'মজবুত' কেন্দ্র বনাম আমার অঙ্গ রাজ্য
মালবিকা মিত্র
বেশ মনে আছে, আমাদের এক বন্ধু সহ-শিক্ষক, চন্দ্রশেখরকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি কখনও। কেমন যেন খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, ঠিক প্রধানমন্ত্রী মানায় না। একবারও ভেবে দেখেননি যে, খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন ছিলেন প্রায় চন্দ্রশেখর সদৃশ্য। একইরকম মনোভাব প্রকাশ করত ট্রেনে আমার সহযাত্রী এক শিক্ষিকা। সে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদিকে দেখে বলেছিল, এতদিনে একটা মানানসই ফিগার, মুষ্টিবদ্ধ হাত, পেশীবহুল কাঁধ, 'না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা' পাওয়া গেল- এইরকম প্রধানমন্ত্রীই তো চাই। মনমোহন সিং কেমন যেন মিনমিনে, দাদু-দাদু সুলভ। আসলে, শাসক সম্পর্কে কল্পনায় বিরাজ করে পরাক্রমশালী, দীর্ঘ দেহী, বলিষ্ঠ বাহুর ছবি। সেই ছবিতে কখনই দয়াশীল, স্নেহশীল কর্তব্যপরায়ণ হরিশচন্দ্র বা যুধিষ্ঠির মার্কা ভাবমূর্তি গড়া হয়নি।
লক্ষ করবেন, রাজা রামচন্দ্রের সৌম্য শান্ত স্থিতধী মূর্তিটি বহুদিন হল বিদায় নিয়েছে। পরিবর্তে রাম রাজ্যের রামের চেহারা বদলে গেছে-- বলিষ্ঠ বাহু, চওড়া কাঁধ, সরু কোমর, সিক্স-প্যাক মার্কা রামের ছবি চিত্রিত হচ্ছে। এমনকি ভুঁড়ি সর্বস্ব ভোলানাথ বাবার 'শ্মশানে থাকে গায়ে ভস্ম যে মাখে' ছবিটাও পাল্টে গিয়ে ইদানীং জিম থেকে বেরিয়ে আসা সিক্স-প্যাক'এর শিব মূর্তি খুব প্রাধান্য পাচ্ছে। মানুষের মধ্যে শাসক ও প্রভু সম্পর্কে একটা ভিন্ন ভাব জাগানোর জন্য ফিজিক্যালি একটা ভিন্ন মূর্তি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলছে। শক্তি ও ক্ষমতা যার মূল কথা। শাসককে হতে হবে শক্তিশালী, বলিষ্ঠ, নির্দয়। 'ঠোক দো শালেকো'..., 'গোলি মারো শালেকো'..., 'এনকাউন্টার স্পেশাল'..., 'বুলডোজার বাবা'-- এই মনোভাবের সঙ্গে আমাদের 'এক দেশ এক ধর্ম এক ভাষা এক নেতা'র মানানসই চেহারাটা অবশ্যই নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদির সঙ্গেই খাপ খায়। রাহুল সাবালক হল না, অরবিন্দের মাফলার সমস্যা ঘুচল না; আর যদি নেতা নারী হয়, তবে তো কথাই নেই। মমতা ও হাওয়াই চটি, মমতার পা ভাঙা এসব নিয়ে কত গল্প। রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মূর্মুকেও সটান দাঁড় করিয়ে রাখতে পারেন নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী। এমনই এক শক্তির প্রতীক তিনি।
