ধর্মীয় অনুশাসনে দেশ চলবে না
নীলকন্ঠ আচার্য
গত দু' সপ্তাহ ধরে ইরানের রাজধানী সহ প্রায় ৮০টি শহরের রাজপথ ও আকাশ বাতাস হাজার হাজার ইরানি তরুণী ও তরুণদের দীপ্ত প্রতিবাদ বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে উঠেছে। তাদের বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে শ্লোগান উঠেছে, 'জান, জিন্দেগি, আজাদী' (নারী, জীবন, স্বাধীনতা)', 'আমরা সবাই মাহশা', 'ইসলামি শাসন নিপাত যাক', 'স্বৈরাচারের মৃত্যু হোক', 'যারা আমাদের বোন-ভাইকে হত্যা করেছে তাদের আমরা খতম করব' ইত্যাদি।
ঘটনার সূত্রপাত ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২। ইরানের কুর্দিস্তান অঞ্চলের বাসিন্দা ২২ বছরের মেয়ে মাহশা আমিনি তার মা, বাবা ও ভাইয়ের সঙ্গে একটি গাড়িতে যখন তেহরানে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আসছিল তখন সেখানে বিশেষ পুলিশের একটি দল ('নীতি পুলিশ') তাদের পথ আটকায় এবং মাহশা ঠিকমতো হিজাব পরেনি এই অভিযোগে(!) তার মা-বাবার সামনেই তাকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় ও আটক করে। হিজাবে তার চুল নাকি ঠিক মতো ঢাকা ছিল না! তাই দেশের ইসলামি আইন লঙ্ঘনের(!) কারণে পুলিশ তাকে গাড়ির মধ্যেই শারীরিক নির্যাতন চালায় যা তাদের হেফাজতে চূড়ান্ত রূপ নেয়। মাহশা অসুস্হ হয়ে চির অজ্ঞানে নিমজ্জিত হয়। ১৬ সেপ্টেম্বর তার মৃত্যু ঘটে।
এই ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই রাজধানী তেহরান সহ ইরানের বেশ কিছু শহরে তরুণীরা তীব্র বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের সমর্থনে দেশের তরুণরাও বিক্ষোভে অংশ নিতে শুরু করে। বিক্ষোভ ক্রমশ ব্যপক রূপ ধারণ করে। এক সপ্তাহের মধ্যেই তা দাবানলের মতো ইরানের ছোট-বড় প্রায় ৪৫টি শহরে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ ও আধা-সামরিক বাহিনী এই বিক্ষোভের ওপর দমন-পীড়ন নামিয়ে আনলে তা আগুনের মতো আরও প্রসারিত হয়। বহু জায়গায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সরকারি বাহিনীর মুখোমুখি সংঘর্ষ বেঁধে যায়। নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের উপর পুলিশ নির্মমভাবে গুলি চালাতে থাকে। এই প্রতিবেদন লেখার সময়, সংবাদ সূত্র অনুসারে প্রায় ৭৬ জনের পুলিশের গুলিতে মৃত্যু হয়েছে (BBC, Al Jazeera), ১০০ জনের বেশি মানুষ গুরুতর আহত এবং প্রায় ১২০০ বিক্ষোভকারীদের গ্রেফতার করা হয়েছে।
তরুণী ও প্রৌঢ়া সহ শত শত নারীরা মাহশা আমিনির এই হত্যা এবং ইরানের শাসকের মৌলবাদী পুরুষতান্ত্রিক হিজাবনীতির বিরুদ্ধে প্রকাশ্য রাস্তায় এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় গণহারে নিজেদের হিজাব খুলে আগুনে পোড়ানো শুরু করে। এমনকি প্রকাশ্যে নিজেদের চুল কেটে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে। শহরের বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে তাদের কেটে ফেলা লম্বা চুল দিয়ে প্রতিবাদের 'কেশধ্বজা' বানিয়ে তা টাঙ্গিয়ে দেয়। এক অভূতপূর্ব রোষে বৃহৎ তরুণ ও যুবসমাজ পুলিশ বাহিনীর সামনে প্রতিরোধের প্রাচীর গড়ে তোলে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলো একযোগে এই প্রতিবাদী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যোগ দিয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস বয়কট করে চলেছে। আরও তাৎপর্যপূর্ণ হল, শহরের বিভিন্ন স্থানে টাঙানো দেশের প্রধান ধর্মীয় নেতা রোহউল্লা খোমেইনির বড় ছোট সব ধরনের প্রতিকৃতিকে জনতা টেনে ছিঁড়ে নামিয়ে ফেলছে। উল্লেখ্য যে, এই বিক্ষোভ আন্দোলনে ইরানের দু'বারের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হাশেমি রাফসানজানির মেয়েও সামিল হয় এবং বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে আটক। বিখ্যাত ইরানি ফুটবলার আলি করিমিও এই আন্দোলনকে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন। বেশ কিছু জায়গায় এই উত্তাল গণরোষের সামনে সুরক্ষা কর্মীদের পালিয়ে যেতে দেখা গেছে। ইরানের বিচার বিভাগের প্রধান দফতর থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা রক্ষীরা ক্লান্ত। তারা নাকি কয়েকদিন ধরে ঠিকমতো শুতে যেতে বা বিশ্রাম নিতে পারছে না। অর্থাৎ, এই বিক্ষোভ আন্দোলন ক্রমশ যেন বিশেষ মাত্রা অর্জন করে চলেছে।
