চাকরির ভবিষ্যৎ কি সঙ্গীন?
শোভনলাল চক্রবর্তী
বিশ্ব জুড়ে চলা আর্থিক মন্দার কারণে একের পর এক সংস্থা তাঁদের কর্মীদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, ঠিক কী কারণে এই ছাঁটাই? আর্থিক মন্দার যে ধুয়ো তোলা হয়েছে তা কি ঠিক? আমরা যদি সংস্থাগুলোর বিগত দিনের কর্মপদ্ধতির দিকে নজর ফেরাই তবে দেখব যে আর্থিক মন্দার থেকেও অন্যান্য কারণ বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
যেমন, নেটওয়ার্কিং সংস্থা 'সিসকো' তাঁদের কর্মীদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। প্রায় ৪,০০০ কর্মী ছাঁটাই করতে চলেছে এই সংস্থা, যা মোট কর্মীর প্রায় ৪ শতাংশ। সারা বিশ্ব জুড়ে এদের অফিসগুলিতে ৮৩,০০০ কর্মী রয়েছে। যদিও এই কর্মী ছাঁটাই নিয়ে বিশদে কিছুই জানাতে রাজি হননি সিসকোর চেয়ারম্যান ও সিইও চাক রবিনস। তবে এই ছাঁটাইয়ের প্রক্রিয়াকে একটি রি-ব্যালেন্সিং অ্যাক্ট হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন সংস্থার চিফ ফাইন্যানশিয়াল অফিসার স্কট হেরেন। আর্থিক মন্দা আসতে চলেছে, তাই খরচ কমানোর জন্য এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে বলেই জানিয়েছেন তিনি। তাঁর অভিমত, অন্য খাতে অর্থ বিনিয়োগ করার জন্য এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। তবে, যে সব ক্ষেত্রে এই সংস্থা বিনিয়োগ করবে, সেই সব ক্ষেত্রে আরও বেশি পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি করা হবে বলেই দাবি করেছে এই সংস্থা। যে সব কর্মীদের নতুন ক্ষেত্রগুলিতে কাজ করার দক্ষতা রয়েছে, তাঁদের সেই সব ক্ষেত্রে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কোম্পানির মাথায় বসে যাঁরা কর্মপদ্ধতি নির্ণয় করেন, তাঁদের ব্যবসার ধারা বদল করার চেষ্টার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে কর্মী ছাঁটাইয়ের আসল কারণ। নতুন বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এত দ্রুত তার বাঁক বদল করছে, তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছেন না তথাকথিত ম্যানেজমেন্ট গুরুরা। সেই কারণে অর্থনৈতিক মন্দার ঘাড়ে বন্দুক রেখে তাঁরা পার পেতে চাইছেন। কিন্তু সমস্যা আরও গভীরে। নয়া শিল্প বিপ্লবের প্রকৃতিকে না ধরতে পারলে এই সমস্যা চলবে এবং কর্মী ছাঁটাই করে এই সমস্যা মিটবে না।
ইতিমধ্যেই বেশ কিছু কর্মীদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে মেটা, টুইটার, গুগল, মাইক্রোসফট, অ্যামাজন সহ বেশ কিছু টেক সংস্থা। বিগত কয়েক মাস ধরেই কমেছে এই সংস্থাগুলির আয়। কেন কমল আয়? কারণ, এই টেক কোম্পানিগুলো ধরেই নিয়েছিল যে করোনার কালবেলা পৃথিবীর বুকে স্থায়ী হবে। হয়তো হতও, যদি না ফার্মা লবি ও বৃহৎ পুঁজির এই কারবারিদের বিরুদ্ধে মানুষ না জাগ্রত হত।এদের লকডাউনের খেলা ধরে ফেলে মানুষ। বাইরে বেরিয়ে আসেন তাঁরা, ফলে, মাঠে মারা যায় বৃহৎ পুঁজির প্রকল্প। কিন্তু ততদিনে তারা ব্যবসার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে ফেলেছে করোনা বাজারের ফুলে-ফেঁপে ওঠা লাভের ভিত্তিতে। আজ সেই বাজারে ঘাটতি পড়তেই তারা বলছে বাজারে টিকে থাকতে কর্মী ছাঁটাইয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।
শুধুমাত্র তথ্য প্রযুক্তি সংস্থাগুলিই নয়, শিক্ষা সম্পর্কিত বেশ কিছু অনলাইন সংস্থাও তাঁদের কর্মীদের ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে একেবারে প্রথমেই রয়েছে বাইজুস-এর নাম। একদিনের নোটিশে কয়েকশো কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে এই সংস্থার বিরুদ্ধে। এছাড়াও, ছাঁটাই হওয়া কর্মীদের বাউন্সার দিয়ে অফিসের বাইরে বার করে দেওয়ারও অভিযোগ উঠেছে।
