মণিপুর থেকে গুরুগ্রাম
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
জয়পুর-মুম্বাই এক্সপ্রেসে আরপিএফ
কনস্টেবল চেতন সিং প্রথমে তার উর্ধ্বতন সহকর্মীকে হত্যা করে তারপর ঠাণ্ডা মাথায়
চার-পাঁচটি কোচের মধ্য দিয়ে বন্দুক হাতে হাঁটতে হাঁটতে আরও তিনজন যাত্রীকে বেছে
বেছে গুলি করে খুন করল। চেতনকে গ্রেফতার করার পর বাহিনী সাফাই দিল, সে মানসিক ভাবে
অসুস্থ। অথচ, সেই অসুস্থ সেনার হাতে বাহিনী অস্ত্র তুলে দিয়ে তাকে ডিউটিতে পাঠাতে
কসুর করেনি। উপরন্তু, বেছে বেছে শুধুমাত্র মুসলমানদের চিহ্নিত করে তাদের হত্যা
করতেও ‘মানসিক ভাবে অসুস্থ’ চেতনের কোনও সমস্যা হয়নি। এমনকি খুন করে মোদি ও যোগীর
নামে জয়ধ্বনি দিতেও সে কিছুমাত্র দ্বিধা করেনি। পরন্তু, সেই উল্লাসকে ভিডিও বন্দী
করতে উপস্থিত সহযাত্রীদের নির্দেশ দিতেও তার কোথাও ছন্দপতন হয়নি। যেহেতু, বিনা
প্ররোচনায় ঠাণ্ডা মাথায় যে কোনও নিরীহ মানুষকে হত্যা করতে পারার মানসিকতাটাই অসুস্থতা,
সে কারণেই সম্ভবত চেতনকে তুরন্ত ‘অসুস্থ’ বলে দেগে দিয়ে তাঁকে বাঁচানোর ছকটিও অতীব
পরিষ্কার।
অনতিপরেই হরিয়ানার বজরঙ্গী নেতা ও পুলিশের
খাতায় নথিবদ্ধ খুনে মনু মানেসর’এর নেতৃত্বে কয়েকশো লোক গত ৩১ জুলাই লাঠি, বন্দুক ও
তলোয়ার হাতে ‘ব্রিজমণ্ডল জলাভিষেক যাত্রা’ নাম দিয়ে উত্তেজক শ্লোগান দিতে দিতে ঢুকে
পড়ে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত নুহ অঞ্চলে। তার আগে এই যাত্রা নিয়ে নানান প্ররোচনামূলক
ভিডিও মনু সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে এক বিষাক্ত আবহ তৈরি করে ফেলেছে। নুহ ঢুকতেই
শুরু হয়ে যায় ভাঙচুর, লুঠতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও খুন-খারাপি। সে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে
গুরুগ্রাম থেকে পালওয়াল ও ফরিদাবাদেও। এখন পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী, দুজন
হোমগার্ড সহ মোট ছ’জন ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। এক বিশাল অঞ্চল জুড়ে এলাকা বিশেষে
জারি হয়েছে কার্ফু ও ১৪৪ ধারা।
কে এই মনু মানেসর? হরিয়ানার
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অনিল ভিজ প্রকাশ্যে যাকে বলেন, wanted criminal, রাজস্থানে যার নামে দুটি খুনের মামলা রয়েছে, বজরং দল
ও গোরক্ষক সমিতির ঘোষিত নেতা, যার আহ্বানেই মিছিল ও তারপর মারদাঙ্গা। হরিয়ানা
