Sunday 30 October 2022

লক্ষ্য ‘কলমধারী নকশাল’?

ঠিক কী বলতে চাইছেন তিনি?

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

গত ২৮ অক্টোবর হরিয়ানার সূরযখণ্ডে রাজ্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকগুলির এক সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সদম্ভে ঘোষণা দিয়েছেন যে, শুধু ‘বন্দুকধারী নকশালদের’ নয়, এবার ‘কলমধারী নকশালদের’ও উপড়ে ফেলতে হবে। 

আশ্চর্যের কথা হল, হঠাৎ এই বিষোদগার কেন? কারণ, মাওবাদী বলে যাদের চিহ্নিত করা হয়, গত কয়েক বছরে তাদের কার্যকলাপ অনেকটাই স্তিমিত; ছত্তিশগড় ও সংলগ্ন রাজ্যগুলিতে তাদের কিছু ভিত্তি আছে, কিন্তু সেখানে বড়সড় ‘গেরিলা অ্যাকশন’ ধরনের কোনও ঘটনাক্রম ইদানীং চোখে পড়েনি; উপরন্তু, তাদের সংগঠনের বহু নেতা এখন জেলে, কেউ কেউ আত্মসমর্পণও করেছেন। দেশের কোনও কোনও অঞ্চলে শোনা যায় তাদের সংগঠন বিস্তৃতির প্রচেষ্টা রয়েছে, কিন্তু তা গণআন্দোলন ও আইনি লড়াইয়ের স্তরেই সীমাবদ্ধ। এই মুহূর্তে দেশ জুড়ে মাওবাদীদের প্রবল প্রতাপ আছে বলে সরকারের তরফেও কোনও রিপোর্ট দাখিল হয়নি। মাওবাদী ব্যতীত অন্যান্য নকশালপন্থীদের যে কার্যকলাপ তা মূলত সংসদীয় গণতন্ত্রের চৌহদ্দির মধ্যেই সীমাবদ্ধ- বিহার ও ঝাড়খণ্ডে সিপিআইএমএল (লিবারেশন)’এর যথাক্রমে ১২ ও ১ জন এমএলএ পর্যন্ত রয়েছে। তাই, কোনওভাবে এ কথা সাব্যস্ত হচ্ছে না যে নকশালপন্থীরা বন্দুকের ভাষায় কথা বলছে। বরং উল্টোদিকে, শান্তিপূর্ণ ও আইনি পথে বিবিধ গণ আন্দোলনের ওপর কেন্দ্রীয় সরকার আইন প্রণয়ন করে অথবা ইউএপিএ ধরনের আইন প্রয়োগ করে কিংবা সশস্ত্র পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী নামিয়ে দমন করে চলেছে। বন্দুকটা বরং শাসকের হাতেই গর্জাচ্ছে।

তাই স্বাভাবিক, প্রশ্ন উঠবে, তবুও মোদিজী ‘বন্দুকধারী নকশাল’দের বিপদ সম্পর্কে এতটা ‘উৎকণ্ঠা’ প্রকাশ করলেন কেন? আর সেই সঙ্গে ‘কলমধারী নকশাল’দের কথাও পাড়লেন। তারা কারা? এতদিন তিনি ‘শহুরে নকশাল’ বলে কাউকে কাউকে দাগিয়ে দিতেন। এবার ‘শহুরে নকশাল’ না বলে তিনি ‘কলমধারী নকশাল’ বললেন। ‘শহুরে নকশাল’ আর ‘কলমধারী নকশাল’ কি একই বস্তু? নাকি, ‘শহুরে নকশাল’ বললে পরিধিটা একটু খাটো হচ্ছিল, ‘কলমধারী নকশাল’ বলে তিনি পরিসরটাকে আরও বৃহৎ করলেন। এখানেই সম্ভবত আসল রহস্যটা লুকিয়ে আছে। আরও গভীরে গেলে প্রশ্নটা হবে, আসলে তিনি কোথায় বা কাদের ভয় পাচ্ছেন?

বোঝাই যাচ্ছে, ‘নকশাল’ ব্যাপারটা ছুতো মাত্র। যে ভাবে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বা ‘সন্ত্রাসবাদী’ বলে কাউকে দেগে দিলে তা প্রমাণ করা অথবা গণতান্ত্রিক আচার-বিচারের কোনও দায় থাকে না, তেমনই কাউকে ‘নকশাল’ বলে চিহ্নিত করতে পারলে তাকে স্রেফ নিকেশ করারও আর কোনও বাধা থাকে না। কিন্তু ‘নকশালপন্থা’ কি একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়? কাশ্মীরের কোনও জঙ্গীকে ধরে কি নকশাল বলে চালানো যাবে? না, তা হাস্যকর হবে। একই কারণে অসমের ‘আলফা’র কোনও জঙ্গীকে ধরেও নকশাল বলে চালাতে অসুবিধা আছে। একই সমস্যা হবে, আল-কায়দা’র কোনও জঙ্গী মডিউলকে ধরে নকশাল বলে ছাপ মারতে। এদের মধ্যকার মতাদর্শগত ও উদ্দেশ্যগত ফারাকগুলি মোদি সাহেব বোঝেন। কারণ, আরএসএস’এর শিবিরে তাঁর প্রশিক্ষণ নেওয়া আছে। তিনি ভালমতোই জানেন, ‘নকশালপন্থা’ হল এমন এক মতাদর্শ যা শ্রমজীবী মানুষের স্বাধিকার ও আত্মমর্যাদার কথা বলে, তাদের পথ ও মত নিয়ে যতই বাদ-বিবাদ থাকুক না কেন! এও বাস্তব, নকশালপন্থীদের বড় একটা অংশ আজ সংসদীয় গণতন্ত্রের অংশীদার এবং দেশ জুড়ে নির্বাচনী ময়দানে তারা বিজেপি’র কোনও বড়সড় প্রতিদ্বন্দ্বীও নয় (বিহার বা অন্যান্য রাজ্যের অল্প কিছু অঞ্চল ছাড়া)। তবুও আজ মোদিকে তাদের নামেই হুঙ্কার ছাড়তে হচ্ছে। আশ্চর্যের হলেও এটাই আজকের কঠোর বাস্তব। কারণ, নকশালপন্থীরা সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও তাদের মৌলিক মতাদর্শটি আজ দেশ জুড়ে বিজেপি’র সামনে বিপদ হিসেবে দেখা দিয়েছে। আর সেই মতাদর্শটি হল, শ্রমজীবী মানুষের অধিকারের লড়াই, বিশেষ ভাবে আজকের পরিস্থিতিতে, যখন বিজেপি উত্থাপিত হিন্দু-মুসলমানের বিভাজনের রাজনীতি ও হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাদের খোয়াব শ্রমজীবী মানুষকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছে ভ্রাতৃঘাতী অনাচার ও দাঙ্গায়।

গত এক দশক ধরে বিদ্বেষ ও বিভাজনের যে রাজনীতি সাধারণ মানুষকে ছত্রভঙ্গ করেছে, নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে প্ররোচিত করেছে ও তাদের রুটি-রুজির সমস্যাকে তীব্রতর করেছে, তার থেকে মুক্তির পথ খুঁজছে দিশাহীন মানুষ। একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়কে নিকেশ করে ও কর্পোরেটদের হাতে অর্থনীতিকে সঁপে দিয়ে রাষ্ট্রকে প্রায়-সম্পূর্ণ ভাবে জনগণের দায় মুক্ত করে হিন্দু-হিন্দি রাষ্ট্র স্থাপনের যে প্রবল মতাদর্শটিকে আরএসএস-বিজেপি আজ হাতিয়ার করে আক্রমণাত্মক হয়ে উঠেছে, তার বিরুদ্ধে রুটি-রুজির দাবিতে গরিব-মেহনতি মানুষের বৈচিত্র্যের মধ্যে সার্বিক ঐক্য ও রাজনৈতিক অধিকারের আওয়াজই যে হতে পারে প্রকৃত শান্তিকামী বিকল্প- তা ধীরে ধীরে হলেও সাধারণজনেরা তো বুঝছেনই, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকেও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে বিকল্পের এই বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিতে হচ্ছে। অতএব, এই বিকল্প রাজনীতি প্রকাশ পাচ্ছে বিভিন্ন মাত্রায়, এমনকি বিরোধী দলগুলির রাজনৈতিক অনুশীলনেও। এখানেই মোদি-শাহ জুটির তীব্র আশঙ্কা ও ভয়। তাই, নিজেদের হিন্দু-প্রকল্পকে সচল রাখতে ‘নকশালপন্থা’ই হল সেই শব্দবন্ধ যা দেগে দিয়ে বিরোধীদের মনে ভয় ধরানো ও তাদের ওপর নিপীড়ন নামিয়ে আনা যায়।

আর ‘কলমধারী নকশালপন্থীরা’ হলেন সেই সব অজস্র লেখক ও সাধারণজন যারা বিজেপি’র জনবিরোধী রাজনীতির বিরুদ্ধে পত্র-পত্রিকায় ও বিশেষত সোশ্যাল মিডিয়ায় অনবরত লিখে তাদের পর্দা ফাঁস করে চলেছেন। একসময় সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি’র আইটি সেলের যে রমরমা ও একচেটিয়া আধিপত্য ছিল তা আজ অনেকটাই চূর্ণবিচূর্ণ। বরং, বিরোধী মতাবলম্বীরা সেখানে আজ যথেষ্ট দৃশ্যমান ও শক্তিশালী। আর সে কারণেই কেন্দ্রীয় তথ্য মন্ত্রক থেকে এই হুমকিও দেওয়া হয়েছে- ইউটিউব, ফেসবুক, ট্যুইটার ধরনের সামাজিক মাধ্যমগুলিকে ভারত সরকারের তীব্র নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণাধীনে থাকতে হবে যেখানে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে কোন অ্যাকাউন্ট বা পোস্ট বাতিল হবে বা থাকবে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটি পরিষ্কার।

হুমকিগুলি আসছে ঠিক গুজরাত নির্বাচনের প্রাক্কালে, যখন সেখানে বিজেপি-বিরোধী একটা তীব্র হাওয়া বইছে বলে কেউ কেউ দাবি করছেন। গুজরাতে নতুন শক্তি হলেও আম আদমি পার্টি (আপ) তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্য-বিদ্যুৎ মডেল নিয়ে প্রচারে একটা ঝড় তুলেছে বলে অনেকের অভিমত। এই প্রচার বিজেপির হিন্দুত্বের রাজনীতিকে ধাক্কা দিয়ে জনমানসে ধর্ম-জাতপাত-জাতি নির্বিশেষে সাধারণ মানুষের জীবন-জীবিকার প্রশ্নটিকে জোরালো ভাবে সামনে নিয়ে আসছে। আর ঠিক সে কারণেই কয়েকদিন আগে মোদি সাহেব গুজরাতে গিয়ে ‘নকশালপন্থা’কে আরেক প্রস্থ গালাগাল দিয়ে এসেছেন। শুধু তাই নয়, প্রকারান্তরে কেজরিওয়াল ও তাঁর দলবলকে ‘শহুরে নকশাল’ বলে দেগে দিতে চেয়েছেন। এখন কেউ কেউ বলছেন (অভয় দুবে), মোদির এই বিভ্রান্তিকর প্রচারের জবাবে কেজরিওয়াল একটি গুগলি খেলে দিয়েছেন: প্রধানমন্ত্রীর কাছে টাকার নোটের ওপর লক্ষ্মী-গণেশের ছবি ছাপানোর আর্তি। আসলে, দেশের অর্থনীতির যে হাল মোদি সাহেব তৈরি করেছেন, তা থেকে ভক্তদের উদ্ধার ভগবান ছাড়া আর কেই বা করবেন! এর মধ্য দিয়ে যেন একটা হেঁয়ালি ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে, যা বুঝতে বুঝতেই মোদি সাহেবের দিন পার। আর যেই আঁচ করেছেন ব্যাপারটা, তখন আরও বিভ্রান্ত হয়ে প্রায়-সকলকে ‘নকশালপন্থা’র বস্তায় পুরে সূরযকাণ্ড থেকে গোলাটা ছুঁড়েছেন। এদিকে ভূতের মুখে রামনাম হলেও বেবাক এই দৃশ্যটাও পাশাপাশি দেখা গেল- গোদি মিডিয়া ও বিজেপি’র নেতারা একযোগে বলতে শুরু করেছেন ‘আমাদের দেশ ধর্ম-নিরপেক্ষ’। কার বোঝা কে বয়!

