দুটি দৃশ্যপট বলছে, পালাও পালাও
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
‘শিক্ষা জগৎ’ নিয়ে কথা বলার আমার
কোনও ‘হক’ নেই। কারণ, আমার সঙ্গে সে জগতের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ কোনও যোগাযোগ
নেই; আমি নিতান্তই ছাপোষা এক কর্মজীবী নাগরিক, যার চারপাশ নিয়ে সামান্য কিছু কৌতূহল
আছে মাত্র, যেমন আর পাঁচজনের থাকে। আর সেই সুবাদে মাঝেসাঝে কিছু লিখে ফেলা, যেমন
মাঝি-মাল্লারা নৌকো বাইতে বাইতে গান করেন, অথবা শহুরে-গ্রামীণ শ্রমজীবী মানুষেরা নিজ
নিজ কাজের ফাঁকে কেউ কেউ এটা-সেটা বলেন বা লেখেন।
তবুও এক সহ-নাগরিক, যে তখনও প্রাপ্তবয়স্ক
হয়নি- যখন সে কারও পাকা ধানে মই দেয়নি, কারও সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়নি, কাউকে কটু
কথা পর্যন্ত বলেনি, এক নতুন শিক্ষা প্রাঙ্গণে সে এসে পৌঁছেছে মাত্র- তাকে ঠাণ্ডা
মাথায় সেখানেই হত্যা, সে তো শুধু শিক্ষা জগতের বিষয় আর থাকে না, তার বাপ-মা,
পাড়া-প্রতিবেশী, বন্ধু-বান্ধব, সহ-নাগরিক সহ সকলেরই এক মর্মন্তুদ আর্তনাদ হয়ে ওঠে।
এই মুহূর্তে আর্তনাদ ছাড়া আর অন্য কিছু
প্রকাশেরও নেই। শুধু, থেকে থেকে দুটি দৃশ্যকল্প মনের মধ্যে গুমরে উঠছে। তাড়া করছে।
বলছে, পালাও, পালাও। আমি পালাচ্ছি, কিন্তু সেই দৃশ্যপট আমার পিছু ছাড়ছে না। আমিও
কি স্বপ্নদীপের মতো আতঙ্কে কোনও উচ্চতল থেকে ভূপতিত হব? নাকি, আমাকে কেউ ধাক্কা
দিয়ে ফেলে দেবে খাদের গভীরের ওই পাথরের ওপর?
দৃশ্য: ১
অউসভিৎজ
নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প
মাথায় কদম ছাঁটের চুল, হাতের মুঠোয়
যা ধরা যায় না, দাঁড়ি-গোঁফ ছাঁটা, স্ট্রাইপড পাজামা পরে কোঠরাগত চোখ নিয়ে হাজারে
হাজারে বন্দী অউসভিৎজের বন্দী শিবিরের স্বল্প চত্বরে হেঁটে বেড়াচ্ছেন। সূর্যাস্তের
আগেই তাঁদের ফিরে যেতে হবে বন্দীশালায় প্রতিজনের জন্য বরাদ্দ চার বাই চার ফিটের পরিসরে।
পরে একে একে তাঁদের গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে দেওয়া হবে, অথবা, সামান্য এদিক-ওদিক মনে
হলেই বুকে গুলি বিদ্ধ হবে। তাঁরা কেউ ইহুদী, কেউ কমিউনিস্ট, কেউ গণতন্ত্রী, কেউ বা
যুদ্ধবন্দী। তাঁদের সারিবদ্ধ ‘সাবধান’ ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে গুনতি চলে, অথবা দেখে
নেওয়া হয়, কারও চোখে কোনও সংশয় বা প্রতিস্পর্ধার ঝিলিক মাত্র আছে কিনা!
হের হিটলার!!
স্বপ্নদীপের আমি সহ-নাগরিক। খুব ভয়ে
ভয়ে নিবেদন করি, এই যে বছরের পর বছর নবাগতদের এক অংশের (হোস্টেল নিবাসী) মধ্যে
দেখা যাচ্ছে, একই কায়দায় কদম ছাঁটে তাদের চুল-ছাঁটা, তা কি বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে কারও
নজরে পড়েনি? কেউ কি কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেসও করেননি যে, এইভাবে বহুজনের কেন চুল-ছাঁটা!
খুব দায়িত্বপূর্ণ কাজ অথবা বন্ধুদের জমায়েত ফেলেও কেন তাদের সূর্যাস্তের আগে
(সন্ধ্যা ৬টা) হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে? রাষ্ট্রের ভেতরে আরও এক রাষ্ট্র? কাদের
হুকুম? সে হুকুম না মানলে কী হয়?
