড়ানো বন্ধ হোক
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
'INDIA finally identified & marked the star cast of the Godi media team. Good.' X হ্যান্ডেলে এই প্রতিক্রিয়া বিশিষ্ট আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের। এই অ্যাক্টিভিস্ট আইনজীবীর এমন প্রতিক্রিয়া খুবই স্বাভাবিক। প্রশান্ত ভূষণের মতো অনেকেই INDIA জোটের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাবেন অবশ্যই, কিন্তু বিপ্রতীপ প্রতিক্রিয়াও তো আছে। যেমন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জগৎপ্রকাশ নাড্ডা বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ। অথচ তাদেরই কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা কংগ্রেস বহুদিন ধরে করে আসছে। জওহরলাল নেহেরু বাক-স্বাধীনতা রোধ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে বলায় সাংবাদিকদের গ্রেফতার করতে বলেছিলেন। আর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে এই বিষয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী। এমনকী, রাজীব গান্ধীও মিডিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ কায়েমের চেষ্টা করেছিলেন।'
সংবাদচর্চার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িয়ে থাকার কারণে নাড্ডার এই মন্তব্যের একটি পয়েন্টের সঙ্গেও আমি ডিফার করতে পারি না। কিন্তু মজা হচ্ছে, অর্ধ সত্য দিয়ে সত্যকে ঢেকে দেওয়ার এই নাড্ডা মডেলটিও অতি পুরনো। নরেন্দ্র মোদীর এই মোসাহেবটি কি বুক চিতিয়ে বলবেন, ৫৬ ইঞ্চির প্রধানমন্ত্রী তাঁর সাড়ে ৯ বছরের রাজত্বকালে ক'টা সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন? নিজের বশংবদ মিডিয়া ছাড়া কোথায় এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দিয়েছেন? নাড্ডা বা অমিত মালব্য কি বলবেন, সদ্য শেষ হওয়া জি২০ শীর্ষ সম্মলনে কেন সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল? জি২০ শীর্ষ সম্মেলন সেরে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে সাংবাদিক সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে কেন বলতে হল, 'আমি সব সময় মানবাধিকার রক্ষা, নাগরিক সমাজের ভূমিকা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে সওয়াল করেছি। ভারতেও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে এই বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করেছি। শক্তিশালী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ার ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।' বাইডেনের ফোঁস করার কারণ, জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের আগের সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বসেছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আবেদন জানানো সত্ত্বেও সেই বৈঠকের সাংবাদিক সম্মেলনের অনুমতি দেওয়া হয়নি দিল্লির তরফে, এমনটাই দাবি করা হয়েছিল মার্কিন সংবাদমাধ্যম সূত্রে। শুধু তাই নয়, ঝাঁ-চকচকে দিল্লি শহর ও ভারতমণ্ডপম বিদেশি অতিথিদের কাছে তুলে ধরার জন্য যে সংখ্যক বসতিকে উৎখাত করতে হয়েছে বা যে সংখ্যক স্ট্রিট ডগকে নির্মমভাবে বাক্সবন্দি করা হয়েছে, সে খবরও করতে দেওয়া হয়নি। গোদি মিডিয়া তা নিয়ে কোনও চ্যাটব্যাটও করেনি।
