Sunday, 2 October 2022

'আদালত ও একটি মেয়ে'

'সন্ততি' দিলে না হৃদয়ের সন্তাপপটে...

অমৃতা ঘোষাল



'সন্ততি'। অবশ্যই পরম আনন্দ মনকে ভরিয়ে তোলার মতো একটা শব্দ। কিন্তু যদি এ শব্দের ব্যবহার মনের কোণে এক চিলতে দ্বিধা জাগিয়ে দেয়? তখনও কী তা আনন্দের উৎস-শব্দ রূপেই গণ্য হবে? আসলে 'নারীত্ব' আর 'মাতৃত্ব' সমার্থক নয়। এই দু'য়ের চেয়েও 'মানবত্ব' শব্দটা সত্য।

ঋতুদর্শন। এক আধো কিশোরী, আধো বালিকা প্রথম ঋতুদর্শনের পর পরিবারের প্রবীণার থেকে জানতে পারে যে, এখন তার দেহ সন্তান ধারণের উপযোগী হয়ে উঠেছে। ক্রমশ তার মধ্যে যেন আরোপ করা হতে থাকে কীভাবে স্নেহময়ী জননী হয়ে উঠবে- সেই শিক্ষা। তার কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে গর্ভলাভ আর গর্ভধারণের ব্যাপারটা খুবই প্রয়োজনীয়। অর্থাৎ, প্রায় শিশুকাল থেকে একটা মেয়ের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হচ্ছে, স্ত্রীলিঙ্গ থাকার কারণে তাকে একদিন মা হতে হবে। পুতুল খেলাও যে কারণে মেয়েদের ক্ষেত্রে একপ্রকার যেন অনিবার্য ব্যাপার। কত সহজে এক শিশুকন্যা নির্জীব পুতুলকে কোলে নিয়ে বলে, 'এটা আমার ছেলে কিংবা মেয়ে!' তাকে আবার খাওয়ায়, স্নান করায় কিংবা আদর করে ইত্যাদি। শিশুর জন্যে খেলনা কেনার সময়ও সেই বিষম প্রশ্নই স্পষ্ট শুনি- ছেলে না মেয়ে? ঠিক এরকম একটা দেশে ২০২২'এর সেপ্টেম্বরে পাওয়া গেল বিস্ময়কর এক রায়। জনতার রব উঠল- 'যুগান্তকারী' রায়! রায় দিলেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড়, এএস বোপান্না ও জেবি পারদিওয়ালার বেঞ্চ।

১৯৭১ সালের ‘মেডিক্যাল টার্মিনেশন অব প্রেগন্যান্সি’ আইন অনুসারে, গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত হতেই পারে, অবশ্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে। তবে, ভ্রূণের বয়স ১২ সপ্তাহ থেকে ২০ সপ্তাহ হলে দু'জন চিকিৎসকের মত প্রয়োজন। আর ২০ সপ্তাহ অতিক্রম করে গেলে যদি গর্ভপাতের প্রয়োজন হয় তবে মেডিক্যাল বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে। ২০১৬'এর জুলাই মাসে এক ধর্ষিতা নারীর ২৪ সপ্তাহের ভ্রূণ গর্ভপাতের অনুমতি দেয় সুপ্রিম কোর্ট। ভ্রূণের গঠনগত অস্বাভাবিকত্বর কারণে সেই নারীটিরও জীবন সংশয় হতে পারে- এমন এক রিপোর্ট দেয় মুম্বইয়ের কেইএম হাসপাতালের সাত সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড। তখন অ্যাটর্নি জেনারেল মুকুল রোহতাগির পরামর্শ অনুযায়ী বিচারপতি জে এস কেহর ও বিচারপতি অরুণ মিশ্রের বেঞ্চ ছাব্বিশ বছরের ওই গর্ভবতী তরুণীর গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। 

২০১৭'এর জুলাই মাসে ঘটে যায় আরেকটি মানবিক ব্যাপার। গর্ভাবস্থার ২৬ সপ্তাহে ভ্রূণের গঠনগত ত্রুটির কারণে গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন পশ্চিমবঙ্গের এক সন্তানসম্ভবা। এসএসকেএম'এর রিপোর্টকে মান্যতা দিয়ে বিচারপতি দীপক মিশ্র এবং বিচারপতি এ এম খানউইলকরের ডিভিশন বেঞ্চ 'স্পেশাল মেডিক্যাল কেস' হিসেবে গর্ভপাতের অনুমতি দেয়। এবার ২০২১'এ আইনসম্মতভাবে গর্ভপাতের সময়সীমা সেই ২০ সপ্তাহ থেকে বেড়ে ২৪ সপ্তাহ হল। তবে তা কিন্তু শারীরিক বা মানসিকভাবে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন অন্তঃসত্ত্বা, ধর্ষিতা এবং নাবালিকাদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। এমনকি অন্তঃসত্ত্বা থাকাকালীন স্বামী মারা গিয়েছেন বা ডিভোর্স হয়েছে- এমন নারীরাও এর অন্তর্ভুক্ত হলেন। ২০২১'এর আইন অনুযায়ী, আবেদনের পাঁচ দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে।

