যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর ওপর প্রবল আঘাত
সোমেন চক্রবর্তী
সংসদের দুই কক্ষে পাস হয়ে গেল দিল্লি সার্ভিসেস বিল ২০২৩। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় কেন্দ্র বনাম রাজ্যের ক্ষমতা নিয়ে আমাদের দেশে কম দড়ি টানাটানি হয়নি। তবে আধুনিক রাষ্ট্রের বিবর্তন একটি দেশের অঙ্গ রাজ্যগুলিকে অনেক বেশি স্বাধিকার ও আত্মনিয়ন্ত্রণ দেওয়ার কথাই বলে। অতএব, ইতিহাসের কিছু রেফারেন্স টেনে আমরা শুরু করতে পারি।
রাষ্ট্রই সবচেয়ে শক্তিশালী হবে নাকি তা হবে আরও অনেক শক্তিধর অন্যান্য প্রতিষ্ঠানেরই এক প্রতিনিধি মাত্র- এই নিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে বিতর্কের সূচনা। রাজনৈতিক চিন্তাবিদ হ্যারল্ড লাস্কি রাষ্ট্রকে কখনই একমেবোদ্বিতীয়ম প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতি দেননি। এর বিপরীতে সমসাময়িক সময়ে ইতালির তৎকালীন সর্বাধিনায়ক মুসোলিনি বলেছিলেন, রাষ্ট্রের আগে বা পরে কিছু হয় না; রাষ্ট্রই সর্বশক্তিমান।
এই বিতর্কের প্রায় এক দশক আগে রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লব সম্পূর্ণ হলে নব্য সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় সংবিধান রচিত হয়। এক অভাবনীয় নিয়মকানুনে ঠাঁসা সেই সংবিধান। যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোয় সব প্রদেশকে সেখানে দেওয়া হয়েছে স্বনিয়ন্ত্রণ বা স্বাধীনতার অধিকার; যেখানে রাষ্ট্রকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে যে কোনও প্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজেকে স্বাধীন ঘোষণা করতে পারে। এমনতর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কোনও প্রদেশ বেরিয়ে তো যায়ইনি বরং বেঁধে বেঁধে থেকে এক পরাক্রমশালী সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল কয়েক দশক ধরে। অতুলনীয় সেই যুক্তরাষ্ট্র কাঠামোয় চিড় ধরল যখন জোসেফ স্তালিন প্রাদেশিক শাসনের উপর কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকে শক্তিশালী করতে বেপরোয়া হয়ে উঠলেন। ছাইচাপা আগুনের বহিঃপ্রকাশে কয়েক দশক লাগল বটে, তবে তা যখন নিজেকে দোর্দণ্ডপ্রতাপে সামনে নিয়ে এল, তার প্রবল পরাক্রম কেন্দ্রানুগ রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে অচিরেই ভেঙেচুরে তছনছ করে দিল।
উল্টোদিকে, আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ শিখিয়ে ছিল যে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থার মাধ্যমে ক্ষমতার বন্টন করেই দেশ গড়ে তুলতে হবে। আমেরিকার তেরোটি প্রদেশ সেদিন যূথবদ্ধ হয়ে ‘United States of America’র জন্ম দিয়েছিল। প্রদেশগুলি সেখানে অত্যন্ত রকম স্বাধীন আবার পাশাপাশি ছিল শক্তিশালী মার্কিন রাষ্ট্র। অনেক বেশি প্রাদেশিক স্বশাসন এবং যথেষ্ট পরিমাণ শক্তিশালী কেন্দ্র গড়ে তুলে এক নতুন রাষ্ট্র ব্যবস্থার জন্ম হয় সদ্য স্বাধীন আমেরিকায়। গত আড়াইশো বছর ধরে সেই যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা কিন্তু নিজের জায়গায় আজও সমাসীন হয়ে রয়েছে।
