দেশান্তরই এখন চালিকাশক্তি!
অনিন্দ্য ভট্টাচার্য
এখনও নাকি ওরা গুলতানি মারে,
দীর্ঘশ্বাস ফেলে; সান্ধ্য গোদি-টিভি’র জলসায়, সুখী মধ্যবিত্তের নিরিবিলি গৃহ অবসরে,
অলস বৃদ্ধকুলের চায়ে পে চর্চায়, আধ-চোখ বোজা হতাশ যুবকের সোশ্যাল মিডিয়া’র পাতায়।
আরও যেন কোথায় কোথায়। বলে, রাজ্যে কর্মসংস্থান কই; শিল্প কই; বিনিয়োগ কই! কে তাদের
চোখে আঙুল দিয়ে দেখাবে যে, আজকের কর্মসংস্থান আর ভূ-নির্দিষ্ট নয়; কৃত্রিম
বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স’এর বর্তমান যুগে শিল্পের সঙ্গে কর্মসংস্থানের কোনও
প্রত্যক্ষ যোগ নেই; বিনিয়োগের চরিত্র আজ বহুধা বিচিত্র, তার নানান আকার-প্রকার,
অতএব, তার গতিবিধিও উথাল-পাথাল। ফলে, চোখকান খোলা, তথ্যনিষ্ঠ, আধুনিক যুবকটি
ঠিকানা খুঁজে নিচ্ছে, হয়তো কতকটা আপাত ঠিকঠাক। আমূল বদলে গেছে বিশ্ব। তার
ভালমন্দের বিচারও চলবে! কিন্তু বাস্তব বদলগুলির দিকে চোখ ফিরিয়ে থাকার অর্থ
আত্মঘাত।
৭ মে ২০২৪- রাষ্ট্রসংঘের The International Organization for Migration (IOM) প্রকাশ করল
World Migration Report 2024। চমক জাগানো এই প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে
ভারত, মেক্সিকো ও চীন ছিল প্রবাস থেকে নিজ দেশে অর্থ আসার তালিকার শীর্ষে। ২০২০
সালে ভারতে যেখানে ৮৩ বিলিয়ন ডলার ‘প্রবাসী অর্থ’ (remittances) ঢুকেছিল, ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে
১১১ বিলিয়ন ডলারে। সামগ্রিক ভাবে, ২০০০ থেকে ২০২২ সালের মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রবাসী
অর্থ বা remittances ১২৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৮৩১ বিলিয়ন
ডলারে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রায় ৬৫০ শতাংশ। প্রতিবেদনের মতে, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এই
বিপুল প্রবাসী অর্থের সঞ্চালন জিডিপি’র বৃদ্ধিতে সহায়তার ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি
বিনিয়োগের পরিমাণকেও ছাপিয়ে গিয়েছে। আন্তর্জাতিক দেশান্তরের এই বিপুল প্রবণতাকে
প্রতিবেদনটি বলছে, আজকের অর্থনৈতিক ও মানব উন্নয়নের চালিকাশক্তি। উল্লেখ্য, ৮৩১
বিলিয়ন ডলারের এই প্রবাসী অর্থের মধ্যে ৬৪৭ বিলিয়ন ডলার ঢুকেছে শুধুমাত্র নিম্ন ও
মধ্য আয়ের দেশগুলিতে। তবে প্রতিবেদনে এও স্বীকার করা হয়েছে যে, দেশান্তরের সমস্ত
পর্বটা মোটেই উৎসাহব্যঞ্জক নয়, কারণ, বহু মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে, সহিংস উচ্ছেদের বলি
হয়ে দেশান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছে। তাদের সংখ্যাও কম নয়- সারা বিশ্বে বর্তমানে ২৮.১
কোটি দেশান্তরীদের মধ্যে আনুমানিক ১১.৭ কোটি মানুষ এই বাধ্যত দেশান্তরের শিকার।
কিন্তু যে দেশান্তরগুলি অর্থনৈতিক
