Thursday 13 October 2022

মোমিনপুরে কী ঘটেছে?

পারস্পরিক অবিশ্বাস থেকে বেরতেই হবে

সুমন সেনগুপ্ত


সামাজিক মাধ্যম থেকে পাড়ার চায়ের দোকানে একটাই প্রশ্ন: মোমিনপুরে কী হয়েছে? কলকাতার পশ্চিম প্রান্তে কি রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা হয়েছে? এই দাঙ্গা কি ১৯৪৬ সালের নোয়াখালি দাঙ্গার সমতূল্য? হিন্দুরা কি সত্যিই আক্রান্ত হয়েছে ইকবালপুরে ও সংলগ্ন অঞ্চলে? কেন ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে ঐ অঞ্চলে? কেনই বা ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে? তাহলে কি প্রশাসন কিছু আড়াল করতে চায়? এই প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গেলে তথ্য ও সমস্যার ঈষৎ গভীরে যেতে হবে।

প্রথমে খেয়াল করতে হবে, কোন সময়টাকে বেছে নেওয়া হল এই তথাকথিত ‘গোষ্ঠী সংঘর্ষ’ বা 'হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা’ দেখানোর জন্য। সেদিনটা ছিল একদিকে লক্ষ্মী পুজো, অন্যদিকে নবী দিবস। মুসলমান মানুষজনের নমাজ পড়া থেকে শুরু করে হজরত মহম্মদের জন্মদিন, অর্থাৎ নবী দিবস পালন- সব কিছুর মধ্যেই তাঁদের পুরো মহল্লা ও সম্প্রদায়কে জড়িয়ে নেওয়ার বিষয় থাকে। যদিও নবী দিবসে কী হয় তা অনেকের জানা নেই, তাই সেই সূত্র ধরেই আসে অবিশ্বাস। মিলাদ-উন-নবী আসলে হজরত মহম্মদের জন্মদিন পালন। যদিও আজও গ্রামবাংলার অনেক স্থানেই এই নবী দিবস উদযাপন করা হয় না, কিন্তু শহর মফস্বলের বেশ কিছু জায়গায় একজন মুসলমান ধার্মিক মানুষের কী করণীয়, তা নিয়ে দু' একজন মৌলবী এইদিন আলোচনা করেন। তারপর কিছু খাওয়া দাওয়া এবং মিষ্টি বিতরণ করা হয়ে থাকে- এইভাবেই বাংলার স্থানে স্থানে মিলাদ-উন-নবী পালন করা হয়। মৌলবী না পাওয়া গেলে অডিও-যন্ত্র দিয়েও অনেক সময় সিডি বা আগে থেকে বলা কথা প্রচার করা হয়। 

হিন্দুদেরও দুর্গাপুজো বা কালীপুজো বারোয়ারী হয়, কিন্তু তা নিয়ে কোনও মানুষের কোনও আপত্তি শোনা গেছে বলে জানা নেই। যদিও ইদানীং হিন্দুদের বেশ কিছু পুজো বা ধর্মীয় আচার অনেক বেশি বেশি করে বাইরে আনা হচ্ছে, হয়তো গণেশ পুজো বা শিবরাত্রির মতো অনুষ্ঠান বাইরে দেখা যাচ্ছে, হয়তো বা রামনবমীর মতো অনুষ্ঠান বাংলায় হচ্ছে, কিন্তু তা কখনই এই বাংলার সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। আমাদের মা-ঠাকুমারা যে লক্ষ্মীর পুজো করে থাকেন, সেই লক্ষ্মী চঞ্চলা, তাই সেই দেবীকে তাঁরা ঘরের ভিতরেই পুজো করেন। 

