Thursday, 12 October 2023

সুন্দরবনের মৎস্যজীবীরা

'মৎস্য শিকারের পূর্ণ অধিকার চাই' 

বর্ণালী রায়



কথায় বলে, 'মাছে ভাতে বাঙালি'। আর তাই নাকি বাঙালির এত বুদ্ধি! শেষ কথাটি নিয়ে বিতর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু মাছ না হলে সত্যি আমাদের মুখে ভাত ওঠে না। কিন্তু যারা ভাতের পাতে মাছের সমাবেশ ঘটান তাঁদের খবর কে রাখে?

কাকদ্বীপ: প্রতিবাদের ঐতিহাসিক এক নাম। গত ৩ অক্টোবর সেখানকার বাসস্ট্যান্ডে উপস্থিত অগুনতি মানুষ। চোখে পড়ছে মহিলাদের সংখ্যাগুরু উপস্থিতি। দেখেই বোঝা যায় তারা দরিদ্র মেহনতি মানুষ। কিন্তু চিত্তের দৃঢ়তায় কোনও দারিদ্র্য নেই। এঁরা প্রত্যেকেই মৎস্যজীবী। সেদিন ছিল তাঁদের মহাসমাবেশ ও বিক্ষোভ ডেপুটেশন। আয়োজক 'দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরাম'। এর আগেও এঁদের নদী-খাল-বিল-হাওড়-বাওড়-পুকুর-জলাশয় বাঁচানোর দীর্ঘস্থায়ী একরোখা আন্দোলনে দেখা গেছে। কী নিয়ে বিক্ষোভ?

সুন্দরবন অঞ্চলের বাসিন্দাদের হাতে গোনা কয়েকটি জীবিকার মধ্যে নদী, খাঁড়ি, সমুদ্রে মাছ শিকার অন্যতম। বিভিন্ন প্রজাতির মাছ সামুদ্রিক পরিবেশের মধ্যে বসবাস করে। তারা ঋতু, জোয়ার-ভাটা ইত্যাদির টানে, খাদ্যের সন্ধানে বা প্রজননের কারণে উপকূলের কাছাকাছি চলে আসে, কখনও বা গভীর সমুদ্রে চলে যায়। এই আসা-যাওয়ার পথেই তারা জেলেদের জালে ধরা পড়ে। এভাবেই রূপোলী শস্য ইলিশ মানুষের পাতে উঠে আসে। 

বর্ষাকাল ইলিশের উপযুক্ত সময়। এই সময় সমুদ্র উত্তাল থাকে। তবু, জেলেরা ইলিশের সন্ধানে জীবনকে বাজি রেখে বরফ, চাল-ডাল বেঁধে নিয়ে সমুদ্রে পাড়ি জমান। একেকটা ট্রিপ ৭ থেকে ১০ দিনের। পরিবারের কাছের মানুষেরা ট্রিপের সময় আতঙ্কে প্রহর গোনেন। রুদ্ধশ্বাসে বাড়ির গা ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদী কিংবা দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঘাটে ফিশিংবোট ফিরেছে খবরটা কানে এলেই তবে তাঁরা হাঁফ ছাড়েন। কখনও কান্নায় ভেঙে পড়েন আপনজন না-ফেরার বেদনায়।

কিন্তু মাছ কি সব সময় পাওয়া যায়? না। কারণ, বড় বড় মৎস্য শিকারীরা বিরাট বিরাট ট্রলি নিয়ে সারা বছরই গভীর সমুদ্র দখল করে রাখে। তাদের ধ্বংসাত্মক জাল আগেভাগেই সব মাছ তুলে নেয়। এরপর যখন ভটভটি বা ছোট দাঁড় টানা নৌকোয় ছোট মৎস্য শিকারীরা সেখানে পৌঁছন তখন মাছ শেষ। মাছের পরিমাণ জলবায়ুর পরিবর্তন ও অত্যাধিক দূষণ ইত্যাদির কারণে এমনিতেই কমে গেছে। তার ওপর এই ট্রলিগুলো তাদের বিরাট বিরাট ট্রলনেট দিয়ে সমুদ্রের তলদেশ ছেঁচে ধ্বংস করে দিচ্ছে। উজাড় করে দিচ্ছে মাছ সহ সকল প্রকার জলজ প্রাণীর বাসা ও প্রজননস্থল। তলদেশেও সামুদ্রিক প্রাণীদের পিশে দিয়ে যাচ্ছে অবিরত। ছোট-বড় সব মাছই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সে কারণে মাছের জন্ম বা বৃদ্ধি কোনওটাই হয়ে উঠছে না। রত্নগর্ভা সমুদ্র ট্রলি'র অত্যাচারে আজ বাঁজা হয়ে গেছে। আজকাল জালে মাছ পড়ে না বললেই চলে। আর তাই হাঁড়িও চড়ছে না ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের হেঁসেলে। 