২০২২'এর ২৯ সেপ্টেম্বরে আরও এক ধাপ এগোলো ভারতের আইন। নারীর বৈবাহিক সত্তার সঙ্গে গর্ভপাতের সম্পর্ক আর বিবেচনা করা হল না। নারীর নিজস্ব ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েই গর্ভপাতের ক্ষেত্রে বিবাহিত আর অ-বিবাহিত নারীর পার্থক্যকে অ-স্বীকার করা হল। বলা হল, গর্ভের সন্তানকে জন্ম দেওয়া উচিত হবে কিনা তার সিদ্ধান্ত একমাত্র নেবেন গর্ভধারিণীই। সেই সঙ্গে বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টিও গুরুত্ব পেল। বিবাহের পরেও নিজের অসম্মতিতে কোনও নারী সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়তেই পারেন। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণ সন্তান নেওয়ার মতো মধুর না-ও হতে পারে। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ জানালেন যে, ভারতীয় সাংবিধানিক অধিকারকে মর্যাদা দিয়েই বিবাহিত কিংবা অ-বিবাহিত যে কোনও নারীরই নিজস্ব গর্ভকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা আছে। অর্থাৎ, যে কোনও নারীরই সুস্থ যৌন সম্পর্ক স্থাপনের অধিকারকে অনেকটা গুরুত্ব দেওয়া হল। আর  সম্পর্কের ফলে গর্ভসঞ্চার হলে সেই  বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকারও ভারতীয় নারীর রয়েছে। যৌনসঙ্গী পুরুষটি অসম্মত হলে কিংবা ছেড়ে চলে গেলে সে ক্ষেত্রেও সন্তানসম্ভবা নারী গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নিতেই পারেন। অবশ্য, ভ্রূণের ২৪ সপ্তাহের সেই শর্তটি কিন্তু রইল। 

এই সবের মূলে যে ঘটনাটি ছিল, তা খানিকটা এরকম- ২৩ সপ্তাহের এক  অন্তঃসত্ত্বা নারীকে তার প্রেমিক বিবাহ করতে অস্বীকার করেন। তখন গর্ভপাতের অনুমতি চেয়ে দিল্লি হাইকোর্টের দ্বারস্থ হন সেই বছর পঁচিশের তরুণী। এবার তিনি তাঁর ন্যায্য অধিকার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হন। প্রথমত তিনি অ-বিবাহিত, দ্বিতীয়ত তাঁর প্রেমিক বিবাহে অনিচ্ছুক, সর্বোপরি তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা সন্তান লালনের প্রতিকূল। ২০২২ সালের ২১ জুলাই সেই নারীকে গর্ভপাতের অধিকার দেয় সুপ্রিম কোর্ট। আর এই প্রথমবার গর্ভপাতের  'মেডিক্যাল কেস'এর স্টিরিওটাইপ থেকে বেরিয়ে এল ভারতীয় আইন।

এখন প্রশ্ন হল, আমাদের দেশের কতজন নারী এই গর্ভপাতের অধিকারের খবর রাখেন? মফস্বল এলাকায় অধ্যাপনা করার সূত্রে দেখেছি, অনেক মেধাবী ছাত্রী কলেজে পড়ার সময়েই গর্ভবতী হয়ে পড়ে ও অনেক অসুবিধার মধ্যে তারা আর স্নাতক হয়ে ওঠে না। কিংবা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা পরিবারের নারীরা তো এখনও জানেনই না যে গর্ভপাত ২৪ সপ্তাহ অবধি আইনসম্মতভাবেই করা সম্ভব। ফলত, শিক্ষায় অনগ্রসর এলাকায় কিন্তু গর্ভপাত করাতে আগ্রহী হাতুড়ে ডাক্তারদের বেশ রমরমা। বেশ কয়েক বছর আগে প্রথম সারির কিছু সংবাদপত্রে প্রায় রোজই চোখে পড়ত কিছু ক্লিনিকের বিজ্ঞাপন। অবাঞ্ছিত মাতৃত্ব থেকে তারা নাকি মুক্তি দেয় আর পুরো পদ্ধতিই নাকি নিরাপদ আর গোপন। বলাই বাহুল্য, সেই ক্লিনিকগুলোর সব ক'টি বৈধ নয়, আর নিরাপদ তো নয়ই! তবু সেখানে ভিড় তো যথেষ্টই হত।

বর্তমানে সরকারি সূত্রে যতটা জন্মনিরোধক নিয়ে প্রচারের কথা শোনা যায়, ততটা কি গর্ভপাত বিষয়ে শোনা যায়! কিংবা ভ্রূণ নির্ধারণ যে অনুচিত- এই বিষয়ে যতটা শিক্ষিত মানুষ সরব, ততটা বাক্যব্যয় কি গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে করে? সমাজের তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরা নারীর ধর্ষণের পরে যতটা আওয়াজ তোলেন, তারা কি ধর্ষিতা নারীর গর্ভপাতের অধিকার নিয়ে ততটাই  উদ্বিগ্ন হন! যদি সত্যিই গর্ভপাতের অধিকারের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হত, তাহলে কিন্তু পরিত্যক্ত সদ্যোজাত'র সংখ্যাটিও নিঃসন্দেহে কমত। তাই গর্ভপাতের আইন সংশোধন করাই একমাত্র পন্থা নয়, তার যথাযথ প্রচারও প্রয়োজন। 'সন্ততি'র মতো অনুপম শব্দ তখন আর গর্ভধারিণীর মনে কোনও কালো মেঘ ঘনিয়ে তুলবে না।


No comments:

Post a Comment