এর বিরুদ্ধে আপনি কি বিকল্প এক জন আব্রাহাম বা সলমন খান খুঁজবেন? নাকি আপনাকে শাসক সম্পর্কে ধারণাটা পাল্টাতে হবে। ভিন্ন আখ্যান রচনা করতে হবে। আসুক রাজা হরিশচন্দ্র, রাজা গোবিন্দ মানিক্য, তবে তো নতুন আখ্যান তৈরি হবে। ছাপ্পান্ন ইঞ্চি পেশি বহুল ছাতিকে মোকাবিলা করতে আটান্ন ইঞ্চি ছাতি খুঁজবেন? পারবেন ধূর্ততা ও চালাকির দ্বারা মানুষকে কিছু উত্তরবোধক প্রশ্ন দিয়ে নিজের কথা বলিয়ে নিতে? যিনি তা করছেন তাকে সুবক্তা বলবেন? হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসা, আমাদের হৃদয়ের সঙ্গে নিত্য সম্পর্কিত সমস্যাগুলিকে নিয়ে সংযুক্তি তৈরি করা ও তার সমাধানের রাস্তা খোঁজা- সেটা যিনি পারেন তিনি সুবক্তা নন? কিন্তু দুঃখজনক হলেও এটা সত্যি যে, বিজেপি বিরোধী দলগুলিও আজ মঞ্চে ভাষণ দিতে গিয়ে নিজের স্বকীয়তা হারিয়ে মোদিসুলভ প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে মানুষকে কিছু বলানোর চেষ্টায় রত।
মোদির বিরুদ্ধে উপযুক্ত বিকল্প হতে গিয়ে শরীরচর্চা, টি-শার্ট, একমুখ দাড়ি-- এসবের মধ্য দিয়ে 'পাপ্পু' নাম ঘোচানোর চেষ্টা অর্থহীন। বরং 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র মধ্য দিয়ে যে অভিজ্ঞতার সঞ্চয় রাহুল গান্ধী করেছিলেন, সেটাই তাঁকে ভিন্ন আখ্যান রচনায় সাহায্য করেছিল। 'ভারত জোড়ো যাত্রা'র পর রাহুল গান্ধীর যে সাক্ষাৎকার, পরিণতমনস্ক কথাবার্তা, তা যেন হঠাৎই ভোটের প্রতিযোগিতায় কোথাও হারিয়ে গেল। ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রেম-প্রীতি-ইনসানিয়াৎ'এর রাজনীতির সেই স্লোগানটাই আর দেখতে পাই না।
আখ্যান রচনার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রীয় দল হিসেবে কংগ্রেস সর্বভারতীয় স্তরে দীর্ঘদিন প্রাধান্য করেছে। এমনকি সেই মধ্য গগনে সূর্যের দিনগুলিতে কংগ্রেস সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ ছিল যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে ধীরে ধীরে দুর্বল করে শক্তিশালী কেন্দ্র গঠন করার চেষ্টা চলছে। দেবকান্ত বড়ুয়ার সেই উক্তি এখনও অনেকেরই মনে আছে- 'ইন্দিরা ইজ ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইন্ডিয়া ইজ ইন্দিরা।' আমার মনে হয় না, বিজেপির 'এক দেশ এক দল এক ধর্ম এক নেতা' আখ্যানকে প্রতিহত করার জন্য কংগ্রেস উপযুক্ত। কারণ, সর্বভারতীয় দল হিসেবে কংগ্রেসের মধ্যেও এই প্রবণতাগুলি ছিল এবং ভবিষ্যতেও পুনরায় দেখা দেবে। সম্প্রতি কর্নাটক নির্বাচনের পরেও সেই মনোভাব দেখা দিয়েছিল। আজ যে ৩৭০ ধারা নিয়ে এত শোরগোল চলছে, মনে রাখতে হবে, কংগ্রেস শাসনে ধারাবাহিকভাবে এই ৩৭০ ধারার ক্ষয় ধরানো হয়েছে অন্তত ৫৬টি সংশোধনীর মাধ্যমে। কংগ্রেস শাসনেই তো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে নয়/ বারোটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও নেতারা বিভিন্ন সময় ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন রাজ্যের অধিকার রক্ষার দাবিতে। ফলে, মোদি'র অমিতবিক্রম পেশীবহুল ভাবমূর্তির