বিচারে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে ঘটেছে, তার ফলাফল কিন্তু সাড়া জাগানো। IOM’এর একটি ম্যাপে দেখাচ্ছে, সংযুক্ত আরবশাহী, মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবে যথাক্রমে ৩৪.৭ লক্ষ, ২৭ লক্ষ ও ২৫ লক্ষ প্রবাসী ভারতীয় বসবাস
করছেন। বলাই বাহুল্য, দেশে মোট প্রবাসী অর্থ আসার ক্ষেত্রে ভারত বিশ্বে সবার শীর্ষে;
এবং প্রতিবেদনে প্রদত্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০১০ সালে ভারতে আসা এই অর্থের পরিমাণ
৫৩.৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১১১.২২ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। ভারতের পরে
ক্রমানুসারে যে চারটি দেশে সব থেকে বেশি প্রবাসী অর্থ প্রবেশ করেছে সেগুলি হল: চীন, মেক্সিকো, ফিলিপিন্স ও ফ্রান্স; যদিও এই দেশগুলি
নিজেদের মধ্যে নানা সময়ে ক্রম বদল করেছে কিন্তু ভারত সদাই শীর্ষে থেকেছে।
অন্যদিকে, ২০১০ সাল ও পরবর্তী সময়ে যে দেশগুলি থেকে প্রবাসী অর্থ নির্গত হয়েছে তার
শীর্ষে সব সময়েই থেকেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ২০২২ সালে যার মোট পরিমাণ ছিল ৭৯.১৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, বিশ্ব অর্থনীতি আজ দেশকালের
সীমানা পেরিয়ে যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে এমন এক অবয়ব পেয়েছে যেখানে শ্রমের অবাধ
যাতায়াত যেন এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যাওয়ার মতোই সাবলীল ও অনায়াস; ফলে, যেখানে
যে দেশে কাজের সুযোগ ও মজুরি বেশি, শ্রমিক ও শ্রম সেদিকেই বইতে চাইছে। ২০২৩ সালে
আমাদের দেশে প্রবাসী অর্থ ঢুকেছে ১২৫ বিলিয়ন ডলার যা জিডিপি’র ৩.৪ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে
কেরল রাজ্যের ভূমিকা অগ্রগণ্য। সারা বিশ্বে ১৮২টা দেশে কেরল থেকে দেশান্তরী হয়ে
কাজ করছেন প্রায় ৪০ লক্ষ মানুষ। ইতিমধ্যে দাবি উঠেছে রাজ্য স্তরে ‘প্রবাস মন্ত্রক’ তৈরির এবং তেলেঙ্গানা, হরিয়ানা ও ঝাড়খণ্ডের মতো কিছু রাজ্যে তা
গড়ে তোলার কাজও শুরু হয়েছে বলে শোনা যাচ্ছে।
এই বাস্তবতা সম্ভব হয়েছে মূলত দুটি কারণে।
এক, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিক্স’এর ব্যাপক প্রয়োগের ফলে ম্যানুফ্যাকচারিং ও
পরিষেবা ক্ষেত্রের সংগঠিত পরিসরে শ্রমের চাহিদা প্রায় ফুরিয়েছে। অর্থাৎ, ‘শিক্ষিত’
ও ‘দক্ষ’ শ্রমের অধিকাংশ কাজগুলি যন্ত্রই করে দিতে সক্ষম। দুই, ধনী দেশগুলিতে গড়
বয়স বেড়ে যাওয়া ও নানাবিধ কারণে বিশেষত অসংগঠিত ক্ষেত্রে ব্লু-কলার বা কায়িক
শ্রমের অভাব বেশ প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। একেক দেশে তা একেকরকম। যেমন, মরিশাসে
নারকেল-কুড়োনো একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ যার মজুরি বার্ষিক ৪.৫ লক্ষ টাকা,
