ছাইচাপা আগুন খুব বিপজ্জনক
মালবিকা মিত্র
কয়েকটি টুকরো ছবি তুলে ধরছি, কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছনো আমার কাজ নয়। কিন্তু ছবিগুলি যথাযথ।
প্রথম ছবি: আমার এক পুরনো ছাত্র বর্তমানে একটি ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষক, মধ্যবিত্ত পরিবার। ফোনে জানিয়েছিল, সে তার অসুস্থ কাকাকে নিয়ে কলকাতার নামিদামি মাঝারি বেসরকারি হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছে। তারপর প্রায় দু' মাস পর তার কাকা শারীরিকভাবে থিতু হয়েছেন। পরে ছাত্রটি বলে, রেশন তোলা হয় না কোনওদিন, তবুও রেশন কার্ড কেন গুরুত্বপূর্ণ এতদিনে বুঝলাম। আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে ওর কথা বুঝতে চেষ্টা করলাম। বলল, রেশন কার্ডটা আছে বলে একটা ভরসা আছে, যে যেমন খুশি চালের দাম বাড়াতে পারবে না। কারণ, সাধ্যের বাইরে গেলে আমরা রেশনের চাল খাব। এটাকে বলতে পারেন একটা নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। ঠিক তেমনি আমাদের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড। নানা হাসপাতালে ঘুরেছি, তর্ক করেছি, প্রশ্ন করেছি। কোথায় যেন অধিকারবোধ দিয়েছে এই কার্ড। শেষ পর্যন্ত ভর্তি করতে সমর্থ হয়েছি। আগে হলে অ্যাপোলো বা আমরি'তে গিয়ে এত তর্ক-বিতর্ক করতে পারতাম না। স্বাস্থ্যসাথী কার্ডটা আমাকে সেই ভরসা দিয়েছে।
দ্বিতীয় ছবি: আমার প্রতিবেশী কট্টর সিপিআইএম কর্মী ও পার্টি সদস্য। মধ্যবিত্ত পরিবার, টিউশনি করেন। সাধারণ জীবন যাপন। হঠাৎ শাশুড়ি অসুস্থ হলেন, চিকিৎসকরা বললেন, আইসিইউ আছে এমন নার্সিংহোমে নিয়ে যান। এক কথায় এটা ওই পরিবারের পক্ষে প্রায় অসম্ভব। পরে সেই প্রতিবেশীর মুখেই শোনা, চুঁচুড়া সদর হাসপাতালে আইসিইউ'তে তার শাশুড়ি ভর্তি ছিলেন। জানালো, নিয়মিত সময় অন্তর যেভাবে শাশুড়ি'র চিকিৎসার প্রগ্রেস ও রিগ্রেস রিপোর্ট পেত, যেভাবে সামান্যতম খরচ ছাড়াই ১৬ দিন হাসপাতালে রেখে সুস্থ করে বাড়িতে এনেছে, এক কথায় সে অভিভূত। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয় করে যে চিকিৎসা আমরি-অ্যাপোলো'তে কিনতে হয়, সরকারি হাসপাতালে সম্পূর্ণ নিখরচায় তা পেয়েছে। 'সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ।' আমার প্রতিবেশীর সমগ্র মন্তব্যটি আমি উপস্থাপন করলাম।
তৃতীয় ছবি: আমেরিকায় ম্যাসাচুসেটস'এ গবেষণারত এক ছাত্রের কাছে শুনলাম, ওখানে সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করা আর মৃত্যু ডেকে আনা সমার্থক। একটা সাধারণ অপারেশনের দিনক্ষণ ধার্য হয় প্রায় এক মাস পরে। কোনও জরুরিকালীন এমার্জেন্সির জন্য বেসরকারি হাসপাতাল প্রধান ভরসা। সেই ছাত্র বলেছিল, আমাদের পশ্চিমবাংলায় সরকারি হাসপাতালে যে পরিমাণ রোগীর চাপ, সেই বিচারে আমেরিকার সরকারি হাসপাতালের চেয়ে আমাদের বাংলার সরকারি হাসপাতাল ১০ গুণ ভালো; ভাবতে খারাপ লাগে, দেশে থাকতে সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার অব্যবস্থা নিয়েই বেশি কথা বলেছি। এখন মনে হয়, বড় বেশি ভুল বলেছি। এখানকার তুলনায় আমাদের ব্যবস্থা অনেক বেশি ভালো।
