ভারতীয় অর্থনীতি কি বিপর্যয়ের মুখে?
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
দু’ কথা লিখতে বসতেই হল! আজ এক শূন্যগর্ভ বাজেট পেশ হয়েছে আর গতকাল আদানি
সাম্রাজ্যকে বাঁচাতে আদানি এন্টারপ্রাইজের ফলো-অন পাবলিক অফারের (এফপিও) ২০,০০০ কোটি
টাকা আদানির ঘরে তুলে দেওয়া গেছে। তার আগের দিন যেখানে মাত্র ৩ শতাংশ এফপিও
সাবস্ক্রাইবড হয়েছিল, তা কোন যাদুবলে জানি গতকাল শেষ দিনে বাকী ৯৭ শতাংশ বিক্রি
হয়ে কোটা পূরণ করে ফেলল। যদিও খুচরো বিনিয়োগকারীদের বৃহদাংশ এই অফার থেকে দূরে ছিল,
কিন্তু কিছু ব্যবসায়ী বন্ধুর বদান্যতায় আদানির মুখরক্ষা পেল। মূলত, আবু ধাবি’র
ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং কোম্পানির তাহনুন-বিন-জায়েদ-অল-নাহহিন এবং এ দেশের সজ্জন
জিন্দাল, সুনীল মিত্তল, মুকেশ আম্বানি’দের (যাদের শেয়ার বাজারে আল্ট্রা হাই
নেট-ওয়ার্থ ইনডিভিজ্যুয়ালস (UHNI) বলা হয়) পারিবারিক ব্যবসা
থেকে অর্থের সংস্থান করে তবে এ যাত্রায় আপাতত স্বস্তি পেলেন গৌতম আদানি। এই
মিলন-উদ্ধারের পেছনে যে এক রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই আশঙ্কা
প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু বিপদ কি দূর হল?
সবচেয়ে বড় বিপদ ভারতীয় অর্থনীতির। দেশের দুই বড় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এলআইসি ও স্টেট ব্যাঙ্কের বিপুল শেয়ার আদানির কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা আছে এবং স্টেট ব্যাঙ্ক থেকে আদানির ঋণের পরিমাণও কম নয়। প্রবল আশঙ্কা এই যে, হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’এর রিপোর্ট আসার পর ডুবতে থাকা আদানির সাম্রাজ্য যদি এইবার ভেঙ্গে পড়ে তাহলে এই দুই রাষ্ট্রীয় সংস্থা সহ আরও বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান প্রায় দেউলিয়া হয়ে যেতে পারে। এই পরিপ্রেক্ষিতে তাই সকলের নজর ছিল আদানি এন্টারপ্রাইজের এফপিও’র গতিবিধির উপর। যেভাবেই হোক, এফপিও’কে উতরে দেওয়া গেছে। তাই, কেউ কেউ ভেবেছিলেন, বাজেটের হৈ-হট্টগোলে আদানির বিরুদ্ধে জালিয়াতির অভিযোগ এবার ধামাচাপা পড়ে যাবে আর শেয়ার বাজারেও চাঙ্গা ভাব ফিরে আসবে। কিন্তু তা একেবারেই হয়নি। বিতর্কিত আদানি এন্টারপ্রাইজের শেয়ার আজ সারাদিন (১ ফেব্রুয়ারি) হুড়হুড় করে নামতে থেকেছে (২৬ শতাংশ পতন) যা নিচের চিত্র থেকে আরও পরিষ্কার ভাবে বোঝা যাবে:
