এক বিস্ফোরণের মুখে?
প্রশান্ত ভট্টাচার্য
'আমার বাড়িতে সিবিআই হানা দিতে পারে বলে শুনেছি। আমি এখন দুর্গাপুজো নিয়ে ব্যস্ত রয়েছি। এই মুহূর্তে সিবিআই যদি আমার বাড়িতে আসে তবে আমার ক' জোড়া জুতো আছে তা গোনা ছাড়া আর কোনও কাজ থাকবে না। আমি সিবিআই'কে জুতো গোনার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। তবে প্রথমে অনুগ্রহ করে, ভারতীয়দের কাছ থেকে আদানি ১৩ হাজার কোটি টাকার যে কয়লা চুরি করেছে, তার এফআইআর হোক।'
শাবাশ মহুয়া! আপনি শুধু বাগ্মী সাংসদই নন, আপনি সাহসী এবং দুর্মুখও। যখন আপনাকে বিঁধবার জন্য ব্যূহ রচনা করেছে মোদী-আদানি কম্বিনেশন, আর আপানার পাশে আপাত-দৃশ্যে আপনার দল নেই, তখনও আপনি সপাটে হাঁকিয়ে খেলছেন আপনার এক্স-হ্যান্ডেলে।
বাংলার সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলগুলো গোটা ব্যাপারটা নিয়ে হিম-নীরবতা পালন করছিল। কিন্তু যখন দেখছে, আপনি সোশ্যাল মিডিয়ায় লড়াই জারি রেখেছেন, তখন দু'-একজন সরব হতে শুরু করেছেন। দেরিতে হলেও তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা ফিরহাদ হাকিম মুখ খুলেছেন। এক টিভি সাক্ষাৎকারে ফিরহাদের মন্তব্য, ‘আমি মনে করি, মহুয়ার কণ্ঠরোধ করার জন্য একটা ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। মহুয়া যেহেতু ভোকাল বেশি তাই এরকম করা হচ্ছে।’ কলকাতার মেয়র সুনির্দিষ্টভাবে দাবি করেছেন, মহুয়া বিজেপি'র বিরুদ্ধে প্রশ্ন তোলেন বলেই তাঁকে বিপাকে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে। অথচ, দলগত ভাবে তৃণমূল কিন্তু অন্য কথা বলছে! দলের রাজ্য সম্পাদক তথা মুখপাত্র কুণাল ঘোষ জানিয়েছিলেন, আপাতত এ ব্যাপারে দলের কিছু বলার নেই। অন্যদিকে, তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ তথা জাতীয় স্তরের মুখপাত্র ডেরেক ও’ব্রায়েন রবিবার সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানান, কৃষ্ণনগরের সাংসদের বিরুদ্ধে সংসদীয় প্যানেল অর্থাৎ এথিক্স কমিটির তদন্ত শেষ হলে তাঁকে নিয়ে দল যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নেবে।
এখানে একটা এড়িয়ে চলা মনোভাব কি স্পষ্ট নয়? তৃণমূল জানে, বিজেপি সাংসদ বিনোদ কুমার সোনকারের নেতৃত্বে লোকসভার এথিক্স কমিটির ১৫ জন সদস্যের মধ্যে (সাতজন বিজেপি, একজন শিবসেনা (শিন্দে), চারজন কংগ্রেস এবং একজন করে শিবসেনা, বিএসপি, জনতা দল (ইউনাইটেড) এবং সিপিআই(এম) সাংসদ) তাদের দলের একজনও নেই। ফলে, মহুয়ার বিরুদ্ধে তোলা বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবেকে পালটা প্রশ্ন ছোড়ার কেউ নেই। সমূহ সম্ভাবনা মহুয়ার বিরুদ্ধে একতরফা সিদ্ধান্ত নেওয়ার, আর তখন ঘাসফুল শিবির হাত গুটিয়ে নেবে, কেননা, সংসদ ও তার কমিটিগুলো বাইবেল-গীতা-কোরানের মতো পবিত্র ও অনড়। কৃষ্ণনগরের সাংসদ প্রশ্নে কেন তৃণমূল দলগতভাবে এমন পদক্ষেপ করছে তা নিয়ে পরে আলোচনায় আসা যাবে, তার আগে মহুয়া মৈত্রর 'অপরাধ' বা 'ভুল'টা কোথায় আলোচনা করে নেওয়া যাক।
ঝড়ের গতিতে ইংরেজি বলা, স্যাম্পেন মুখে ছবি পোস্ট করা, সংসদে তথ্যসমৃদ্ধ ও তীক্ষ্ণ বক্তব্য রাখা বাঙালি ললনা মহুয়া মৈত্র আদানিকে এক্সপোজ করার যুদ্ধে নেমেছেন। আদানির স্ক্যান্ডাল এতটাই গভীর ও ভয়ঙ্কর যে সেগুলি এক্সপোজ করে দিলেই বিজেপি ও আরএসএস ধরাশায়ী হয়ে যাবে। জাহাজডুবি হয়ে যাবে। তাই গেরুয়া শিবির পাগল হয়ে গিয়েছে। সংসদে যিনি আদানির বিরুদ্ধে সরব হবেন তাঁকেই 'কোতল' করতে হবে। প্রথম উদাহরণ রাহুল গান্ধী। এরপর সঞ্জয় সিং- তাঁকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হয়েছে। এখন টার্গেট মহুয়া মৈত্র। কিন্তু মহুয়াকে দমানো যাচ্ছে না। ২১ অক্টোবর শনিবার সরাসরি এক্স-হ্যান্ডেলে মহুয়া লিখেছেন, 'দুঃখিত মিস্টার আদানি। আমি 'শান্তি'র বিনিময়ে ছ' মাসের জন্য মুখ বন্ধ রাখার আপনার প্রস্তাবিত ডিল গ্রহণ করছি না। আমি আপনার দ্বিতীয় প্রস্তাবটিও মানছি না, যেখানে আপনি আপনাকে আক্রমণ করাটা মেনে নিতে চান, কিন্তু প্রধানমন্ত্রীকে নয়।' শুধু এটুকুই নয়, মহুয়া আরও লিখেছেন, 'Adani used to CASH TO NOT QUESTION. Now he is forced to create a fake CASH FOR QUESTIONS.'।
