Tuesday 28 July 2015

লিটল ম্যাগাজিনের আজ কাল


লিটল ম্যাগাজিনের চলার পথ নিরন্তর
প্রেমাংশু দাশগুপ্ত

লিটল ম্যাগাজিন সমন্বয় মঞ্চের উদ্যোগে আয়োজিত ‘লিটল ম্যাগাজিনের আজ কাল’ আলোচনাসভার প্রাণের উত্তাপকে নিরন্তর প্রবল বর্ষাও চুপসে দিতে পারেনি। বেশ কিছু উৎসাহী মানুষের অংশগ্রহণে এবং তাঁদের মূল্যবান মতামতে সভাটা হয়ে উঠেছিল আকর্ষণীয়। কেউ বললেন, কর্পোরেট দুনিয়া যখন নিজেদের স্বার্থে অত্যুৎসাহে সাহিত্য সংস্কৃতির ঠিকেদারি নিয়ে ফেলেছে, লিটল ম্যাগাজিন তখন নিজস্ব লড়াইটা জারি রেখেছে কেবলমাত্র প্রাণশক্তিকে সম্বল করে। কর্পোরেট দ্বারা প্রকাশিত পত্র পত্রিকার পিছনে যেমন রয়েছে বিপুল অর্থ তেমনি আছে অগণ্য লেখক এবং পাঠক আর আছে নির্দিষ্ট একটা দর্শন মতবাদ। কর্পোরেটের দেখানো দুনিয়াটার বাইরে অন্য যে আরও একটা জগ আছে তারই কথা ক্রমাগত বলে চলেছে লিটল ম্যাগাজিনকিন্তু বৃত্ত তার পরিসীমিত। লিটল ম্যাগাজিনের কণ্ঠস্বরকে তাই আরও মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। এই প্রসঙ্গে আর একজন বললেন, কলকাতা শহরের বাইরে হয়তো তাঁদের পত্রিকার প্রচার আগের থেকে কিছু কমেছে কিন্তু এখনও তাঁদের ম্যাগাজিন বিক্রির প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি হয় সেখানেই। তাঁর মতে, সামাজিক আন্দোলনের ভিত্তিই যেহেতু লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণভোমরা তাই ম্যাগাজিনগুলিকে আন্দোলনও গড়ে তুলতে হবে সাংগঠনিক ভাবেতবেই সম্ভব তার প্রচারকে বাড়ানোএই কথাতেই উঠে এল এক প্রশ্ন- তাহলে কি সমাজে নতুন চিন্তার চর্চার জন্য সাংস্কৃতিক আন্দোলন নিজের নিয়মেই নিজেই গড়ে উঠতে পারে না? এই কথা বেয়েই সবাই প্রায় সহমত হলেন, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরস্পরের পরিপূরক মাত্র।
সভায় বর্তমান প্রজন্মের প্রতিনিধি কম থাকায় এই আশঙ্কাও কেউ প্রকাশ করলেন, যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে আগ্রহ সম্ভবত কম। কিন্তু বিপরীত মত প্রকাশ করে একজন বলেন, ব্যাপারটা এতটা হতাশাজনক নয়। তিনি কিন্তু বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন মেলায় অল্পবয়সীদের যথেষ্ট সংখ্যায় দেখেছেন। তাঁর মতে পাঠক আছেন, কিন্তু আমরা তাঁদের কাছে পৌঁছতে পারছি না। এর পরে তাই যথারীতি সামনে এসে গেল বিপণন নিয়ে ম্যাগাজিনগুলির