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কর্ণের রথের চাকা যখন বসে গিয়েছিল, নীতিনিষ্ঠ ও দ্বিধান্বিত অর্জুন অস্ত্র সংবরণ করেছিলেন। কারণ, নিরস্ত্র যোদ্ধার ওপর অস্ত্র চালানো যায় না। কিন্তু সারথী কৃষ্ণ অর্জুনকে বুঝিয়েছিলেন, এই হল উপযুক্ত সময়, এখনই কর্ণকে বধ করো; মনে করে দেখ, কর্ণ কীভাবে তোমার পুত্র বালক অভিমন্যুকে নিরস্ত্র অবস্থায় বধ করেছিল।

জানি না, মোদি-শাহজী'র রথের চাকা মাটিতে বসে গিয়েছে কিনা। তবে ‘কলমধারী নকশাল’দের উপড়ে ফেলতে হবে বলে তিনি যে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তা এক নিদারুণ ভয় থেকে। ভয়টা নকশালদের নয়, নকশালপন্থার মতাদর্শকে, যা গত শতকের ৬০-৭০ ও ৮০’র দশকে দেশের রাজনীতির মোড়টাকেই ঘুরিয়ে দিয়েছিল রোটি-কাপড়া অউর মকানের দিকে। আজ আবারও বাধ্যত সেইদিকে ঘুরছে দেশের রাজনৈতিক মানস- নানা প্রান্তে জল-জঙ্গল-জমি রক্ষার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, কর্পোরেটদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী কৃষক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে, এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির তথাকথিত ‘রেউড়ি’ রাজনীতির অনুশীলনেও। হ্যাঁ, ধর্ম-জাতপাত-ভাষার হানাহানিতে মদত দেওয়া নয়, রাষ্ট্রের দায়িত্ব নাগরিকের শিক্ষা-স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেওয়া, গরিব মানুষের কর্মক্ষমতার সুযোগ সৃষ্টি করা, সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ানোর লক্ষ্যে তাদের দৈনন্দিন ও নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচগুলিতে রাশ টানা এবং আর যা এমত কিছু। কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে বারবার কর্পোরেট করে ছাড়, কর্পোরেট ঋণ মকুব, ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে যেতে দেওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বড় বড় ধনকুবেরদের যে বিশাল মূল্যের ‘রেউড়ি’ দেওয়া হচ্ছে, তার বিপ্রতীপে বিভিন্ন স্তরের সরকারি দুর্নীতি বন্ধ করে গরিব মানুষের মধ্যে ‘রেউড়ি’ দেওয়াটাই আজকের প্রকৃত রাজনৈতিক-অর্থনীতি যা দেশের বিকাশের পক্ষে অপরিহার্য।

আসলে, লড়াইটা দুই রাজনৈতিক-অর্থনীতির পথের মধ্যে। কর্পোরেট বনাম শ্রমজীবী মানুষ। মোদিজী এই লড়াইয়েরই পোশাকি নাম দিয়েছেন: হিন্দুত্ব বনাম নকশালপন্থা। আর সেখানে কলমের জোর তো বন্দুকের থেকে বেশিই। তাই, কলমধারীদের নিশানা!

Saturday 22 October 2022

মধ্যরাতের জিঘাংসা?

ক্ষতের নিরাময় সরকারেরই হাতে

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


 

এ রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে টেট পরীক্ষায় সফল চাকরি-প্রার্থীদের আন্দোলন চলছে। ওরা অবশ্যই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নামেননি। পেটের দায়ে, চাকরির সন্ধানে বা চাকরি পেতে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন। ওরা এমনকি নির্জলা অনশনও করেছেন। বহু মানুষের সহানুভূতি তাঁদের দিকে। এমনকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন যে, তিনি প্রকৃত দাবিতে করা আন্দোলনের পাশে আছেন এবং তাঁর সহানুভূতি রয়েছে তাঁদের দিকে। তারপরও দেখি নেমেছে অন্ধকার। পুলিস ওদের বাকরুদ্ধ করতে আসরে নেমেছে লাঠিসোটা  নিয়ে। তবে কী আন্দোলন হচ্ছে ভুল দাবিতে? 

অভিযোগ, রাজ্য পুলিস আন্দোলনরত যুবক-যুবতীদের কার্যত বলপ্রয়োগ করে সরিয়ে দিয়ে আদালতের কাছে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিল। আদালতের প্রশ্ন- পুলিস কি আন্দোলনকারীদের হটাতে পারে না, নাকি এই পুলিস এমনই শক্তিহীন যে ১৪৪ ধারা জারি করেও তা রক্ষার দায় নিতে অক্ষম?

বহু প্রশ্ন এরপরেও। 

প্রশ্ন ১: আদালত কি পুলিসকে বলপ্রয়োগে এমন উসকানি দিতে পারে?

প্রশ্ন ২: কেউ উসকালেই পুলিস ঝাঁপ দেবে নাকি আগুনে? সংবিধান কী বলে? 

প্রশ্ন ৩: যে রাজ্য সরকার দাবি করে, তারা জোর করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার দমন করতে চায় না, সেই সরকারের অধীনে থেকেও যখন পুলিস অত্যাচার করে, অধিকার রক্ষার আন্দোলন ভেস্তে দিতে ব্যস্ত হয়, তখন সরকার কীভাবে দর্শক আসনে বসে পড়ে নীরবে? প্রশাসন কি তবে একমাত্র আদালতের কাছে দায়বদ্ধ? 

প্রশ্ন আরও আছে। থাক। আসুন, এবার উত্তর খুঁজি।  

উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই আসে রাজ্য সরকার, আদালত ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। 

সম্প্রতি, রাজ্য সরকারের প্রধান দাবি করেছেন যে, তিনি টাটাকে তাড়াননি, তাড়িয়েছে সিপিএম। তাহলে আমরা কী করলাম! তৎকালীন রাজ্য সরকারের দেওয়া পুরস্কার ফেরত থেকে লেখালেখি, মিছিল-পথসভা সব বৃথা! সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ? ক্ষমতা পেয়ে আমাদের পরামর্শ মেনে নেত্রী যে সিঙ্গুরের চাষীদের জন্য সভা করলেন বিশিষ্টদের নিয়ে (টাউন হলে), তা মিথ্যা? এর জন্য তাঁকে কেউ কেউ মিথ্যে বলার দায়ে দুষছেন। টাটাকে তাড়ানোর দায় যে পুরো সিপিএমের নয়, অবশ্য পরদিনই তার ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। প্রথমটা যদি বা সংবাদমাধ্যমের কেরামতি (মুখ্যমন্ত্রীর কথার অংশ নিয়ে তারা আলোচনায় মাতে) বলে অগ্রাহ্য করা যায়, পরেরটা (গণতান্ত্রিক আন্দোলন  নিয়ে যা বলেছেন) গ্রহণযোগ্য নয়। পরে তিনি স্পষ্ট প্রমাণ দিলেন যে তিনি যা বলেন আর তার অধীন পুলিস যা করে তা এক নয়। 

খুব উৎসাহ নিয়ে সংবাদমাধ্যম দুর্নীতি বিষয়ে প্রচারে নেমেছে । ঠিকই করেছে। তবে এই সাংবাদিকেরা কেন সেই খবর (পার্থবাবুদের টাকা খাওয়ার খবর, যা নাকি প্রায় সকলেই জানতেন!) আমাদের দিতে পারলেন না আগেভাগে। কিন্তু এসব কথাই তো সব নয়। চাকুরী প্রার্থীদের কথাও বলতে হয়। আমরা এই দাবি বিবেচনা করব নিশ্চয়। একই সাথে বিবেচনা করব আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের কথাও। তিনি যে চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে বাংলার যুবদের 'না' করেছিলেন- কেন ভুলব সে কথা? পুরনো কথা বলে? বেশ, তবে এ কালের বিশিষ্ট লেখক রমাপদ চৌধুরীর কথা শুনি। তিনি তাঁর আত্মকথায় (হারানো খাতা) লিখেছেন যে, চাকরি কম ছিল। এ কথা মানতেই হয় যে, চাকরি নিশ্চয় সবাইকে দিতে পারে না কোনও সরকারই। আর, কেউ টেট পাশ করলেই চাকরি পেতে পারেন না, প্রাথমিক বা অন্য যে কোনও স্তরে। টেট পাশ করার অর্থ একটা যোগ্যতামান অর্জন করা। তবে কেন আন্দোলন?

আসলে, গোলমাল দুটো ভিন্ন জায়গায়:

১) মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও 

২) সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের দুর্নীতি। 

সমস্যার হাল-হকিকত না বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী ২০ হাজার জনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসলেন। মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আর দলের নাম তৃণমূল- সাধ্যি আছে কার যে মুখ্যমন্ত্রীর কথার বিরুদ্ধতা করেন? ব্রাত্য তো চুনোপুঁটি, রাঘববোয়াল পার্থবাবুরও তেমন সাহস ছিল না। পার্থবাবু হয়তো ভেবেছিলেন, অন্যায় যদি মুখ্যমন্ত্রী করতে পারেন তো তিনিও পারেন। আর যদি সংবাদমাধ্যম সঙ্গে থাকে তবে তো মাভৈঃ। আর পেলেনও সঙ্গে মানিকরতনদের (সরকারি কর্তারাও- সুকান্ত আচার্য থেকে পর্ষদ সভাপতি)। কেবল শিক্ষক পদ নয়, তাঁরা  নাকি বেচেছেন করণিক থেকে উপাচার্য পদও। তাতে যারা আন্দোলন করছেন তাদের কী যায় আসে? মোদ্দা কথা, তাঁরা চাকরি পেলেন না, পেলেন না মেধা তালিকাও। মেধা তালিকা না পাওয়ায় ২০১৪'র প্রার্থীদের বয়স পার হবার পথে। কী করবেন তাঁরা? সরকার তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থানের আয়োজন করতেই পারে। অথবা, তাঁদের বয়সসীমা শিথিল করার জন্য আদালতের কাছেও আবেদন রাখতে পারে। কারণ, তাঁদের বয়সসীমা যদি আজ এসে অতিক্রম করে গিয়ে থাকে, তবে তার জন্য তাঁরা মোটেও দায়ী নন। সরকারের উচ্চস্তরে দুর্নীতি দায়ী। তেমন সুপারিশ করতে পারে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদও। বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে আইন পাশ করিয়েও তো একটা ব্যবস্থা করা যায়!

