Monday, 20 February 2023

দেবাশিস ভট্টাচার্য

আমার ভালবাসার মানুষ

অশোকেন্দু সেনগুপ্ত


(১৯৫২ - ২০২৩)

ভাবিনি কখনও আপনার স্মৃতি তর্পণে আমাকেও লিখতে হবে কিছু। খানিক বাধ্য হয়েই লিখছি। বাধ্য করলেন আপনি নিজেই। মনে পড়ছে কত কথা। সবার আগে মনে পড়ছে কৃপাল সিং'এর স্মরণে বিষেণ সিং বেদীর লেখা। তেমন লিখব সে যোগ্যতা নেই। তবু লিখতে হবে। 

বলতে পারি না আচমকা গেলেন; যেমন আচমকা ডিমনিটাইজেশনের ঘোষণা শুনি আমরা দুজনে সেদিন আশিস চট্টোপাধ্যায়ের চ্যানেল থেকে বেরিয়েই। আশিস তারপরও নানা জায়গায় ঘুরে আবারও এসেছে কলকাতা টিভিতে। সেই কলকাতা টিভি। যার উপদেষ্টা ছিলেন আপনি।

মনে পড়ে, আশিস আর আপনি দুজনে আমার সাথে ছিলেন বাংলা একাডেমি আয়োজিত এক গল্পপাঠের আসরে। যেন এই তো সেদিন। সঞ্চালকের ভূমিকায় ঝড়েশ্বর চট্টোপাধ্যায়। আপনার সম্পাদিত কাগজেও তো অনেক লিখেছি। কিন্তু গল্প! না, লিখিনি কখনও। সে সবে যেন আগ্রহই ছিল না আপনার। আপনি এক বিরল সাংবাদিক। এমন নির্ভীক ও সৎ সাংবাদিক আমি আমার জীবনে দেখিনি। সাংবাদিকতা করেছেন আজকাল, আকাশ, প্রতিদিন কাগজে। সাংবাদিকের অভিজ্ঞতা ও বোধ থেকেই সম্পাদনা করতেন। পত্রিকা চালাতেন নিশ্চয় সেই অভিজ্ঞতা ও বোধেই । সে পত্রিকাকে 'বিনোদন' উপযোগী করার বুঝি কোনও বাসনাই ছিল না। 

বাসনা ছিল না 'দেশ শাসনের'ও। প্রতিদিন মুখ্যমন্ত্রীর ঘরে আনাগোনা ছিল সে সময় কিছু সাংবাদিকের। সে দলে ভেড়েননি এবং লেখেননি কোথাও সুনীলের মতো- 'কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক'। অথচ, কার্যত তাই নাকি ঘটেছিল সেই সময়। শুনেছি, চারজন সাংবাদিক দেশ শাসনের বিষয়ে নিয়মিত মুখ্যমন্ত্রীকে পরামর্শ দিতেন। মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের কথা শুনতেন কিনা জানি না। শান্তনু বসুও সম্ভবত জানতেন না। আমি বা আমার মতো কেউ কেউ জানি শুধু এই যে, আপনি কদাচ থাকতেন না তাদের দলে। গল্প লেখার মশলা সংগ্রহের লোভেও না। 

চিরদিন কাটিয়েছেন সামান্য আসবাবে। বন্ধু শুভাশিসের সঙ্গে আপনার বাড়িতে ঢুকে বিস্মিত হয়েছি। আপনার সরল জীবনযাপন নিয়ে যা লেখার লিখেছে উত্তান। কেবল এটুকু বলি, আপনি কখনও সরকারের কৃপাপ্রার্থী হননি। হবেন না যে, তাও তো জানা ছিল। প্রয়োজন ছিল না এমন তো নয়। তবু অনেকে নিন্দে করেছেন আপনার, যখন আপনি সাময়িকভাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রেস সংক্রান্ত বিষয়ে পরামর্শদাতা হ'ন।

প্রথমবার আপনার অসুস্থতার খবর পেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে ফোন করি। তিনি জানতেন, আপনার খবর রাখতেন  এবং আপনার চিকিৎসার সব বন্দোবস্ত করেন। আপনি সে সব উদ্যোগ ব্যর্থ করে চলে গেলেন।