সমস্যার কথা। প্রস্তাব এল, পরে শুধুমাত্র বিপণন নিয়ে আমরা একদিন আলোচনা করতে পারি। কেউ বললেন, পুঁজির বিরুদ্ধে কথা শুধু নয়, পাল্টা কাজও আমাদের মতো করে করতে হবে স্কুলে কলেজে প্রচারের মাধ্যমে। সেখানে আমরা লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে পৌঁছে যেতে পারি। কৃষক সমাজের কাছেও পারলে আমাদের যেতে হবে। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে এবং বাংলাদেশে লিটল ম্যাগাজিনের চাহিদা কিন্তু আছে বলে মনে করেন অনেকে। তাঁদের কাছে পত্রিকা নিয়ে যাবার দায়িত্ব আমাদেরই পালন করতে হবে।
রাজনৈতিক প্রসঙ্গ আসাটাও ছিল এই আলোচনায় অবশ্যম্ভাবী। ভোগবাদের বিপুল প্রচারের আয়োজন যে হয়ে চলেছে আমাদের চারপাশে তার মোকাবিলার জন্য আধুনিক প্রযুক্তিকেও সফল ভাবে ব্যবহার করতে হবে, যেমনটা হয়েছে আধুনিক বিশ্বে সমসাময়িক বিভিন্ন রাজনৈতিক আন্দোলনে। লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করাও একটা আন্দোলন, এটা সভার সবাই মনে করেন। তাই আন্দোলনের প্রচলিত হাতিয়ারগুলিকেও আমাদের প্রয়োগ করতে হবেকেউ কেউ বলেন, কর্পোরেট দুনিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বা মাদারা টেরেসার সংস্থাকে অর্থ দান করে, যারা কিছু সামাজিক কাজকর্ম করে থাকে। কিন্তু প্রচলিত রাজনৈতিক চিন্তার বিপরীত কিছুকে সে অস্বীকারই শুধু করে না, তাকে সবরকম ভাবে নিরুৎসাহিত করে। সভায় উপস্থিত দুজন তাদের ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতার উদাহরণ দিয়ে জানালেন, রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে চর্চা করা লিটল ম্যাগাজিনগুলির সঙ্গে সমস্ত রকম সম্পর্ক ছেদের শর্তে কেমন ভাবে কর্পোরেট জগ তাঁদের টোপ দিয়েছিল উজ্জ্বল এক ভবিষ্যতের। লড়াইটা তাই সহজ নয়। কিন্ত অসম্ভবও নয়। অপ্রথাগত বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করা পত্রিকা বা লেখকদের নিয়ে ছুমার্গ এখনকার মতো আগেও ছিল। কিন্তু তা অন্য ধারার লেখক বা পত্রিকা কোনটারই চলার পথকে বন্ধ করতে পারেনি। ইতিহাসের এই ধারাকে মেনেই লিটল ম্যাগাজিন এগিয়ে চলবে। প্রয়োজন শুধু উদ্যোগ আর সংগ্রামে একাত্মতা। এরই প্রতিশ্রুতি দেওয়া নেওয়ার মধ্য দিয়েই শেষ হল ২৫শে জুলাই’এর দুই ঘণ্টা ব্যাপী কলকাতার কলেজ স্ট্রিট মোড়ে ঘোষ কেবিনের উপরের ঘরের আলোচনা।                      