তাহলে মোমিনপুরে সেই লক্ষ্মী পুজোকে কেন্দ্র করে গণ্ডগোল কেন? আসলে বিষয়টা লক্ষ্মী পুজোকে জড়িয়ে নয়। বিষয়টা গণ্ডগোল করার জন্য করা; তা থেকে যাতে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা যায় সেই উদ্দেশ্যেই এইসব করা। ২০১৭ থেকে ২০১৯'এর মধ্যে যে সমস্ত 'দাঙ্গা' সারা বাংলার বিভিন্ন জায়গায় হয়েছে, তার প্রত্যেকটির চরিত্র যদি দেখা যায়, তাহলে দেখা যাবে এগুলি কোনওটিই বড় হাঙ্গামা নয়, কম তীব্রতার। এমন হাঙ্গামায় প্রাণহানি প্রায় নেই বললেই চলে। যদিও এমনতর ঘটনাও মুহূর্তের জন্যও কাম্য নয়। কিছু বাড়িঘর জ্বলার ছবি, গাড়ি এবং বাইক পোড়ার ভিডিও, কিছু মানুষ ঘরছাড়া হওয়া, কয়েকটি ধর্মস্থান আক্রান্ত হওয়ার ছবি, আগুন জ্বলছে, বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, রাস্তায় উত্তেজিত জনতার জটলা- এইরকম ছবি ছড়ানো হয়েছে । বরং, অন্য কোনও অঞ্চলের ছবি ও ভিডিও এমনভাবে ছড়ানো হয়েছে যে তাকেই সত্যি মনে হয়েছে অনেকের। কিন্তু কোনও এলাকায় সাম্প্রতিক খুব বড় কিছু হয়নি- একমাত্র আসানসোল ছাড়া- কয়েকদিনের মধ্যেই সে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেও চলে আসে। মোমিনপুরের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এটা একটা প্যাটার্ন। এর ফলে যেটা হয়- সারাক্ষণ একটা চাপা টেনশন, একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করে। পারস্পরিক অবিশ্বাস আরও তীব্র হয়। সেই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুরু হয় ঘৃণার চাষ। ভাইরাল করে দেওয়া হয় 'হিংসার' ভিডিও৷ সত্যের সঙ্গে মিথ্যে মিশিয়ে বয়ান তৈরি করে হাড়হিম করা প্রচার চালানো হয়। উদ্দেশ্য, আমরা চায়ের দোকানে সেইসব নিয়ে আলোচনা করব, মোবাইলে যা আসবে তাই বিশ্বাস করতে শুরু করব, সেগুলিকে ফরওয়ার্ড করব আর অন্যদেরও বলব সেই কথা বিশ্বাস করতে।

আসলে আমাদের পাশের বাড়ির প্রতিবেশীর ধর্মাচারণ ও তাঁর সংস্কৃতি সম্পর্কে আমরা এত কম জানি, বা বলা ভালো জানি না, যে সেই অজ্ঞানতার মধ্য দিয়ে ঢুকে পরে পারস্পরিক অবিশ্বাস। মোমিনপুরে একটি হরিজন বস্তি আছে, তার পাশেই নবী দিবস পালনের উদ্যোগ নিচ্ছিলেন কিছু মুসলমান যুবক। পতাকা লাগানোর সময়ে তার বিরোধিতা করেন সেই বস্তির কিছু মানুষ। তাঁরা বলেন পাশেই একটি মন্দির আছে, সুতরাং ওই অঞ্চলে পতাকা লাগানো যাবে না। সেইখান থেকেই শুরু হয় বচসা। সামান্য কথা কাটাকাটিতে তখনকার মতো মিটে গেলেও, প্রত্যক্ষদর্শীর তথ্য অনুযায়ী, পরে ওই হরিজন বস্তির মানুষজন এসে ওই পতাকা খুলে নেন। তারপর মুসলমান মানুষজনও প্রতিবাদ করেন। তাঁদের একটাই দাবি- যাঁরা ওই পতাকার অবমাননা করেছেন তাঁদের গ্রেফতার করতে হবে। এই গণ্ডগোলের সময়ে মুসলমান যুবকেরা থানা ঘেরাও করেন, বিক্ষিপ্ত কিছু ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটে। এখান থেকে আসরে নামে বিজেপি। সারা রাত ধরে বিজেপির বিরোধী দলনেতা এবং রাজ্য সভাপতি ট্যুইট করে অনবরত চেষ্টা করতে থাকেন কী করে এই ছোট্ট ঘটনাকে জাতীয় স্তরে প্রাসঙ্গিক করে তোলা যায়। 

