Saturday 22 October 2022

মধ্যরাতের জিঘাংসা?

ক্ষতের নিরাময় সরকারেরই হাতে

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


 

এ রাজ্যে দীর্ঘদিন ধরে টেট পরীক্ষায় সফল চাকরি-প্রার্থীদের আন্দোলন চলছে। ওরা অবশ্যই ঘোলা জলে মাছ ধরতে নামেননি। পেটের দায়ে, চাকরির সন্ধানে বা চাকরি পেতে তাঁরা আন্দোলনে নেমেছেন। ওরা এমনকি নির্জলা অনশনও করেছেন। বহু মানুষের সহানুভূতি তাঁদের দিকে। এমনকি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও বলেছেন যে, তিনি প্রকৃত দাবিতে করা আন্দোলনের পাশে আছেন এবং তাঁর সহানুভূতি রয়েছে তাঁদের দিকে। তারপরও দেখি নেমেছে অন্ধকার। পুলিস ওদের বাকরুদ্ধ করতে আসরে নেমেছে লাঠিসোটা  নিয়ে। তবে কী আন্দোলন হচ্ছে ভুল দাবিতে? 

অভিযোগ, রাজ্য পুলিস আন্দোলনরত যুবক-যুবতীদের কার্যত বলপ্রয়োগ করে সরিয়ে দিয়ে আদালতের কাছে নিজেদের শক্তির প্রমাণ দিল। আদালতের প্রশ্ন- পুলিস কি আন্দোলনকারীদের হটাতে পারে না, নাকি এই পুলিস এমনই শক্তিহীন যে ১৪৪ ধারা জারি করেও তা রক্ষার দায় নিতে অক্ষম?

বহু প্রশ্ন এরপরেও। 

প্রশ্ন ১: আদালত কি পুলিসকে বলপ্রয়োগে এমন উসকানি দিতে পারে?

প্রশ্ন ২: কেউ উসকালেই পুলিস ঝাঁপ দেবে নাকি আগুনে? সংবিধান কী বলে? 

প্রশ্ন ৩: যে রাজ্য সরকার দাবি করে, তারা জোর করে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার দমন করতে চায় না, সেই সরকারের অধীনে থেকেও যখন পুলিস অত্যাচার করে, অধিকার রক্ষার আন্দোলন ভেস্তে দিতে ব্যস্ত হয়, তখন সরকার কীভাবে দর্শক আসনে বসে পড়ে নীরবে? প্রশাসন কি তবে একমাত্র আদালতের কাছে দায়বদ্ধ? 

প্রশ্ন আরও আছে। থাক। আসুন, এবার উত্তর খুঁজি।  

উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই আসে রাজ্য সরকার, আদালত ও সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা। 

সম্প্রতি, রাজ্য সরকারের প্রধান দাবি করেছেন যে, তিনি টাটাকে তাড়াননি, তাড়িয়েছে সিপিএম। তাহলে আমরা কী করলাম! তৎকালীন রাজ্য সরকারের দেওয়া পুরস্কার ফেরত থেকে লেখালেখি, মিছিল-পথসভা সব বৃথা! সাধারণ মানুষের প্রতিরোধ? ক্ষমতা পেয়ে আমাদের পরামর্শ মেনে নেত্রী যে সিঙ্গুরের চাষীদের জন্য সভা করলেন বিশিষ্টদের নিয়ে (টাউন হলে), তা মিথ্যা? এর জন্য তাঁকে কেউ কেউ মিথ্যে বলার দায়ে দুষছেন। টাটাকে তাড়ানোর দায় যে পুরো সিপিএমের নয়, অবশ্য পরদিনই তার ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। প্রথমটা যদি বা সংবাদমাধ্যমের কেরামতি (মুখ্যমন্ত্রীর কথার অংশ নিয়ে তারা আলোচনায় মাতে) বলে অগ্রাহ্য করা যায়, পরেরটা (গণতান্ত্রিক আন্দোলন  নিয়ে যা বলেছেন) গ্রহণযোগ্য নয়। পরে তিনি স্পষ্ট প্রমাণ দিলেন যে তিনি যা বলেন আর তার অধীন পুলিস যা করে তা এক নয়। 

খুব উৎসাহ নিয়ে সংবাদমাধ্যম দুর্নীতি বিষয়ে প্রচারে নেমেছে । ঠিকই করেছে। তবে এই সাংবাদিকেরা কেন সেই খবর (পার্থবাবুদের টাকা খাওয়ার খবর, যা নাকি প্রায় সকলেই জানতেন!) আমাদের দিতে পারলেন না আগেভাগে। কিন্তু এসব কথাই তো সব নয়। চাকুরী প্রার্থীদের কথাও বলতে হয়। আমরা এই দাবি বিবেচনা করব নিশ্চয়। একই সাথে বিবেচনা করব আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রের কথাও। তিনি যে চাকুরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতে বাংলার যুবদের 'না' করেছিলেন- কেন ভুলব সে কথা? পুরনো কথা বলে? বেশ, তবে এ কালের বিশিষ্ট লেখক রমাপদ চৌধুরীর কথা শুনি। তিনি তাঁর আত্মকথায় (হারানো খাতা) লিখেছেন যে, চাকরি কম ছিল। এ কথা মানতেই হয় যে, চাকরি নিশ্চয় সবাইকে দিতে পারে না কোনও সরকারই। আর, কেউ টেট পাশ করলেই চাকরি পেতে পারেন না, প্রাথমিক বা অন্য যে কোনও স্তরে। টেট পাশ করার অর্থ একটা যোগ্যতামান অর্জন করা। তবে কেন আন্দোলন?