সঙ্গে বিনামূল্যে থাকার জায়গা ও কাজের সময় ফ্রি মিল। প্রচুর ভারতীয় এই কাজগুলিতে
যোগ দিয়ে সচ্ছল আয় করে দেশে অর্থ পাঠাচ্ছেন। এছাড়াও, এই মুহূর্তে যে কাজগুলির
চাহিদা বেশ তুঙ্গে: জার্মানিতে ফিটার, জাপানে কসাই, অস্ট্রিয়াতে প্লামবার ও রাশিয়াতে লিফট
অপারেটর। এইসব কাজের খোঁজ এনে, উৎসাহী
লোকজনদের প্রশিক্ষিত করে, তাদের ভিসার বন্দোবস্ত করে দেশান্তরের প্রক্রিয়াও শুরু
হয়ে গেছে। মহারাষ্ট্র, গোয়ায় এই ধরনের কিছু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও গড়ে উঠেছে যাদের
সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষা ও সরকারি প্রতিষ্ঠান জুড়ে গিয়ে কাজটাকে গতি দেওয়ার চেষ্টা করছে।
এই কাজগুলি সম্পর্কে একটি বিস্তারিত
প্রতিবেদন (The Great
Indian Outplacement) ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’য় ৫ মে ২০২৪’এ প্রকাশ পেয়েছে। দেখা যাচ্ছে, হরিয়ানায় যে স্বাস্থ্যকর্মী মাসে ৮
হাজার টাকা রোজগার করতেন, তিনি জাপানে গিয়ে একই কাজে মাসিক ১ লক্ষ টাকা কামাচ্ছেন।
গুরগাও’তে যে ব্লু-কলার শ্রমিক মাসে ২০ হাজার টাকা কামাচ্ছিলেন, তিনি দুবাই’তে
গিয়ে বাউন্সার হিসেবে পাচ্ছেন ১.৫ লক্ষ টাকা। আগে আমরা NRI বলতে জাঁদরেল, পয়সাওলা ব্যবসায়ী অথবা উচ্চ-চাকুরে কিংবা উদ্যোগপতি লোকজনদের যে
ছবিটা কল্পনা করতাম তা আজ পালটে যাচ্ছে ব্লু-কলার NRI’র গল্পে। এখন ধনী দেশগুলিতে দরকার দক্ষ ও প্রশিক্ষিত গাড়ির চালক, বাউন্সার,
স্বাস্থ্যকর্মী, নার্স, প্লামবার, বেবি-সিটার, কেয়ার-গিভার, কুকুর-হাঁটানো ব্যক্তি,
পাচক, রেস্টুরেন্টের বয়, বাগান পরিচর্যাকারী, রাজমিস্ত্রী এবং আরও বিবিধ ও বিচিত্র
কর্মের শ্রমবাহিনীর। এর জন্য স্কুল-কলেজের শিক্ষা তেমন প্রয়োজনীয় নয়, দরকার কিছু কর্মের
প্রশিক্ষণ ও স্ব স্ব দেশের আচার-বিচার সম্পর্কে কিঞ্চিৎ বোধগম্যতা ও মান্যতা।
অতএব, যে
সমস্ত বিরক্তিকর প্রাচীনপন্থীরা নিজ গ্রামে, শহরে বা রাজ্যে অথবা দেশে যাবতীয়
কর্মসংস্থানের অলীক রূপকল্প তৈরি করেন, তাঁরা ভুলে যান যে কোনও একটি নির্দিষ্ট
ভৌগোলিক প্রাঙ্গণে দুনিয়ার যাবতীয় কাজের হাব আজ তৈরি হতে পারে না। কর্মের প্রক্রিয়া
আজ বিশ্বজোড়া- তার মুড়োটা যদি বিশ্বের উত্তর প্রান্তে থাকে, ল্যাজাটা হয়তো পূব
প্রান্তে। বড় বড় শিল্প আজ আর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে না, তারা যন্ত্র দিয়েই
কাজ সারে। যে পরিষেবা ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কিং ও বিমা ব্যবস্থা, পরিবহন ব্যবস্থা গত ৭০
বছরে, সর্বোপরি, তথ্য প্রযুক্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা গত ৩০ বছরে এক বড় মাপের
কর্মসংস্থানের আয়োজন করেছিল, তাদের নিয়োগ গতিও যন্ত্রের দাপটে আজ অস্তমিত। তাই বলে,