দল পাশে না থাকলেও মহুয়া প্রথম থেকেই আক্রমণাত্মক। এমনকী, দর্শন হিরানন্দানির হলফনামার বিষয়টি প্রকাশ্যে আসার পরে মহুয়া পালটা পিএমও-র দিকে আঙুল তুলেছেন। মহুয়ার বক্তব্য, হিরানন্দানির ‘হলফনামা’ সাদা কাগজে লেখা হয়েছে। তাতে কোনও ‘অফিসিয়াল লেটারহেড’ বা ‘নোটারি’ করা নেই। কৃষ্ণনগরের সাংসদের প্রশ্ন, মাথায় বন্দুক ঠেকানো না হলে কি হিরানন্দানির মতো একজন সম্মাননীয় এবং শিক্ষিত শিল্পপতি কখনও এরকম সাদা কাগজে সই করবেন? এই অভিযোগ সপাটে গিলে হিরানন্দানি একদিন পরেই দুবাই থেকে (এবারে নোটারি করে) আবারও হলফনামা দাখিল করেছেন। হিরানন্দানির ‘হলফনামা’য় কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী এবং শশী তারুরের নামও উল্লিখিত হয়েছে। প্রেস বিবৃতিতে মহুয়ার মন্তব্য, ‘সব কা নাম ঘুসা দো, অ্যায়সা মওকা ফির নেহি আয়েগা!’ অর্থাৎ, সকলের নাম ঢুকিয়ে দাও, এরকম সুযোগ আর আসবে না।
'টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন' বিতর্কে সাংসদ আরও দাবি করেছেন, হিরানন্দানি ও তাঁর বাবাকে ২০ মিনিট সময় দেওয়া হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে তৈরি খসড়া ‘হলফনামা’য় সই করার জন্য। সই না করলে হুমকি দেওয়া হয়েছে তাঁদের সব ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার। মহুয়ার বক্তব্য, 'দর্শন হিরানন্দানির বাবার আবাসন শিল্প রয়েছে। তাঁকে সরকারি লাইসেন্সের ওপর নির্ভর করতেই হয়। হিরানন্দানিও যে ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, সেখানেও দরকার হয় সরকারি লাইসেন্স। উত্তরপ্রদেশেই ওঁর ৩০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। ওঁদের বলা হয়েছে, সব ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়া হবে। সিবিআই অভিযান চালাবে। ইডি নামবে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে ওঁদের ঋণ পাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।’ মহুয়ার দাবি, এই চাপে পড়েই তৈরি করা ‘হলফনামা’য় সই করতে বাধ্য হয়েছেন হিরানন্দানি।
বিতর্কিত সাংসদের এসব দাবিও প্রমাণ সাপেক্ষ। কিন্তু যেটা লক্ষ করার, মহুয়া আক্রমণাত্মক হলেও বিজেপি-বিরোধী দলগুলো মহুয়া বনাম আদানি-মোদী দ্বৈরথে আশ্চর্যজনক ভাবে এখনও নীরব। যদিও কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরী ও মুখপাত্র সুপ্রিয়া শ্রীনেট মহুয়ার প্রতি প্রচ্ছন্ন সমর্থন ব্যক্ত করেছেন; সিপিআই(এমএল) লিবারেশন'এর নেতা দীপঙ্কর ভট্টাচার্য'ও বিবৃতি দিয়ে মহুয়া মৈত্র'র পাশে দাঁড়িয়েছেন। তৃণমূলের মতো ইন্ডিয়া জোটের অন্যরাও হয়তো মনে করছে, মহুয়া নিজে যথেষ্ট সাবলীল এই বিষয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। এই ভাবনাটা বিপদজনক। গণতন্ত্রের মোড়কে আসা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কাউকে একা ছেড়ে দেওয়া শিশুসুলভ রাজনৈতিক প্র্যাকটিসের লক্ষণ। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের স্বার্থে মোদী-আদানি সমীকরণকে যেখানে অনেক বেশি এক্সপোজ করা জরুরি, তখন তা মহুয়ার ব্যক্তিগত লড়াই বলে ছেড়ে দেওয়াটা বড় বিপদ ডেকে আনছে। বিজেপি কিন্তু বিরোধীদের মতো ফেন্সিং-এ বসে পা দোলাচ্ছে না, তারা রীতিমতো আক্রমণ শানাচ্ছে। বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র শেহজাদ পুনওয়াল্লা দাবি করেছেন, 'তৃণমূল মুখপাত্র জানিয়েছেন, 'আমরা মন্তব্য করব না। সাংসদ নিজে আত্মরক্ষা করবেন’। এর অর্থ, এক, তৃণমূল মেনে নিয়েছে মহুয়া মৈত্র গুরুতর অন্যায় করেছেন। সুবিধা নিয়ে বিদেশের মাটি থেকে তাঁর সংসদের লগ-ইন আইডি ব্যবহার করতে দিয়েছেন। দুই, তৃণমূল এটা মেনে নিলে তাঁকে কেন বহিষ্কার করছে না?'
