Friday, 27 October 2023

অনন্ত যুদ্ধে ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন? (১)

ইতিহাস ও বর্তমান

সুব্রত হালদার



ইজরায়েলের বর্তমান ঘটনাবলী জীবনের সমস্ত ধরনের অধিকারকে ক্রমাগত অস্বীকার করে যে অভিমুখে চলেছে তাতে কবির ভাষায় বলতে হয়-

'প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে

শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ।' 


যে ভাবে ঘটনাপ্রবাহ ও সম্ভাব্য ঘটনাবলী আমাদের যুগপৎ আশঙ্কিত ও আতঙ্কিত করে তুলেছে তার অভিঘাত এতটাই প্রবল ও হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠেছে যে, সমস্ত জটিলতা সরিয়ে রেখে অবিলম্বে যুদ্ধ বন্ধ ও জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করাই সময়ের প্রাথমিক ও সর্বোচ্চ দাবি হয়ে উঠেছে। সমস্ত শুভবুদ্ধি ও গণতান্ত্রিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে আন্তর্জাতিক মহলের সামনে যুদ্ধ, সম্পত্তি ও প্রাণহানি বন্ধ এবং সর্বার্থে জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে কার্যকরী উদ্যোগ ও হস্তক্ষেপের দাবি জানানো ছাড়া আর কোনও দ্বিতীয় উপায় দেখি না। ঘটমান যুদ্ধ কারা শুরু করেছে, তার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় কারা কতটা যুদ্ধাপরাধ করেছে ও করছে- সে প্রশ্নের চুলচেরা বিশ্লেষণ আপাতত থাক; বরং সমগ্র মধ্যপ্রাচ্য যে বারুদের স্তূপের উপরে দাঁড়িয়ে আছে তাতে অগ্নিসংযোগ করা থেকে বিরত হওয়াটাই প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হওয়া উচিত। ফলে, ভূমধ্যসাগর থেকে মার্কিন রণপোত সরিয়ে নেওয়াটাই প্রথম কর্তব্য।

একদিকে ইজরায়েল-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অক্ষ, অপরদিকে হামাস সহ প্যালেস্টাইনের জনগণের থেকে উদ্ভূত বিভিন্ন জঙ্গী গোষ্ঠীর সাথে পেট্রোডলারে সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের গোপন বা খোলাখুলি সম্পর্ক যে পরিস্থিতিকে ক্রমাগত জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে, এ ব্যাপারে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। আর একটি বৃহত্তর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপট যে ভাবে রচিত হচ্ছে তার প্রভাব অকল্পনীয় রকমের সূদুরপ্রসারী হতে পারে। একমাত্র সব পক্ষের নিবৃত্তি ও আধুনিক মনস্কতা নিয়ে বিরোধ মীমাংসা করাটাই সুবিবেচনার কাজ হবে বলে বিশ্বাস। দেখা যাচ্ছে, ইয়াসের আরাফতের নেতৃত্বে PLO ও স্টেট অফ ইজরায়েলের মধ্যে যে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল তার মান্যতা আর সেভাবে নেই। ফলে, প্রয়োজন রাষ্ট্রপুঞ্জের তরফে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করা।

এই পরিস্থিতির আবর্তের থেকে আপাতভাবে কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে একটু দেখে নেওয়ার চেষ্টা করা যাক ঘটনাক্রম ও পরিস্থিতির জটিলতাকে। 

প্রথমেই এই প্রশ্ন আসবে, হামাস (Harakat al-Muqawama al-Iskamia বা Islamic Resistance Movement) হঠাৎ এমন হামলা করতে গেল কেন? এক রাতেই ৫০০০ থেকে ৭০০০ রকেট হামলা হয়েছে, প্যারাট্রুপিং করে হামাস গেরিলা যোদ্ধাদের নামানো হয়েছে এবং এক বড় সংখ্যক নাগরিকদের পণবন্দী করা হয়েছে। আপাত ক্ষমতার ভারসাম্যের নিরিখে হামাস একটি অসম যুদ্ধ শুরু করেছে যা স্ট্রাটেজিকালি ও ট্যাকটিকালি গেরিলা যুদ্ধের পর্যায়ভুক্ত। ১৯৮৭ সালে মুসলিম ব্রাদারহুড থেকে ভেঙে আসা এই সুন্নি ইসলামি রাজনৈতিক ও সশস্ত্র মিলিটারি সংগঠন মূলত গাজা স্ট্রিপে ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন ঘটিয়েছে এবং সেখানে ডি-ফ্যাক্টো সরকার চালাচ্ছে। কিন্তু সম্ভবত এদের নেতৃত্ব বসে আছে কাতারে। ইজরায়েলের অভিযোগ এবং স্বাভাবিক গেরিলা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী, এ ক্ষেত্রে সাধারণ ফিলিস্তিনি জনগণকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে হামাস। বিদেশি মদত আছে- এই অভিযোগের আঙুল তোলা হয়েছে মিশর, ইরান, সিরিয়া, জর্ডন, লেবানন, তুর্কির দিকে। মিশর থেকে টানেল যোগাযোগ মারফত নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহের অভিযোগ আছে। 

