Saturday, 11 February 2023

ওদের ০.০১ শতাংশ আপনার ১০০

শাক দিয়ে মাছ ঢাকা

মালবিকা মিত্র


যে বছর জেলে এলাম

একটা পেন্সিল ছিল

লিখে লিখে খুইয়ে ফেলতে এক সপ্তাহ লাগেনি। 

পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে সে বলবে

'একটা গোটা জীবন।'

আমি বলব:

'এমন আর কী, একটা সপ্তাহ।'

- কিছুই নয়, অণুমাত্র কাল (নাজিম হিকমত)।


আসল কথা হল, কে কোন অবস্থান থেকে দেখছি। ডাক্তারবাবু প্রবল গর্বে ও দর্পে বলতেই পারেন, 'আপনি সামান্য একটা বাচ্চার মৃত্যুর কারণে আমাকে দুষছেন! জানেন, কত হাজার হাজার শিশু আমার কাছে জীবন ফিরে পেয়েছে!' ডাক্তার শতাংশ হিসাবে ব্যস্ত। সন্তানহারা মায়ের কাছে তো একটায় একটা, একশো শতাংশ। 

প্রেমাংশু চৌধুরী কেন্দ্রীয় অর্থ সচিব টি ভি সোমনাথনের সাক্ষাৎকার নিলেন (আবাপ/ ৪ ফেব্রু ২০২৩)। বিষয়: শেয়ার বাজারে আদানি গ্রুপের উল্লেখযোগ্য পতন। এর ফলে ব্যাঙ্ক বা বীমা কোম্পানির লোকসানের সম্ভাবনা আছে কিনা। অর্থ সচিবের উত্তর, 'যে বেসরকারি সংস্থাটি এই সপ্তাহে খবরে রয়েছে, সেই সংস্থায় এলআইসি, স্টেট ব্যাঙ্কের এক শতাংশেরও কম অর্থ আটকে রয়েছে। ফলে, সঞ্চয়কারীদের অর্থের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুশ্চিন্তার দরকার নেই। সামগ্রিক অর্থনীতির দিক থেকেও চিন্তার কারণ নেই।'

অর্থ সচিবের কথায় এটা স্বীকৃত যে, 

১) এলআইসি ও স্টেট ব্যাঙ্কের অর্থ আদানি গোষ্ঠীর হাতে আটকে গেছে; 

২) রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বীমা কোম্পানিতে আমরা মধ্যবিত্তরা অর্থ আমানত করি বেশি লাভের উদ্দেশ্যে নয়, বরং কম লাভ ও অধিক নিরাপত্তার আশায়। আমরা রেসের মাঠে, বেটিং চক্রে বা স্পেকুলেশন নির্ভর শেয়ার বাজারে দৌড়ই না। সরকারি নীতির ফলে আমার আমানত শেয়ার বাজারে লগ্নি হয়েছে; 

৩) আমার ভয় সত্য হয়েছে। শেয়ার বাজারের ওঠা নামায় আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরোক্ষে আমাকে নামানো হয়েছে;

৪) আদানি গ্রুপের শেয়ার কিনব নাকি ইনফোসিসের, সে ক্ষেত্রে আমার মতামত নেওয়া হয়নি;

৫) আদানির বাড়বাড়ন্ত দেখে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা লগ্নি করল, তারপর অকস্মাৎ পতন। মিথ্যা বেলুনে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে কে বা কারা দেখাল? স্ট্যানলি মর্গান, লেম্যান ব্রাদার্স, মেরিল লিঞ্চ এরাও তো এভাবেই মিথ্যার ফানুস ফুলিয়ে রাতারাতি ফানুস ফুটো করেছিল দুই দশক আগে। এসবই পরোক্ষ ভাবে মেনে নিয়েছেন অর্থ সচিব। 

এবার উঠে এল অন্য প্রশ্ন। শতাংশের পরিসংখ্যান:

১) সম্রাট আকবরের সময় মুঘল মনসবদারদের মধ্যে রাজপুতের অংশ ছিল ২২ শতাংশ, ঔরঙ্গজেবের সময় এটা কমে দাঁড়িয়েছিল ১৬ শতাংশে, অতএব, ঔরঙ্গজেবের রাজপুত বিদ্বেষ প্রমাণিত। 

২) আকবর সাম্রাজ্যের সূচনা পর্বে মনসবদারের সংখ্যা কম, ৩৫০০-এর কমবেশি। তুলনায় ঔরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের চরম বিকাশ পর্বে মনসবদারের সংখ্যা ৮০০০ কমবেশি। অতএব, মনসবদারের সংখ্যা দ্বিগুনের বেশি। ফলে, রাজপুতের শতাংশ কমেছে, কিন্তু মোট সংখ্যা বেড়েছে। 