শুধু আদানি এন্টারপ্রাইজ নয়, আদানি গোষ্ঠীর অন্যান্য শেয়ারের মূল্যও আজ বিপুলভাবে পড়েছে এবং নিফটি রেড অ্যালার্ট দিয়ে বাজার বন্ধ করেছে। উল্লেখ্য, আজ আদানি পাওয়ার ও আদানি উইলমার উভয়েরই শেয়ারের দামে ৫ শতাংশ পতন হয়েছে এবং আদানি টোটাল গ্যাস, আদানি ট্রান্সমিশন ও আদানি গ্রিন এনার্জি’র পতন যথাক্রমে ১০, ৩ ও ৫.৭ শতাংশ। ইতিমধ্যে আবার আজই আন্তর্জাতিক ‘ক্রেডিট স্যুইস’ ব্যাঙ্ক ঋণদানের ক্ষেত্রে আদানির বন্ডকে বাতিল করেছে। অর্থাৎ, এই ব্যাঙ্ক কাউকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে আদানির বন্ডগুলিকে মর্টগেজ হিসেবে আর গ্রহণ করবে না। অস্যার্থ, আদানির বন্ডের মূল্য দাঁড়াল শূন্য। নিঃসন্দেহে এই ঘটনা বিশ্বের আর্থিক বাজারে আদানিকে একঘরে করে দেবে। বলা যেতেই পারে, আদানির বাণিজ্য সাম্রাজ্যের পতন পর্ব শুরু হয়েছে। আজ দিনের শেষে আদানি কোম্পানির গত কয়েকদিন মিলিয়ে মোট ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৬ বিলিয়ন ডলারে। ফোর্বস’এর ধনী তালিকায় আদানি আজ নেমে এসেছে ১৫ নং স্থানে, যেখানে অম্বানির স্থান এখন নবম। ফলাফলে, ভারতের মার্কেট ক্যাপ (মার্কেট ক্যাপিটালাইজেশন) নেমে গেছে ৩.২ ট্রিলিয়ন ডলারে। ফ্রান্সের থেকে পিছিয়ে পড়ে ভারত এখন মার্কেট ক্যাপের বিচারে ষষ্ঠ স্থানে নেমে এসেছে; দুদিন আগেও প্রথম পাঁচে রয়েছে বলে মোদি সরকার বুক ফুলিয়ে ঘোষণা দিয়েছিল।
মাত্র সাতজনের একটি ছোট্ট কোম্পানি ‘হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ’ কী এমন বোমা ফাটালো যে আদানির সাম্রাজ্য আজ টলোমলো? আর সে ব্যাপারে শেয়ার বাজারের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি ও কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রক এখনও মুখে কুলুপ এঁটে রেখেছে কেন? তাহলে কি সত্যিই ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়?’
হিন্ডেনবার্গের প্রধান ও মূল অভিযোগ হল, আদানি গোষ্ঠী তার শেয়ারের দরকে অন্যায়
ভাবে ও তঞ্চকতা করে বাড়িয়ে রেখেছে। আর সেই বাড়তি শেয়ারের মূল্যের অজুহাতে তারা
ব্যাঙ্ক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে এবং শেয়ার বাজারে ফাটকা খেলেছে।
স্টেট ব্যাঙ্কের প্রচুর টাকা এইভাবে আদানি গোষ্ঠীর কাছে ঋণ মারফত জমা হয়ে রয়েছে।
প্রশ্ন উঠবে, কীভাবে শেয়ারের এই মূল্যস্ফীতি করা হল? দু’ বছর ধরে প্রভূত তথ্য
সংগ্রহ ও গবেষণা করে হিন্ডেনবার্গ এই রহস্য উন্মোচন করেছে। তারা দেখাচ্ছে, প্রমোটার
হিসেবে আদানি গোষ্ঠী একেকটা কোম্পানিতে ৭০ থেকে ৭৩ শতাংশ মতো শেয়ার নিজেরা কিনে
রেখেছে (প্রমোটার ৭৫ শতাংশের বেশি হোল্ড করতে পারে না) আর বাকী ১৫ শতাংশ শেয়ার
এসেছে মরিশাস, কেম্যান দ্বীপের মতো জায়গাগুলি থেকে শেল কোম্পানি মারফত। এইগুলি
আদানিরই বেনামী কোম্পানি। আর এই কাজে আদানিকে সহায়তা করেছে তাঁর ভাই বিনোদ আদানি ও
এক নিকটাত্মীয় রাজেশ আদানি। অর্থাৎ, একেকটা কোম্পানিতে আইনি-বেআইনি জুড়ে আদানির
শেয়ারের পরিমাণ আদতে দাঁড়াচ্ছে ৯০ শতাংশের আশেপাশে। ফ্লোটিং শেয়ার হিসেবে
অন্যান্যদের কাছে থাকছে মাত্র ১০ শতাংশ মতো। যখন শেয়ারের দাম বাজারের নিয়মে পড়তে
থাকে তখন আদানিরা (প্রায় ৯০ শতাংশ অংশীদারি থাকায়) এই শেয়ারগুলিকে ধরে রেখে দেয়।