তাই ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের দাবি, 'অবিলম্বে ট্রলিং বন্ধ করতে হবে', 'ধ্বংসাত্মক সব ধরনের মৎস্য শিকার বন্ধ করতে হবে'। মৎস্য শিকার নিয়ন্ত্রণের জন্য আইনকানুন আছে। যেমন, ২৩ সেন্টিমিটার'এর ছোট ইলিশ (যার ওজন ৫০০ গ্রাম মতো) ধরা বারণ। কারণ, এরা তখনও পূর্ণবয়স্ক নয়। এদের ধরে ফেললে ডিম পাড়বে কারা? আর ডিম না পাড়লে পরবর্তী মাছের প্রজন্ম রুদ্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তাও কি আটকানো যাচ্ছে?  

ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা যেমন কাঁচা মাছ উৎপাদন করেন, তেমনি শুঁটকি মাছও উৎপাদন করেন। সেপ্টেম্বর থেকে মার্চ শুঁটকি মাছ উৎপাদনের মরশুম। জেলেরা সমুদ্রের বুক থেকে ধরে আনা পাতা, লোইটা, আমোদী, রুপাপাটি, চিংড়ি ইত্যাদি মাছ সমুদ্রের বালুকাতটে শুকান। একে খোটি বলে। হাজার হাজার পুরুষ মহিলা খোটি মরশুমে খোটিতে মাছ শিকার, শুকানো, বিক্রি, জাল সারাই ইত্যাদি কাজে নিযুক্ত থেকে জীবিকা যাপন করেন। জম্বুদ্বীপেও তেমন হত। কিন্তু বন সংরক্ষণের অজুহাতে আর পর্যটন শিল্প স্থাপনের সরকারি চক্রান্তে ২০০৩ সালে জম্বুদ্বীপ থেকে প্রায় দশ হাজার মৎস্যজীবীর জীবিকা উৎখাত করা হয়েছে।      

বুদ্ধবাবুর আমলে জম্বুদ্বীপ থেকে উৎখাত হওয়া খোটি মৎস্যজীবীরা আজও জম্বুদ্বীপ ফিরে পাননি। তাই খোটি-মৎস্যজীবীদের দাবি, জম্বুদ্বীপে মাছ শুকানোর অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সাগর, ফ্রেজারগঞ্জ ইত্যাদি এলাকার খোটিগুলো একটু একটু করে বন দফতর দখল করে নিচ্ছে। তার উপর তথাকথিত উন্নয়নের নামে খোটির জমি দখল করে নেওয়ার নিরন্তর চাপ তো রয়েছেই। তাই ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের দাবি, খোটির জমির উপর মৎস্যজীবীদের সমষ্টিগত আইনানুগ অধিকার দিতে হবে।  

ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা চান, জলাশয়-নদী-সমুদ্রে সমষ্টিগত পাট্টা। দুর্নীতির দুর্গন্ধ যখন সর্বত্র তখন মাছের জগতই বা বাদ পড়বে নাকি? ক্ষুদ্র সামুদ্রিক মৎস্যজীবীদের আর্থিক উন্নতির জন্য সরকার মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলির মাধ্যমে কখনও কখনও কিছু ঋণের ব্যবস্থা করে। ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ অর্থ বর্ষে 'ট্র্যাডিশনাল মেরিন ফিশ প্রোডাকশন বেহুন্দি ফেজ-৩ স্কিম' নামে সাবসিডি সহ লোন স্কিম ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল। সাবসিডি সহ লোন স্কিম ছিল ৪,৭৩,০০০ টাকা। এই টাকার মধ্যে ২,৩৮,০০০ টাকা ছিল সাবসিডি বা অনুদান। এই অনুদানের টাকার প্রায় সবটাই মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির দুর্নীতিগ্রস্ত কর্তাব্যক্তিরা রাজনৈতিক নেতা ও সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে যোগসাজশে লুঠ করে নেয়। ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই থেকে যান। তাই তাঁরা আওয়াজ তুলেছেন, লুঠ হয়ে যাওয়া সাবসিডির টাকা ফেরত দিতে হবে এবং সাবসিডি চোরদের গ্রেফতার করতে হবে।