এমএ পাশ করে চাকরি না পেয়ে অটোরিকশা টানার গ্লানি সহ্য করতে হবে? তা কেন? নিজেকেই
জিজ্ঞেস করতে হবে, বিএ, এমএ সত্যি সত্যিই পাশ দেব কেন? চাকরির জন্য নাকি নিজের
জ্ঞান, পাণ্ডিত্য অথবা নিছক ডিগ্রি অর্জনের জন্য? যদি দ্বিতীয়টা হয়, তাহলে অপেক্ষা
করতে হবে। যারা বাবু ও পণ্ডিতদের কাজ দেবেন, তারা বিচার করে দেখবেন, অত সহস্র বাবু
ও পণ্ডিত সত্যি সত্যিই আজ আর লাগে কিনা! আর যদি প্রথমটা হয় (চাকরি), তাহলে বুঝতে
হবে, আজ আর বেশি পড়াশোনা বা অধিক ডিগ্রিতে কাজ নাই! কিন্তু আচারে আছে, গরিব বামুন
ভিক্ষা করবে, তবুও কায়িক শ্রমে ‘হাত নোংরা করবে না’। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে কায়িক শ্রম
হীন, ঘৃণ্য। তাই, ‘বাবুগিরির কাজ’ না পেলে বামুন ও উচ্চজাতের যত আক্ষেপ আর বিলাপ! অবশ্য,
যারা ফাঁকতালে দেশান্তরী হচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের লোটা-কম্বল
বিসর্জন দিয়ে দিব্যি সেখানে গাড়ি চালাচ্ছেন অথবা রেস্টুরেন্টে বাসন মেজে আয় করে ‘প্রবাসী
অর্থ’ দেশে পাঠাচ্ছেন। শুধু দেশের লোকেরা জানেন না, তাঁদের ছেলে বা মেয়ের কাজটা
ঠিক কী!
বিশ্ব জুড়ে মজুরি সমস্যাই আজ সব থেকে বড় সমস্যা। উচ্চ মজুরির টানেই দেশান্তর। কারণ, পুঁজিবাদের পুরনো ফরম্যাটে যে স্থানিক কারখানা-ভিত্তিক সংগঠিত ব্যবস্থা ছিল, যেখানে এক শেডের তলায় হাজার হাজার শ্রমিক কাজ করতেন, তার আজ অবসান হয়েছে। সে জায়গায় এসেছে বিশ্বায়িত ডিজিটাল গ্লোবাল ফরম্যাট, যেখানে যন্ত্রই আজ প্রায় সমস্ত কাজের ধারক ও বাহক। মনুষ্য শ্রমের কতটুকুই বা প্রয়োজন আর? কাজের স্থানিক চরিত্রও অতএব উধাও। যা থাকছে তা অসংগঠিত ক্ষেত্রের এমন শ্রমের চাহিদা, যেখানে যন্ত্র এখনও পারদর্শী নয়; যেমন, সুস্বাদু রান্না অথবা অসুস্থ মানুষের শুশ্রূষা, এই কাজগুলিতে (পাচক অথবা স্বাস্থ্যকর্মী) যান্ত্রিক নিপুণতার থেকেও আরও বড় প্রয়োজন পরিপাট্য ও মানসিক সান্নিধ্য। অতএব, শ্রমও ছুটছে কাজের নতুন আঙিনা ও চাহিদায়। মূলত কায়িক শ্রমই এখন দেশান্তরের চালিকাশক্তি। তাতে স্ব স্ব দেশ, রাজ্য ও গ্রাম বা শহরের সার্বিক লাভও হচ্ছে।
অনেক দিন পরে একটা ভাল লেখা পড়লাম 'একক মাত্রায়' । তথ্যনির্ভর, যুক্তিসমৃদ্ধ, ক্ষুরস্য ধারার মত বিশ্লেষণী শক্তির প্রয়োগ । সত্যিই তারিফ করার মত । আমার অভিনন্দন রইল ।
ReplyDeleteগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি যুক্তিযুক্ত ভাবে ব্যাখ্য করা হয়েছে। এখন ব্রেইন ড্রেইন কম হয় শ্রমিক বাহিনীর অভিবাসন বেশী হচ্ছে কারণ দেশে কাজ নেই আর মালিক পক্ষ মুনাফা অর্জন করেন শ্রমিকদের বঞ্চিত করে। এত টাকা দেশে ঢুকছে কিন্ত দেশের অর্থনীতির ওপরে রিশেষ প্রভাব পড়বে না।
ReplyDeleteবিশ্বের ছবিটা কীভাবে বদলে গেছে এবং যাচ্ছে তার এক ঝলক
ReplyDeleteযথার্থ ছবি।
ধন্যবাদ।
খুব সুন্দরভাবে সহজ কথায় বোঝানো হয়ে
ReplyDelete