এই প্রসঙ্গে গৌতম পাল (প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের বর্তমান সভাপতি) বলেছেন, সকলের চাকরি হবে। তা যে হবার নয় তা সকলেই বোঝে। অথচ, তিনি বলতে পারেননি কেন ভুল প্রশ্নের জন্য সকলে নম্বর পেল না, জানি না তাঁকে আদালতও কেন কিছু বলেনি। হয়তো বলেছে, আমি তা জানি না। এটা তো সত্য যে চাইলেই তিনি বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বদলাতে পারেন না, বাধা রয়েছে অনেক। তিনি যে বলেছেন NCTE- তা ঠিক নয়। মূল বাধা ৪২তম সংবিধান সংশোধনী যার পর শিক্ষা এখন যৌথ তালিকায়। জনতা সরকার সুযোগ পেয়েও তেমন কিছু করেনি। বাম-ডান কেউই কিছু করেনি (কেরালা রাজ্য সরকার অবশ্য এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে ছিল। আর, বর্তমান রাজ্য সরকার তো এই সংশোধনীর প্রধান চরিত্র সিদ্ধার্থ রায়ের বড় সমর্থক)। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন অতি জরুরি, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধে কে?

বোঝাই যাচ্ছে, সবটা মিলিয়ে অবস্থা বেগতিক। কিন্তু সরকারের যদি সত্যিই সদিচ্ছা থাকে, তবে তাদের মন্ত্রী ও আমলাদের দুর্নীতির জন্য যে অবস্থা আজ সৃষ্টি হয়েছে, তা অনায়াসেই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একটা রফার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারে। যে সরকারের শীর্ষকর্তারা নিজেরাই আইন ভেঙ্গে দুর্নীতি করেছে, এখন তাদেরই ব্যতিক্রমী হলেও এমন কোনও আইনসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে এই ক্ষতের নিরাময় হয়। কাজটা কঠিন কিন্তু সম্ভব।

 

Monday 17 October 2022

ডা. দিলীপ মহলানবিশ

শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ওষুধের এক প্রধান আবিষ্কর্তা

জয়ন্ত দাস


১৬ অক্টোবর ২০২২। ডা. দিলীপ মহলানবিশ চলে গেলেন। খবরের কাগজের কোনও একটা পাতায় নামটা বেরল বটে, তবে লোকে তেমন চিনল না। নামকরা লোক নন। টিভি'র সিরিয়াল করে বা ছোটমাপের রাজনৈতিক নেতাগিরি করে তাঁর চাইতে ঢের বেশি নাম করা যায় এ-বঙ্গে, তবে লক্ষ কোটি মানুষের প্রাণ বাঁচানো যায় না। ডাক্তার মহলানবিশ সেই ‘সামান্য কাজ’-টুকু করেছিলেন। তিনি ডায়ারিয়া জাতীয় রোগে জীবনদায়ী অতি পরিচিত ওষুধ ওআরএস-এর অন্যতম আবিষ্কর্তা।

ওরাল রিহাইড্রেশন সল্যুশন, সংক্ষেপে ওআরএস। এক গ্লাস জলে অল্প দামের খানিকটা পাউডার মিশিয়ে খাওয়া। বাজারে পাউডার না কিনে ঘরে বসেই বানিয়ে নেওয়া যায় এমন জিনিস। সেটাকে নিয়ে রাষ্ট্রসংঘের চিলড্রেন্স’ ফান্ড (ইউনিসেফ) বলল, 'বিংশ শতকের আর কোনও একক মেডিক্যাল আবিষ্কার এত বেশি সংখ্যক মৃত্যুকে এত কম সময়ের মধ্যে এবং এত কম খরচে আটকানোর ক্ষমতা দেখায়নি।'

ষাট-সত্তরের দশকে বছরে কম-বেশি ৫০ লক্ষ শিশু ডায়াবিয়ায় মারা যেত, মরত বড়রাও। এ দেশে এই রোগে মরাটাই ছিল সব চাইতে সহজ। ১৯৬৮ সালে বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে যখন কলেরা নিয়ে কাজ শুরু করলেন ডাক্তার মহলানবিশ, তখন তাঁরা ভাষাতেই—

'কলেরা ওয়ার্ডে তখন ঢুকতেন না ডাক্তাররা। নার্সরাও না। জনাকয়েক ওয়ার্ড বয় স্যালাইনের বোতল চালিয়ে দিত শিশুদের শরীরে। ওয়ার্ডে বাবা-মায়েদের ঢুকতে দেওয়া হত না, জানলার বাইরে তাঁরা থাকতেন, ওয়ার্ড বয়রা তাঁদের শিশুদের তুলে ধরে দেখিয়ে দিত।'

সেখানে ডাক্তার মহলানবিশেরা শুরু করলেন বৈজ্ঞানিক গবেষণা। গবেষণার নিয়ম অনুসারে দুই দলে ভাগ করলেন শিশুদের। এক দল পেল শিরা ফুঁড়ে স্যালাইন, তখনকার চালু চিকিৎসা। অন্য দল পেল ওআরএস। চিকিৎসায় কার কতটা কাজ হল, তার নিখুঁত বিবরণ রাখা দরকার। নার্সরা সে কাজ করতে রাজি নন। পড়াশুনো জানা কিছু ছেলেকে শিখিয়ে পড়িয়ে ওয়ার্ডে কাজের অস্থায়ী চাকরিতে বহাল করতে হবে। ডাক্তার মহলানবিশের ওপর সেই ভার পড়ল। তিনি চাকুরিপ্রার্থীদের বললেন, 'আমি যা যা করি সে সব তোমাদেরও করতে হবে, রাজি তো?' তারা রাজি হল, ঢুকল ওয়ার্ডে, মলমূত্র ঘেঁটে শিশুদের পরীক্ষা করার কাজ শিখে গেল। ওয়ার্ড বয়দের হল ভারি সমস্যা। তারা রোগীদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে রোগী ছেড়ে দিত, সে ঘরে গিয়ে বাঁচল কি মরল সে দায় বাপ-মায়ের। ডাক্তারবাবুর অনুরোধে লাভ হল না। তখন নতুন রিক্রুট দুটি রোগা-প্যাংলা ছেলে বলল, ডাক্তারবাবু, আমরা দেখছি। তারা দেখেছিল। ষণ্ডাগুণ্ডা ওয়ার্ড বয়দের বলেছিল, ঝামেলা করলে লাশ ফেলে দেবে। সময়টা ভাল ছিল না, বেলেঘাটা তখন ওদের দখলে। সুড়সুড় করে মাস্তান ওয়ার্ড বয়রা সিধে হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য প্যাংলা ছেলে দুটির একজনের লাশ ক’দিন পরেই পুলিশই ফেলে দেয়, নকশাল ছিল তারা। কিন্তু ততদিনে দধিচীর হাড়ে বজ্র গড়ার কাজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ১৯৭০ সালে আমেরিকান জার্নালে পাঠানো হল সে গবেষণাপত্র, কিন্তু তা পড়ে রইল বছরভোর।

পড়েই থাকত, যদি না বাংলাদেশের যুদ্ধ বাঁধত, আর লক্ষ লক্ষ মানুষ বর্ডার পেরিয়ে ভারতের ক্যাম্পে আসতেন। বনগাঁর ক্যাম্পে পাঠানো হল ডাক্তারবাবুকে। সেখানে কলেরার মড়ক লেগেছিল। ইন্দিরা গান্ধি তখন ক্যাম্পে বিদেশি প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তাঁর গবেষণার সঙ্গী আমেরিকান ডাক্তাররা ঢুকতে পারলেন না ক্যাম্পে। তিনি দেখলেন, প্রচলিত শিরা ফুঁড়ে স্যালাইন দেবার মতো ব্যবস্থা করা অসম্ভব। অতএব, ওআরএস। বেলেঘাটা আইডি হাসপাতালে তৈরি হল গ্লুকোজ, নুন আর সোডিয়াম-বাই-কার্বনেট মেশানোর কারখানা। এখনও হাসপাতালে যে ওআরএস পাওয়া যায়, তার ফর্মূলা প্রায় একই, শুধু অতিরিক্ত থাকে পটাশিয়াম ক্লোরাইড, আর সোডিয়াম বাই-কার্বনেটের বদলে সোডিয়াম সাইট্রেট। সেই ১১ পয়সায় তৈরি এক প্যাকেট ওআরএস বনগাঁর ক্যাম্পে এক লিটার জলে গুলে খাইয়ে কলেরার মৃত্যুহার অনেক কমে গেল।

ওআরএস'এর ফর্মুলা সহজ। আবিষ্কারের ইতিহাস মোটেই সহজ নয়। কয়েকজন বিজ্ঞানী ব্যক্তিগত লাভক্ষতি, অর্থ বা খ্যাতির হিসেব করেননি। আশ্চর্য এই, বিশ্বখ্যাত দু-একজন বিজ্ঞানী স্রেফ সুবিধাজনক অবস্থানের জোরে একগুঁয়েমি করে এর পথ আটকানোর বৃথা চেষ্টা করেছিলেন।  

বিংশ শতকের গোড়া থেকেই কলেরা ও নানারকমের ডাইরিয়া নিয়ে গবেষণাতে রোগের জীবাণু খুঁজে তাদের মারার চেষ্টা ছিল প্রধান দিক। তবে অনেক বিজ্ঞানী দেখলেন, ডাইরিয়ায় শরীরের জল বেরিয়ে যাবার ফলে রোগী মরে। তাঁরা শিরা ফুঁড়ে স্যালাইন বা লবণ জল দিয়ে জলশূন্যতার চিকিৎসা করতে চাইলেন। তবে দু-দলের চিকিৎসকরাই ভাবতেন, এরকম ডাইরিয়ার সময়ে আমাদের খাদ্যনালীর খাদ্যগ্রহণ ক্ষমতা থাকে না, তাকে মুখে কিছু খাওয়ানো ক্ষতিকারক। শিরায় নানা রকমের স্যালাইন ধরনের তরল চালিয়ে চিকিৎসা করার সময়ে রোগীদের উপোস করিয়ে রাখা হত। এতে মৃত্যুহার কিছুটা কমে।

অধিকাংশ ডাইরিয়া আক্রান্ত রোগী ছিল শিশু। তাদের বেশ কিছুদিন উপোস করিয়ে রাখার পরে তারা অপুষ্টির শিকার হত, নানা অপুষ্টি জনিত রোগে মারা যেত। তার ওপরে এই চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তি করতে হত, খরচ ছিল অনেক। বিভিন্ন হাসপাতালে নানা ডাক্তার নানাভাবে চিকিৎসা করতেন, ভর্তি রোগীদের মধ্যে মোটামুটি অর্ধেক মারা যেত।

১৯৪০ সালে ডাক্তার ড্যানিয়েল ডারো নানারকমের ডাইরিয়া রোগী পরীক্ষা করে এক বিশেষ স্যালাইন বানালেন। ডাইরিয়ার চিকিৎসা খানিকটা বিজ্ঞানসম্মত হল, কিন্তু সারা বিশ্বে ডাইরিয়ায় মৃত্যু কমল না। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোয় ডারো সাহেবের স্যালাইন চালানোর উপযুক্ত হাসপাতাল, যথেষ্ট চিকিৎসক অথবা দক্ষ স্বাস্থ্যকর্মী ছিল না। মুখে খাবার দ্রবণ দরকার ছিল। কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞানী ভাবতেন, ডাইরিয়ায় পরিপাকনালীর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।