Monday 6 July 2015

গ্রিস বলছে 'না'



গ্রিসের 'না' আমাদের আশা

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
 
অবশেষে গ্রিসে ৬১.৩ শতাংশ মানুষ ‘না’ বলেছেন। এ এক ঐতিহাসিক রায়। গ্রিস ও ইউরোপ জুড়ে যা এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে নিঃসন্দেহে। গ্রিস এখন ইউরোজোনে থাকবে না বেরিয়ে যাবে, কীভাবেই বা অর্থনৈতিক সংকটকে কাটিয়ে উঠবে, বেকারত্বের সমস্যাকে কীভাবে মোকাবিলা করবে – সবই এখন নির্ভর করছে সে দেশের মানুষ ও বাম্পন্থী সরকারের উপর। তবে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার বা বিশ্ব ব্যাংক জাতীয় সংস্থাগুলির মুখে যে গ্রিস ঝামা ঘষে দিতে পেরেছে, তাই এখন অনেক। একেবারে মহাজনী প্রথায়, ‘উন্নয়ন’এর কিছু গৎ বাঁধা নিদান দিয়ে একেকটি দেশের ওপর ঋণের বোঝা চাপিয়ে তারপর সেই টাকা কর্পোরেট’দের কোলে পাচার করে সাধারণ মানুষের পেটে গামছা বেঁধে টাকা আদায়ের যে পুরনো খেলা এইসব অর্থলগ্নি সংস্থাগুলি চালিয়ে এসেছে, তা এবার সপাটে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে গণভোটে। সারা পৃথিবীর কাছে এটা এখন দৃষ্টান্ত এবং এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে কোনও দেশের শাসকেরা আর সাহস করবে না তথাকথিত কৃচ্ছ্রসাধনের কথা পাড়তে।

সাধারণ মানুষকে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলে কর্পোরেট সংস্থাগুলির ফুলেফেঁপে ওঠা – এই রাজনীতিই এতদিন চালানো হয়েছে উন্নয়নের নাম করে। এর রাজনৈতিক অর্থনীতিটা অনেক গভীরে। বহুজাতিক কর্পোরেটের শুধু বাজার হলেই চলে না, তার চাই সস্তা শ্রম ও পরিকাঠামো। যেমন ভারতে, তার বাজার দরকার, সঙ্গে সস্তা শ্রমও। সবাই কর্পোরেট পণ্যের ক্রেতা হয়ে উঠলে সস্তায় শ্রম মিলবে না। আবার সবাইকে সস্তায় পাওয়া গেলে ক্রেতা তৈরি হবে না। তাই, একইসঙ্গে তার দরকার - একদিকে একটা পণ্যের বাজার আর অন্যদিকে সস্তা শ্রমের বাজার। দুটোই পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে কিন্তু তাদের বর্গ দুটি মৌলিক ভাবে ভিন্ন।

ভারতে যেমন ২৫ থেকে ৩০ কোটি ক্রেতা বাজারের ওপরেই কর্পোরেটরা নির্ভর করে আছে। বাকী ৯০ থেকে ৯৫ কোটি মানুষ সস্তার শ্রমিক বা বেকার। এই সবটাই তার দরকার – অর্থাৎ একটা স্থায়ী বৈষম্যের অর্থনীতি না হলে তার পক্ষে টিকে থাকাটা মুশকিল। সস্তার শ্রম বাজার তাকে কম খরচে ও অধিক মুনাফায় পণ্য তৈরি করে দেবে যা ক্রেতা বাজারে বিক্রি হয়ে তার ঘরে জমা পড়বে। এই সস্তার শ্রমের বাজারের কোনও মুক্তি নেই – ৯০ কোটি সস্তা শ্রম না থাকলে ৩০ কোটি ক্রেতা থাকবে না। এই বিভাজনের অর্থনীতিটাকে মাথায় রেখেই নীতিকারকেরা অগ্রসর হন।

আর এই মুনাফাকে সুনিশ্চিত করতে ও তা আরও বাড়িয়ে তুলতে তার দরকার ‘পরিকাঠামো’, মানে, সস্তায় জমি, জল, বিদ্যুৎ, রাস্তা। এই পরিকাঠামোয় অনেক বিনিয়োগ লাগে এবং তার সুরাহার জন্য পাহারাদারের মতো দাঁড়িয়ে আছে আন্তর্জাতিক অর্থসংস্থাগুলি প্রভূত পরিমাণে অর্থের সংস্থান নিয়ে। সেই অর্থ তারা দেশের সরকারের হাতে তুলে দেয় ঋণ হিসেবে যা আবার চলে যায় বড় বড় কর্পোরেট সংস্থাগুলির খপ্পরে, এইসব পরিকাঠামো তৈরির কাজের বরাত হিসেবে। তারপর ঋণ পরিশোধের যখন সময় আসে তখন সরকারগুলির ওপর আদায়ের চাপ দেওয়া হয়। সরকার তার দায় চাপায় সাধারণ মানুষের ওপর – মজুরি ও পেনশন হ্রাস, জনপ্রকল্পগুলোয় বরাদ্দ ছাঁটাই, কর বৃদ্ধি, সরকারের হাতে থাকা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়ানো ইত্যাদি ইত্যাদি। আদপে, মুল চাপটা গিয়ে পড়ে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষের ওপরে, মানুষ সর্বস্বান্ত হয়।