অন্যান্য ফ্লোটিং শেয়ার-হোল্ডাররা নিজেদের কাছে গচ্ছিত শেয়ার বিক্রি করলেও তা
যেহেতু ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ মাত্র, তাই শেয়ার বাজারে তার কোনও প্রভাব পড়ে না। ফলে,
আদানির শেয়ারের মূল্য সবসময়েই স্ফীত থাকে; এই ‘ফোলানো মূল্য’ দেখিয়েই আদানি গোষ্ঠী
বাজার ও রাষ্ট্রীয় সংস্থা থেকে প্রভূত পরিমাণে ঋণ সংগ্রহ করে। আর সেই অর্থ দিয়ে
একের পর এক কিনতে থাকে এয়ারপোর্ট থেকে বন্দর, খনি থেকে জঙ্গল, হাইওয়ে থেকে পাহাড়। প্রশ্ন,
অর্থের এক বড় অংশ কি চলে যায় ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’এর মাধ্যমে বিশেষ একটি রাজনৈতিক
দলের কাছে, যাদের বদান্যতায় নির্বিঘ্নে ও বেপরোয়া উপায়ে এই কর্মগুচ্ছ চলতেই থাকে? তাহলে
কি এইভাবেই অর্থ ও রাষ্ট্রের জোরে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দল ও অর্থনৈতিক গোষ্ঠী পরস্পর
সমৃদ্ধ হতে থাকে? স্বৈরাচারের উৎসভূমি?
এছাড়া আরও বহু অভিযোগ হিন্ডেনবার্গ’এর তরফে তোলা হয়েছে। গত তিন বছরে আদানির সাতটি কোম্পানির সম্পদের পরিমাণ গড়ে ৮২০ শতাংশ বেড়েছে। মোট ৮৮টি প্রশ্ন আদানি গোষ্ঠীর কাছে হিন্ডেনবার্গের তরফে রাখা হয়েছে যার কোনও উত্তর এখনও পাওয়া যায়নি। ‘মিথ্যাচার’, ‘ভারতের ওপর হামলা’, ‘মামলা করব’, ’৩১ জানুয়ারির পর দেখে নেব’- এইসব বড় বড় বুলি আউড়ে আদানি আপাতত শেয়ার বাজারে নিজেদের রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। মামলা করার হুমকিকে হিন্ডেনবার্গ সাধুবাদ জানিয়েছে এবং আমেরিকার আদালতে যেন মামলাটি হয় সেই দাবি রেখেছে; কারণ, সে ক্ষেত্রে আদালত আদানিকে বাধ্য করতে পারবে অভিযোগ সম্পর্কিত সমস্ত নথি জমা করতে। একইসঙ্গে নানান কুনাট্যও শুরু হয়েছে। হিন্ডেনবার্গের অভিযোগ সমূহকে আদানি’র মুখপাত্র জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড-তুল্য একটি আক্রমণ বলে অভিহিত করেছেন। এই তুলনাটি ভয়ানক। ইংরেজ শাসকের হুকুমে জালিয়ানওয়ালাবাগে গুলি চালিয়েছিল যে ভারতীয় সেনারা, তাদের সঙ্গে তিনি খুচরো বিনিয়োগকারীদের তুলনা টেনেছেন; এই অর্থে যে, বিদেশি একটি সংস্থার অভিযোগকে মান্য করে একইভাবে খুচরো বিনিয়োগকারীরা আদানির শেয়ার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
বলাই বাহুল্য, ভারতীয় অর্থনীতি আজ ভয়ঙ্কর এক বিপদের মুখে। সাধারণ মানুষের লক্ষ কোটি টাকা হস্তগত করে রেখেছে এক কর্পোরেট গোষ্ঠী, যারা এখন খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে। মৌন থেকে কেন্দ্রীয় সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা সেবি তাদের পরোক্ষে মদত দিচ্ছে। ভাবছে, সময় পেরিয়ে গেলে সব আবার আগের মতোই হয়ে যাবে। অবিলম্বে আওয়াজ উঠুক, সেবিকে তদন্ত করে সমস্ত জালিয়াতির পর্দা ফাঁস করতে হবে।
No comments:
Post a Comment