মূলত মাঝারি ও সিনিয়র লেভেলের কর্মীদেরই ছাঁটাই করা হচ্ছে। যখন প্রোডাক্টের রিভ্যাম্প প্রয়োজন পড়ে তখনই এই কর্মীদের কাজ। কিন্তু এই প্রোডাক্ট রিভ্যাম্পের কাজ শেষ। তাই এই সব কর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। এছাড়াও, বেশ কিছুদিন আগে একটি বৈঠকে বেশ কিছু বিভাগ, যেগুলির কাজে ভালো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না, সেখান থেকেও কর্মীদের ছাঁটাই করা হচ্ছে। ফুড ডেলিভারি সংস্থা জোমাটোও কর্মী ছাঁটাই করেছে। ক্লাউড কিচেনের কাজের সঙ্গে যুক্ত বেশ কিছু অ্যাকাউন্ট ম্যানেজারদের ছাঁটাই করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, সংস্থার টপ ম্যানেজমেন্টের বেশ কিছু আধিকারিক সংস্থা ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার ফলেও সংস্থায় টালমাটাল অবস্থার সৃষ্টি হয়। তবে শুধুমাত্র নামীদামী নয়, বেশ কিছু স্টার্ট-আপ থেকেও কর্মীদের ছাঁটাই করার প্রক্রিয়া চালু হয়েছে।
আর্থিক মন্দার কারণে হওয়া ক্ষতি সামাল দিয়ে বাজারে টিকে থাকতে বহু সংস্থাই এখন কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হাঁটছে। প্রায় ৫০ শতাংশ কর্মী ছাঁটাই করেছে টুইটার। জনপ্রিয় এই মাইক্রো ব্লগিং ওয়েবসাইটের তরফে জানানো হয়েছিল, কোম্পানিকে বাঁচাতে এটাই একমাত্র উপায়। টুইটার প্রধান এলন মাস্ক জানিয়েছিলেন, প্রতিদিন প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে তারা। এই পরিস্থিতিতে টুইটারকে বাঁচাতেই কর্মী ছাঁটাইয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বলাই বাহুল্য, ক্ষতির মূল কারণের বিশ্লেষণে না গিয়ে কর্মী ছাঁটাই কোনও স্থায়ী সমাধান নয়।
আমাদের জন্য যা খুব চিন্তার- কর্মী ছাঁটাই নিয়ে আমাদের মেনস্ট্রিম মিডিয়াতে কোনও আলোচনা চোখে পড়ছে না, তাঁরা শুধু খবরটুকু করেই দায় সারছে। ছাঁটাই যা হয়েছে তা মূলত আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায়। ছাঁটাইয়ের ঢেউ সেভাবে ভারতে এখনও আছড়ে পড়েনি। আজ হচ্ছে না বলে যে কাল হবে না, তার কোনও গ্যারান্টি তো নেইই বরং উল্টোটা ঘটার সম্ভাবনা প্রচুর। কারণ, আজকের বিশ্বের অর্থনীতির শিকড়ে কে কার সঙ্গে কীভাবে যুক্ত হয়ে আছে তা বোঝা দুঃসাধ্য। তাই আজ যারা চায়ের দোকানে বসে সুন্দর পিচাইয়ের মাইনে কমে যাওয়া নিয়ে টিপ্পনি কাটছে, তারা বুঝতেও পারছে না, যে কোনও সময়ে ছাঁটাইয়ের কোপ এসে পড়বে তাদেরই বাড়ির ছেলেমেয়েদের ঘাড়ে। গতকালই ডেল'এর ব্যাঙ্গালোর অফিসের বহু কর্মীকে ছাঁটাই করা হয়েছে। যদিও ডেল মোট যে সংখ্যক কর্মী ছাঁটাই করেছে তার তুলনায় ব্যাঙ্গালোরে ছাঁটাই হওয়া কর্মীর সংখ্যাটা কম, কিন্তু তবু বিপদ যে আসছে তা বোঝা যাচ্ছে। এর আগে টুইটার যখন ভারতীয় কর্মীদের ছাঁটাই করেছিল, তখন টাটা মোটরস'এর তরফে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করার কথা আমরা জেনেছিলাম। কিন্তু এই পথে তো সমাধান আসবে না।
সমাধানের জন্য আগে আজকের নয়া প্রযুক্তির বৈশ্বিক রূপটা ভালো করে বুঝতে হবে। সেটা কেবলই চাহিদা আর জোগানের খেলা। শুধু তাই নয়, অতি দ্রুত এই চাহিদা বস্তুটির রকমফের হচ্ছে। আজ যে বস্তুটা নতুন, ছয় মাস যেতে না যেতেই তা হয়ে যাচ্ছে পুরনো। তার ফল কর্মক্ষেত্রে হচ্ছে দু'রকম। একদল যেমন বাতিল হয়ে যাচ্ছেন, তেমনই একদম নতুন ধরনের কাজ করতে পারেন এরকম কর্মীদের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে। ফলে, এখন কর্মক্ষেত্রে এমন কর্মী দরকার যাঁরা জ্যাক অফ অল ট্রেডস মাস্টার অফ ওয়ান। একটি কাজ ভালো করে জানার সঙ্গে সঙ্গে আরও চারটি কাজ জানা দরকার হয়ে পড়ছে। এই শ্রেণির কর্মী তৈরির কথা প্রথম লিখেছিলেন আলভিন টফলার তাঁর জগৎ বিখ্যাত গ্রন্থ 'ফিউচার শক'-এ। এই ধরনের কর্মী তৈরি করতে গেলে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর স্তরে সিলেবাসের আমূল পরিবর্তন করে নতুন পাঠ্যক্রম চালু করার প্রয়োজন। আমরা সে সবের ধারে কাছে নেই। আমরা তো কোন ছাড়, আমেরিকাও নেই, ইউরোপও নেই। যে দুটি দেশ মোটের উপর প্রস্তুত আছে, যাদের উপর এই কর্মী ছাঁটাইয়ের অভিঘাত তেমন ভাবে পড়বে না বলে বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, বলাই বাহুল্য সেই দুটি দেশ যথাক্রমে চিন এবং জাপান। এদের পাশে দাঁড়িয়ে হয়তো এই কর্মী সংকোচনের সুনামির হাত থেকে পার পেয়ে গেলেও যেতে পারে ভারত সহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। নচেৎ, আরও খারাপ দিনের জন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে।
No comments:
Post a Comment