দিল্লি রাজ্যের নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার যে কেন্দ্রীয় উদ্যোগ বেশ কয়েক বছর হল শুরু হয়েছে, তাতে ইতিহাসের এই উদাহরণগুলি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। দিল্লি চিরকাল কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল ছিল না। স্বাধীনতার পরেও বহু বছর তা ছিল একটি প্রদেশ। পরে তা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হয় এবং ১৯৯১ সালে সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে সেখানে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা করে তাকে পুনরায় প্রাদেশিক শাসনের আওতায় আনা হয়। কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকার দিল্লি প্রদেশকে কতটা ক্ষমতা দেবে তা ঠিক না করতে পেরে তাকে বস্তুত একটি বিকলাঙ্গ প্রদেশে পরিণত করে। আইনের দৃষ্টিতে দেখতে তাকে প্রদেশের মতো হলেও সে আসলে একটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল। যেন এক সোনার পাথরবাটি। আজকের কেন্দ্রীয় সরকার সেই অসম্পূর্ণ আইনি ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে ফলত দিল্লিকে ব্যবহারিক ভাবে এখন একটি নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা শাসিত কেয়ার-টেকার সরকারে পরিণত করেছে।
বলাই বাহুল্য, দিল্লি সার্ভিসেস বিল, ২০২৩ (রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর গেজেট নোটিফিকেশন দ্বারা আইনে পরিণতি পাবে) সমস্ত রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের প্রাদেশিক সরকারের নিয়ন্ত্রণের আওতার বাইরে রেখে দিয়েছে। কোন আমলা কোন পদে আসীন হবে বা সেখানে কতদিন থাকবে তা এখন ঠিক করবে কেন্দ্র সরকার। অন্যদিকে জনগণকে সেবা ও সুশাসন দেবার দায়িত্বে থাকবে একটি নির্বাচিত রাজ্য সরকার। আবার শাসনের ব্যাপারে যদিও মন্ত্রীসভা সিদ্ধান্ত নিতে দায়বদ্ধ কিন্তু সে সব খণ্ডন করে দেবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা উপ-রাজ্যপালের হাতেই থাকবে। একেই কি বলে কিম্ভূতকিমাকার?
১৬০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ইংরেজ চিন্তাবিদ থমাস হবস বলেছিলেন যে, সাধারণ মানুষকে ক্ষমতা দিলে তারা নৈরাজ্য সৃষ্টি করবে, তাই ক্ষমতা সর্বশক্তিমান রাজার কাছে গচ্ছিত রাখা প্রয়োজন। তার প্রায় দুশো বছর পরে আরেক ইংরেজ উদারনীতিবাদী জন স্টুয়ার্ট মিল উপনিবেশের 'অশিক্ষিত' মানুষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণের পরিপন্থী ছিলেন, কারণ তারা গণতন্ত্রকেই নাকি রক্ষা করতে পারবে না। সমাজ কিন্তু তারপর আরও প্রায় দেড়শো বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু শাসকের দুশ্চিন্তা এবং জনগণ সম্পর্কে তাদের উন্নাসিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এখনও বহু যোজন দূরে। দিল্লি সার্ভিসেস বিল ২০২৩ তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ। এ প্রসঙ্গে মনে রাখা দরকার যে, কেন্দ্রীয় সরকারের এ ব্যাপারে সমস্ত পদক্ষেপ কিন্তু এখনও পর্যন্ত আইনানুগ। তবে তা সংবিধানের বিপক্ষে যাচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব সর্বোচ্চ আদালতের। ২০০৭ সালের বিখ্যাত Koelho মামলায় নির্ধারিত হয়ে গেছে যে, সংসদ কৃত আইন সংবিধানের মূল ভিত্তিকে লঙ্ঘন করছে কিনা তা নির্ধারণ করবে দেশের উচ্চতম আদালত |
এই বিল মোতাবেক, বর্তমানে দিল্লির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত প্রাদেশিক আইনসভা কোনও আইন পাশ বা নীতি নির্ধারণ করলে অথবা কোনও উন্নয়নমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করলেও উপ-রাজ্যপাল তাতে সম্মতি দিলে তবেই তা প্রণয়ন যোগ্য হবে; এবং সরকারি আমলারা সে ব্যাপারে অনুগ্রহ করে সহায়তা করলে তবেই সেই সব আইন, নীতি বা কর্মসূচি বাস্তবে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে। আমলাদের উপর যেহেতু প্রাদেশিক সরকারের কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকছে না, তাই তাদের বাধ্য করারও কোনও রাস্তা বাস্তবত থাকছে না। তাদের কাজের বাৎসরিক মূল্যায়নের ব্যাপারে প্রাদেশিক সরকারের ক্ষমতা শুধু খাতাকলমে থাকবে মাত্র। সেই আমলারা কবে, কতদিন ছুটিতে থাকবে তাও বস্তুত ঠিক করবে কেন্দ্র সরকার।