আসলে, গোলমাল দুটো ভিন্ন জায়গায়:

১) মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি ও 

২) সরকারের সর্বোচ্চ স্তরের দুর্নীতি। 

সমস্যার হাল-হকিকত না বুঝেই মুখ্যমন্ত্রী ২০ হাজার জনের চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসলেন। মুখ্যমন্ত্রীর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আর দলের নাম তৃণমূল- সাধ্যি আছে কার যে মুখ্যমন্ত্রীর কথার বিরুদ্ধতা করেন? ব্রাত্য তো চুনোপুঁটি, রাঘববোয়াল পার্থবাবুরও তেমন সাহস ছিল না। পার্থবাবু হয়তো ভেবেছিলেন, অন্যায় যদি মুখ্যমন্ত্রী করতে পারেন তো তিনিও পারেন। আর যদি সংবাদমাধ্যম সঙ্গে থাকে তবে তো মাভৈঃ। আর পেলেনও সঙ্গে মানিকরতনদের (সরকারি কর্তারাও- সুকান্ত আচার্য থেকে পর্ষদ সভাপতি)। কেবল শিক্ষক পদ নয়, তাঁরা  নাকি বেচেছেন করণিক থেকে উপাচার্য পদও। তাতে যারা আন্দোলন করছেন তাদের কী যায় আসে? মোদ্দা কথা, তাঁরা চাকরি পেলেন না, পেলেন না মেধা তালিকাও। মেধা তালিকা না পাওয়ায় ২০১৪'র প্রার্থীদের বয়স পার হবার পথে। কী করবেন তাঁরা? সরকার তাঁদের বিকল্প কর্মসংস্থানের আয়োজন করতেই পারে। অথবা, তাঁদের বয়সসীমা শিথিল করার জন্য আদালতের কাছেও আবেদন রাখতে পারে। কারণ, তাঁদের বয়সসীমা যদি আজ এসে অতিক্রম করে গিয়ে থাকে, তবে তার জন্য তাঁরা মোটেও দায়ী নন। সরকারের উচ্চস্তরে দুর্নীতি দায়ী। তেমন সুপারিশ করতে পারে প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদও। বিধানসভার বিশেষ অধিবেশন ডেকে আইন পাশ করিয়েও তো একটা ব্যবস্থা করা যায়!

এই প্রসঙ্গে গৌতম পাল (প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের বর্তমান সভাপতি) বলেছেন, সকলের চাকরি হবে। তা যে হবার নয় তা সকলেই বোঝে। অথচ, তিনি বলতে পারেননি কেন ভুল প্রশ্নের জন্য সকলে নম্বর পেল না, জানি না তাঁকে আদালতও কেন কিছু বলেনি। হয়তো বলেছে, আমি তা জানি না। এটা তো সত্য যে চাইলেই তিনি বয়সের ঊর্ধ্বসীমা বদলাতে পারেন না, বাধা রয়েছে অনেক। তিনি যে বলেছেন NCTE- তা ঠিক নয়। মূল বাধা ৪২তম সংবিধান সংশোধনী যার পর শিক্ষা এখন যৌথ তালিকায়। জনতা সরকার সুযোগ পেয়েও তেমন কিছু করেনি। বাম-ডান কেউই কিছু করেনি (কেরালা রাজ্য সরকার অবশ্য এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে ছিল। আর, বর্তমান রাজ্য সরকার তো এই সংশোধনীর প্রধান চরিত্র সিদ্ধার্থ রায়ের বড় সমর্থক)। এর বিরুদ্ধে আন্দোলন অতি জরুরি, কিন্তু বেড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধে কে?

বোঝাই যাচ্ছে, সবটা মিলিয়ে অবস্থা বেগতিক। কিন্তু সরকারের যদি সত্যিই সদিচ্ছা থাকে, তবে তাদের মন্ত্রী ও আমলাদের দুর্নীতির জন্য যে অবস্থা আজ সৃষ্টি হয়েছে, তা অনায়াসেই আন্দোলনকারীদের সঙ্গে একটা রফার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে বের করতে পারে। যে সরকারের শীর্ষকর্তারা নিজেরাই আইন ভেঙ্গে দুর্নীতি করেছে, এখন তাদেরই ব্যতিক্রমী হলেও এমন কোনও আইনসম্মত সিদ্ধান্ত নিতে হবে, যাতে এই ক্ষতের নিরাময় হয়। কাজটা কঠিন কিন্তু সম্ভব।

 

3 comments:

  1. সুন্দর বিশ্লেষণ ভিত্তিক আলোচনা র জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। এমন সজাগ নির্ভিক সাংবাদিকতা আমাদের
    জন সচেতনার পথে বিশেষ ভরসা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. Excellent and appropriate analysis of the entire episode. Our Govt. should take up the issue with full and satisfactory perspective ignoring political angle. Other concerned parties should also cooperate in arriving at solution....may be short term and long lasting basis.
      Debabrata Dasgupta

      Delete
  2. লেখক যা বলেছেন তা যথেষ্ট যৌক্তিক।আর সমাধানের যে সম্ভাব্য পথ বাতলেছেন।আমি পূর্ণ সমর্থন করি।

    ReplyDelete