১৯৫০-এর দশকে ইঁদুরের অন্ত্রে গ্লুকোজের উপর নির্ভরশীল সোডিয়াম ও জল শোষণের পদ্ধতি আবিষ্কার হয়। তারপরে ডাইরিয়ার চিকিৎসায় গ্লুকোজের সঙ্গে লবণ জল খাওয়ানোর কথা ভাবা হয়। ১৯৬১ সালে ফিলিপিন্সে কলেরা মহামারীতে ডাক্তার রবার্ট ফিলিপ্‌স গ্লুকোজ ও লবণ জলের মিশ্রণ খাইয়ে কিছু কলেরা রোগীকে সুস্থ করে তোলেন। এরপরে বড় মাত্রায় পরীক্ষা করতে গিয়ে কয়েকজন কলেরা রোগী মারা যায় ও তিনি পরীক্ষা বন্ধ করে দেন। পানীয়ে গ্লুকোজ ও লবণের মাপ ঠিক ছিল না। ডাক্তার ফিলিপ্‌স ভুল বুঝে বিজ্ঞান পত্রিকায় লেখেন, কলেরার সময় খাদ্যনালীর ক্ষমতা কমে যায়, তাদের একমাত্র চিকিৎসা শিরার মাধ্যমে স্যালাইন।

১৯৬০ সালে ঢাকায় Pakistan-SEATO Cholera Research Laboratory প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রায় একই সময়ে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় The Johns Hopkins Center for Medical Research and Training। দুই জায়গাতেই দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীদের নিয়ে জোরকদমে চলল কলেরা নিয়ে গবেষণার কাজ। ঢাকার কেন্দ্রটিতে ডেভিড সাচার ও তাঁর বাঙালি সহযোগী চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে দেখান, কলেরা রোগীদের খাদ্যনালীর গ্লুকোজ-নির্ভর সোডিয়াম শোষণের ক্ষমতা নষ্ট হয় না, অর্থাৎ তাদের মুখে গ্লুকোজ-লবণ জল খাইয়ে জলশূন্যতা সারানো সম্ভব। কলকাতার চিকিৎসকেরাও একই ব্যাপার দেখতে পান। কিন্তু বিদেশি চিকিৎসক-বিজ্ঞানীরা এটা হজম করতে পারলেন না। তাঁদের হাতে চাবিকাঠি। কলকাতা বা ঢাকায় রোগীদের ওপর ওআরএস নিয়ে পরীক্ষার অনুমতি মিলল না।

চট্টগ্রামে কলেরা মহামারীর সময়ে দুই আমেরিকান বৈজ্ঞানিক ডেভিড নালিন ও রিচার্ড ক্যাশ সেখানে যান। ডাক্তার রফিকুল ইসলাম সেখানে ওআরএস দিয়ে কলেরার চিকিৎসা করে অনেক রোগীকে সুস্থ করছিলেন। তাঁদের চিকিৎসা পদ্ধতির নাম দেওয়া হয় ‘ইসলাম প্রোটোকল’। যথেষ্ট নথিপত্র রাখা হয়নি, এই কারণে পশ্চিমি চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই প্রোটোকলকে পাত্তা দিলেন না। পরে বোঝা গিয়েছিল, ‘ইসলাম প্রোটোকল’ কাজ করে। অনেক পরে ডাক্তার রফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, জীবন বাঁচানো ছিল আমার কাজ। আমি সেটা করতে পেরেছি। ঐ পরিকাঠামো নিয়ে নথিপত্র রাখা শক্ত ছিল, স্বীকৃতি পাইনি, তা নিয়ে দুঃখ নেই। চট্টগ্রামের চাঁদপুর জেলার ‘মতলব’ হাসপাতালে ডাক্তার মিজনুর রহমান ওআরএস যোগে কলেরা রোগীদের চিকিৎসার অনুমতি ছাড়াই ওআরএস দিয়ে চিকিৎসা করে অনেক রোগীকে বাঁচান।

নানা বাধা পেরিয়ে ঢাকা কলেরা রিসার্চ ল্যাবরেটরির প্রধান ডাক্তার হেনরি মসলে-র সহযোগিতায় নালিন ও ক্যাশ-এর প্রোটোকল ছাড়পত্র পায়। ওআরএস নিয়ে ঢাকায় তাঁদের ট্রায়াল সফল হয়। একই সময়ে ডাক্তার মহলানবিশের নেতৃত্বে কলকাতা তথা বনগাঁ শরণার্থী শিবিরের ট্রায়াল সফল হয়। শুধুমাত্র ওআরএস দিয়ে ও হাসপাতালে ভর্তি না করেও কলেরার মৃত্যুহার অনেক কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। ডাক্তার মহলানবিশের নিজের ভাষায়, 'আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, ওআরএস চিকিৎসা কোথায় প্রথম প্রমাণিত হয়েছিল, ঢাকা না কলকাতা। আমি বলি, ঢাকাতে ও কলকাতায় সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়েছিল, কিন্তু যে ভাবে ‘র‍্যান্ডমাইজড কন্ট্রোল ট্রায়াল’-এর প্রতিটি নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করে, প্রতিটি শিশুর প্রতিটি প্রয়োজনীয় তথ্য রেখে কলকাতায় গবেষণা হয়েছে, তা হয়নি ঢাকায়।' বেলেঘাটার দধিচীদের হাড় তিনি বৃথা যেতে দেননি।

ওআরএস এর ফর্মুলায় কিছু পরিবর্তন করেন ডাক্তার মহলানবিশ, ফলে এটি আরও বেশি কার্যকরী হয়ে ওঠে। তিনি অজস্র আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন। তার মধ্যে বিশেষ করে উল্লেখযোগ্য হল ২০০২ সালের পলিন পুরস্কার। তিনি আমেরিকা বা ইউরোপের বাসিন্দা হলে আরও অনেক বেশি পুরস্কার পেতেন- এটা বলার পাশাপাশি মনে হয়, বাংলার মানুষই বা তাঁকে কতটুকু সম্মান দিয়েছে? ডাক্তার মহলানবিশ কলকাতায় স্ত্রী ড. জয়ন্তী মহলানবিশের সঙ্গে থাকতেন। গত বছর স্ত্রী-বিয়োগের পরে তিনি মানসিকভাবে অনেকটা নিঃসঙ্গ হয়ে যান, হয়তো বা বিষাদগ্রস্তও। এইবার চলে গেলেন তিনি। সব মহীরূহ পতনের শব্দ শোনা যায় না, বিশেষ করে কার্নিভাল-প্রিয় হুজুগে এই নগরে। কিন্তু ধীরে ধীরে আমাদের শহর, আমাদের দেশ দরিদ্র হয়ে চলে।


Sunday 16 October 2022

হিন্দি উপনিবেশের পথে?

কাগুজে প্রস্তাবগুলি ঠোঙা হয়ে যাক!

প্রশান্ত ভট্টাচার্য 

 

আরএসএস'এর হিন্দুত্বের সঙ্গে পরিপূরক হিন্দি। 'এক দেশ এক ভাষা' স্লোগান 'এক দেশ এক জাতি' ও 'এক দেশ এক ধর্ম' নীতির এক্সটেন্ডেড ফর্ম। সংঘের এই এজেন্ডা এবার রূপায়ণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে মোদী-শাহ'র সরকার। দেশের ঐক্য বিপন্ন হওয়ার মুখে। তবে ফ্যাসিস্টরা দেশে দেশে এই ভাষা সন্ত্রাস চালিয়েছে অতীতে। এবার ভারতে সেই সন্ত্রাস চালাবার নান্দীমুখ হচ্ছে। 

পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছি, ২০১৯ সালে হিন্দি দিবস উপলক্ষে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ আবেদনের ছলে জানিয়েছিলেন, যাতে হিন্দিকে ভারতের 'সর্বজনীন' ভাষা করে দেওয়া হয়। একটি টুইটার পোস্টের মাধ্যমে অমিত শাহ বলেন, দেশে এমন একটি সর্বজনীন ভাষার প্রয়োজন যা 'আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের পরিচিতির ছাপ' রেখে যায়। তিনি আরও বলেন, হিন্দির ক্ষমতা আছে 'দেশকে এক সূত্রে ঐক্যবদ্ধ' করার। বহু ভাষাভাষি ভারত ভূখণ্ডে এর চেয়ে বাতুল মন্তব্য আর কিছু হতে পারে না বলে অনেকেই ভেবে বসেছিলেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আরএসএস'এর ঘরের লোক আর মোদীর ক্যাপ্টেনশিপে সংসদীয় রাজনৈতিক মঞ্চে উঠে আসা অমিত শাহ বাতুল নন বরং সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্যমুখি। আর সেটা এখন বুঝতে পারছেন সকলেই। অতীতে বার বার হিন্দিকে দেশের প্রধান ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেছেন অমিত শাহ। 

এরই মধ্যে সরকারি কাজের ভাষা হিন্দি করার কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাব নিয়ে নানা স্তরে বিতর্ক শুরু হয়ে গিয়েছে। এই আবহেই এবার তা কার্যকর করতে প্রথম পদক্ষেপ মধ্যপ্রদেশে ডাক্তারি পড়ানোর টেক্সট হিন্দিতে করা। সরকারের হিন্দি নিয়ে এই আগ্রাসী মনোভাব দেশকে এক বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ইতিমধ্যে তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এম কে স্ট্যালিন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ১৯৬৫ সালের কথা। স্ট্যালিন বলেন, যদি কেন্দ্রীয় সরকার তামিলনাড়ুর ওপর হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কথা ভাবে, ডিএমকে'র অর্ধ শতাব্দী পুরনো হিন্দি-বিরোধী আন্দোলনের কথা যেন মাথায় রাখে। কেরালার মুখ্যমন্ত্রী পিনারই বিজয়নও সতর্ক করে দিয়েছেন। নিজস্ব ট্যুইট বার্তায় পিনারই জানান, 'কেন্দ্রীয় সরকারের বলপূর্বক হিন্দি চাপানোর এই পদক্ষেপ ভারতের আদর্শ এবং বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ওপরে আক্রমণ। এই পদক্ষেপ দেশের অভ্যন্তরে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের একটি বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এই নিষ্ঠুর পদক্ষেপ যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোকে অবমাননা করে। তাই ঐক্যবদ্ধভাবে এর বিরোধিতা করতে হবে।'

এটা আমরা সবাই জানি, দেশের সংবিধানের অষ্টম তফসিলে বাংলা, তামিল, ওড়িয়া, মালয়ালম, হিন্দি সহ ২২টি ভাষার সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে। সেই অনুসারে, সিপিআইএম পলিটব্যুরোর সদস্য তথা কেরালার মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাব, কেন্দ্রীয় সরকারি চাকরির প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় অষ্টম তফসিলে থাকা নির্দিষ্ট সমস্ত ভাষায় প্রশ্নপত্র করার। শুধু তাই নয়, আমার ব্যক্তিগত মত, মেডিক্যালের পাঠ্যপুস্তক শুধু হিন্দিতে কেন, অষ্টম তফসিল অন্তর্ভুক্ত ২২টি ভাষাতেই মেডিক্যালে পড়ার ব্যবস্থা হোক। তা ভীষণভাবে বরণীয়। চিৎকার করে বলা হোক, শুধু হিন্দি কেন? সব মাতৃভাষায় চিকিৎসা প্রকৌশল, আইন বিদ্যা শেখানো হোক। কোনও রাষ্ট্রভাষা চাই না। এক দেশ বহু ভাষা বহু ধর্ম বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। উলটো আমরা দেখছি, আইআইএম/ আইআইটি সহ সব জায়গায় শিক্ষার মাধ্যম হিন্দি করার জন্য অমিত শাহর নেতৃত্বে সংসদীয় কমিটির সুপারিশ বুঝিয়ে দিল দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসলে কুয়োর ব্যাঙ। তিনি বুঝতে পারছেন না এর পরিণাম কী হতে পারে। ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, হিন্দুত্বের চেয়ে অনেক বেশি বিপজ্জনক হিন্দি সন্ত্রাস। কেন না, ধর্মভিত্তিক লড়াই ও সহিংসতা ভারত ভূখণ্ডে গত আড়াই হাজার বছর ধরে হয়ে আসছে এবং ১৯৪৭ সালে ধর্মভিত্তিক দেশভাগের পরও আমরা গুঁতোগুঁতি করে টিকে আছি। ফলে, ধর্ম দিয়ে দেশের সামগ্রিক ক্ষতি করার ক্ষমতা হারিয়ে গিয়েছে ধর্মীয় মৌলবাদের। কিন্তু ভয়ঙ্কর ক্ষতি করবে তাদের হিন্দি চাপানোর মানসিকতা, যা নিম্নমেধাতন্ত্রের প্রতীক। 

