দূষণমুক্ত জীবন-জীবিকার খোঁজে
বিবর্তন ভট্টাচার্য
চাকদহে নাগরিক সমাজের সফল আন্দোলনের ফলে বুড়িগঙ্গা নদীর আংশিক সংস্কারের পর এবার মজে যাওয়া ও দূষিত চূর্ণী ও মাথাভাঙ্গা নদীর দিকে তাকানো যাক। আমরা বহুদিন ধরেই চূর্ণী নদীর দূষণের কথা শুনে আসছি। কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, পরিবেশ বিশেষজ্ঞ এমনকি সাংবাদিকরাও বড় সংবাদপত্রে সবসময়ই চূর্ণী নদীর দূষণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ থেকে ছাড়া কালো জলের কথা বলে থাকেন। আমরাও সে কথাই জেনে এসেছি এতদিন। কিন্তু ঘটনা হল, গোবিন্দপুর থেকে পাওয়াখালি পর্যন্ত মাথাভাঙা নদীর দীর্ঘ ১৯ কিলোমিটার গতিপথ সর্বপ্রথমে দূষিত হয়। অথচ, তা নিয়ে যে কেন আলোচনা হয়নি, এ কথা ভেবে বিস্মিত হই। মাথাভাঙা নদীর যে ভয়ঙ্কর দূষণ তা কিন্তু চূর্ণীতে এসে অনেকটাই কমে যায়। আসলে, শিবনিবাস পর্যন্ত চূর্ণী নদীতে গঙ্গার জোয়ার ভাটা খেলে। কিন্তু মাথাভাঙা নদীতে তা পৌঁছয় না।
তাই মাথাভাঙা নিয়ে অত মাথাব্যথা নেই। এছাড়া চূর্ণী নদী ৫৩ কিমি এবং তার আশপাশে জনবসতি ও জনঘনত্ব বেশি, তাই এই দূষণ বহু আলোচিত। এছাড়াও হাইকোর্টের আইনজীবী প্রয়াত মদন লাল পুণ্যস্নান করতেন চূর্ণীতে। চূর্ণীতে কালো জলের দূষণ দেখে তিনি হাইকোর্টে একটি মামলা করেন (W.P.No. 2795 (W) of 2011, Madan Lal Vs Union of India)।
এই মামলায় বিচারকদ্বয় জয়মাল্য বাগচী ও অরুণ মিশ্র তাঁদের রায়ে উল্লেখ করেন,
'It is submitted that Kero and Company at Darshana in Bangladesh which manufactures sugar, wine, chemicals etc. and stores its effluents in lagoons/ reservoirs which when released into the Mathabhanga river automatically finds its way into the Churni resulting in huge quantity of loss of fish, unbearable stench in the area affecting hygiene and health of the people residing near the bank of the said river and making it unworthy of bathing and unfit for irrigation.'
তারপর থেকেই চূর্ণী দূষণ মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে।
মাথাভাঙা নিয়ে একটা কথা চালু আছে যে, পাওয়াখালির কাছে মাথাভাঙা যেহেতু দু' ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি ইছামতি অপরটি চূর্ণী- তাই মাথা ভেঙে চূর্ণী ও ইছামতির উৎপত্তি থেকে মাথাভাঙা নাম। কিন্তু এই কথাটি ঠিক নয়। মাথাভাঙা সীমান্ত নদী। মাথাভাঙা নদীর উৎপত্তি মুর্শিদাবাদের জলঙ্গির উৎস থেকে আনুমানিক ১৬ কিমি পূর্ব-দক্ষিণে পদ্মা বা গঙ্গা থেকে। উৎসারিত হয়ে মাত্র ১০ কিমি পথ পশ্চিমবঙ্গের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে তা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বাংলাদেশের চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার হাটবোয়ালিয়ার কাছে মাথাভাঙা দু' ভাগে বিভক্ত হয়েছে- পূর্ব শাখা কুমার নামে এবং অন্য শাখাটি এঁকেবেঁকে বাংলাদেশের কাপাসডাঙায় গিয়ে ভৈরবকে কেটে দিয়ে দক্ষিণে নেমেছে। তারপর চুয়াডাঙ্গা ছেড়ে মেমনগর ব্রিজ পেরিয়ে শ্যামপুর ও জয়নগর হয়ে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার গেদের কাছে গোবিন্দপুরের BSF ক্যাম্পের পাশ দিয়ে পুনে চাঁদপুর হয়ে ১৯ কিমি বয়ে গিয়ে মাজদিয়ার কাছে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে।
ইছামতি ও চূর্ণীতে আসলে দূষণ শুরু হয়েছে বাংলাদেশের শ্যামপুর বটতলা থেকে কেরু অ্যান্ড কোম্পানির দূষিত জল থেকে যার সাথে দর্শনা পৌরসভার জলও রয়েছে। বাংলাদেশের দুটি গ্রাম শ্যামপুর আর জয়নগর প্রায় ১০ কিমি দূষিত। এলাকার মানুষের ধারণা, বৃটিশ আমলে এই কেরু অ্যান্ড কোম্পানি তৈরি হয়েছিল আর সারা পৃথিবীতে কেরুর মদের বিশাল চাহিদা ছিল; তাছাড়া এই দূষিত জল ছাড়লে তো নিচের দিকে যাচ্ছে, তাই ভারত কিছুটা অসুবিধায় পড়ছে! তবুও কিছুটা মানিয়ে নিয়ে চলছে এই গ্রামগুলোতে বসবাসকারী ৫/৬ হাজার মানুষ। কৃষক ও মৎস্যজীবী পরিবারের অসুবিধা বেশি হলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না।