বিরুদ্ধে কংগ্রেসকে দাঁড় করানো যাবে না। কারণ, সেই মূর্তির আপাত জরাজীর্ণ অবস্থা হলেও ভেতরের খড়ের কাঠামোটি একইরকম। বরং আঞ্চলিক শক্তিগুলি তার নিজস্ব আঞ্চলিক সত্তা, স্বতন্ত্র স্বপ্ন, আবেগ, ভিন্ন রুচির অধিকার, এগুলিকে সযত্নে লালন করে শক্তিশালী, একমাত্রিক স্বরকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আঞ্চলিক শক্তিগুলিকে নিজেদের স্বার্থেই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে ভিন্ন স্বর সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে। তা না হলে সংসদীয় শাসন, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সবই বিপর্যয়ের সম্মুখীন হবে। দেখাও গেল, একটি স্টিং অপারেশনে বিজেপি'র স্থানীয় মণ্ডল সভাপতির স্বীকারোক্তিতে, সন্দেশখালি'তে কীভাবে 'মহিলা নির্যাতনের' অভিযোগগুলিকে নির্মাণ করা হয়েছিল।
বাংলার মুখ্যমন্ত্রী যখন বাংলা ও বাঙালির স্বার্থের কথা বলেন, সেটা চটকদারি ভোটের ফায়দা শুধু নয়, অতি কেন্দ্রিক দানবীয় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে আঞ্চলিক, ক্ষুদ্র এককের সংস্কৃতি ও অর্থনীতির স্বাতন্ত্র্য রক্ষার স্লোগান। শুধু বাংলা নয়, বিহার, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, তামিলনাড়ু, কেরল, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, কাশ্মীর এই সমগ্র আঞ্চলিক এককগুলির পক্ষে যা একান্ত জরুরি। অন্যথায় আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য, যুক্তরাষ্ট্রীয় সংবিধান বিপন্ন হতে বাধ্য। আঞ্চলিক দল ও শক্তিগুলির অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটা আজ জরুরি চাহিদা ও শর্ত। কিন্তু দুঃখজনক হলেও এ কথা সত্য যে, বৃহৎ এককের চাপের সামনে ক্ষুদ্র এককের লড়াইয়ে ক্ষুদ্র একক বৃহৎ এককের অনুরূপ কৌশল অনুকরণ করছে। আম আদমি পার্টি সর্বভারতীয় হয়ে উঠতে চাইছে। বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস অল ইন্ডিয়া তৃণমূল হতে চাইছে। সিপিআইএম যতই আঞ্চলিক শক্তি হোক না কেন নিজেকে সর্বভারতীয় শক্তি হিসেবেই দেখে। ফলে, শক্তিশালী কেন্দ্র, এক দেশ, এক দল, এক নেতার বিপরীতে ভিন্ন ভাষ্য বা আখ্যান তৈরি হচ্ছে না; যে আখ্যান আঞ্চলিকতার কথা বলবে, বৈচিত্র্যময় ভারতের কথা বলবে, বিবিধের মিলনের কথা বলবে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই কথাটাই মনে পড়ছে- 'ব্যাঘ্রসনে নখে দন্তে নহিক সমান, তাই বলে ধনুঃশরে বধি তার প্রাণ, কোন নর লজ্জা পায়?' শক্তিশালী কেন্দ্রের বিরুদ্ধে বিকল্প শক্তিশালী কেন্দ্র হয়ে ওঠা সম্ভব নয়। জনমত যাচাই করলে তাই নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রীত্বের পক্ষে এখনও ৬৭ শতাংশ মানুষ সমর্থন দেয়। কিন্তু একবারও কি আঞ্চলিক