মূল অভিযোগকারী বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে মহুয়ার বিরুদ্ধে লোকপাল তদন্তের দাবিও তুলেছেন। বিজেপি এত তৎপরতা দেখাচ্ছে কারণ তারা জানে, লোকসভার এথিক্স কমিটি বহিষ্কারের সুপারিশ করে না এবং তা কখনও করেনি। এ প্রসঙ্গে লোকসভার প্রাক্তন মহাসচিব পিডিটি আচারির মন্তব্য, এটি সর্বোচ্চ স্তরে সাধারণত সাসপেনশনের সুপারিশ করে, এর বেশি কিছু নয়। কিন্তু বিজেপি চায়, মহুয়া যেন আর লোকসভায় ঢুকতে না পারে, না পারে মোদী-আদানিকে জড়িয়ে যুক্তিজাল বিস্তার করতে। মোদী-শাহরা জানেন, আহত বাঘ মহুয়া যদি এরপরে লোকসভার আগামী অধিবেশনে ঢোকার সুযোগ পান, তবে ছিঁড়ে ফেলবেন আরএসএস-বিজেপির সেরা কম্বিনেশন মোদী-আদানিকে। তাই হিরানন্দানিকে দিয়ে 'হলফনামা' পেশ এবং তা পাবলিক করে দেওয়া। এর ফলে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এথিক্স কমিটিকে ছাপিয়ে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে সিবিআই-ইডি। আর এটা সকলেই জানেন, ইডি কোনও কারণ না দর্শিয়েই স্রেফ সন্দেহের বশে ও 'তদন্তের প্রয়োজনে' যে কাউকে মাসের পর মাস জেলে পুরে রাখতে পারে।
মোদি সরকার সেই পথেই চলেছে আর তৃণমূল বলছে, এটা মহুয়ার ব্যাপার তিনিই সামলে নেবেন। আমার মতো পাঠকের মনেও প্রশ্ন জাগছে, তৃণমূল কেন এই ইস্যুতে অলআউট লড়াইয়ে নামছে না? কেন ইন্ডিয়া জোটকে সঙ্গী করছে না, যেমন করেছিল জোটের সমন্বয় কমিটির বৈঠকের দিন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ইডির তলব নিয়ে? উত্তর কি একটাই যে, আদানি বাংলায় লগ্নি করেছে এবং করবে, অতএব ভাঁড়-মে-যাক একটা মহুয়া মৈত্র। তাছাড়া, মহুয়াকে বাগে আনা যাচ্ছে না, ফলে অ্যাট দ্য কস্ট অফ মহুয়া যদি টিকে থাকা যায় তবে মন্দ কী!
আমার কথা হচ্ছে, মনে রাখবেন, ঝড়ে ভিত নড়লে চাল কখনও স্থির থাকে না। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের নীরবতা ফ্যাসিস্ত শক্তিকেই পুষ্ট করে।
ভাল লেখা।
ReplyDeleteসঠিক পর্যালোচনা
ReplyDeleteএটাই রাজনৈতিক অসততা। যে দোষে সকলে দুষ্ট। কোন দল এই ইস্যুতে পথে নামে নি।
ReplyDeleteমহুয়া মৈত্র সঠিক পথে আছেন বলেই মনে হয়।
ReplyDeleteনরেন্দ্র দামোদারদাস নিজের বিষাদ গাঁথা গাইছেন।
প্রতিশোধ কিসের ?
একজন প্রধানমন্ত্রী ধর্ম আর রাজনীতির নাম করে দেশের ধ্বংস করবেন, আর সবাইকে সেটা দেখে হাততালি দিতে হবে নাকি ?