যদিও কেরালা ও তামিলনাড়ু সরকার রণং দেহি ভাব ইতিমধ্যে দেখালেও গা ঝাড়া দিয়ে ওঠেনি ওড়িশা বা বাংলা। বাংলা, ওড়িশা কেন ঘুমিয়ে রয়েছে কে জানে! যেখানে, এ আর রহমানের মতো কিংবদন্তি সংগীত শিল্পী নিজের মতো করে প্রতিবাদ জানিয়ে রাখছেন। যেখানে, অভিনেতা-রাজনীতিক কমল হাসন হুঙ্কার দেন, 'কোনও শাহ, সুলতান বা সম্রাটের মর্জিমাফিক দেশ চলবে না। দরকারে জাল্লিকাট্টুর চেয়েও বড় আকারে প্রতিবাদ হবে'। কমল হাসন জাতীয় সংগীতের প্রসঙ্গ তুলে যা বলেছেন, তার তুলনা হয় না। অভিনেতা বলেন, 'দেশের অধিকাংশ মানুষই গর্বের সঙ্গে বাংলায় জাতীয় সংগীত গায় এবং ভবিষ্যতেও গাইবে। তার কারণ, জাতীয় সংগীতের স্রষ্টা প্রত্যেক ভাষা ও সংস্কৃতিকে সম্মান জানিয়ে তা রচনা করেছিলেন। সে জন‌্যই এটি জাতীয় সংগীত হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছিল। তাই যে ভারত সবাইকে আপন করে নেয়, তাকে কোনও একটি ভাষার করতে চেষ্টা করবেন না।' কেন্দ্রের দূরদৃষ্টির অভাবে সবাইকে ভুগতে হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। তখন বাংলা কেন ঘুমায়ে রয়! আজও যদি আমরা ঘুরে না দাঁড়াই, তবে এই ভারতভূমিতে বাঙালি বলে কোনও জাতি আর অবশিষ্ট থাকবে না। আগামী প্রজন্মে বাংলা ভাষা বলে কিছু থাকবে না। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, বিভূতিভূষণ বলে কিছু থাকবে না। ১লা নভেম্বরের ঐতিহাসিক মানভূম ভাষা আন্দোলন, ১৯ মে ভাষা শহিদ দিবসের ইতিহাস মুছে যাবে। ভাষা শহিদদের প্রতি এর চেয়ে বড় অসম্মান আর কী হতে পারে!? তাই এক কবির কথাই মনে পড়ে, যিনি লিখেছিলেন, 'সহসা কে চেঁচিয়ে ওঠে শীতের রাতে/ বরকত বরকত.../ এই ভাষা চেয়েছিলে বুঝি/ রফিক সালাম.../ এই ভাষা রচেছিল বুঝি/ শিলচরে কমলা সুন্দরী...'। 

একটু ফিরে তাকানো যাক। ১৯৬৩ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু অফিসিয়াল ল্যাঙ্গোয়েজ বিল পেশ করেছিলেন, যেখানে ১৯৬৫ থেকে ইংরেজি এবং হিন্দিকে দেশের একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। কেন্দ্রের এই চেষ্টার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ ওঠে তামিলনাডুতে। প্রচারে নামে ডিএমকে। দলের ক্যাডাররা সংবিধানের ১৭ অধ্যায়ের কপি পোড়ান। কারণ, ওই ১৭ অধ্যায়েই হিন্দিকে সরকারি ভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। গ্রেফতার হন ডিএমকে প্রধান সিএন আন্নাদুরাই। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি চিন্নাস্বামী নামে এক ২৭ বছরের ডিএমকে কর্মী হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে গায়ে আগুন ধরিয়ে শহিদ হন। নেহরু সরকার তখনও নির্বিকার। যেন কিছুই হয়নি। উলটে ঘোষণা করা হয়, ১৯৬৫ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে হিন্দি একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে চালু হবে। ২৬ জানুয়ারি এম করুণানিধি সহ ডিএমকে'র প্রথম সারির নেতাদের গ্রেফতার করে হেফাজতে নেওয়া হয়। কিন্তু তামিলদের দমাতে পারেনি। একদিকে হাজার হাজার ছাত্রের মিছিল অন্যদিকে, সেদিন ডিএমকে সদস্য টিএম শিবলিঙ্গম শরীরে পেট্রল ঢেলে মাদ্রাজের কোদামবক্কমে আত্মহত্যা করেন। আর, ভিরুগাম্বাক্কাম আরঙ্গনাথম, আয়ানপলায়ম বীরাপ্পান এবং রঙ্গসমুথিরা মুথুর মতো ডিএমকে কর্মীরা গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। কিরানুর মুথু, ভিরালিমালাই সম্মুগম, পিলামেদু ধান্দাপানি প্রতিবাদের পথে হেঁটে বিষ খান। এমন প্রতিবাদের ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকার ভাষা নীতি বাতিল করতে বাধ্য হয়। 

নতুন ইতিহাস, হিন্দুত্ববাদীদের, সংঘীদের ইতিহাস তৈরি করার অঙ্গীকারবদ্ধ মোদী-শাহরা আবার হিন্দি সাম্রাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করতে উঠে পড়ে লেগেছেন। ওঁদের শুধু স্মরণ করিয়ে দিই, এমন কমিটি করে এমন সিদ্ধান্ত অনেকবারই নেওয়ার চেষ্টা হয়েছে, শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধে কাগজগুলো ঠোঙা হয়ে গিয়েছে। তবে আমাদের বিবেচনায় রাখতে হবে, অতীতে ভারতে যতগুলি সরকার হয়েছে সকলেই সংবিধান ও গণতান্ত্রিক রীতিনীতিকে যথাযথ মান্যতা দিয়ে এসেছে। ফলে, মানুষের প্রতিবাদ-প্রতিরোধ মর্যাদা পেয়েছে। ২০১৪ সাল থেকে ভারত রাষ্ট্রটি এমন কয়েকজন নেতার হাতে পড়েছে যাঁরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ব্যবহার করেই পরিপূর্ণ ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠায় উদ্যত। তার মোকাবিলা না করতে পারলে আমাদের হিন্দি উপনিবেশের অধিবাসী হতেই হবে। আমাদের প্রমাণ করতে হবে, বাঙালি শুধু কবিতা লেখে না, দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে লড়াইও করে।


Thursday 13 October 2022

মোমিনপুরে কী ঘটেছে?

পারস্পরিক অবিশ্বাস থেকে বেরতেই হবে

সুমন সেনগুপ্ত


সামাজিক মাধ্যম থেকে পাড়ার চায়ের দোকানে একটাই প্রশ্ন: মোমিনপুরে কী হয়েছে? কলকাতার পশ্চিম প্রান্তে কি রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়েছে? এই দাঙ্গা কি ১৯৪৬ সালের নোয়াখালি দাঙ্গার সমতূল্য? হিন্দুরা কি সত্যিই আক্রান্ত হয়েছে ইকবালপুরে ও সংলগ্ন অঞ্চলে? কেন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে ঐ অঞ্চলে? কেনই বা ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে? তাহলে কি প্রশাসন কিছু আড়াল করতে চায়? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গেলে তথ্য ও সমস্যার ঈষৎ গভীরে যেতে হবে।

প্রথমে খেয়াল করতে হবে, কোন সময়টাকে বেছে নেওয়া হল এই তথাকথিত ‘গোষ্ঠী সংঘর্ষ’ বা 'হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা’ দেখানোর জন্য। সেদিনটা ছিল একদিকে লক্ষ্মী পুজো, অন্যদিকে নবী দিবস। মুসলমান মানুষজনের নমাজ পড়া থেকে শুরু করে হজরত মহম্মদের জন্মদিন, অর্থাৎ নবী দিবস পালন- সব কিছুর মধ্যেই তাঁদের পুরো মহল্লা ও সম্প্রদায়কে জড়িয়ে নেওয়ার বিষয় থাকে। যদিও নবী দিবসে কী হয় তা অনেকের জানা নেই, তাই সেই সূত্র ধরেই আসে অবিশ্বাস। মিলাদ-উন-নবী আসলে হজরত মহম্মদের জন্মদিন পালন। যদিও আজও গ্রামবাংলার অনেক স্থানেই এই নবী দিবস উদযাপন করা হয় না, কিন্তু শহর মফস্বলের বেশ কিছু জায়গায় একজন মুসলমান ধার্মিক মানুষের কী করণীয়, তা নিয়ে দু' একজন মৌলবী এইদিন আলোচনা করেন। তারপর কিছু খাওয়া দাওয়া এবং মিষ্টি বিতরণ করা হয়ে থাকে- এইভাবেই বাংলার স্থানে স্থানে মিলাদ-উন-নবী পালন করা হয়। মৌলবী না পাওয়া গেলে অডিও-যন্ত্র দিয়েও অনেক সময় সিডি বা আগে থেকে বলা কথা প্রচার করা হয়। 

হিন্দুদেরও দুর্গাপুজো বা কালীপুজো বারোয়ারী হয়, কিন্তু তা নিয়ে কোনও মানুষের কোনও আপত্তি শোনা গেছে বলে জানা নেই। যদিও ইদানীং হিন্দুদের বেশ কিছু পুজো বা ধর্মীয় আচার অনেক বেশি বেশি করে বাইরে আনা হচ্ছে, হয়তো গণেশ পুজো বা শিবরাত্রির মতো অনুষ্ঠান বাইরে দেখা যাচ্ছে, হয়তো বা রামনবমীর মতো অনুষ্ঠান বাংলায় হচ্ছে, কিন্তু তা কখনই এই বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আমাদের মা-ঠাকুমারা যে লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন, সেই লক্ষ্মী চঞ্চলা, তাই সেই দেবীকে তাঁরা ঘরের ভিতরেই পুজো করেন। 