করবে কেন? দক্ষিণপন্থী রাজনীতির সবচেয়ে শক্তিধর পুরুষ যখন থেকে ভারতের মসনদে বসেছেন তখন থেকে নানা অছিলায় মোদী সরকার ও তার সমর্থকরা সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে প্রায় ‘গেরিলা' কায়দায় আক্রমণ শানিয়ে তাদের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে নিয়েছে। তার নিট ফল, 'ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম' ইনডেক্স অনুযায়ী ভারতের ক্রম অবনমন। ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে আরও ১১ ধাপ নেমে গেছে ভারত। এই নিয়ে একটানা দ্বিতীয় বছর প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে নিচে নামল ভারত। ২০২৩ সালের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ১৮০ দেশের মধ্যে ভারতের স্থান দাঁড়িয়েছে ১৬১। গত বছর এই র্যাঙ্কিং-এ ভারতের স্থান ছিল ১৫০। ২০২১-এ ছিল ১৪২। তার মানে মাত্র তিন বছরে আমাদের পতন ১৯ ধাপ। 'অচ্ছে ভারত' একেই বলে।
অবনমন আরও স্পষ্ট। মোদী এসেছেন ২০১৪ সালে। ভারতে সাংবাদিকতার নিম্নমুখিনতার পর্যায়টি কীরকম? ২০১৬ সালে ১৩৩, ২০১৭-য় ১৩৬, ২০১৮ সালে ১৩৮ আর ২০১৯ সালে ১৪০। অথচ আমাদের 'চিরশত্রু রাষ্ট্র' পাকিস্তান সেই তুলনায় তালিকায় অনেক ওপরে রয়েছে। গত বছর যেখানে ১৫৭তম স্থানে ছিল তারা, এ বছর ১৫০তম স্থান দখল করেছে। এগিয়ে রয়েছে তালিবান শাসনের দেশ আফগানিস্তানও। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় ভারতের চেয়ে ঢের এগিয়ে রয়েছে আরেক প্রতিবেশী দেশ শ্রীলঙ্কা। ২০২২ সালে ১৪৬তম স্থান দখল করেছিল তারা। এ বছর আরও ওপরে উঠে ১৩৫তম স্থান দখল করেছে। ফেলে আসা সাড়ে ন' বছরে দেশের তাবড় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের ওপর বার বার আঘাত নেমে এসেছে, আক্রান্ত মৌলিক অধিকার, সর্বোপরি ভারতীয় বোধ। ভারতীয়ত্বের বৈচিত্র্যপূর্ণ ধারণাটাই আজ সংকটের মুখে। সাংবাদিকের স্বাধীনতা, সাংবাদিকতার স্বাধীনতার এই ক্রমপতন তারই সঙ্গে যেন সাযুজ্য রেখে চলেছে।
অনিবার্যভাবে দেখা গিয়েছে, এই আমলে গণপরিসরে ঘৃণাভাষণের প্রবণতা (বিশেষত মুসলমান সম্প্রদায়ের প্রতি কটূক্তি) বেড়ে গিয়েছে। মণিপুরে গত চার মাসে যা হয়ে চলেছে, তাও ঘৃণারই আরেক রূপ। এ ক্ষেত্রেও গোদি মিডিয়া আশ্চর্য উদাসীন। পাশাপাশি, সমাজমাধ্যমে যে কোনও বিষয় নিয়ে হেনস্থা করতে উদ্যোগী ট্রোল বাহিনীর উত্থান ঘটেছে। পথেঘাটে গণপ্রহারে মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারতীয়দের কাছে এসব আর কোনও ‘খবর’ নয়। ভারতবাসীরা আর তাদের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি নিয়ে আদৌ ভাবিত নন। কেউ যদি চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চায় বাস্তবের প্রকৃত ছবিটি কেমন, ভারতীয়রা তা শুনতে আর আগ্রহী নন। কেননা, চিৎকারজীবী সংবাদ পরিবেশকরা জাতীয়তাবাদ আর দেশপ্রেমের ফেরিওয়ালা হয়ে এইসব অনাচারকে কার্পেটের তলায় ফেলে রাখছেন, ফলিত স্বৈরাচারের সুরে একরকমের আগ্রাসী আত্মপক্ষ সমর্থনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই অবস্থায় গোদি মিডিয়ার অ্যাঙ্করদের ঘৃণা এবং জাল খবর ছড়ানোকে বর্জন করা ছাড়া কোনও গভীর নির্জন পথে মৈত্রীর খোঁজ করা সম্ভব নয়। এটা বুঝেছেন INDIA জোটের নেতারা। পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল আগেই। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হল গত বৃহস্পতিবার INDIA জোটের মিডিয়া কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠকে। এক ধাক্কায় ১৪ জন সরকার-ঘনিষ্ঠ নিউজ অ্যাঙ্কর বা সঞ্চালক দ্বারা পরিচালিত শো বয়কটের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিরোধী শিবির। বৃহস্পতিবার কংগ্রেস নেতা পবন খেরা টুইট করে এই তথাকথিত সরকার ঘনিষ্ঠ সংবাদমাধ্যমের সঞ্চালকদের নাম প্রকাশ্যে আনেন। বিরোধীরা বয়কটের সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে জানিয়েছে, ওই টিভি চ্যানেল সঞ্চালকদের তারা ঘৃণা করে না, কিন্তু দেশকে তার চেয়েও বেশি ভালবাসে। পবন খেরার ভাষায়, 'প্রতি সন্ধ্যায় ওই সঞ্চালকরা ঘৃণার দোকান খুলে বসেন।'