এএনআই থেকে পরের দিন সকালে কিছু ছবি এবং ভিডিও সহ ট্যুইট করা হয়। কিন্তু তাতেও কোনওভাবে খবর তৈরি করা যায় না। রিপাবলিক টিভি ও অন্যান্য গোদি মিডিয়া যাঁরা কোনও না কোনও ভাবে সারাক্ষণ চেষ্টা করে চলে কীভাবে যে কোনও ছোট খবরকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখাতে- যাতে সমাজের মধ্যে এই গরল আরও বেশি মাত্রায় প্রবেশ করে- তারা অবধি মোমিনপুরের এই ঘটনার এমন কোনও ফুটেজ বা ছবি জোগাড় করতে পারেনি যার মধ্যে দিয়ে তাদের এই কাজটা সহজ হয়। ফলে, কোনওভাবেই আর এই ঘটনা থেকে রাজনৈতিক সুবিধা বিজেপি তুলতে পারেনি। 

প্রচার করা হয়, ঐ মুসলমান যুবকেরা নাকি পাকিস্তানের পতাকা লাগাচ্ছিলেন। অথচ, ইসলামের পতাকা যে সবুজ রঙের এবং তাতে যে চাঁদের ছবি থাকে, তা যেহেতু বেশির ভাগ হিন্দু মানুষের অজানা, তাই তা নিয়েও আরেক প্রস্থ প্রচার চলে যে ঐ মুসলমান যুবকেরা পাকিস্তানের সমর্থক। কিন্তু এত কিছু করেও বিজেপির পক্ষে বাড়তি কিছু করা সম্ভব হয়নি। যে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার জন্য তারা ঐ হরিজন বস্তির পিছিয়ে পড়া দলিত ও ডোম সম্প্রদায়ের মানুষদের তাতিয়েছিল, তাঁদেরই একটা অংশ পরে স্বীকার করেছেন যে এমন কিছু হয়নি যা নিয়ে এত শোরগোল করতে হবে।

অতঃ কিম?

আশঙ্কার কথা হল, আজকের অবিশ্বাসের আবহে এই প্রবণতা কিন্তু বাড়তেই থাকবে। প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষ একটা কথা বারংবার বলতেন- উঁচু মঞ্চ থেকে বক্তৃতা দিয়ে হিন্দু-মুসলমানের পারস্পরিক সমস্যা কোনওদিনও মিটবে না, কোনও রাজনৈতিক দলের তরফ থেকে এই কাজ করা সম্ভবও নয়। দু' জন প্রতিবেশী মানুষকে পাশাপাশি বসিয়ে একে অন্যের সম্পর্কে জানার মধ্যে দিয়েই এই সমস্যা মিটতে পারে। একজন হিন্দু মানুষ যদি মুসলমান সমাজ, তাঁর ধর্ম, তাঁর সংস্কৃতিকে জানার চেষ্টা করেন, তবেই এই সামাজিক মাধ্যম দিয়ে প্রচারিত মিথ্যে তথ্যকে মোকাবিলা করা সম্ভব। 

এখন যাঁরা মোমিনপুর অঞ্চলে যাচ্ছেন ওইদিনের ঘটনার খোঁজ খবর করতে, তাঁদের মধ্যে কতজনই বা জানেন মুসলমানদের সম্পর্কে? তাঁরা ঈদ-উল-ফিতর বা বকরি-ঈদের তফাত বোঝেন কী? কীরকম আর্থিক অবস্থায় এই মানুষগুলি আছেন, তাঁদের মধ্যে কতজন সরকারি বা বেসরকারি চাকরি করেন? কেন সরকারি চাকরিতে তাঁদের আনুপাতিক হার অত্যন্ত কম? তাঁদের মধ্যে শিক্ষার হার কেমন? কেন এখনও একজন মুসলমান যুবক বা যুবতীকে শহরে ঘর ভাড়া পেতে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়? এই জানার মধ্যে দিয়েই আসলে সত্যের কাছাকাছি পৌঁছনো সম্ভব। তাহলেই কাটবে অজ্ঞানতা ও অবিশ্বাস। তাহলেই সামাজিক মাধ্যমের এই যুগেও মিথ্যে প্রচারকে ভেঙে সঠিক দিশায় পৌঁছনো সম্ভব। 