স্বাতন্ত্র্য, আমার ভাষা, আমার পোশাক, আমার খাদ্যাভ্যাসের উপরে কোনও জনমত যাচাই হয়েছে? আমি নিশ্চিত সেটা হলে শক্তিশালী কেন্দ্রের পক্ষে অবশ্যই ৬৭ শতাংশ সমর্থন জুটত না। দুঃখজনক বিষয় হল, একদা কংগ্রেসের সুদিনে ইন্দিরা গান্ধী শক্তিশালী কেন্দ্র ও স্থায়ী সরকার গড়ার গ্যারান্টি দিয়ে ভোটে জিতেছেন। আবার পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীরাও স্থায়ী সরকারের স্লোগান দিয়েছে নিজের রাজ্যে। ফলে, বিকল্প ভাষ্য ও আখ্যান তৈরি হল না। যুক্তরাষ্ট্রীয় রাজনীতিটা সঠিকভাবে অনুশীলন করাই হল না। কেবলই শক্তিশালী কেন্দ্রের অনুশীলন। আজ মোদি যেটা খোলামেলা ভাবে ডাবল ইঞ্জিন সরকার বলছেন, বাস্তবে ব্যবহারিক অনুশীলন কংগ্রেস জমানাতে তার সূচনা।
খবরের কাগজে দেখলাম, মে মাসের ৩ তারিখে কলকাতায় উচ্চ শিক্ষিত জ্ঞানীগুণী অধ্যাপকদের এক সভায় পরকাল প্রভাকর স্মরণ করিয়ে দেন, ওই তারিখটিতে মনিপুরের জাতি দাঙ্গার বীভৎসতা ও হিংস্রতার এক বছর পূর্ণ হল। আরও মনে করান যে, মনিপুরে ডবল ইঞ্জিন সরকার। তিনি বলেন, এবারের ভোট খুব ভেবে চিন্তে না দিলে ভবিষ্যতে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে এখনকার রূপে আর দেখা যাবে কিনা তা নিয়েই আশঙ্কা আছে। মনে রাখবেন, সভাটি ছিল উচ্চশিক্ষিত পণ্ডিত অধ্যাপকদের সভা। সেই সভায় একজন শ্রোতা প্রশ্ন করেন, কেন্দ্রে মজবুত সরকার গঠিত না হলে বিনিয়োগ আসবে কীভাবে? অর্থনীতির ভিত শক্ত হবে কীভাবে? পরকাল প্রভাকর জবাব দেন, মজবুত সরকার ও আর্থিক মাপকাঠিগুলি ঠিকঠাক থাকা সত্ত্বেও গত ১০ বছরে বিনিয়োগকারীরা হাত খোলেননি, জিডিপি'র নিরিখে সঞ্চয় তলানিতে ঠেকেছে, কমেছে প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নি।
বোঝা গেল, উচ্চবর্গের চেতনাতেও একটি লোমশ মজবুত পেশীবহুল কেন্দ্র বিরাজ করে। প্রভাকর যখন গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত, তখন পণ্ডিত প্রশ্নকর্তা মজবুত সরকার ও বিদেশি লগ্নি নিয়ে চিন্তিত। পশ্চিমবঙ্গের একজন বামপন্থী নেতা বলতেন, সরকারটা যদি জনবিরোধী, পশ্চাতে বাঁশ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে সেটা কম মজবুত, কম স্থায়ী, ভঙ্গুর হওয়াই বাঞ্ছনীয়। এবারের লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির পেশীবহুল শক্তিশালী কেন্দ্রের বিপরীতে আঞ্চলিক রাজনীতির প্রচার ও উত্থান সম্ভব ছিল। শেষাবধি কত দূর তার বাস্তবায়ন হবে, ভবিষ্যৎ সে কথা বলবে।
ভালো লেখা, যুক্তিপূর্ণ।
ReplyDeleteএই লেখাটা যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক এবং বিশ্লেষণভিত্তিক __ বিশেষত আজকের ভয়ঙ্কর অগণতান্ত্রিক ও বিরোধী কণ্ঠস্বরের টুঁটি চেপে ধরা শ্বাসরূদ্ধকর রাজনৈতিক বাতাবরণকে উন্মোচিত করার সাধু অভিপ্রায়ে।
ReplyDelete