এই সর্বগ্রাসী অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বারেবারে মানুষ পথে নেমেছেন, চীৎকার করেছেন। গত দশকে এ রাজ্যেও এমনতর কর্পোরেট বেয়ারাপনাকে মানুষ অনেকটাই রুখে দিতে পেরেছেন। গ্রিসের গণভোটের রায় এই চলমান আন্দোলনকে আরও এক দফা অক্সিজেন দিল।       
   

Thursday 2 July 2015

গ্রিস কী করবে?

গ্রিস 'না' বলুক
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য



এমন তো নয় যে এই প্রথম কোনও দেশ ঋণের দায়ে দেউলিয়া হল। গ্রিসের ঘটনার তাৎপর্য হল, এই প্রথম কোনও তথাকথিত ‘উন্নত’ বা ‘শিল্পোন্নত’ দেশ এমনতর অবস্থায় পড়ল। সামনে দুটো পথ খোলা – এক, আইএমএফ’এর ১.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ থেকে আপাত মুক্তি পেতে গেলে কিছু ভয়ঙ্কর শর্তাবলীতে সম্মত হতে হবে; নয়তো, দুই, দেশের জনগণ ঋণ করেননি, সে বোঝা তাঁরা নেবেন না, তাই ঋণ পরিশোধ করা যাবে না, এমনতর কোনও অবস্থানে থিতু হতে হবে। এই দ্বিতীয় অবস্থানটির তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। তাই, সকলের দৃষ্টি এখন গ্রিসের দিকে। প্রধানমন্ত্রী তিপ্রাস ৫ জুলাই গণভোটের ডাক দিয়েছেন – গ্রিসের মানুষ কোন পথে এগোতে চাইছেন তা তাঁরা নিজেরাই ঠিক করবেন। এইরকম এক পরিস্থিতি আইসল্যান্ড’এর সামনে এসেছিল – সেখানে গণভোটে মানুষ ‘না’ জানিয়েছিলেন। অর্থাৎ, ঋণের দায় আমাদের নয়, ঋণ পরিশোধের অজুহাতে আমরা নিজেদের উৎসর্গ করতে পারব না।
সারা পৃথিবী জুড়ে আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক জাতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির উদ্দেশ্যই হল বিকাশের নাম করে বিভিন্ন দেশগুলিকে যথেচ্ছ ঋণ গছানো এবং সেই ঋণ পরিশোধের প্রস্তুতির নামে এক গুচ্ছ নিদান সাব্যস্ত করা। বিশাল বিশাল পরিকাঠামো গড়ে তোলার নাম করে এইসব ঋণ গছানো হয়, দেশে তো বটেই এমনকি বিদেশ থেকেও আমদানিকৃত কিছু সুবেশী দালাল সুবিশাল পুঁজি বিনিয়োগে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের ছবি এঁকে নেমে পড়ে বৃহৎ মিডিয়া পুষ্ট প্রচারের আঙ্গিনায়, কিনে ফেলা হয় তাবড় রাজনৈতিক নেতা ও নীতিনির্ধারকদের। এই ঋণের টাকাগুলো কোথায় যায়? যে সব কোম্পানি ওইসব বড় বিনিয়োগের বরাত পায়, তাদের ঘরে। এইভাবে ঋণের যে টাকাটা একটি দেশের প্রাপ্তি হল তা টেন্ডার মারফত বা ক্রয় বাবদ সরকারের ঘর থেকে চলে গেল কর্পোরেটের ঘরে। অর্থাৎ, দেশের নামে ধার করা টাকা চলে যাচ্ছে বড় কর্পোরেটের ঘরে আর ঋণ পরিশোধ করছে দেশের সরকার সাধারণ মানুষের পকেট কেটে। সরকারের ঋণ পরিশোধের উপায়? যেমন, অহরহ মন্ত্রী ও কর্পোরেট মিডিয়ার তরফ থেকে শোনা যায়, সরকারি ব্যয় সংকোচন করতে হবে, জনমুখি প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দিতে হবে, সুদের হার কমাতে হবে, পেনশনকে বাজারজাত করতে হবে, ‘ক্ষতি’তে চলা সরকারি উদ্যোগগুলো বিক্রি করে দিতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এইভাবে মানুষের প্রাপ্ত অধিকারকে কাটছাঁট করে সরকারের ঘরে যে টাকাটা জমা করা যাবে, তা দিয়ে শোধ হবে ঋণ। আর সে ঋণ কখনও শোধ হয় না, চক্রাকারে ঘুরতে ও বাড়তে থাকে। কেউ কেউ একে বলেন ‘কর্পোরেটক্রেসি’।
আজকাল কেউ কেউ বলছেন, শেষ বিচারে অর্থনীতির কোন পথ অনুসৃত হবে তা নির্ধারণের দায়িত্ব জনগণের হাতেই ছেড়ে দেওয়া উচিত। গ্রিস হয়তো সে পথেই এগোচ্ছে। কোনও সরকারই ঋণ নেওয়ার আগে দেশের মানুষের মতামত নেয় না। তবে তার পরিশোধের দায়িত্ব কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্য দিয়ে কেন দেশের মানুষ নেবেন? গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী প্রথমে আইএমএফ’এর সঙ্গে দর কষাকষির কথা ভেবেছিলেন। এখন তিনি স্পষ্টই জানিয়েছেন, জনগণ সিদ্ধান্ত নিক। উপরন্তু, তিনি ‘না’ ভোটের জন্য জনগণের কাছে আপিল রেখেছেন। ‘উন্নয়ন’এর নামে জোরজবরদস্তি ঋণ দেওয়া, তারপর ঋণের টাকা কর্পোরেটের হাতে পাচার - না হলে বন্ধ হওয়ার নয়। গ্রিসের দিকে সারা বিশ্ব তাই এখন তাকিয়ে আছে।     