৩) আকবরের সময় সাম্রাজ্য প্রধানত উত্তর ভারতে বিস্তার লাভ করেছে। রাজপুতেরা মূলত উত্তর ও মধ্য ভারতের জাতি। রাজপুতদের সংখ্যা ও শতাংশ তাই বেশি। ঔরঙ্গজেবের সময় সাম্রাজ্য দক্ষিণে ও প্রান্তদেশে প্রসারিত। স্বভাবতই অন্যান্য জাতি গোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ফলে রাজপুতরা শতাংশের হিসেবে কমেছে, কিন্তু মোট সংখ্যায় বেড়েছে। শতাংশ অনেক  কিছুই প্রমাণ করে না। 

৩০ জানুয়ারি ২০২৩ এলআইসি'র পক্ষ থেকে প্রেস বিবৃতি দেওয়া হয়- LIC's exposure in Adani Group, as on the day, is 0.975% of LIC's total AUM। অর্থাৎ, এক শতাংশেরও কম। অতএব গ্রাহকগণ, মাভৈঃ। এবার দেখা যাক এই এক শতাংশেরও কম বলতে অর্থের পরিমাণ কত? The total amount invested under Adani Group, amounts to Rs. 36,474.78 crores, as on the day। আমাদের ১৪০ কোটির দেশে ভারত সরকারের এই বছরের বাজেটে নারী ও শিশু কল্যাণ খাতে বরাদ্দ আছে ২৫,৪৪৮.৭৫ কোটি টাকা। 

এবার একটি রাজ্যের দিকে তাকানো যাক। মিজোরাম সরকারের বার্ষিক বাজেটের মোট পরিমাণ ১৪,০০৮.১৫ কোটি টাকা। বিজেপি শাসিত ডবল ইঞ্জিন সরকার ত্রিপুরা সরকারের বার্ষিক বাজেট আরও সামান্য- 5285 Cr in Budget Estimates of 2022-23 from Rs. 2651 Cr in BE of 2021-22. It is through this Capital Expenditure, Tripura Economy will grow at a very high rate। বিজেপি শাসনে ত্রিপুরার দ্রুত গতিতে বিকাশের ঘটা করে প্রচার। তাই বলছি, আদানি গ্রুপে এলআইসি'র ১ শতাংশ বিনিয়োগ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি রাজ্যের মোট বাজেটের সমান। 

আচ্ছা, যে রিক্সাচালক রিক্সার জন্য ১৫ হাজার টাকা ব্যাঙ্ক ঋণ নিয়ে অনিচ্ছুক ডিফল্টার হয়, সেই সংখ্যাটা শতাংশের হিসেবে কত? দশমিকের পর কটা শূন্য বসাতে হবে? অথচ তাই নিয়ে ব্যাঙ্ক, এলআইসি'র কত মাথাব্যথা। হাঁড়ি চাটা হাড় হাভাতের দলই ব্যাঙ্কের বোঝা। তাদের ঋণ উশুল করার জন্য আছে মাস মাইনে দেওয়া মাসলম্যান। পোশাকি নাম বাউন্সার। কত আয়োজন ঋণ আদায়ের। এই ঋণের পরিমাণ কত শতাংশ একটু জানাবেন সচিব মশায়?

মাননীয় অর্থ সচিব তো শতাংশের হিসেব দিয়ে আশ্বস্ত করলেন। ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের ক্ষেত্রেও একই মেজাজে বলতেই পারেন, বিজয় মালিয়ার অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ব্যাঙ্ক অ্যাসেটের ০.২ শতাংশের কম। আচ্ছা, নীরব মোদি, মেহুল চোকসি, শতাধিক ডিফল্টার ঋণ গ্রহীতার অনাদায়ী পরিমাণ যোগ করলে চিত্রটি কী দাঁড়াবে? রিজার্ভ ব্যাংকের গভর্নর রঘুরাম রাজন তো প্রধান একশোটি অনাদায়ী ঋণের নাম প্রকাশ করার অনুমতি চেয়েছিলেন। অনুমতি দেওয়া হয়নি ভাগ্যিস, তালিকা প্রকাশ পেলেই বোঝা যেত বিন্দু বিন্দু'র সাথে সিন্ধুর সম্পর্ক। দেশের রাজকোষ কড়ে গোনা কিছু ভাগ্যবানের নিয়ন্ত্রণে। 

তো তাতে কী? দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এরাই। এই অনাদায় নাকি অর্থনীতির মধ্যে ধরাই থাকে। এরা কত ঝুঁকি বহন করে শিল্প বাণিজ্য চালায়। তাই কৃতজ্ঞতা হিসেবে এদের অনাদায়ী ঋণ ঠিক মকুব নয়, রাইট অফ, অভিধানে যার অর্থ- cancel the record of a bad debt; acknowledge the loss of or failure to recover an asset। সোজা বাংলায় তামাদি। খাতা বন্ধ। মানে, বিজয় মালিয়া নীরব মোদি আবার ব্যাঙ্ক বা বীমা কোম্পানির ঋণ চাইলে তাদের আগের খাতা দেখা হবে না। ওটা বন্ধ। এ না হলে বিনিয়োগ হবে কেন। আর বিনিয়োগ ছাড়া উন্নয়ন হবে না। অতএব, এরা আবার একটা নতুন সাইনবোর্ড লাগিয়ে ঋণ পাবে।  