(বর্তমান এই বিলটি ২০২৩'এর মে মাসে জারি করা একটি অধ্যাদেশের আইনি রূপান্তর মাত্র। যেহেতু তা নিয়ে সেই সময়ে 'একক মাত্রা'র পডকাস্টে বিস্তারিত বলেছিলাম, তাই ওই অধ্যাদেশ বা বর্তমান বিল নিয়ে নতুন করে আর বলছি না। উৎসাহী পাঠকেরা এই লিঙ্কে তা শুনে নিতে পারেন: https://www.ekakmatra.in/delhi-govt-ordinance/ )
বর্তমান আইনের আরেকটি বিপজ্জনক দিক হল যে, এই আইনের বিভিন্ন ধারা যদি পরবর্তীকালে পর্যাপ্ত মনে না হয় এবং কেন্দ্র সরকার যদি মনে করে আরও নতুন কিছু নির্দেশ বা নিয়মাবলী জারি করা দরকার, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবার সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে। বকলমে, যদি কেন্দ্র সরকারের মনে হয় যে এই আইনকে এড়িয়ে গিয়ে দিল্লির সরকার কোনও কর্মসূচি বা অন্য কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করছে তবে তা আটকাতে যে কোনও পদক্ষেপ তারা নিতে পারবে। বস্তুত, প্রাদেশিক সরকারের প্রায় কিছুই আর স্বাধীনভাবে করবার সুযোগ থাকছে না। অতএব, এই অভিনব যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় নির্বাচিত সরকারের সামনে দুটো রাস্তা খোলা আছে- হয় নর্বাচিত সরকারকে কেন্দ্রের পদলেহন করে টিকে থাকতে হবে, নয় পদত্যাগ করে জন আন্দোলনের পথ বেছে নিতে হবে।
উল্লেখ্য, এই আইনের সঙ্গে লাগোয়া 'উদ্দেশ্য ও কারণ' নামক শীর্ষকের তিন নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, দিল্লি সম্পর্কিত যে কোনও সিদ্ধান্ত শুধু দিল্লিবাসী নয় বরং তা গোটা দেশকে প্রভাবিত করে এবং তা দেশের সম্মান, ভাবমূর্তি, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং গর্বকে ক্ষুণ্ণ করতে পারে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও তার ক্ষতিকারক প্রতিফলন হতে পারে এবং সেই কারণেই নাকি কেন্দ্রের এই নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। এও বলা হয়েছে যে, দেশের রাজধানী হবার কারণে দিল্লির একটি বিশেষ অবস্থান ও বিশেষত্ব রয়েছে, সে কারণে দিল্লিতে সুশাসন সুনিশ্চিত করা জরুরি। আর সে জন্যই নাকি সংবিধান কেন্দ্র শাসিত অঞ্চলকে রাষ্ট্রপতির এক্তিয়ারে রাখবার ব্যবস্থা রেখেছে।
প্রশ্ন হল, যে প্রশাসনিক জটিলতা বা দ্বিমত আলোচনার মাধ্যমে মিটিয়ে ফেলা প্রয়োজন, তাকেই যখন আইনের প্যাঁচে বেঁধে রাখবার প্রয়াস চলে তখন তা আর শুধুমাত্র আইনি বিষয় থাকে না। তার পিছনে গভীর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অবশ্যই নিহিত আছে।
দিল্লি সার্ভিসেস বিলের বিরুদ্ধে লড়াই আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে বাঁচিয়ে রাখবার লড়াই। কারণ, এই বিলকে অনুসরণ করে ভবিষ্যতে বাকী রাজ্যগুলির ওপরেও নিয়ন্ত্রণের কড়া দাওয়াই নেমে আসতে পারে। ইতিমধ্যেই বিরোধী শাসিত রাজ্যগুলিতে রাজ্যপালের দৃশ্যমান অতি-সক্রিয়তা হয়তো এই পরিকল্পনারই অঙ্গ। তবে, কেন্দ্রীকরণ এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর লড়াইয়ে শেষমেশ যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থারই জয় হবে। রাষ্ট্র নির্মাণের ইতিহাস বারবার এই সত্যকে প্রমাণিত করেছে। এ লড়াইকে সফল করতে নাগরিক সমাজকে এগিয়ে এসে দায়িত্ব নিতেই হবে। এখনই তো ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক আন্দোলন এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পুনর্গঠনের সময়। রাস্তা নিশ্চয়ই খুবই কঠিন তবুও আশাতেই তো বেঁচে থাকে চাষা।
No comments:
Post a Comment