Monday, 13 February 2023

আদালত ও শিক্ষাক্ষেত্র

মাইলফলক না মরীচিকা!

সোমনাথ গুহ

 



ফেব্রুয়ারির ৯ তারিখ কলকাতা হাই কোর্ট এক উল্লেখযোগ্য রায়ে স্কুল সার্ভিস কমিশনকে নিয়ম বহির্ভূত ভাবে নিয়োগ হওয়া ২৮১৯ জন গ্রুপ-ডি শিক্ষাকর্মীর চাকরি বাতিল করার  নির্দেশ দেয়। এঁদের প্রত্যেকের উত্তরপত্র ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও এঁরা নিয়োগের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯১১ জন নিয়োগের সুপারিশপত্রও পেয়ে গিয়েছিলেন, আদালতের নির্দেশের ফলে তা বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া, ৮০০ জন শিক্ষক যাঁরা অবৈধ ভাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন, তাঁদের চাকরি বাতিল করার কথাও ঘোষণা করেছে এসএসসি। অভূতপূর্ব ভাবে আদালত এঁদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। এঁরা এতদিন যে বেতন পেয়েছেন তা ফেরত দিতে হবে এবং ভবিষ্যতে আদালতের অনুমতি ছাড়া এঁরা কোনও সরকারি চাকরি পাবেন না।  

এই রায় কি ভবিষ্যতে যুগান্তকারী হিসাবে গণ্য হবে? এই রায় কি শিক্ষক নিয়োগের হিমালয়সম দুর্নীতির ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক? শিক্ষাক্ষেত্রে আর কত নীচে নামবে পশ্চিমবাংলা? 

সম্প্রতি এক চাঞ্চল্যকর রিপোর্টে জানা যাচ্ছে যে, এই বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা চার লক্ষ হ্রাস পেয়েছে (চার লক্ষ! ভাবা যায়?)! গতবারের পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল ১০.৯৮ লক্ষ, এবারে ৬.৯৮! এর ফলে নবান্ন নাকি নড়েচড়ে বসেছে। স্কুল শিক্ষা দফতর গুঁতো খেয়ে ময়দানে অবতীর্ণ হয়েছে এবং মনে হয়েছিল সেই করোনা অতিমারিকেই তারা এর জন্য দায়ী করবে। কিন্তু না, তারা নিজেরাই এতদিনে উপলব্ধি করেছে যে ছাত্র/শিক্ষক অনুপাত নাকি লজ্জাজনক ভাবে কম। শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী যা হওয়া উচিত ৩০:১, সেটা বাংলার গ্রামাঞ্চলে হয়ে দাঁড়িয়েছে ৭০:১! মাননীয়দের বোধোদয় হয়েছে যে সরকারের বদলি নীতির ফলে গ্রামে নিযুক্ত শিক্ষকরা রাজনৈতিক দাদাদের ধরে, নিন্দুকেরা বলে ঘুস দিয়ে, বাড়ির কাছে স্কুলে চলে যাচ্ছেন। ফলে, গ্রামে শিক্ষকের বিপুল ঘাটতি। বহু স্কুলে অঙ্ক, বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। নিয়মিত ক্লাস হয় না। ছাত্র-ছাত্রীরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। স্কুল ছেড়ে দিয়েছে। 

শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটাই একটা প্রহসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুর্নীতি সর্বব্যাপী এবং এতই গভীর যে এর তল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এটা আজ থেকে শুরু হয়নি, বহু বছর ধরেই চলছে। আগে ছিল লুকোছাপা, এখন ন্যাক্করজনক ভাবে প্রকাশ্য। বাম আমলেও দুর্নীতি হয়েছে। ২০০৬ সালে এনসিটিই (ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ টিচার্স এডুকেশন) শিক্ষক প্রশিক্ষণরতদের ট্রেনিং বাতিল করে। ব্যাঙের ছাতার মতো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য যে কলেজগুলিকে অনুমোদন দেওয়া হচ্ছিল তাও এনসিটিই বাতিল করে দেয়। তারা যুক্তি দেয় যে প্রশিক্ষণের ন্যূনতম যোগ্যতামান না মেনেই প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। তখন প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের দায়িত্বে ছিল ডিপিএসসি (ডিস্ট্রিক্ট প্রাইমারি স্কুল কাউন্সিল)। বলার অপেক্ষা রাখে না যে এগুলো বাম সমর্থকদের ঘাঁটি ছিল। ২০১১'এ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পরে তারা তাদের নিজেদের নিয়োগ পদ্ধতি চালু করল- শুরু হল টেট (টিচার্স এলিজিবিলিটি টেস্ট)। ২০১২ সালে প্রথম টেট পরীক্ষা থেকেই দুর্নীতি চরমে উঠল। মোট পরীক্ষার্থী ছিল ৫৫ লক্ষ, পাশের হার ০.৩ শতাংশের কাছাকাছি। পুরো পদ্ধতি নিয়ে ছিল বিস্তর অভিযোগ। এনসিটিই'র স্ট্যান্ডার্ড প্রশ্নপত্রের সাথে টেটের প্রশ্নপত্রের কোনও সঙ্গতি ছিল না। এছাড়াও ছিল আরও নানা অভিযোগ, যেমন ওএমআর (অপ্টিমাল মার্ক রেকগনিশন) শিট ও মেধা তালিকায় হেরফের করা, টাকা নিয়ে নিয়োগ করা এবং অবশ্যই স্বজনপোষণ। এক তৃণমূল বিধায়কের পরিবার ও স্বজন মিলিয়ে মোট ১৩ জন চাকরি পেয়েছিলেন। 

এরই মধ্যে শিক্ষকতার জন্য বিএড বা ডিএলএড পাশ করা বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হল। এই কোর্সগুলি করার জন্য রাজ্য জুড়ে প্রায় ৬৫০ কলেজ গজিয়ে উঠল। এদের মোট আসন সংখ্যা ৪৫৭০০, যার মধ্যে সরকারি মাত্র ৩৭০০। নজিরবিহীন ভাবে শিক্ষার বেসরকারিকরণ শুরু হল। এসব বেসরকারি কলেজগুলিতে ভর্তি হওয়ার জন্য লক্ষ লক্ষ টাকা লাগে কিন্তু তারপরেও চাকরির কোনও নিশ্চয়তা থাকে না। বহু ছেলেমেয়ে এই কোর্সগুলি করেও চাকরির জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকে। এই পরিস্থিতিতে দালালদের হয় পোয়াবারো। নিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতছানিতে অনেকেই এদের খপ্পরে পড়ে। নেতা, মন্ত্রী, আমলা, রাজনৈতিক দাদা, চুনোপুঁটি, দালাল সহ বহু স্তরে দুর্নীতি বিবিধ রূপে অভাবনীয় রূপে ছড়িয়ে পড়ে। 

২০১৫ সালে দ্বিতীয় টেট পরীক্ষা নেওয়ার আয়োজন হয়। বিএড, ডিএলএড পাস করা ছাত্রছাত্রীরা আবেদন করে। কিন্তু এনসিটিই'র নিয়ম অনুযায়ী শিক্ষকতার চাকরির জন্য এই কোর্সগুলি পাস করা বাধ্যতামূলক হওয়া সত্ত্বেও শাসক দল বহু প্রশিক্ষণহীন ছেলেমেয়েকে টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার ফর্ম ভরতে দেয়। এর ফলে এক অরাজকতা সৃষ্টি হয়। রাজ্য সরকার এনসিটিই'কে শিক্ষক নিয়োগের নিয়ম শিথিল করার জন্য অনুরোধ করে। অবশেষে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীন উভয়কে নিয়েই পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত হয়। শুরুতেই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে যায়। পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী ২০১৭ সালে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়। বিস্তর অভিযোগ উঠতে শুরু করে। প্রচুর টাকাপয়সা লেনদেন হয়, অভিযোগ ১০-১২ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি দেওয়া হয়। এছাড়া সংরক্ষিত আসনে অসংরক্ষিত প্রার্থী নিয়োগ, কাউন্সেলিং'এ পক্ষপাতিত্ব ও ভুরিভুরি অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ঠিক কত শিক্ষক যে এই টেট পরীক্ষার পর নিয়োগ হয়েছে তা আজও পরিষ্কার নয়। 