Wednesday 1 July 2015

মিড ডে মিলেও ধর্ম?



মিড ডে মিল নিয়ে ধর্মের রাজনীতি কেন?

অভিজিৎ রায়

শিশুদের পুষ্টি নিয়ে কোনো ট্র্যাজেডি না ঘটলে সেটি প্রাইম টাইম নিউজ হয় না। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান মহাশয়ের মিড ডে মিলে সম্প্রতি সেদ্ধ ডিম দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞ‍া জারি করেছেন। অঙ্গনওয়াড়ীর অন্তর্ভুক্ত ইন্টিগ্রেটেড  চাইল্ড  ডেভেলপমেন্ট (আইসিডিএস) কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে শিশুদের পুষ্টিবৃদ্ধির যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তাতে পুষ্টি বৃদ্ধিতে মধ্যাহ্ন ভোজনে সেদ্ধ ডিমের গুরুত্ব অনস্বীকার্য মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর এ হেন পদক্ষেপ তার ব্যক্তিগত রাষ্ট্রনীতি বলেই বোধ করি। অবশ্য এই পদক্ষেপের কোনও ব্যাখাই তিনি নিজে দেননি তার মুখ্য সচিবের ব্যাখানুযায়ী, ‘নিরামিষভোজন মুখ্যমন্ত্রীর একটি অনুভূতির বিষয়’; শুধু তাই নয় মুখ্যসচিবের ব্যখানুযায়ী, আমিষ ভোজনে নাকি শিশুদের ‘সেনসিটিভিটি’ বা ‘সহজে অনুভবনশীল ক্ষমতা নষ্ট হয়’ বলেও মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী অথচ তারই রাজ্যের নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক ৩-৬ বছরের শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য প্রাতরাশে সেদ্ধ ডিম দেওয়ার প্রস্তাব রাখে - বিশেষত মান্ডলা, আলিরাজপুর ও হোসাঙ্গাবাদের মতো উপজাতি এলাকাগুলিতে পুষ্টির হার বৃদ্ধির জন্য এই প্রস্তাব খুবই কার্যকরী। আইসিডিএস ও মিড ডে মিল কর্মসূচির প্রধান লক্ষ্যই হল অন্ত্বঃসত্তা মহিলা ও শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধি করা।