সরকার তাকে নাকি খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ, সে প্রকাশ্যে মানেসর অঞ্চলে ঘুরে বেড়ায়।
গরু চুরির অভিযোগে সে রাজস্থানে জুনাইদ ও নাসির নামে দুই ব্যক্তিকে খুন করে আপাতত ‘ফেরার’;
নুহ অঞ্চলে গোরক্ষক বাহিনীর তোলাবাজির পাণ্ডা।
হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী মনোহর লাল
খট্টর এক বাক্যে ঘোষণা দিয়েছেন, সমস্ত ঘটনাগুলিই ‘পূর্ব-পরিকল্পিত’ এবং ‘এক বৃহৎ
ষড়যন্ত্রের অংশভাক’। এবার আপলোগ সব ‘ক্রোনোলজি সমঝিয়ে’। মণিপুরের চলমান রক্তস্নাত
জাতি দাঙ্গা থেকে চলন্ত ট্রেনে বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষকে বেছে বেছে হত্যা ও
তারপরেই নুহ’এ অস্ত্র হাতে মিছিল করে উন্মত্ততা- সবটাই কী ভীষণ ভাবে পরিকল্পিত।
অথচ, নুহ’এ যে হিংসাত্মক গণ্ডগোল হতে পারে, তার আগাম খবর কিন্তু পুলিশের গোয়েন্দা
বিভাগ অন্তত দিন সাতেক আগে প্রশাসনকে জানিয়েছিল। তা সত্ত্বেও ঘটনা ঘটেছে এবং খট্টর’এর
মতানুযায়ী পরিকল্পনা মাফিকই ঘটেছে। প্রশ্ন হল, এই পরিকল্পনাটা কার? বৃহৎ
ষড়যন্ত্রটাই বা কী? দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর প্রিয় শব্দ ‘ক্রোনোলজি’ বলছে, মণিপুর
থেকে গুরুগ্রাম যেন এক তারে বাঁধা; তারপর অন্যত্র- এ যেন এক ক্রোনোলজিকাল প্রবাহ!
এখন বইতে থাকবে দেশ জুড়ে। কারণ, ২০২৪’এর লোকসভা নির্বাচন। কেউ কেউ বলছেন পুলওয়ামা
২.০ ভার্সানের জন্য অপেক্ষার আর দেরি নেই। জম্মু ও কাশ্মীরের প্রাক্তন রাজ্যপাল
সত্যপাল মালিকও আমাদের আরও বড় পরিকল্পনামাফিক বিপর্যয়ের জন্য দিন গুনতে বলেছেন। কারণ,
তিনি পুলওয়ামার ঘটনাবলীর সময়ে রাজ্যপাল হিসেবে তার প্রত্যক্ষ সাক্ষী ছিলেন।
সাধে কি আর বিরোধী পক্ষের বেঙ্গালুরু
বৈঠকের দিনই তড়িঘড়ি দিল্লিতে ৩৮টা দলকে কুড়িয়ে বাড়িয়ে তুলে এনে এনডিএ’এর তামাশা
জমায়েত দেখাতে হয়? যখন, যে এনডিএ’র শেষ বৈঠক কস্মিনকালে কবে হয়েছিল তা কারও
স্মরণেই নেই! এই অস্বাভাবিক আচরণ কি কোনও আশঙ্কা ও ভয় থেকে? কীসের ভয়? ক্ষমতা
হারানোর ভয়? যিনি গর্ব ভরে সংসদে বুক চাপড়ে বলেছিলেন, ‘এক একেলা কিতনো পর ভারী পড়
রহা হ্যায়’, তিনি হঠাৎ বিরোধীদের ২৬’এর পালটা ৩৮’এর খেলায় কেন মাতলেন? পরিকল্পনার
সূত্রপাত কি এখান থেকেই? দিল্লির পৌর নির্বাচন এবং হিমাচল প্রদেশ ও কর্নাটকে
অভাবনীয় পরাজয়ের পর দাম্ভিক বিশ্বগুরুর কি এখন একা পড়ে যাওয়ার ভয় ধরেছে? পাঁচ
রাজ্যে আগত বিধানসভা নির্বাচন ও পরের বছর লোকসভা নির্বাচনে পরাজয়ের আশঙ্কা থেকেই
কি নানান ছক তৈরির প্রয়াস?