হামাসের ঘোষিত লক্ষ্য সমগ্র ইজরায়েলকে ইসলামি দেশে রূপান্তর ও ফিলিস্তিন জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তি। কিন্তু সেই লক্ষ্যকে সফল করতে কি তারা স্ট্রাটেজি হিসেবে আসলে অন্যান্য ইসলামিক দেশকেও যুদ্ধে জড়িয়ে নিতে চাইছে? নাকি, তারা আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে ফিলিস্তিন জনগণের দীর্ঘ বঞ্চনা ও দুর্ভাগ্যপীড়িত জীবনের দিকে? নাকি, হামাস মনে করে যে, দীর্ঘ গেরিলা ও প্রথাগত যুদ্ধে তারা ইজরায়েলের উপরে সামুহিক বিজয় অর্জনে সক্ষম এবং তার জন্য তারা ইতিমধ্যেই যথেষ্ট প্রস্তুতি গড়ে তুলতে পেরেছে। নাকি, তারা স্রেফ শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে? 

এই আপাত ইজরায়েল-ফিলিস্তিন যুদ্ধে নানান দিকের নানান লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ আছে। যেমন, রাশিয়ার লাভটাও ফেলে দেওয়া যায় না। ইউক্রেন থেকে এর ফলে ফোকাসটা যেমন ঘুরে গেল, ঠিক তেমনই ইউক্রেনে মার্কিন সাহায্য অর্ধেক ছেঁটে ফেলে তা তড়িঘড়ি ভূমধ্যসাগরের পূর্ব পাড়ে পাঠানো হচ্ছে। অথবা, পশ্চিমি শক্তিগুলির সামগ্রিক বলকান ও মধ্যপ্রাচ্য নীতির সাথেও এটা সংযুক্তভাবে দেখা চলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন ধরেই নিচ্ছে ইরান এ যুদ্ধে যে কোনও সময় জড়াবে, তাই মার্কিন আস্ফালন ইরানের দিকে; বা একটা ব্লক হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলি এই যুদ্ধে ১৯৪৮ কিংবা ১৯৬৭ সালের মতোই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সংযুক্ত হয়ে পড়তে পারে। আবার পরিস্থিতি তেমন মোড় ঘোরার জায়গায় পৌঁছলে রাশিয়া নিজেকে বিযুক্ত রাখবে এমনটা নাও ঘটতে পারে।

ফিলিস্তিন জনগণের সাথে ইহুদি জনগোষ্ঠীর বর্তমান সংঘাতের ইতিহাস প্রায় ১০০ বছরের বেশি সময়ের পুরনো, যদিও তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের প্রাচীনত্ব প্রায় তিন হাজার বছরের। এই সংঘাতের মর্মবস্তুতে একদিকে রয়েছে অতিকথা, বিশ্বাস, ধর্ম, আচার, সুপ্রাচীন ঘটনা পরম্পরা ও ইতিহাসের বোঝা। অতীত এসে ঢুকে পড়েছে বর্তমানে এবং তা প্রতি মূহুর্তে প্রভাবিত করছে বর্তমানকে; আর অন্যদিকে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠীগুলির আগ্রাসন, হস্তক্ষেপ, ও ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস-নির্দিষ্ট ফলশ্রুতি। একদিকে রয়েছে কমিউনিজমের বিস্তার রোধে পশ্চিমি সাম্রাজ্যবাদের সাথে ইসলামি দেশগুলির ঐক্য ও একই সাথে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। আবার জিওনিস্ট ইহুদি রাষ্ট্র ইজরায়েলের সাথে একই প্রশ্নে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ঐক্য সুপ্রসিদ্ধ। একদিকে রয়েছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রতি বিদ্বেষ ও তার ফলশ্রুতিতে তাদের উদ্বাস্তু হয়ে যাবার সুদীর্ঘ ইতিহাস, যার সর্বোচ্চ পরিণতি জার্মানিতে ইহুদি হলোকাস্ট; আবার রয়েছে পশ্চিমি সমাজ-অর্থনীতি-বিজ্ঞান-রাজনীতিতে ইহুদি জনগোষ্ঠীর মূল্যবান অবদান। একদিকে রয়েছে ইসলামি ব্রাদারহুড বা প্যান ইসলামিক মুভমেন্ট, আর অন্যদিকে রয়েছে জায়োনিস্ট রাষ্ট্র গঠনের আকাঙ্ক্ষায় ইহুদি পবিত্রভূমি দখলের জন্য জঙ্গি আন্দোলনের ইতিহাস। রয়েছে দু' দুটো আরব-ইজরায়েল যুদ্ধ (১৯৪৮ ও ১৯৬৭)। রয়েছে ১৯৪৮ পরবর্তীতে প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতার যুদ্ধ বনাম ইজরায়েল রাষ্ট্র গঠন ও তার সীমানা বাড়ানো, ইজরায়েল স্টেট আর্মি ও প্যালেস্টাইনের জনগণ ও সশস্ত্র সংগঠন সমূহের মধ্যে নিরন্তর সংঘর্ষের ইতিহাস। রয়েছে জমি ও এথেনিক জনতার অনুপাত ও আনুপাতিক হারের নিয়মিত একপাক্ষিক পরিবর্তন, ফিলিস্তিনি জনতার 'নবকা' হলোকস্টের ইতিহাস। রয়েছে অত্যাচারিত থেকে অত্যাচারী হয়ে ওঠার ইতিহাস, এক সময় উদ্বাস্তু হতে থাকা ইহুদি জনগোষ্ঠীর জায়োনিস্ট আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠীর উদ্বাস্তু হয়ে যাবার ইতিহাস। রয়েছে ১৯৪৮'এর আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর বর্তমান গাজা স্ট্রিপ মিশর ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জর্ডনের দখলে চলে যাবার ইতিহাস; আবার ১৯৬৭ সালের আরব-ইজরায়েল যুদ্ধের পর অঞ্চল দুটিকে ইজরায়েলের দখলে আনা।