তাহলে মোমিনপুরে সেই লক্ষ্মী পুজোকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল কেন? আসলে বিষয়টা লক্ষ্মী পুজোকে জড়িয়ে নয়। বিষয়টা গণ্ডগোল করার জন্য করা; তা থেকে যাতে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায় সেই উদ্দেশ্যেই এইসব করা। ২০১৭ থেকে ২০১৯'এর মধ্যে যে সমস্ত 'দাঙ্গা' সারা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে, তার প্রত্যেকটির চরিত্র যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে এগুলি কোনওটিই বড় হাঙ্গামা নয়, কম তীব্রতার। এমন হাঙ্গামায় প্রাণহানি প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও এমনতর ঘটনাও মুহূর্তের জন্যও কাম্য নয়। কিছু বাড়িঘর জ্বলার ছবি, গাড়ি এবং বাইক পোড়ার ভিডিও, কিছু মানুষ ঘরছাড়া হওয়া, কয়েকটি ধর্মস্থান আক্রান্ত হওয়ার ছবি, আগুন জ্বলছে, বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, রাস্তায় উত্তেজিত জনতার জটলা- এইরকম ছবি ছড়ানো হয়েছে । বরং, অন্য কোনও অঞ্চলের ছবি ও ভিডিও এমনভাবে ছড়ানো হয়েছে যে তাকেই সত্যি মনে হয়েছে অনেকের। কিন্তু কোনও এলাকায় সাম্প্রতিক খুব বড় কিছু হয়নি- একমাত্র আসানসোল ছাড়া- কয়েকদিনের মধ্যেই সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও চলে আসে। মোমিনপুরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এটা একটা প্যাটার্ন। এর ফলে যেটা হয়- সারাক্ষণ একটা চাপা টেনশন, একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করে। পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও তীব্র হয়। সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় ঘৃণার চাষ। ভাইরাল করে দেওয়া হয় 'হিংসার' ভিডিও৷ সত্যের সঙ্গে মিথ্যে মিশিয়ে বয়ান তৈরি করে হাড়হিম করা প্রচার চালানো হয়। উদ্দেশ্য, আমরা চায়ের দোকানে সেইসব নিয়ে আলোচনা করব, মোবাইলে যা আসবে তাই বিশ্বাস করতে শুরু করব, সেগুলিকে ফরওয়ার্ড করব আর অন্যদেরও বলব সেই কথা বিশ্বাস করতে।

আসলে আমাদের পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর ধর্মাচারণ ও তাঁর সংস্কৃতি সম্পর্কে আমরা এত কম জানি, বা বলা ভালো জানি না, যে সেই অজ্ঞানতার মধ্য দিয়ে ঢুকে পরে পারস্পরিক অবিশ্বাস। মোমিনপুরে একটি হরিজন বস্তি আছে, তার পাশেই নবী দিবস পালনের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন কিছু মুসলমান যুবক। পতাকা লাগানোর সময়ে তার বিরোধিতা করেন সেই বস্তির কিছু মানুষ। তাঁরা বলেন পাশেই একটি মন্দির আছে, সুতরাং ওই অঞ্চলে পতাকা লাগানো যাবে না। সেইখান থেকেই শুরু হয় বচসা। সামান্য কথা কাটাকাটিতে তখনকার মতো মিটে গেলেও, প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য অনুযায়ী, পরে ওই হরিজন বস্তির মানুষজন এসে ওই পতাকা খুলে নেন। তারপর মুসলমান মানুষজনও প্রতিবাদ করেন। তাঁদের একটাই দাবি- যাঁরা ওই পতাকার অবমাননা করেছেন তাঁদের গ্রেফতার করতে হবে। এই গণ্ডগোলের সময়ে মুসলমান যুবকেরা থানা ঘেরাও করেন, বিক্ষিপ্ত কিছু ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এখান থেকে আসরে নামে বিজেপি। সারা রাত ধরে বিজেপির বিরোধী দলনেতা এবং রাজ্য সভাপতি ট্যুইট করে অনবরত চেষ্টা করতে থাকেন কী করে এই ছোট্ট ঘটনাকে জাতীয় স্তরে প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়। 

এএনআই থেকে পরের দিন সকালে কিছু ছবি এবং ভিডিও সহ ট্যুইট করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনওভাবে খবর তৈরি করা যায় না। রিপাবলিক টিভি ও অন্যান্য গোদি মিডিয়া যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে সারাক্ষণ চেষ্টা করে চলে কীভাবে যে কোনও ছোট খবরকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাতে- যাতে সমাজের মধ্যে এই গরল আরও বেশি মাত্রায় প্রবেশ করে- তারা অবধি মোমিনপুরের এই ঘটনার এমন কোনও ফুটেজ বা ছবি জোগাড় করতে পারেনি যার মধ্যে দিয়ে তাদের এই কাজটা সহজ হয়। ফলে, কোনওভাবেই আর এই ঘটনা থেকে রাজনৈতিক সুবিধা বিজেপি তুলতে পারেনি। 

প্রচার করা হয়, ঐ মুসলমান যুবকেরা নাকি পাকিস্তানের পতাকা লাগাচ্ছিলেন। অথচ, ইসলামের পতাকা যে সবুজ রঙের এবং তাতে যে চাঁদের ছবি থাকে, তা যেহেতু বেশির ভাগ হিন্দু মানুষের অজানা, তাই তা নিয়েও আরেক প্রস্থ প্রচার চলে যে ঐ মুসলমান যুবকেরা পাকিস্তানের সমর্থক। কিন্তু এত কিছু করেও বিজেপির পক্ষে বাড়তি কিছু করা সম্ভব হয়নি। যে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য তারা ঐ হরিজন বস্তির পিছিয়ে পড়া দলিত ও ডোম সম্প্রদায়ের মানুষদের তাতিয়েছিল, তাঁদেরই একটা অংশ পরে স্বীকার করেছেন যে এমন কিছু হয়নি যা নিয়ে এত শোরগোল করতে হবে।

অতঃ কিম?

আশঙ্কার কথা হল, আজকের অবিশ্বাসের আবহে এই প্রবণতা কিন্তু বাড়তেই থাকবে। প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ একটা কথা বারংবার বলতেন- উঁচু মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সমস্যা কোনওদিনও মিটবে না, কোনও রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এই কাজ করা সম্ভবও নয়। দু' জন প্রতিবেশী মানুষকে পাশাপাশি বসিয়ে একে অন্যের সম্পর্কে জানার মধ্যে দিয়েই এই সমস্যা মিটতে পারে। একজন হিন্দু মানুষ যদি মুসলমান সমাজ, তাঁর ধর্ম, তাঁর সংস্কৃতিকে জানার চেষ্টা করেন, তবেই এই সামাজিক মাধ্যম দিয়ে প্রচারিত মিথ্যে তথ্যকে মোকাবিলা করা সম্ভব। 

এখন যাঁরা মোমিনপুর অঞ্চলে যাচ্ছেন ওইদিনের ঘটনার খোঁজ খবর করতে, তাঁদের মধ্যে কতজনই বা জানেন মুসলমানদের সম্পর্কে? তাঁরা ঈদ-উল-ফিতর বা বকরি-ঈদের তফাত বোঝেন কী? কীরকম আর্থিক অবস্থায় এই মানুষগুলি আছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করেন? কেন সরকারি চাকরিতে তাঁদের আনুপাতিক হার অত্যন্ত কম? তাঁদের মধ্যে শিক্ষার হার কেমন? কেন এখনও একজন মুসলমান যুবক বা যুবতীকে শহরে ঘর ভাড়া পেতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়? এই জানার মধ্যে দিয়েই আসলে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনো সম্ভব। তাহলেই কাটবে অজ্ঞানতা ও অবিশ্বাস। তাহলেই সামাজিক মাধ্যমের এই যুগেও মিথ্যে প্রচারকে ভেঙে সঠিক দিশায় পৌঁছনো সম্ভব। 

তৈরি করা আজকের বিভাজিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সামাজিক কাজটাই অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শঙ্খবাবু আরও একটি কথা বলতেন, যেহেতু ঘৃণার কারবারীরা সারা বছর ধরে তাদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটা করে থাকে, আর আমরা কোনও একটি ঘটনার পরে সেখানে জল নিয়ে পৌঁছনোর চেষ্টা করি, তাই শুধুমাত্র জল ছিটিয়ে এই সমস্যা মিটবে না। একমাত্র পথ হচ্ছে, আমরাও যদি ছোট ছোট স্তরে আমাদের প্রতিবেশীকে জানার চেষ্টা করি, তাহলেই একদিন আমরা সকলে হিন্দু-মুসলমান নয়, সঠিক অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারব।


Thursday 6 October 2022

সংঘর্ষ ও নির্মাণ

ধর্মীয় হানাহানি বনাম প্রকৃত আয় বৃদ্ধি

অনিন্দ্য ভট্টাচার্য


 

একটি ইউটিউব চ্যানেলের পক্ষ থেকে আগত গুজরাত বিধানসভা নির্বাচন সম্পর্কে সেই রাজ্যের বিভিন্ন বিধানসভা কেন্দ্রে চলমান মানুষজনের মতামত সংগ্রহ করা চলছিল। প্রকাশিত সেই ভিডিও’তে দেখলাম, একজন শ্রমজীবী মানুষ বলছেন, ‘আমরা শুধু চাই, শিক্ষা আর স্বাস্থ্যটা সরকার ফ্রি করে দিক, তাহলে মাসে কোনওরকমে যে দশ হাজার টাকা রোজগার করি, তাতেই আমাদের ভালোমতো চলে যাবে। দিল্লিতে আপ সরকার এই কাজটা করেছে, তাই আমরা আপ’কেই এবার ভোট দেব।’ কথাটি অসম্ভব তাৎপর্যপূর্ণ। বলা যেতে পারে, আজকের আমূল পরিবর্তিত রাজনৈতিক-অর্থনীতিতে এক দিকনির্দেশ।

আমাদের দেশে খাওয়া-পরা বাদ দিলে সাধারণ মানুষের আয়ের বাকী বড় অংশটাই শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পিছনে খরচ হয়। যতই বিনামূল্যে সর্বজনীন শিক্ষা, মিড-ডে মিলের কথা বড় মুখে বলা হোক না কেন, বাস্তবতা হল, প্রাইভেট স্কুল ও টিউশনির চাপে সে গুড়ে বালি। দিনের শেষে, ফেল কড়ি মাখো তেল। ছেলেমেয়েদের শিক্ষার খরচ টানতে বাবা-মায়ের নাভিশ্বাস। News18.com'এ প্রকাশিত একটি সমীক্ষায় (২০২২) উল্লেখযোগ্য ভাবে দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে সরকারি স্কুলে পড়ুয়াদের ৫৬ শতাংশ অভিভাবকেরা স্কুল-অতিরিক্ত খরচ, যেমন, প্রাইভেট টিউশন, কোচিং ক্লাস ইত্যাদির পিছনে বছরে গড়ে প্রতি সন্তান পিছু বাড়তি ১৪,০০০ টাকারও বেশি ব্যয় করে। তার ওপর সরকারি স্কুলগুলির দৈন্য দশায় গরিবের লেখাপড়া মাথায় ওঠে। কিন্তু শিক্ষা বড় বালাই। বড় বড় পাশ না দিলে কাঙ্ক্ষিত চাকরিও জোটে না, আধুনিক বাণিজ্য জগতেও পেরে ওঠা যায় না, গরিবের ছেলে গরিবই থাকে। কথা হল, দিল্লির আপ সরকার এই পটটাকেই আমূল বদলে দিয়েছে। সেখানে সরকারি স্কুলগুলি এতটাই উন্নত ও পারদর্শী হয়েছে যে এমনকি অবস্থাপন্ন অভিভাবকেরাও প্রাইভেট স্কুল থেকে সন্তান-সন্ততিদের ছাড়িয়ে এনে সরকারি স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। আলাদা করে প্রাইভেট কোচিং’এরও কোনও দরকার নেই। ছাত্রের সমস্ত দায়-দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের। স্বাভাবিক, সে খবর ছড়িয়ে পড়েছে দেশের কোণে কোণে। বলাই বাহুল্য, গরিবের কান ও মন দুইই খোলা থাকে। তাই, গুজরাতের পথেঘাটেও সে বার্তা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।