চতুর্থ ছবি: যাদবপুরে একটি কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র, দেশের অন্যতম বিখ্যাতও বটে। সেখানে পাঠরত এক ছাত্র জানাচ্ছে যে, আমাদের স্কুলগুলোতে এমনিই শিক্ষক কম, তার উপর এত চাকরি বাতিল করলে তো স্কুলগুলোই বন্ধ হয়ে যাবে। Political vendetta পূরণ করার জন্য কি সর্বনাশটাই করছে, আর করবেও। আমাদের ইনস্টিটিউটে একটা selfie point খুলেছে। চৌকিদারের বড় কাটআউট লাগানো Research Building'র সামনে। কী চূড়ান্ত অপমানজনক লাগে সেটা। ওই কাটআউটের পেছনে ঢাকা পড়েছে মেঘনাদ সাহার মূর্তি। ইচ্ছে করে, ছিঁড়ে দিই ওই কাটআউট'টা।
একজন অধ্যাপক বললেন, আগের ডাইরেক্টর রাজি ছিলেন না এইসবে। ওনাকে পদ থেকে সরিয়ে সাধারণ একটা প্রফেসর পদে (distinguished professor পদও নয়) দিয়ে হায়দরাবাদের এক সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউটের প্রফেসরকে তাঁর জায়গায় বসানো হল। এনাকে ঠাণ্ডাঘরের বাইরে দেখা যায় না। ইনি 'ঠিক ঠিক' বলে ওঠা হীরক রাজার পারিষদ। তাই এই কীর্তি।
গত দু' মাস ইনস্টিটিউট'এ তীব্র আন্দোলন চলেছে। উনি ছাত্রদের সঙ্গে কথা না বলেই একটা বিলে সই করে দিয়েছেন, যাতে বলা ছিল, পাঁচ বছরে PhD শেষ করতে না পারলে fellowship বন্ধ করে দেওয়া হবে। PhD শেষ করতে হবে নিজের খরচায়। যে PhD গবেষকরা এখন 5th yr'এ আছে, তারা ওই extension'এর আশায় ধীরে সুস্থে কাজ করছিল। তীব্র আন্দোলন করা হয়েছিল। ডাইরেক্টরের দেহরক্ষীদের সঙ্গে ধ্বস্তাধস্তি হয়েছিল। স্বৈরাচারী লোকটা সমস্ত প্রফেসরদের হুমকি দিয়ে মেইল করেছেন, নিজের ল্যাবের ছেলেদের তুলে নিন, নয়তো আপনাদের ডাকা হবে। কী চরম স্বৈরাচার! আমরাও ক্লাস করিনি ওই দুদিন। কিছু প্রফেসর আমাদের সঙ্গে ছিলেন, ওনারা চূড়ান্ত অসহযোগিতা করেছেন ঐ ডাইরেক্টরের সঙ্গে। অবশেষে গত সপ্তাহের আগের সপ্তাহে ঐ ডাইরেক্টর পদত্যাগ করেছেন।
'প্রথমবার কোনও আন্দোলনে প্রত্যক্ষ অংশ নিলাম। এবারে ভোট দেবই। আমার বাইরের সেমিনার যাত্রা এক সপ্তাহ পিছিয়ে দিয়েছি। শুধু ভোট দেব বলে বাড়ি ফিরেছি।'
এদের কথাগুলো ছাই চাপা আগুনের আভাস দিচ্ছে। ছাই চাপা আগুন খুব বিপজ্জনক।
এই সামাজিক কোলাজ বাস্তব। একে অস্বীকার করার অন্ধত্ব যেন কারুর না হয়, এটাই আবেদন।
ReplyDeleteভালো লাগছে সত্যি ও মিথ্যার চেহারা দেখে।
ReplyDeleteতৃতীয় ছবিতে ম্যাসাচুসেটস্ এর সরকারী হাসপাতালের যে বর্ণনা দিয়েছেন সেইরকমই কিছু বর্ণনা পেলাম আমাদের ইনস্টিটিউটের গত বছরের পাসআউট এক দাদার থেকেও, যে বর্তমানে আমেরিকার purdue university র প্রথম বর্ষ পিএইচডি স্টুডেন্ট।