১৯৬৪'তে Palestine Liberation Army (PLO) গঠন (হেড কোয়ার্টার আল বিরেহ, ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক), যাদের প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সমগ্র ইজরায়েল ভূ-খণ্ডকে ইসলামিক আরব রাষ্ট্রে রূপান্তর ও ইহুদি জিওনিস্ট রাষ্ট্রের অপসারণ। ১৯৯৩'তে বিরোধ মীমাংসার লক্ষ্যে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে অসলো চুক্তি সম্পাদিত হল, যেখানে PLO প্রধান মেনে নেবেন ইজরায়েল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং প্যালেস্টাইন অঞ্চল হিসেবে ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক ও গাজা স্ট্রিপ দাবি করবেন। ইজরায়েলও সে দাবি মেনে নেবে। বর্তমানে গাজা স্ট্রিপে বাস করেন প্রায় ২০ লক্ষ ও ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে প্রায় ৩০ লক্ষ প্যালেস্টাইন জনগোষ্ঠী। কিন্তু ইতিপূর্বে ১৯৮২'তে তৈরি হয়েছে Hezbollah (১৯৮২) নামক শিয়া জঙ্গী গ্রুপ, যার অর্থ Party of Allah বা Party of God, যাদের সদর দফতর লেবাননের রাজধানী বেইরুটে, কিন্তু প্রভাবিত অঞ্চল ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে।

হামাস ছাড়াও গাজা স্ট্রিপে সক্রিয় আর একটি সুন্নি ইসলামি সংগঠন Islamic Jihad Movement in Palestine বা Palestine Islamic Jihad, সংক্ষেপে PIJ (১৯৮১); দুটোই ভেঙে তৈরি হয়েছে 'The Society of the Muslim Brotherhood' (জন্ম ১৯২৮ সালে অটোমান সাম্রাজ্যের অব্যবহিত পরে ), যাদের লালিত স্বপ্ন ও অঙ্গীকার সব দেশের মুসলমানদের ঐক্যের উপরে দাঁড়িয়ে এক বৃহৎ মুসলিম রাষ্ট্র গঠন, যা উত্তর আফ্রিকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সুদূর ইন্দোনেশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত হবে, সংক্ষেপে যা প্যান-ইসলামিক আন্দোলন। লক্ষণীয়, এটি জাতি রাষ্ট্রকে প্রতিস্থাপন করতে চায় ধর্মরাষ্ট্র দিয়ে। হামাস দাবি করে সমগ্র ইজরায়েল রাষ্ট্রকে তারা ইসলামিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করবে, ফলে ধর্মরাষ্ট্র ও জাতিসত্তাগত আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এ ক্ষেত্রে হাত ধরাধরি করে আছে। প্রসঙ্গত অভিযোগ যে, হামাস ও অন্যান্য ইসলামিক জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে সামরিক, মানবিক, অর্থনৈতিক সহযোগিতা করছে ইরান, সিরিয়া, লেবানন, জর্ডন, মিশর, লিবিয়া, তুরস্কের মতো দেশগুলি। ফলে, সমস্যাটি আদতে একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক পরিসর পেয়েছে। এই সামুহিক জটিলতার মাঝে আর একটি নির্দিষ্ট জটিলতা তৈরি হয়ে রয়েছে 'পবিত্র' জেরুজালেম শহরকে কেন্দ্র করে। সেই প্রশ্নটি আমরা সংক্ষেপে দেখে নেব।

ক্রমশ...

দ্বিতীয় পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_28.html

তৃতীয় পর্ব:

https://ekakmatra2013.blogspot.com/2023/10/blog-post_29.html


1 comment:

  1. অনেক অজানা তথ্য জানা গেল। আমাদের মিডিয়া স্থানীয় রাজনীতির বাইরে থাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে তেমন কোনো আলোচনা করেনা। ছোট জায়গা গাজাকে নিয়ে সংঘর্ষ চললেও তাকে কেন্দ্র করে বড়। শক্তিগুলি যেভাবে দ্বিধাবিভক্ত হচ্ছে তা সমূহ চিন্তার বিষয়।

    ReplyDelete