টেট পরীক্ষা ছাড়াও এসএসসি'র বিভিন্ন স্তরের পরীক্ষায় লাগামছাড়া দুর্নীতি হয়েছে। ২০১৯'এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এসএসসি'তে দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর অভিযোগ প্রকাশ্যে আসে। প্রাক্তন মন্ত্রী পরেশ অধিকারী যিনি ঐ সময় তৃণমূলে যোগ দেন, তাঁর মেয়ে অঙ্কিতা অধিকারী র‍্যাঙ্ক জাম্প করে ওয়েটিং লিস্টের ওপরে উঠে আসেন এবং চাকরিতে নিযুক্ত হন। নানা গড়মিলের এরকম ভুরিভুরি নিদর্শন দেখানো যায়। এগুলো ঘটেছে বিভিন্ন ক্লাসের শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এমনকি নার্স নিয়োগের ক্ষেত্রে। 

২০১৬ থেকে বঞ্চিত প্রার্থীরা নানা ভাবে এই চরম অরাজকতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেন। ২০১৯'এর লোকসভা ভোটের আগে প্রায় ৪৫০ জন পরীক্ষার্থী নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘এসএসসি যুব ছাত্র অধিকার মঞ্চ’ গঠন করেন এবং ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে প্রেস ক্লাবের সামনে আমরণ অনশনে বসেন। অনশন ২৯ দিন চলে। অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন, কিন্তু সুস্থ হয়েই আবার ধর্ণামঞ্চে ফিরে আসেন। সরকার নানা ভাবে আন্দোলন ভাঙ্গার চেষ্টা করে। জলের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়, চোরাগোপ্তা হুমকি দেয়, কিন্তু আন্দোলনকারীরা অনড় থাকেন। অবশেষে মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচনের পরে তাঁদের সমস্যা সমাধান করার আশ্বাস দেওয়ার পরে তাঁরা অনশন তুলে নেন। এরপরে বহু নির্বাচন আসে যায় কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর আশ্বাস ফাঁপা প্রতিপন্ন হয়। সমস্যার কোনও সুরাহা হয় না। অবশেষে আদালত ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। তারা সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেয়, সিট (স্পেশ্যাল ইনভেস্টিগেশন টিম) গঠন করে। এদের তদন্ত অনুযায়ী, শিক্ষক নিয়োগের সর্বস্তরে বিপুল দুর্নীতি হয়েছে। নিয়মবহির্ভূত ভাবে ২১০০০ শিক্ষক নিয়োগ হয়েছে। সিবিআই আরও জানায়, যদিও র‍্যাঙ্ক জাম্প করা দিয়ে তাঁদের তদন্ত শুরু হয়েছিল, পরে তারা নিয়োগ প্রক্রিয়ার সর্বস্তরে গোলমাল খুঁজে পায়। মেধা তালিকা, ওয়েটিং লিস্ট, ওএমআর শিটে পরিবর্তন, সব কিছুতেই সীমাহীন গণ্ডগোল। 