জাতিতে-জাতিতে অথবা ধর্মে-ধর্মে
বিভাজনের রাজনীতি হল সেই সহজ পন্থা যা উভয় পক্ষের ব্যাপক অংশের জনতাকে খুব সহজেই
ক্ষেপে উঠতে প্রলুব্ধ করতে পারে। আর সেই উন্মত্ততার বাহনে চড়ে যে ক্ষমতালাভ, তা যেহেতু
সহজলভ্য কিন্তু ভঙ্গুর, অতএব অসম্ভব নিষ্ঠুর ও প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাকে ফ্যাসিবাদই
বলি বা উন্মত্ত নিপীড়ন- তা সমাজের বুকে লালন করে সুতীব্র ঘৃণা ও হিংসার এক
ধারাবাহিক প্রদাহ। কারণ, এগুলিই তার টিকে থাকার ভিত্তিভূমি। এই রাজনৈতিক মানসিকতা
থেকেই জয়পুর-মুম্বাই এক্সপ্রেস হয়ে ওঠে মিনি ‘অউসভিৎস (Auschwitz) কনসেন্ট্রেশন
ক্যাম্প’, যেখানে চাইলেই কাউকে নিমেষে হত্যা করা যায়। হত্যাকাণ্ড যেন এক রোজকার
প্রাতঃকৃত্য মাত্র!
এই খুল্লাম খুল্লা রাজনীতি যে অবাধে
চলবে, আজও তার প্রমাণ পাওয়া গেল যখন পুলিশের থেকে কোনও অনুমতি ব্যতিরেকেই দিল্লির
বিভিন্ন অঞ্চল ও বদরপুর সীমান্তের জাতীয় সড়ক অবরোধ করে রাখল বজরং দল ও বিশ্ব
হিন্দু পরিষদের লেঠেল বাহিনীর ‘স্বেচ্ছাসেবকেরা’। এ আর কিছুই নয়, একদিকে সমাজের
বুকে হিমশীতল ভয়কে জারিত করা, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মনের গহনে প্রতিহিংসার
আগুনকে উস্কে দেওয়া। এইভাবেই এক ‘নব্য রাজনৈতিক হিন্দুয়ানা’র বয়ান তৈরি করা,
যেখানে অ-হিন্দুরা সেই রাজনীতির অধীন হবে এবং হিন্দুরাও মনে করবে, এইই হল যথার্থ
হিন্দুত্ব; যদি তা না হয়, অথবা, কেউ তাকে অস্বীকার করে, তবে তাদের জন্য থাকবে আধুনিকতম
চলমান ‘অউসভিৎস’- হাটে-বাজারে, রাস্তাঘাটে, মহল্লায় মহল্লায়, ঘরের ভিতরে অনায়াসে
ঢুকে পড়ে সবক শেখানোর হাড়-হিম করা সব কারুকৌশল!
আজ বিকেলে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে
মুখ্যমন্ত্রী খট্টর পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছেন, প্রত্যেক নাগরিককে সুরক্ষা দেওয়া
তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এত স্পষ্ট বাচন আগে কখনও কারও থেকে শোনা গেছে কী? আইটি সেল
প্রধান অমিত মালব্যও আসরে নেমে একটি টিভি চ্যানেলকে বলেছেন, যা ঘটেছে সবই নুহ’এর
কংগ্রেস এমএলএ’র কারসাজীতেই।
অতএব বলাই বাহুল্য, শীর্ষ আদালত যখন যথার্থ ভাবেই মণিপুরের সরকারকে তুলোধোনা করে বলে যে, আইন-শৃঙ্খলা বলে সে রাজ্যে আর কিছু নেই, সাংবিধানিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে, তখন জয়পুর-মুম্বাই এক্সপ্রেস ও হরিয়ানার ঘটনা এই পর্যবেক্ষণ থেকে কিছুমাত্র ব্যতিক্রম বলে আর মনে হয় না। ডাবল ইঞ্জিন যে কত ভয়ানক হতে পারে, এ সব তারই 'টুকরে টুকরে' নিদর্শন!
ভয়াবহ সব।
ReplyDeleteভালো লেখা ।
সত্যিই ভয়াবহ।
ReplyDelete