শুধু তাই নয়। দিল্লিতে মহল্লায় মহল্লায় (প্রতি এক কিলোমিটার দূরত্বে) বিনামূল্যে সরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিক নিত্য রোগভোগের হাত থেকে গরিবদের তো বাঁচিয়েইছে, তাদের কর্মক্ষমতাকে অটুট রাখতেও সমান হাত বাড়িয়েছে। এক কথায়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য প্রকল্প দিল্লির গরিব শ্রমজীবী মানুষ ও তাদের পরিবারের জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছে- এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিনামূল্যে পানীয় জল, ২০০ ইউনিট অবধি বিদ্যুৎ ফ্রি, বাসে মহিলাদের ফ্রি সফর। একই ব্যবস্থাপনা পঞ্জাব সরকারও শুরু করেছে।

এই পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী অর্থনৈতিক তাৎপর্যকে অনুধাবন না করতে পারলে মুশকিল আছে। গরিবের মন যেহেতু উদার থাকে, তাই তাঁরা সহজেই ধরে ফেলেছেন, কেজরিওয়াল সরকারের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে যুগল অভিসারে আসলে তাঁদের প্রকৃত আয়টাই বেড়ে গেছে। কারণ, এই দুই ক্ষেত্রে তাঁদের আগে যে ব্যয় হত তার যথেষ্ট সাশ্রয় হওয়াতে তাঁদের হাতে বাড়তি কিছু টাকা থাকছে (অথবা বাজার থেকে ঋণ করতে হচ্ছে না), ফলে, তাঁরা অনেক বেশি পুষ্টিকর খাবার ও অর্থ সঞ্চয়ের দিকে মুখ ফেরাতে পারছেন। এই সহজ সত্যটিই উপরে উল্লিখিত গুজরাতের ওই শ্রমজীবী মানুষের কথায় প্রতিফলিত হয়েছে।

এই বিষয়টা চর্চা করার আগে এর রাজনৈতিক অভিযোজন নিয়ে দু-এক কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগে এ দেশে গরিবের রাজনীতি বলতে মূলত বোঝাত, রাস্তায় নেমে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দাবি আদায় করা। সেই আন্দোলনে সমাজ বদলের অভিমুখও স্পষ্ট ছিল। স্বাধীনতা উত্তরকালে অন্তত ৯০’এর দশক অবধি এই ধারাই কম বেশি শক্তিশালী ছিল, একবিংশ শতকের প্রথম দশকেও তা কোথাও কোথাও কার্যকরী ভাবে প্রবল ছিল। কোনও কোনও ধারা গরিব কৃষক ও আদিবাসীদের ঐক্যবদ্ধ করে এমনকি সুবিস্তৃত সশস্ত্র সংগ্রামও গড়ে তুলেছিল। যেমন, নকশালপন্থীদের বিভিন্ন উদ্যোগ। তাছাড়া আরও কিছু তেজস্বী স্রোত ছিল যা শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও সুষ্ঠু জীবনযাপনের পক্ষে ঐতিহাসিক সব ধারাবাহিক লড়াইয়ের ঐতিহ্য তৈরি করে। এদের মধ্যে সবিশেষ উল্লেখ্য, তেভাগার কৃষক আন্দোলন, ধানবাদে এ কে রায়ের নেতৃত্বাধীন এমসিসি সংগঠনের শ্রমিকদের লড়াই, মুম্বাইয়ে দত্ত সামন্তের নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়ন সংগ্রাম, বিহারে সিপিআই(এমএল) লিবারেশন’এর উদ্যোগে দলিত ও পিছড়ে বর্গের মানুষের লাগাতার সংগ্রাম, শঙ্কর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বে ছত্তিশগড়ে শ্রমজীবী মানুষের সংঘর্ষ ও নির্মাণ এবং আরও এমনতর বহুবিধ ছোট-বড় সংগ্রামের ধারা।

মূলত ২০০০ সালের পর একটা ধীর পট পরিবর্তন দেখা দেয়। ক্রমেই ওয়েব দুনিয়ার সর্বগ্রাসী হয়ে ওঠা, শনৈ শনৈ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আবাহন ও রাজনৈতিক অর্থনীতির আঙ্গিকে এক সুদূরপ্রসারী পরিবর্তন আসতে থাকায় সংগ্রামের গতিধারায় কিছু অন্যতর বাঁকের দেখা মেলে। পাশাপাশি, কেন্দ্রীয় স্তরে একদলীয় শাসনপ্রথা দুর্বল হয়ে পড়া ও রাজ্যে রাজ্যে বহু নতুন নতুন দলের উত্থানের ফলে বিভিন্ন দলের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে টাগ-অফ-ওয়ার’টা প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে, ভোটে জিতে ক্ষমতায় আসার অভিলাষে বিভিন্ন দল 'জনমোহিনী' নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দিতে শুরু করে। তা তো একপ্রকার জনতারই জিত! কারণ, জনতার বৃহৎ অংশটি এটা বোঝে যে, কোনও একটি দলের প্রতি চির-আনুগত্য বজায় রাখলে তাদের কোনও লাভ নেই। বরং, একটা দর-কষাকষির মতো করে এই দল সেই দলের মধ্যে যদি সমর্থনটাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে নাচানো যায়, তাহলে দলগুলিও নিজেদের জনপ্রিয়তা অটুট রাখার তাড়নায় আরও এটা-সেটা জনপ্রকল্প বা সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে পারে। বাস্তবেও তাই ঘটল। প্রায় প্রতিটি রাজ্যেই দেখা গেল, সেই দলের সরকারগুলিই নির্বাচনে ভাল ফল করছে যারা আরও বেশি বেশি জনহিতকর প্রকল্প লাগু করছে। অর্থাৎ, জন-আকর্ষণটা লড়াইয়ের ময়দান থেকে সরে গেল ‘কু’ ও ‘সু’ শাসনের তারতম্যের বিচারের দিকে। যেন, একটা নতুন সরকার এলে গরিবের কিছু সুরাহা হতে পারে; অথবা তেমন দলকেই ভোট দেওয়া যেতে পারে, যে দল গরিবের জন্য কিছু করেছে বা করতে পারে।

এইসব ডামাডোলের মধ্যেই ২০১২ সাল থেকে বিজেপি’র প্রবল উত্থান। যে জনহিতকর রাজনীতির সরল প্রক্রিয়াটার সূত্রপাত হয়েছিল ২০০০ সালের পর থেকে, সেখানে এবার একটা বিচ্যুতি ঘটল। কারণ, বিজেপি এসে গরিবের রুটি-রুজির আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে এবং সেই সুবাদে রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যকার আকচাআকচিকে জনতার দিক থেকে ব্যবহার করার সক্ষমতাকে, ভেস্তে দিল হিন্দু-মুসলমানের বিভাজন করে। গরিব মানুষদের অনেকেই ভেবে বসলেন, হিন্দু-মুসলমান সংঘাতই বোধহয় তাদের বেঁচেবর্তে থাকার প্রধান সমস্যা। কয়েকটা বছর এই করে কাটল। সম্ভবত, দিল্লির সীমান্তে এক বছর ধরে চলমান কৃষক আন্দোলন বিজেপি’র এই ভয়ঙ্কর ভাগাভাগির রাজনীতিতে সবল আঘাত হানল। কিন্তু তা বলে, রুটি-রুজি বনাম সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস- গরিব মানুষ কোন পক্ষে থাকবে তা নিয়ে বিভ্রান্তি এখনও কাটেনি। কিন্তু কাটছে। যে কারণে, গুজরাত বিধানসভা নির্বাচনে হেরে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কায় বিজেপি ‘রেউড়ি রাজনীতি’র বাপ-বাপান্ত করেও এবং কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের তীব্র অর্থ সংকটকে স্বীকার করে নিয়েও ডিসেম্বর অবধি (আরও তিন মাস বাড়িয়ে) ‘প্রধানমন্ত্রী অন্ন যোজনা’র অধীন ‘ফ্রি রেশন’ ব্যবস্থাকে চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে দিয়েছে। সোজা কথায়, হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের রাজনীতিতে আর চিঁড়ে যে তেমন ভিজছে না, তা তাদেরও বেশ মালুম হচ্ছে। এখন দেখার, আগামী দু-এক বছরে সারা দেশের রাজনীতি শেষাবধি কোন অভিমুখে বহমান হয়- ধর্মীয় পরিচয় নাকি রোটি কাপড় অউর মকান।

তবে, জনহিতকর প্রকল্প বা জনকল্যাণমূলক কর্মসূচি বলতে কোনগুলিকে দীর্ঘমেয়াদে ফলদায়ক বলে অভিহিত করা যাবে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। এ বিষয়ে স্পষ্টত দুটি ভিন্নতর প্রবণতা প্রতীয়মান:

এক) গরিব মানুষের হাতে সরাসরি কিছু অর্থ বা খাদ্যশস্য তুলে দাও যা দিয়ে তাদের অন্তত দিন গুজরান হতে পারে। সর্বজনীন ন্যূনতম আয় প্রকল্প ধারণার সঙ্গে এর অনেকটাই মিল আছে। এই ধরনের প্রকল্প বিভিন্ন রাজ্যে চালু আছে এবং কেন্দ্রীয় সরকারও অল্প কিছু ক্ষেত্রে চালু করেছে।

দুই) সরাসরি এইভাবে অর্থ না দিয়ে সাধারণ মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচগুলিকে যদি সরকারি উদ্যোগ ও সাহায্যের মাধ্যমে কমানো যায় তাহলে গরিব মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ে। শুধু তাই নয়, এর মধ্য দিয়ে এমন কিছু আবশ্যিক সরকারি উদ্যোগ গড়ে উঠতে পারে যা এক সবল সামাজিক-অর্থনৈতিক পরিকাঠামো হিসেবে দক্ষ ও উৎপাদনশীল মানবসম্পদ নির্মাণ করতে সক্ষম। যেমন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্ষেত্র। সরকারি উদ্যোগে বিনামূল্যে যদি সত্যি সত্যিই এক অনুকূল পরিবেশে উন্নত শিক্ষা প্রদান করা যায়, তা যেমন সমাজের সমস্ত শিশু, কিশোর ও যুবকদের কাছে শিক্ষার অধিকারকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে, পাশাপাশি, একটি গরিব ঘরের মেয়ে অর্থের অভাবে সেই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয় না; বরং সে আরও সক্ষম হয়ে ওঠে তার ভবিষ্যৎ আত্মপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে।

কতকটা দ্বিতীয় এই ভাবনার আদলেই শঙ্কর গুহ নিয়োগীর নেতৃত্বে ছত্তিশগড় মুক্তি মোর্চা সংঘর্ষ ও নির্মাণের এমন এক মডেল গত শতকের ৭০-৮০’র দশকে বাস্তবত দল্লি-রাজহরার বুকে গড়ে তুলেছিল। আর তার জন্যই শিল্পপতিদের মাফিয়ার হাতে তাঁকে প্রাণ দিতে হয়েছে। আমরা জানি, শ্রমিকদের অনুদানে গড়ে ওঠা ‘শহীদ হাসপাতাল’ ওই অঞ্চলের স্বাস্থ্যচিত্রটিকেই আমূল বদলে দিয়েছিল। ১৯৮৩ সালে মাত্র ১৫টি বেড নিয়ে শুরু হওয়া ওই হাসপাতাল পরে আরও বড় একটি প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হয় যেখানে নিঃস্বার্থ চিকিৎসকেরা নিরলস কাজ করে অঞ্চলটির চেহারাই পালটে দিয়েছিলেন। ডাঃ নর্মান বেথুন ও ডাঃ দ্বারকানাথ কোটনিসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে কলকাতা থেকেও এক দল চিকিৎসক ছত্তিশগড়ে পৌছে 'শহীদ হাসপাতালের' পাশে দাঁড়িয়ে এই স্বাস্থ্য আন্দোলনকে আরও উন্নত স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। একদিকে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকার লড়াই, অন্যদিকে সুস্থ সমাজের ভিত নির্মাণ- এই ছিল শঙ্কর গুহ নিয়োগীর ‘সংঘর্ষ ও নির্মাণের’ দর্শন।