ভারতে ২০০৫-০৬ সালে জাতীয় পরিবার সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে শিশুরা মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত তাদের শারীরিক গঠন অত্যন্ত দুর্বল এবং গোটা দেশে মাত্র ১০ শতাংশ শিশু প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় একটি টিভি চ্যানেলে বিতর্কানুষ্ঠানে বিজেপি মুখপাত্র দুধের মহিমা কীর্তন করে এটিকে প্রোটিনের উৎকৃষ্ট উৎস বলে ঘোষণা করেন। কিন্তু যে পরিমাণ ক্যালোরি, প্রোটিন ডিম থেকে মেলে দুধ থেকে তা মেলে না বলেই মনে করেন নিউট্রিশ্যানিষ্টরা। আসলে যতই ডিম অথবা দুধ দেওয়ার কথা বলা হোক, সরকারি খাতায় মিড ডে মিলের মাধ্যমে একটি শিশুর পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য প্রত্যহ মাত্র ৭ টাকা বরাদ্দ - এই খরচে পুষ্টি সত্যিই কতটা বাড়ানো সম্ভব তা জানা নেই

ভারতীয় সংবিধানের ২১ ধারানুসারে জীবনের অধিকারের মধ্য দিয়ে খাদ্যর অধিকার প্রতিষ্ঠিত। তাছাড়া সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন রায়েও খাদ্যের অধিকারকে স্বীকৃতি জানানো হয়েছে। আসলে গলদটা গোড়া থেকেই ছিল। ২০০১ সালে সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যগুলিকে মিড ডে মিল চালু করার যে নির্দেশ দেয় এবং সেটির মেয়াদ ফুরোনোর আগে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটি রাজ্য সেই নির্দেশ কার্যকর করে। ডিম নিয়ে অনীহাটা শুরু থেকেই চলে এসেছে, মূলত ২০০৭ সাল থেকে বিজেপি মিড ডে মিলে ডিম দেওয়ার বিরোধিতা করে আসছে। মধ্যপ্রদেশে ডিমের নিষিদ্ধকরণের পক্ষে সওয়াল করে রাজ্যের একটি সম্প্রদায়ের দাবি ‘ডিম তো গাছে ফলে না তাই এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থেকে শিশুদের বাঁচানো দরকার, তাছাড়া ঘোড়া বা হাতির মতো শক্তিধর প্রাণীও শাকাহারি’।কথাগুলি হাস্যকর শোনালেও এগুলিই তাদের কাছে প্রত্যয় শিশুদের স্বাস্থ্যের আগে ধর্মীয় আবেগকে স্থান দিয়ে এনারা প্রকৃত কর্তব্য পালন থেকে শুধু বিরতই হন না, মানবাধিকারও লঙ্ঘন করেন।