কার্যত, বিজেপির ঘৃণা ও জাল খবর ছড়ানোর অ্যাজেন্ডার অংশ হয়ে উঠেছে এই টিভি চ্যানেলগুলো ও তাদের তারকা সঞ্চালকরা। এই সঞ্চালকরা অধীত অভ্যাস বশে ঘৃণা এবং মিথ্যা ছড়াচ্ছেন। এর কারণ এটা নয় যে তাঁরা বিজেপি-বিরোধী দলগুলির বন্ধু নন, কারণটা হচ্ছে, তাঁরা সাংবাদিকতার মূল মন্ত্রগুপ্তিকে পাশে সরিয়ে বিজেপি-আরএসএস'এর প্রতিনিধিত্ব করতে শুরু করেছেন। এঁদের কাজ শুধু গণমাধ্যমকে বিপথে চালিত করছে না, তা একটি মুক্ত প্রজাতন্ত্রের মুক্ত গণমাধ্যমের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ফলে, বিরোধী জোট খুব নির্দিষ্ট করেই এঁদের শো বয়কটের ডাক দিয়েছে, কেননা, সঙ্ঘ ব্রিগেড এবং গোদি মিডিয়া প্রতিটি ইস্যুকে ক্ষতিকর মোচড় দিয়ে সুস্থ ভাবনাচিন্তাকেই ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আসল ইস্যুকে অস্পষ্ট করা এবং বিষয়টিকে উল্টে দেওয়ার জন্য একটি বানানো বিতর্ক তৈরি করা ফ্যাসিবাদী প্রচারের একটি আদর্শ কৌশল। যেমন এখন তাঁরা ভারত এবং ইন্ডিয়া'র মধ্যে একটি মিথ্যা বিতর্ক তৈরি করার চেষ্টা করে চলেছেন।
এই সঞ্চালকদের অনেকেই বিজেপির মিডিয়া ও আইটি সেলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক রেখে চলেন। আর যাঁরা এখনও অতটা এগোতে পারেননি, তাঁরাও দলের প্যাসিভ ক্যাডারের ভূমিকা পালন করে চলেছেন। এমনটা নয় যে এঁরা জানেন না, চাপিয়ে দেওয়া সেন্সরশিপ এবং নিজস্ব সেন্সরশিপের মধ্যে পার্থক্য কী! সত্য এবং অপপ্রচারের মধ্যে পার্থক্য কী! সাংবাদিকতা এবং দেশপ্রেমের মধ্যে পার্থক্য কী! আসলে প্রেস ফ্রিডম ফাইটার বলে যাঁরা সকাল থেকে গলাবাজি করেন, এগিয়ে রাখেন, মিডিয়া ট্রায়াল করেন, তাঁরা জানেন না তলে তলে তাঁরা কতখানি নিঃস্ব, তাই শাসকের মুখাপেক্ষী। তাই আদালতে বিচারের আগেই সংবাদমাধ্যমে বিচার করার নামে পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ বা খবর দেখানোর নামে চালিয়ে যান মিডিয়া ট্রায়াল। সুপ্রিম কোর্টের মতে, মিডিয়া ট্রায়ালের নামে পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন বা সংবাদ পরিবেশনা সাধারণ মানুষের মনে বিভ্রান্তি তৈরি করে। আদালতের রায় বেরনোর আগেই অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করে ফেলা হয়, যা একাধারে অমানবিক অন্যদিকে নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন; পূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও আদর্শ বিচারব্যবস্থার যা পরিপূর্ণ পরিপন্থী।
এইরকম একটা সময়ে রীতিমতো বিজ্ঞপ্তি জারি করে ১৪ গোদি সঞ্চালকের শো থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্ত INDIA জোটের একটি পরিণত পদক্ষেপ। হ্যাটস অফ টু INDIA।
Right decision taken in right time by INDIA. Thanks for the write up
ReplyDeleteজরুরী লেখ। মোদী সরকার কতজন সংবাদদাতাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে গত ৯ বছরে কয়েদ করেছে, সেই পরিসংখ্যান জুড়ে দিলে লেখাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পেতো বলে মনে হয়।
ReplyDelete