ইতিমধ্যে প্রতিবেশী দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ায় এই আন্দোলনের সমর্থনে বিক্ষোভ গড়ে উঠেছে। পাশাপাশি, গ্রিস, ফ্রান্স, ইতালি, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা প্রভৃতি দেশে বসবাসকারী ইরানি জনতাও এই আন্দোলনের সমর্থনে সেইসব দেশের ইরানি দূতাবাসগুলোর সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। এদিকে ইরানের পশ্চিম সীমান্তে ইরাকী ভূখণ্ডে অবস্থিত কুর্দিস্তান অটোনমাস রিজিওন নামের একটি স্বশাসিত অঞ্চলে গত পাঁচ দিন ধরে ইরানি সামরিক বাহিনীর পক্ষ থেকে কামানের গোলা বর্ষণ, ড্রোন ও মিসাইল আক্রমণ শুরু করা হয়েছে যা পরিস্থিতিকে হয়তো আরও জটিল করে তুলতে পারে।
ইরানে মহিলাদের উপর এই বাধ্যতামূলক হিজাব আইন ঘোষিত হয় ১৯৭৯ সালের মার্চে ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লা খোমেইনির নেতৃত্বে ইসলামী বিপ্লব সম্পন্ন হওয়ার পর। এর বিরুদ্ধে ওই সময় সঙ্গে সঙ্গেই হাজার হাজার মহিলারা বিক্ষোভ আন্দোলন গড়ে তোলেন। একই সময়ে পুরুষদের জন্য বহুবিবাহ প্রথার আইনও লাগু করা হয়। তারপর থেকে এ পর্যন্ত বেশ কয়েকবার হিজাব বিরোধী এবং নারীদের সমান অধিকারের দাবিতে বড় বড় প্রতিবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ২০০৬ ও ২০১৪ সালের আন্দোলনগুলো ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়াও, প্রতি বছর ১২ জুলাই সরকারি হিজাব দিবস পালনের সময় ইরানের সাহসী নারীরা বিভিন্ন স্থানে হিজাব খুলে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে থাকেন। এই অপরাধে(!) বহু নারী পুলিশী নির্যাতনের শিকার হয়ে আসছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, কয়েক মাস আগে ভারতের বেঙ্গালুরুর স্কুলে হিজাব পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। অর্থাৎ, মুসলমান স্কুল ছাত্রীদের হিজাব না পরার জন্য বাধ্য করা হয়। কর্নাটক হাইকোর্টও স্কুল প্রশাসনের পক্ষেই রায় দেয়। এর বিরুদ্ধে মুসলমান স্কুল ছাত্রীরা দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ করে। বিষয়টি এখন সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন।
হিজাব প্রশ্নে ভারত ও ইরানের ঘটনাক্রম আপাতভাবে বিপরীত মনে হলেও বিষয়টি কিন্তু একই। অর্থাৎ, দুটি ক্ষেত্রেই সরকার, শাসক বা কর্তৃপক্ষ মেয়েদের ব্যক্তিগত জীবনের স্বাধীনতার উপর বলপূর্বক নিয়ম চাপিয়ে দিচ্ছে যা নারীদের নিজস্ব পছন্দের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে। দুই ক্ষেত্রেই ধর্মীয় মৌলবাদী কর্তৃত্ব পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যকে বজায় রাখতে চায়। তাই, নারীর অস্তিত্ব, জীবন এবং স্বাধীনতা অর্জনের যে মৌলিক দাবি আদায়ের পথে ইরানি নারীরা আজ যেভাবে নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে নৃশংস মৌলবাদী শাসক শক্তির চোখে চোখ রেখে, ইরানের শুধু নয়, সারা দুনিয়ার অর্ধেক আকাশের ন্যায্য অধিকার ছিনিয়ে আনতে চলেছে, তাকে সহস্র কুর্নিশ জানাই।
অসাধারণ সুন্দর পরিশ্রমলব্ধ বিশ্লেষণ লেখা একেবারে মগজে কামারের ঘা মারা। এই পৃথিবী থেকে সমস্ত রকমের মৌলবাদ নিপাত যাক। যুক্তির বিজ্ঞানের মানুষেরা শুভ বুদ্ধির জয় হোক।।
ReplyDelete