এরা ঠিক কতটা ঝুঁকি নেয়? সরকার শিল্পের জন্য জমি দেবে, নানাবিধ সুযোগ-সুবিধা, কর ছাড়, বিনিয়োগকারীর শর্ত পালন। পুঁজি আসবে ব্যাঙ্ক ঋণ থেকে। মুনাফা ঘরে ঢুকবে, পিএম কেয়ার্স ফান্ড, সিএসআর স্কীমে পুজো দিলেই হল। পাঁঠা মানত করা আরকি- সমস্ত ধরটা আমার, কেবল মাথাটা দেবতার ভাগে। আর শেষাবধি তো অনাদায়ী ঋণের রাইট অফ আছেই। তাহলে কোথায় ঝুঁকি? 

আরও মজার কথা হল, সরকার যখন কোনও ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে, দু/পাঁচ বছর পর ওই সংস্থা জলের দরে বিক্রি হয় অলাভজনক অজুহাতে। জাহাজ বন্দর, বিমান বন্দর, খনি, রেল, ভেল, বিএসএনএল সব বিক্রি হয়। পাবলিক মানি কর্পোরেট তস্করের হাতে তুলে দেওয়ার কত না আয়োজন। কোথায় ঝুঁকি বলুন দেখি? এ কার বিকাশ, কার উন্নয়ন? জনগণের অর্থে উন্নয়ন, লাভের গুড় আমার, লোকসান হলে তোমার (জনগণের)। আর তস্কররা, তাদের স্যাঙাৎরা যখন কথার জাগলিং করে বলে, তাহলে কি উন্নয়ন হবে না? আমরা জনগণ তোতলামি করি, নাআআ, তা হবে না কেন? বুক টান করে বলতে পারি না, হ্যাঁ এই পাবলিক মানির শ্রাদ্ধ চাই না, এই উন্নয়ন চাই না। অপার সাগর মহাসাগরের ০.১ শতাংশেরও বিষক্রিয়া চাই না, ফুকুশিমা চাই না। চার ধাম সংযোজন, রাস্তার সম্প্রসারণ, পাহাড়ে টানেল খনন চাই না। এই উন্নয়ন আমি চাই না। আমার নিরাপত্তার অর্থ শেয়ার ফাটকা বাজারে বিনিয়োগ আমি চাই না। আমার অর্থে গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার জলের দরে বিলগ্নিকরণ চাই না। আমি সকলের সাথে সম অধিকার নিয়ে বাঁচতে চাই। এ কথা বলতেই পারি না, কারণ মন থেকেই এ কথা বিশ্বাস করি না। জীবন যাপনের তরিকাই এখন ঢের পাল্টে গেছে। আমি বরং প্রলুব্ধ হই, মন্দ কি, আমার হয়ে যদি ব্যাঙ্ক এলআইসি শেয়ার বাজারে টাকাটা বাড়াতে পারে, আমারই লাভ। এই সভ্যতা যা আছে তাই নিয়ে তৃপ্ত থাকে না। অতএব, এই সভ্যতার মর্মে কীটের বাসা, আর কপালে শনির দশা। 

সেই কারণেই কখনও প্রশ্ন করতে পারব না, রিয়াল ইকনমিতে সত্যিই কি আদানির বাড়বাড়ন্ত ছিল? নাকি একটি কুচক্র আদানির বেলুন ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সেখানে সরকারি রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার লগ্নি বাড়িয়েছে! তারপর অকস্মাৎ বেলুন ফুটো। কুচক্র যে যার ভাগ-বাঁটোয়ারা করে সাগর পার। এই সন্ধান করবই না। বরং আরও কোনও সহজ পথে আমার ঘাটতিটুকু পুষিয়ে নেওয়া যায় কিনা, সেই সন্ধান করব। প্রতিযোগিতামূলক বাজার অর্থনীতিতে শুধু শিল্পপতি প্রতিযোগিতা করে না, এটা শুধু অর্থনৈতিক ক্যাটাগরি নয়, একটা সামাজিক সাংস্কৃতিক প্রবণতা। প্রত্যেকে ছুটছে প্রত্যেকের আগে, প্রতিবেশীকে পিছনে ফেলে। একটা কথা শুধু মনে রাখবেন, ডাক্তারের কাছে আপনার প্রাণ ০.০১ শতাংশ হতেই পারে, আপনার কাছে আপনার প্রাণ একটাই (১০০ শতাংশ)। আপনি সব হারাবেন।


No comments:

Post a Comment