দৃশ্য: ২
তোতা-কাহিনী
‘এক-যে
ছিল পাখি। সে ছিল মূর্খ। সে গান গাহিত, শাস্ত্র পড়িত না। লাফাইত, উড়িত, জানিত না
কায়দাকানুন কাকে বলে।
রাজা
বলিলেন, ‘এমন পাখি তো কাজে লাগে না, অথচ বনের ফল খাইয়া রাজহাটে ফলের বাজারে লোকসান
ঘটায়'।
মন্ত্রীকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘পাখিটাকে
শিক্ষা দাও'।
অতএব, শিক্ষার আয়োজন। ইউরোপ ও পরবর্তীকালে
ভারত সহ তাদের অন্যান্য উপনিবেশে অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতকে এক-একটি প্রশস্ত ঘরে সারি
সারি বেঞ্চ পেতে ব্ল্যাকবোর্ডে চক-ডাস্টার সহযোগে শিক্ষকের পড়ানোর যে পদ্ধতির
উদ্ভব হয়েছিল, তার সঙ্গে সাযুজ্য ছিল সে সময়ের ম্যানচেস্টার ও অন্যত্র গড়ে উঠতে থাকা
শিল্প সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীণ কাঠামোর। কাজের সময় কোনও কথা নয় (ক্লাস চলাকালীনও
তাই), নির্দেশিত কাজের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে পারদর্শিতা অর্জন (শিক্ষকের নির্দেশে
মুখস্থবিদ্যার মাধ্যমে পরীক্ষায় সাফল্য), কাজের ক্ষেত্রে কঠিন-কঠোর শৃঙ্খলা
(ক্লাসরুমেও ছাত্রদের বিধিবদ্ধ অবস্থান) ইত্যাদি ইত্যাদি কারখানার যে নিয়মমালা
চালু ছিল, তারই আদলে সর্বজনীন ‘শিক্ষা’র আয়োজন। যাতে, লিখতে-পড়তে পারে এমন শৃঙ্খলাবদ্ধ
শ্রমিক ও কাজের লোক পাওয়া যায়। অর্থাৎ, উদ্দেশ্যটাই ছিল, শিল্প ও তার আনুষঙ্গিক
কাজের জন্য উপযুক্ত শ্রমবাহিনীর জোগান দেওয়া।
পরে সে ‘শিক্ষাব্যবস্থা’র প্রভূত
বিবর্তন হয়েছে। আমরা দক্ষতার আরও উচ্চশিখরে পৌঁছেছি। কেরানি, ইঞ্জিনিয়ার, বিজ্ঞানী,
ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক, লেখক, প্রযুক্তিবিদ, আমলা, নলেজ-ওয়ার্কার, তথ্য প্রযুক্তির কর্মী এমনতর
বহুবিধ প্রয়োজনীয় বিদ্যা-অর্জিত, দক্ষ শ্রমবাহিনীর জোগান পেয়েছি ও পাচ্ছি। সাধারণ
ভাবে এ ছিল নেহাতই উপযুক্ত শ্রমের এক নির্মাণ-প্রক্রিয়া, যারা নিয়োজনের ভিত্তিতে নানাবিধ পারিশ্রমিকের
বিনিময়ে এক যাপনচিত্র গড়ে তুলেছিলেন। এর সঙ্গে পেশাগত দক্ষতার সম্পর্ক আছে। মানবিকতা
অথবা মানব গুণ অর্জনের কোনও সম্পর্ক আছে কী? নিছক কেরিয়ার গড়তে, ভালো চাকরি পেতে,
ভাল রোজগার ও আয়েসি জীবনযাপনের উদ্দেশ্যেই তো এইসব বিদ্যা অর্জন। যে
শিক্ষাব্যবস্থায় অর্থোপার্জনই জীবনের মোক্ষ, তাকে কি ‘শিক্ষা’ নামে অভিহিত করা
যায়? অবশ্য, এক অর্থে তা শিক্ষা, কারণ, শিখে তবে তো অর্থোপার্জন। কিন্তু ‘শিক্ষা’
বলতে যে মানবিকতা, মহত্ব ও গরিমা আরোপ করা হয়, তা কি এই শিক্ষাব্যবস্থা থেকে
অর্জিত হয়? যেন তেন প্রকারেণ অর্থ উপার্জনই যদি উদ্দেশ্য হয়, তাহলে মানবিক গুণের
সঙ্গে কি তার সখ্যভাব থাকে? একবার এক পণ্ডিতকে এও বলতে শুনেছি, স্বামী বিবেকানন্দ
তো প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনায় খুব গড় মাপের নম্বর পেয়েছিলেন। তাহলে তিনি কি
অর্ধশিক্ষিত ছিলেন?