এইসব যুক্তি দেখে বলা যায়, আমিষ ভোজনে শিশুদের খুব একটা বেশি বুদ্ধিহীনতা ঘটবে না কারণ অবস্থাটা আগে থেকেই খারাপ। দেশের শিশুরা ইস্কুলের বেঞ্চির উপর দু'খানি শীর্ণ খর্ব চরণে দোদুল্যমান, সেই সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎও দুলছে। ইস্কুলে মাস্টারের বেত হজম করতে করতে, অনাহারে দিন কাটাতে কাটাতে তাদের হজম শক্তি দুর্বল, মানসিক পাকযন্ত্রটাও পরিণত হয় না, অতএব সেখানে আমিষ ভোজনে তাদের ‘সেনসিটিভিটি’ কমে যাওয়ার বিশেষ ভয়না নেই

ভারতে সংস্কৃতিগত পার্থক্যের জন্য মানুষের রুচি, খাওয়া-দাওয়ার ক্ষেএে ভিন্নতা আছে আর এই ফারাকটাই কোথাও সমস্যার সৃষ্টি করে। এই ধরনের নিষিদ্ধকরণে উচ্চ শ্রেণির নিরামিষ ভোজন মানসিকতা যেমন গুরুত্ব পায় সরকারি নীতির বদলে, তেমনি বাস্তবকে উপেক্ষা করে আপন চিন্তাধারা চালানো আর সেখানেই প্রকাশ পায় শ্রেণি-জাতপাত ভেদাভেদের রাজনীতি। আমাদের দেশে ‘খাদ্যের জাতপাতকরণ’ ব্যাপারটাও অস্বাভাবিক নয়, তাতে শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধি কমে গেলেও শাসকের নিরামিষ বিধি প্রয়োগ করা ছাড়া গতি নেই ইউনাইটেড নেশন’এর খাদ্য ও কৃষি সংস্থার তথ্যানুযায়ী, অপুষ্টির শিকারে প্রতি চারজনের একজন ভারতীয়; যেখানে অপুষ্টির হার তীব্র সেখানে পুষ্টির বৃদ্ধি প্রাধান্য পাওয়া দরকার নয় কী?।

কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক এবং ছওিশগড়ের শিক্ষা ও সাহিত্য মন্ত্রকের যৌথ সমীক্ষাতে উঠে এসেছে, মিড ডে মিলে প্রোটিনের জন্য অন্য রাজ্যগুলির তুলনায় ওড়িশায় সবচেয়ে বেশি ডিমের ব্যবহার হয়, বিশেষত উপজাতি বসতি এলাকাগুলিতে পুষ্টির হার বৃদ্ধিতে বেশি নজর দেওয়া হয়েছে। ওড়িশা সরকার একটি অভিনব পন্থা নিয়েছে - তিন বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের মিল বাড়িতে রেশন করে দেওয়া হয়। মিড ডে মিলের মধ্যেও বহুজাতিক সংস্থাগুলি তাদের মুনাফা পেতে চায়। তারা প্রভাব খাটিয়ে রান্না করা মিলের পরিবর্তে ড্রাই মিলের প্যাকেটের ব্যবস্থা করে যার মেনুতে নিরামিষ খাবারই থাকে এতে খাবারের মান নিয়ে সন্দেহ থাকে পশ্চিমবঙ্গেও মিড ডে মিলের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু এই বঙ্গ কেন, সম্প্রতি মহারাষ্ট্রেও অঙ্গনওয়াড়ীর খাদ্য কেনার ক্ষেএে কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে এবং খাবারের মান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে মিড ডে মিলের মাধ্যমে কেবল পুষ্টি নয় ইস্কুলের প্রতি শিশুদের আকর্ষণ বৃদ্ধিও করা হয়। তথ্যানুযায়ী, ২০১৩-১৪ সালে প্রায় ১০.৪৫ কোটি শিশুকে স্কুলমুখি করা গেছে মিড মিলের মাধ্যমে