ReplyDeleteসে দেশে রাত আটটার পর কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থাকে না। চূড়ান্ত capitalist দেশে ওরা এটা প্রত্যাশা করে সবার নিজস্ব গাড়ি থাকবে। ওর গাড়ি ভাড়া নেওয়ার সামর্থ্য এই মুহূর্তে নেই, তাই আফশোষ। ওখানে যারা গরিব, তারা প্রথম বিশ্বের দেশ বলে তাদের দরিদ্রতা তৃতীয় বিশ্বের থেকে কম নয়, আমাদের দেশে গরিবরা কায়িক পরিশ্রম করে দিনবদলের স্বপ্ন দেখে, সে দেশে গরিবরা খুব সহজেই অসামাজিক কাজে হাত পাকায়। চুরি, ছিনতাই রাতের দিকে খুব স্বাভাবিক। ওই দাদাটা খুব ভয়ে আছে,যেহেতু প্রতিদিন রাত আটটার পর ও খাবার কিনতে বেরোয়....এখানে জিনিসের দরদাম করা যায়, সে দেশে সেসব হয় না, ট্যাঁকে অর্থ না থাকলে দোকানদারও পাঁচ সেকেন্ড সময়ও সেই ব্যক্তির জন্য অতিবাহিত করে না। ও আমাকে বলছিল, ভাই ইউরোপ অনেকবেশী সোশ্যালিষ্ট। আমেরিকার ক্যাপিটালিশম এর সাথে মানিয়ে নেওয়াটা খুব কষ্টকর, বিশেষত বাঙালি মাত্রেই এতটা পারিবারিক তথা সামাজিক জীবনযাপন করে ক্যাপিটালিশমের অনেকটা উর্দ্ধে উঠে সেখানে বিদেশ বিভুঁইতে ওইরকম ব্যবহার একাকিত্ব আনে।
ঝপ্ করে পড়ে ফেললাম। এই বাস্তবতা কেউই মেনে নিতে চায়না। আজ লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সারা দেশে গ্রহণীয় হয়ে উঠেছে নানা নামে। জনসংখ্যার আধা অংশকে উপেক্ষা করে কেবল ধম্ম নিরপেক্ষ শক্তি আর রামাচারী হয়ে গলা ফাটালে চলবে? অনেক ত্রুটি আছে। তার মাঝে যেটুকু ইতি আছে তাকে অস্বীকার করা যায়?
ReplyDeleteঠিকই বলেছেন, রেশনের এই দিক টা আগে ভেবে দেখিনি, ,😊
ReplyDeleteদীর্ঘদিন গ্রামেগন্জে শহরের এখানে ওখানে চাকরির কারণে বা নিছক কৌতূহলী হ য়ে গরীবগুরবো মানুষদের,বিশেষকরে কাজকরতে শহরে আসা মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি গত আটদশ বছরে তাদের জীবনযাপন রাজ্যসরকারের উদ্যোগে চালু হ ওয়া নানা জনকল্যাণকর কর্মসূচির সুবাদে তাদের পরিবারের শ্বাস নেবার পরিধিটা খানিকটা বেড়েছে। অথচ আসু বিপ্লবের কেতাবিপথের আশায় আকুল গম্ভীরানন বামপন্থীরা এই নিস্তব্ধে চালু থাকা ঘটনাবলী স্বীকার করতে আদৌ আগ্রহী নন। কলকাতা বা অন্য জায়গায় রোজরোজ কাজের খোঁজে আসা মানুষ জনেদের বিশেষকরে মেয়েদের দৈনন্দিন গেরিলাযুদ্ধ অব্যাহত থাকলেও এই সমস্ত পরিকল্পনা তাদের দুদন্ড নিশ্চিন্ত রাখে, ভরসা যোগায়। এগুলির পেছনে চেনাচেনা ভারীকোনো তত্ত্বের হদিশ মেলেনা।তাই নাগরিক সমাজে এই নিয়ে হিল্লোল ওঠেনা।আনন্দম য় সমাজে গেঁ য়ো যোগীদের স্থান চিরকাল ই,ক্ষমতার প্রান্তে।মালবিকা মিত্রকে অভিনন্দন নাবলা কথাগুলি চমৎকার ভাবে সামনে আনার জন্য।
ReplyDeleteঅসাধারণ পরিবেশনা। এই বাস্তবতা অনস্বীকার্য। অনেক ধন্যবাদ। ভালো থেকো।
ReplyDelete