আজ রাজ্যে শিক্ষাব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। যেখানেই হাত দেওয়া হচ্ছে, কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উপচে পড়ছে। করোনার অতিমারির কারণে সারা দেশ জুড়ে শিক্ষার বিপুল ক্ষতি হয়েছে। দীর্ঘ দিন স্কুল বন্ধ থাকার কারণে বহু ছাত্রছাত্রী পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে স্কুল খোলা নিয়ে বেশ কিছু দিন টালবাহানা চলে যার ফলে সমস্যা আরও প্রকট হয়। বহু স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১২ সালে রাজ্যে প্রাথমিক স্কুল ছিল ৭৪৭১৭, ২০২২'এ যা কমে দাঁড়িয়েছে ৬৭৬৯৯'এ। ভুয়ো শিক্ষক নিয়োগের ফলে শিক্ষার মান অত্যন্ত নিম্নমানের। অ্যানুয়্যাল স্টেটাস অফ এডুকেশন রিপোর্ট ২০২২ অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৪০ শতাংশ ক্লাস থ্রি'র ছাত্র ক্লাস টু'এর বই পড়তে পারত, সেটা ২০২১'এ ২৯.৩ শতাংশে নেমে গেছে। এছাড়া দেখা গেছে, এই রাজ্যে ৭৩.৯ শতাংশ ছাত্রছাত্রী প্রাইভেট টিউশন নিয়ে থাকে, যা দেশে সর্বোচ্চ। এর থেকে বোঝা যায় বিদ্যালয়ের পড়াশোনার মান কতটা নিম্নমানের। 

এরই মধ্যে ২০২২'এর টেটের ফল বেরিয়ে গেছে কিন্তু সেখানেও নিয়োগ নিয়ে সংশয়। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন, কোনও দালাল বা দুষ্টচক্রের ফাঁদে যদি কেউ পা দেন তাহলে তিনিও সমান ভাবে অপরাধী। প্রশ্ন হচ্ছে, এখন অবধি যত দুষ্টচক্রের সন্ধান পাওয়া গেছে তারা সবাই শাসক দলের সঙ্গে জড়িত। সফল প্রার্থীদের জ্ঞান বিতরণ না করে তিনি নিজের দলকে শোধরালে ছাত্রছাত্রীরা উপকৃত হয়। আদালতের রায়ের ফলে শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষকদের শূন্যপদ সৃষ্টি হয়েছে। আদালত অবিলম্বে কাউন্সেলিং করে এই সব পদ যোগ্য প্রার্থীদের দিয়ে পূরণ করার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি হল, যাঁদের আন্দোলন ৭০০ দিন পূরণ করল, যাঁরা যোগ্য প্রার্থী, তাঁরা কি অবশেষে চাকরি পাবেন? অন্যত্র উচ্চ প্রাথমিক ও শিক্ষাকর্মী যাঁরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করছেন তাঁরাও কি চাকরি পাবেন? আদালতের এই রায় কি সত্যিই একটা মাইলফলক হিসাবে চিহ্নিত হবে, নাকি এটাও হবে একটা মরীচিকা? 

সর্বশেষ খবর, যে ১৯১১ জনের নিয়োগপত্র আদালত বাতিল করেছে, তাঁরা হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চের কাছে আপিল জানিয়েছেন। এরপর কি তাঁরা সুপ্রিম কোর্টে যাবেন? এইভাবেই কি বয়ে যাবে সময়? যোগ্য প্রার্থীরা রাস্তাতেই আজীবন থেকে যাবেন?


2 comments:

  1. সোমনাথ গুহ যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলো এখানে হাজির করেছেন তার প্রাসঙ্গিকতা আর তাৎপর্য্য এক সুদূরপ্রসারী পথ আর উত্তরের পরিক্রমা।.আমি এই লেখাটির.অন্তর্নিহিত বক্তব্যকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করি।লেখককে তাই জানাই অভিনন্দন।

    ReplyDelete
  2. নিঃসন্দেহে সমসাময়িক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভয় হচ্ছে, এরপর এই schools গুলো তে
    ছাত্রছাত্রী থাকবে তো?
    আরেকটা চিন্তা, শিক্ষকতার মান নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই কোথাও।

    ReplyDelete