তৈরি করা আজকের বিভাজিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই সামাজিক কাজটাই অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। শঙ্খবাবু আরও একটি কথা বলতেন, যেহেতু ঘৃণার কারবারীরা সারা বছর ধরে তাদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর কাজটা করে থাকে, আর আমরা কোনও একটি ঘটনার পরে সেখানে জল নিয়ে পৌঁছনোর চেষ্টা করি, তাই শুধুমাত্র জল ছিটিয়ে এই সমস্যা মিটবে না। একমাত্র পথ হচ্ছে, আমরাও যদি ছোট ছোট স্তরে আমাদের প্রতিবেশীকে জানার চেষ্টা করি, তাহলেই একদিন আমরা সকলে হিন্দু-মুসলমান নয়, সঠিক অর্থে মানুষ হয়ে উঠতে পারব।


8 comments:

  1. তবে কি এই ভাবেই ভারত চলবে ❗ চারিদিকে অন্ধকার অবিশ্বাসের বাতাবরণে আমাদের বা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে থাকতে হবে ⁉️ আমার ছেলে কি ঈদের দিন আমিন বা আরিফ দের বাড়ি তে নেমন্তন্ন খেতে যেতে পারবে না বা ওরা কি দীপান্বিতা লক্ষ্মী পুজোর দিন আমাদের বাড়িতে নেমন্তন্ন খেতে বাজী ফাটাতে আসতে পারবে না ⁉️😭😭

    ReplyDelete
    Replies
    1. হয়তো সেটাই ভবিতব্য, অন্তত বর্তমান চালচিত্র দেখে যেটা মনে হচ্ছে

      Delete
  2. যথার্থ লিখেছেন। এই বিদ্বেষ একদিনের উদ্যোগে যাওয়ার কথা নয়। পরষ্পরকে জানার নিরন্তর চর্চা, শুধু উৎসব নির্ভর সমাজ মাধ্যমে কোলাকুলি হাস্যকর। প্রতিদিনের জীবনে ওরা আমরা নয়, সকলে একসাথে যাপন, এটাই চর্চা করতে হবে। আর এই স্ত্রীকে গভীরে গ্রহণ করতে হবে রে,মা কিছু আছে এখানে তার সকলের সম্মিলিত নির্মাণ, একক গোষ্ঠীর নয়।

    ReplyDelete
  3. খুব সুন্দর পোষ্ট, শান্তিতে থাকতে গেলে এই অবিশ্বাস থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে।

    ReplyDelete
  4. সাম্প্রদায়িক পোস্ট। আপত্তি জানিয়ে রাখলাম। ইসলামকে জানুন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. এটাকে সাম্প্রদায়িক পোস্ট কেন বলছেন?

      Delete
  5. সম্প্রীতির বার্তা

    ReplyDelete
  6. যতটা ভালোবাসা আর সম্প্রীতি লেখায় দেখাচ্ছেন, যখন শান্তিকামীরা মানুষেরা ঝামেলা করছিলো সেই সময় গিয়ে তাদের নিরস্ত্র করলে তাদের গায়ে দাঙ্গাবাজ সম্প্রদায়ের তকমা লাগতো না। আগে আপনাদের পত্রিকা উন্মুক্ত মনের ছিলো এখন এত সংকীর্ণ মানসিকতার হয়ে পড়েছে কেন কে জানে!

    ReplyDelete