ছওিশগড়ে ২০০৫ সাল থেকে ‘ফুলওয়ারির’ মাধ্যমে উপজাতি এলাকাগুলিতে শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধির প্রক্রিয়াতে ডিম প্রচলিত হলেও ২০১৩ সাল থেকে তা নিষিদ্ধ হয়। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী রামন সিং কিছুদিন আগে সুরগুজাতে প্রকাশ্য জনসভায় বলেন, উপজাতি এলাকার শিশুদের পুষ্টির জন্য ডিম প্রয়োজন। কিন্ত তিনি এটিকে সরকারি নীতির আওতাভুক্ত করেননি। কারণটা বোধহয় হিন্দুত্ববাদী বস’দের চোখে অপ্রিয় পাত্র হয়ে পড়বেন। ‘ফুলওয়ারি’ কোনও সরকারি প্রকল্প নয়, এটি প্রতিটি গ্রামের মায়েদের দ্বারা পরিচালিত একটি প্রকল্প যার অর্থ আসত জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে।

মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক বা ছওিশগড়ে ডিম নিষিদ্ধকরণ শিশুদের স্বাস্থ্যর পরিপন্থী - এই ধরনের নিয়ন্ত্রণ অবৈজ্ঞানিক পর্যায়ে পড়ে। যেখানে প্রধানমন্ত্রী ‘বেটি বাঁচাও’র মতো কর্মসূচিতে গুরুত্ব দিচ্ছেন সেখানে শিশুদের পুষ্টির সঙ্গে আপস মেনে নেওয়া হবে কেন? প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, আইসিডিএস এবং মিড ডে মিল কর্মসূচিতে মেয়েদের স্বাস্থ্যের উপর বেশি জোর দেওয়া হয়েছিল। ‘মিশন ইন্দ্রধনুশ’ কর্মসূচির সাফল্য পুষ্টির হার বৃদ্ধির উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। শিশুদের স্বাস্থ্যের উন্নতি বৃদ্ধিটাই প্রাধান্য পাওয়া দরকার। দেশের স্বাস্থ্যের হাল নিয়ে বড়াই করা যায় না তবু এই সব সিদ্ধান্ত যারা নেন তাদের উদ্দেশ্য প্রশংসনীয় তো নয়ই বরং সমাজের পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক। কোনওরকম রাজনৈতিক জটিলতা, জাতপাতের ভেদাভেদ ও ধর্মীয়তাকে দূরে রেখে শিশুদের পুষ্টি বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার।

মিড ডে মিলের কর্মসূচির নির্ধারণে মুনাফাখোরেরা নাক গলাতে পারে না তাই মন্ত্রীকে হাত করে কোটি টাকার টেন্ডার আদায় করে ন্যূনমানের খাবার কিনে দেয়। আখেরে ক্ষতিটা হয় শিশুদেরই। সহজ কথাটা হল, ‘শিশুরাই দেশের ভবিষ্যৎ’ - কিন্তু এখানে তারাই তো দুর্নীতির শিকার এখানে শিশুদের স্বাস্থ্য মায় দেশের ভবিষ্যৎ, অপুষ্টি-হিন্দুত্ববাদী-সংকীর্ণ মানসিকতার মাঝে পথ হারিয়েছে। মিড ডে মিল নিয়ে রাজনীতির আকচাআকচি বন্ধ হোক এই কামনা করি। শাসক কখনও অন্যের নিষেধ মানবে না, তার নিষেধ সবাইকে মানতে হবে, এটাই দস্তুর আমাদের সমাজে।
সব শেষে একটা কথাই বলা যায়, শিশুদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া দরকার। মিড ডে মিলে আমিষ বন্ধ করে নিরামিষ খাবার দেওয়ার মধ্যে দিয়ে সমাজের কোনও কল্যাণ করা যায় না ধর্ম-জাতপাতের দোহাই দিয়ে শিশুদের খাদ্যের উপর নিষেধাজ্ঞ‍া আরোপে কোনও বীরত্ব নেই।