১৯৭৩ সালে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প প্রতিষ্ঠার পর থেকে মৎস্যজীবীদের উপর বন দফতর নিরন্তর অত্যাচার করে চলেছে। সুন্দরবন নদী খাঁড়ি জঙ্গলে মৎস্যজীবীদের মাছ কাঁকড়া ধরার পরম্পরাগত অধিকার বন দফতর কেড়ে নিয়েছে। সুন্দরবনের কোর এলাকায় ও সীমানা অঞ্চলে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা মাছ ধরতে পারেন না। বন দফতর ও  বিএসএফ'এর অত্যাচারে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীদের জীবিকা বিপন্ন। তাই মৎস্যজীবীদের দাবি, তাঁদের সুন্দরবনে মাছ ধরার অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। সীমান্ত এলাকায় মৎস্যজীবীদের জীবিকাকে সুরক্ষিত করতে হবে।  

এইসব সমস্যা নিয়েই ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা দাবি তুলেছেন। তাঁরা প্রতিবাদ করছেন, বিক্ষোভেও সামিল হচ্ছেন। প্রায় অর্ধ শতাব্দী হল সে আন্দোলনের বয়স। সম্প্রতি 'দুয়ারে সরকার' থেকে মৎস্যজীবী রেজিস্ট্রেশন কার্ড দেওয়া হয়েছে। তাতে কোনও মৎস্যজীবী মাছ ধরতে গিয়ে দুর্ঘটনায় মারা গেলে ৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ পাবেন। এটা মৎস্যজীবীদের দীর্ঘ আন্দোলনের ফল। 

সুন্দরবনের বিভিন্ন অঞ্চল (গোসাবা, নামখানা, সাগর, পাথরপ্রতিমা, ডায়মন্ডহারবার, কুল্পি ও কাকদ্বীপ ব্লকের বিভিন্ন এলাকা) থেকে ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা গত ৩ অক্টোবর কাকদ্বীপের সমাবেশে এসেছিলেন। মহিলারা জাল সারাই, মাছ ধরা, মাছ বাছা, মাছ শুকোনো, বিক্রি- সবই করেন পুরুষদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। মিটিং মিছিলেও তাঁরা খুবই সক্রিয়। মৎস্যজীবী সমাজের মাথায় তাই আধখানা নয়, মস্ত একখানা আকাশ। তাঁদের ডেপুটেশনেও এসডিও দাবি-দাওয়াগুলির বাস্তবতা অনেকটাই স্বীকার করে নিয়েছেন। নিজের ক্ষমতার মধ্যে কিছু করার আশ্বাসও দিয়েছেন। বাকিটা যথোপযুক্ত জায়গায় পাঠাবার ব্যবস্থা করবেন বলে জানিয়েছেন।

মৎস্যজীবীরা হলেন সমাজের বন্ধু। আর বন্ধু ভালো না থাকলে সমাজ কীভাবে ভালো থাকে!


3 comments:

  1. ছোট মৎস্যজীবীদের বর্তমান অবস্থার সাথে সমব্যথী, এটা অনেকটা ই-কমার্স এর চাপে দেশের ছোট ব্যবসায়ীদের কোণঠাসা হয়ে যাওয়া অবস্থার সমতুল্য। পরিস্থিতির সুষ্ঠু সমাধান কাম্য, তবে কোনভাবেই মানুষের রুটি রুজির অজুহাতে পরিবেশের উপর হস্তক্ষেপ বরদাস্ত নয়।

    ReplyDelete
  2. প্রত্যন্ত এলাকা থেকে সাধারণ মানুষের বিস্তৃত খবরাখবর পড়লে মনে হয় যেন এই নাগরিক জীবন এক মেকি বুদবুদে বসবাস। প্রতিদিন যাদের জন্য পাতে মাছটুকু উঠে আসে তাদের কথা তেমন করে ভাবিই না। ধন্যবাদ।

    ReplyDelete
  3. লড়াই জারি থাকবে

    ReplyDelete