মাওবাদীদের সঙ্গে আলোচনার জন্য মুখ্যমন্ত্রী একটা দল বানালেন। সে দলে আপনার সঙ্গে কাজ করেছি, সরকারের থেকে কোনও অর্থ বা সুবিধা না নিয়ে। অনেকে সমালোচনা করেছেন। আপনি গুরুত্ব দেননি। নিশ্চয় বলতে দ্বিধা নেই যে, আমরা শান্তিস্থাপনে ব্যর্থ হয়েছি। অন্তত সাধারণের তাই ধারণা। চেয়েছিলাম, রাজনৈতিক বন্দীদের অন্তত মুক্তি দেওয়া হোক, তাও হয়নি, তখনকার মন্ত্রী ও আমলাদের কৌশলে। 

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনাকে বিশেষ পছন্দ করতেন তা সত্ত্বেও আপনি হতাশ হ'ননি, কিষেণজী হত্যাকাণ্ডের পর একযোগে পদত্যাগ করতে দ্বিধা করেননি। কেবল তো একজন সাংবাদিক নন, আপনি তারও আগে বন্দীমুক্তি কমিটি, এপিডিআর-এর প্রাক্তন কার্যকর্তা। যত দূর মনে পড়ে, গৌতম ভদ্রের পর এপিডিআর'এর হাল ধরেন আপনি। তখন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী আপনাকে পছন্দ করেনি। জরুরি অবস্থাকালে কেন্দ্রের শাসক দলও পছন্দ করেনি আপনার ভূমিকা। আপনি সে অপছন্দকে কোনও গুরুত্বই দেননি। বদলা নেবার কোনও অভিসন্ধিও দেখিনি কখনও। 

রক্ত থেকে তথ্য- নানা প্রয়োজনে মানুষ আপনার দ্বারস্থ হয়েছে বারেবারে। মন্ত্রী, আমলা, আমার মতো সাধারণ মানুষ, আপনি কাউকেই হতাশ করেননি। কানোরিয়া জুট মিলের আন্দোলনরত শ্রমিকরাই বা আপনাকে ভুলবে কেমন করে?

সাংবাদিক দেবাশিস ছিলেন অসামান্য স্মৃতিশক্তির অধিকারী, যে গুণে আমাদের কাছে তো বটেই, সাংবাদিক মহলেও তাঁর বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আজও বিস্মিত হই এ কথা ভেবে যে, এইসব শুকনো তথ্যরাশি আপনি মনে রাখতেন কেমন করে? ভালবাসা ছাড়া যে হয় না তা। শুভাশিস বলছিলেন, বাজেটের পরই অসুস্থ অবস্থাতেই আপনি বাজেট বিশ্লেষণে লেগে পড়েন। কোথায় পাব আর এমন বিশ্লেষক? মোদী শাসনে এমন বিশ্লেষক আর কে আছেন যিনি দূরের ঘন্টাধ্বনি শুনতে পান, শোনাতে পারেন?

আমার ভালবাসার মানুষ দেবাশিস চলে গেলেন। বয়সে বুঝি অল্প ছোটই ছিলেন, তবু চলে যেতে হল। কেন? কেন পারছি না আপনার স্মরণে বেদীর মতো লিখতে?


2 comments:

  1. বেশ কয়েক বছর আগের কথা। হাজরা মোড়ে হঠাৎ মুখমুখি।টিভির পর্দায় দেখা মুখ চিনতে পারলাম। দেবাশিসবাবু বলে ডাকতেই, পাশ ফিরে চাইলেন,যেন কত দিনের চেনা।রাজ্যের রাজ্যপাট নিয়ে দুএকটা কথা হতেই সোজা নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন আশুতোষ কলেজের উল্টোদিকে ক্যাফে রেস্টুরেন্টে।দুটো ফিশচপ, আর চা অর্ডার দিলেন, প্রায় দেড়ঘন্টার উপর আড্ডা দিলেন আমার সঙ্গে।মাওবাদী প্রসঙ্গ, চেনা কমরেডদের মৃত্যু নিয়ে হল অনেক কথা।অদ্ভুত মানুষ ছিলেন বটে। সেই দিনের স্মৃতি ভোলার নয়।অশোকেন্দুবাবুর লেখায় দেবাশিস বাবুকে চমৎকার ধরেছেন।তাঁকে ধন্যবাদ।দেবাশিসবাবুদের মত বিরল প্রজাতির সাংবাদিকদের সংখ্যা এখন হাতে গোনা।

    ReplyDelete
  2. Kishenjir এর হত্যাকাণ্ডের *দেড় মাস* আগে আমরা শান্তি কমিটি থেকে পদত্যাগ করি একযোগে। --সুজাত ভদ্র

    ReplyDelete