শহীদ হাসপাতাল

আজকের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে সেই দর্শনের বাস্তব রূপায়ন অনেকটাই সম্ভব। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানীয় জল, বিদ্যুৎ- এইসব নিত্যপ্রয়োজনীয় পরিষেবা ও পরিকাঠামো যদি যথাযথ ও সুষ্ঠু ভাবে প্রদান করা যায়, তা একদিকে যেমন গরিব মানুষের প্রকৃত আয় বাড়াতে সাহায্য করে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের জন্য এক কর্মক্ষম, দক্ষ, শিক্ষিত মানবসম্পদও নির্মাণ করতে পারে। রাজনীতির এই ধারাটাই আজ সর্বত্র আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। সাধারণজনের চৈতন্য ও মননে সেই আকাঙ্ক্ষারই অনুরণন। যে রাজনৈতিক দল তা উপলব্ধি ও অনুশীলন করবে, মানুষ ধীরে ধীরে তাকেই সমর্থন দেবে। সম্ভবত এই কারণেই সর্বত্র আপ’এর জনপ্রিয়তাও বাড়ছে।

এখন প্রশ্ন হল, আপনি কোনদিকে? ধর্মীয় হানাহানি-জাতপাতের রাজনীতি নাকি প্রকৃত আয় বৃদ্ধির রাজনৈতিক-অর্থনীতি? সাধারণ মানুষকে আজ এই দুই পক্ষের কোনও একদিকে এসে দাঁড়াতে হবে! 

  

Sunday 2 October 2022

'আদালত ও একটি মেয়ে'

'সন্ততি' দিলে না হৃদয়ের সন্তাপপটে...

অমৃতা ঘোষাল



'সন্ততি'। অবশ্যই পরম আনন্দ মনকে ভরিয়ে তোলার মতো একটা শব্দ। কিন্তু যদি এ শব্দের ব্যবহার মনের কোণে এক চিলতে দ্বিধা জাগিয়ে দেয়? তখনও কী তা আনন্দের উৎস-শব্দ রূপেই গণ্য হবে? আসলে 'নারীত্ব' আর 'মাতৃত্ব' সমার্থক নয়। এই দু'য়ের চেয়েও 'মানবত্ব' শব্দটা সত্য।

ঋতুদর্শন। এক আধো কিশোরী, আধো বালিকা প্রথম ঋতুদর্শনের পর পরিবারের প্রবীণার থেকে জানতে পারে যে, এখন তার দেহ সন্তান ধারণের উপযোগী হয়ে উঠেছে। ক্রমশ তার মধ্যে যেন আরোপ করা হতে থাকে কীভাবে স্নেহময়ী জননী হয়ে উঠবে- সেই শিক্ষা। তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে গর্ভলাভ আর গর্ভধারণের ব্যাপারটা খুবই প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, প্রায় শিশুকাল থেকে একটা মেয়ের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে, স্ত্রীলিঙ্গ থাকার কারণে তাকে একদিন মা হতে হবে। পুতুল খেলাও যে কারণে মেয়েদের ক্ষেত্রে একপ্রকার যেন অনিবার্য ব্যাপার। কত সহজে এক শিশুকন্যা নির্জীব পুতুলকে কোলে নিয়ে বলে, 'এটা আমার ছেলে কিংবা মেয়ে!' তাকে আবার খাওয়ায়, স্নান করায় কিংবা আদর করে ইত্যাদি। শিশুর জন্যে খেলনা কেনার সময়ও সেই বিষম প্রশ্নই স্পষ্ট শুনি- ছেলে না মেয়ে? ঠিক এরকম একটা দেশে ২০২২'এর সেপ্টেম্বরে পাওয়া গেল বিস্ময়কর এক রায়। জনতার রব উঠল- 'যুগান্তকারী' রায়! রায় দিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, এএস বোপান্না ও জেবি পারদিওয়ালার বেঞ্চ।

১৯৭১ সালের ‘মেডিক্যাল টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সি’ আইন অনুসারে, গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত হতেই পারে, অবশ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে। তবে, ভ্রূণের বয়স ১২ সপ্তাহ থেকে ২০ সপ্তাহ হলে দু'জন চিকিৎসকের মত প্রয়োজন। আর ২০ সপ্তাহ অতিক্রম করে গেলে যদি গর্ভপাতের প্রয়োজন হয় তবে মেডিক্যাল বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে। ২০১৬'এর জুলাই মাসে এক ধর্ষিতা নারীর ২৪ সপ্তাহের ভ্রূণ গর্ভপাতের অনুমতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ভ্রূণের গঠনগত অস্বাভাবিকত্বর কারণে সেই নারীটিরও জীবন সংশয় হতে পারে- এমন এক রিপোর্ট দেয় মুম্বইয়ের কেইএম হাসপাতালের সাত সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতাগির পরামর্শ অনুযায়ী বিচারপতি জে এস কেহর ও বিচারপতি অরুণ মিশ্রের বেঞ্চ ছাব্বিশ বছরের ওই গর্ভবতী তরুণীর গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। 

২০১৭'এর জুলাই মাসে ঘটে যায় আরেকটি মানবিক ব্যাপার। গর্ভাবস্থার ২৬ সপ্তাহে ভ্রূণের গঠনগত ত্রুটির কারণে গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন পশ্চিমবঙ্গের এক সন্তানসম্ভবা। এসএসকেএম'এর রিপোর্টকে মান্যতা দিয়ে বিচারপতি দীপক মিশ্র এবং বিচারপতি এ এম খানউইলকরের ডিভিশন বেঞ্চ 'স্পেশাল মেডিক্যাল কেস' হিসেবে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। এবার ২০২১'এ আইনসম্মতভাবে গর্ভপাতের সময়সীমা সেই ২০ সপ্তাহ থেকে বেড়ে ২৪ সপ্তাহ হল। তবে তা কিন্তু শারীরিক বা মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন অন্তঃসত্ত্বা, ধর্ষিতা এবং নাবালিকাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনকি অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন স্বামী মারা গিয়েছেন বা ডিভোর্স হয়েছে- এমন নারীরাও এর অন্তর্ভুক্ত হলেন। ২০২১'এর আইন অনুযায়ী, আবেদনের পাঁচ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।

২০২২'এর ২৯ সেপ্টেম্বরে আরও এক ধাপ এগোলো ভারতের আইন। নারীর বৈবাহিক সত্তার সঙ্গে গর্ভপাতের সম্পর্ক আর বিবেচনা করা হল না। নারীর নিজস্ব ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিবাহিত আর অ-বিবাহিত নারীর পার্থক্যকে অ-স্বীকার করা হল। বলা হল, গর্ভের সন্তানকে জন্ম দেওয়া উচিত হবে কিনা তার সিদ্ধান্ত একমাত্র নেবেন গর্ভধারিণীই। সেই সঙ্গে বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টিও গুরুত্ব পেল। বিবাহের পরেও নিজের অসম্মতিতে কোনও নারী সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়তেই পারেন। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ সন্তান নেওয়ার মতো মধুর না-ও হতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ জানালেন যে, ভারতীয় সাংবিধানিক অধিকারকে মর্যাদা দিয়েই বিবাহিত কিংবা অ-বিবাহিত যে কোনও নারীরই নিজস্ব গর্ভকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা আছে। অর্থাৎ, যে কোনও নারীরই সুস্থ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অধিকারকে অনেকটা গুরুত্ব দেওয়া হল। আর  সম্পর্কের ফলে গর্ভসঞ্চার হলে সেই  বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও ভারতীয় নারীর রয়েছে। যৌনসঙ্গী পুরুষটি অসম্মত হলে কিংবা ছেড়ে চলে গেলে সে ক্ষেত্রেও সন্তানসম্ভবা নারী গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। অবশ্য, ভ্রূণের ২৪ সপ্তাহের সেই শর্তটি কিন্তু রইল। 

এই সবের মূলে যে ঘটনাটি ছিল, তা খানিকটা এরকম- ২৩ সপ্তাহের এক  অন্তঃসত্ত্বা নারীকে তার প্রেমিক বিবাহ করতে অস্বীকার করেন। তখন গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন সেই বছর পঁচিশের তরুণী। এবার তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। প্রথমত তিনি অ-বিবাহিত, দ্বিতীয়ত তাঁর প্রেমিক বিবাহে অনিচ্ছুক, সর্বোপরি তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা সন্তান লালনের প্রতিকূল। ২০২২ সালের ২১ জুলাই সেই নারীকে গর্ভপাতের অধিকার দেয় সুপ্রিম কোর্ট। আর এই প্রথমবার গর্ভপাতের  'মেডিক্যাল কেস'এর স্টিরিওটাইপ থেকে বেরিয়ে এল ভারতীয় আইন।

এখন প্রশ্ন হল, আমাদের দেশের কতজন নারী এই গর্ভপাতের অধিকারের খবর রাখেন? মফস্বল এলাকায় অধ্যাপনা করার সূত্রে দেখেছি, অনেক মেধাবী ছাত্রী কলেজে পড়ার সময়েই গর্ভবতী হয়ে পড়ে ও অনেক অসুবিধার মধ্যে তারা আর স্নাতক হয়ে ওঠে না। কিংবা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের নারীরা তো এখনও জানেনই না যে গর্ভপাত ২৪ সপ্তাহ অবধি আইনসম্মতভাবেই করা সম্ভব। ফলত, শিক্ষায় অনগ্রসর এলাকায় কিন্তু গর্ভপাত করাতে আগ্রহী হাতুড়ে ডাক্তারদের বেশ রমরমা। বেশ কয়েক বছর আগে প্রথম সারির কিছু সংবাদপত্রে প্রায় রোজই চোখে পড়ত কিছু ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন। অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব থেকে তারা নাকি মুক্তি দেয় আর পুরো পদ্ধতিই নাকি নিরাপদ আর গোপন। বলাই বাহুল্য, সেই ক্লিনিকগুলোর সব ক'টি বৈধ নয়, আর নিরাপদ তো নয়ই! তবু সেখানে ভিড় তো যথেষ্টই হত।

বর্তমানে সরকারি সূত্রে যতটা জন্মনিরোধক নিয়ে প্রচারের কথা শোনা যায়, ততটা কি গর্ভপাত বিষয়ে শোনা যায়! কিংবা ভ্রূণ নির্ধারণ যে অনুচিত- এই বিষয়ে যতটা শিক্ষিত মানুষ সরব, ততটা বাক্যব্যয় কি গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে করে? সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নারীর ধর্ষণের পরে যতটা আওয়াজ তোলেন, তারা কি ধর্ষিতা নারীর গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে ততটাই  উদ্বিগ্ন হন! যদি সত্যিই গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত, তাহলে কিন্তু পরিত্যক্ত সদ্যোজাত'র সংখ্যাটিও নিঃসন্দেহে কমত। তাই গর্ভপাতের আইন সংশোধন করাই একমাত্র পন্থা নয়, তার যথাযথ প্রচারও প্রয়োজন। 'সন্ততি'র মতো অনুপম শব্দ তখন আর গর্ভধারিণীর মনে কোনও কালো মেঘ ঘনিয়ে তুলবে না।