জি-২০'র মাথাব্যথা!
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
দিল্লিতে জি-২০ গোষ্ঠীভুক্ত দেশগুলির
সম্মেলনে উত্থাপিত নানা বিষয় নিয়ে মিডিয়া ও রাজনৈতিক মহলে বহুবিধ পর্যালোচনা হয়েছে।
কিন্তু সকলের নজর এড়িয়ে গিয়েছে এমন একটি আলোচ্য বিষয় যা এই মুহূর্তে ও আগামী দিনে
বিশ্বের খোলনলচে বদলে দিতে চলেছে। দেখা গেল, জড়ো হওয়া দেশগুলির প্রতিনিধিদের মধ্যে,
বিশেষত পুঁজিবাদী দুনিয়ায় সামনের সারিতে দণ্ডায়মান দেশগুলির মধ্যে সেই বিষয়ে প্রকারান্তরে
এক সহমতও গড়ে উঠেছে। বিষয়টি আর কিছুই নয়, যে ক্রিপ্টোমুদ্রা ও ক্রিপ্টোসম্পদের ভয়
তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে বড় বড় মহারথীদের, তাকে কীভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা যায়। যে
কারণে জি-২০’র তরফে আইএমএফ ও এফএসবি (ফিনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি বোর্ড)’কে দায়িত্ব
দেওয়া হয়েছিল ক্রিপ্টো দুনিয়া সম্পর্কে যথাযথ অবস্থান স্থির করতে, যাতে তারা একটি উপযুক্ত
বিশ্ব নীতি প্রণয়ন অভিমুখে এগোতে পারে। সেই মোতাবেক, গত ৭ সেপ্টেম্বর আইএমএফ-এফএসবি’র
পক্ষ থেকে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় এই শিরোনামে- IMF-FSB Synthesis Paper: Policies for
Crypto-Assets।
জি-২০ বৈঠকে
এই প্রতিবেদনটিকে মান্যতা দেওয়া এবং সেই অনুসারে এগোনোর কথাও ঘোষিত হয়েছে। অতএব,
এই ঔৎসুক্য খুব স্বাভাবিক- প্রতিবেদনটিতে কী পরামর্শ দেওয়া হয়েছে? ক্রিপ্টো দুনিয়া
নিয়ে ধনী দেশগুলি এত সচকিত কেন? ক্রিপ্টোমুদ্রা কি আধুনিক অর্থনীতির খোলনলচে আমূল
বদলে দিতে পারে?
বলাই
বাহুল্য, এখনও বিশ্ব আর্থিক দুনিয়ার মোট সম্পদের তুলনায় ক্রিপ্টো সম্পদের অনুপাত
অনেক কম। এমনকি ক্রিপ্টো সম্পদের মূল্যে যে অতি-অস্থিরতার কথা বলা হয়, তা ক্রিপ্টো
দুনিয়ার মধ্যেই মোটের উপর সীমাবদ্ধ। হয়তো, দু-একটি ব্যাঙ্ক এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত
হয়েছে, কোনও কোনও শেয়ার বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। এও বাস্তব, খুব জটিল লেনদেনে
ক্রিপ্টোমুদ্রা এখনও তেমন ব্যবহৃত হয় না। তাহলে, মূলধারার অর্থনীতির শক্তিশালী দেশগুলি
ক্রিপ্টোমুদ্রাকে আটকাতে এত মরীয়া কেন? এর কিছু উত্তর হয়তো প্রতিবেদনটি থেকেই
পাওয়া যাবে।
প্রতিবেদনটিতে
বলা হচ্ছে, যদিচ এখনও ক্রিপ্টো সম্পদ আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থায় কোনও
গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, তথাপি, এটি যদি লেনদেন ও খুচরো বিনিয়োগে এক আকর্ষণীয় ক্ষেত্র
হয়ে ওঠে, তাহলে তা কিন্তু সম্ভাব্য বিপদের সূত্র হিসেবে দেখা দেবে। উপরন্তু, আশঙ্কা
এও যে, যদি ক্রিপ্টো সম্পদ ও সাবেক আর্থিক ব্যবস্থার মধ্যে যোগাযোগ আরও বেড়ে ওঠে,
তাহলে ক্রিপ্টোসম্পদের বাজার থেকে উপছে পড়া উপাদানগুলি বৃহত্তর আর্থিক ব্যবস্থার
মধ্যে বাড়বাড়ন্ত হয়ে বিপদের সম্ভাবনাকে আরও বাড়িতে তুলবে। এই শঙ্কা থেকে উত্থিত দুটি
মাত্রাকে বিশদে বোঝার আছে:
১) লেনদেনে ক্রিপ্টোমুদ্রার ব্যবহার যদি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে;
২) সাধারণ মানুষ যদি ক্রিপ্টো সম্পদে খুচরো লগ্নি করেন।
অর্থাৎ,
রাষ্ট্রপ্রধান ও নীতিপ্রণেতারা ধরে নিচ্ছেন যে ক্রিপ্টো সম্পদের একটা সর্বজনীন
গ্রহণযোগ্যতা গড়ে উঠতে পারে (প্রতিবেদনের ভাষায়, ‘… in the event of widespread adoption of
crypto-assets.’)। উপরে
উল্লিখিত এই দুই প্রবণতাই কিন্তু রাষ্ট্র ও একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজির কেন্দ্রীয়
কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সাবেক রাষ্ট্র অবশ্য সোরগোল তুলবে যে, কোনও কেন্দ্রীয়
হস্তক্ষেপ বা নিয়ন্ত্রণ না থাকলে ক্রিপ্টো দুনিয়ায় ফাটকাবাজ ও লুম্পেন পুঁজির দাপটে
সাধারণ মানুষেরা নাজেহাল ও বিপর্যস্ত হবেন। তা যে হচ্ছে না, তাও নয়।
কিন্তু তবুও
কেন ক্রিপ্টো বাজারের জনপ্রিয়তা তৈরি হচ্ছে? আর তাকে রুখতে রাষ্ট্রপ্রধানেরা মরীয়াই
বা কেন? আদর্শগত ভাবে প্রথমে স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে, ক্রিপ্টোমুদ্রার আবির্ভাব
কিন্তু ২০০৮-০৯ সালে সাব-প্রাইম সংকটের সময়কালে ধনী দেশগুলিতে যখন বড় বড় আর্থিক সংস্থা
ও ব্যাঙ্কগুলি তাসের ঘরের মতো ভেঙ্গে পড়ছিল। কারও কারও মনে ভাবনা এল, কেন্দ্রীয় আর্থিক
সংস্থার নানারকম বিধিনিষেধ ও নজরদারি থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সংস্থাগুলি এইভাবে ভেঙ্গে
পড়ছে কেন? তাহলে কি গোড়াতেই গলদ? এমন ভাবে আর্থিক নীতিগুলিকে কি তৈরি করা হয় যা
বিশেষ ধরনের বাণিজ্যিক সংস্থাগুলির মুনাফাকে বর্ধিত করে? নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্বের
নামে আসলে এক বিশেষ ধরনের অর্থনৈতিক স্বার্থকে অগ্রাধিকারে রাখা হয়? তাহলে তেমন
কর্তৃত্ব বা খবরদারিকে মানতে হবে কেন? এই ভিত্তি থেকেই পিয়ার-টু-পিয়ার নেটওয়ার্কের
এমন এক ভাবনা সূত্রায়িত হল যেখানে কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ ব্যতিরেকেই, উদ্ভাবিত বিশেষ
মুদ্রার মাধ্যমে এক বিনিময় ব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে। অর্থাৎ, ক’এর সঙ্গে খ বিনিময়
করছে বাজার চলতি কোনও মুদ্রা দিয়ে নয়, এমন এক মুদ্রা মারফত যার কোনও স্পর্শযোগ্য
অস্তিত্ব নেই, এক সাংকেতিক ঘোষণা আছে মাত্র। বিটকয়েন নামে এর আত্মপ্রকাশ; সাতাশি নাকামোতো
নামে এক জাপানি প্রযুক্তিবিদ এর উদ্গাতা বলে কথিত, কিন্তু তিনি কোনও বাস্তবিক ব্যক্তি
না কারও ছদ্মনাম বা কোনও গোষ্ঠীর পরিচয়, সে নিয়ে ধন্দ এখনও কাটেনি। কম্পিউটার
নেটওয়ার্কে ব্লকচেইন প্রযুক্তি মারফতই এর লেনদেন। ইতিমধ্যে বিটকয়েন ব্যতিরেকে আরও
বহু ক্রিপ্টোমুদ্রা বাজারে এসে গেছে এবং ক্রিপ্টো জগতের উত্থান-পতনের রেখা বিশ্বের
মানচিত্রে এক নাটকীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। অতএব, জি-২০ বৈঠকে তা যে মাথাব্যথার
কারণ হবে, সহজেই অনুমেয়।
অবস্থাটা
দাঁড়িয়েছে, সাপের ছুঁচো গেলার মতো। ক্রিপ্টো লেনদেনকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা যাচ্ছে