শিক্ষা ও
বিদ্যা অর্জনের ফারাকটিকে না বুঝলে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় সাফল্যের ওপর একচেটিয়া
মহিমা আরোপ করে আসলে দক্ষতা অর্জনকেই শিক্ষার মাপকাঠি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। এখানেই
বিপদটা লুকিয়ে আছে। উচ্চ ডিগ্রি প্রাপ্ত কোনও জনকে আমরা নিষ্ঠুর কাজে লিপ্ত হতে
দেখলে ভাবি, উনি এত ‘শিক্ষিত’ হয়েও কেন এমন অমানবিক কাজ করলেন। আসলে তো তিনি দক্ষতা
অর্জনের দৌড়ে উচ্চস্তরের সাফল্য পেয়েছেন! সম্ভবত, তার সঙ্গে ‘শিক্ষার’ তেমন কোনও
সম্পর্ক নেই। আর সে কারণেই, যে চাষী বা মুটে মজুরের তেমন কোনও সার্টিফিকেট বা
ডিগ্রি নেই, তার মধ্যে আমরা শিক্ষার পরিব্যাপ্তিকে খুঁজে পাই না। তিনি মানুষ ভাল
হলেও, তাঁর ডিগ্রি না থাকায় তিনি হয়ে যান ‘অশিক্ষিত’ বা ‘মূর্খ’।
আজকের
সোশ্যাল মিডিয়া ‘শিক্ষা’ ও ‘বিদ্যা’র এই তফাত’টাকে আরও প্রকট করেছে। তা এই অর্থে,
কাউকে প্রকাশ্যে লিঞ্চিং করতে হলে, তার ‘লাইফ হেল’ করে দিতে হলে, দেখা যায়, নানা স্তরীয় বিদ্বান
মানুষেরাই সব থেকে কুৎসিত লাঞ্ছনাটি সোশ্যাল মিডিয়ায় করেন। মাইকেল জে স্যান্ডেল
তাঁর ‘The Tyranny of Merit’ গ্রন্থে বিদ্বান ও মেধাজীবীদের
নিপীড়নের এমত বিভিন্ন কাহিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন।
১৭ বছর বয়সী স্বপ্নদীপ ছিল মফস্বলের
এক সরল মনের ছেলে। একরাশ স্বপ্ন ও বিস্ময় ভরা চোখে সে প্রবেশ করেছিল এক এলিট
প্রতিষ্ঠানের গর্ভগৃহে। তাকে কারা মারল? কিছু ‘শিক্ষিত’ ছেলে? ‘শিক্ষা’ প্রতিষ্ঠান?
মেধার আত্মগর্বী নিষ্ঠুরতা?
‘রাজা পাখিটিকে টিপিলেন, সে হাঁ করিল না, হু করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে
পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল।
বাহিরে নববসন্তের দক্ষিণ হাওয়ায় কিশলয়গুলি দীর্ঘনিশ্বাসে মুকুলিত বনের আকাশ
আকুল করিয়া দিল।’
অনবদ্য বিশ্লেষন,একেবারে সঠিক কথাগুলি উচ্চারণ করেছেন
ReplyDeleteঅসম্ভব ভালো একটি লেখা । বেশি কিছু এখন আর লিখলাম বা বললাম না । কয়েকটা অংশের জন্যে চুমু । 👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼👌🏼💟😘
ReplyDeleteশিক্ষাঙ্গনের বাইরের পীড়নকারী সমাজ তার উপযোগী করে বানিয়ে তোলার আয়োজন উচ্চ বর্গীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। হয় এই স্যাডিস্টিক প্লেজার উপভোগ করবে, নয়তো নিজেই শিকার হ ও
ReplyDeleteখুব ভালো লেখা। লেখাটা পড়ে কেউ কি এই র্যাগিং মানসিকতার জীবন দর্শন পরিবর্তন করবে? মোমবাতি মিছিল কবে হচ্ছে? এই সপ্তাহটা মনে হয় কখন কোথায় মোমবাতি মিছিল তার খোঁজ রাখতে হবে।
ReplyDeleteএই ঘটনা অবিরাম অবিচ্ছিন্ন বহমান। আমরা ধরতে পারিনা।
ReplyDeleteএই লেখাটির মন্তব্যে অপূর্ব বলতে কোথাও আটকাচ্ছে, তার কারণ এমন একটা ঘটনা যেটা প্রতি মুহূর্তে দোষীদের শাস্তি চাইছে এবং একই সঙ্গে শঙ্কায় আছি কোনো উপরওয়ালার হাত এদের আড়াল করবে না তো, তেমনটা বরাবর হয়ে এসেছে। তবুও বলব, খুব ভালো লাগলো।
ReplyDeleteহিটলার-এর অনুষঙ্গটি সুপ্রযুক্ত। শুরু এবং শেষটিও চমৎকার! বেশ বেশ!
ReplyDeleteহৃদয় গলিয়ে ঢেলে দিয়েছেন অনিন্দ্য। ফলতঃ বিটুইন দ্যা লাইন সেই পরশ উপলব্ধি করলাম। অনেক শুভেচ্ছা।
ReplyDeleteহৃদয়স্পর্শী
ReplyDelete