বাংলাদেশের দিকে মাথাভাঙা'র শাখা নদী কুমার, চিত্রা, নরগঙ্গা, কপোতাক্ষ, ভৈরব প্রভৃতি। তা কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর উপজেলার ইনসাফনগরের কাছে বাংলাদেশে প্রবেশ করে সেখান থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়ে চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা উপজেলা থেকে আবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে। বাংলাদেশের মধ্যে নদীটির প্রবাহপথে কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর, মিরপুর, চুয়াডাঙ্গা জেলার দামুড়হুদা, আলমডাঙ্গা, মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলা রয়েছে। নদীটির দৈর্ঘ্য ১৩০ কিমি, প্রস্থ ১৫০ মিটার। দর্শনার কাছে নদীর গভীরতা ১০ মিটার। নদী অববাহিকার আয়তন ৫০০ বর্গ কিমি। এই নদীতে জোয়ার ভাটার প্রভাব নেই। সাধারণত নদীর তীর উপচে পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে বন্যা হয় না।
আসলে, যেখানে মাথাভাঙার উৎপত্তি হয়েছে সেই স্থানটিতে নদী অত্যন্ত ভাঙনপ্রবণ। অর্থাৎ, নদীর মাথা ভাঙনপ্রবণ বলে নাম হয়েছে মাথাভাঙা।
ভারতের নদী বিজ্ঞানী কপিল ভট্টাচার্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণে বাধা দিলেও এই বাঁধের অবস্থানগত বিষয় নিয়ে উইলিয়াম উইলকস একটি সুন্দর পরিকল্পনা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মাথাভাঙার উৎসস্থল নদীয়ার কাছে যদি এই বাঁধ নির্মিত হয় তাহলে বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশেরই মঙ্গল হতে পারে। কিন্তু তা হয়নি। পদ্মা থেকে জল আসা অনেকটাই প্রকৃতিগত কারণে বন্ধ হয়েছে। এছাড়া বৃষ্টির পরিমাণ কম হওয়াতে দুই বাংলাতেই বৃষ্টির পরিমাণ কম। তাছাড়া নদী কচুরিপানাতে ভর্তি। তার ওপর কেরু অ্যান্ড কোম্পানির চিনির কল আর মদ কারখানার দূষিত জল সরাসরি ফেলা হয় মাথাভাঙা নদীতে।
মাথাভাঙা নদীর ১৯ কিমি আর চূর্ণীর ৫৩ কিমি মোট ৭২ কিমি নদীপাড়ের মানুষজন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। জীবন-জীবিকা হারিয়ে রিক্সা টোটো অটো চালাচ্ছেন। কেউ কেউ ভিন রাজ্যে রাজমিস্ত্রির কাজ নিতে বাধ্য হয়েছেন। বহু নদী বিশেষজ্ঞ অনেক কথা বলেছেন, কেউ কেউ বহু কবিতা লিখেছেন, অনেকে গান গেয়েছেন, কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এই কালো জলের সমস্যা দূর হয়নি। কেউ কেউ বলেছেন, এই আন্তঃসীমান্ত নদীর সমস্যা দূর করতে হলে আন্তর্জাতিকভাবে সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে। আবার অনেকে ফারাক্কার মতো আলাদা ক্যানেল কাটবার কথা বলেছেন।
আজ আমি একটা সমাধানের পরিকল্পনা দিচ্ছি দেখুন সম্ভব কিনা।
মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে শেখ হাসিনার মধুর সম্পর্ক। তিনি যদি শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেন যে, তিনটি ড্রেনের জল শোধন করে ফেলার মেশিন শ্যামপুর বটতলা থেকে পরপর বসিয়ে পরিশোধিত পরিষ্কার জল মাথাভাঙা নদীতে ফেলতে হবে, তবে বাংলাদেশের গ্রাম সহ ১৫০টি গ্রামের মানুষ উপকৃত হতে পারেন। বৃটিশ আমলের এই কারখানা, তাই আধুনিকীকরণের জায়গা থেকেও তা করা সম্ভব। অবশ্য দুই দেশের ও রাজ্যের প্রধানদের সদিচ্ছার ওপর সবটা নির্ভর করছে। বিষয়টি খুব যে কঠিন তা কিন্তু নয়। কারখানা থেকে ঢাকা ড্রেনে জল নামছে মাথাভাঙা নদীতে। তাই, এই জলশোধনের মেশিনটি শ্যামপুর বটতলা এলাকায় বসালেই সব সমস্যার সমাধান হয় এবং দুই দেশের মানুষ সুস্থভাবে বাঁচতে পারেন। এই সহজ প্রক্রিয়া যদি রাজ্যের প্রধান ও রাষ্ট্রের প্রধানগণ গ্রহণ করেন তাহলে পশ্চিমবঙ্গের নদীপাড়ের প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের জন্য মাত্র ৬০ লক্ষ টাকা খরচ করলে এই মানুষজন রক্ষা পাবেন সারা জীবনের জন্য।
No comments:
Post a Comment