না, কারণ, তাতে এক বড় পরিমাণ সম্পদ সাবেক অর্থনৈতিক পরিসর থেকে ছিটকে ক্রিপ্টো
বাজারে সংশ্লিষ্ট হয়ে পড়বে, যেখানে নাগাল পাওয়া দুষ্কর; কারণ, নানা দেশে ক্রিপ্টো
বাজার ও বিনিময় কেন্দ্রের অস্তিত্বের ফলে ক্রিপ্টো বাজারে পরদেশি লেনদেনে কোনও
সমস্যা নেই। জি-২০ দেশগুলি তাই বুঝেছে, কোনও একটি দেশে ক্রিপ্টো বাজারকে বেআইনি
করে সুবিধা মিলবে না, যতক্ষণ না একটি বিশ্বায়িত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভবপর
হচ্ছে। মুশকিল হল, ক্রিপ্টো বাজারের বিনিয়োগকারীরা যখন সে বাজারে ধাক্কা খায় তখন
তারা নগদ সংগ্রহের জন্য সাবেক বাজারের সম্পদের কেনাবেচা শুরু করে দেয় যা এক
সামাজিক অর্থনৈতিক অস্থিরতার সৃষ্টি করে। অর্থাৎ, দুটি বাজার পরস্পরের সঙ্গে এমন
ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে যে, আর্থিক নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলির এখন ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে
বাঁচি অবস্থা’।
কিন্তু
দিনের শেষে ক্রিপ্টো বাজার ও সম্পদকে রুখতে জি-২০ বৈঠক থেকে কি কঠিন দাওয়াই কিছু
বেরল? একেবারেই না। আইএমএফ-এফএসবি’র নিদানে গোল গোল কিছু উপদেশে ক্রিপ্টো বাজারকে নিয়ন্ত্রণ
করার কথা বার বার উচ্চারিত হয়েছে, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টাটি কীভাবে বাঁধা হবে,
তার কোনও হদিশ নেই। শুধু,
উপদেশ ১: ক্রিপ্টো সম্পদকে
নিষিদ্ধ করা যাবে না, তাকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে;
উপদেশ ২: আকর্ষিত হয়ে কোনওভাবেই যেন ক্রিপ্টোমুদ্রাকে সরকারি
মুদ্রার স্বীকৃতি দেওয়া না হয়;
উপদেশ ৩: কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কগুলি যেন কখনই ক্রিপ্টো সম্পদকে
নিজেদের গচ্ছিত সম্পদের অংশভাক না করে।
অর্থাৎ, ক্রিপ্টো বাজার থাকবে স্বমহিমায়, রাষ্ট্রপ্রধানেরা ঐক্যবদ্ধ উপায়ে নানা রকমফেরে তাকে সবক শেখানোর চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিন্তু সে দৌড় কি আদৌ সফল হওয়ার? যদিও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ক্রিপ্টো করের ওপর একটি শক্তপোক্ত আইন লাগু করেছে, কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও সে ব্যাপারে অনেক পিছিয়ে। ভারত সরকার বাজেটে ক্রিপ্টো আয়ের ওপর ৩০ শতাংশের একটি করব্যবস্থার সূত্রপাত করেছে। কিন্তু যেহেতু সকলেই একমত যে, একটি দেশে আইন প্রণয়ন করে ক্রিপ্টো সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, কারণ, তার আন্তর্জাতিক চলাচলের নমনীয়তার দরুণ তাকে দেশকালের গণ্ডিতে বেঁধে ফেলা সম্ভব নয়। বরং ভাবতে হবে, কর্তৃত্বহীন ক্রিপ্টো সম্পদের লেনদেনের যে ব্যবস্থা ব্লকচেইন প্রযুক্তি মারফত আজ এক দুর্নিবার সর্বজনীন প্রকল্প হয়ে উঠেছে, তা কি পুঁজিবাদের সুবৃহৎ একচেটিয়া পুঁজি ও রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে? আমাদের আলোচনাগুলি যদি এই প্রশ্নের উত্তরের সন্ধানে ধাবিত হয় তাহলে হয়তো এক নতুন পট পরিবর্তনের চিত্র সুস্পষ্ট হয়ে উঠতে পারে।
ভালো লেখা। অনেক কিছু জানলাম।
ReplyDelete